তৃনভূমি পর্ব -০৩

#তৃনভূমি
#ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৩

সোহাগের হাসিখুশি মুখে কালো মেঘ এসে ভিড় জমাতে শুরু করলো। আমি মুচকি হেসে ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম। এখন বুঝুক কেমন লাগে!
সোহাগের সাথে জেদ করে বাটি নিয়ে চলে তো এলাম কিন্তু একা একটা ছেলের বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না। হয়তো ছেলেটা আমাকে কিছু বলবে না তবে আমার প্রতি তার কোনো এক অদৃশ্য মায়া জন্ম নিবে। যা আমি চাই না। সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে যাবো এমন সময় দেখলাম মনির চাচা খেতে বসছে, তাহলে উনাকেই দিয়ে আসি বরং!

–” চাচা খেতে বসলেন নাকি?”

হঠাৎ কোনো মানুষের গলার আওয়াজে একটু নড়েচড়ে বসলেন। তারপর টিফিনবাক্সের উপর ঢাকনা দিতে দিতে বললেন, ” কিছু বলবে মা?”

চাচা ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখলেও আমি স্পষ্ট দেখিছি উনি শুধু ভাত আর পেঁয়াজ মরিচ নিয়ে খেতে বসেছিলেন। বর্তমানে জিনিসপত্রের যে দাম তাতে এই নিম্ন আয়ের মানুষগুলোর না খেয়ে মরার মত অবস্থা। আমি উনার দিকে বাটিটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, ” দুপুরে রান্না করছি, আপনি খেয়ে নিন। ”

মনির চাচা ছলছল চোখে আমার দিকে তাকালো, আমি শুধু মুচকি হাসলাম। এই মানুষগুলো সামান্য জিনিসেও কত খুশি হয়। অথচ আমাদের সবকিছু থাকার পরেও আমরা খুশি থাকতে পারি না।

–” চাচা সোহাগকে বলেছি যে বাদশাকে খাবার দিতে যাচ্ছি। যাতে ও বুঝতে পারে সুমনার সাথে অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে কথা বললে আমার কেমন লাগে, আপনি ও-কে কিছু বলবেন না।

–” মাশাল্লাহ! কি বুদ্ধি তোমার। হা হা।”

–” হি হি। আমি গেলাম সোহাগ বসে আছে।”

মনির চাচা এক টুকরো গোশত নিয়ে খাওয়া শুরু করলো। আমি খুব ভালো করে জানি উনি সব গোশত খাবেন না। বড়জোর দুই টুকরো গোশত খাবে বাকিটা ছেলে মেয়ের জন্য নিয়ে যাবে। বাবারা মনে হয় এমনই হয়। ঘরে গিয়ে দেখলাম সোহাগ মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। আমি গিয়ে ওর সামনের চেয়ারে বসে পড়লাম।

–” দোতলা থেকে তিনতলা যেতে ২০ মিনিট সময় লাগে নাকি?’

জ্বলছে জ্বলছে আগুন। হি হি হি!

–” একটু দাঁড়িয়ে গল্প করছিলাম আর কি! প্লেটটা এদিকে দাও তুমি।”

আমি হেসে হেসে কাজ করছি আর সোহাগ গম্ভীর হয়ে আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছে। আমি নিজের মতো করে খাচ্ছি। ও-র দিকে তেমন কোনো খেয়াল করছি না। ইচ্ছে করেই এমন করছি।

–” জানো বাদশা..

