#কৃষ্ণময়ীর_অলংকার
#রাহনুৃমা_রাহা
#পর্বঃ২৯
বিছানা ভর্তি খেলনা আর ছোট ছোট জামা কাপড়ের দিকে বিষ্ময়ভরা লেচনে তাকিয়ে আছে তপা। আশ্চর্য হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে সবগুলো খেলনা, জামা দুটো করে রয়েছে। একই রঙের কয়েক জোড়া জুতোও উঁকি দিচ্ছে ভীড়ের মাঝে। সিঁদুর লাল রঙা দু’জোড়া জুতো তপা হাতে তুলে নিল। মখমল কাপড়ের তৈরী। লাইটের আলোয় কাপড়ের উপরিভাগ ঝিকিমিকি করছে। আলতো হাতে ধরে সম্মুখে তাকাল তপা। সিজান, পৃথা, প্রান্ত মুচকি হেসে তাকিয়ে আছে তার পানেই।
তপা পৃথার দিকে তাকিয়ে বলল,
“কুটনামি করতে শিখেছিস আজকাল?”
পৃথা চোখ ছোট ছোট করে তাকাল। বলল,
“কি কুটনামি করেছি আমি? তুই আমাকে এই অপবাদ দিতে পারিস না।”
তপা শক্ত গলায় বলল,
“আমি তোকে বলেছিলাম সবাই কে টুইন বেবির কথা বলে বেড়াতে? বেয়াদব মহিলা। আর কাকে কাকে জানিয়েছিস? পলক কে বলেছিস?”
পৃথা কিছু বলার আগেই প্রান্ত বলল,
“তুই আমাদের থেকে লুকিয়ে রাখতে বলেছিলি?”
তপা মিয়িয়ে গেল। নরম গলায় বলল,
“তা নয় ভাইয়া। আমি নিজে বলতে চেয়েছিলাম। সারপ্রাইজড হতো না ব্যাপারটা?”
প্রান্ত হাসল। বলল,
“আমরা যে তোকে সারপ্রাইজ দিলাম ভালো লাগল না? আরও বড় সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে তোর জন্য। কিছুক্ষণের অপেক্ষা।”
তপা বাচ্চাদের মত বায়না করে বলল,
“কি সারপ্রাইজ ভাইয়া বলো না।”
প্রান্ত ঠোঁট প্রসারিত করে হাসল। তপার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“আমার বাচ্চাটার বাচ্চা হবে। তাও আবার দুটো। আমার স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছেরে আপুনি।”
তপা স্নেহাবিষ্ট হয়ে পড়ল। পেটের উপর একহাত ছুঁয়ে মোলায়েম কণ্ঠে বলল,
“আমারও স্বপ্নই লাগে ভাইয়া। মনে হয় এই বুঝি ঘুম ভেঙে যাবে। আবার সব অন্ধকারে মিলিয়ে যাবে। কিন্তু জানো ভাইয়া গত কয়েকমাস ধরে স্বপ্নটা বিরতিহীন ভাবে চলছেই।এ স্বপ্ন আর কখনো ভাঙবার নয় তাই না ভাইয়া?”
প্রান্ত বুঝতে পারল মেয়েটা ইমোশনাল হয়ে পড়ছে। অতীত নিয়ে এখনো হয়তো মনের ভেতর ভ*য় রয়ে গেছে।
“এটাই বাস্তব। এটাই নিয়তি। দুঃখের পর তো সুখের সূর্যোদয় হয়। তোর জীবনে দুঃখের সময়গুলো শেষ হয়ে সুখের সূর্যোদয় হয়ে গেছে। আর কোনো দুঃখ তোকে ছুঁতে পারবে না। আল্লাহ চাইলে এবার থেকে সব ভালই হবে। ইনশাআল্লাহ।”
বেলা বাড়তেই পলকের শুনশান নীরবতায় ঘেরা বিলাসবহুল ফ্ল্যাটটি পরিণত হলো উৎসবমুখর পরিবেশে। একা থাকা তপার সঙ্গ দিতে এলো আয়েশা, হাজেরা বেগম ও মোর্শেদুল হক। তপার খুশিতে ম*রে যাই যাই অবস্থা। মামাকে পেলে তপা এমনিতেই পৃথিবী পাওয়ার আনন্দ হয়। কিন্তু আজ সেই আনন্দের মাত্রা বেড়ে গেল শতগুণ। কারনটা হাজেরা বেগম। তিনি এসেছেন একজন মা হয়ে। কড়া চোখের মামি হয়ে নয়। যিনি নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত। অনুশোচনায় ভুগছেন বহুদিন ধরে।
হাজেরা বেগম খালি হাতে আসেন নি। নিয়ে এসেছেন তপার প্রিয় কিছু খাবার। তারমধ্যে অন্যতম আমড়ার আচার,ভাজা চিংড়ি শুটকি গুড়ো এবং ঢ্যাপের নাড়ু। তপা নাড়ু দেখে মামির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার জন্য?”
হাজেরা বেগম মাথা নাড়িয়ে সায় জানালেন। তপা বিনা দ্বিধায় মুখে পুরে নিল। তৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে তুলল ঠোঁটের কোণে।
“মামি তুমি এই নাড়ুটা কি যে ভাল বানাও না। ঠিক আগের মতই। ছোটবেলার স্বাদ এখনো মুখে লেগেছিল। এতবছর পর সেই স্বাদ পুনরায় ফিরে পাচ্ছি। কিন্তু এখন তুমি এসব কোথায় পেলে মামি? অনেক বছর ধরে তো বানাও না। হঠাৎ বানালে?”
