অনেক সাধনার পরে পর্ব -০৩+৪+৫

#অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল_মিহির [লেখিকা]

[০৩]

ওবাইদুরের পাল্টা জবাব, ‘আমি তো কারোর নাম একবারও উল্লেখ করিনি। তুমি চেঁচাচ্ছ কেন?’

মনিরা ঠোঁট চেপে হাসলো। হাফছাকে আজ সঠিক ভাবে হ্যানস্তা হতে দেখে ভীষণ রকমের হাসি পাচ্ছে তার। ইচ্ছে করছে মুখের সামনে মাইক এনে হাফছার কানের কাছে হাসতে। ওবাইদুর কে সে মনে মনে শ’খানেক ‘লাভ ইউ’ বলে দিয়েছে অলরেডি।

হাফছার শরির রাগে অপমানে জ্বালা-পালা করে উঠলো। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে ওবাইদুরের দিকে তাকালো। ব্যাগ হাতে নিয়ে গটগট পায়ে বেরিয়ে গেলো ক্লাস রুম থেকে। হাফছার সঙ্গ দেওয়া মেয়ে গুলো তার পিছু পিছু বেড়িয়ে গেলো। উচ্চস্বরে হেসে উঠলো বাকিরা। রুমি হাসতে হাসতে বললো, ‘ওবাইদুর তোমাকে আজকে আমার পক্ষ থেকে একটা কোকাকোলা ট্রিট রয়েছে।’

ওবাইদুর বললো, ‘আমার কিন্তু ছোট টা দিয়ে হয় না। এক লিটারের টা হলে ভালো হতো। আর যদি পারো তো দুই লিটারেরটা দিতে পারো আই ডোন্ট মাইন্ড।’

রুমি মুখ হা হয়ে গেলো তাৎক্ষনাৎ। আহাম্মকের মতো ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলো ওবাইদুরের দিকে। অন্যরা হাসলো তার কথায়। সে নিজেও ক্যাবলা মার্কা হাসি দিলো। মনি ওবাইদুরের পেটে কুনই দিয়ে গুঁতো দিয়ে বললো, ‘নির্লজ্জ পোলা! এতো খাই খাই করো কেন হ্যাঁ?’

হেসে উঠলো সবাই। সাথে মিতালীও। অপর দিকে ওবাইদুর কনুই’য়ের গুঁতো খেয়ে ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠলো ‘উরিম্মা’.
.

সকালে স্নিগ্ধ সূর্যকিরণ থাকলেও দুপুরের প্রথম ভাগে রোদের আলো তীব্র থেকে তীব্রতর হলো। ভ্যাঁপসা গমগমে গরম ছড়িয়ে পরলো চারপাশে। দীর্ঘসময় ধরে রোদের তাপে ক্রিকেট খেলার পর দুই ভাই প্রচুর ক্লান্ত। ঘেমে একাকার দুজন। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। অলস শরির টেনে বাসায় আসলো তারা। মাঠ থেকে তাদের বাসার দূরত্ব খুব কম। পায়ে হেটে আসলেও বোধহয় এক মিনিটও লাগবে না। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল বাজালো অংকুর। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে মুখখানা গম্ভীর করে রেখেছে। সেই থেকে এখন অব্ধি রাকিব অংকুরের সাথে একটা কথাও বলেনি। অংকুর ব্যাপারটা ধরতে পেরেছে। তবে নিশ্চপ রইলো। কলিংবেল বাজানোর কিছুসময় পর অংকুরের মা সুপ্তি দরজা খুলে দিলো। দুই ছেলের দিকে হাসিমাখা মুখে তাকিয়ে বললো, ‘এসেছিস তোরা? ওমা ঘেমে আছিস দেখছি। দিনদুপুরে খেলে অসুস্থ হয়ে যাবি তো।’

চাচিমার কথা কানে তুললো না রাকিব। গম্ভীর মুখ বজায় রেখে বিলম্ব না করে দ্রুত নিজের রুমে চলে গেলো। ভিতরে গিয়ে ঠাস্ করে দরজা লাগিয়ে দিলো। রাকিবের এহেন কান্ডে সুপ্তি বেগম অবাক হলেন। তাড়াতাড়ি করে অস্থির হয়ে অংকুর কে প্রশ্ন করলেন, ‘রাকিবের কি হয়েছে? ছেলেটা রেগে আছে মনে হচ্ছে। কি রে কি হয়েছে?’

অংকুর ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে প্রতিত্তুর করলো, ‘উচিত কথা কারোরই হজম হয় না। চিন্তা করো না। আমি কথা বলবো।’

পিছু ফিরে তাকালো না অংকুর। বড়বড় পায়ের কদম ফেলে নিজের রুমে চলে আসলো। পিছু ফিরে তাকালে হয়তো মায়ের চিন্তিত মুখখানি নজরে আসতো তার।

রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো। গা থেকে ঘামে ভেজা টি-শার্ট খুলে পাশের ঝুড়িতে রাখলো। আলমারি থেকে থ্রি-কোয়াটার প্যান্ট ও তাওয়াল হাতে নিয়ে ওয়াশরুমে গেলো গোসল করতে। পাক্কা পঁচিশ মিনিট সময় নিয়ে গোসল সেরেছে অংকুর।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো দুপুরের শেষভাগ। খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। খিদায় পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। সুপ্তি এসে ডেকে গেলো দুপুরের খাবার খেতে। অংকুর গায়ে কালো পাতলা টি-শার্ট পরে বের হলো রুম থেকে। ডাইনিং টেবিলে এসে চেয়ার টেনে বসলো। খেয়াল করে দেখলো রাকিব এখানে নেই। তাই সে মাকে প্রশ্ন করলো, ‘রাকিব কই? ডাক দেও নাই তুমি?’

সুপ্তি টেবিলে মাছের বাটি রেখে উত্তর দিলো, ‘ডেকেছিলাম। আসছে না। ছেলেটার মন ভালো নেই। তুই যা না গিয়ে কথা বল।’

অংকুর মনে মনে কিছুটা বিরক্ত হলো। এই ছেলেকে নিয়ে সে পারে না। সকালে কি থেকে কি বললো সেটা নিয়ে রাগ করে বসে আছে। এতো ইমোশনাল কেন এই ছেলে? ছেলে মানুষ হবে শক্ত। কাঁদবে না তারা। অল্পতে ভাঙ্গবে না। সকল পরিস্থিতিতে নিজেকে অটুট রাখবে তারা। কিন্তু রাকিব তার বিপরীত পারসন। কোনো ব্যাপারে উনিশ থেকে বিশ হলেই অংকুরের নাম জপবে। যদিও দুই ভাইয়ের সম্পর্ক অনেক গভীর।

বিলম্ব করলো অংকুর। চেয়ার ছেঁড়ে উঠে দাঁড়ালো। পা বাড়ালো রাকিবের রুমের উদ্দেশ্যে। রুমে এসে দেখলো পুরো রুম ফাঁকা। তাই বারান্দায় গেলো সে। দেখলো রাকিব সেখানে বেতের মোড়ায় বসে মোবাইল ঘাঁটছে। পাশ থেকে আরেকটা বেতের মোড়া টেনে রাকিবের পাশে বসলো অংকুর। রাকিব প্রথমের ন্যায় প্রতিক্রিয়াহীন ভাবে বসে রইলো। এমন একটা ভাব যেন এই বারান্দায় সে ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি নেই।

বেশ কিছুক্ষন পর যখন অংকুর দেখলো রাকিবের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই তখন আরো বিরক্ত হলো। বললো, ‘ভাই নাটক থামা। তোর এই নাটক আমি নিতে পারি না। তুই আমার গার্লফ্রেন্ড না যে ঘটা করে তোর রাগ ভাঙ্গাতে হবে।’

ত্যাঁছড়া চোখে তাকালো রাকিব। বললো, ‘তো এখানে আসছিস কেন? যা!’

