অবেলায় তুমি পর্ব -১৯ও শেষ

#অবেলায়_তুমি (পর্ব-১৯)
#লেখক_আকাশ_মাহমুদ

তনু আকাশকে পছন্দ করে নিয়ে দেওয়া শার্টের কলারে সে নিজেই খপ করে চে’পে ধরে। এরপর আকাশের শার্ট ধরে তাঁকে সবার সামনে টেনে এনে লাগাতার কোষে কয়েকটা থা’প্পড় মা’রে। আকাশ তনুর আচরণে পুরো আশ্চর্য হয়ে যায়। হুট করেই পরিস্থিতির এমন পরিবর্তন দেখে আকাশ হতভম্ব হয়ে তনুর দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশের সাথে সাথে অফিসের সকল কর্মচারীও অবাক। কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। বিশেষ করে আকাশ। তনু আকাশকে সকলের সামনে টেনে এনে লাগাতার কোষে কয়েকটা থা’প্পড় মা’রার পর সকলকে বলে,

–‘আমি জানি আপনাদের সকলের মনে একই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, যে আমি আকাশকে কেন মা’রলাম। কিন্তু সত্যি জানলে আপনারা নিজেরাও আশ্চর্য হবেন এই শয়তানটা কি করেছে। আপনারা একটু অপেক্ষা করুন বলছি। আগে নিজের বাকি রেষ টুকু মিটিয়ে নেই।’

তনু আকাশকে আরো কয়েকটা থা’প্পড় মা’রে।
তনুর আচরণে রীতিমতো সবার আশ্চর্যের সীমা ইতিমধ্যে ছাড়িয়ে গেছে। প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকিয়ে আছে সবাই তনুর দিকে। আর তনু পরবর্তীতে আকাশকে আবারো থা’প্পড় মে’রে তাঁকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়। আকাশ গালে হাত চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। লজ্জায় মাথা কা’টা যাবে মতন অবস্থা। তনু রেষ মিটিয়ে নিয়ে সবাইকে বলে,

–‘এবার সকলেই শুনুন কারণটা বলছি। এই ব’দ’মাইশটা আমার অফিসে এসেছে খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে। শুরুতে আমি এই বেয়াদবের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে পারিনি। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারি এই ছেলের মতলব খারাপ। আমি একজনের সাথে সিরিয়াস একটা রিলেশনে রেয়েছি। কিন্তু তার পরেও এই ব’দমাইশ ছেলে আমাকে একটা ফাঁদে ফেলে বিয়ে করেছে। অবশ্য সেই বিয়ের কোনো ভ্যালু নেই। কারণ কোর্টের একটা কাগজে সে আমার থেকে চালাকি করে সিগনেচার নিয়েছে। আর তাছাড়া সেই কাগজটা আমি কৌশলে জব্দ করে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলেছি। কিন্তু এই ছেলের উদ্দেশ্য ছিল সে আমাকে কৌশল করে বিয়ে করবে, যাতে করে সে আমার সমস্ত সম্পত্তি ভোগ করতে পারে। কিন্তু পরবর্তীতে আমি তার উদ্দেশ্য জানতে পেরে চালাকি করে আমার সিগনেচার করা কাগজটা নিজের আয়ত্তে করে নিয়ে নষ্ট করে ফেলেছি। যাতে সে আমার কোনো ক্ষতি করতে না পারে। আর আজকের আয়োজনের আসল উদ্দেশ্য হলো এই ছেলের ইতিহাস সম্পর্কে সবাইকে জানানো। এছাড়া আরেকটা উদ্দেশ্য আছে। সেটা হলো আগামীকাল আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। যেটার অগ্রীম দাওয়াত আপাদের খাইয়ে দিলাম। আমার ধুমধাম করে বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে নেই। কিন্তু আপনাদের একটা হক আছে। তাই আজকে অগ্রীম আয়োজন করলাম। আর আমি যাকে বিয়ে করবো তার সাথে সকলের একবার পরিচয় করিয়ে দেই। এই সোহান এদিকে আসো।

আকাশ লজ্জায় কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ায়।
সোহান তনুর কথা মতন কর্মচারীরের মধ্যে থেকে গিয়ে তনুর পাশে দাঁড়ায়। আর তনু সকলের সামনে সোহনকে পরিচয় করিয়ে দেয়। এবং আগামীকাল তনু আর সোহান বিয়ে করতে যাচ্ছে সেই বিষয়ে ঘোষণা করে। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে আকাশ। ভিতরটা জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে আকাশের তনুর সমস্ত কথা শুনে। একটু আগে একগাদা মিথ্যা দোষ তনু আকাশের উপরে চাপিয়ে দিয়েছে। যেটার একটাও সে করেনি। উল্টো তনু নিজেই সব করেছিল। আকাশ যেদিন জয়েনিংয়ের জন্য আসে, সেদিন তনুই তাঁকে ফোর্স করে বিয়ে করছে। আর আজ তনু তাঁকেই উল্টো অপবাদ দিয়ে সবার চোখে আসামি বানিয়ে দিয়েছে। আকাশ কখনোই এমনটা আশা করেনি তনুর থেকে। মন থেকে সত্যিই সে তনুকে অনেক বেশি ভালোবাসতো। কিন্তু তনু শেষমেশ তার সাথেই চোখ উল্টে নিলো। আকাশের কেমন যেনো কোনো কিছুই বিশ্বাস হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সে যেনো কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছে। তনু আর সোহানের দিকে ফেলফেল করে তাকিয়ে আছে আকাশ। ভিতরে ভিতরে প্রচন্ড আফসোস হচ্ছে। হওয়ার কথা ছিল কি। আর হলো কি। ভালোবাসার পরিণাম যে কতোটা ভয়াবহ হতে পারে সেটা আকাশ আজ বাস্তবে দাঁড়িয়ে নিজের চোখে দেখেছে। পুরো অফিসের সবাই আকাশের দিকে ঘৃণার নজরে তাকিয়ে আছে। দু-চারটে খুন করে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামীর মতন দাঁড়িয়ে আছে আকাশ। সে আজ কিছু না করেও আসামি। তনু সোহানকে ডেকে নিয়ে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। সোহানের চোখে-মুখে হাসি। আর আকাশ কষ্টের ঠিকাদারি নিয়েছে। তনু সোহানকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে আকাশের কাছে যায়। গলার আওয়াজ ছোট করে আকাশ আর সে ছাড়া কেউ শুনতে না পায় মতন করে বলে,

