#কি_করে_বোঝাই_ভালবাসি (৮,৯,১০,১১,১২)
৮.
রাতের খাবার টেবিলে কৌশিককে না দেখে রিয়াদ সাহেব তার বোনের দিকে তাকালেন।
-কোথায় আমার রাজপুত্র?
-পরে খাবে বলেছে ভাইজান।
-কি হয়েছে বলেছে কিছু তোকে?
-না। কিছুতেই বলে না। কত বার যে জিজ্ঞেস করলাম।
-এক কাজ কর ওই যে ওর বন্ধু বান্ধব মানে যার বিয়েতে গিয়েছিল তাদের আর রনিকে দাওয়াত করতে বল এই শুক্রবারে। ওদের দিকে লক্ষ্য রাখবি। দেখবি ঠিক গল্পে গল্পে বলে ফেলবে। পারলে লোক লাগিয়ে রাখবি।
-কি যে বলেন ভাইজান।
কৌশিকের খাবার নিয়ে রাহেলা কৌশিকের ঘরে আসে। এলোমেলো হয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে ছেলেটা।
-এই বাবু ওঠ, খাবি না? বাবু…
-ওহ তুমি।
-খেয়ে নে বাবা। কত রাত হয়ে গেছে।
-খিদে নেই ফুপি।
-এমন করলে হয় বাবা। যা হাতমুখ ধুয়ে আর আমি খাইয়ে দিই।
অনিচ্ছা স্বত্তেও ওঠে সে। হাতমুখ ধুয়ে এসে বসে। খাওয়ার মাঝখানে রাহেলা বলেন,
– শোন তোর বন্ধু আর বন্ধুর বউকে দাওয়াত কর একদিন। রনিকেও বল। সবাই মিলে হইচই করলে তোর ভাল লাগবে।
-হঠাৎ দাওয়াত কেন ফুপি।
-কি বলিস, বিয়ে খেয়ে এলি। দাওয়াত করতে হবে না। তোর বাবাই বলছিল দাওয়াতের কথা।
-বাবা? তোমাদের মতলব কি বলতো?
-মতলব আবার কি রে। দাওয়াত করার মধ্যে আবার মতলব কি? শুক্রবারের বল।
-আচ্ছা আমি বলে দেব।
ফুপি চলে যেতেই রনিকে ফোন করলো কৌশিক।
-কি রে মজনু হয়ে গেলি নাকি? আসার পর আর কোন পাত্তাই নেই? লাইলীর কি খবর?
-কি যে বলিস। অফিসের কাজে ব্যাস্ত।
-তোর আবার অফিসের কাজ কিরে? বাপের অফিস, খালি তো হুকুম করবি।
– ভাগ শালা। শোন শুক্রবার রাতে ফ্রি আছিস?
-কেন রে?
-আমাদের বাসায় দাওয়াত। সয়ং পিতাজীর হুকুম। শান্তদের ও বলবো।
-তাহলে তো আসতেই হবে।
-চলে আসিস তবে।
-আচ্ছা।
শান্তকেও ফোন করে দাওয়াত দিয়ে দেয়। তারপর ফোন নাড়াচাড়া করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে।
৯.
শুক্রবার বলেই সকাল সকাল শান্তদের বাসায় এসেছে তিথি। সকাল থেকেই চিলেকোঠার ঘরে সে। বেশ বড় সড় দুই ব্যাগ ভর্তি একরে ফেলেছে ইতিমধ্যেই। আফরোজা বেগম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তিথির কার্যকলাপ দেখছেন।
-কি শুরু করেছিস বলতো? তোকে কেন এ বাড়ি ছাড়তে হবে? আমি বা তোর চাচা তো তোকে কিছু বলিনি। আর বাড়িটা তো আমাদের নাকি?
-তোমাদের তা তো বুঝলাম চাচী কিন্তু তোমাদের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী চায় না আমি এ বাসায় থাকি।
-তার চাওয়াটাকে কেন প্রাধান্য দিচ্ছিস? শোন শান্ত তো এখানে এসে থাকবে না। তুই মাঝে মাঝে এসে থাকলে আমার কত ভাল লাগে বলতো।
-আসবো চাচী। এসে অবশ্যই দেখা করে যাব। তবে থাকা হবে না আর।
ধীর পায়ে নীচে নেমে আসেন তিনি। কোন কুক্ষনে যে এমন ছেলে পেটে ধরেছিলেন।
সন্ধ্যা মিলিয়ে যাবার আগেই কৌশিকের বাড়িতে হাজির হয়েছে রনি। দুই বন্ধুতে ছাদের কোনায় চেয়ার নিয়ে বসে। গৌধুলী মিলিয়ে গেছে বেশ আগে। এখন শুধু ধুসর একটা আলো।
-কি খবর বল তোর? চেহারার এই অবস্থা কেন? মনে হচ্ছে ঝড়ের মধ্যে পড়ছিস।
-এইতো চলতেছে রে। কিছু ভাল লাগে না। ফোন করে সরি তো বলেছি। তবুও কেমন জানি মনে হয়। একবার মনে হয় ভুলটা আমার। আগ বাড়িয়ে গেছি। আবার মনে হয় যা করছে ঠিক করেছে। এমনি হওয়া উচিৎ।
-তোর তো দেখি বেহাল অবস্থা। তো কি করবি এখন? শান্তকে জানাবি ?