ফুঁশ করে হতাশার নিশ্বাস ফেললো অংকুর। কন্ঠস্বর মোলায়েম করে বললো, ‘ভাই তখন কি বললাম তাই নিয়ে রেগে থাকবি?’

‘আর আমিই বা কি বললাম? মেয়েটা সত্যি একটু মোটা সেটাই তো বলেছি। মেয়েটাকে তো ছোট করে বলিনি। তুই আমার নরমাল কথাটা সিরিয়াসলি নিয়ে বসেছিস। আর কি বললি? আমার ম্যান্টালিটি কুৎসিত।’ রাকিবের পাল্টা উত্তর। কথাটা বলে অংকুরের দিকে আর তাকালো না। মুখ ঘুরিয়ে তাকে পিছ দিয়ে বসলো রাকিব। অংকুর রাকিবের বাহু টেনে তার দিকে ঘুরালো। দুই হাত জুড় করে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বললো, ‘মাফ চাই ভাই মাফ চাই। আমার আসলেই তখন ওই কথাটা বলা উচিত হয় নাই। মাফ কইরা দে ভাই। আমিও ওইভাবে বলতে চাই নাই। রাগ করিস না এবার খেতে আয়।’

ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো রাকিব। কপালে সূক্ষ্ম ভাজ ফেলে বললো, ‘তোকে এভাবে মাফ চাইতে বললো কে? আর কে বলেছে আমি রাগ করে খেতে যাচ্ছি না? সর, আমার ইনভেস্ট করা শেষ হলে খেতে আসবো।’

হতভম্ব হলো অংকুর। রাগ হলো তার। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে রাকিবের মাথায় গাট্টা মারলো একটা। বললো, ‘শালা, তুই আগে বলবি না? আমরা তো ভাবছি রেগে খেতে আসছিস না। নাটক ভালোই পারিস।’

হেসে উঠলো রাকিব। পকেটে মোবাইল রেখে বললো, ‘আয়!’ অতঃপর দুজন খাবার খাওয়ার জন্য টেবিলে গেলো।
.

অপরাহ্নের স্নিগ্ধ কিরণ! দিবাকর পশ্চিম আকাশে হেলে পরেছে। ধরনীতে ছড়িয়ে আছে হলুদ লালছে আলো। আকাশে উড়ন্ত কালো পাখি গুলো ঢানা ঝাপটাচ্ছে নিজেদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। মিতালীর কোমড় অব্ধি মৃসন চুল গুলো হিম শীতল বাতাসে উড়ছে। আঁচড়ে পরছে চোখে মুখে। এক হাতে চুল গুলো খোঁপা বেধে নিলো সে। ওড়নার আচল টেনে ঘোমটা দিলো মাথায়। দৃষ্টি রাখলো সামনে। তাকিয়ে রইলো শেফালীর বাচ্ছামোর দিকে।

শেফালী ছাদের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ইটের টুকরো হাতে নিয়ে সামনের ছাদে ঢিল ছুড়ছে সে। উদ্দেশ্য তার সামনের ছাদে থাকা ইটের তৈরি ছোট পুকুরটা সই করা। পুকুরটা ছাদের অপর প্রান্তে হওয়ায় শেফালী সই করতে পারছে না। বারবার বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে সে।

‘থামবি তুই? হুদাই লাফিয়ে শক্তি খরচ করছিস। পারছিস তো না। বাদ দে এবার আয়। একটু পর আজান দিবে। বাসায় আয়।’

বিরক্ত মাখা কন্ঠে বললো মিতালী। শেফালী ইটের আরো দুইটা টুকরো হাতে নিলো। একটা টুকরো ছাদে ঢিল ছুঁড়লো। ব্যর্থ হলো সে। অপর টুকরো হাতে নিয়ে আবারো ঢিল ছুঁড়ে মিতালীর দিকে তাকালো। বললো, ‘বুবু রব্রাট ব্রুস এর একটা গল্প আছে পড়ো নাই? রব্রাট একবার পারে নাই। কিন্তু মাকরশা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে চেষ্টা করে রাজ্যজয় করেছে। আমিও পারবো। তুমি আমাকে উৎসাহ না দিয়ে উল্টো থামতে বলছো।’

বলেই আরেকটা ইটের টুকরো নিচে থেকে নিয়ে ঢিল দিলো এবং ভাগ্যবশত ছোট পুকুরটার মধ্যে ইটের টুকরোটা পরলো। খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলো শেফালী। ‘ইয়েয়ে’ বলে চেঁচিয়ে লাফাতে লাগলো। উল্লাসিত হয়ে দৌড়ে এসে মিতালীকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধলো। মিতালীও প্রতিত্তুরে মুচকি হাসলো কেবল।

মিতালী এক হাত শেফালীর গালে রেখে বললো, ‘হয়েছে। এবার চুল গুলো বেঁধে ফেল। সন্ধ্যা হয়ে গেছে।’

শেফালী তাকে ছেড়ে সামনে এসে দাঁড়ালো। তারপর বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে বললো, ‘উহুম! আমি তো কাটা আনি নি। তাহলে বাধবো কিভাবে?’

মিতালী নিশ্চুপ রইলো। শেফালীকে ধরে ঘুরালো। তারপর তার পিঠ সমান হাল্কা ঢেউ হেলানো চুল গুলো ধরে খোঁপা করে দিলো। শেফালী হাত দিয়ে মাথার সামনের বেবি হেয়ার গুলো টেনে আনলো। সেই ছোট ছোট অবাধ্য চুল গুলো বাতাসে উড়ে এসে মুখে পরছে। শেফালী বোধহয় এই মুহূর্তটা উপভোগ করছে।

আরো কিছুসময় থাকার পর সিদ্ধান্ত নিলো বাসায় ফিরে যাবার। তাই দুই বোন চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই পিছন থেকে এক মহিলা উদ্ভব কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো। চালিত পা থামিয়ে দিলো দুজন। ভ্রুঁ কুঁচকে পিছনে তাকাতেই দেখতে পেলো পাশের বাসার মালকিন-কে।

‘এই মাইয়া রা। দাঁড়াও কইতাছি।’

অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো দুজন। এই মহিলা ডেকেছে নিশ্চয় কিছু কটুকথা শুনিয়ে দিবে আজ। শেফালী বিরক্ত হলো। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নিলো আজ রেহাই দিবে না সে। আজ প্রতিটি কটুকথার প্রতিত্তুর দিবে সে। আর তার বোনকে নিয়ে কিছু বললে চুল টেনে ছিঁড়ে দিবে। দাঁতে দাঁত পিষে ঘর্ষণ করতে লাগলো। চোখমুখ শক্ত করে মহিলাটার সামনে এগিয়ে আসলো দুজন।

পাশাপাশি ছাদের কার্নিশ দাঁড়িয়ে আছে তারা। মহিলাটি অর্থাৎ সখিনা বিবি মিতালীর উদ্দেশ্যে বললো, ‘তোমার আম্মা বাড়িতে আছে?’