হাজেরা বেগম কিছু বলার আগেই সিজান বলল,
“তোর জন্য বানিয়েছে। জানিস কত কষ্ট করে ঢ্যাপের চাল যোগাড় করতে হয়েছে আমাকে। আজকাল কি এসব পাওয়া যায়। তারপর ভেজে নাড়ু বানিয়ে নিয়ে এসেছে। জানিস আমাকে একটা ছুঁতে পর্যন্ত দেয় নি।”
তপা অবাক হলো না। হাজেরা বেগমের চোখমুখ বলে দিচ্ছে তিনি অনুতপ্ত নিজের ব্যবহারের জন্য। শুধু কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকাল মামির পানে।
হাজেরা বেগম বললেন,
“ছোট বেলায় আর খেতে পারতিস কোথায়? আমি তো তোকে দেই নি খেতে। কি করে এত পাষণ্ড ছিলাম আমি। একরত্তি মেয়েটার সাথে কত খারাপ ব্যবহার করেছি আমি। কেবল নিজের ছেলেকে বসিয়ে বসিয়ে খায়িয়েছি। তোর এত পছন্দের জেনেও তোকে ছুঁতেও দেই নি একটুখানি।”
তপা খাওয়া বন্ধ করে ফেলল। ছলছল চোখে তাকিয়ে রইল। হাজেরা বেগমের হাত ধরে বলল,
“অতীতটা ভুলে যাও না মামি। দেখো বর্তমান কত সুন্দর। কালো অতীত ভুলে না গেলে তো আমরা বাঁচতে পারব না। আর নাড়ুর কথা বলছো তো? তুমি না দিলেও ভাই লুকিয়ে লুকিয়ে দিয়ে আসতো আমার ঘরে। চুপিচুপি আমিও খেয়ে নিতাম। কখনো লুকিয়ে বৈয়াম থেকে নিয়ে দিতো। আবার কখনো নিজের ভাগ থেকে দিতো।”
হাজেরা বেগম ছেলের দিকে তাকালেন। নিজের নাড়ীছেড়া ধন। তারই পেট থেকে জন্মেছে। অথচ সে কতটা মায়া দিয়ে ভরা। কতটা দায়িত্বশীল ছোট বেলা থেকে। অথচ তিনি? চোখে পর্দা লাগিয়ে বসে ছিলেন। শুধু মামুনের দোষ দিয়ে লাভ নেই। তার নিজেরও দোষ কিছু কম না।সেটা তিনি বোঝেন। তপা নেহাৎই ভালো মেয়ে। তাই তাকে কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছে।
তপা পুনরায় বলল,
“আমার এই দুটো ভাই আমার জীবনে মহামূল্যবান মামি। দুজনেই বুক দিয়ে আগলে রেখেছে আমাকে। নয়তো কবেই ভেসে যেতাম।”
“আমি তোমাকে মাত্রারিক্ত ভালবাসি পলক। ঠিক যতটা ভালবাসলে তোমাতে বিলীন হওয়া যায়। ঠিক যতটা ভালবাসলে তোমাতে নিঃশেষ হওয়া যায়।”
মেসেজটা সেন্ড করে তপা চোখ বন্ধ করে রইল।
বাসা ভর্তি আপন মানুষ পেয়ে তপার মনটা আপ্লূত হয়। সেই সাথে ইচ্ছে হলো পলক কে খুব করে ভালবাসার। সেই মানুষটার জন্যই আজ এত ভালবাসা এসে জুটেছে ওর চার আঙুল কপালে। নয়তো কিছুদিন আগেই সে এই সুখগুলোকে কেবল মরিচীকাই ভাবত। পলক আসার পরেই না পাল্টে গেল জীবনের অধ্যায়। ভয়ঙ্কর ম্যাথমেটিক্যাল টার্মের পর এলো প্রেমের রসায়ন।
পলক ফোন হাতেই বসে ছিল। ফোন হাতে তার মনটাও আকুপাকু করছিল একটু কথা বলার তৃষ্ণায়। মেসেজ দেখে চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম তার। তার কৃষ্ণময়ী তাকে ভালবাসি বলেছে! সেটাও আবার নাম বলে তুমি সম্বোধনে। অনতিবিলম্বে প্রিয় নাম্বারটা ডায়াল করল। এপার থেকেও তপার বিলম্ব হলো না ফোনকলটা গ্রহণ করতে।
পলক ধীর গলায় বলল,
“মেসেজে কি লিখেছো?”
তপা নমনীয় গলায় বলল,
“আমি তোমাকে ভালবাসি পলক। ঠিক যতটা ভালবাসলে তোমাতে বিলীন হওয়া যায়। ঠিক যতটা ভালবাসলে তোমাতে নিঃশেষ হওয়া যায়।”
পলক চকিতে বলল,
“তুমি সত্যি সত্যি তুমি সম্বোধনে কথা বলছো আমার সাথে?”
“কেন? আপনি কি ভেবেছিলেন সারাজীবন আপনি করে বলব? তুমি বলাতে খারাপ লাগছে?”
পলক ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল।
“তুমি যাই বলো তাতেই আমি সুখ খুঁজে পাই কৃষ্ণময়ী। যেই মানুষটাই আমার। যার প্রতিটা স্পন্দনে আমি। তার সম্বোধনে কি আসে যায়?তুমি আমার সাথে কথা বললেই হলো। আপনি, তুমি, তুই কোনো ব্যাপার না।”
তপা ঈষৎ হেসে বলল,
“আচ্ছা! তাহলে তুই করেও বলা যায়?”