–‘কিরে কেমন ফিলিংস হচ্ছে তোর? আজকের দিনটার জন্য বহুদিন ধরে অপেক্ষা করেছিলাম। কি ভেবেছিস তুই আমাকে বারবার অপমান করবি আর আমি তোকে ছেড়ে দিব? না রে আমি এতোটা দয়ালু নই। আমি সেই তনু, যে কারোর দেওয়া কষ্টের কথা ভুলি না। কেউ আমায় একবার কষ্ট দিলে আমি তাঁকে সেটা সুদে-আসলে দশবার ফিরিয়ে দেই। তবে তোর ভাগ্যটা ভালো ছিল। তুই আমায় পাঁচ বছর আগে অপমান করেছিস। তোদের জন্য আমার বাবা মা’রা গিয়েছে। কিন্তু আমি তোর বেলায় সেটা ভুলে গিয়েছিলাম। তবে তুই পরেরবার আবারো একই কাজটা করলি আমায় পার্টিতে অপমান করে। আর সেদিন এই আমি ঠিক করে নিয়েছি তোর উপরে অতীত এবং বর্তমানের সমস্ত প্রতিশোধ নিব। সেই কারণে আমি তোর সাথে অতিরিক্ত ভালোবাসার নাটক শুরু করেছিলাম। অবশ্য আমিও তোকে ভালোবাসতাম। কিন্তু তোর কারণে অপমানিত হওয়ার পর সমস্ত ভালোবাসা ঘৃণায় পরিণত হয়ে গিয়েছে। এছাড়া যদিও তুই আসাদ সাহেবের সাথে কথা বলে সব ঠিক করেছিস। কিন্তু আমি তনু যেটা একবার করবো ভাবি, সেটা করেই ছাড়ি। আর তোর কারণেই আমি বাধ্য হয়ে সোহানের সাথে সম্পর্কে করেছি। না হয়তো আজ আমি তোর থাকতাম। যে নারী অসম্ভব ভালোবাসতে জানে। সে ঘৃণাও করতে জানে। তুই সেদিন ঐ রকমটা না করলে আজ তোর এই দুঃসময় দেখতে হতো না। একে একে বেশ কয়েকবার তুই আমাকে আ’ঘাত করেছিস। আজ সেসব তোকে ফিরিয়ে দেওয়ার পালা। আমার বাবা মা’রা গিয়েছে কিন্তু তোরা কেউ সাহায্য করিস নি। তোরা যদি আমার বাবার সাহায্য করতি তাহলে আজও আমার বাবা জীবিত থাকতো। বাবার দুঃসময় আসায় তোরা সব কয়টা সাইড কেটে পড়েছিস। তার উপরে টাকার কারণে আমায় তুই অপমান করেছিস। কি যেনো বলেছিলি তখন? আমি তোর যোগ্য না? আমার মতন অনেক মেয়ে দৈনিক তোর পিছনে ঘুরে? আজ দেখ তো কে কার যোগ্য না। তুই আমাকে গত পাঁচ বছর আগে তুচ্ছ, অকিঁচিৎ, নিষ্ফলা ভেবেছিস।
আজ দ্যাখ আমার আশেপাশে আসার ও যোগ্যতা তোর নেই। তার উপরে আবার আমাকেই পার্টিতে অপমান করা হ্যাঁ। দ্যাখ এখন কেমন লাগে। সেদিন যখন সোহান অফিসে এসেছিল, তার একদিন পর আমি সোহানের সাথে মিলে সব প্ল্যান করি। তোকে সোহান রাস্তার মাঝে আঁটকেছিল এটাও আমাদের একটা প্ল্যানের অংশ ছিল। আমাদের ইচ্ছে ছিল তোকে কষিয়ে একটা মা’ইর দেওয়া। কিন্তু তুই সেদিন বেঁচে গেছিস পিস্তলের কারণে। আর আমাদের প্ল্যান বৃথা যায়। তারপর আবার নতুন করে প্ল্যান সাজাই আজকের জন্য। এতো টাকা পয়সা নষ্ট করেছি শুধু তোকে অপমান-অপদস্ত করার জন্য। তুই আমাকে ভরা মজলিসের সামনে অপমান করেছিস। তাই আমি ঠিক করেছিলাম তোকেও একটা আয়োজন করে সেখানে ইচ্ছে মতন অপমান করবো। যেটা তোকে আজ করলাম।’

আকাশের চোখ থেকে অশ্রু ঝড়তে শুরু করে তনুর কথায়। যাকে সে সব টুকু দিয়ে ভালোবেসেছে সেই তনু তার উপরে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ভালোবাসা নামক জঘন্য একটা নাটক করেছে। দুই গাল লাল হয়ে গিয়েছে আকাশের তনুর থা’প্পড়ের কারণে৷ ভিষণ কষ্ট হচ্ছে আকাশের। টলমল করে চোখের পানি পড়ছে। কি পরিমাণ কষ্ট হচ্ছে আকাশের ভিতরে তা কারোর পক্ষে অনুমান করা অসম্ভব। তনুর দিকে ফেলফেল করে তাকিয়ে আকাশ ভাবে,