-পাগল হয়েছিস। জানলে আবার কি না কি করে। আর আমি তো এটাও জানি না যে ওদের সম্পর্ক কতটা ছিল।
-সেটা আর এখন জেনে কি হবে। শান্ত তো আর ওকে বিয়ে করতে যাচ্ছে না। তোকে একটা কথা বলি, আঙ্কেল আর ফুপিকে বলে শান্তর আম্মুর সাথে কথা বল। তুই তো আর এখন প্রেম করবি না। তো বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়ে দে।
দুজনে কথায় এতই মগ্ন ছিল যে রাহেলা যে পেছনে দাঁড়ানো খেয়ালই করনি।
-কি রে? তোরা চা টা কিছু খাবি এখন? নাকি একেবারে ডিনার?
দুজন এমন চমকে গেল যে তিড়িং করে লাফিয়ে উঠলো। রাহেলা হাসতে শুরু করলেন।
-যা নীচে ঘরে গিয়ে বোস। এখানে বসে মশার কামড় খাবার দরকার কি?
রাহেলা চলে যেতেই রনি বলে,
-তোর ফুপি কি হাওয়ায় ভেসে চলে?
এবার দুজনেই হেসে ওঠে।
নীচে আসার কিছুক্ষনের মাঝেই শান্তরা চলে আসে। তবে মিথিলা থাকার কারনে আর তেমন কথা হয়ে ওঠে না। ডিনার শেষে সবাই মিলে কিছুক্ষন বসে। তারপর ওরা চলে যেতেই কৌশিক নিজের ঘরে আসে। ফোনটা হাতে নিয়ে ট্যাপ করতেই ম্যাসেজটা ভেসে ওঠে,
“ওই দিন আপনাকে একটু বেশি বেশিই বলে ফেলেছি। আমিও অনেক দু:খিত তার জন্য।”
যাক অপমানের কাঁটাটা বেশ কদিন ধরেই খোঁচাচ্ছিল। এখন সেটা আর নেই।
১০.
মায়ের কাছে শুনেলো শান্ত যে তিথি বাড়ী ছেড়ে চলে গেছে। কি আজব মেয়েরে বাবা। পরের বাড়িতে থাকবি আর একটু অপমান হজম করতে পারবি না এটা কেমন কথা। অফিস থেকে ফেরার পথেই তাই ফোন করে তিথিকে। কিন্তু ফোন তো ধরলই না। কয়েকবার কল করার পর বুঝলো তার নাম্বারটা ব্লক করে দিয়েছে তিথি। মনে হচ্ছে তুলে আছাড় দেয় ওই মেয়েকে।
বাসায় ফিরে দেখে মিথিলা অফিস থেকে ফিরে ফোন নিয়ে বসে আছে। সে কোন কথা না বলে বাথরুমে ঢুকে পড়ে।
খাবার টেবিলে এসে দেখে মিথিলা বাইরে থেকে খাবার অর্ডার করেছে।
-আজও বাইরের খাবার অর্ডার করেছো।
-রোজ রোজ রান্না করতে আমার ভাল লাগে না। আর আমি পারিওনা তেমন একটা রান্না। মাকে বলেছি একটা রান্নার লোক জোগাড় করতে।
-মার সাথে কথা হয়েছে তোমার?
-এইতো বিকেলেই কথা হল। আচ্ছা তিথি বলে কেউ থাকতো নাকি তোমাদের বাড়িতে?
-সালাম চাচার মেয়ে।
-কই আগে তো বলনি তিথির কথা। তোমাদের বাসায় নাকি থাকতো? বিয়েতে তো দেখলাম না?
-কেন কি বলতে হবে। বাসায় তো কত লোক থাকে। সবার কথা বলে বেড়াতে হবে নাকি তোমাকে?
