তৃনভূমি পর্ব -০২

#তৃনভূমি
#ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -২

–” ভাবি আপনি যেমনটা ভাবছেন তেমন কিছু না। সোহাগ আমার ভাইয়ের মতো, আমাকে ভবি ডাকে। এছাড়া আমাদের মাঝে আর কোনো সম্পর্ক নেই।

সুমনা ভাবির কথায় আমি মুচকি হাসলাম। তারপর বললাম, ” জ্বি ভাবি আমি জানি সোহাগের রুচি এতোটাও খারাপ হয়নি যে কারো বিবাহিত বউয়ের সাথে কোনো প্রকার সম্পর্ক করবে। অনেকদিন ধরে দেখছি ও-কে। সোহাগের আমাকে ভালো না লাগলে আমি অবিবাহিত কোনো মেয়ের সাথে আবারও সোহাগের বিয়ে দিবো। আপনি চিন্তা করবেন না এসব নিয়ে আমি কিছুই মনে করিনি।”

সুমনা ভাবীর মুখটা মলিন হয়ে গেলো। সোহাগ নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে হাসি মুখে থাকলেও আমার ভেতরটা কষ্টে ছেয়ে গেছে। তবুও নিজেকে সামলে দাঁড়িয়ে আছি। একান্ত আপন লোক ছাড়া কাউকে নিজের দূর্বলতা দেখাতে নেই। তাহলে আরো বেশি করে আঘাত করে। কথায় বলে না নরম মাটিতে পা দিয়ে গভীরতা পরীক্ষা করে, অনেকটা তেমনই। সোহাগের সাথে সুমনা কিছু আছে কিনা সঠিক জানি না। তবে থাকলে ওঁরা বুঝতে পারবে আমি অতোটাও দূর্বল নই। সুমনা কোনো কথা না বলে চুপচাপ ছাঁদ থেকে নেমে চলে গেলো। আমি চোখ বন্ধ করে কয়েকটা সূরা পড়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করতে লাগলাম। মিনিট দুয়েক চোখ বন্ধ রাখার পর চোখ খুললাম। তারপর কাপড়গুলো নিয়ে ছাঁদ থেকে চলে আসতে যাবো এমন সময় বাম হাতে কারো স্পর্শ অনুভব হলো৷ চিরচেনা সে-ই স্পর্শ। সোহাগ আমার হাতটা ধরে রেখেছে। আমি শান্ত দৃষ্টিতে ও-র দিকে তাকিয়ে রইলাম।

–” অন্য কাউকে আমার ভাগ দিতে পারার মতো উদার হলে কবে থেকে?”

–” যবে থেকে আপনি পরনারীর কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসতে পেরেছেন তবে থেকে।”

–‘ কখনো কখনো চোখের দেখাও ভুল হয়।’

–” কখনো কখনো বিশ্বাসগুলোই চরমভাবে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে।”

সোহাগ আমার হাত ছেড়ে দিলো। আমি সময় নষ্ট না করে রুমে চলে এলাম। অনেক কন্ট্রোল করেছি নিজেকে, আর পারছি না। চোখের কোণে জমে ওঠা পানিকণাগুলোকে বেরিয়ে আসতে দেওয়া উচিত। বাইরে নিজেকে যতই শান্ত দেখাতেই না কেন কোনো মেয়েই নিজের স্বামীর ভাগ কাউকে দিতে পারে না। তাছাড়া সোহাগ কে-ই আমি ভালোবাসি। আমার জীবনে সোহাগ ব্যতিত কোনো দ্বিতীয় পুরুষের এমন অধিকার নেই। আমি যতোদূর জানতাম সোহাগের জীবনেও আমার গুরুত্ব এমন। কিন্তু হঠাৎ কেন সব ফিকে হতে শুরু করলো বুঝতে পারলাম না।
কাপড়গুলো খাটের উপর রেখে অজু করে নামাজ পড়ে নিলাম। আল্লাহ’র কাছে মনের সকল কথা খুলে বলতে পারার মতো শান্তি হয়তো দ্বিতীয় কিছুতেই নেই। আল্লাহ কাছে সকল দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির আবেদন করলাম।