–‘আমি বরাবরের মতোই হতোভাগা। আমি
আমার দুঃখ গুলো একটা গ্লাসে রাখি, গ্লাস গলে যায়। একটা কাঠের পাত্রে রাখি তাতে আগুন ধরে যায়। একজন ঘৃণিত লোকের চুল্লিতে রাখি তৎক্ষণাৎ সে মা’রা যায়। একটা উন্মুক্ত আগ্নেয়গিরির মুখের মধ্যে পুরে দেই, কিন্তু ওরা শূন্যপথে উত্তপ্ত লাভা হয়ে উড়ে যায়। আমার দুঃখ গুলো কারোর সাথে ভাগাভাগি করার চেষ্টা করি, সে আমার মজা উড়িয়ে চলে যায়। আমি আমার দুঃখ গুলো কোনো আলোকিত সমাজে রাখি, সেই সমাজে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়ে যায়। আমার দুঃখ গুলো আমি পূনরায় আবার নিজের ভিতরে ফিরিয়ে আনি, সেই দুঃখ আমায় কাঁদিয়ে ছারখার করে দেয়। আমি তাঁকে স্বার্থহীন ভাবে ভালোবাসলাম। আর পরিশেষে সে আমার সাথে নৃশংসতা দেখালো। হায়রে দুনিয়া।’

তনুর দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ছেড়ে মনে মনে আফসোস করছে আকাশ। তনুর বিন্দু পরিমাণ মায়া হচ্ছে না আকাশের চোখের পানি দেখে। উল্টো আরো প্রতিহিংসা দেখিয়ে বলে,

–‘আরেহ বাহ তোর তো দেখছি বেশ লজ্জা। অল্পতেই তোর চোখের পানি বেরিয়ে গেছে। আমি তো ভেবেছিলাম তোর মধ্যে লজ্জাবোধ বলতে কিছুই নেই। কিন্তু এখন দেখছি তোর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। তার মানে একটু হলেও তোর ভিতরে লজ্জা আছে। তবে তোর লজ্জা থাকা আর না থাকা দিয়ে আমার কোনো লাভ নেই। আর তোর চোখের পানি দেখে আমি আর গলছি না। তাই তোর জন্য ভালো হবে বৃথা চোখের পানি গুলো নষ্ট করিস না। কারণ এখন মাত্র একটা ধাপ গিয়েছে। আরেকটা ধাপ এখনো বাকি আছে। সেজন্য বলছি চোখের পানি গুলো আপাতত বাঁচিয়ে রাখ একটু পর কাজে আসবে।’

আকাশ তনুর কথা শুনে বুঝে উঠতে পারে না তনু কিসের ধাপের কথা বলছে। ইতিমধ্যেই তনু আকাশকে সজোড়ে এক ধাক্কা দিয়ে উল্টে মাটিতে ফেলে দেয়। তারপর সে সরে যায়। সোহান এগিয়ে আসে আকাশের কাছে। আকাশ নিজেকে সামলে মাটি থেকে উঠার আগেই আকাশের কলার চে’পে সোহান। আকাশ পুরোপুরি নিশ্চুপ। সোহান আকাশের কানের দিকে৷ নিজের মুখ কিছুটা এগিয়ে তনুর ন্যায় দু’জন ব্যতীত কেউ না শুনে মতন করে বলে,

–‘খুব দেমাগ বেড়েছিলি তোর তাই না? খুব অহঙ্কার হচ্ছিলো তোর তনুকে পেয়ে? দ্যাখ তনু এখন আমার। আগামীকাল আমরা দু’জনে বিয়ে করে সংসার শুরু করবো। আগামীকাল সারাজীবনের জন্য তনু আমার হয়ে যাবে। আগামীকাল থেকে তোর তনুর শরীরে আমি স্পর্শ করবো। ওর উপরে আগামীকাল থেকে একান্তই শুধু আমার অধিকার থাকবে।’

আকাশ সোহানের কথা শুনে সোহানের দিকে কিছুটা আক্রোশ নিয়ে তাকায়। সোহান আকাশের তাকানো দেখে আকাশকে বলে,

–‘সেদিন পিস্তল নিয়ে বহু বাহাদুরি দেখিয়েছিস। কিন্তু আজ তোর বাহাদুরি আমি ছুটিয়ে দিব।’