মিতালী স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলো, ‘জি বাসায় আছে। কেন আন্টি কোনো দরকার?’

‘আসলে তোমার আম্মার লগে আমার জরুরি কথা আছিলো। আমার শরিরটা ভালা না নাইলে আমি জাইতাম তোমাদের বাড়ি। তোমার আম্মারে কইয়ো আমার কথা। আমাদের বাড়ি আইসা যাতে দেখা কইরা যায়। মনে থাকবো নি?’

‘জি আন্টি মনে থাকবে।’

‘আইচ্ছা তাইলে ঘরে যাও। এই সন্ধ্যা বেলা বাইরে থাকলে কাল নজর পরবো। এমনিতেও তোমার উপরে কাল নজর পইরা আছে। এর লাগি তো বিয়াশাদী হইতাছে না। তাড়াতাড়ি ঘরে যাও।’

দাঁতে দাঁত পিষে তাকালো শেফালী। কিছু বলতে যাবে তার আগেই মিতালী তার হাত ধরে আটকে দিলো। মিতালী ঠোঁটে হাসি টেনে মহিলাটিকে বিদায় জানিয়ে দিয়ে শেফালীর হাত টেনে ছাদ থেকে দ্রুত নিচে নেমে আসলো।

বোনের এমন ব্যাবহারে বিরক্ত হলো শেফালী। সিঁড়ির কাছে আসতেই হাতটা ঝামটা মেরে ছাড়িয়ে নিলো। বললো, ‘সমস্যা কি তোমার বুবু? আমাকে থামালে কেন? ওই বজ্জাৎ মহিলার মজা আজ বুঝিয়ে দিতাম।’

মিতালী বললো, ‘মানুষ খারাপ ব্যাবহার করলেই কি আমাদেরও খারাপ ব্যাবহার করতে হবে? ওরা নিকৃষ্ট হলে আমরা ভদ্র। তাছাড়া উনি তোর বড়। মুখের উপরে কিছু বলা উচিত না।’

‘ছাই গেছে তোমার উচিত অনুচিত। ওই মহিলা যে তোমাকে ইন্ডাইরেক্টলি অপমান করলো তার বেলা? আমি এতো ভালো মানুষ না। নেক্সট টাইম কেউ কিছু বললে তাকে একদম ছাড়বো না। মনে রেখো।’ শক্ত গলায় বললো শেফালী। দাঁড়ালো না আর এক মুহূর্তও। রাগে গিজগিজ করতে করতে গটগট পায়ে নিচে নেমে এলো। মিতালী তার জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে হতাশার নিশ্বাস ফেললো।
#অনেক_সাধনার_পরে’
মাইশাতুল_মিহির [লেখিকা]

[০৪]

বাংলাদেশের ঐতিহ্য’এর মাঝে একটি হলো মৃৎ ও কুটির শিল্প মেলা। বিশাল আয়োজন নিয়ে মৃৎশিল্পী রা তাদের তৈরিকৃত আসবাবপত্র পর্যবেক্ষণ করায়। পর্যটক রাও ঘুরে ঘুরে সব মাটির তৈরিকৃত জিনিসের সৌন্দর্য পদর্শন করে। বিভিন্ন ধরনের মাটির জিনিস পত্র পাওয়া যায় এখানে। বছরে একবার মেলাটি হয় সেই বিধায় মানুষজনের ভীড় প্রচুর। চারপাশ ক্রেতা বিক্রেতাদের কোলাহলে ভরপুর। এতো এতো মানুষের ভীড় ঠেলে সামনে এগুচ্ছে দুই বোন মিতালী ও শেফালী। আজ মেলায় না আসলে শেফালী বুঝতেই পারতো না বাংলাদেশে এতো মানুষ আছে। হায় আল্লাহ! এই মানুষজনের চিপায় পরে কখন জানি প্রাণপাখি টা ফুড়ুৎ করে উড়াল মারে। ভিড় ঠেলে একটা ফাঁকা দোকানে এসে দাঁড়ালো দুই বোন। শেফালী বুকে হাত রেখে জুড়ে জুরে কয়েকবার নিশ্বাস নিলো। সে যেন হাফ ছেঁড়ে বেঁচেছে। মিতালীর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘বাপরে বাপ। এতো মানুষ? হায় আল্লাহ! আরেকটু হলে ম-রেই যেতাম।’

ম:রার কথা বলায় কিঞ্চিৎ পরিমানের বিরক্ত হল মিতালী। ধমকে উঠলো তাৎক্ষনাৎ, ‘চুপ কর। এভাবে বলতে নেই।’

তোয়াক্কা করলো না শেফালী। মিতালীকে ঠেলে-ঠুলে দোকানের ভিতর ঢুকলো। তারপর বললো, ‘এই দোকানে ঢুকি আসো। দেখো কত সুন্দর সুন্দর মাটির কাপ প্লেট আছে। আসো।’

মিতালী ও শেফালী দুজন মিলে দোকানের আনাচে-কানাচে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো সব। দুই বোন দুই পাশে। মিতালী একটা মাটির কাপ হাত নিলো। সেটা ভালো করে দেখলো একবার। তারপর দোকানী কে দাম জিজ্ঞেস করলো। পছন্দ মতো হওয়ায় অল্প দামাদামি করে কিনে নিলো।

বেশ কিছুক্ষন ঘুরাঘুরির পর শেফালী পাশের অন্য একটা দোকানে গেলো দেখতে। মিতালী এখনো এই দোকানে ঘুড়ছে। বেশ কয়েকটা জিনিসও নিলো সে। একটা মাটির টব হাতে নেওয়ার পর হঠাৎ কর্ণগোচর হলো একটি কথা।

‘হ্যালো মিস মানব দূষণকারী কন্যা।’

আপনা-আপনি ভ্রুঁ যুগল কুঁচকে এলো মিতালীর। ঘাড় বাঁকিয়ে পিছনে ফিরে তাকাতেই চক্ষু-চড়ক হয়ে গেলো তার। আহাম্মকের মতো তাকিয়ে রইলো। মনে পরলো কথাটি। মানে বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করলো, ‘মানব দূষণকারী কন্যা?’