হঠাৎ পাশে নজর ঘোরাতে দেখলাম একজন সুদর্শন যুবক পাঞ্জাবি পরে নামাজে দাঁড়িয়ে আছে। এই পুরুষ আমার চোখে শ্রেষ্ঠ সুন্দর, কেন জানি না। হয়তো অনেক ভালোবাসি বলে নয়তো অন্যকিছু! তবে একজন জীবনসঙ্গীর মাঝে সীমাবদ্ধ থাকার আত্মতৃপ্তি উপলব্ধি করার মতো অনুভূতি সকলের থাকে না। আমাকে হয়তো আল্লাহ সে অনুভূতি দিয়েছেন নয়তো কেন এমন হয় জানি না। নামাজ শেষ করে সোহাগ আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। এটা কোনো নতুন ব্যাপার না, তবে আমি কেন সবকিছু অন্যভাবে দেখছি, শুধু কি সুমনাই!

আমার চিন্তার মাঝে কপালে কারো ঠোঁটের কোমল স্পর্শ অনুভব করলাম। নিজের অজান্তে চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। এই মানুষটাকে আমি হারাতে চাই না, বদলেও যেতে দিতে চাই না। শুধু নিজের করে রাখতে চাই।

–” আমি অফিস থেকে ফিরে ছাঁদে কাপড় আনতে গেছিলাম। সুমনা ভাবী আমাকে উনার বরের সাথে কথা বলতে অনুরোধ করছিলো তাই বসেছিলাম, কখন এতো কাছাকাছি চলে এসেছি আমি জানি না। বিশ্বাস করো। আমি আর এমনটা করবো না। ”

–” আচ্ছা। কিছু খাবে তুমি এখন?”

–” না একটু বাইরে যেতে হবে, অফিসের কিছু জিনিস কেনার জন্য। তোমার ক্ষুধা লেগেছে নাকি?”

আমি না সূচক মাথা নাড়লাম। সোহাগ মাথা থেকে চুপিটা খুলে রেখে পাঞ্জাবি পরেই বেরিয়ে গেলো। আমি দুইটা মানুষের হিসাব মেলাতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। স্বামী সংসার ছেড়ে আলাদা থাকার কোনো মানসিকতা আমার নেই তবে আমি মেরুদণ্ডহীনও নই। নিজেকে কষ্ট অন্যকে দেখিয়ে সহানুভূতি পাওয়া বা কাউকে আনন্দে দেওয়ার সুযোগ আমি কাউকে দিবো না। রান্নাঘরে আমার মোবাইল বেজে চলেছে, এখন কে কল দিতে পারে, তড়িঘড়ি করে রান্নাঘরে গিয়ে মোবাইলটা নিয়ে এলাম। শাশুড়ি মা’য়ের কল। উনার সাথে আমার রোজই কথা হয়। কিছুসময় কথা বলে সারাদিনের না বলা কথাগুলো শেষ করি। কি বলতে কি বলবো ঠাঁই খুঁজে পাই না কখনো কখনো। পৃথিবীর যে কোনো সম্পর্কে সময় দেওয়া, ভালোবাসা, বিশ্বাস রাখা জরুরি। নয়তো দিনশেষে সব ঠুনকো হয়ে যায়।

সোহাগ বেশ কয়েকবার কল দিয়েছে আমাকে, কথা বলছিলাম তাই হয়তো খেয়াল করিনি। শেষে একটা এসএমএস দিয়েছে দেখলাম,

” মনির কাকার কাছে তোমার জন্য বেগুনি আর আলুরচপ রেখে গেছি, গাড়িতে ছিলাম বলে উপরে যেতে পারিনি। তুমি গিয়ে নিয়ে এসো। ”

এই ছেলেটা পারেও বটে, মন থেকে সব বাজে চিন্তা সরিয়ে ফেলতে চেষ্টা করলাম। সন্দেহ করে মিজের সংসার নষ্ট করার কোনো মানে নেই, তবে নজরে রাখতে হবে। মাথায় ওড়না জড়িয়ে মনির কাকার কাছে গেলাম, মনির কাকা এই বিল্ডিংয়ের দারোয়ানের চাকরি করে। বেশ বয়স্ক। আমাদের সকলকেই খুব ভালোবাসে।

–” আসসালামু আলাইকুম কাকা। ভালো আছেন?”

