বসন্ত বিলাস পর্ব -০২

#বসন্ত_বিলাস
#আমিনা_আফরোজ
#পর্ব:- ০২

অভিদের বাড়ির সামনে পড়ে একটা সরু কানা গলি। কানা গলি বলার কারন এ গলিতে কোন গাড়ি চলাচল করে না। গলিটা মানুষের হাঁটার উপযোগী। কোন রকমে মানুষ চলাচল করে। সেই গলিতে হাঁটতে হাঁটতেই অভি গম্ভির স্বরে বলল,

–” হ্যাঁরে মেহুল পাস করবো তো? বাকি পরিক্ষা তো দিতেই পারলাম না।”

মেহুল অভির পিছনে পিছু পিছু হাঁটছিল। সংকীর্ণ এই গলিতে এক সঙ্গে দুজন হাঁটবার জো নেই। অভির কথা শুনে উদাস গলায় বলল,

–” তুই আছিস পাস নিয়ে আর আমি আছি মায়ের ভয়ে। ভাব অভি মা যদি আজকের ঘটনাটা জানতে পারে তবে কি হবে আমার? আমাকে তো ঠেঙ্গিয়েই বাড়ি থেকে বের করে দিবে। যদি বাড়ি থেকে আমায় বের করে দেয় তবে কোথায় যাবো আমি? এই অভি শোন মা যদি সত্যি সত্যি আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় তবে আমাকে তোর বাড়িতে একটু ঠাঁই দিস কেমন।”

অভি ঈষৎ রেগে বলল,

–” সবকিছু হয়েছে তোর জন্য?”

–” আমার জন্য মানে? কি করেছি আমি?”

অভি ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,

–” বাহ্ রে তুই যদি তখন স্যারের সাথে ওভাবে তর্ক না করতিস না হলে কি স্যার আমাদের বের করে দিতো, বল ? আরে বাবা পরিক্ষার হলে যখন অন্যের খাতা দেখতে গিয়ে ধরা পড়েইছিস তখন একটু মাথা নিচু করে কাঁদো কাঁদো হয়ে স্যারের কাছে মিনতি করবি তা না……

–” বেশ করেছি গলাবাজি করেছি। আরে বাবা পরিক্ষার হলে দেখাদেখি করাটা আমাদের জন্মগত অধিকার। ওনি সেই জন্মগত অধিকারে হস্তক্ষেপ করবেন আর আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবো। কাভি নেহি। এ মেহুল কখনোই তার অধিকারের ওপর অন্য কারো হস্তক্ষেপ মেনে নিবে না।”

মেহুল নাটকের মতো করে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলো। বেশ বড়ো একটা ভাষন দিয়ে রিতিমত এখন ক্লান্ত মেহুল। অভি সামনে থেকেই শুনছিল মেহুলের এই লম্বা চওড়া ভাষন। অভি মনে মনে এক বেদম খিস্তি দিলো মেহুলকে।

–” আর পরিক্ষার হলে ছাত্ররা দেখাদেখি করলে তাদের খাতা কেড়ে নেওয়াটাও স্যারদের জন্মগত অধিকার।”

পিছন থেকে ভরাট কন্ঠস্বর শুনে চমকে উঠল মেহুল ও অভি দুজনেই। সেকেন্ডের মাঝে ওরা দুজনে হাঁটা থামিয়ে বিদুৎ গতিতে পিছন ফিরে তাকালো। একটা অতি পরিচিত মুখ ওদের চোখের রেটিনায় ধরা দিলো। অভি দু পা পিছিয়ে গেলো। মেহুল মিনমিনিয়ে বলে উঠল,

–” কাকু তুমি?”

মেহুলদের পিছু পিছু আসছিলেন মৃণাল ঘোষ। এতক্ষন চুপটি করে ওদের দুজনের কথা শুনছিলেন তিনি। তবে মেহুলরা মৃণাল বাবুর উপস্থিতি বুঝতে পারে নি। মৃণাল ঘোষ সম্পর্কে অভির বাবা। একটা বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন তিনি। বেশ ভালোই টাকায় মাইনে পান তিনি। এছাড়া বড়ো বাজারে কয়েকটা দোকান আছে ওনার নামে‌ । সব মিলিয়ে একজন স্বচ্ছল মানুষই বলা চলে ওনাকে। অভি ওর বাবাকে দেখে ভয়ে ভয়ে বলল,

–” বাবা তুমি?”