সোহান আকাশের উপরে বসে নৃশংস ভাবে আকাশকে মা’রতে আরম্ভ করে। কিন্তু আকাশ একটা টু শব্দ’ও করে না। চুপচাপ পড়ে পড়ে মা’র খাচ্ছে। অফিসের সবাই দৃশ্যটা তাকিয়ে তাকিয়ে উপভোগ করছে। কেউ আকাশকে বাঁচাতে আসছে না। কারণ সবার নজরে আকাশ ঘৃণিত। সোহান আকাশকে মা’রতে মা’রতে আকাশের নাক-মুখ ফাটিয়ে রক্ত বের করে ফেলে। নাক-মুখ থেকে অনর্গল রক্ত পড়ছে আকাশের। কেউ কোনো মনুষ্যত্ব দেখাচ্ছেনা আকাশের জন্য। সোহানের ভিতরেও কোনো মায়া-দয়া কাজ করছে না। সে প্র’হার করেই চলেছে আকাশকে। এমন সময় অফিসের ম্যানেজার খালেক সাহেব দৌড়ে আসে আকাশকে বাঁচানোর জন্য। এতো সময় বেচারা চাকরি হারানোর ভয়ে চুপচাপ করে থাকলেও এখন আর চুপচাপ করে থাকতে পারে না। সাহস করে আকাশকে বাঁচাতে চলে আসে। কারণ কেউ না জানলেও খালেক সাহেব জানে আকাশ নির্দোষ। কয়েকদিন আগে তনু নিজেই তিনাকে বলেছে আকাশ তার হাজবেন্ড। কিন্তু যদি আকাশ সত্যিই তাঁকে ফন্দি করে বিয়ে করতো, তাহলে তনু তিনাকে কখনোই ঐ ভাবে বলতো না। মানুষ আপন মানুষকে নিয়েই জোর গলায় বলে। কারোর প্রেশারে পড়ে তনুর মতন ঐরকম নিখুঁত ভাবে কথা বলা কারোর পক্ষে অসম্ভব। খালেক সাহেব জোরপূর্বক সোহানকে আকাশের কাছ থেকে টেনে ছাড়িয়ে আকাশকে ধরে মাটি থেকে তোলে। কিন্তু সোহান আবারো তেড়ে যায় আকাশকে মা’রার জন্য। খালেক সাহেব আকাশকে ছেড়ে সোহানকে আটকানোর চেষ্টা করে। এই সুযোগে পিছন থেকে আকাশ সামনে এগিয়ে গিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সোহানকে কোষে একটা লাগিয়ে দেয়। যার ফলে সোহান সাথে সাথে ঢুলে ধ্রামম করে মাটিতে পড়ে যায়….
#অবেলায়_তুমি (অন্তিম-পর্ব)
#লেখক_আকাশ_মাহমুদ

সোহান আবারো তেড়ে যায় আকাশকে মা’রার জন্য। খালেক সাহেব আকাশকে ছেড়ে সোহানকে আটকানোর চেষ্টা করে। এই সুযোগে পিছন থেকে আকাশ সামনে এগিয়ে গিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সোহানকে কোষে একটা লাগিয়ে দেয়। যার ফলে সোহান সাথে সাথে ঢুলে ধ্রামম করে মাটিতে পড়ে যায়। আকাশের এক ঘু’ষিতে সোহানের দুনিয়াদারী উলট-পালট হয়ে গিয়েছে। নাক ফেটে অনবরত রক্ত পড়ছে। রক্তের কারণে চেহারার নকশা বদলে গিয়েছে সোহানের। সারা মুখ রক্তে লাল হয়ে গিয়েছে। মাটির মধ্যে শুয়ে নাক চেপে ধরে আছে সোহান। তনু সোহানের অবস্থা দেখে সোহানের কাছে দৌড়ে আসে। আকাশ সোহানের অবস্থা সত্যিই বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। এতো সময়ের প্রতিশোধ আকাশ একবারেই উঠিয়ে নিয়েছে। হিসেব বরাবর। তবে আকাশের ভিতরটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে তনুর আচরণে। রক্ত দু’জনের শরীর থেকেই পড়ছে। কিন্তু তনু তাঁকে নয় সোহানকে সামলাচ্ছে। রক্তের সাথে চোখের জল ঝর্ণার পানির ন্যায় টলমল করে পড়ছে আকাশের চোখ থেকে৷ হতভাগার মতন তাকিয়ে আছে তনুর দিকে আকাশ। আর তনু সোহানকে সামলে মাটি থেকে ধরে উঠে বসায়। আকাশের উপরে প্রচন্ড রাগ উঠছে তনুর। ইচ্ছে করছে আকাশকে এখুনি খু’ন করে ফেলতে৷ তবে এমনটা করা সম্ভব নয়। কারণ অনেক মানুষজন রয়েছে উপস্থিত। তার উপরে একটা মানুষকে খু’ন করা দু’চারটে কথা নয়। সোহানকে কোনো মতে সামলে রাগান্বিত কন্ঠে আকাশকে বলে,

–‘আকাশ এই মুহূর্তে তুই আমার অফিস থেকে বের হ। না হয় কিন্তু আমার হাতে তোর কোনো অঘটন ঘটবে। তোর কতো বড় সাহস তুই আমার সোহানের শরীরে আ’ঘাত করিস? তুই তো এর জন্য কখনোই ক্ষমা পাবি না আকাশ। একদম জানে মে’রে ফেলবো তোকে। আমার সোহানের গায়ে হাত উঠানোর ফল তোকে অবশ্যই ভোগ করতে হবে। অবশ্য আমার সমস্ত প্রতিশোধ নেওয়া শেষ তোর উপরে। কিন্তু একটু আগে যেটা করলি সেটার কারণে আমি নয় সোহান তোর উপরে নিজেই প্রতিশোধ নিবে। আর সেই সময় আমি সোহানকে সঙ্গ দিব। তুই নিজের জীবনে আরো একটা মুসিবত ডেকে এনেছিস সোহানের উপরে হাত তুলে। আমার প্রতিশোধের পালা শেষ। কিন্তু সোহানের নতুন করে পালা শুরু হয়েছে। তুই পাতালে গিয়ে লুকিয়ে থাকলেও সোহান তোকে খুঁজে বের করবে। এবার আমার চোখের সামনে থেকে দূর হ। আগামীতে যেনো আর কখনো তোর সাথে আমার দেখা না হয়। আর যদি হয়েও থাকে, তাহলেও যেনো তোর লাশের সাথে আমার দেখা হয়। এখন বের হ তুই আমার অফিস থেকে। তোর মতন ছোট লোক আমার অফিসে থাকার কোনো যোগ্যতাই রাখে না।’