-তেমন কেউ নয় বলছো? তাহলে ওকে এতবার ফোন করেছো কেন?
-তুমি আমার কল লিস্ট চেক করেছো?
-এমনিতেই দেখছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি আসলেই চেক করার দরকার আছে।
-আর কখনও আমার কোন জিনিসে হাত দেবে না। তাহলে কিন্তু..
-তাহলে কিন্তু কি? নিজের কথা চিন্তা কর শান্ত। আমার সাথে বাড়াবাড়ি করবে না। আমি কিন্তু ছেড়ে দেব না।
শান্ত খাবার রেখে উঠে পড়ে। বিয়ের আগের জীবনটাই তো ভাল ছিল। অযথা যেচে বিপদ ঘাড়ে নেয়া। কেন যে ফোন করবার পর ডিলিট করে ফেললো না। এখন থেকে সাবধান হতে হবে। ফোনের পাসওয়ার্ড বদলে ফেললো।
তিথিকেও ছেড়ে দেবে না সে। তাকে অপদস্ত করল সবার কাছে। এইসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে যাবার পর ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো।
-এই কুত্তা ফোনের পাসওয়ার্ড বদলেছিস কেন?
মাথা আর কাজ করছে না শান্তর। রাগের মাথায় দিল কষিয়ে এক চড়।
-আমাকে কুত্তা বলিস। এত বড় সাহস তোর। আর তোকে না মানা করলাম যে আমার ফোন ধরবি না। তারপরেও ধরেছিস।
চুলের মুঠি ধরে আরেক চড় দিয়ে ঘর থেকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় মিথিলাকে।
চুপ করে বসে পড়ে দরজার কাছে।
ওদিকে মিথিলা চিৎকার করেই যাচ্ছে।
-তুই কি মনে করেছিস আমাকে মেরে পার পেয়ে যাবি? তোকে আমি পুলিশে দেব। এমন মামলা করবো সারাজীবন জেলে পঁচে মরবি।
মিথিলা তার বাবাকে ফোন করে, থানায় ফোন করে। পুলিশ কিছুক্ষনের মাঝেই শান্তকে ধরে নিয়ে যায়।
১১.
“তোমার জন্য হৃদয়ের কতটা জমিন খোঁড়া
আছে, তুমি তার বিন্দু বিসর্গ বুঝবেনা আজ…
আমার বসন্ত মানে তুমি,
এক ঝলক বৃষ্টি,
আমার বসন্ত মানে …
বেলী ফুলের গন্ধে মন কেমন করা…”
ম্যাসেজটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তিথি। এই লোকটার নিশ্চই মাথা খারাপ।
সে লিখে,
-‘মাথা কি পুরা নষ্ট হয়ে গেছে?’
সাথে সাথেই জবাব আসে,
-‘আপনার জন্যই তো হল।’
-‘কি বলছেন এসব? কতটুকু চেনেন আমাকে?’
-‘যতটুকু চিনলে একজনকে ভালবাসা যায়।’
-‘আপনি মানসিক ডাক্তার দেখান।’
-‘আপনি কি হবেন আমার মনের ডাক্তার?’
নাহ্ এই লোকের সাথে কথপোকথন চালানো বিপজ্জনক। তিথি আর কোন জবাব দেয় না। কিন্তু ফোনটা হাতেই রাখে। কেন জানি মনে হয় আবার কিছু লিখে পাঠাবেন।
-‘একটু পথ তুমি এসো, আর একটু আসি আমি..
দেখবে হঠাৎ মানে খুঁজে পাবে আমাদের পাগলামি।
একটু পথ তুমি এসো.. আর একটু আমি।’
তিথিও লিখে …
-‘তার চেয়ে বরং দূরেই থেকো
যেমন দূরে থাকে ছোঁয়া থেকে স্পর্শ
রোদ্দুরের বু্ক থেকে উত্তাপ
শীতলতা থেকে উষ্ণতা
প্রেমের খুব গভীর ম্যাপে যেমন লুকিয়ে থাকে ভালোবাসা,
তেমন দূরেত্বেই থেকে যেও-
এক ইঞ্চিতেও কভু বলতে পারবে না কেউ
কতটা কাছাকাছি এসেছিলে বলে দূরত্বের পরিমাপ দিতে পারেনি পৃথিবী।
কৌশিক চুপ করে যায়। কি করে সে বোঝাবে তার মনের কতটা যায়গা দখল করে ফেলেছে তিথি। ফোন বাজতেই ফোনটা হাতে নেয়। ভেবেছিল তিথি কিন্তু অপরিচিত নাম্বার।
-হ্যালো..