–” আজ্ঞে আমি। কেন আসতে পারি না নাকি?”

–” না মানে কাকু অভি কথাটা ওভাবে বলতে চায় নি। আসলে তুমি তো এসময় বাড়ি ফিরো না তাই…..

–” প্রতিদিন ফিরি না বলে কি বলে কি আজ ফিরতে পারবো না? তাছাড়া রোজ রোজ তো আর ছেলের স্কুল থেকে আসে না তাই না। যেসব ছেলেমেয়েদের স্কুল থেকে পিতামাতার কাছে কল আসে সেসব বাবারাই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে বুঝেছো।”

দুজনে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে । তবে মেহুল বলে উঠে,

–” মানে?”

–” মানেটা এবার বাড়ি গিয়ে বলবো। তোরা কি কোন দিনও শুধরাবি না? তোদের আর কতো বাঁদরামি আমি ঢেকে রাখবো বল তো?”

–” কাকু বিশ্বাস করো , আজ আমাদের কোন দোষ ছিল না। ঐ ভুড়িওয়ালা টাকলা……

মৃণাল ঘোষের আকশ্মিকভাবে কান টেনে ধরায় মেহুলের কথা মাঝপথেই থেমে যায়। মৃণাল বাবু দুজনের কান টেনে বললেন,

–” চল বাড়ি চল, বাকি কথা বাড়ি গিয়ে হবে।”

বলেই মেহুলদের কান ধরে হিরহির করে টেনে নিয়ে যেতে লাগলেন বাড়ির দিকে।

–” আ আ আ কাকু লাগছে তো, কানটা তো ছাড়ো। এভাবে কান টেনে রাখলে তো কানটা লম্বা হয়ে ঝুলে যাবে। তখন এই লম্বা কানওয়ালা মেয়েকে কে বিয়ে করবে? ও কাকু আমার এতো বড় ক্ষতি তুমি করো না গো।”

–” তুই এত ড্রামা কুইন হলি কিভাবে? আমি তো তোকে দেখি আর মাঝে মাঝে ভাবি তোর কাকিমার ঐ টিভির আলতু ফালতু সিরিয়াল না দেখে যদি তোর ড্রামা দেখতো তবে বেশি মজা পেত।”

অভি ওর বাবার কথা শুনে ফিক করে হেসে দিল। মেহুল একবার রাগি রাগি চোখে তাকালো অভির দিকে। মৃণাল বাবু অভির কানটা আরো খানিকটা জোরে চেপে বললেন,

–” তুই ফিক ফিক করে হাসছিস কেন হতচ্ছাড়া। দিন দিন শুধু গায়ে গতরে বড়ো হচ্ছিস কিন্তু বুদ্ধি আর হলো না। বাড়ি চল দুটোয় আজ মজা বোঝাবো।”

রাত আটটা। অভি আর মেহুল গলা ফাটিয়ে পড়ছে । তবে অভি আর মেহুলের শাস্তি হয়েছে আজকের রাতটা ওদের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়া মুখস্থ করতে হবে। বাড়ি ফিরে মৃণাল বাবু কাউকে ওদের এই কুকীর্তির কথা বলেন নি তার পরিবর্তে দিয়েছেন এমন কঠোর শাস্তি। মেহুল কাকুর দেওয়া শাস্তি মাথা পেতে নিয়েছে। দু-চার ঘন্টার পরিবর্তে যদি মায়ের ঠেঙ্গানীর হাত থেকে বাঁচা যায় তবে এই ভালো। অভির মন খারাপ ছিল। জীবনের প্রথম আজ বাবার সামনে অপরাধী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ও। আগামীকাল অভিদের ইংরেজি পরিক্ষা আছে। দাঁড়িয়ে পড়তে পড়তে একসময় ওদের দুজনের ঝিমুনি এসে যায়। মৃণাল বাবু ওদের থেকে একটু দূরে সোফায় বসে খাতায় কিসব আঁকিবুঁকি করছেন আর মাঝে মাঝে দুজনকে বলছেন,