–” বাদশাকে নিয়ে জানার ইচ্ছে আমার নেই, খেতে দাও আমাকে। ”

সোহাগ সেদিন তেমন কিছুই খেতে পারলো না। ও-র রিয়াকশন একটু বেশিই হচ্ছে কারণ এই বাদশা একদিন সোহাগকে ভুল করে বলে ফেলেছিলো সে আমাকে পছন্দ করে, আমি সোহাগের বোন হই কিনা। সেদিন সোহাগের রিয়াকশন ছিলো দেখার মতো। দাঁত কিড়মিড় করে বাদশাকে বলেছিলো,” ভাই-বোন কেন হতে যাবো আমরা, দেখে কি বোন মনে হয় নাকি?” আরো কত কি! ভাবলে এখনও হাসি পায়।

দুপরের খাওয়া শেষ করে সোহাগ বিছানায় শুয়ে মোবাইলে কিসব দেখছে, আমি সব কাজ গুছিয়ে রেখে রুমে গেলাম।

–” মোনালিসা দেখে যাও। ”

মোবাইলে দৃষ্টি আটকে রেখে কথাগুলো বললো আমাকে। আমি কোনো জবাব না দিয়ে ও-র পাশে শুয়ে পড়লাম। শরীরটা হঠাৎ একটু খারাপ লাগছে, মাথা ব্যাথা করছে অনেক, সেই সাথে ঠান্ডাও লাগছে। আমি চুপচাপ শুয়ে আছি। সোহাগ আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তারপর আমার কপালে হাত দিয়ে দেখলো জ্বর আসছে কিনা!

–” তোমার কি ঠান্ডা লাগছে? ”

আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিলাম। সোহাগ বিছানার পাশে ভাঁজ করে রাখা নকশীকাঁথাটা আমার গায়ে জড়িয়ে দিলো। উঠে গিয়ে ফ্যানের জোরটা কমিয়ে লাইট অফ করে আসলো। এরপর আমার কপালে আস্তে করে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। এই মানুষ বদলে গেলে হয়তো আমি নিঃশেষ হয়ে যাবো। আমাদের সম্পর্কটা হয়তো একটু নাটকীয়, সিনেমার মতো। তবে বাস্তব জীবনেও এমন করতে পারলে সম্পর্ক খারাপ হবে না। বরং ভালোই থাকবে। প্রতিটা স্বামী স্ত্রী চায় তার জীবন সঙ্গী তার খেয়াল রাখুক। যারা বলে এমন সম্পর্ক বাস্তবে হয় না তারাও দিনশেষে এমন সম্পর্কের জন্য লোভী হয়ে থাকে। তবে অতিরিক্ত আশা না করাই ভালো।

চোখ বন্ধ করার কিছুসময় পর স্বপ্নের জগতে চলে গেলাম। সোহাগ ও-র ল্যাপটকে বসে কাজ করছে। এদিকে আমার শরীরের তাপমাত্রা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। সারা শরীরে ব্যাথা অনুভব করছি। সোহাগ মাঝে মাঝে আমার কপালে হাত দিয়ে জ্বরের অবস্থা পরীক্ষা করছে। দরজায় কারো উপস্থিতি উপলব্ধি করে সোহাগ উঠে গেলো।

–” আরে সোহাগ ভাই শোনো। আমরা সবাই মিলে নদীর পাড়ে যাচ্ছি। তুমিও চলো। মোনালিসাকেও নিতে পারো। ”

আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম এটা সুমনা ভাবী। এর গলা কথা বলার ধরণ সবই উনার মতো। ইচ্ছে করছে উঠে গিয়ে যা মুখে আসে বলে আসি। কিন্তু শরীরের অবস্থা ভালো না। চাইলেও শরীর বিছানা থেকে নড়তে চাইছে না।

–” না ভাবি আমি যাবো না। মোনালিসা অসুস্থ। সামান্য জ্বর এসেছে। আপনারা যান। ”

–” আরে সামান্য জ্বরে কি হবে! মেয়েদের হলো ভাল্লুকের জ্বর। আসে যায়। তবে যদি ভাবি আসতে না পারে আপনি একাই আসুন। আমার একা যেতে একদম ইচ্ছে করছে না। ”

