অনেক সাধনার পরে পর্ব -০১+২

‘আপনি ডায়েট করেন না?’

পাত্রের কাছ থেকে এমন প্রশ্ন শুনে তব্দা খেলো মিতালী। কাজল কালো আঁখি যুগল তুলে তাকালো সামনে বসে থাকা সুদর্শন পাত্রের দিকে। অপমানিত হলো সে। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো তার। তাৎক্ষনাৎ দৃষ্টি নত করে নিল। আজ তাকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছে। প্রতিবারের মতো এবারও পাত্রপক্ষের কাছ থেকে এই কথাটা শুনতে হয়েছে তার। কারন একটাই সে একটু মোটা। এই একটা কারনে বহুবার পাত্রপক্ষের কাছে প্রত্যাহার হয়েছে সে। সমাজের কাছে কটূকথা শুনতে হয়েছে। কিন্তু মিতালী কাউকে বুঝাতে পারে না। এতে তার কোনো হাত নেই। সে তার সাধ্যমতো খুব করে খাওয়া নিয়ন্ত্রণ করে কিন্তু! সৃষ্টিকর্তা তাকে হয়তো এভাবেই পছন্দ করে। তাই তো কোনো পরিবর্তন আসে না তার মাঝে।

পাত্রের মা তার মনে থাকা সকল প্রকার প্রশ্ন এক এক করে করতে লাগলো। মিতালীও স্বাভাবিক ভাবে সকল প্রশ্নের উত্তর দিলো। ব্যাবহার তার খুব সাবলীল। বেশকিছু সময় পর মিতালীকে তার রুমে চলে যাবার জন্য বলা হয়। যাওয়ার অনুমতি পাওয়ার পর এক মুহূর্তও বিলম্ব করলো না মিতালী। কোন রকমে এই প্রতিমূর্তি সেজে বসে থাকার স্থান থেকে বেড়িয়ে গেলো। রুমে গিয়ে দরজা খানি হালকা ভাবে লাগিয়ে দিলো। কিন্তু বন্ধ করলো না। জীবনটা এতো অদ্ভুত কেন? সৃষ্টিকর্তার নিজের হাতে তৈরিকৃত মানব হয়ে কেন সে কটূক্তি শুনবে? লাল হয়ে এলো তার কাজল টানা নেত্রপল্লব। ভারী হতে লাগলো চোখদুটো। জলের বিন্দু কণা জমতে জমতে সাগর হয়ে গড়িয়ে পরলো কোমল গালে।
.

বিকেলের স্নিগ্ধ দৃশ্য মিলিয়ে গেলো কিছুক্ষন আগে। গোধূলির আবিরে ভেসে উঠলো হলুদ লালচে আভা। পাখিদের কিচিরমিচির ডাকে চারপাশ মুখরিত। বারান্দার কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে মিতালী। পলকহীন ভাবে তাকিয়ে আছে দূর আকাশের হলুদ লাল বর্ণের সূর্যের দিকে। পরনে তার সেই কমলা রঙের জামদানী শাড়ি। খোঁপায় সাদা গাজরা গেঁথে রাখা। চোখে গাঢ় করে কাজল টানা। হাস্যউজ্জল মুখটি এখন মলিন। আজও পাত্রপক্ষ তাকে প্রত্যাহার করেছে তার দেহের গরনের কারনে। নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো মিতালী।

‘বুবু? সন্ধ্যা বেলায় এখানে একা একা কি করছো?’ খারাপ কিছুর নজর লাগবে তো।’

পিছু ফিরে তাকালে শেফালীর মুখ নজরে আসলো তার। হালকা পাতলা ছিমছাম গায়ের গড়ন। চুলগুলো অল্প কুঁকড়ানো। টুল পরা গালের হাসিতে মিষ্টি মিষ্টি লাগে একদম। শেফালী আর মিতালীর মাঝে বেশ তফাৎ। সেটা দেহের গড়ন দেখলেই সবার নজরে পরবে। শেফালী এগিয়ে এসে তার পাশে দাঁড়ালো। রেলিং’এ হেলান দিয়ে বললো, ‘আম্মা বারণ করেছে তোমাকে এমন সময় এখানে থাকতে। তাও এখানে তুমি? আম্মা দেখলে বকবে তো।’