পলক শব্দ করে হেসে বলল,
“আই ডোন্ট মাইন্ড।”
তপা প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,
“শুনুন না। আমার না খুব প্রেম প্রেম পাচ্ছে। মাখো মাখো ভালবাসায় মাখামাখি করতে ইচ্ছে করছে।”
পলক মৃদু হেসে বলল,
“হঠাৎ আমার বউ এত রোমান্টিক হয়ে গেল কি করে? আগে তো ধরতে গেলেই পালাতে। কি হয়েছে বলোতো? সবই কি আমার বাচ্চাদের কামাল?”
তপা চমকাল। বাচ্চাদের মানে কি? পলক কি তবে জেনে গেল?
বিস্মিত গলায় বলল,
“বাচ্চাদের মানে কি? বলুন বাচ্চার। বাচ্চার জন্য কিছুই না। আমার আপনার জন্য প্রেম প্রেম পাচ্ছে পলক। একটু জড়িয়ে নিন না প্লিজ। অনেক দিন আপনার ঘ্রাণ পাই না। হৃদয়টা তপ্ত মরুভূমি মনে হচ্ছে।”
পলক মলিন কণ্ঠে বলল,
“কেন পাগল করছো আমাকে? আমি তো পারছি না তোমাকে আস্টেপিস্টে বেঁধে নিতে দু’হাতে। তোমার উষ্ণতা ধারণ করতে পারছি না এই বক্ষঃস্থলে।বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। চিনচিনে ব্যথাও হচ্ছে। আমি কি হার্ট অ্যাটাক করব কৃষ্ণময়ী? কেন এই যন্ত্রণা? এটা কি তোমার বিরহের তীব্র বিষাদময় অনূভুতির সাক্ষ্য?”
তপা মিয়িয়ে গেল। কণ্ঠনালীর গোঁড়ায় এসে আঁটকে রইল না বলা বহু প্রেমালাপন। বক্ষঃস্থলে বয়ে গেল হিম শীতল সমীরণ। অন্তরীক্ষের ন্যায় বিশালতায় ঘেরা হৃদয়টা সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ। শুধু একজনের ভালবাসার অনূভুতির গন্ডিতে।
“চোখ বন্ধ করে কল্পনায় তোমার পলক কে সাজাও তুমি কৃষ্ণময়ী। অনুভব করো। দেখতে পাবে। ভিডিও কলে তো আসবে না। না নিজে দেখবে আর না আমাকে দেখতে দেবে।”
পলকের গম্ভীর কণ্ঠে সহসা কথাগুলো শুনে তপা মৃদু কেঁপে উঠলেও নিজেকে সামলে নিল।
“আপনাকে দেখতে হলে চোখ বন্ধ করতে হয় না। আমার রুমে ঢুকলেই দেখতে পাই আমি।”
পলক ভাবুক হলো। বলল,
“তোমার রুম? তুমি কোথায়? তাজমহলে না?”
তপার কণ্ঠটা এবার কঠিন শোনালো।
“কেন তাজমহল কি আমার নয়? আমি কি অতিথি এখানের? যে মানুষটার পা থেকে মাথা অবধি আমার। যার শরীরের রক্ত, মাংশ, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ,শিরা-উপশিরা, দমনী, অস্থিমজ্জা সব আমার। তার ফ্ল্যাটের একটা রুমও আমার বলতে পারব না?”
পলক ঘাবড়ে গিয়ে বলল,
“রাগও কেন? আগে তো কখনো বলো নি এভাবে।তাই হজম করতে পারছি না। একটু তো রয়েসয়ে অ্যাটাক দাও। কি হয়েছে বলো তো তোমার?”
তপা দুদণ্ড জিরিয়ে নিল। গভীর স্বরে বলল,
“আমার তোমাতে পিষ্ট হতে ইচ্ছে করছে তো।”
পলক কণ্ঠে আকুলতা মিশিয়ে বলল,
“আর মাত্র কিছুদিন সোনা। তারপর আর কাছ ছাড়া করব না। একদম হৃদয়ের মণিকোঠায় লুকিয়ে রাখব।একটু ধৈর্য রাখো। আমি ফিরব। খুব শিগগিরই।”
তপা মৃদুস্বরে বলল,
“সেই সুমধুর দিনের অপেক্ষায়।”
আতিথেয়তা শেষে সবাইকে বিদায় জানালো তপা। কেবল রয়ে গেল হাজেরা বেগম। দুদিন থাকবেন তিনি। প্রান্ত মায়ের সাথে নিজের বাড়ি এবং পৃথা সিজানও মোর্শেদুল হকের সাথে শ্বশুর বাড়ি চলে গেছে। হাজেরা বেগম একা তপা কে সঙ্গ দিতে দুদিনের সময় নিয়েছেন। পুনরায় নীরবতায় ছেয়ে গেল ফ্ল্যাটের ভেতরের পরিবেশ। হাজেরা বেগম মাগরিবের নামাযের পর একটু শুয়েছেন। শরীরটা তারও ঠিক নেই। তবুও একা, এতিম মেয়েটির একাকিত্ব ঘুচাতে রয়ে গেলেন। একসময় করা পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চান তিনি এভাবেই। তপার সঙ্গ দিয়ে। তাকে ভাল রেখে।
তেল হাতে বিছানার উপর বসে দেয়ালে টাঙানো বিশালাকৃতির ছবিটির দিকে তাকিয়ে আছে তপা। ছবিটির ব্যক্তি পলক হলেও মালিক তপা। সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত পলক সদা হাসোজ্জল মুখে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। ঠোটের সাথে সাথে হাসছে তার চোখও। সামনের কোনো মানুষ অথবা দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে অমায়িক এই হাস্যজ্জল ছবিটি ক্যামেরাবন্দি করেছে প্রান্ত। তপা আসার মাস খানেক আগের আলেখ্য এটা। ভার্সিটির কোনো এক অনুষ্ঠানে দুবন্ধু একত্রিত হয়েছিল। তখনই সুযোগ বুঝে এই মোখ্যম কাজটা করে ফেলেছে প্রান্ত।
তপা পলকের ফেসবুক ওয়াল থেকে সংগ্রহ করেছে ছবিটা। পলক সিংগাপুর যাওয়ার কয়েকদিন পর সিজান কে দিয়ে বাঁধিয়ে আনিয়েছে ছবিটা। উদ্দেশ্য সারাক্ষণ চোখের সামনে পলকের মুখাবয়ব উপস্থিত রাখা। উঠতে, বসতে সবসময় পলকের সুশ্রী মুখটা চোখের মণিতে ফুটে ওঠা। শুধু উঠতে বসতে নয়, তপা শুয়ে থেকেও স্পষ্ট দেখতে পায় দেয়ালে সেঁটে দেওয়া ছবিটি। বোধহয় তখন আরও ভালো করে দেখা যায়।
হাজেরা বেগম তপা কে তেল হাতে বসে থাকতে দেখে পাশে বসলেন। মলিন কণ্ঠে শুধালেন
“আমি দিয়ে দেব?”
