#অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল_মিহির
[০৬]
দিনটা ছিলো বৃহঃস্পতিবার। ঘড়ির কাটা এগারোটা ছুঁই ছুঁই। আকাশে থাকা লাল উল্কাপিণ্ড তার আলোকরশ্মিতে গরম করে রেখেছে পৃথিবী। আজ সারাদেশে অসহনীয় গরম পরেছে। শরিরের চামড়া জ্বালাপালা হয়ে গেছে শেফালীর। বিরক্তিতে নাক মুখ কুঁচকে রেখেছে সে। ইচ্ছে ছিলো না শপে আসার। কিন্তু তার মা জরুরি ভিত্তিতে পাঠিয়েছে। মার্কেটে এসে বড় শপের দোকানে ঢুকলো শেফালী। মুহূর্তেই গায়ে হিম শীতল হাওয়ায় ঠান্ডা হয়ে গেলো। সূর্যের তাপের আগুনে জ্বলে যাওয়া কলিজাটা যেন ঠান্ডা এসির হাওয়া পেয়ে জীবিত হয়েছে। মনটা ফুরফুরে হয়ে গেলো তার। হাত ঘড়ির দিকে চোখ বুলালো একবার। পুরো শপ এই দুপুর বেলা একদম খালি। কেবল রিসিপশনের মেয়েটা উপস্থিত। ব্যাগ থেকে বাজারের লিষ্ট বের করে দেখলো। লিকুইড দুধ, ধনিয়ার গুড়ো, মুগ ঢাল, মেজারেলা চিজ সহ আরো কিছু উপকরনের নাম লিখা আছে তাতে। শেফালীর বাবা বাসায় নেই, আর উনি আসতে দেড়ি হবে তাই শেফালী এসেছে নিতে। পুরো শপ ঘুরে ঘুরে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস গুলো নিতে লাগলো শেফালী। খুব বেশি ওজন হয়নি। একটা ব্যাগেই জায়গা হয়েছে। এখন গুনগুন করে গান গাইছে আর চিপ্সের প্যাকেট দেখছে। মূলত সে কোনটা নিবে তাই ভাবছে। তখুনি হঠাৎ নিজের খুব কাছাকাছি কারোর অস্তিত্ব টের পেলো সে। পিছু না ফিরেই শেফালী বুঝতে পারলো মানুষটা কাছাকাছি দাঁড়িয়ে তার দিকে ঝুকে আছে। এতো টাই কাছে যে মানুষটার তপ্ত শ্বাসের আওয়াজ তার কানে স্পষ্ট আসছে। চোখ বড় হয়ে গেলো শেফালীর। কে এই লোক? আস্তে আস্তে ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে তাকালো। নিজের কাধের কাছে লোকটার মুখ ছিল। যার কারনে সে ঘুরতেই দুজনের মুখমণ্ডল খুব নিকটে চলে আসলো। কয়েক ইঞ্জি দূরত্ব কেবল। ভরকে গেলো শেফালী। তাৎক্ষনাৎ পিছিয়ে গেলো। লোকটাকে চিনতে পেরে শুকনো ঢুক গিললো সে।
রাকিব পকেটে দুই হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। তীক্ষ্ণ চোখে শেফালীর আপাতমস্তষ্ক দেখে নিলো একবার। বললো, ‘আপনার জুতার ফিতা বাধা এখনো হয়নি?’
আড় চোখে তাকালো শেফালী। এই লোকের সাথে যে এখানে দেখা হবে সেটা তার কল্পনার বাহিরে ছিলো। ভালো মতো ফেঁসেছে সে। একবার দরজার দিকে তাকালো। পালিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা তার মাঝে নেই। কাচুমুচু চেহারায় রাকিবের দিকে তাকালো শেফালী। দাঁত টেনে বোকা বোকা হাসি দিয়ে বললো, ‘আসলে, হয়েছে কি, ওই তো আমি, মানে।’
রাকিবও সাথে সাথে তাল মিলিয়ে বললো, ‘হুম হুম, তুমি?’
ভিতরে ভিতরে নিজের উপর বিরক্ত হলো শেফালী। মনে করতে লাগলো আজ সকালে কার মুখ দেখেছে সে? ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল যার কারনে পাশের বাড়ির ভুড়ি ওয়ালা টাক্কুর মাথাটা দেখেছিল। এই জন্যই আজ কপালে বৃহঃস্পতি দশা লেগেছে। কাদুকাদু চেহারায় রাকিবের দিকে তাকালো সে। বললো, ‘সরি ভাইয়া। আর হবে না। এবারের মতো মাফ করে দেন প্লিজ।’
চোখ ছোট ছোট করে তাকালো রাকিব। শেফালীর কাদুকাদু চেহারা দেখে হাসি পেলো তার। কিন্তু মোটেও হাসলো না। বরং উপরে রাগি ভাব রেখে বললো, ‘মেয়ে তোমার জন্য আমার ছয়শো টাকা ফাউ তালে গেছে। কাপটা তুমি ভেঙ্গেছিলে তাই না? জরিমানা দিতে হবে বলে আমার হাতে কাপ ধরিয়ে দিয়ে নিজে পালিয়ে গেলে। ভালোই চালাক তুমি।’
‘ওই একটু।’ দাঁত কেলিয়ে বললো শেফালী। তারপর চোখ ফিরিয়ে দরজার দিকে তাকালো একবার। ঠোঁট কামড়ে ভাবতে লাগলো কি করবে সে। বিল পে করা হয়নি। নাহলে দৌড়ে পালিয়ে যেত। এইগুলো ফেলেও যাওয়া যাবে না নাহলে মায়ের কেলানি খেতে হবে। কি করবে সে ভাবতে লাগলো। এমনি সময় খেয়াল করলো রাকিব তার দিকে এগিয়ে আসছে। হকচকিয়ে গেলো শেফালী। রাকিবকে এগুতে দেখে পিছালো সে। পেছনে বড় কাচের গ্লাসে পিঠ ঠেকেছে তাই আর পিছাতে পারেনি আর। ভয়ে ভয়ে রাকিবের দিকে তাকালো সে। শুকনো ঢুক গিললো একটা।
রাকিব এগিয়ে এসে ঝুকে দাঁড়ালো তার দিকে। এক হাত শেফালীর এক পাশে রাখলো। শেফালী ভয়ে চোখ কুঁচকে ফেলেছে। রাকিব প্রগাঢ় ভাবে দেখতে লাগলো শেফালীকে। ছিমছাম পাতলা গড়নে ফর্শা গায়ের রঙ। হাল্কা কুঁকড়ানো চুল গুলো পিঠ পর্যন্ত। কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে গালে বড়সড় টুল পরে বোধহয় হাসলে আরো ফুটে উঠবে। পরনে বেবি পিংক কালার টপ শার্ট, জিন্স। সব মিলিয়ে বেশ ভালোই। তবে একটু বেশি চঞ্চল। শেফালীর চেহারার অবস্থা দেখে নিঃশব্দে হাসলো রাকিব। মৃদু গলায় বললো, ‘তোমার জন্য আমার ছয়শো টাকা লস হয়েছে। এবার আমাকে সাড়ে ছয়শো টাকা দাও।’
অবাক হয়ে চোখ খুললো শেফালী। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘কাপ ছয়শো টাকা তাহলে সাড়ে ছয়শো দিবো কেন?’