‘আম্মা এই সময় আমার রুমে আসবে না। গিয়ে দেখ রান্না ঘরে ব্যস্ত উনি।’ শেফালীর দিকে ফিরে রেলিং’এ হেলান দিয়ে বললো মিতালী। দক্ষিণা এক দমকা হাওয়ায় উড়ছে চুল গুলো। মিতালী এক হাতে স্বযত্নে নিজের এলোমেলো খেলায় মেতে উঠা চুল গুলো কানের পিছে গুঁজলো। শেফালী গালে টুল পরা হাসি দিয়ে বললো, ‘বুবু, তোমাকে না আজকে অনেক সুন্দর লাগছে। আর ভালো করে দেখেছো? তোমার চোখ দুটো একদম আমার মতো লাগছে।’

শেফালীর কথা শুনে স্মিতি হাসলো মিতালী। এক হাতে বোনের গাল টেনে দিলো। শেফালী বিরক্তি সহিত ঝাপটা মেরে তার হাত সরিয়ে দিলো। উচ্চস্বরে হাসিতে মেতে উঠলো মিতালী। হাসি তার থামছে না দেখে শেফালী চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বললো, ‘আমার গাল তোমার বাপের সম্পত্তি? যখন সামনে পাও খালি টেনে দাও।’

‘তুই জানিস? তোর গালে সর্বপ্রথম আমি চুমু খেয়েছিলাম? তখন তুই খিলখিল করে হাসছিলি। তোর হাসি দেখে এতো কিউট লাগছিলো যে তোর গাল টেনে দিয়েছিলাম। তাও প্রথম বার। সে কি কান্না তোর।’ বলেই এক হাত মুখের সামনে এনে আবারো হাসতে লাগলো মিতালী। শেফালী অপ্রসন্ন চোখে তাকিয়ে রইলো শুধু। মনমরা করে বুকে দুই হাত গুঁজলো বোনকে পিছ দিয়ে দাঁড়ালো। মিতালী ঠোঁটে ঠোঁট টিপে হাসলো। তারপর এগিয়ে এসে শেফালীকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। কাধে চিবুক রেখে চোখ বুজে আহ্লাদী গলায় বললো, ‘আহারে বোন আমার। রাগ করেছে। কি করবো বল? তোর গাল দুইটা দেখলেই টেনে দিতে ইচ্ছে করে। এই অভ্যেস আমার এই জীবনেও যাবে না। রাগ করিস না।’

প্রতিত্তুরে শেফালী মুচকি হাসি দিলো। তারপর মিতালীর দুই হাত ধরে বললো, ‘হয়েছে এবার রুমে আসো। কেউ দেখলে তোমাকে বকবে।’

বিলম্ব করলো না দুই বোন। বারান্দা ছেঁড়ে রুমে চলে আসলো। মিতালী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গয়না খুলতে লাগলো। কানের দুল, গলার হার, দুই হাতের চুড়ি খুলে ডেসিংটেবিলে রাখলো। চুল থেকে গাজড়া খুলে খোঁপায় বাধা চুল গুলো উন্মুক্ত করে দিলো। মুহূর্তেই সিল্কি কালো চুল গুলো পিঠ আঁচড়ে পরে কোমড়ের নিচ অব্ধি গেলো। আলমারি থেকে কুর্তি নিয়ে ওয়াশরুমে গেলো শাড়ি বদলাতে।

রাতের ঘড়ির কাটা নয়টার ঘরে। গমগমে পরিবেশ। আয়োজন চলছে রাতের খাবারের। মিতালীর মা আমেনা টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে। আপাতত টেবিলে সবাই উপস্থিত শুধু মিতালী আর শেফালী বাদে। আমেনা মিতালীর বাবার প্লেটে ভাত দিয়ে তরকারি দিয়ে দিলো। তারপর এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো। এর কিছু সময় পর মিতালী ও শেফালী দুইজনই সেখানে উপস্থিত হলো। চেয়ার টেনে পাশাপাশি বসলো দুজন। আমেনা মিতালীর প্লেটে তিনটে রুটি দিলো। তখুনি মুখ বাঁকিয়ে উঠলেন জুলেখা।

‘বলি মেয়েকে একটু কম খাওয়াও আমেনা। সারাদিন খাইতে খাইতে তো শরিরের অবস্থা নষ্ট করছে। কেউ পছন্দ করে না। যতোবার পাত্রপক্ষ দেখতে আসে ততোবার মোটা শরিরের লাগি মুখ ফিরায়া নেয়। কি লজ্জা! কি লজ্জা!’