তপা খুশি হলো ভীষণ। ইচ্ছে করছিল না এখন এই চুলের ঝক্কি সামলাতে। কিন্তু না সামলেও উপায় নেই। এমনিতেই চুলের যত্নে অভাব হচ্ছে। তেলটুকুও না দিলে তো নষ্ট হয়ে যাবে। তাই নিজের উপর জোর খাটিয়ে হলেও চেষ্টা করে যত্নে রাখার। পলকের পছন্দ যে। শুধু পছন্দ নয়। মারাত্মক পছন্দ। ভালবাসাটাতো চুলের ওপরই প্রথম এসেছিল।
পলকের ভাবনায় মশগুল তপা টেরই পেল না, কখন চুলে তেল দেয়া শেষে লম্বা বিনুনি পাকিয়েছেন হাজেরা বেগম। বুঝতে পারল তখন যখন হাজেরা বেগম চিরুনী দেখিয়ে বললেন,
“চুল পড়ছে তো। যত্ন নিচ্ছিস না? সারাক্ষণ কি এত ভাবিস?”
তপা চকিতে তাকাল। কিছু বলল না। আবার মশগুল হলো আকাশ কুসুম ভাবনায়। যেন তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সবার ভাবনা ভেবে দেওয়ার। বাস্তব ভুলে তাইতো সে মত্ত নিজের ব্যক্তিগত মানুষটার ভাবনায়।
রায়হান তাজওয়ার শারীরিক ভাবে বেশ খানিকটা সুস্থতা অনুভব করছেন আজকাল। মনটাতো তার বরাবরই সুস্থ। যদিও শরীরের অসুস্থতায় মনটাও খানিকটা আক্রান্ত হয়েছিল। তবে তা কেটে গেছে কিছুকাল আগেই। এখন কেবল শারীরিক সুস্থতায় আরেক ধাপ উন্নতি বাকি। তবেই ফিরে যেতে পারবেন নিজ মাতৃভূমিতে। মনটা দেশের জন্য উচাটন করে আজকাল। কিন্তু সে জানেন না তার থেকে অধীর আগ্রহে দিন গুনছে পলক। তীব্র উৎকণ্ঠা নিয়ে দিনাতিপাত করছে সে। চাইছে সময়ের চাকা আলোর গতিতে ঘুরিয়ে দিতে। কিন্তু সময় যে নিজ গতিতে চলে। এই অমোঘ সত্যটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। আর না আছে তা উপেক্ষা করার ক্ষমতা।
চলবে….#কৃষ্ণময়ীর_অলংকার
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ৩০
সায়াহ্নের প্রথম প্রহর। তেজস্বী সূর্য নিজের আধিপত্য বিস্তার শেষে পলায়মান অন্তরীক্ষ থেকে। মৃদু আলোয় ধরনীর বুকে মায়ারাজ্যের আবির্ভাব। আবছা আলোয় অস্পষ্ট দুহাত সামনের বস্তুও। কিন্তু তপার নিবাস কৃত্রিম রোশনাই এ ভরপুর। ২৪০ ভোল্টের একটি এলইডি বাল্ব সার্বক্ষণিক জ্যোতির ব্যবস্থা করছে তপার ছোট্ট আলোয়ে।
কেটে গেছে বেশ কিছু দিন। তপার প্রেগন্যান্সির পাঁচ মাস সম্পূর্ণ হয়েছে। ছয় মাসের দু তিনদিন চলছে। ড্রেসিং টেবিলের বিশালাকার আরশিতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে নিজের পরিবর্তনীয় রূপ। বেশ খানিকটা উন্নতি হয়েছে শরীরের। গালদুটো আগের তুলনায় ফুলে গেছে। শরীরটাও আগের মত নেই। বেশ মুটিয়ে গেছে সে। তবে নিজেকে খারাপ লাগছে না এই নতুন রূপে। পিঠজুড়ে খোলাচুলে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করছে তপা। পেটের উপর দু’হাত রেখে নজর দিল আরশিতে। পেটের জায়গাটায়। থ্রিপিস ছেড়েছে মাস খানেক আগে। এখন পরনে ঢিলেঢালা গোল জামা। উঁচু পেটের দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসল তপা।
মোলায়েম হাত বুলিয়ে বলল,