‘সাতশো দাও এবার।’
‘সাতশো মানে?’
‘সাড়ে সাতশো। কথা বললেই দাম বাড়বে।’
চেহারায় বিরক্তি আনলো শেফালী। কিছু কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু ‘কথা বললে দাম বাড়বে’ তাই কথা বাঁড়ায় নি। চেহারা কালো করে ব্যাগ থেকে টাকা বের করতে লাগলো। আড় চোখে একবার দরজায় তাকালো। রাকিব হাত সরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। সুযোগ পেয়ে গেলো শেফালী। চটজলদি রাকিবকে ধাক্কা দিয়ে ব্যাগ হাতে নিয়ে দৌড় লাগালো। হঠাৎ আকর্স্মিক ঘটনায় তব্দা খেলো রাকিব। কিছুসময় লাগলো ঘটনা বুঝতে। বুঝতে পেরে দরজার দিকে তাকালো। শেফালীর বাচ্ছামো দেখে হেসে ফেললো সে। তাকিয়ে রইলো শেফালীর দৌড়ে চলে যাওয়ার দিকে।
শেফালী রিসিপশনের মেয়েটির কাছে এসে ‘বিল তার আব্বু দিবে’ বলে দৌড়ে চলে গেলো। এই শপের মালিক আর তার আব্বুর বেশ ভালো বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক। তাছাড়া এখানে তার রেগুলার আসা যাওয়া চলে। সেই সুবাধে অসুবিধা হয়নি তার। বাহিরে এসে রিকশা ডেকে উঠে পরলো তাড়াতাড়ি। বুকে হাত রেখে জুড়ে জুড়ে কয়েকটা নিশ্বাস নিলো। বললো, ‘ঠ্যাকা পরছে আমার তোরে সাড়ে সাতশো টাকা দিতে হুহ।’
বাসায় এসে কলিংবেল বাজালে মিতালী দরজা খুললো। শেফালী তার হাতে ব্যগটা দিয়ে বাসায় ঢুকেই সোফায় হেলাম দিয়ে বসে পরলো। অস্থির হয়ে নিশ্বাস ছুঁড়তে ছুঁড়তে বললো, ‘উফফ বড় বাঁচা বেঁচে গেছি বুবু। আল্লাহ গো। এই বৃহঃস্পতির দশা যেন কপালে আর না লাগে।’
মিতালী ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে তার দিকে তাকালো। নিশ্চুপ থেকে দরজা লাগিয়ে দিলো। ব্যাগ টা রান্না ঘরে নিয়ে রেখে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এনে দিলো। শেফালী তৃষ্ণার্ত কাকের মতো গ্লাস হাতে নিয়েই ঢকঢক করে পুরো গ্লাসের পানি এক চুমুকে শেষ করে ফেলেছে। বিরক্ত হলো মিতালী। কোমড়ে এক হাত রেখে শাসনের স্বরে বললো, ‘তোকে কত বার বারণ করেছি এক নিশ্বাসে পানি খাবি না।’
শেফালী পানির গ্লাস টি-টেবিলের উপর রাখল। অপরাধীর মতো মুখ করে বলল, ‘সরি বুবু। খেয়াল ছিলো না।’
‘তিন নিশ্বাসে পানি পান করা সুন্নত। নিশ্বাস ফেলার আগে গ্লাস থেকে মুখ সরিয়ে নিবি। মনে থাকবে?’
শেফালী বাধ্য মেয়ের মতো মাথা দুলিয়ে বলল, ‘জ্বি মেরি বুবুজান, মনে থাকবে।’
মুচকি হাসলো মিতালী। এক হাতে শেফালীর কুঁকড়ানো চুল গুলো এলোমেলো করে দিয়ে গাল টেনে দিল। বিরক্তিতে আবারো হাত ঝামটা মেরে ফেলে দিল শেফালী। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে গালে হাত বুলাতে লাগলো। বললো, ‘সুযোগ পেলেই আমার গালে হামলা করো তুমি। যাও এখান থেকে। ভাল্লাগে না একদম।’
বসা থেকে উঠে গটগট পায়ে রুমে চলে গেলো। শেফালীর রাগের মুখখানি দেখে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো মিতালী। হাসি তার থামছে না। তখুনি দাদীর রুম থেকে খেঁকিয়ে উঠার আওয়াজ এলো।
‘বলি মাইয়া মানুষের হাসির এতো আওয়াজ ক্যা? আস্তে হাসতে পারছ না? রাস্তা ঘাট, বাড়িঘর কাপাইয়া ফেলতাছোস। অলক্ষি মাইয়া। এর লাইগাই বিয়াশাদীর নাম গন্ধ নাই।’
তাৎক্ষনাৎ হাসিমাখা মুখখানি কালো হয়ে গেলো মিতালীর। নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো শুধু। তার জীবনটা বড়-ই অদ্ভুত। হাসতে হলে, কাঁদতে হলে অন্যের পারমিশন নিতে হবে। হায়রে জীবন!