দাঁত কেলিয়ে হাসলো অংকুর। দুই হাত দিয়ে উড়ন্ত এলোমেলো চুল গুলো পিছে ঠেলে ঠিক করলো। বললো, ‘হ্যাঁ, যদি যেখানে সেখানে ময়লা ফেললে পরিবেশ দূষণ হয়, তাহলে মানব দেহে ময়লা ফেললে হবে মানব দূষণ। আর যারা পরিবেশ দূষণ করে তাদের পরিবেশ দূষণকারী বলে। যেহেতু আপনি আমার উপর ময়লা ফেলেছেন সেহেতু আপনি মানব দূষণকারী কন্যা।

চেহারায় স্পষ্ট বিরক্ত ছাপ ফুটে এলো মিতালীর। অসন্তোষ-জনক চোখে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো, ‘ফালতু মার্কা লজিক।

মিতালী কথাটা বিড়বিড় করে বললেও কর্ণগোচর হলো অংকুরের। সে স্পষ্ট শুনতে পেলো মিতালীর বলা কথাটা। তাই ভাব নিয়ে এক আঙ্গুল তুলে বললো, ‘হ্যালো? আমার লজিক নিয়ে মশকারা করবে না একদম। তুমি কি জানো? আইনস্টাইন পর্যন্ত আমার এই লজিকে হার মেনেছে? জানবে কিভাবে এই সব নিয়ে গবেষণা করেছো কখনো? করো নাই। তাই আমিও জানাচ্ছি না।’

রুক্ষভাষী চোখে তাকালো মিতালী। এই ছেলে ফালতু কথার গোডাউন খুলে বসেছে নাকি? তখন নাহয় ভুলবশত কলার খোসা ফেলেছিল। তার জন্যও স্যরি বলেছে সে। তাও এই ছেলে থেমে নেই। এখানে এসেও তাকে পুরনো ঘটনা তুলে কথা শুনাচ্ছে। রাগ হলো তার। দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠলো, ‘আপনার মনে হয় না আপনি বেশি কথা বলছেন?’

অবাক হওয়ার ভান ধরলো অংকুর। বুঝতে না পারার ঢং ধরে বললো, ‘সিরিয়াসলি? আমি বেশি কথা বলছি?’

রাগে শরির কিড়মিড় করে উঠলো। একে তো বেশি কথা বলছে। তারউপর আবার আপনি থেকে তুমিতে চলে এসেছে। প্রচন্ড রাগ হলো তার। হাতে থাকা মাটির টপ টা টেবিলে স্বজোড়ে আছাড় মেরে রাখলো মিতালী। খানিকটা ভড়কে গেলো অংকুর। দোকানী মিতালীকে বলে উঠলো, ‘ম্যাডাম সাবধানে। ভেঙ্গে যেতে পারে।’

ধাতস্থ হলো মিতালী। চোখ ঘুরিয়ে একবার দোকানীর দিকে তাকালো। ফুঁশ করে নিশ্বাস ছুঁড়লো সে। রাগ দমানোর আপ্রান চেষ্টা চালালো। আষ্টর্য, সে তো এতো সহজে রেগে যায় না। কারোর সাথেও খারাপ ব্যবহার করে না। তাহলে? হঠাৎ এই ছেলের সাথে এতো রুক্ষ ব্যবহার করছে কেন? নিজের এমন ব্যবহারে নিজেই লজ্জিত হলো মিতালী। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করলো। টপ টা পাশে সুন্দর করে রেখে দিলো।

অংকুর মনে মনে হাসলো শুধু। মেয়েটাকে এখন রাগাতে প্রচুর মজা লাগছে তার কাছে। সে কি থেকে কি বলছে নিজেও জানে না। অথচ এই মেয়ে দেখো? রেগে বোম্ব হয়ে যাচ্ছে। হাহা। মনে মনে হাসতে হাসতে অলরেডি সে মাটিতে লুটিয়ে পরেছে। আবারো রাগাতে চাইলো সে। তাই বললো, ‘তুমি সবার সাথে এমন ব্যাবহার করো? না মানে আমি তো..’

সম্পূর্ণ কথা শেষ হবার আগেই চোখ পাকিয়ে তাকালো মিতালী। অংকুর তার চাহনীতে ভড়কে গিয়ে অস্থির হলো। দুই হাত সামনে এনে ভীতিজনক কন্ঠে বলে উঠলো, ‘ এই দেখো এইভাবে তাকাবে না আমার দিকে। আমার হার্ট বেচারা অনেক দুর্বল। তোমার এই ভারী চাহনী সে সয্য করতে পারবে না। পরে প্রেমে টেমে পরে গেলে মা:ইর দিতে পারবে না। আমি আগেই সাবধান করে দিচ্ছি। পরে বলতে পারবে না সাবধান করি নি কেন।’

মিতালী আর সয্য করতে পারলো না। ধৈর্যহীন হয়ে গেলো সে। তাই রেগে বলে উঠলো, ‘আপনি যাবেন এখান থেকে?’

অংকুর পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়লো, ‘এই দোকান টা কি তোমার?’

‘আমার হতে যাবে কেন? আজিব।’

‘তাহলে আমাকে বেড়িয়ে যেতে বলছো কেন? আজিব।’

অংকুরের ত্যাড়া জবাব শুনে হতাশ হলো মিতালী। এই ছেলে নন-স্টপ কথা বলে। এতো এক্সট্রোভাট কোনো ছেলে হয়? হলেও কেন তার সাথে দেখা হতে হলো? এর থেকে রেহাই দাও খোদা। রেহাই দাও। মনে মনে দোয়া করতে লাগলো মিতালী।
.

সম্পূর্ণ দোকান ঘুরে দেখার পর অন্য একটা দোকানে ঢুকলো শেফালী। এখানে মাটির অনেক আসবাবপত্র দেখতে পেলো সে। খুব সৌখিন, জিনিস গুলোর মাঝে আভিজাত্যের ছোঁয়া আছে যেন। মুগ্ধ চোখে দেখতে লাগলো শেফালী। হঠাৎ একটা ছেলের বাহুর সাথে তার ডান হাতের বাহুর হাল্কা ধাক্কা লাগলো। দুইজনই দোকানে ভিতর। রাস্তাটা সরু যার ধরন এপাশ থেকে ওপাশ যাওয়ার সময় ধাক্কা টা লাগলো। ভুলটা দুই পাক্ষিক ছিল তাই কেউ রাগলো না। বরং সৌজন্যমূলক ভাবে একে অপরকে ছোট করে ‘স্যরি’ জানিয়ে দিল। অতঃপর যে যার মতো মাটির তৈরি আসবাবপত্র দেখতে লাগলো।

শেফালী একপাশে দাঁড়িয়ে একটা কাপ হাতে নিল। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কাপটার খুঁটিনাটি বিজ্ঞব্যক্তিদের মতো দেখতে লাগলো। হঠাৎ ভুলবশত দেয়ালে হাত লেগে কাপটার একপাশ ভেঙ্গে গেলো। হকচকিয়ে গেলো শেফালী। চোখ বড়বড় করে তাকালো কাপটার দিকে। দোকানীর দিকে তাকিয়ে দেখলো সে অন্য কাজে ব্যস্ত তাই শেফালীর দিকে খেয়াল নেই। এখন কি করবে সে? বিপাকে পরে গেলো। ঠোঁট কামড়ে ভাবতে লাগলো। হঠাৎ খেয়াল হলো একটা মুভির কথা। মুহূর্তেই চেহারায়, ঠোঁটে ফুটে এলো শয়তানীর হাসি। এক হাতে কানের পিছে চুল গুলো গুঁজে নিলো। কাপটার ভাঙ্গা জায়গাটা ঠিক করে লাগিয়ে নিলো। তারপর গিয়ে দাঁড়ালো ধাক্কা লাগা সেই ছেলেটির পাশে। বললো, ‘হাই।’

রাকিব আশেপাশে তাকিয়ে দেখছিল সব। শেফালীর কথা শুনে বিনীময়ে মৃদু হাসি দিলো। আবারো নিজের কাজে ব্যস্ত হলো সে। শেফালী ইচ্ছে করে বললো, ‘আব্ এইটা একটু ধরুন আমার জুতার ফিতা খুলে গেছে। ওয়েট।’