“কবে আসবি সোনা? মা তোদের অপেক্ষায় তো। তোরা কিন্তু একদম তোদের বাবার মত হবি। মনে থাকবে? দেখতে, ব্যবহারে সবদিকে। জানিস তো তোদের বাবা একজন সুপার ম্যান। সবকিছু ম্যাজিকের মতো ঠিক করে দেওয়ার ক্ষমতা আছে তার। তোরা তো এখনো কাছেই পেলি না বাবা কে। আসলে বকে দিবি কেমন? আমি তো বকা দিতে পারি না। ভালবাসি যে। দেখিস বেশি বকিস না যেন। মা তাহলে ভীষণ কষ্ট পাব। আচ্ছা সোনা তোরা কি বাবাকে বেশি ভালবাসবি না মাকে? মাকে বেশি ভালবাসিস কেমন? বাবাকেও ভালবাসবি। কিন্তু কম কম। এই যে তোদের ছেড়ে, আমাকে ছেড়ে কতদূরে আছে তার শাস্তি দিতে হবে না? আগে পানিশমেন্ট দিবি। তারপর ভীষণ ভীষণ ভালবাসবি। দেখেছিস তোদের বাবা কত ভাগ্যবান। আমরা তিনজনে তাকে কত ভালবাসি। অবশ্য এদিক থেকে আমরা আরও বেশি ভাগ্যবান আর ভাগ্যবতী। সে আমাদের আরও বেশি ভালবাসে। একবার তোদের বাবার সান্নিধ্যে এলে তখন বুঝতে পারবি কার ঔরস্য তোরা। ভালবাসায় ভরিয়ে দেবে তোদের ছোট্ট দরিয়া।”
বারান্দায় দাঁড়িয়ে সন্ধ্যার আঁধারে নিমগ্ন পরিবেশ অবলোকন করছে তপা। আজকাল শরীরটা ভীষণ ভারী ঠেকে তার। মনটাও ভারী লাগছে। উচাটন করছে। পলক কে ফোনে পাচ্ছে না সকাল থেকে। এখন দিবসের প্রাতঃকাল। তবুও কোনো সন্ধান নেই পলকের। দূরের রাস্তার মিটিমিটি আলোর ছটা দেখতে দেখতে পেটে হাত রেখে মলিন কণ্ঠে শুধালো,
“আমার খুব চিন্তা হচ্ছে রে সোনা। তোরা কি জানিস তোদের বাবা কোথায়? ভালো আছে তো সে? বলনা বাবা, তোদের বাবা সুস্থ আছে তো?”
উত্তর আসে না পেটের ভেতর থেকে। কিন্তু তপা অনুভব করতে চেষ্টা করে। কেউ বলছে উচ্চস্বরে, “আমাদের বাবা ভালো আছে। তুমি চিন্তা করো না মা। বাবা ঠিক ফিরে আসবে।”
তপা আনমনে মৃদু হাসল। চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল কিছু মুক্তো কণা। পেটের উপর থেকে হাত সরিয়ে রেলিংয়ে ভর করে দাঁড়াল। একটানা দশ মিনিট দাঁড়াতে পারে না আজকাল। শরীরে কুলোয় না। পা দু’টো ভেঙে আসতে চায়।
কিছুকাল অতিবাহিত হলো বারান্দায়। আবছা আলোর অস্পষ্ট পরিবেশ নিমজ্জিত হলো ঘন কৃষ্ণ আধারে। এহেন সময় কর্কশ শব্দে বেজে উঠল ডোরবেল। তপা বিরক্ত হলো। শব্দটা কর্কশ না হলেও তপার কানে তা কর্কশই ঠেকল। আজ সবই বিরক্ত লাগছে তার।
ধীর পায়ে দরজার নিকটে গেল সে। ততক্ষণে শব্দটা আরও দুবার বেজে উঠল। তপার বিরক্তি ভাবটা সপ্তম আসমানে পৌঁছে গেছে। দরজা খুলে কিছু তিক্ত কথা শুনিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলল অতি দ্রুত। কিন্তু হায়! দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার মুখাবয়ব দর্শন করে মুখ ভুলে গেল কথা বলতে। চোখ ভুলে গেল পলক ফেলতে। শরীরটাও বুঝি ভুলে গেল নড়াচড়া করতে। মস্তিষ্কও অচল হয়ে পড়ল। কেবল জাগ্রত রইল মনটা।
সাদা শার্ট পরিহিত পলক তাজওয়ার বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তপার মুখের দিকে। অতঃপর সগৌরবে উঁচু হয়ে থাকা পেটের দিকে। যেখানটা আগলে ধরে আছে তপার বাম হাত। মাত্র কিছুমাস আগে রেখে যাওয়া ছিমছাম চিকন মেয়েটি আজ পরিপূর্ণ নারী। যার নারীত্বের বড়াই হিসেবে দেখিয়ে যাচ্ছে সযত্নে ধরে রাখা পেট। পলক পলক ফেলল না। তাকিয়ে রইল শুধু। কাটল কিছু প্রহর এভাবেই।
তপা দুপা এগিয়ে গেল। স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছে তার। দ্বিধা কাটাতে সজোরে চিমটি বসিয়ে দিল পলকের হাতে। পলক হঠাৎ আক্রমণে লাফিয়ে উঠল।
চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলল,
“পাগল হয়ে গেছো তুমি? এত জোরে কেউ চিমটি দেয়?”