দাদীর কথা শুনে ধাতস্থ হলো মিতালী। চুপচাপ প্লেটে থাকা রুটি দুটোর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকালো। খাবার নিয়ে আর কত অপমান সয্য করবে সে? নামে মাত্র তিনটে রুটি। কিন্তু দুইটা রুটির সমানও হবে না যে এতো পাতলা করে বানানো। এখন কি সে খাওয়া দাওয়াও ছেড়ে দিবে? উঠতে বসতে এতো অপমান, এতো লাঞ্ছনা কেন ভোগতে হবে তাকে? রুটি ছিঁড়ে মুখে দেওয়ার মতোও সময় পেলো না। তার আগেই দাদী খেঁকিয়ে উঠলেন। খিদে মিটে গেছে একদম। এই বিষাক্ত খাবার আর গলা দিয়ে নামবে না।

শেফালী দাঁতে দাঁত পিষে বসে আছে। তার বোনকে নিয়ে কেউ কটুক্তি করলে একদমই সয্য করতে পারে না। ইচ্ছে করছে মুখের উপর কড়া করে কিছু কথা শুনিয়ে দিতে। চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকালো সে। আমেনা ইশারায় তাকে চুপ থাকতে বললো।ধাতস্থ হলো শেফালী। কিছু বলতে চেয়েছিলো কিন্তু পারলো না মায়ের বারণের জন্য। তাই চুপচাপ বোনের অপমান সয্য করতে লাগলো। একদিন সময় আসলে সব একইসঙ্গে মুখের উপর বলে দিবে বলে পণ করলো তার মন।

আমেনা নিজেও শাশুড়ির এমন ব্যবহারে বরাবরই অসন্তুষ্ট। নিজের মেয়েকে নিয়ে কোনো মা কখনো কটূকথা শুনতে পারে না। শাশুড়িকে যথেষ্ট সম্মান করে তাই প্রতিত্তুর করতে পারে না এটাই সমস্যা। চোখ ঘুরিয়ে স্বামীর দিকে তাকাতেই দেখলো সেও নিস্থব্ধ হয়ে আছে। নিরবে তপ্ত শ্বাস ফেললো আমেনা।

মিতালীর দাদী জুলেখা আবারো বলতে লাগলো, ‘এমন অপায়া মেয়ে এজীবনে দেখিনি বাপু। বলি অন্য মাইয়া দের থেইকা কিছু শিখবার পারছ না? অন্য মাইয়া বাদ দিলাম। নিজের বোইনের থেইকাই শিখ। মাশা আল্লাহ আমাদের শেফালীর গড়ন মাশা আল্লাহ। কারোর নজর না লাগুক।’

হতাশ হলো শেফালী। দাদী সবসময় তাকে একটু বেশি আহ্লাদ করে। আলাদা চোখে দেখে। কারন একটাই তার স্বাস্থ্য স্বাভাবিক। দেখতেও উজ্জ্বল ফর্শা গায়ের রঙ। কিন্তু এই আদর শেফালীর চায় না। যেখানে তার বোনকে উঠতে বসতে অপদস্থ করা হয় সেখানে এইসব সে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। কষ্ট হয় তার। সে কেন আলাদা হলো? হলে দুই বোন একইসঙ্গে মোটা হতো নাহলে চিকন।

জুলেখা কিছু বলতে যাবে তার আগেই তাকে থামিয়ে দিলো মিতালীর বাবা জুলফিকার। গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘আম্মা। আমার মেয়ে যেমন তেমনি সুন্দর। ওই ছেলে আমার মেয়ের যোগ্য ছিলো না। এমন ছেলের হাতে আমার মেয়েকে আমি অবশ্যই তুলে দিতাম না। তারা হ্যাঁ বললেও আমি না করে দিতাম। আমার দুই মেয়েকে আমি সমান চোখে দেখি। তারা দুইজনই আমার আকাশের চাঁদ। আপনি চুপচাপ খেয়ে নিন। আপনার ঊষুধ আছে।’