রাকিবের প্রতিত্তুর শুনলো না শেফালী। কাপটা রাকিবের হাতে গুঁজে দিয়ে নিচু হয়ে বসে ফিতা বাধতে লাগলো। রাকিব সাতপাঁচ না ভেবে কাপটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। শেফালী ফিতা বাধার ফাঁকে আড় চোখে রাকিবকে দেখলো একবার। যখুনি সে খেয়াল করলো রাকিবের ধ্যান অন্য দিকে, তখুনি সে উঠে তড়িঘড়ি করে রাকিবের চোখের আড়াল হয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে গেলো। বাহিরে এসে আশে পাশে মিতালীকে খুঁজতে লাগলো সে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে পালাতে হবে। নাহলে ভাঙ্গা কাপের জন্য খেসারত ভুগতে হবে। কয়েকটা দোকান খুঁজেও মিতালীর দেখা মিললো না। কপালে সূক্ষ্ম ভাজ পরলো তার। এক হাতে মাথা চুলকাতে লাগলো। ঘুরতে ঘুরতে কোন কোন দোকান পেরিয়ে এসেছে খেয়াল নেই একদম। নিচের ঠোঁট-খানি কামড়ে ধরলো। আশেপাশে তাকাতেই চোখ গেলো পাশের দোকানে। সেখানে মিতালীর পিছন দিকটা দেখা যাচ্ছে। বিলম্ব করলো না সে। দ্রুত পা চালিয়ে মিতালীর কাছে এলো। উত্তেজনায় হাঁপিয়ে উঠলো সে। তাকে এভাবে আসতে অবাক হলো মিতালী। বললো, ‘কি হয়েছে তোর? এভাবে হাঁপাচ্ছিস কেন?’

জুরপূর্বক শুকনো ঢুক গিললো শেফালী। বললো, ‘বুবু, তাড়াতাড়ি বাসায় চলো। আমার হার্ট অনেক দ্রুত চলছে। এখানে আর এক মুহূর্ত থাকলে আমি অকালে জ্ঞান হারাবো। তাড়াতাড়ি চলো।’

কিছুই বুঝতে পারলো না মিতালী। প্রচন্ড রকমের বিস্মিত হলো সে। কন্ঠস্বরে বিস্মিত প্রকাশ করে বললো, ‘মানে?’

শেফালী তাড়াহুড়ো করতে লাগলো। মিতালীর এক হাত ধরলো। তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চট-জলদি দোকান থেকে বেরিয়ে এলো সে। মিতালীর হাত টেনে দ্রুততার সঙ্গে পা চালাতে লাগলো। মিতালী অবাকের সপ্তম আকাশে চলে গেছে যেন। হা হয়ে তাকিয়ে দেখছে শেফালীর অস্থির মুখ-খানি। কি হয়েছে আর কি হচ্ছে কিছুই তার বুঝে আসছে না। অবাক হওয়ায় বোধহয় প্রতিক্রিয়াহীন হয়ে পরেছে সে। তাই কোনো প্রশ্ন করছে না এখন। শেফালী তার হাত ধরেই রিকশা ডেকে উঠে পরলো। প্রতিত্তুর করলো না মিতালী। সেও মৌনতার সঙ্গে রিকশায় উঠে বসলো। শেফালী একবার রিকশার পিছনে উঁকি দিয়ে দেখলো। যাক বাবা। সে যেন হাফ ছেঁড়ে বাঁচলো।
.

মিতালীর যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো অংকুর। মেয়েটার মুখটা বড্ড মায়াবী। রাগি চোখ টা অসাধারন। গোলগাল চেহারায় একদম গুলুমুলু। হাসলে নিশ্চয় আরো সুন্দর লাগবে? আহঃ বুকের বা পাশে একহাত রাখলো অংকুর। চোখ দুটো আবেশে বন্ধ করে নিলো। হার্টবিট তখন দুই দুইবার মিস গিয়েছে। মেয়েটার রাগি চেহারা, চোখ পাকিয়ে তাকানো, দাঁত কিড়মিড় করা সব মিলিয়ে পাগল করেছে তাকে। এমন গুলুমুলু মেয়ে কয়টা পাওয়া যায়? ইশ, এতো তাড়াতাড়ি চলে গেলো? ভাগ্যে থাকলে নিশ্চয় আবার দেখা হবে। নিজের মনোভাবে নিজেই অবাক হলো অংকুর। আনমনে মুচকি হেসে মাথা চুলকালো সে।

দোকান থেকে বের হলো রাকিবের উদ্দেশ্যে। সামনের কয়েকটা দোকানে অগ্রসর হলো। হঠাৎ চোখ গেলো পাশের একটা দোকানে। দেখলো রাকিব দোকানীর সাথে কি নিয়ে যেন ঝগড়া করছে। ভ্রুঁ কুঁচকালো অংকুর। এগিয়ে গেলো সেখানে। প্রশ্ন করলো, ‘কি হয়েছে এখানে? কি নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে?’

রাকিব বললো, ‘ভাই দেখ, এই কাপটা ভাঙ্গা ছিলো আগে থেকেই। কিন্তু এই মিয়া বলছে আমি ভেঙ্গেছি মানে আমাকে জরিমানা দিতে হবে। কেন ভাই? কাপ তো আমি ভাঙ্গি নাই। তাহলে আমি কেন জরিমানা দিব?’

অংকুর কিছু বলার আগেই দোকানদার খেঁকিয়ে উঠলো, ‘কাপটা যেহেতু আপনার হাতে ছিল তার মানে আপনি ভেঙ্গেছেন। মিথ্যে বলছেন কেন এখন? জরিমানা দিতেই হবে আপনাকে।’

অংকুর রাকিবের দিকে তাকালো। রাকিবের দ্বিগুণ কণ্ঠস্বর, ‘আমি ভাঙ্গি নাই বলছি তো। একটা মেয়ে কাপটা আমার হাতে দিয়ে বলেছে সে জুতার ফিতা ঠিক করবে। আমি কি জানতাম সেই মেয়ে কাপটা ভেঙ্গে আমার হাতে দিয়ে নিজে ফুড়ুৎ হয়ে যাবে? এখানে আমার দোষ কোথায়? আমি যেহেতু ভাঙ্গি নাই সেহেতু টাকা আমি দিচ্ছি না।’

তর্ক-বিতর্ক চলতে লাগলো দুজনের মাঝে। অংকুর হ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে। এক পর্যায়ে যখন দেখলো পরিস্থিতি নাগালের বাহিরে। তখন সে চেঁচিয়ে উঠলো। দোকানদারের কাছে জরিমানা কত জানতে চাইলে সে জানায় ছয়শো টাকা। অংকুর টাকা বের করে দিয়ে দিলো। দোকানী টাকা হাতে নিয়ে রাকিবের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে চলে গেলো। অংকুর রাকিব কে টেনেটুনে দোকান থেকে বের করলো। বাহিরে এসে রাকিব তার হাত ঝামটা মেরে ছাড়িয়ে নিল। রাগে ফুশ করতে করতে বললো, ‘মেয়েটাকে একবার পাই আমি। ওর চৌদ্দ গুষ্টির জুতার ফিতা লাগানোর মজা বের করবো আমি।’