তপা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। পরক্ষণেই কিঞ্চিৎ অভিমান ভর করল মনের কোণে। নিঃশব্দে পিছু ফিরে চলে গেল নিজের জায়গায়। পলক দরজা বন্ধ করে তপার পিছু পিছু বারান্দায় এলো। বুঝতে পারল তার অভিমানিনী অভিমান করেছে।
পেছনে দাঁড়িয়ে নরম গলায় বলল,
“আমার বাচ্চা টা আমার জন্য কাঁদছে কৃষ্ণময়ী। ও ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরতে চাইছে।”
তপা পেছনে ঘুরে দাঁড়াল। পলকের চোখে চোখ রেখে বলল,
“আচ্ছা! তা কি বলছে শুনি?”
পলক তপার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখল অভিমানের পরিবর্তে চোখে ফুটে উঠেছে শিশুসুলভ চাহনি।
“বলছে, বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরো। আমি তোমার গায়ের গন্ধ নেব। মা তো পঁচা। আমার ভালো বাবাটাকে জড়িয়ে ধরতে চাই।”
তপা হাসল। চোখেমুখে খুশির ঝলক স্পষ্ট। সারাদিনের বিরক্তির আভাস এখন আর পাচ্ছে না তপা। এখন খুশির জোয়ারে ভাসছে সে।
“আপনি মিথ্যে বলছেন পলক। আপনি শুনতে পান নি। ওরা এভাবে কথা বলে না। ওরা বলতো, ‘আমাদের জড়িয়ে ধরো। আমরা গায়ের গন্ধ নেব।’ ওরা কখনো আমি বা আমার বলে না। ওরা আমরা বা আমাদের বলে।”
পলক দিশেহারা বোধ করল। বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে রইল। তপা লাজুক হেসে বলল,
“কিছু বুঝতে পারলেন?”
পলক কিছু বলল না। কেবল তাকিয়ে রইল। তপাও ফেলল না চোখের পলক।
কিঞ্চিৎ সময় পর পলক কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“আমার দু কোল ভরে ওরা আসবে? আমি বিশ্বাস করতে পারছি না কৃষ্ণময়ী। আমার ছোট্ট কৃষ্ণময়ী আমার দু দুটো সন্তান তার গর্ভে লালন করছে?”
তপা মৃদু হেসে মাথা নিচু করে ফেলল। এক পা এগিয়ে দু’হাতের বাঁধনে বেঁধে ফেলল নিজের কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিগত পুরুষ কে। এতদিনের তৃষ্ণার্ত, খড়াময় মরুভূমিতে নিঝুম বৃষ্টি হলো যেন। পলক আলতো হাতে বেরি পড়িয়ে দিল তপার পিড়জুুড়ে। খোলা চুলের গভীরে মুখ ডুবিয়ে এতদিনের ধরে রাখা নিশ্বাসটা ছেড়ে দিল। মনে হলো সে হয়তো বাঁচতে শিখল নতুন করে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে পোঁছে গেল কৃষ্ণময়ীর মাতাল করা ঘ্রাণ।
তপা পলকের বুকে নাক ঘষতে ঘষতে বলল,
“আপনি খুব খারাপ।”
পলক চোখ বন্ধ করেই বলল,
“আচ্ছা! তাহলে শাস্তি দাও এই খারাপ লোকটাকে।”
তপা পলক কে ছেড়ে দিল বলল,
“দেব তো। এই যে ছেড়ে দিলাম। আর আমার বাচ্চাদের এবং আমাকে কাউকেই জড়িয়ে ধরার সাহস করবেন না।”
পলক ভ্রু কুঁচকে ফেলল। চোখ ছোট ছোট করে তাকাল।
“বাচ্চা কার?”
“আমার।” তপা দ্বিধাহীন উত্তর।
“আর তুমি কার?”
তপা থতমত খেল। ভ্রুকুটি করে বলল,
“আমি যার হইনা কেন, সেটা বড় ব্যাপার নয়। বড় ব্যাপার হচ্ছে আপনি আমাদের সারাদিন চিন্তায় রেখেছেন। তার শাস্তিস্বরূপ আমরা অনশনে নামব। যাতে আপনি আমাদের কাছে না আসেন।”
পলক মৃদু হেসে বলল,
“আচ্ছা! তাহলে একটু আগে কেন জড়িয়ে ধরলে?”
“তখন আমাদের জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছিল তাই ধরেছি। আমরা ধরতে পারব। কিন্তু আপনি না।”
পলক অবাক হয়ে বলল,
“নিজের বেলা ষোলো আনা আমার বেলায় চার আনাও নয়?”
তপা কঠিন গলায় বলল,
“শাস্তি আপনার চলছে আমাদের নয়। তাই না বল সোনা?”