দুই বোনের কথোপকথনের আওয়াজে রুম থেকে বেড়িয়ে এসেছিল আমেনা। রান্না ঘরের কাছে আসার পরেই কর্ণপাত হলো শাশুড়ির কর্কষ কণ্ঠস্বর। মহা বিরক্ত হলো সে। চুল গুলো টাইট করে খোঁপা বাধতে বাধতে রান্না ঘরে আসলো। ব্যাগ থেকে জিনিসপাতি বের করতে করতে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো, ‘সারাজীবন আমাকে কটুকথা শুনিয়ে এসেছে। আর এখন শেষ বয়সে এসেও আমার মেয়েকে রেহাই দিচ্ছে না। ভাল্লাগে না আর এই সংসার। মেয়ের অপমানে নিজেকেই মা:রতে ইচ্ছে করে।’
#অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল_মিহির
[০৭]
দুপুরের মধ্যভাগের সময়। খাওয়া দাওয়া শেষে এখন প্রস্তুতি ভাত-ঘুমের। সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পরেছে। তীব্র উত্তাপ কমে এখন পরিবেশ শীতল। মৃদু বাতাস প্রভাহমান। ছাদ থেকে স্পষ্ট নিচের মাঠে ফুটবল খেলা দেখা যাচ্ছে। অংকুরদের বাসা থেকে মাঠের দূরত্ব একদম কম। সেই সুবাধে মাঠে খেলতে থাকা ছেলেদের উল্লাসিত কন্ঠ ধ্বনি পাঁচ তলার ছাদ থেকেও শুনা যাচ্ছে। রেলিং’এ হেলান দিয়ে রাকিব ফুটবল খেলা দেখছে। অংকুর তার পাশে দাঁড়িয়ে মোবাইলে ইডিটিং করছে। মৃদু বাতাসে ছাদের এক পাশে থাকা ফুল গাছ গুলো দুলছে। সেই ফুল গাছ গুলোতে স্বযত্নে পানি দিচ্ছে অংকুরের মা সুপ্তি। অর্ধ-বয়স্ক মহিলার কিছু চুল পেকে সাদা বর্ণ ধারন করেছে। চোখে এটে আছে কালো ফ্রেমের চশমা। মহিলাকে ভয় পায় সবাই। ঝাঁঝ মেশালো গলায় কথা বলে। বাড়িওয়ালী সেই সুবাধে এই বিল্ডিং’এ ধাপট বেশি। খিটখিটে মেজারের হলেও ছেলেদের প্রতি তার আকাশ সমান ভালোবাসা। দুই ছেলে যেন তার চোখের মনি, হিরামানিক। ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে ছাদে আসলেও এখন রেগে আছে প্রচুর। কারন ছাদের গোলাপ গাছের নতুন ফুলটা ছিঁড়ে ফেলে রেখেছে কেউ। তাই তো থেমে থেমে প্যানপ্যান করছে।
‘আংকুরের বাপ আসুক আজকে। এমন ভাড়াটিয়া রাখার দরকার নাই। ভাড়া দেওয়ার আগে বলছি পর্যন্ত। তাও আমার গাছের ফুল ছিঁড়ে। কত বড় সাহস।’
বিরক্ত হলো অংকুর। মোবাইল থেকে দৃষ্টি তুলে মায়ের দিকে তাকালো। কণ্ঠস্বর একটু উঁচু করে বলে উঠলো, ‘হইছে তো আম্মু। বাচ্চা মানুষ বুঝে নাই তাই ছিঁড়ে ফেলছে। গাছ তো আর ভাঙ্গে নাই। এবার থামো প্লিজ।’
ছেলের উপর রেগে গেলেন সুপ্তি। কপাল কুঁচকে রাগি গলায় বললেন, ‘তুই চুপ কর। তাদের বলি নাই আমি? প্রথমেই বলছি আমার গাছে যেন হাত না লাগায়। তাও ফুল ছিঁড়বো কেন? আজই এমন ভাড়াটিয়া বের করবো আমি। নতুন ভাড়াটিয়া পেলে পাবো নাহলে বাসা খালি থাক।’
অংকুর বিরক্তির চূড়ান্ত পর্যায়ে। অসন্তুষ্ট হয়ে ফুঁশ করে নিশ্বাস ছুঁড়লো। তার রাগ দেখে নিরবে বিদ্রোপ হাসলো রাকিব। ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকে বললো, ‘চাচিমা তার গাছগাছালির ব্যাপারে একটু বেশি সিরিয়াস।’
অংকুর চেহারায় রাগ ফুটিয়ে বললো, ‘তুই জানিস ভাড়াটিয়া রা আম্মুর কয়েকটা স্বভাবের কারনে অসন্তুষ্ট? ভাড়াটিয়া বাদ দে ভাই আমারই সহ্য হয় না। মাঝে মাঝে একটু বেশি করে ফেলে। ধানিলঙ্কা টাইপ।’
অংকুরের কথায় এবার উচ্চস্বরে হেসে উঠলো রাকিব। তার হাসি দেখে অংকুর নিজেও হেসে ফেললো। দুই ভাইয়ের হাসি-মাখা মুখ-খানি দেখে কলিজা শান্তিতে ভরে এলো সুপ্তির। যদিও হাসির কারণ সম্পর্কে অবগত নয় সে। তাকিয়ে রইলো ছেলে দুটোর দিকে। দুজনই তার কাছে সমান। হয়তো রাকিবকে পেটে ধরেনি কিন্তু মন থেকে নিজের সন্তানের মতোই ভালোবাসে সে। রাকিবের মা জুলি তার স্কুল জীবনের বান্ধুবি ছিলো। দুজনের ইচ্ছে ছিল একই পরিবারে বিয়ে করবে। হলোও তাই। সুপ্তির বিয়ের পর তার দেবরের জন্য জুলিকে পছন্দ করেন তার শাশুড়ি। তার বিয়ের ঠিক এক মাস পর জুলির বিয়ে হয়। দুই জা একই সংসারে মিলেমিশে থাকতে শুরু করে। তারপর দুইজন এক মাস আগে পরে কন্সিভ করে। সেই সুবাধে রাকিব আর অংকুর সমবয়সী। যখন রাকিব ও অংকুরের বয়স সাত কি আট তখন ঘটেছিল পৃথিবীর সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা। সুপ্তির আজও মনে পরে সেই দিনের কথা।
দিনটি ছিলো বুধবার!