অপরদিকে একটা মেয়ে রাকিবকে বোকা বানিয়েছে ভেবেই হাসতে হাসতে বেহুশ অংকুর। তার হাসিতে যেন রাকিবের শরিরের আগুনে ঘি ঢালা হয়েছে। রাকিব রেগে অংকুরের বাহুরে পা:ঞ্চ মারলো একটা। ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠলো অংকুর।
#অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল_মিহির [লেখিকা]

[০৫]

নভোমণ্ডলে ভাস্যমান বিশালাকৃতি উল্কাপিণ্ডের উত্তাপে জ্বলজ্বল করছে ধরনী। ভ্যাঁপসা গরমে গায়ের চামড়া জ্বলছে প্রচন্ড। তীব্র তাপে মাথার থুলি আগুনের লাভা ন্যায় উত্তাপ। মাথা চক্বর দেওয়ার উপক্রম। রিকশার হুট তুলেও এই তীব্র উত্তাপ থেকে বাঁচতে পারেনি মিতালী ও শেফালী। মাত্রারিক্ত সূর্যকিরণ পুড়িয়ে দিয়েছে দুই বোনকে। চেহারায় স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ ফুটে আছে শেফালীর। বাসার সামনে আসতেই ধপ করে রিকশা থেকে নেমে গেলো সে। আকাশের পানে তাকিয়ে সূর্যকে অশ্রাব্য ভাষায় কয়েকটা গালি দিল। মিতালী রিকশা-ওয়ালা কে তার ভাড়া মিটিয়ে বাসার ভিতরে ঢুকলো বোনকে নিয়ে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে মিতালী প্রশ্ন করলো, ‘ তখন কি হয়েছিল তোর?’

বিরক্তিতে নাক মুখ কুঁচকে রেখেছে শেফালী। সেই অবস্থাতেই উত্তর দিল, ‘আর বলো না। টাকা বাঁচিয়েছি। ভাগ্যিস তখন মুভি টার কথা মনে পরেছিল। এতোদিনে কোনো ভারতী বাংলা মুভি আমার লাইফে কাজে দিয়েছে। যার ফলস্বরুপ ছয়শো টাকা বেঁচে গেছে।’

‘মানে? কিছুই বুঝলাম না।’

‘উহুম! বুঝতে হবে না। তাড়াতাড়ি আসো বাসায় যাই। গরমে অর্ধেক শেষ আমি।’

নিশ্চুপ রইলো মিতালী। হাজারো প্রশ্ন করে লাভ নেই এখন। যতোক্ষন না শেফালী নিজে থেকে কিছু বলছে। কারন সে জানে তার বোন কি পরিমানের বিচ্ছু। হয়তো কিছু করেছে। কিন্তু সেটা কি জানতে চাইলো না। মৌনতা বজায় রেখে বাসায় চলে এলো দুজন।

বাসার বাহির টা যেন মিতালীর জন্য শান্তিময় স্থান। নিজ বাসস্থানও কেমন নিজের কাছে বিষন্ন লাগে। প্রতিবার, প্রতিমুহূর্তে নিজের দেহের গড়নের খোঁটা শুনতে শুনতে নিজেকেই নিজের কাছে অভাগা লাগে। বাসায় এসেও শান্তির খোঁজ নেই তার। ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই দাদির কর্কষ কন্ঠ কানে আসলো। চোখ লাল বর্ণ ধারন করে ঝাপসা হয়ে এলো। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা করলো।

‘বলি মাইয়া মানুষের এতো ঘুরা ফেরা কিসের? অপায়া মাইয়া তো মুখ লাগাই রাখছোস। তাইলে আবার বাইরে যাস কেন? এমনিতেও বিয়াশাদীর নাম গন্ধ নাই তোর। তাও বাইরে গিয়া আরো নজর লাগাইয়া আয়। লজ্জা শরমের মাথা নাই মাইয়া? ছিঃ এমন মাইয়া জীবনেও দেখি নাই।’

দাঁতে দাঁত পিষলো শেফালী। নিজের রাগ দমাতে না পেরে বলে উঠলো, ‘সমস্যা কি তোমার দাদী? তুমি সব সময় বুবুর পিছনে পরে থাকো কেন? বুবুর লেগ পুল করা ছাড়া তোমার আর কাজ নেই? সারাদিন শুধু মিতালী এই, মিতালী সেই। আরেহ বা*ল মিতালী কোন জন্মে তোমার শত্রু ছিল? আমার কি মনে হয় জানো? তোমাকে জরুরী ভিত্তিতে সাইক্রেটিস্ট দেখানো উচিত। মন্ডুর যেই ক্রু গুলা ঢিলা আছে সে গুলা একটু টাইট দেওয়া উচিত।’

রান্না ঘরে ছিলো আমেনা। শাশুড়ির বলা প্রত্যেকটা কথায় তার কানে এসেছে। নিজের মেয়েকে নিয়ে এমন কুটক্তি তিনি একদম নিতে পারে না। মিতালী যখন গর্ভে এসেছিল তখন জুলেখার আশা ছিল ছেলে হবে। কিন্তু ঘর আলো করে আসা মিতালী তার দাদীর মুখ অন্ধকার করে দিয়েছে। সেই থেকেই মিতালী যেন তার কোনো কালের অদৃশ্য শত্রুতে পরিণত হয়েছে। কি পায় মেয়েটাকে এভাবে কথা শুনিয়ে? তারই রক্ত বইছে মিতালীর মাঝে। তাও কেন মিতালীর প্রতি তার এতো তিক্ততা? বুঝে আসে না আমেনার। আজ এমন কটুক্তি শুনে রাগ উঠেছে ছিল শরিরে। ভেবেছিল আজ উত্তর দিবে। কিন্তু তার আগেই ছোট মেয়ে শেফালীর কথা শুনে মুখ হা হয়ে এলো তার। সাইক্রেটিস্ট, স্ক্রু ঢিলা শুনে হাসি পেলো খুব। যতোটুকু হাসি পেয়েছে তার থেকে দ্বিগুণ হাসি পাচ্ছে এখন শাশুড়ির প্রশ্ন শুনে।

শেফালীর কথা বুঝতে না পেরে জুলেখা প্রশ্ন করলেন, ‘সাইকেসিস মানে কিরে?’

নির্বোধ হলো মিতালী। চোখ তুলে দাদীর দিকে তাকালো। তারপর চোখ ফিরিয়ে তাকালো শেফালীর দিকে। দেখলো শেফালী ঠোঁট টিপে হাসছে। প্রথমে কথা গুলো বিষাদের মতো লাগলেও এখন শেফালীর জন্য হাসি পেলো একটু।

শেফালী দাঁত কেলিয়ে প্রতিত্তুর করলো, ‘এটা একটা জায়গার মালিকের নাম দাদী। সেখানে গেলে তোমাকে ফুলের মালা দিয়ে বরন করবে। মাথায় তুলে লম্বা লম্বা লাল নীল তার দিয়ে শক দিবে। তাহলে তুমি একদম হেলদি হয়ে যাবে। কোনো সমস্যা থাকবে না পাক্কা।’

জুলেখা পুরনো আমলের মানুষ। কি থেকে কি বুঝলেন কে জানে। শেফালীর কথা শুনে কন্ঠস্বরে আফসোস এনে বললেন, ‘ঠিক কইছোস। আমার সেখানে যাওয়া দরকার। দিনকাল ভালো যাইতেছে না। মাথা ডা কেমন জানি ঘুরে। খাইতেও পারি না। তোর আব্বা আইলে কইছ আমারে নিয়া যাইতে।’