তনুর কথা শুনে আকাশের প্রচন্ড হাসি পায়। তনুর কথার কোনো প্রত্যুত্তর না করে সজোড়ে হাসতে হাসতে তনুর অফিস থেকে বেরিয়ে চলে যায়। আপদ বিদায় হয়েছে অফিস থেকে। আকাশ চলে যাওয়ার পর তনু কয়েক জনের সাহায্যে নিয়ে সোহানকে হসপিটালে নিয়ে যায়। ডক্টর জানায় সোহানের নাকের ভিতরে হালকা করে চোট লেগেছে। তেমন বড় ধরনের কোনো ক্ষতি হয় নি। তনুর শান্তিতে নিশ্বাস ফেলে ডক্টরের কথা শুনে। ভিতরে ভিতরে বেশ আনন্দ লাগছে তনুর। একে তো সোহানের তেমন বড় ধরনের কোনো ক্ষতি হয়নি। দ্বিতীয়ত আকাশের উপরে আজ সে সমস্ত কিছুর প্রতিশোধ নিয়েছে। সোহানকে ডক্টর দেখিয়ে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসে তনু। আনন্দের কোনো সীমা নাই তনুর। এর আগে কখনো তার কোনো কিছু নিয়ে এতোটা আনন্দ হয়নি। আজ যেই আনন্দটা হচ্ছে আকাশের উপরে প্ল্যান মোতাবেক সমস্ত প্র’তিশোধ নিতে পেরে। খুশি মনে বাসায় এসে নিজের মা’কে বলে,

–‘মা আজ আমি বেশ খুশি। জানো আজ আমি ঐ আকাশের উপরে সমস্ত প্রতিশোধ নিয়ে নিয়েছি। আমার বাবার প্রতিশোধ এবং আমাকে করা অপমানের শোধ আজ আমি আকাশের উপরে তুলেছি। অফিসের সকল কর্মচারীর সামনে তাঁকে অপমান করে অফিস থেকে বের করে দিয়েছি। আর সেই সঙ্গে তাঁকে সোহানের হাতেও মা’ইর খাইয়েছি। আমার কি যে আনন্দ হচ্ছে মা জানো? আমার এই জীবনের সব চাইতে বড় পূর্ণতাটা যেনো আজ আমি পেয়েছি আকাশের উপরে প্রতিশোধ নিতে পেরে। একেবারে নাক-মুখ ফা’টিয়ে দিয়েছে সোহান আকাশের। আমায় অপমান করার সমস্ত ফল আজ আকাশ পেয়েছে। কত্তো বড় সাহস তার সে আমায় অপমান করেছিল প্রেমের প্রপোজাল দেওয়ায়। আজ তার স্টাটাস তাঁকে বুঝিয়ে দিয়েছি৷ রাস্তার টোকাই হয়ে আমার সাথে বাহাদুরি দেখায়। আজ একদম পরিপূর্ণ ক্ষোভ মিটিয়েছি আকাশের উপর।’

তনুর সমস্ত কথাবার্তা শুনে রাগে তনুর মা’য়ের চোখে পানি চলে আসে। মেয়ের কথাবার্তা শুনে নিজেকে দমানো মুশকিল হয়ে উঠেছে তনুর মা’য়ের। কোষে তনুর দুই গালে দু’টো থা’প্পড় লাগিয়ে দেয় তনুর মা। তনু আশ্চর্য হয় তার মা’য়ের এমন আচরণে। গালে হাত দিয়ে আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করে,

–‘মা তুমি আমায় মা’রলে কেন? তোমার তো আমার খুশিতে খুশি হওয়া উচিত মা। সেই জায়গায় তুমি আমায় থা’প্পড় মা’রলে?’

–‘হ্যাঁ মে’রেছি। কারণ তুই যেই বড় অন্যায় টা করেছিস আকাশের উপরে, সেটা এর আগে দুনিয়ার বুকে কেউ কারোর সাথে করেনি।’

–‘মা আমি কিসের অন্যায় করেছি আকাশের উপরে? অন্যায় তো সে আমার সাথে করেছে৷ তাঁকে প্রেমের প্রপোজাল দেওয়ায় আমাকে অপমান করেছে। আমার বাবার দুঃসময়ে তারা সাহায্য না করে আমার বাবাকে ম’রার জন্য ছেড়ে দিয়েছিল। আজ তাঁদের কারণে আমার বাবা বেঁচে নেই। তার উপরে সে আমায় পার্টিতেও অপমান করেছে। আর তুমি বলছো আমি তার উপরে সমস্ত কিছুর প্রতিশোধ নিয়ে অন্যায় করেছি?’

–‘হ্যাঁ তুই অন্যায় করেছিস। আর তোর অন্যায়টা এতো বড় যার কারণে হয়তো সৃষ্টিকর্তার আরশ সহ কেঁপে উঠেছে। তনু তুই একটা নির্দোষ ছেলের উপরে প্রতিশোধ নিয়েছিস। যেটার কারণে তুই এই জীবনে হয়তো কোনোদিন ও ক্ষমা পাবি না।’

–‘মা আকাশকে তোমার কোন দিকে নির্দোষ মনে হচ্ছে? সে যে আমার সাথে এতো কিছু করেছে সেসব কি তোমার কাছে কিছুই মনে হচ্ছে না?’

–‘না মনে হচ্ছে না। কারণ তুই এখনো সত্যিটা জানিস না।’

–‘কিসের সত্যি আমি জানি না মা?’

–‘শুনতে চাস কোন কি তুই জানিস না?’