প্রতিদিনকার মতো দুই ভাই অফিস থেকে বাসায় ফিরে। তবে আজ দুইজন দুপুরেই চলে এসেছে। কারন তাদের অর্ধাঙ্গিনীকে ওয়াদা করেছে আজ ঘুরতে নিয়ে যাবে। কথা অনুযায়ী দুইজন দুপুরে উপস্থিত হওয়ায় সুপ্তি ও জুলি অতিরিক্ত খুশি হয়েছে। সকল প্রকার প্রস্তুতি নিয়ে খাওয়া দাওয়া করেই বের হলো কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ে যাওয়ার জন্য। তখন তারা কুমিল্লা থাকতো। বিশ মিনিটের রাস্তা অতিক্রম করে পাহাড়ের পাদদেশে আসে তারা। সুপ্তি ও জুলির বহু কালের ইচ্ছে ছিলো লালমাই পাহাড়ে চড়া। সেই ইচ্ছা পূরন করতে দুই ভাই তাদের স্ত্রীদের নিয়ে পাহাড়ে উঠতে লাগলো। আংকুর ও রাকিব একে অপরের হাত ধরে আপন মনে হেলেদুলে হাটছে। পাহাড়টা একেবারে খাড়া না। যার কারনে উপরে উঠা সহজ তবে সাবধানে উঠতে হয়। একসময় কষ্টসাধ্য করে পাহাড়ে উঠলো সবাই। এ-যেন বহুকালের সখ পূরন হওয়ার সার্থকতা। সুপ্তি ও জুলি মিলে একে অপরের হাত ধরে দূর আকাশে তাকিয়ে একইসঙ্গে ‘আআ’ বলে চেঁচাল। সবাই মিলে ছবি তুলতে লাগলো। জুলি আর রাকিবের বাবা পাশাপাশি ছবি তুলার জন্য পাহাড়ে একদম দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ালো এবং সেখানে দাঁড়িয়ে বেশ কয়েকটা ছবিও তুলেছে। হঠাৎ-ই দুর্ভাগ্যবশত মাটি ধসে যায়। যার ফলস্বরুপ জুলি ও রাকিবের বাবা পাহাড় থেকে নিচে পরে যায়। রাকিবের বাবা সেখানেই মা:রা যায়। আর জুলি মা:রা যায় হাসপাতালে আনার কিছুক্ষন পর। মা:রা যাবার আগে সুপ্তিকে জুলি বলেছিলো, ‘তুই আমার সব চেয়ে কাছের বান্ধুবি ছিলি। আমার বোন তুই। আমার ছেলেকে দেখে রাখিস। সাবধানে থাকিস বোন।’
চোখ লাল হয়ে ঝাপসা হয়ে এলো সুপ্তির। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়ালো। নিরবে চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সুপ্তি। অংকুর ও রাকিবের দিকে তাকিয়ে প্রাপ্তির হাসি দিয়ে নেমে গেলো ছাদ থেকে।
.
বেশকিছু সময় নিরবতা কাটয়ে রাকিব প্রশ্ন করলো, ‘তা সেই মেয়েটার খবর কি?’
মোবাইল থেকে দৃষ্টি তুলে রাকিবের দিকে তাকালো অংকুর। পাওয়ার বাটনে ক্লিক করে মোবাইল পকেটে রাখলো। বললো, ‘জানি না। আর দেখা হয়নি।’
‘মেয়েটা কোথায় থাকে, নাম এইসব কিছুই জানিস না?’
অংকুর মাথা এপাশ থেকে ওপাশ ঘুরালো। অর্থাৎ সে জানে না। বিরক্ত হলো রাকিব। বললো, ‘সব কিছুতে তুই এক্সপার্ট। তাহলে এই ব্যাপারে এতো কাঁচা কেন? গাধা।’
রাকিবের কথা শুনে কাচুমুচু চেহারা হলো অংকুরের। এক হাতে মাথা চুলকে থমথমে গলায় বললো, ‘তুই মেয়েটাকে চিনিস। মানে দেখেছিস আরকি।’
বিস্মিত হলো রাকিব। কন্ঠস্বরে অবাক এনে বলে উঠলো, ‘সত্যি? কোন মেয়েটা? কোথায় দেখেছি?’
‘ওই দিন ক্রিকেট খেলার সময় যেই মেয়েটার সাথে কথা বলছিলাম ওই মেয়েটাই।’
‘সত্যি?’
‘হুম! মেয়েটার সাথে মাত্র দুইবার দেখা হয়েছে। লাভ এট ফাস্ট সাইড বলতে পারিস। দ্বিতীয়বার দেখা হয়েছিল মেলাতে। ব্যাস! আমি জানি না কিভাবে কি। মানে!’