শেফালী বিড়বিড় করে বললো, ‘যদি সম্ভব হতো তাহলে আরো আগেই আমি নিয়ে যেতাম।’

শেফালী আরো কিছু বলার উদ্বেগ হতেই মিতালী তার হাত ধরে ফেললো। তারপর টেনেটুনে নিজের রুমে নিয়ে গেলো। রুমে এসেই শেফালী উচ্চস্বরে হাসিতে মেতে উঠলো। হাসতে হাসতে বিছানায় শুয়ে পরলো সে। মিতালী ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হেসে তাকিয়ে আছে তার দিকে। শেফালী পেটে হাত দিয়ে হাসতে হাসতে বললো, ‘কি বোকা বানালাম বলো বুবু? এমন বোকা জীবনেও দেখি নাই। দাদীরে ছোট থেকেই এভাবে বোকা বানিয়ে আসছি আমি। আজওও তাই হলো। আব্বা আসলে বলতে হবে তো।’ বলেই আবারো হাসতে লাগলো সে।

স্মিতি হাসলো মিতালী। ‘তুই পারিসও বটে।’ বলে আলমারি থেকে কাপড় বের করে ওয়াশরুমে চলে গেলো। শেফালী এখনো হাসছে। তার হাসি যেন আজ না থামার পণ করেছে।
.

দিনের ব্যস্ততা কাটয়ে বিকেলে অবসর হলো আমেনা। পাশের বাসায় যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিলো। মিতালী কাল সন্ধ্যা বেলায় ছাদ থেকে এসেই তাকে জানিয়েছে পাশের বাসার আন্টি অর্থাৎ সখিনা বিবি তাকে যেতে বলেছে। হয়তো কোনো জরুরি দরকার তাই। আমেনা মাথায় শাড়ির আঁচল টেনে নিজেকে যাবার জন্য তৈরি করে নিলো। বের হওয়ার আগে মেয়েদের রুমে অগ্রসর হলো। প্রথমে শেফালীর রুমে আসলো। দরজা খুলে দেখলো সে ঘুমাচ্ছে। তাই হাল্কা করে দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে মিতালীর রুমে আসলো। দেখলো মিতালী টেবিলে বসে আর্ট করছে। রুমে না ঢুকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পিছন থেকেই ডাক দিলো আমেনা।

‘মিতালী শুন, আমি পাশের বাসায় যাচ্ছি। শেফালী আর তোর দাদী ঘুমাচ্ছে। খেয়াল রাখিস। কেউ আসলে দেখে দরজা খুলবি তার আগে না।’

ক্যানভাসে তুলি চালাচ্ছিলো মিতালী। মায়ের কথা শুনে পিছনে ফিরে তাকালো। বিনয়ী একটা হাসি বললো, ‘চিন্তা করো না। তুমি সাবধানে যাও।’

প্রতিত্তুরে মুচকি হাসলেন আমেনা। তারপর দরজা হাল্কা ভিড়িয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। তাদের বিল্ডিং’য়ের পিছনের বিল্ডিং টাই যাবে সে। তাই সময় বেশি লাগে নি। তিন-তলায় এসে কলিংবেল বাজালে দরজা খুললেন সখিনা বিবির পুত্রবধূ। মেয়েটির নাম মিনা। ছিমছাম গড়নের ফর্শা গায়ের রঙ। বয়স অল্প। শেফালীর থেকেও দুই-এক বছরের ছোট হবে বোধহয়। মিনা তাকে খুব সাধরে গ্রহন করলো। আন্তরিকতার সাথে ভিতরে নিয়ে বসালো। তারপর চা আনার জন্য রান্না ঘরে গেলো। আমেনা বসার পরেই সখিনা বিবি এসে তার পাশে বসলেন।

‘আসলে কি হইছে মিতালীর মা। তোমারে একটা দরকারি কামে ডাকছিলাম।’

‘জ্বি আপা বলেন কি দরকার ছিল।’

পান চিবুচ্ছে সখিনা বিবি। ডান হাতের অনামিকা আঙ্গুলে চুন লাগানো ছিল। আঙ্গুল মুখের সামনে এনে দাঁতের মধ্যে একটু চুন লাগালো। পান চিবুতে চিবুতে বললেন, ‘তোমার বড় মাইয়া তো মেলা বড় হইছে। এখনো বিয়াশাদী হয় নাই। একটা ভালো সমন্ধ আইছে আমার কাছে। পোলা অনেক ভালো। বাপের ব্যবসা আছিল এখন পোলা হেইডা সামলাইতাছে। এক মার এক পোলা। ননাস, ননদ, জালের কোনো প্যারা থাকবো না। হড়িও বুড়া কইদিন পর মইরা যাইবো গা। তোমার মাইয়ার কপাল লাগবো।’

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আমেনা। এমন কথা বলার জন্য তাকে জরুরি তলব দিয়ে এনেছে জানলে কখনোই এই বাড়ির মুখী হতো না সে। মিতালী কত বড় হবে? বয়স মাত্র চব্বিশ। এই চব্বিশ বছর বয়সকেই সবাই বুড়ি বলে আখ্যায়ী করছে।

সখিনা বিবি আরো বলতে লাগলেন, ‘তবে একটু সমস্যা আছে বুঝছো নি মিতালীর মা। পোলার আগেও একটা বিয়া হইছিল। মাইয়া ডার নাকি আরেক পোলার লগে লাইন আছিল। তাই ভাইগা গেছে গা। প্রথম পক্ষের একটা ছোট মাইয়া আছে। এছাড়া সবই ঠিক আছে। এমন পোলা লাখে একটাও পাইবা না। আমি কি ঘটকরে কমু তারা দেখতে আসার লাগি?’

সখিনা বিবির উচ্ছোক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমেনা চোখ তুলে তার দিকে তাকালো। ধাতস্ত কন্ঠে বললো, ‘দেখেন আপা। আপনাদের আমার মেয়েকে নিয়ে ফালতু টেনশন করতে হবে না। আমার মেয়ে কোনো ফেলনা নয় যে যার তার সাথে তার বিয়ে দিয়ে দিবো। আমার মেয়ের বিয়ে নিয়ে খামোখা টেনশন করে মাথার চুল পাকাতে হবে না। আপনার দরকারি কথা শেষ হলে আমি এখন আসি।’

চটজলদি উঠে দাঁড়ালো আমেনা। সখিনা বিবির দিকে ধিক্কার দৃষ্টিতে তাকালো একবার। বিলম্ব না করে প্রত্যাখ্যান করলো এই বাড়ি। রাগে তার শরির কাঁপছে। ইচ্ছে করছে পৃথিবী ছেড়ে দুই মেয়েকে নিয়ে শান্তিপূর্ণ কোনো এক অচেনা জায়গায় চলে যেতে। যেখানে থাকবে না এমন মানুষরূপী নিকৃষ্ট প্রানী যারা কথায় কথায় অন্যকে অপদস্থ করে। বাসায় এসে কলিংবেল বাজালে শেফালী দরজা খুললো। সে মায়ের এমন চেহারা দেখেই তাৎক্ষনাৎ প্রশ্ন ছুঁড়লো, ‘কি হয়েছে আম্মু?’