-কৌশিক আমি শান্ত।
-কিরে এত রাতে কি ব্যপার। দোস্ত খুব ঝামেলায় পড়ে গেছি। তো পরিচিত কোন উকিল থাকলে একটু যোগাযোগ কর। আমি ধানমন্ডি থানায় আছি। আর পারলে তুই এখুনি আয়।
গাড়ীর চাবিটা নিয়ে কৌশিক বাড়ি থেকে থানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। থানার অফিসার ইনচার্জ এর কাছে সব শুনে সে তো অবাক হয়ে যায়। এমনটাও হয় নাকি?
-আপনি এক কাজ করেন আপনার বন্ধুর পক্ষে উকিল ঠিক করেন। আজকে তো আর কিছু করতে পারবেন না। কাল সকালে আসেন। আর ওনার পরিবারের লোকদের খবর দেন।
১২.
আফরোজা বেগম আর ইলিয়াস সাহেব পরের দিনই ঢাকায় চলে এলেন। অন্য কাউকে এ বিষয়ে জানানো হলো না। দুই পরিবারের সবাই বসে আলোচনা করে শান্তকে ছাড়িয়ে আনা হল। তবে শান্ত আর মিথিলা এক সাথে আর থাকবে না এই সিদ্ধান্ত পাকাপাকি হল।
শান্ত নিজের ঘরে চুপচাপ শুয়ে ছিল। যে ঝড় গেছে তার উপর দিয়। ভাগ্য ভাল যে কৌশিক ছিল। চাকরিটাও বোধহয় আর করা হবে না। অন্য কোথাও খুঁজতে হবে।
-শান্ত আসবো?
মায়ের কথায় খুব অবাক হয়। তার ঘরে আসতে মা অনুমতি চাইছেন? সে উঠে বসে। আফরোজা বেগম বিছানার পাশে এসে চেয়ার টেনে বসেন।
-তুমি এমন জঘন্য কাজ কি করে করলে? একটা মেয়ের গায়ে হাত তুলতে তোমার বিবেকে বাঁধলো না? তুমি না শিক্ষিত ছেলে?
-রাগের মাথায় করে ফেলেছি মা।
-রাগ হলেই মারতে হবে?
-এর জন্য কি আমার শাস্তি হয়নি? আমি কি হাজতে গিয়ে থাকলাম না? তুমি কি চেয়েছিলে আমি বছর পাঁচেক জেলখানায় থাকি?
-তোমার সে শাস্তি অনেক কম শান্ত। ওরা তো তোমাকে ছেড়ে দিয়েছেন। আমি হলে কখনই ছাড়তাম না। জেলে ঢুকিয়েই ছাড়তাম। কোনো মেয়েকেই তুমি তার প্রাপ্য সন্মান করতে শেখো নাই।
-শিখি নাই তো। কি করে শিখবো বল? বাবা কি তোমাকে তোমার প্রাপ্য সন্মান দিয়েছে? তাহলে কেন তুমি বাবাকে পুলিশে দাও নাই মা। তুমি কি ভুলে গেছ আমি যখন ছোট ছিলাম তখন প্রায় রাতেই বাবা তোমাকে মারতেন। আমি চুপ করে ঘুমের ভান করে পড়ে থাকতাম। কেন তুমি ছেড়ে দিলে বাবাকে?
আফরোজা বেগমের চোখে পানি চলে আসলো।
-তাই বলে তুমি তোমার বাবার মত হবে। মায়ের কষ্ট বুঝবে না? আর কেন চুপ থেকেছি জান? তোমার জন্য। তোমাকে নিয়ে কোথায় যেতাম? অল্প বয়সে বিয়ে হওয়া আমি কি পড়ালেখা শিখেছিলাম বেশী? যে নিজের পায়ে দাঁড়াবো। আর খুব ভাল করেই জান তোমার মামা মামীরা আমাকে তাদের সংসারে জায়গা দিতেন না। তবে তুমি কিন্তু বাবার শিক্ষা না নিয়ে উল্টোটাও করতে পারতে। যাক আমরা কাল চলে যাব। তুমি তোমার মত করে থাক।
বলেই আফরোজা বেগম উঠে পড়লেন। শান্ত বিছানা থেকে নেমে তার মায়ের পা জড়িয়ে ধরে।
-আমাকে মাফ করে দাও মা। ভুল হয়ে গেছে।
-আমি মাফ করার কে? যাদের কাছে অপরাধ করেছো তাদের কাছে মাফ চাও।
তিনি আর দাঁড়ালেন না।
চলবে…
এমি