অংকুর তার মনের কথা ঠিক গুছিয়ে বলতে পারছে। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সব। কেমন অস্থির অস্থির লাগছে তার নিজেকে। মৃদু হাসলো রাকিব। মাথা উপর-নিচ দুলালো কিছুসময়। তারপর অংকুরের কাধে চাপড় মেরে মৃদু হাসলো। বললো, ‘ভালোই ফেঁসেছো দেখছি। যাক! এইদিকেই যখন থাকে আবার দেখা হবে নিশ্চিত। তখন না হয় বুদ্ধি করে পরিচয় জেনে নিস।’
.
সন্ধ্যার পর পরিবেশ অন্ধকারাবৃত। সূর্য যখন পশ্চিম আকাশে একদম ডুব দিয়েছে তখুনি চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়েছে । তবে রাস্তা-ঘাট একদমই অন্ধকার নয়। সোডিয়ামের কৃতিম আলোতে রাস্তা-ঘাট আলোকিত। শু-শু আওয়াজে তুমুল বেগে গাড়ি চলছে। কোলাহলপূর্ণ হয়ে আছে শপিংমলের সামনের স্থান। সেখানেই রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে আছে মিতালী। মূলত অপেক্ষা করছে তার শেফালীর জন্য। ভুলবশত দোকানে শপিং ব্যাগ ফেলে এসেছে যেটা শেফালী আনতে গিয়েছে। মিতালী আশেপাশে একবার তাকালো। তারপর সময়টা পার করতে মোবাইল বের করে ফেসবুকে ঢু মারলো একটু। তখন তার সামনে মাক্স পরিহিত একটা যুবক এসে দাঁড়ালো। মিতালী ছেলেটিকে একবার দেখে চোখ ফিরিয়ে নিলো।
‘এক্সকিউজ মি? একটু মোবাইলটা দিবেন? ইমার্জেন্সি একটা কল করার ছিল। আমার মোবাইলটা এই মাত্র চুরি হয়েছে।’
ছেলেটির দিকে সন্দিহান চোখে তাকালো মিতালী। কণ্ঠস্বর চেনা চেনা লাগলো তার। কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো। ভাবছে সে। মোবাইলটা কি দেওয়া ঠিক হবে? পরোক্ষনে ভাবলো হয়তো সত্যিই বিপদে পরেছে। সাতপাঁচ ভাবলো না আর। চুপচাপ মোবাইলটা এগিয়ে দিলো। ছেলেটি মোবাইল হাতে নিয়ে নাম্বার টা টাইপ করলো। ডায়াল করার কিছুক্ষন পর ছেলেটির ডান পকেটে রিং বেজে উঠলো। অবাক চোখে তাকালো মিতালী। মোবাইল না চুরি হয়ে গেছে? তাহলে এই মোবাইল কার? তাৎক্ষনাৎ বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন করলো, ‘আপনার মোবাইল না চুরি হয়ে গেছে?’
ছেলেটি মৌনতার সঙ্গে মিতালীর মোবাইলটা এগিয়ে দিয়ে দিলো তাকে। মিতালী এখনো বিস্মিত হয়ে আছে। নিরবে নিজের মোবাইলটা হাতে নিয়ে প্রতিত্তুরের আশায় তাকিয়ে রইলো। ছেলেটি মাক্স খুলেই দাঁত কেলিয়ে হাসলো। তার চেহারা দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো মিতালী। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে অস্ফুটিত কন্ঠে বললো, ‘আপনি?’
এবার ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে বড় করে হাসি দিলো অংকুর। এক হাতে এলোমেলো চুল গুলো ঠিক করতে করতে বললো, ‘হ্যাঁ আমি। ভেবেছিলাম আমাকে ভুলেই যাবে। কিন্তু এতো ভালো করে আমার চেহারা মনে রেখেছো দেখে আমি ইম্প্রেসড হলাম।’
বিরক্তিতে বিবর্ণ ধারন করলো মিতালীর মুখশ্রী। রাগে গিজগিজ করতে করতে বললো, ‘মিথ্যে বললেন কেন আপনি? মোবাইল না চুরি হয়েছে আপনার? তাহলে আমার মোবাইল নিলেন কেন? সব সময় বিরক্ত করেন কেন?’
অংকুর কন্ঠস্বরে ভাবুক আনলো। নির্বিকার ভাবে উত্তর দিলো, ‘ওমা তাই? আমি কখন তোমাকে বিরক্ত করলাম?’
অসন্তোষজনক চোখে তাকালো মিতালী। ফুঁশ করে নিশ্বাস ছুঁড়লো একটা। এই ছেলের সাথে রাগ দেখিয়ে লাভ হবে না। কি চাইছে সেটা জানতে হবে। ব্যাপারটার একটা মীমাংসা দরকার। তাই মিতালী অংকুরের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। চোখে চোখ রেখে কণ্ঠস্বর নরম করে বললো, ‘দেখুন, ওইদিন যা ঘটেছিলো সেটা সম্পূর্ণ একটা এক্সিডেন্ট ছিলো। আমি তার জন্য ক্ষমাও চেয়েছি। আজও চাইছি আমি দুঃখিত। প্লিজ ওই ব্যাপারটা নিয়ে আর ঝামেলা বাঁধাবেন না।’
এক নাগাড়ে এতোগুলো কথা বলে থামলো মিতালী। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো উত্তরের আশায়। অংকুর নিশ্চুপ রইলো। শীতল চাহনী দিলো মিতালীর দিকে। কন্ঠস্বরে মলিনতা এনে শুধাল, ‘আমি মোটেও ওই ব্যাপার নিয়ে ঝামেলা বাঁধাচ্ছি না। তোমার বুঝার ভুল আছে।’
ভ্রুঁ জোড়া বাকা হয়ে এলো মিতালীর। কপালে পরল সূক্ষ্ম চিন্তার ভাজ। অংকুরের কথা ঠিক ধরতে না পেরে প্রশ্ন করলো, ‘তাহলে আর কোন ব্যাপারে শুনি?’ #অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল_মিহির
[০৮]
গভীর চাহনীতে তাকালো অংকুর। উষ্ঠধয়ে ফুটালো মৃদু বাকা হাসি। মিতালীর দিকে এক কদম এগিয়ে কিছুটা ঝুকে দাঁড়ালো। পিছালো না মিতালী। বরঞ্চ উত্তরের আশায় তাকিয়ে রইলো তার দিকে। অংকুর মিতালীর কাজল কালো চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘যদি বলি ভালোবাসার জন্য?’