প্রসন্ন হলো মিতালী। ঠোঁটে ফুটে এলো তার প্রাপ্তির হাসি। সন্তোষ চোখে বাবার দিকে তাকালো সে। শেফালীও খুশি হলো বাবার কথায়। বাবার প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা উভয় আরো দ্বিগুণ বেড়ে গেলো।

অন্যদিকে ছেলের কথা শুনে মুখ বাঁকাল জুলেখা। নাক কুঁচকে বললেন, ‘হ হ, মাইয়ার হইয়া সাফাই করা বাদ দাও। নয়তো সারাজীবন ঘরে পালা সাজাইয়া রাখো। এই জীবনে এই মাইয়ার বিয়া হইবো না।’

‘দরকার পরলে সারাজীবন মেয়েকে ঘরে বসিয়ে খাওয়াবো। আমার সম্পত্তির অভাব নেই। সমস্যা হবে না। এই নিয়ে খামোখা আপনার চিন্তা করতে হবে না।’ জুলফিকারের গম্ভীর উত্তর। নিভলো জুলেখা। নাক মুখ কুঁচকে বিড়বিড় করে কিছু বলতে লাগলো।

মিতালী তার প্লেট থেকে দুটো রুটি কমিয়ে ফেললো। অবশিষ্ট একটা রুটির ছোট ছোট টুকরো করে আপন মনে খেতে লাগলো সে। আহত হলো আমেনা। আর কতো খাওয়া কমাবে মেয়েটা? এতো কম খেলে যে অসুখ পরবে। সবাই বলে খাবার কম খেতে। কিন্তু আমেনা জানে মিতালী একটা ছোট বাচ্চার থেকেও কম খায়। কিন্তু বুঝাবে কাকে? সৃষ্টিকর্তা যে মিতালীকে এই রূপেই পছন্দ করে। কষ্টে বুক ভারি হয়ে এলো তার। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে সয্য করতে লাগলো মেয়ের এই অপদস্থ হওয়া।
.

স্নিগ্ধ সকালের রৌদ্দুর। শীতল হাওয়া প্রভাহমান। যানবাহনে পূর্ণ রাস্তাঘাট। তীব্র হর্ণের ধ্বনি সঙ্গে মানুষের কোলাহল সব মিলিয়ে একটা ব্যস্ত নগরী গড়ে উঠেছে। পিচ ঢালা রাস্তার এক পাশের ফুটপাত ধরে হাটছে মিতালী। হাতে তার এক্রাইলিক রঙতুলি আর ক্যানভাস। মসৃণ কালো চুল গুলো বেনী করে এক পাশে রাখা। কানে মাধ্যমিক সাইজের দুল। ওড়নাটা শরিরে ভালোই আঁটসাঁট করে দেওয়া। সম্পূর্ণ শরির খুব সাবলীল ভাবে ঢেকে রেখেছে সে।।বাম হাত টা উঠিয়ে ঘড়িতে সময় দেখে নিলো। না আজ দেড়ি হয়ে গেছে। মুফাজ্জল স্যার তার ক্লাসে দেড়ি করা পছন্দ করে না। আর মিতালীর ব্যাপারে তো না-ই। কারন মুফাজ্জল স্যার মিতালী কে ভিষণ ভাবে আদর করে। দ্রুত পা চালালো মিতালী। হাটার সময় হঠাৎ পায়ের নিচে একটা কলার খোসা পরলো। কিঞ্চিৎ পিচ্ছিল খেলেও নিজেকে সামলে নিলো মিতালী। বিরক্তিতে কপালে তার সূক্ষ্ম ভাজ পরলো। মানুষ এতো অসতর্ক কেন? এখন সে যদি পরে গিয়ে হাত পা ভাঙ্গতো তাহলে তার দায়ভার কে নিতো? ক্ষুব্ধ মনে নিশ্বাস ফেললো সে। খোসা টা হাতে নিয়ে রাস্তার পাশে নিচে ছুঁড়ে মারলো। সামনে অগ্রসর হতে যেই পা বাড়াবে ওমনি কানে আসলো একটি কথা।

‘হ্যালো মিস? সমস্যা কি আপনার?’
#অনেক_সাধনার_পরে’
#মাইশাতুল_মিহির [লেখিকা]

[০২]

‘হ্যালো মিস? সমস্যা কি আপনার?’