প্রতিত্তুর করলো না শেফালী। মৌনতার সঙ্গে বাসায় ঢুকে নিজের রুমে চলে গেলেন। শেফালী যেন মায়ের এমন ব্যবহারে বিস্মিত হয়ে আছে। কি হয়েছে বুঝতে পারলো না। ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামালো না তেমন। চুপচাপ সদর দরজা লাগিয়ে দিলো। কানে হেডফোন গুঁজে গান লাগালো একটা। পুরনো দিনের একটি গান।
.

রাত্রীর মধ্যভাগ। চারপাশ কোলাহল মুক্ত। আকাশে বিশালাকৃতি চাঁদটা থালা ন্যায় ফুটে আছে। তার জ্যোৎস্নায় আলোকিত ধরনী। রাস্তাঘাট জনমানব-হীন। পরিবেশ শীতল হলেও ঘেমে চুপসে আছে দুই ভাই অংকুর ও রাকিব। দুজনই বাস্কেটবল খেলা শেষে নির্জন রাস্তা পার করে বাসায় ফিরছে। অংকুরের হাতে ঠান্ডা কোকাকোলার বোতল। যার মাঝে থেমে থেমে চুমুক দিচ্ছে সে। আর রাকিবের হাতে বাস্কেটবল যেটা দিয়ে খেলতে খেলতে এগুচ্ছে সে। খেলার মাঝে হঠাৎ বলটা রাস্তার নিচে চলে গেছে। রাকিব ‘শিট’ বলে রাস্তার নিচ থেকে বলটা নিয়ে আসলো। খেয়াল করলো অংকুর হাঁটতে হাঁটতে একদম দূরে চলে গেছে। সে আপন মনে কোক খাচ্ছে আর কিছু ভাবছে। রাকিব ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকালো। দৌড়ে এসে অংকুরের পাশাপাশি হাটতে লাগলো। এতেও যেন অংকুরের ধ্যান নেই। বিরক্ত হলো রাকিব। অংকুরের গায়ে কিল বসিয়ে বললো, ‘কোন দুনিয়াতে ডুবে আছিস তুই?’

হঠাৎ ভাবনার জগতে ব্যাঘাত ঘটায় হকচকিয়ে গেলো অংকুর। ড্যাবড্যাব চোখে রাবিকের দিকে তাকালো। রাকিব কোমরে হাত রেখে দাঁড়ালো। চোখ ছোট ছোট করে তাকে পর্যবেক্ষণ করে বললো, ‘প্রেমে পরেছিস?’

খুকখুক করে কেশে উঠলো অংকুর। হাল্কা গলা ঝড়ে বললো, ‘বেশি কথা বলিস। তাড়াতাড়ি বাসায় আয়।’

বলেই চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই রাকিব তার বাহু ধরে দাঁড় করালো। ভ্রুঁ নাচিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘মেয়েটা কে?’

রাকিবের এমন প্রশ্নে ভ্যাবাচেকা খেলো অংকুর। অপ্রস্তুত হয়ে গেলো সে। কিছুটা আমতা আমতা করে বলে উঠলো, ‘তেমন কিছু না। তুই ভুল ভাবছিস।’

‘থা::প্রাবো ধরে। আমার কাছে মিথ্যে বলতে আসিস না। আমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি তুই প্রেমে পরেছিস। ভালোই ভালোই বলে দে না হলে আমাকেই পেট থেকে কথা বের করতে হবে।’

মৃদু হেসে ফেললো অংকুর। পাশাপাশি হাটতে লাগলো দুজন। অংকুর বললো, ‘প্রেমে পরেছি কিনা জানি না। তবে ভালো লেগেছে মেয়েটাকে। কথায় কথায় কেমন রাগি চোখে তাকায়। জাস্ট অসাধারন লাগে দেখতে। চুল গুলো অনেক বড়। চেহারায় গুলুমুলু একটা ভাব আছে। চোখ দুটো বড়বড় যখন রেগে তাকায় তখন বুঝা যায়। কাজল দিলে মায়াবী লাগে। মেয়েটা কে, তার নাম কি আমি জানি না। আদৌ তার সাথে আবার দেখা হবে কি না সেটাও জানি না। তবে আমি চাই। খুব করে চাই আরো একবার দেখা হোক আমাদের।’

স্মিতি হাসলো রাকিব। অংকুরের চোখে মুখে একরাশ মুগ্ধতা দেখতে পারছে সে। হাটার মাঝেই এক হাতে অংকুরের গায়ে চাপড় বসিয়ে বলল, ‘বাহ্ ভালোই ফেঁসেছিস দেখছি।’

নিরবে হাসল অংকুর। প্রতিত্তুর করলো না। ভাবতে লাগলো মিতালীর কথা। মেয়েটা অনেক অদ্ভুত। চাহনীটাও অদ্ভুত। সব চেয়ে বেশি ভালো লাগেছে চেহারাটা। একদম গুলুমুলু। টুকুশ করে আদর করে দিতে ইচ্ছে করবে। হাহা! আপন মনে হেসে ফেললো অংকুর।
.
ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে আমেনা। শলার ছোট ঝাড়ু দিয়ে বিছানায় ঝেড়ে নিলো। বালিশ গুলো ঠিক করে মিতালীর বাবার অগুছালো শার্ট ও তার নিজের শাড়ি গুছানোর জন্য হাতে নিলো। মন তার ক্ষুন্ন। মৌনতার সাথে নিজের কাজ করছে। দূর থেকে সবই পর্যবেক্ষণ করছিলেন জুলফিকার। নিশ্চুপ থেকে ধীর পায়ে আমেনার কাছে আসলেন। বিছানায় আয়েশী ভঙ্গিতে বসে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার কি মন খারাপ?’

নিস্প্রভ দৃষ্টি তুলে তাকালেন আমেনা। বললেন, ‘আমার আর ভালো লাগে না। মেয়েটাকে নিয়ে ইচ্ছে করে অনেক দূরে চলে যাই। যেখানে এমন নিকৃষ্ট মানবজাতি থাকবে না। কারোর কূটক্তির দেখা মিলবে না। শুধু শান্তি থাকবে। এই দুনিয়াতে মিতালীর আসাটাই ভুল ছিল। কেন এলো সে? কেন দিলো আল্লাহ? কেন এমন লাঞ্ছনা শুধু মিতালীর জন্য লিখে রেখেছেন তিনি?’

ফুঁপিয়ে উঠলো আমেনা। শাড়ির আচল টেনে মুখে ঝাপটে ধরে কেঁদে উঠলেন। জুলফিকার দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকে পাশে বসালেন। শান্তনা দিয়ে বললেন, ‘সমাজে চলতে গেলে তোমার সাথে ভালো ও মন্দ দুইটা জিনিসের সাথেই দেখা হবে। তাদের দেখে শুনে অভিজ্ঞতা বাড়বে। সবার কথার গুরুত্ব দিতে নেই। যদি তুমি তাদের গুরুত্ব দাও। তাহলে তারা তোমাকে পরিবর্তেকষ্ট দিবে। উপেক্ষা করতে শিখো। এক কান দিয়ে ঢুকাবে তো আরেক কান দিয়ে বের করে দিবে।’

আমেনা নিশব্দে মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলো জুলফিকারের কথায়। চোখের পানি মুছে নিলো। অতঃপর লাইট নিভিয়ে ঘুমানোর প্রয়াস করলো দুজন।

চলমান..
চলমান..
চলমান..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here