#হৃদমাঝারে
#নাঈমা_জান্নাত
( ১৭)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মানেই স্বপ্নের জায়গায়। ভরপুর সৌন্দর্য্য দেখার জন্যও যেখানে মানুষ ভীড় করে সেখানে চান্স পাওয়াটা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ভার্সিটির ভেতরে পা রাখতেই কেঁপে উঠে শুভ্রতার শরীর। সারা শরীরে অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যায়। দীর্ঘ ছয়বছরের স্বপ্ন আজ সত্যি হয়েছে। শুভ্রতার মামা যখন এখানে চান্স পেয়েছিলো,তখন মামার থেকে হাজারো গল্প শুনেছিলো। সেই গল্পই একটু একটু করে মনে গেঁথে গিয়েছিলো। নিজের স্বপ্ন হয়ে উঠেছিলো। কিন্ত মাঝে সেখান থেকে সরে গেলেও মেঘের সাপোর্ট এ আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। শুভ্রতা নিজের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্নিগ্ধ পুরুষের দিকে তাকালো। আল্লাহর কাছে হাজারো শুকরিয়া এই মানুষটাকে তার জীবনে দেওয়ার জন্য। আভিয়ানের বিয়ের পর কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। সম্পর্কটা খুব সুন্দর হয়ে উঠেছে। দুম করে হওয়ার থেকে একটু একটু করে গড়ে উঠা সম্পর্ক সুন্দর,সাথে মজবুদও হয়!
‘শুভ্র ওইদিকে চল। ওখানে এডমিশনের কার্যক্রম চলছে।’ মেঘ শুভ্রতার হাতটা নিজের হাতের ভাজে নিয়ে বলে। শুভ্রতা মাথা দুলিয়ে সম্মতি দেয়। হ্যাঁ আজ তার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আজ সে তার স্বপ্নের ক্যাম্পাসে ভর্তি হতে এসেছে। রেজাল্ট পাওয়ার পর কিছুক্ষণ বিশ্বাস করে উঠতেই পারে নি। অবশ্য না পারার কিছু নেই। সেই ইন্টারের প্রথম বর্ষ থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে কথা। শুধু শুভ্রতা একা না,কোচিং নতুন আলাপ হওয়া মাহিরাও চান্স পেয়েছে। এতে শুভ্রতা ভীষণ খুশি। কারণ সব বন্ধুরা একসাথে থাকতে পারবে।
__________________
‘শুভ্র! কই তুমি?’ মেঘের ডাকে বারান্দা থেকে রুমে আসে শুভ্রতা। মাত্রই মেঘ বাসায় এসে ফ্রেশ হয়েছে। রুমে এসে দেখে মেঘ শার্ট পড়ছে। মেঘ বাসায় সবসময় টি-শার্টই পড়ে। শুভ্রতা খানিক ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাস করে,,’কোথাও যাচ্ছেন?’
মেঘ বোতাম লাগাতে লাগাতে বলে,,’হুম। সাথে আপনিও যাচ্ছেন ম্যাডাম!’
‘আমি কোথায় যাবো?’ শুভ্রতা কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞাস করে।
‘অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয় না তোমাকে নিয়ে,সারাদিন বাসায় থাকো,আমিও অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকি। আর দু’দিন পর তো তুমি ভার্সিটি নিয়ে বিজি হয়ে যাবা। তখন তো টাইম হবে না। তাই ভাবলাম আজ বাইরে যাই!’
‘কিন্ত তাই বলে এতো রাতে?’ মেঘ শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,,’রাত আটটা ঢাকা শহরের বিকেল!’
শুভ্রতা ড্রেসিংটেবিলের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে মেঘের দিকে তাকিয়ে বলে,,’তা যা বলেছেন!’
‘জ্বি। এবার চলো চটপট রেডি করে দেই। এই নাও (খাট থেকে একটা প্যাকেট শুভ্রতার দিকে তা বাড়িয়ে) এটা পড়বা।’ শুভ্রতা মেঘের হাত থেকে প্যাকেটটা নেয়। সাদা রংয়ের উপর বিভিন্ন কালারের লতা,পাতা,ফুল দেওয়া,আর আচলটাতে পুরো সুতো আর ছোট বিভিন্ন কালারের স্টোন,পুতির কাজ! এক কথায় শাড়িটা শুভ্রতার খুব পছন্দ হয়েছে। শুভ্রতা শাড়িটা নিয়ে অন্যরুমে যেতে নিলে মেঘ শুভ্রতার হাত ধরে থামিয়ে দেয়। শুভ্রতা ইশারায় ‘কি?’ জিজ্ঞাস করলে মেঘ আলতো স্বরে বলে,,’আমি পড়িয়ে দেই?’