কথাটি কর্ণপাত হতেই থমকালো মিতালী। পিছু ফিরে তাকালে গাঢ় নীল রঙের হাফ হাতা টি-শার্ট পরা একটি ছেলে কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। চেহেরায় তার স্পষ্ট রাগের ছাপ ভাস্যমান। চোখমুখ শক্ত করা তাকিয়ে আছে মীতালীর দিকে। তার এমন চাহনীতে মিতালী ভ্যাবাচেকা খেলো। বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলো শুধু।

‘আমার শরির টা কি আপনার ডাস্টবিন মনে হয়? চোখে দেখেন না?’

ছেলেটির গমগমে কন্ঠ শুনে বিস্মিত হলো মিতালী। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো একবার। না তাকেই কথাগুলো বলছে। চোখ ছোট ছোট করে তাকালো মিতালী। হঠাৎ তাকে এমন কথা বলার কারণ বুঝার চেষ্টা করতে লাগলো। ছেলেটির রাগ যেন আরো আকাশচুম্বী হলো। রাগে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বললো, ‘সমস্যা কি? এভাবে হাম্বার মতো তাকিয়ে আছেন কেন? আমার শরিরে কি কলার খোসা ফেলার জায়গা? কলা খাবেন ভালো কথা তাই বলে যার তার গায়ে ছুঁড়ে ফেলবেন?’

মিতালী নিশ্চুপ। একদম প্রতিক্রিয়াহীন হয়ে পরেছে সে। আহাম্মকের মতো তাকিয়ে রইলো প্রথম বারের মতো। ছেলেটির এরূপ ব্যবহারের কারন তার বুঝে আসলো তার। ভুলবশত কলার খোসা ছেলেটির গায়ে পরেছে। যার ফলস্বরুপ এমন বাঘের মতো ক্ষেপে আছে। ধাতস্থ হলো মিতালী। কণ্ঠস্বরে রুক্ষতা এনে বললো, ‘আমি তো রাস্তার পাশে ফেলেছিলাম। আপনি ওইখানে কি করছিলেন? এটা কি আমার দুষ? আপনি ওই নোংরা জায়গায় না থাকলে কলার খোসা আপনার গায়ে পরতো না।’

ছেলেটির রাগ আরো তিরতির করে বেড়ে গেলো। দাঁতে দাঁত ঘর্ষণ করে বললো, ‘বাহ্ একে তো দুষ করলেন নিজে। তার ওপর আবার আমার উপর দুষ চাপাচ্ছেন? আমি ক্রিকেট বল আনতে রাস্তার নিচে নেমেছিলাম। আপনি দেখে ফেলবেন না? যেখানে সেখানে ময়লা ফেলবেন কেন? ডাস্টবিন কিসের জন্য রাখা হয়েছে হ্যাঁ? পরিবেশ দূষণ করার ধান্দায় থাকেন নাকি?’

বিরক্ত হলো মিতালী। ঝগড়া করার ইচ্ছে নেই একদম। এমনিতেই সময় কম। তাড়াতাড়ি ক্লাসে ফিরতে হবে। অসন্তুষ্টির চোখে তাকালো সে। কন্ঠস্বরে মলিনতা এনে বললো, ‘কলার খোসা ফুটপাতে পরে ছিল। আমি এখান থেকে তুলে রাস্তার নিচে ফেলেছি যেন কেউ পিচ্ছিল না খায়। আর আপনি যে ওইখানে ছিলেন একদমই দেখতে পাই নি। দুঃখিত।’