এই মহিলা কি ধাতু দিয়ে তৈরী আল্লাহ জানে। মেয়ে হয়ে মেয়েদের ছোট করতে দ্বিধা বোধ করছে না। মেয়ে বলে কি মানুষ না, নাকি মেয়েদের শরীর পাথর বা লোহা দিয়ে তৈরি? আমার রুচিতে বাঁধলে দুই-চারটা গালাগালি দিতাম। কিন্তু মন্দ কথা বলা উচিত না।

ওপাশ থেকে সোহাগের রাগি গলা শোনা গেলো। হয়তো রেগে গেছে। কর্কশ কন্ঠে সুমনা ভাবীকে উদ্দেশ্য করে বলছে,

–” আপনার বোধহয় মাঝে মাঝে ভাল্লুকের জ্বর হয়। কিন্তু আমার স্ত্রী মানুষ। আপনি দয়া করে আসতে পারেন, আপনাকে দেওয়ার মতো সময় আমার হাতে নেই। আমার মোনালিসার কাছে থাকাটা বেশি প্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে। ”

খুশিতে আমার মন নেচে নেচে উঠেছে। কি ভালো আমার বরটা। উহু আহা, লা লা লা লা…
এতো সময় হয়তো সুমনার হাস্যউজ্জল মুখে মেঘের ভীড় জমেছে। বেহায়া মেয়ে একটা। আমার বরকে নিয়ে নদীর পাড়ে যাওয়ার ইচ্ছে উনার। যত্তসব।

–” আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো।”

দেখো কি সাহস আবার বলছে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো। লে কি বেহায়া মেয়ে রে বাবা। উপাশ থেকে সোহাগের আওয়াজ পাওয়া গেলো না। বরং দরজা দেওয়ার শব্দ কানে ভেসে আসলো। মিনিট খানেকের ভিতর সোহাগ নিজের জায়গাতে বসে আবারও কাজ শুরু করলো। খাটের উপর বসে বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে কিসব কাজ করছে। আমি উঠে গিয়ে ও-কে জড়িয়ে ধরলাম। সোহাগ মুচকি হেসে আমার কপলে চুমু এঁকে দিলো। আমি অন্যগাল বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, ” একগালে চুমু দিলে আমার বিয়ে হবে না হুহ। ”

সোহাগ হেসে অন্যগালো তার ঠোঁটের স্পর্শ লাগিয়ে দিলো। আমি চোখ বন্ধ করে ও-র কপালে চুমু দিয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। সোহাস হাসছে আর বলছে, ” এ লজ্জা কবে যাবে তোমার?”

আমি কিছু বললাম না। সত্যি বিয়ে হয়েছে কত্তদিন হলো কিন্তু আমার এখনও লজ্জা কমে না। বেচারা আমাকে নিয়ে এখনো সমস্যার ভিতর আছে। রাস্তায় বা লোকজন থাকলে আমি ও-র হাতটাও ধরতে চাই না। মিনিট দশেক কাজ করার পর সোহাগ পরের শার্ট খুলে একটা শার্ট পরে নিলো। তারপর প্যান্ট পরে ম্যানিব্যাগ পকেটে ঢুকিয়ে কোথাও যাওয়ার জন্য বের হলো। যাওয়ার আগে আমার কপালে হাত দিয়ে জ্বর পরীক্ষা করতে ভুললো না। আচ্ছা সোহাগ কি ও-ই সুমনার সাথে দেখা করতে যাচ্ছে? আমাকে শোনানোর জন্য তখন ওসব বললো?

মিনিট পাঁচেক শুয়ে থাকার পর আর মন মানতে চাইলো না। কোনো রকমভাবে উঠে সুমনার বাসার সামনে চলে গেলাম। দরজায় তালা লাগালো। সারা বাড়ির কোথাও সুমনার কোনো খোঁজ পেলাম না। আমার শরীরের তাপমাত্রা এতো সময় ১০৩ ছাড়িয়ে গেছে। আর এক পা হাঁটার শক্তি পাচ্ছি না। কি শুরু হলো এসব!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here