‘নিন!’ শুভ্রতার সম্মতি পেয়ে মেঘ খুব সুন্দরভাবে শুভ্রতাকে শাড়িটা পড়িয়ে দিলো। অন্যদিন মেঘ শুধু কু্ঁচি ঠিক করে দিয়ে সাজিয়ে দিতো। আজ প্রথমবার শাড়ি পড়িয়ে দিচ্ছে। শুভ্রতা মুগ্ধ চোখে মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে। মানুষটাকে যত দেখে ততোই যেনো অবাক হয়। কি আছে এর মাঝে যার জন্য শুভ্রতা বারে বারে আটকে যায়! মেঘের শাড়ি পড়ানো শেষ হতে শুভ্রতার ধ্যান ভাঙ্গে।
‘আপনি এভাবে শাড়ি পড়ানো কার থেকে শিখলেন? আর এতো পারফেক্ট কি করে হলো। সত্যি করে বলুন!’ শুভ্রতা কোণাচোখে তাকিয়ে মেঘকে প্রশ্ন করে। মেঘ আঁচল ঠিক করে দিতে দিতে বলে,,’কোঁণা চোখে তাকানোর কিছু নেই। ইউটিউব থেকে দীর্ঘদিন শেখার পর আজকে এপ্লাই করলাম!’
‘ইন্টালিজেন্ট!’
‘জ্বি এবার মুখটা বন্ধ রেখে,কাজ করতে দাও।’ কথাটা বলে মেঘ শুভ্রতাকে খাটে বসিয়ে দিলো। তারপর চিরুনি নিয়ে শুভ্রতার চুল আছড়ে দিলো।
‘এই তোমার চুলে এতো জট কেনো? তেল দেও না?’
‘নাহ জামাইয়ের খরচ বাঁচাই!’
‘দিতে ভাল লাগে না ওটা বলো। জামাইয়ের খরচ বাঁচাও,হুদাই গুল মারো!’ মেঘের কথায় দু’জনেই হেসে দিলো। আজ আর শুভ্রতাকে সাজালো না। জাস্ট শাড়ি,হাতে স্টোনের দু’টো চুড়ি,কানে একজোড়া ছোট ঝুমকো,খোলা কোঁকড়ানো চুল। ব্যাস শুভ্রতাকে পুরো শুভ্র রংয়ে রাঙিয়ে দিলো মেঘ।
‘তো মিসেস আবরার যাও যাক!’
‘অবশ্যই!’ হেসে দু’জনেই বেরিয়ে গেলো।
_________________
পিচঢালা রাস্তায় পা মিলিয়ে হাটতে লাগলো দু’জনে। এইদিকে গাড়ি তেমন চলাচল করে না,করলেও কয়েকটা রিক্সা বা মাঝে মাঝে বাইক। রাস্তার ধারে হাতে হাত দিয়ে হেটে চলেছে মেঘ আর শুভ্রতা। মৃদ্যু বাতাসে খালি পায়ে হাটতে দারুণ লাগছে।
‘আচ্ছা আপনি আমার পছন্দ গুলো এতো নিখুঁত ভাবে জানেন কি করে? আমাদের তো এরেঞ্জ ম্যারেজ,কথাও হয় নি। তাও জানেন কি করে?’ শুভ্রতা ঘাড় কাত করে মেঘের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে। ল্যাম্পপোস্ট এর আবছা আলোয় সাথে পাশ কেটে যাওয়া বাইকের হেড লাইটের আলোয় মেঘের মুখ ভেসে উঠে শুভ্রতার কাছে। পরক্ষণে পাশ কাটিয়ে বাইক চলে যাওয়াতে আবারও আবছা হয়ে যায়। তাও শুভ্রতা অনুভব করে মেঘের মুচকি হাসি টা। এখন যদি সেটা সরাসরি দেখতো তাহলে নিশ্চিত মনে মনে বলত,,’আপনার হাসিটা এতো সুন্দর কেনো!’
‘উত্তর তোমার আশেপাশেই আছে। মন দিয়ে ভাবো,ভাবলেই পেয়ে যাবে। আসলে আমরা মানুষরা যে কোনো সিচুয়েশনে সবকিছু জটিল করে ভাবি,কিন্ত সেটার সহজ সমাধান আমাদের হাতের নাগালে পাওয়া যায়!’