শেষের কথাটা পেটের উপর হাত রেখে বলল তপা। পলক মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইল। তপার মুখাবয়বে মা মা ব্যাপারটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে পলক। স্নেহময়ী লাগছে। নির্নিমেষ চেয়ে রইল কিছুক্ষণ।
কিয়ৎকাল পর ঘন হয়ে আসা গলায় টেনে টেনে বলল,
“আমি আমার বাবুদের একটুখানি আদর করব বউ? জাস্ট এতটুকু। প্লিজ।”
তপা অপলক চেয়ে থেকে মাথা নাড়ালো। অনুমতি পেয়ে পলক নষ্ট করল না একটা সেকেন্ড পরিমাণ সময়ও। দু’হাতে কোমর আঁকড়ে জড়িয়ে ধরল তপার উঁচু হয়ে থাকা পেট। একের পর এক চুমুতে ভরিয়ে দিল। অনেকটা সময় কান লাগিয়ে বসে রইল। গাল ঘষে দিল।
তপা পলকের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“আমি রুমে যাব। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে।”
পলক চোখ মেলে তাকাল। দু-হাতে চোখ কচলে বলল,
“আগে বলবে তো। চলো।”
একমুহূর্তের অপেক্ষা না করে তপা কে সাবধানে কোলে তুলে নিল। তপা অবাক হলো না। তবে খামচে ধরল পলকের শার্ট। আঁকড়ে ধরল গলা। অপলক চেয়ে থেকে মুখ উঁচিয়ে যত্ন করে কেটে রাখা খোঁচা খোঁচা দাড়ির উপর ঠোঁট ছোঁয়াল। পলক ঠোঁট কামড়ে হাসল। তপা লজ্জা পেয়ে মুখ লুকিয়ে ফেলল প্রশস্ত বুকে।
বিছানায় বসিয়ে পলক আবারও তপার পেটে মুখ গুঁজে পড়ে রইল। তপা মৃদু স্বরে শুধালো,
“আপনি কাঁদছেন?”
পলক থেকে থেকে কেঁপে উঠছে। মুখ না দেখলেও তপা স্পষ্ট বুঝতে পারছে পলক কাঁদছে।
কথা শুনেও পলক মুখ তুলল না। তপা কণ্ঠে আকুলতা মিশিয়ে বলল,
“আমার কিন্তু কান্না পাচ্ছে এবার। আমি শুরু করলে কিন্তু থামাতে পারবেন না। কাঁদতে কাঁদতে যদি আমার বাচ্চারা ছিচকাদুনে হয় তাহলে আপনার খবর আছে। অফিস বাদ দিয়ে ওদের সামলাতে হবে। তখন কিন্তু আমার দোষ দেবেন না যেন।”
পলক উঠে বসল। তপা ওড়নার কোণে চোখ মুছে দিয়ে দুচোখের পাতায় চুমু দিয়ে বলল,
“এই চোখ শুধু বেসামাল তাকিয়ে আমায় লজ্জায় ফেলার জন্য। এ চোখ শুধু ভরসা দেওয়ার জন্য। চোখের ইশারায় বোঝানোর জন্য আমি আছি। কিচ্ছু হবে না। এ চোখ শুধু প্রেম শেখানোর জন্য। এ চোখ জন্য জল ফেলার জন্য নয়। হোক সেটা দুঃখে, সুখে, ভাল লাগায় বা ভালবাসায়। আমি কিন্তু সহ্য করব না।”
পলক নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল। সামান্য মেদ যুক্ত গালে তপার মুখটা আগের থেকেও বেশি মায়াবী লাগছে।
পলক ঘন হয়ে আসা হাস্কি গলায় বলল,
“বউ তোমাকে না ভীষণ আদর আদর লাগছে। ইচ্ছে করছে প্রাণ উজার করে ভালবাসি।”
তপা লাজুক হেসে বলল,
“আমি কি বারণ করেছি নাকি। একটুখানি ছোঁয়ার জন্য এ মনটাও তো বহু যুগ ধরে তৃষ্ণার্ত।”
পলক মৃদু হাসল।একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে নরম গলায় বলল,
“আমার যে ভয় করে। মনে হয় ছুঁয়ে দিলেই তুমি ব্যথা পাবে। নরম মাখনের মত শরীরটা গলে যাবে নিমিষেই। কি করে ছুঁই?”
তপা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। মূহুর্তেই রিনরিনে হাসির শব্দে ভরে উঠল সুখী দম্পতির ছোট্ট নিবাস।
পলক প্রাণোচ্ছল হাসিটুকুর সুধা পান করতে করতে বলল,
“আমার বউটা সারাজীবন এভাবেই হাসতে থাকুক।”
তপা হাসি থামাল। তবে ঠোঁটের কোণে ফুটে রইল তা বহুক্ষণ। হাতটা পলকের হাতের গভীরে গলিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার বরটা সারাজীবন এভাবেই আমাকে ভালবাসতে থাকুক।”
পলক ধরে রাখা হাতটায় আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল।
“আল্লাহ আমাকে তৌফিক দিক, মৃত্যুর আগ মূহুর্ত পর্যন্ত যেন আমি এভাবেই আমার কৃষ্ণময়ীর জীবনটা ভালবাসায় ভরিয়ে দিতে পারি। হাসি খুশিতে মাতিয়ে রাখতে পারি। আদরে আহ্লাদে বুকে জড়িয়ে রাখতে পারি।”
আরাম কেদারায় বসে পায়েল তাজওয়ার ভাবনায় নিমগ্ন হয়েছেন। তার ভাবনার এক এবং একমাত্র কারন পলক তাজওয়ার। সিংগাপুর থেকে ফিরে যন্ত্রের মত বাড়ির পরিবেশ সামলে হন্যে হয়ে বেরিয়ে গেছে সে। রায়হান তাজওয়ার এখন সম্পূর্ণ সুস্থই বলা যায়। তাকে বাড়িতে ছেড়ে, কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা জেনে ঘন্টাখানেকের মধ্যেই বেরিয়ে গেল। সজল কে দিয়ে বাজারও পাঠিয়ে দিল। কিন্তু নিজে লাপাত্তা। সেই যে গেল ঘড়ির কাঁটা রাত এগারোটায় পৌঁছালেও তার কোনো খবর নেই। পাঁচ মিনিট আগে জানাল তিনি আসবে না। পায়েল তাজওয়ার কপালে ভাজ ফেলে কিছুক্ষণ ভাবলেন, তারপর কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেন। ছেলের পেছনে তিনি গোয়েন্দা লাগাবেন। হোক সেটা অনৈতিক, দৃষ্টিকটু তবুও। গোয়েন্দা তিনি লাগাবেনই। প্রয়োজনে নিজে মাঠে নামবেন।
দেয়ালে নিজের বিশালাকার ছবি দেখে পলক অবাক হলো। তপা তখনও তার বুকে লেপ্টে শুয়ে আছে। খোলা চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“কৃষ্ণময়ী, দেয়ালে আমার ছবি কেন? তাও আবার এত বড়।”
তপা হেসে বলল,
“আপনাকে সারাক্ষণ চোখের সামনে রাখার জন্য।”
পলক কপালে চুমু দিয়ে বলল,
“মিস করতে?”
