#স্পর্শ
#পর্ব_২০
#লেখায়ঃস্বর্ণালি_আক্তার_শ্রাবণ
মুখোমুখি সোফায় বসে আছে এলিনা-শান্ত!পাশের শান্তর বাবা মা শ্রাবন্তী!আর এলিনা ইরার বাড়ির লোকজন!
শান্তর মা মুচকি হেসে একটা আংটি পরিয়ে দিলো এলিনার হাতে!এলিনার বাবা মায়ের উদ্দেশ্যে বলল মেয়ে মাশাল্লাহ অনেক পছন্দ হয়েছে।খুব মানাবে আমার ছেলের সাথে!আমার একটা মাত্র ছেলেই ওর চাওয়ার পর আর কিছুই চলে না!আপনারা বরং ইরা-নিহানের বিয়ের দিনই এলিনাকে উঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন।
বেশ কথাবার্তা হলো দুপরিবারের মাঝে!বিদায় নিয়ে চলে গেলেন তারা!ইকবাল সাহেব এখন বুঝতে পারছে কেন তারা সকালে আসবে বলেছিলো।
.
.
.
.
.
ছাদে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে ইরা নিহান!বাড়ির গুরুজনরা বাদে সবাই গিয়েছে এলিনা শান্তর বিয়ের শপিংয়ে!ইরার মাথা ব্যাথা করছিলো তাই সে যায় নি!ইরার উছিলাতে নিহানও যায় নি!
দু’জন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রং ওঠা ছাদের রেলিংয়ে হাত রেখেছে।দুজনেই চুপচাপ!
আমার এখন মনে হচ্ছে এসব রিসেপশন শুধু শুধু!এতলোকজন মোটেই ভালোলাগছে না!মুখ গোমড়া করে বলল ইরা!
নিহান মুচকি হেসে বলল আমার কিন্তু বেশ ভালো লাগছে।
আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে নিহান ভাই!
বা হাতে ইরার কোমড় জড়িয়ে কাছে টেনে আনল নিহান।
ইরা মুখ গোমড়া করেই দাঁড়িয়ে আছে!হঠাৎ এমন কাজ করবে ভাবে নি ইরা।
দুহাতে ইরাকে কাতুকুতু দিতে লাগলো।ইরা হেসে কুটিকুটি!
আহহা কি করছো নিহান ভাই ছাড়ো বলেই হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ছে!ইরার এবার দৌড় দিলো।নিহানও ইরার পেছনে দৌড়াচ্ছে! পুরো ছাদ জুড়ে দুজন দৌড়াচ্ছে।
ছাদের কোণায় যেয়ে চিলেকোঠার দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় থেমে গেলো ইরা।জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে!নিহান আস্তে করে ইরার সামনে যেয়ে দাঁড়ালো।আলতো করে ঘাড়ে ঠোঁট ছোঁয়াতেই লাফিয়ে উঠলো ইরা।তোমার #স্পর্শ গুলো এরকম কেনো হয় নিহান ভাই!বলেই ক্ষীটে দাঁড়িয়ে রইলো!
নিহান মুচকি হেসে গভীরভাবে ইরার ঠোঁট স্পর্শ করলো!
ছুটতে ছুটতে ছাদে এলো অহনা।পুরো ছাদ খালি!মামী যে বলল ছাদে তাহলে?জোরে চেচিয়ে ইরা নিহানের নাম নিয়ে ডাকতে লাগলো অহনা।অহনার গলার আওয়াজে ইরার থেকে সরে আসলো নিহান।অহনার কাছে যেতেই অহনা হুংকার দিয়ে বলক কোন চিপায় ছিলে শুনি?কতক্ষণ ডাকছিলাম
যাব্বাহ দিলিই তো দুটো ডাক!(ইরা)
দুটো কি কম?
হয়েছে এবার বলো ডাকো কেন?(নিহান)
সারপ্রাইজ আছে নিচে চলো।দাঁত বের করে হাসলো অহনা।
অহনা চলে গেলো।ইরা নিহান দুজন দুজনের দিকে তাকালো।
নিচে নেমেই দেখে পুরো ড্রয়িংরুমে শালিস বসেছে!সবাই এখানে।ছোফা ফ্লোর বেতের চেয়ার মোড়া টুল কিচ্ছু বাকি নাই!সব নিয়ে বসেছে ড্রয়িংরুমে।
ইরা নিহান সবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো এবার!ইরা কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল কিসের সভা বসেছে এমন করে?
বাচ্চারা একসাথে চেঁচিয়ে উঠলো_সমস্বরে বলল বিয়ে কমিউনিটি সেন্টারে হবে!
ইরার তো সাথে সাথে লাফিয়ে উঠলো! ওর অনেক দিনের ইচ্ছে কমিউনিটি সেন্টারে ওর বিয়ে হবে বর-বউ একসাথে বিয়ে একসাথে হলুদ আহহা ভাবতেই আনন্দে লাফিয়ে উঠলো ইরার মনটা!