নিষ্প্রাণতা আসলো মিতালীর মাঝে। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো অংকুরের দিকে। এমন প্রতিত্তুর তার কল্পনার বাহিরে ছিলো। কান দুটোতে এখনো অংকুরের বলা কথাটি কম্পিত হচ্ছে। ঈষৎ কেঁপে উঠলো মিতালীর হৃদয়। মৃদু হাসলো অংকুর। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আমাকে খুব বাজে ভাবে ফাঁসিয়েছ তুমি। মামলা করা উচিত তোমার নামে।’
মিতালী বললো, ‘কিসব আবুল তাবুল বলছেন। মাথা ঠিক আছে আপনার?’
উচ্চস্বরে হেসে ফেললো অংকুর। ঠোঁটের বাম পাশের ছোট বাকা দাঁতটা ভেসে উঠলো স্পষ্ট। হাসির কারনে চোখের পাশে ছোট ছোট ভাজ পরেছে। পরিস্ফুট ভাবে দেখলো মিতালী। সে এখনো বাক্যহীন হয়ে আছে। মাত্র দুইদিনের পরিচয়ে ভালোবাসা? এতো টাই সহজ? সবটাই তার কাছে ধোঁয়াশা লাগছে। নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছে অংকুরের দিকে। তখুনি আগমন ঘটলো শেফালীর। সে এখানে এসে দুজনকে পাশাপাশি দেখে ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকালো। হতবাক হয়ে দুজনের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলো, ‘তোমরা একে ওপরকে চিনো? বুবু কে উনি?’
মিতালী নিশ্চুপ রইলো। প্রতিক্রিয়া করার মতো কিছু পেলো না। মনে মনে কিছু কথা আওড়ে নিলো কি বলবে তা নিয়ে। অতঃপর জিভ দিয়ে উষ্ঠধয় ভিজিয়ে নিলো। প্রতিত্তুর করার জন্য কিছু বলতে যাবে তার আগেই অংকুর শেফালীকে বলে উঠলো, ‘হ্যালো সিস্টার, আই’ম ইউ’র ফিউচার ব্রাদার ইন ল। নাইস টু মিট ইউ।’
বিস্ময়ে তাৎক্ষনাৎ দুই ঠোঁট জোড়া ফাঁক হয়ে গেলো শেফালীর। ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে রইলো অংকুরের দিকে। মুখ ফাঁক রেখেই একবার মিতালীর তাকালো। তারপর অংকুরের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘সত্যি নি? নাকি আমি স্বপ্ন দেখতাছি? বুবু হাতে চিমটি কাটো তো। হায় আল্লাহ আমার বিশ্বাস হচ্ছে না কেন?’
উচ্চস্বরে হেসে ফেললো অংকুর। তার হাসি দেখে রাগ শরিরে তিরতির করে বেড়ে গেলো মিতালীর। রাগে কিড়মিড় করতে করতে শেফালীর মাথায় চাপড় বসালো। তারপর চোখ পাকিয়ে বললো, ‘মিথ্যে কথা। এই ফালতু লোকটাকে আমি একদম চিনি না। বাসায় চল এখুনি।’
শেফালীর হাত ধরে হাটতে নিলেই বাধা দিলো শেফালী। মিতালীর হাত ছাড়িয়ে অংকুরের দিকে উল্লাসিত কন্ঠে হাত বাড়িয়ে বললো, ‘হ্যালো, আমি শেফালী। তোমার নাম কি?’