–‘হ্যাঁ শুনতে চাই।’

–‘ঠিক আছে বলছি। তবে আমি কখনোই চাইনি তোকে এই সত্যি গুলো বলতে। কিন্তু শেষমেশ বাধ্য হচ্ছি বলতে। শুরুতে তোর বাবার কথা দিয়েই শুরু করি। তোর বাবা আর সেলিম সাহেব এক সাথে বিজনেস করতো। কিন্তু মাঝ পথে তোর বাবাই সেলিম সাহেব থেকে আলাদা হয়ে অন্য একটা কোম্পানির সাথে হাত মিলিয়ে অধিক অর্থের লোভে বিজনেস করেছে। আর সেটাই তোর বাবার কাল হয়েছে। তোর বাবা সেলিম সাহেবকে রেখে যেই কোম্পানির সাথে শেয়ারে বিজনের করেছে সেই কোম্পানি তো ডুবেছেই, সাথে তোর বাবাকেও ডুবিয়েছে। তোর বাবার সমস্ত টাকা-পয়সা নিজের কারণে হারিয়েছে। সেলিম সাহেব অনেক বার তোর বাবাকে বুঝিয়েছিল এমনটা না করতে, কিন্তু তোর বাবা সেলিম সাহেবর একটা কথাও শোনে নি। উল্টো আরো ব্যাংক থেকেও অনেক লোন নিয়েছিল তোর বাবা নতুন করে বিজনেস করার জন্য। সেলিম সাহেব তোর বাবার কারণে প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু তার পরেও তোর বাবার বিপদে সেলিম সাহেব এগিয়ে এসেছিল। কিন্তু তোর বাবা নিজেই সাহায্য নেয়নি। কারণ এমনিতেই সেলিম সাহেবের কথা না শোনায় তোর বাবার প্রচন্ড লজ্জাবোধ কাজ করছিল। তাই তোর বাবা সেলিম সাহেবের সাহায্য নেয়নি।
আর এই বিষয়টা থেকে তুই নিজেও বেখবর। অবশ্য তোকে ইচ্ছা করেই জানানো হয়নি। কারণ তোর বাবা অতিরিক্ত অর্থের লোভ করতে গিয়ে সব হারিয়েছি সেটা তুই জানতে পেলে তোর নজরে তোর বাবা নিচে নেমে যাবে। তাই তোর বাবা সেটা তোকে জানাতে বারণ করেছে। এরপর যখন তোর বাবা মা’রা যায়, তখন তোর বাবার লোনের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় ব্যাংকের লোকজন আমাদের বাড়িটা নিয়ে নেয়। কিন্তু তার পরেও লোন পুরোপুরি পরিশোধ হয় না। তখন আকাশের বাবা নিজে বাকি টাকা পরিশোধ করেছে। এবার আসি আকাশের কথায়। তুই আকাশকে কখন থেকে ভালোবাসিস সেটা আমি জানি না! তবে তুই যখন ক্লাস সেভেন-এইটে পড়িস তখন থেকেই আকাশ তোকে পছন্দ করে৷ তোর আর সোহানের বিষয়টা সে সহ্য করতে না পাড়ায় পার্টিতে সে তোকে অপমান করেছে। আর গত পাঁচ বছর আগে সে তোকে যেই অপমানটা করেছে সেটা ইচ্ছা করেই করেছে। কারণ যাতে করে আমাদের যেই নাম-ডাকটা খারাপ হয়েছে সেটা তুই আবার ফিরিয়ে আনতে পারিস। তখন সে তোর আচরণে সাড়া দিলে তুই আজ কখনোই এই জায়গায় পৌঁছাতে পারতি না। তোকে অপমান করে সে তোর মধ্যে একটা জেদ ঢুকিয়ে দিয়েছে। যাতে করে তুই তোর বাবার চাইতেও অনেক বেশি নাম-ডাক অর্জন করতে পারিস। আকাশ তোকে এবং আমাদের পরিবারকে অনেক বেশি ভালোবাসতো। তাই আমাদের ভালোর জন্য সে এমনটা করেছে। এমনকি তুই যেই টাকা দিয়ে বিজনেস করছিস সেটা আকাশের এই দেওয়া টাকা। কিন্তু আকাশ তোকে এসব বিষয়ে কখনো না বলতে বলেছে। কারণ সে চায় না তুই তার কাছে কখনো ছোট হয়ে থাক। এমনকি সে তোর বিপদে উপকার করেছে সেই কারণে তুই তাঁকে ভালোবাস। সে সবসময় চাইতো তোদের ভালোবাসাটা যেনো পিওর হয়। কখনো যেনো তোদের ভালোবাসার মধ্যে তার উপকারের প্রসঙ্গটা না আসে। তার জন্যই সে সব সময় ওইসব কথা লুকিয়ে গেছে। এমনকি আমাকেও বারণ করেছে কখনো তোকে এসব বিষয় না বলতে। তাই আমি তার দেওয়া টাকা তোকে দিয়ে বলেছিলাম এসব আমার নিজের জায়গা বিক্রির টাকা। কিন্তু সত্যিকারত্বে টাকাটা আমায় আকাশ দিয়েছিল তোকে দেওয়ার জন্য। আমার কোনো জায়গা জমিন ছিল না।
কিন্তু তুই কি করলি? তার দেওয়া টাকায় রাজপ্রাসাদ বানিয়ে সেই রাজপ্রাসাদে দাঁড়িয়ে তাকেই অপমান করলি? হায়রে তনু তোর কিছুই থাকবে না রে। সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি তোর মা হয়ে বলছি৷ তুই কোনো কুল-কিনারা খুঁজে পাবি না। সমস্ত পথ বন্ধ হয়ে যাবে তোর। অন্যায় ভাবে কখনো মানুষের উপরে প্রতিশোধ নিলে সৃষ্টিকর্তার আরশ সহ কেঁপে উঠে। তার মনের আঘাতে তুই যেই রাজপ্রাসাদ বানিয়েছিস, সেই রাজপ্রাসাদের একটা ইঁটের টুকরো ও খুঁজে পাবি না। আমার কথাটা মিলিয়ে নিস তুই।’