.
.
.
.
যথারীতি কমিউনিটি সেন্টারে সব আয়োজন করা হয়েছে! আজ ইরা-নিহান,শান্ত-এলিনার হলুদ!
একপাশে ছেলেদের স্টেইজ একপাশে মেয়েদের!
ইরা আর এলিনাকে একই রকম করে সাজানো হয়েছে।
খুব হই হুলোড় করে সম্পন্ন হলো হলুদের দিনটা!বিয়েদিনটায় তেমন আনন্দের না হলেও খারাপ যায় নি!এলিনার মা বাবা খুব কান্নাকাটি করেছেন এলিনার চোখ থেকে এক ফোঁটা পানিও বের হয় নি!হয়ত দীর্ঘদিনের জমা অভিমান থেকেই!
ইরার বাবা মা কেউই কাঁদে নি!বরং নতুন জীবনের সূচনার লক্ষ্য দোয়া করেছে অনেক মুখে সুক্ষ হাসির রেখা টেনে!
দুজোড়া নবদম্পতি দুদিকে রওনা হচ্ছে শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে..!
নিহান ও ইরাকে তার নতুন বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে। যদি নিহানের বাবার বাড়ির কেউই নেই তবুও তো সেটা ইরার স্বামীর বাড়ি-ই!
এলিনা পুরো রাস্তায় থম মেরে বসে ছিলো।চোখ দিয়ে পানিও গড়ায় নি আর মুখ থেকে কথাও বেরোয় নি!
খুব অস্বাভাবিক লাগছে ব্যপারটা শান্তর কাছে!একটু ঝুঁকে জিগ্যেস করলো এলিনা আর ইউ ওকে?
ওমনি সে ঝাঁপিয়ে পড়লো শান্তর বুকে…!
বাকিটা রাস্তা শান্তর বুকে মাথা রেখেই কাঁদতে কাঁদতে এলো!
শ্বশুর বাড়ি সবাই খুব সাদরে গ্রহণ করলো নবদম্পতিকে!
.
.
.
.
এদিকে ইরা বাড়ি এসেই প্রথম চারদিকটা ঘুরে দেখলো।বেশ সুন্দর বাড়িটা!একপাশে কাঁচে দেয়া।পর্দা সরালেই বাহিরটা দেখা যায়!
ইরার উচ্ছ্বাস দেখে কপালে চুমু আঁকে নিহান!
কোলে তুলে ফুলে আচ্ছাদিত দোলনায় বসিয়ে দেয়!নিজেও পাশে বসে!পরম আবেশে চোখ বুজে নিহানের ঠোঁটে ঠোঁট স্পর্শ করলো ইরা!
.
.
.
.
.
বছর দুই পর..এক মেয়ে সন্তানের জন্ম দেয় এলিনা!একমাত্র কন্যা সন্তান নিয়ে শান্ত এলিনা কিন্তু বেশ সুখেই আছে!
কিন্তু ইরা-নিহান_??
ছাদে উদাসীন হয়ে বসে আছে ইরা!ইহান ঘুমাচ্ছে! ছেলেকে বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে নিহান আস্তে আস্তে ছাদে আসে!
এলোমেলো চুলে উদাসীন হয়ে বসে থাকতে দেখে প্রিয়তমা স্ত্রীকে!কেমন যেন সুখী সুখী লাগছে তাকে!
ধীর পায়ে এগিয়ে এসে ইরার গাঁ ঘেঁষে বসল নিহান!বিস্তৃত হাসি হেসে হাতটা আলতো করে ধরল!ইরার দৃষ্টি নড়ল না!একদিকেই আটকে আছে!
ঘাড়ের দিকের চুলগুলোতে মুখ ডুবাল নিহান!আলতো স্পর্শ কিছুটা কেঁপে উঠল ইরা!
কি ব্যাপার আমার বউটাকে আজ এত খুশি খুশি লাগছে?
ইরা মুচকি হেসে বলল _তোমার বউ তো সেদিন থেকেই খুশি যেদিন তার কোল জুড়ে ইহান এলো!
নিহান চুল থেকে মুখ সরালো!আলতো করে জড়িয়ে ধরল ইরাকে!ডুবদিলো অতীতে..
দীর্ঘদিন পেট ব্যাথা থাকায় যখন ইরার আলট্রোসোনা করা হলো জানা গেলো সে আর কোনো দিন মা হতে পারবে না!দীর্ঘদিন মাদক জাতীয় দ্রব্য সেবন তার মাতৃত্বের অধিকার কেড়ে নিয়েছে!চিৎকার করে কেঁদে ছিলো ইরা!পুরো হসপিটালের লোক জড়ো হয়ে গেছে!সব কিছু ভেঙে তছনছ করে ফেলেছিলো!