–” ওয়ালাইকুম আসসালাম, এইতো আল্লাহ ভালোই রেখেছে, তুমি কেমন আছো মা?”

–” জ্বি চাচা আলহামদুলিল্লাহ। ”

মনির চাচা একটা কাগজের ঠোঙ্গা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ” সোহাগ রেখে গেছে তোমার জন্য।আমার জন্যও নিয়ে এসেছিলো। কতদিন বলেছি এসব না করতে, কে শোনে কার কথা! ”

আমি মুচকি হেসে উনার কাছ থেকে প্যাকেটটা নিয়ে চলে আসতে গেলে উনি আবার ডাক দিলেন।

–” মোনালিসা মা শোনো। ”

–” জ্বি চাচা বলেন।”

–” কথাগুলো বলা ঠিক হবে কিনা জানি না। তবে তোমাকে মেয়ের মতো ভালোবাসি বলে বলছি। ”

–‘ আরে চাচা আপনি বলুন। ”

–” আজ সোহাগ বাবা অফিস থেকে ফিরলে সুমনা ও-কে বলেছে ছাঁদে কাপড় রয়েছে, তুলে নিয়ে আসতে। তারপর পিছন পিছন চলে গেছে ছাঁদে। মেয়েটার ভাব আমার খুব একটা ভালো লাগে না। তাছাড়া ও-র স্বামীও বিদেশে থাকে। এসব মহিলাদের শয়তান সবচেয়ে বেশি ধোঁকা দেয়। তুমি একটু খেয়াল রেখো। আমি সোহাগকেও বলেছি। এই ছোট ছোট কারণ থেকেই সংসারে ঝামেলা হয়।”

আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম। তারপর ঘরে চলে এলাম। মনির কাকা যথেষ্ট বুদ্ধিমান একজন মানুষ। তাছাড়া উনি কখনো মিথ্যা বলে না। তবে কি সুমনা ভাবী সোহাগের সাথে সম্পর্কে জড়াতে চাচ্ছে?

সোহাগের ফিরতে ফিরতে রাত দশটা বেজে গেলো। দুইহাত ভরে কিসব জিনিসপত্র কিনে নিয়ে এসেছে, বাড়িতে ফিরে ফ্রেশ কিছুসময় বিশ্রাম নিলো। তারপর দুইজনে মিলে রাতের খাবার খেতে বসলাম।

–” সোহাগ আমি আমার ব্যবহারের জন্য দুঃখিত। সকালে ওভাবে বলা আমার উচিত হয়নি। ”

–” আরে সমস্যা নেই।”

–” সত্যি তো কাউকে রান্না করে খাওয়ালে বা দুই-চার মিনিট গল্প করলে দোষের কিছু হয় না। তাছাড়া প্রতিবেশীও তো বটে। ”

সোহাগ নিজের খাওয়ার দিকে মনোযোগ দিয়ে শুধু মাথা নাড়লো, তারপর আস্তে হুম বলে চুপ হয়ে রইলো।

তিনদিন পর,

আজ বাড়িতে গরুর গোশত রান্না হয়েছে, আমাদের তিন তলায় একটা ব্যাচেলর ছেলে থাকে৷ মালিকের আত্মীয় বলেই হয়তো থাকতে দিয়েছে, ও-র জন্য একটা বাটিতে কয়েক টুকরো গোশত নিয়ে ঘর থেকে বের হবো এমন সময় সোহাগ বললো, কোথায় যাচ্ছো বাটি নিয়ে? খেতে আসো, লোভ সামলাতে পারছি না। ”

–” ওই বাদশাকে দিতে যাবো, শুনেছি ছেলেটা একা একা রান্না করে খেতে কষ্ট হয়। তুমি একটু অপেক্ষা করো আমি দু’মিনিটে আসছি। ”

সোহাগের হাসিখুশি মুখে কালো মেঘ এসে ভওড় জমাতে শুরু করলো। আমি মুচকি হেসে ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম। এখন বুঝুক কেমন লাগে!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here