তপা আরও একটু আঁকড়ে ধরে বলল,
“খুব।”
পলক কিছু বলল না। তপা পুনরায় বলল,
“শুধু মিস করার জন্য নয়। আমি চাই আমাদের সন্তান আপনার মত হোক। লোকে বলে যাকে বেশি বেশি দেখবে সন্তান তার মত হয়। আপনাকে তো এতদিন দেখতেই পাই নি। তাই এই ব্যবস্থা।”
পলক ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আমার মত কেন হবে? আমি চাই আমাদের সন্তান তোমার মত হোক। শান্ত, নম্র, ভদ্র, দেখতে একদম তোমার মত মায়াবী।”
তপা মৃদুস্বরে বলল,
“না। আমার মত চাই না। আমি চাই না আমার সন্তানদেরও গায়ের রঙ নিয়ে কথা শুনতে হোক। আমি ভাগ্যবতী তাই আপনি এসেছেন আমার জীবনে স্বর্গীয় দূত হয়ে। কিন্তু এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে আরেকটা পলক তাজওয়ার নেই। তাহলে কে নেবে আমার সন্তানের দায়িত্ব?”
পলক কিছু বলল না। কেবল আস্টেপিস্টে জড়িয়ে নিল বুকের গভীরে।
তপা মোবাইল স্কিনে তাকিয়ে অনলাইনে কিছু ক্লাস ঘাটাঘাটি করছে। পলক অফিসের জন্য বেরিয়ে গিয়েছে কিছুক্ষণ আগে। তপা কে নিজ হাতে খায়িয়ে, চুল চিরুনী করে বিনুনি করে দিয়ে গেছে। যাওয়ার আগে বারংবার সাবধানে চলাচল করতে বলে গেছে। সন্ধ্যায় আসার প্রতিজ্ঞা করে তবেই বেরিয়েছে।
ডোরবেলের আওয়াজ পেয়ে আস্তেধীরে হেঁটে দরজা খুলে দিল তপা। দরজার ওপারে পায়েল দাঁড়ানো। তপা হঠাৎ প্রিয় মানুষটাকে নিজ গৃহে দেখে ভীষণ খুশি হলো। মৃদু হেসে বলল,
“আন্টি আপনি? ভেতরে আসুন প্লিজ।”
পায়েল আশা করে নি তপা কে এখানে। মাথা বাম পাশে ফিরিয়ে অদূরেই জ্বলজ্বল করতে থাকা ‘তাজমহল’ লেখাটায় চোখ বুলালো। নাহ! ভুল হয় নি তার। এটাই তার ছেলের নামে কেনা ফ্ল্যাট। এখানেই সে থাকে দিনের পর দিন। পায়েল বিনা বাক্যে রুমে প্রবেশ করলেন। দেয়ালে টাঙানো বিশালাকৃতির ছবিটি দেখে তপার দিকে তাকালেন। এবার ভাল করে খেয়াল করলেন। এতক্ষণ ঝোঁকের বশে তপার মুখটা দেখলেও এখন পুরো শরীরের দিকে নজর গেল। মূহুর্তেই মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল রক্তস্রোত নেমে গেল তার।
দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“উনি পলক তাজওয়ার না?”
তপা মৃদুস্বরে বলল,
“জ্বি। আপনি চিনেন?”
পায়েল দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন,
“বহুবছর ধরে। পলক কে হয় তোমার?”
“আমার স্বামী।”
পায়েল চমকাতেও ভুলে গেলেন। মলিন কণ্ঠে বললেন,
“আমার নাম জানো?”
তপা মনে করার চেষ্টা করে বলল,
“ঠিক মনে পড়ছে না আন্টি। ভুলে গেছি।”
পায়েল ঠান্ডা কণ্ঠে বললেন,
” পায়েল তাজওয়ার। স্বামী রায়হান তাজওয়ার এবং একমাত্র ছেলে পলক তাজওয়ার। এখন আবার তার বউ ও দেখছি। তিয়াশা তাজওয়ার রাইট? কদিন পর একটা বাচ্চাও হবে। সে কি তাজওয়ার হবে? নাম ঠিক করেছো?”
তপা দু কদম পিছিয়ে গেল। পায়েলের ঠান্ডা কণ্ঠ শুনে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল তার। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“আন্টি নাম ঠিক করিনি। তবে একজন নয়, দুজন। দুটো নাম ঠিক করতে হবে।”
পায়েল তপা কে পাশ কাটিয়ে বিছানায় গিয়ে বসে পড়লেন। তপা আড়চোখে একবার তাকিয়ে মনে মনে আল্লাহ নাম জপতে শুরু করল।
চলবে…
(