হাসলো অংকুর। নিজের হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডসেক করে বললো, ‘অংকুর।’
‘আরেহ বাহ্। সুন্দর নাম। আমার কিন্তু তোমাকে দুলাভাই হিসেবে বেশ পছন্দ হয়েছে। এখন তোমাকে আমি জিমি বলে ডাকবো। আমি আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম দুলাভাই কে জিমি ডাকবো।’
মিতালীর দিকে তাকিয়ে প্রাপ্তির হাসি দিলো অংকুর। অন্যদিকে মিতালী তাদের কথোপকথন শুনে রাগে ফেটে যাচ্ছে একদম। সহ্য করতে না না পেরে শেফালীর কান ধরলো। বললো, ‘ফাজিল মেয়ে। যাকে খুশি তাকেই দুলাভাই কেন ডাকবি তুই? আমি কি এই ছেলে কে বিয়ে করেছি? বেয়াদব মেয়ে কোথাকার।’
ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠলো শেফালী, ‘আহ্ বুবু কি করছো? ব্যাথা পাচ্ছি ছাড়ো প্লিজ।’
কান ছেড়ে দিলো মিতালী। শেফালী মুখ কালো করে কান কান ঢলতে লাগলো। মিতালী অংকুরের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শেফালীর হাত ধরে অটো দাঁড় করিয়ে উঠে বসলো তাতে। অংকুর এখনো আগের জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটে তার মৃদু হাসি। মিতালীদের অটো চোখের আড়াল হতেই দৃষ্টি সরালো রাস্তা থেকে। এক হাতে মাথা চুলকে মোবাইল বের করলো পকেট থেকে। মিতালীর নাম্বার টা সেভ করলো ‘তুলতুল’ দিয়ে।
অটোতে কাচুমুচু হয়ে বসে আছে শেফালী। আড় চোখে মিতালীর দিকে তাকিয়ে দেখলো সে রাগে ফুঁশ ফুঁশ করে নিশ্বাস ছুঁড়ছে। ভয়ে শুকনো ঢুক গিললো। তখন নাহয় নাচতে নাচতে দুলাভাই ডেকে দিয়েছে। এখন তার কি হবে?আর ছেলেটার সাথে বুবুর সম্পর্ক আছে কি না, না জেনেই এমন করেছে সে। আজ তো তার কপালে শনি-দশা আছে নিশ্চিত।
মিতালী চুপচাপ ঘাড় কাত করে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। চলন্ত গাড়ি থেকে রাস্তার পাশের গাছের দৃশ্য দেখতে মুগ্ধকর। একটু আগের ঘটনায় প্রথমে রাগ হলেও এখন তার হাসি পাচ্ছে। দুই দিনের পরিচয়ে কিনা ভালোবাসা? হাহ্ এতো টা সহজ না দুনিয়া। অন্তত্য তার মতো মোটা মেয়েদের জন্য তো না-ই। দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। তখুনি মোবাইলে ম্যাসেজের নোটিফিকেশনের ধ্বনি কানে আসলো তার। মোবাইলের স্কিন অন করে তাকিয়ে দেখলো আননোন নাম্বার থেকে একটা ম্যাসেজ এসেছে। ম্যাসেজ টা ওপেন করে দেখে অবাক হলো। বুঝতে বাকি নেই ম্যাসেজ টা কে পাঠিয়েছে। আপন মনে মৃদু হেসে ফেললো মিতালী।
‘অনাদিকাল এ পথে চলতে গিয়ে,
তোমার সাথে দেখা মিলে চেনা প্রান্তরে।
সুসৌরভে পুলকিত হয় ওঠে আমার মৌন,
বিমুগ্ধ অন্তরে স্বপনদুয়ার খুলে করে মধুপূর্ণ।’
.
রাতের খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই শুয়ে পরেছে। জেগে আছে শুধু দুই বোন। শেফালী টেবিলের এক পাশে বসে পড়ছে। মিতালী এক পাশে বসে নতুন ক্যালিগ্রাফি আর্ট করছে। খুব মনোযোগীর সাথে ০০ সাইজের তুলি ক্যানভাসে চালাচ্ছে সে। কিছুসময় পর খেয়াল করলো শেফালী ঘুমে ঢুলছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত্রীর মাত্র বারো টা ছয়। শেফালী সাধারনত অনেক তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে ভোরে উঠে। রাত দশটা কি এগারোটার পর তাকে ধরে বেধেও সজাগ রাখা যায় না। ইদানীং রাত জাগছে সে। কারন একটা-ই পড়া। এই পড়াশোনা না থাকলে বোধহয় তার জন্য হাজার গুন ভালো ছিল। সে সব কিছু ছাড়তে পারবে কিন্তু ঘুম নিয়ে নো কম্প্রোমাইজ! ঈষৎ হাসলো মিতালী। শেফালীর গায়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললো, ‘ঘুমিয়ে পর গিয়ে। নাহলে ঘাড়ে ব্যাথা করবে পরে।’
পিটপিট চোখে তাকালো শেফালী। ঘুমে চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। ঘুমুঘুমু চোখে তাকিয়ে ঘুমার্ত গলায় বললো, ‘বা*লের পড়া যদি না থাকতো তাহলে আমি আমার আড়ামের ঘুম হারাম করতাম না।’
দেড়ি করলো না আর। চটজলদি টেবিল ছেড়ে মিতালীর রুমেই শুয়ে পরলো উল্টো হয়ে। মুহূর্তেই চোখে হাজারটা রাজ্যের ঘুম এসে হানা দিলো। ঘুমিয়ে গেলো শেফালী। তার এই কান্ডে নিঃশব্দে হেসে উঠলো মিতালী। আবারো মনস্থির করলো ক্যানভাস তুলিতে। কিন্তু মনোনিবেশ করতে পারলো না। যখন পূর্ণ মৌন রঙতুলিতে তখুনি মোবাইলের কর্কষ রিংটোনের আওয়াজে ধ্যান ভাঙ্গে। কিঞ্চিৎ পরিমানের বিরক্ত হলো মিতালী। কপাল কুঁচকে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে। চিনে না তাই কল রিসিভ করেনি মিতালী। মোবাইলটা উল্টে টেবিলের এক পাশে রেখে দিলো। বেশ কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর কল টা আপনা আপনি কেটে গেছে। পাত্তা দিলো না সে। আবারো নিজের কাছে মনোযোগ দিলো। প্রায় দশ মিনিট পর সেই একই নাম্বারে কল আসলো। বিরক্ত হলো মিতালী। কটমট চোখে মোবাইলের দিকে তাকালো। একই নাম্বার থেকে আবারো কল। হয়তো জরুরি। তাই বিলম্ব না করে কল রিসিভ করলো সে। ‘হ্যালো’ বলার পর অপর পাশ থেকে ভেসে এলো একটা পুরুষনালীর কণ্ঠস্বর।
‘ব্যাপার কি মিস? প্রথম দিনেই আমাকে ইগনোর লিষ্টে ফেলে দিলেন?’
ভ্রুঁ জোড়া আপনা-আপনি কুঁচকে এলো মিতালীর। কান থেকে মোবাইল নামিয়ে স্কিনে নাম্বার টা ভালো করে দেখে নিলো একবার। না পরিচিত কেউ বলে মনে হচ্ছে না। মোবাইল কানে রেখে প্রশ্ন করলো, ‘কে আপনি?’