সেদিন বাসায় আনার পর থেকে প্রায় একমাস মানসিক বিপর্যস্ততায় ছিলো ইরা!একা ঘরে বন্ধী থেকে প্রায় মানসিক রোগী হয়ে গিয়েছিলো!একমাত্র নিহানকে কাছে ঘেষতে দিতো!নিহানের স্পর্শে চুপ মেরে যেতো।
মানাসিক ডাক্তারের কাছে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেলো নিহান!বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে যেতেই সামনে ঘটল এক বিরাট দুর্ঘটনা!সপরিবারে সবাই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়!পাশের ড্রেনে পড়া ছোট্ট নবজাতকের প্রাণটা তখনও আছে!মুহুর্তে ঘটে যাওয়া ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে যায় রাস্তার সবাই!সব গাড়ি থেমে যায়।সবাই তাকিয়ে রইলো রক্তাক্ত মানুষগুলোর দিকে।বাচ্চার মা তখনও জীবিত। ইশারা করছে তার বাচ্চাটার দিকে।কেউ এগুচ্ছে না।ইরা ভিড় ঠেলে দৌড়ে বাচ্চাটাকে তোলে!কাঁদা মাখা শরীর মুখ!
ড্রেনের উপরের পানিতে ওড়ানা ভিজিয়ে মুখের কাঁদাটা মুছে শুধু!ততক্ষণে নিহান সহ দুজন মহিলাও এসে হাজির।একজন ব্যাগ থেকে পানি বের এগিয়ে দেয় ইরার দিকে!বাচ্চাটাকে ধুয়ে দেয় ইরা।বয়স ২৬-২৭ দিন হবে!
বাচ্চা মাও কিছু সময়ের মধ্যে প্রাণ হারায়!
পুলিশ আসার আগে কেউ লাশগুলোর কাছে ঘেষে নি।পুলিশ এসে পোসমর্টামের জন্য সবগুলো লাশ নিয়ে যায়।পেছন পেছন থানায় যায় ইরা নিহান।পরিচিত সেই ওসি!
দুঘর্না কবলিত পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা আসে।সপরিবার সবাই মারা যাওয়ায় বাচ্চাটার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় কেউ আসে নি।
সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বাচ্চাকে কোনো অনাথ আশ্রমে দেয়া হবে!কারণ বড় করার মত কেউ-নেই!থাকলেও রাজি না।
একজন মহিলা কনস্টেবল এসে ইরার কোল থেকে বাচ্চাটাকে নিতে আসে।ঘুমিয়েছিলো বাচ্চাটাকে।ইরা শক্ত করে আকড়ে ধরে আছে বাচ্চাকে।
নিহানের কাছে যেয়ে শার্ট ধরে টানতে টানতে বলে ওকে আমি পালবো নিহান ভাই!দেখো না ও কতটা ছোট।আমায় ঠিক মা বলে ডাকবে।আমার এখন বাবু হলে তো ওর মতই হতো বলো।
নিহান বিনা বাক্যে রাজি হয়প গিয়েছিলো!
বাসায় আনার পর বাড়ির কেউই রাজি হয় নি!সালমা বেগম সটান বলে দিয়েছে বংশ পরিচয় বিস্তারিত না জেনে আমি কোনো বাচ্চা আমার বাড়িতে জায়গা দেবো না।এখন হয় না তো কি হয়েছে বছর খানিক পর তোদের ও হবে!
ইকবাল সাহেব ও কথায় সায় দিয়েছিলো।বাবুকে কোলে নিয়ে সেদিনই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো ইরা।ইরার হাতটা শক্ত করে ধরলেছিলো নিহান।
আজও সে বাড়ির চৌকাঠ মাড়ায় নি ইরা।তার এক কথা তার ছেলেকে সে কিছুতেই নিজের থেকে আলাদা করবে না!
সেদিনের পর আর কখনো ইরাকে মন খারাপ করতে দেখেনি নিহান।সব সময় ঠোঁটের কোণে হাসি লেগেই থাকে।
অতীত ছেড়ে বেরিয়েলো নিহান।ইরা নিহানের বুকেই ঘুমিয়ে গেছে।আরেকবার কপালে ঠোঁট স্পর্শ করে কোলে তুলে নিলো!
ছেলের পাশে নিয়ে শুয়িয়ে দিলো!
পরম শান্তিতে ঘুম দিয়েছে মা-ছেলে।সন্ধ্যের আগে আর উঠবে বলে মনে হয় না!
ইরা-ইহান-ই নিহানের পৃথিবী!ইরা স্পর্শে যেমন সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায় তেমনি ইহানের ছোট্ট হাতের স্পর্শে দুনিয়ার সব শান্তি ভর করে মনে!
বিশ্বাস আর স্পর্শে ভালোথাকুক ভালোবাসার মানুষগুলো!
___সমাপ্ত __