–” কি রে চুপ করে গেলি কেন দুটো? জোরে পড়, শুনতে পাই না তো।”

মৃণাল বাবুর ধমকানোতে ওদের ঝিমুনি কাটে খানিকটা তারপর আবারো খানিকটা সময় জোরে জোরে পড়ে দুজনে। এভাবেই কেটে যায় আরো তিনটে ঘন্টা। সময় চলছে তার নিয়মে‌ । সন্ধ্যা রাত পেরিয়ে আসে গভির রাত। মৃণাল বাবুর স্ত্রী মৃন্ময়ী ওদের মৃণাল বাবুর উদ্ভট শাস্তির হাত থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে যান। দুজনকে ডাল ভাত খাইয়ে চলে যান স্বামীর কাছে। এদিকে মৃণাল বাবুর কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে অভি আর মেহুল এক ছুটে চলে যায় ছাদে।

অভিদের ছাদটা বেশ বড়ো। ছাদের একপাশটায় লাগানো আছে কিছু ফুলের গাছ। যাদের মধ্যে একটা বেলিফুলের গাছও আছে। বর্ষাকালের এ সময়টাতে সে গাছে থোকায় থোকায় সাদা রঙের ফুল ফুটে থাকে। বেলি ফুল মেহুলের খুব প্রিয় । একারনেই মেহুল নিজের হাতে লাগিয়েছে গাছটা। তবে গাছের যত্ন নেয় অভি। ফুল গাছগুলোর গা ঘেঁষে টাঙ্গানো হয়েছে একটা দোলনা। দোলনাতে অনায়াসে দুজন বসে দোল খাওয়া যায়। দোলনাটাও মেহুলের জন্য করে দিয়ে মৃণাল বাবু। মৃণাল বাবু আর মেহুলের বাবা ছিলেন ছোট বেলার বন্ধু। মেহুলের বাবা সাঁওতাল বলে গ্রামের ছেলেপেলেরা খুব একটা মিশতে চাইতো না ওনার সাথে। কিন্তু মেহুলের বাবা ছিল তুখোড় ছাত্র। স্কুলে এক রোল থেকে কখনো দুই রোল হয় নি ওনার। সেই স্কুল লাইফ থেকে মৃণাল বাবু আর অশোক ভট্টাচার্য ছিল প্রাণের বন্ধু। স্কুল জীবন শেষে ভার্সিটি জীবনও একই সাথে কেটেছিল দুজনের। শিক্ষাজীবন শেষে দুই বন্ধুতে মিলে একই কর্মসূত্রে আছেন। বাড়িও করেছেন পাশাপাশি। ওদের বন্ধুত্ব দেখে অবশ্য অনেকেই টিটকারী মারেন তবে এতে ওনাদের বন্ধনে কোন পরিবর্তন আসে না।

আজ আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। চাঁদের শুভ্র আলোয় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। দোলনায় বসে অভি আর মেহুল চাঁদের আলো গায়ে মাখছে। ঝিরিঝিরি হাওয়া এসে দোল খেলে যাচ্ছে ওদের গায়ে। বেলি ফুলের কড়া মিষ্টি গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে অপার্থিব জগত সৃষ্টি করেছে। গভির রাত, চারিদিক শুনসান নিরবতা, পূর্ণ জ্যেৎস্না , মৃদু হাওয়া, কানে হেডফোন,প্রিয় গান আর পাশে প্রিয় মানুষ। মেহুল মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে ছেলেটার দিকে। আচ্ছা ছেলেটাকি ওর এই সুপ্ত ভালোবাসার কথা কখনোই জানবে না? বুঝবে না মেহুলে দুচোখের ভাষা? নিজের মনকেই প্রশ্ন করে মেহুল কিন্তু কোন উওর পায় না।

চলবে

( আসসালামু আলাইকুম। আজকের পর্ব কেমন হয়েছে জানাবেন আর ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ভালো থাকবেন সবাই। )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here