ত্যাঁছড়া ভাবে তাকালো ছেলেটি। ঠোঁট যুগল হাল্কা টেনে বিশ্বজয়ের হাসি দিলো একটা। বললো, ‘এতো তাড়াতাড়ি সরি আশা করিনি। ভেবেছিলাম আজ সারাদিন ঝগড়া করতে হবে সরি শুনার জন্য। মেয়ে জাতি নাকি খুব সহজে হার মানে না। তাই এমন ভাবনা ছিলো। কিন্তু আপনি তা ভুল প্রমান করেছে।’

তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো মিতালী। এই কথা গুলো ডিরেক্ট ফালতু কথার মতো লাগছে তার কাছে। কথা বললেই কথা বাড়বে। তাই আর কথা বাড়ালো না। চেহারায় বিরক্তি এনে অপরপাশ দিয়ে হাটতে লাগলো। উফফ আজ সকালে কার মুখ দেখেছিল সে? এই ফালতু ছেলের সাথে কথা বলে তার টাইম নষ্ট হয়েছে। হাত ঘড়িতে সময় দেখলো। উফ শিট! অলরেডি নয় মিনিট লেইট হয়েছে। পায়ের গতি আরো বাঁড়াল মিতালী। দ্রুত হাটার কারনে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। কপালে জমে এসেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
.

‘মেয়েটি কে অংকুর?’

মিতালীর যাওয়ার পথে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল অংকুর। চাচাতো ভাই রাকিবের কথা শুনে ধ্যান ভাঙ্গে তার। একবার রাকিবের দিকে তাকিয়ে আবারো মিতালীর দিকে তাকালো। বললো, ‘চিনি না।’

রাকিব দাঁত কেলিয়ে হাসলো। ভ্রুঁ নাচিয়ে বললো, ‘তাহলে কি কথা বলছিলি এতোক্ষণ?’

অংকুর মৃদু হাসি দিলো একটা। এক হাতে মাথা চুঁলকে বললো, ‘তেমন কিছু না। এমনি!’

‘যাই বল। তোর সাথে মানায় না। মেয়েটি বেশি মোটা।’ বিদ্রূপাত্মক করে বললো রাকিব। কপাট রাগ উঠলো অংকুরের। তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো রাকিবের পানে। কণ্ঠস্বর শক্ত করে বললো, ‘কারোর দেহের গড়ন নিয়ে মজা করা ঠিক না। মেয়েটি তার দিক দিয়ে অবশ্যই সুন্দর। বরং তোর ম্যান্টালিটি কুৎসিত।’

বিস্মিত হলো রাকিব। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো অংকুরের দিকে। তার বিশ্বাস হিচ্ছে না একটা অপরিচিত মেয়ের জন্য অংকুর তার ম্যান্টালিটিকে কুৎসিত বলবে? মানতে পারলো না। বলে উঠলো, ‘তুই ওই মেয়েটার জন্য আমার ম্যান্টালিটিকে কুৎসিত বলছিস?’

এবার বেশ ভালো বিরক্ত হলো অংকুর। ত্যাড়াভাবে বললো, ‘হয়েছে। এবার চল খেলতে সবাই ওয়েট করছে।’

রাস্তার পাশে থাকা বড় মাঠে চলে আসলো অংকুর। রাকিব কিছুসময় সেখানেই অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কিছুটা অপমানিত হলো সে। চুপচাপ খেলার মাঠে আসলো। বড় মাঠ জুড়ে ক্রিকেট খেলছে বড় ছেলেদের দল। জুনিয়র রা পাশে বসে তাদের খেলা দেখছে। রৌদ্দুরের তাপে অংকুরের কপাল থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঘাম ঝরে পরছে। অংকুর আবারো রাস্তায় দেখলো। মেয়েটিকে দেখা যাচ্ছে না দেখে চোখ ফিরিয়ে নিলো সে। সম্পূর্ণ মনোযোগ দিলো খেলায়।
.