তনুর মা’য়ের চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে। আর তনু তার মা’য়ের মুখ থেকে সমস্ত সত্যি কথা শুনার পর যেনো তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়েছে। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে তনুর। মনের ভিতরে বিশাল এক ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়েছে। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। নিজের মা’য়ের মুখ থেকে অপ্রিয় সত্যি গুলো শুনার পর নিজের অনিচ্ছাতেই চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করেছে। কলিজাটা বেধড়ক ভাবে মোচড় দিচ্ছে তনুর। মনে হচ্ছে যেনো কেউ নিজের হাতে ধরে কলিজা টাকে কচলাচ্ছে। ধাপাস করে মাটিতে বসে ফুফিয়ে কাঁদতে শুরু করে তনু। নিজের হাতে দিয়েই সে সব কিছু শেষ করে ফেলেছে। কতো বড় ভুল করেছে সেটা সে এখন উপলব্ধি করতে পারছে৷ কিন্তু এখন উপলব্ধি করে আর কি হবে। যা হওয়ার তা তো হয়েই গিয়েছে।

মেয়ের কান্নাতে মা’য়ের কলিজায় একফোঁটাও ফারাক পড়ছে না। যেখানে সন্তানের কান্নায় মা’য়ের ভিতরে ভূমিকম্প শুরু হয়, সেখানে তনুর কান্না তনুর মা’য়ের ভিতর পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না এতো বড় পাপ করেছে তনু। উল্টো আরো রাগান্বিত কন্ঠে মেয়েকে বলে,

–‘এখন কাঁদছিস কেন? তোর তো আনন্দে থাকার কথা প্রতিশোধ নিতে পেরে। আমি বারবার বলেছিলাম এমনটা করিস না। যা হয়েছে গত পাঁচ বছর আগে চলে গিয়েছে। কিন্তু না আমার কথার অমান্য করে তুই ঠিকই প্রতিশোধ নিয়েছিস। আসলে তোর মতন মেয়ে আমি গর্ভে ধরে নিজের গর্ভকে কলঙ্কিত করেছি এছাড়া আর কিছুই নয়। একদম কাঁদবি না। কাঁদলে গলা টি’পে মে’রে ফেলবো। মায়া কান্না থামা।’

–‘ও মা প্লিজ এই ভাবে বলো না। সত্যিই আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি না বুঝে! মা প্লিজ আমাকে একটা বার শোধরানোর সুযোগ দাও।’

–‘আমার কাছে সুযোগ চেয়ে কোনো লাভ নেই। সুযোগ যার কাছে চাইলে কাজ হবে তার কাছে গিয়ে চা।’

তনু মাটি থেকে উঠে দাঁড়ায়। তার মা ঠিক কথাই বলেছে। ক্ষমা তার আকাশের কাছে চাওয়া উচিত। এক সেকেন্ড ও আর দেরি না করে গাড়ি নিয়ে আকাশের বাসায় চলে যায়। কিন্তু আকাশের বাসায় গিয়ে জানতে পারে আকাশ বাসায় যায়নি। বাসায় না পেয়ে গাড়ি নিয়ে এদিক-সেদিক পাগলের মতন খুঁজতে থাকে আকাশকে। কিন্তু কোথাও আকাশের দেখা মিলে না। অসংখ্য বার ফোন করে। কিন্তু ফোন প্রতিবারই বন্ধ আসে৷ তনু না খেয়ে না দেয়ে সেই বিকাল চারটা থেকে আকাশকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। রাতের বাজে এগারোটা। এখনো আকাশের দেখা মিলেনি। রাস্তার এক পাশে গাড়ি থামিয়ে আকাশের মা’য়ের কাছে ফোন করে জিজ্ঞাস করে আকাশ বাড়ি গিয়েছে কিনা। কিন্তু আকাশের মা ভয়ার্ত কন্ঠে জানায় আকাশ এখনো বাড়ি ফিরেনি। আকাশের মা’য়ের ও প্রচন্ড ভয় হচ্ছে আকাশকে নিয়ে৷ এতো রাত হয়ে গেছে কিন্তু এখনো আকাশ বাড়ি ফিরেনি। হতাশাগ্রস্ত হয়ে ছেলে বাড়ি ফিরে আসার প্রত্যাশায় বসে আছে রহিমা বেগম। ঐ দিকে তনুর ভিতরে প্রচন্ড ভয় হচ্ছে আকাশকে নিয়ে। আবারো গাড়ি করে খুঁজতে শুরু করে আকাশকে। রাত বাজে বারোটা। এখনো অব্দি আকাশের খোঁজ মিলেনি। এতো খোঁজার পরেও না পেয়ে হতাশ হয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বাড়ি ফিরে আসে তনু। শরীর প্রচন্ড ক্লান্ত। চোখের পানি গাল বেয়ে এখনো পড়ছে সেই বিকাল থেকে। বাড়ি ফিরে ক্লান্ত শরীর নিয়ে নিজের রুমে প্রবেশ করে। এমন সময় হুট করে তনু দেখে আকাশ তার রুমের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। তনু আকাশকে দেখতে পেয়ে কোনো কথাবার্তা ছাড়া এক দৌড়ে আকাশের কাছে গিয়ে আকাশকে জড়িয়ে ধরে। আকাশ কোনো কথাবার্তা বলছে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। তনু উপলব্ধি করতে পারে আকাশের মনে প্রচন্ড অভিমান জন্মেছে। অভিমান ভাঙ্গাতে আকাশের চোখে-মুখে অসংখ্য চুমু এঁকে দেয় তনু। কিন্তু তাও আকাশ কোনো কথাবার্তা বলে না। তনু বুঝতে পারে আকাশের রাগ এভাবে কমবে নিয়ে। আকাশের রাগ ভাঙ্গাতে হলে অন্য কিছু করতে হবে। হাত চে’পে ধরে আকাশকে নিয়ে সোজা ছাদে চলে যায়। এরপর ছাদের এক জায়গায় নিয়ে গিয়ে পাশাপাশি বসে একেক বার একেকটা করে আকাশের রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করে। কখনো আকাশের গালে চুমু খাচ্ছে। কখনো আকাশকে এটা সেটা বলে হাসানোর চেষ্টা করছে। এভাবে দুই ঘন্টা কেটে যায়। অবশেষে দুই ঘন্টার প্রচেষ্টার পর আকাশের রাগ ভাঙ্গে৷ তনুর কাছে পারস্য বিজয় করার মতন লেগেছে আকাশের রাগ ভাঙ্গানোটা। তনুর পাগলামি দেখে মুচকি হেঁসে দেয় আকাশ। তনুর মুখেও হাসি ফুটে উঠে আকাশের রাগ ভাঙ্গাতে পেরে। এমন সময় তনুর কাছে একটা ফোন আসে। কাঁধের মধ্যে ঝুলে থাকা ছোট সাইড ব্যাগ থেকে ফোন বের করে রিসিভ করে তনু। তখনি অপরপাশ থেকে কেউ একজন বলে উঠে,