‘হ্যাঁ আর আপনি যে কথাটা সহজভাবে বলা যায়,সে কথাটা জটিল ভাবে বুঝিয়ে আমার ছোট্ট মাথাটাকে হ্যাং করে দেন!’ শুভ্রতার কথায় মেঘ মুচকি হেসে শুভ্রতার পানে তাকায়। মেঘের হাসিটার মানে শুভ্রতা বুঝে উঠলো না। তাও এই সবকিছু বাদ দিয়ে সে চায় সময়টা উপভোগ করতে।
‘আচ্ছা আপনি কখনও কাউকে ভালোবেসেছেন? বা রিলেশন করেছেন?’ শুভ্রতার কথায় মেঘ একটু দাঁড়িয়ে পড়ে, মেঘের দাঁড়িয়ে যাওয়া দেখে শুভ্রতা খানিক হকচকিয়ে গেলো। সে কি কোনো ভূল প্রশ্ন করেছে! মাথা তুলে মেঘের দিকে তাকায়,মেঘ শান্তভাবে শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে আছে। শুভ্রতার মনে হালকা ভয়ের আভাস ফেলো। কিন্ত মেঘ আবার হাটা শুরু করতে স্বস্তির শ্বাস ফেলে।
‘আচ্ছা আমি কি ভূল কিছু বললাম? উনি আমার স্বামী আমি জিজ্ঞাস করতেই পারি,আমি যেমন আমার সব কথা উনাকে বলেছি,উনিও তো বলতে পারেন।অবশ্য আমি জোর করবো না। বলার হলে এমনিতেই হয়তো বলবেন।’ নিজের মনে মনে কথাগুলো বলে নিজেকে শান্ত করে শুভ্রতা।
‘তুমি যেদিন তোমার প্রথম প্রশ্নটার উত্তর বের করতে পারবে,সেদিন সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে!’ মেঘের হঠ্যাৎ কথায় চমকে যায় শুভ্রতা, কিন্ত মেঘের কথার মানে বুঝতে পারে নি। মেঘকে এখন একজন জটিল মানব মনে হচ্ছে। তাও ভালো লাগছে। মোটকথা, যাকে ভালোবাসি তার সবকিছুই হুদাই ভাল লাগে!
‘আইসক্রিম খাবা?’
‘এই জন মানবহীন জায়গায় আপনার জন্য কে আইসক্রিমের দোকান নিয়ে বসে থাকবে শুনি?’
মেঘ শুভ্রতার কথার উত্তর দিলো না। চুপ’চাপ কিছুদূর গিয়ে অন্য গলিতে ডুকে। গলিতে ডুকে শুভ্রতা খানিকটা চোখ বন্ধ করে ফেলে। এতোক্ষণে প্রায় আবছা আলোয় হাটছিলো তো, তাই হঠ্যাৎ তীব্র আলো চোখ নিতে পারে নি। নিজেকে ধাতস্থ করে চোখ খুলে। এই পুরো জায়গাটা খাবারে স্টল। হয়তো কোনো মেলা বসেছে। মানুষের ভীড়ে ভরপুর। পিঁপড়ের মতো মানুষে গিজগিজ করছে।
‘দেখলে এই শুনশান রাস্তায় আমার জন্য আইসক্রিম না,সব খাবার নিয়েই বসে আছে।’ মেঘের কথায় শুভ্রতা ভেংচি কাটে। মেঘ তা দেখে কিছু বলে না,গা বাঁচিয়ে অতি সাবধানে শুভ্রতাকে নিয়ে ভেতরে যায়। পুরো মেলাটা খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। চারদিকে লাইটিং,ফুল,বেলুন শুভ্রতা চারদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে শুধু। শুভ্রতার পাশে মেঘ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুভ্রতাকে দেখছে। বিশেষ করে শুভ্রতার ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসিটা।
‘মেঘ চলুন কিছু কিনি!’
‘আমার কাছে টাকা নাই!’ মেঘের কথায় শুভ্রতা মুখ বাঁকিয়ে বলে,,’আপনার কাছে না থাকলে নাই, আমার বরের কাছে আছে!’
‘তা কে আপনার বর শুনি?’
‘রসকষহীন, গোমড়ামুখো সকিনার বাপ!’
‘ছিহ শুভ্র। নিজের মেয়ের এই রকম একটা নাম রাখবা? ওয়াক, মেয়ে তোমার একটা চুলও আস্ত রাখবে না!’
‘আপনার আন্দাজি বকা শেষ হলে চলেন,আমি কিছু কিনবো!’ শুভ্রতা মেঘকে টানতে টানতে দোকানের দিকে নিয়ে যায়।
চলবে..?
(ভূল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন। ধন্যবাদ)