দ্রুত পায়ে হেটে কুচিং’এ আসলো মিতালী। এতো তাড়াতাড়ি করে আসায় হাঁপিয়ে গেছে সে। জুড়ে জুড়ে নিশ্বাস নিচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে এমন অবস্থা। ওড়নার আঁচলখানি টেনে কপালের, ঠোঁটের পাশের ঘামটুকু মুছে নিলো। দরজায় কাছে এসে দাঁড়িয়ে ভিতরে আসার পারমিশন চাইলো।

ক্যানভাস থেকে চোখ তুলে দরজায় তাকালো মুফাজ্জল। গম্ভীর তার চাহনী। চোখে পাওয়ারফুল চশমা। মাথায় বোধহয় হাতে গুনা কয়েকটা সাদা চুল। বয়সের সঙ্গে কুঁচকে এসেছে গায়ের চামড়া। তিনি মিতালীকে দেখে গম্ভীর মুখে বললেন, ‘আসো। এতো দেড়ি হলো কেন তোমার? আজকে নতুন একটা নিয়ম শিখেছি। তুমি লেইট করলে।’

প্রছন্ন হাসলো মিতালী। ক্লাসরুমে ঢুকে ব্যাঞ্চিতে ব্যাগ কাধ থেকে খুলে রাখতে রাখতে বললো, ‘সরি স্যার! আসলে কিভাবে যেন আজ দেড়ি হয়ে গেছে। তার উপর রাস্তায় একটা ঝামেলায় পরেছিলাম।’

‘ঠিক আছে! ব্যাপার না। তুমি বসো। আমি ক্যালিগ্রাফির হরফ টানার নিয়মটা দেখাচ্ছি।’

মিতালী ব্যঞ্চে বসে ব্যাগ থেকে এক্রাইলিক কালার, কিপ স্মাইলিং ব্যান্ডের প্রয়োজনীয় কিছু তুলি বের করলো। ক্যানভাসে আগে থেকেই জেসু দেওয়া ছিলো বিধায় প্রথমেই রঙ দিয়ে দিলো। মুফাজ্জল ক্যালিগ্রাফির আরবি হরফ গুলো সূক্ষ্মতার সঙ্গে মিতালীকে বুঝিয়ে দিচ্ছে। হোসাইন মুফাজ্জল একজন বড় আর্টিস্ট ম্যান। তার ক্যালিগ্রাফি, বিভিন্ন আর্ট দেশবিদেশে খুব খ্যাতি পেয়েছে। তার বড় একটা কুচিং সেন্টার আছে। যেখানে নবীন দের ক্যালিগ্রাফি শিখানো হয়। মিতালী তারই কাছে ক্যালিগ্রাফি শিখছে। তার ক্লাস সাপ্তায় তিন দিন।

ক্লাস শেষে মুফাজ্জল চলে গেলেন। শিক্ষার্থীরা নিজেদের ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে আর সহপাঠীদের সাথে আলাপ আলোচনা করছে। মিতালী মৌনতার সঙ্গে রঙ, তুলি, ক্যানভাস গুছিয়ে নিলো। ব্যাগ কাধে নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই ওবাইদুর ও মনিরা আসলো সেখানে। ওবাইদুর হাসিমুখে মিতালীকে বললো, ‘আজকে আমরা কয়েকজন রেস্টুরেন্টে পিজ্জা পার্টি এরেঞ্জ করেছি। আমিও চাই তুমি আমাদের সাথে জয়েন করো।’

ওবাইদুর আর মনিরা এখানেই ক্যালিগ্রাফি শিখে। সেই সুবাধে পরিচিত তারা। যদিও মনিরারর সঙ্গে মিতালীর সম্পর্ক খুব গভীর। ওবাইদুর হলো মনিরার বয়ফ্রেন্ড আবার ফিয়ন্সে। মনিরার কারনেই ওবাইদুরের সাথে মিতালীর ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। মনি উল্লাসিত হয়ে মিতালীর হাত ধরে বললো, ‘অনেক মজা হবে রে। না করিস না প্লিজ।’

তাদের দুইজনের অনুরোধে মিতালী পরলো বিপাকে। যাবে? নাকি যাবে না? ভাবতে লাগলো। প্রতিত্তুর করার সময় পেলো না। তার আগেই পাশ থেকে হাফছা নামের উজ্জ্বল ফর্শা সুন্দর ফিগারের মেয়েটি বলে উঠলো, ‘আরে আমাদের সাথে মিতালীও যাবে নাকি? তাহলে তো হলোই। পকেট একদম ফাঁকা হয়ে যাবে আজ।’