–‘দুই ঘন্টা আগে রোড এক্সিডেন্টে একজন লোক মা’রা গিয়েছেন। যিনার শরীর এক্সিডেন্টে একদম ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছে। আমরা কোনো ভাবেই সনাক্ত করতে পারছি না উনি কে। লাশের কাটা আলাদা একটা হাত আর থেঁতলে যাও দেহটা শুধু পড়ে রেয়েছে। মাথার কোনো অস্তিত্ব আমরা খুঁজে পাইনি। তাই লাশের বিষয়ে কাউকে ইনফর্ম করতে পারছিলাম না। তবে আমরা উনাকে সার্চ করে শুরুত উনার একটা মানিব্যাগ পেয়েছি। যেখানে স্বর্ণকারের দোকানের একটা রিসিট ছিল। এছাড়া আর কোনো আইডেন্টিটি ছিল না। তাই আমরা রিসিটের দেওয়া নাম্বারে ফোন করেছিলাম। তখন উনি বললো উনাকে চিনে না। তবে কয়েকদিন আগে উনি কানের এক জোড়া দুল বন্ধক দিয়ে হাজার দশেক টাকা নিয়েছিল। এছাড়া উনার বিষয়ে আর কিছুই জানে না। কিন্তু একটু আগে ঘটনাস্থলে আমরা একটা ফোন খুঁজে পেয়েছি যেটা বন্ধ ছিল। তবে আমরা ফোনটা চালু করার পর দেখি আপনার নাম পার্টনার দিয়ে সেভ করা এবং আপনার নাম্বার অনেক গুলো মিসডকল। তাই আমরা আপনাকে ফোন করেছি। আপনি কি উনার কিছু হন?’

তনু লোকটার কথা শুনে পাশে তাকাতেই দেখে আকাশ নাই। তনু বুঝে ফেলে এতো সময় তার সাথে কেউ ছিল না। আকাশ দুই ঘন্টা আগেই রোড এক্সিডেন্টে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেছে। আর সে নিজে নিজেই এতো সময় একা একা বকবক করেছে। তনুর হাত থেকে ফোনটা নিচে পড়ে যায়। সেই সঙ্গে তনু বিকট আওয়াজে এক চিৎকার মা’রে। মনে হচ্ছে যেনো কেউ তনুর বুকে ছু’রি ঢু’কিয়ে দিয়ে তার কলিজাটা জোরজবরদস্তি বের করে নিচ্ছে। পাগলের মতন জোরে জোরে চিৎকার করে কান্না করতে শুরু করে। আর সেই সঙ্গে চিৎকার করে বলতে থাকে,

–‘আকাশ প্লিজ ফিরে এসো। আমি তোমার সত্যিকারত্বে ভালোবাসাটা বুঝতে পারিনি। তুমি আমায় উচ্চ আসনে বসিয়েছো। আর আমি তোমায় মৃত্যু উপহার দিয়েছি। আজ আমি জেনে গেছি তুমি সেদিন টাকা গুলো কোথা থেকে পেয়েছিল। আমায় অনেক বড় সারপ্রাইজ দিয়েছিলে তুমি সেদিন। আর পরিশেষে আমিও তোমায় সারপ্রাইজ দিলাম অপমান আর লাঞ্ছনা করে। আকাশ প্লিজ ফিরে এসো। আমি তোমার পা ধরে নিজের ভুলের জন্য ক্ষমা চেতে চাই। আমি তোমার সাথে সারাজীবন কাটাতে চাই। প্লিজ ফিরে এসো আকাশ..

তনু চিৎকার করে কান্না করছে আর পাগলের মতন প্রলাপ করছে। তনু হয়তো ভুলে গেছে যে একবার সৃষ্টি কর্তার ডাকে সাড়া দেয় সে আর কখনোই ফিরে আসে না। সঠিক বেলা ফুরিয়ে গেছে। অবেলায় হাজারবার চাইলেও সেটা আর কাজে দিবে না। আর একটা প্রবাদ আছে। সব কিছুর সাথে আপোষ চললেও নিজের আত্মসম্মানের সাথে কখনো আপোষ চলে না। কিন্তু তনু আকাশের সেই আত্নসম্মান টাকেই সকলের সামনে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। সেজন্য আকাশ অভিমান করে মৃত্যুর সাথে আপোষ করেছে। আর কখনো সে ফিরবে না। হারিয়ে গেছে সে। আর অবেলায় মাথা ঠেকিয়ে কাঁদছে তনু।

সমাপ্তি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here