অপর পাশ থেকে অংকুরের অবাক কন্ঠ ভেসে উঠলো, ‘যাক বাবা! সন্ধ্যা রাতেই না তোমার মেমোরির প্রশংসা করলাম। এরই মাঝে ভুলে গেলে? সিরিয়াসলি?
‘আপনি? এতো রাতে কল দিলেন কেন?’
মধ্যরাতে ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে বসে আছে অংকুর। তার থেকে কিছুটা দূরত্বে রাকিব মোবাইলে গেমস খেলছে। মিতালীর কথা শুনে অংকুর হাত ঘড়ির দিকে চোখ বুলালো। তারপর বলল,
‘এতো রাত কোথায়? মাত্র সাড়ে বারোটা বাজে। ঘুমিয়ে গিয়েছিলে নাকি? ডিস্টার্ব করলাম?’
‘অবশ্যই ডিস্টার্ব করেছেন। মাঝ রাতে একটা মেয়েকে তার পারমিশন ছাড়া কল দেওয়া টা কি ডিস্টার্বড নয়?’ মিতালীর কাটকাট গলার উত্তর।
‘তোমার থেকে পারমিশন চাইলেও তুমি দিতে না। তাই নিজেকে থেকে কল দিয়ে দিলাম।’
‘আপনি তো জিজ্ঞেস করেন নি। আমি পারমিশন দিতেও পারতাম। তাহলে? জিজ্ঞেস করে কল দেওয়ার দরকার ছিল না?’
‘তারমানে আমাকে কল দেয়ার পারমিশন দিতে? ওকে ওয়েট!’
বলেই লাইন কেটে দিলো অংকুর। অবাক হলো মিতালী। কান থেকে মোবাইল নামিয়ে টেবিলের কাছে রাখার আগেই আবারো কল আসলো অংকুরের। কপালে বিরক্তির ভাজ আসলো তার। কল রিসিভ করে কানে দিল। তারপর বিরক্তি মাখা কন্ঠে বললো,
‘সমস্যা কি? আবার কল দিলেন কেন?’
‘ওমা! তুমি না পারমিশন দিলে কল দেওয়ার জন্য? তাই আবারো কল দিলাম। এবার বলতে পারবে না পারমিশন নেই নি কেন। ‘
অংকুরের হাস্যউজ্জল কন্ঠ শুনে হতবাক হলো মিতালী। কখন পারমিশন দিলো সে?এই ছেলে এতো কথা বলতে পারে? আষ্টর্য! অংকুর আবারো বলতে লাগলো, ‘তোমার নাম তো মিতালী রাইট?’
ছোট করে উত্তর দিলো, ‘হুম!’
‘ওহ ইয়া! অংকুর নামের অর্থ সূচনা করা, সৃষ্টি করা। আর মিতালী নামের অর্থ বন্ধুত্ব। সুতরাং কি দাঁড়ালো? অংকুর মিতালী নামের অর্থ হয় বন্ধুত্বের সূচনা করা। তাহলে নামের সাথে মিল রেখে আমরা দুইজন এখন থেকে বন্ধু। পাক্কা?’
তার কথা শুনে নিরবে হাসলো মিতালী। ঠোঁটে মৃদু হাসি ঝুলে রইলো তার। অংকুর আবারো বলতে লাগলো, ‘কি মিল আমাদের নামের। ওয়াও। এমন মিল কোনো কাপলের পাবে না বুঝেছো। অংকুর – মিতালী! ওয়াহ্ নাম দুটো একত্রে বললেই কেমন শান্তি শান্তি লাগে। ভালো লাগে না মিতালী?’
উত্তর দিলো না মিতালী। নিশ্চপ থেকে শুনতে লাগলো অংকুরের যতো কথা। তৃতীয় সাক্ষাতে একটা ছেলের এমন ব্যবহার করছে যেন তারা কত বছরের পূর্ব-পরিচিত। অংকুরের ব্যবহারে নিরবে হাসছে আর চুপচাপ শ্রবণ করছে সে।
অংকুর বললো, ‘তোমার নামটা অনেক বড়। স্যরি টু সে, এতো বড় নামে ডাকতে পারবো না আমি। একটু কেটে-ঝেটে ছোট করে নেই কেমন? তাহলে কি নামে ডাকবো?’
ভ্রুঁ কুঁচকালো মিতালী। অংকুরের সাথে তাল মিলিয়ে বললো, ‘হুম তাহলে কি নামে ডাকবেন?’
ভাবুক হলো অংকুর। ভাবতে ভাবতে বললো, ‘মিতালী? মিতা? তালী? নাহ। মাঝখানের তা টা বাদ। তাহলে মিলী। ওয়াও! এটাই ফাইনাল। আনকমন নাম। এখন থেকে মিলি বলে ডাকবো তোমাকে।’
এবার একটু আওয়াজ করেই হেসে ফেললো মিতালী। তার হাসির আওয়াজে অংকুর নিজেও মৃদু হাসলো। মুগ্ধ হলো তার মন। আনমনে কবিতা এঁকে বলে উঠলো, ‘
‘তোমার হাসিতে রজনীগন্ধা ফুটে
বিশাদ যেন এক নিমিশেই টুটে!’
ধাতস্থ হলো মিতালী। উষ্ঠধয়ে লেপ্টে থাকা হাসি মিলিয়ে গেলো। লজ্জাভূতি হলো সে। ঠোঁটে ঠোঁট চেঁপে ধরলো। গালে রক্তিম আভা ছড়িয়ে গেলো তার। কোনো রকমে ‘রাখছি’ বলে কল কেটে দিলো।
বিস্মিত হলো অংকুর। কান থেকে মোবাইল নামিয়ে স্কিনের দিকে তাকালো। ‘তুলতুল’ নামটা দেখে হেসে উঠলো সে।
চলমান।
চলমান।
চলমান।