হাফছার দিকে দৃষ্টি গেলো সবার। হাফছা যে এখন মিতালীকে অপমান করবে তা কারোর বুঝতে বাকি নেই। মনি দাঁতে দাঁত পিষে তাকালো। গ্লানিবোধ করলো মিতালী। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে শুনতে লাগলো রোজকার দিনের মতো সেই একই কথা। বেশিরভাগ সময় হাফছা নামের স্টাইলিশ মেয়েটি তাকে অপদস্থ করার চেষ্টা করে। ফুঁশ করে বিমূঢ়তার নিশ্বাস ফেললো মিতালী।

ক্লাসে অন্য একটা মেয়ে হাফছার কথা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো, ‘পকেট ফাঁকা হবে কেন?’

বিদ্রূপমাখা হাসি দিলো হাফছা। মিতালীকে অপদস্থ করতে বললো, ‘মিতালী মাশাআল্লাহ যা খায়, বিল দিতে গেলে পকেট খালি হবে না? বাজেট আরো বেশি ধরতে হবে। আমাদের সবার খাওয়ার বিল, আর মিতালীর একার খাওয়ার বিল। দুইটা একদম সমান সমান হবে।’

হেসে ফেললো উপস্থিত কয়েকজন। বাকি কয়েকজন হাফছার এরূপ ব্যবহারে অসন্তুষ্ট প্রকাশ করলো। মনি মাত্রারিক্ত রাগান্বিত হলো। রাগে চোখমুখ শক্ত করে বলে উঠলো, ‘সমস্যা কি তোর? সবসময় মিতালীর পিছু পরে থাকিস কেন?’

অবাক হওয়ার ভান ধরলো হাফছা। বললো, ‘যা বাবাহ্! আমার কি আর কোনো কাজ নেই? মিতালীর পিছনে পরে থাকবো কেন? আর মিথ্যে কি বলেছি? ওই তো খায় বেশি। শরির দেখ আস্তো আটার বস্তা।’

হেসে উঠলো অসুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ গুলো। মিতালী নিঃশব্দে অপমান সয্য করতে লাগলো। মুখের উপর কথা বলে দেওয়ার মতো অভ্যেস তার নেই। যার ফলস্বরুপ সব সময় ঠোঁট চেঁপে শুনতে থাকে শুধু। চোখে পানি জমে ঝাপসা হয়ে এলো তার। কান্না গুলো গলায় দলা পাকিয়ে এলো। কিন্তু নিজেকে খুব করে সামলানোর চেষ্টা করছে মিতালী। কাঁদবে না সে।

ওবাইদুর রাগি গলায় বললো, ‘মিতালী কম খেলো নাকি বেশি খেলো সেটা সম্পূর্ণ তার ব্যাপার। তুমি নাক গলানোর কে? তোমার বাপের টাকায় তো আর খায় না।’

‘পারলে বোধহয় তাই করতো।’ ত্যাঁছড়া কন্ঠে বললো হাফছা। মনিরা হাফছাকে আরো কিছু কথা শুনিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হতেই মিতালী তার হাত ধরে ফেললো। মনিরা তাকালো তার দিকে। দেখলো মিতালীর চোখের কোণে জলের কণা চিকচিক করছে। আহত হলো মনিরা।

মিতালী কোনো রকমে বললো, ‘আমি যাবো না। তোরাই যা। বাসায় কাজ আছে আমার।’

ওবাইদুর বললো, ‘আরে ওই অসুস্থ মস্তিষ্কের মানুষদের জন্য তুমি কেন যাবে না? তারা তো পথেঘাটে মানুষ দেখলেই উঠেপড়ে লাগে। এদের ব্যবস্থা করার জন্য তো পাবনার ম্যান্টাল হস্পিটাল আছে। তুমি কেন টেনশন নিচ্ছো?’

সম্পূর্ণ কথাটা হাফছাকে উদ্দেশ্য করে বলেছে ওবাইদুর। হাফছার শরিরে রাগ তিরতির করে বেড়ে গেলো। চেঁচিয়ে উঠলো, ‘হাউ ডেয়ার ইউ? আমাকে অসুস্থ বলার সাহস হয় কি করে তোমার?’

চলমান!!
চলমান..

#

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here