#একটি_নির্জন_প্রহর_চাই
৬৬
#WriterঃMousumi_Akter.
তরীর দেওয়া শার্ট হাতে নিয়ে মৃন্ময় বসে আছে হসপিটালে। কেমন ছন্নছাড়া-উন্মাদ লাগছে দেখতে। চুলগুলো এলোমেলো, শার্টের বোতাম খোলা, ওয়াল হেলান দিয়ে এক হাঁটু ভেঙে হাঁটুর উপর হাত দিয়ে বসে আছে। তিন দিন মৃন্ময় বাড়িতে যায়নি। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে গেল। অথচ মৃন্ময় উঠছেই না। চোখ দু’টো লাল র*ক্ত জবার মতো হয়ে আছে। রোহান কান্নায় ভেঙে পড়েছে। আমি তরীর জন্য মানত করে হসপিটালে প্রবেশ করলাম। মৃন্ময়ের মা-বাবা এসেছে হসপিটালে।
পিহু তার মা-বাবাকে বলl,’ তোমাদের সাথে আমার কথা আছে।
ভাইয়া ছোটো বেলা থেকেই তরী আপুকে পছন্দ করে। পরে আপুর বিয়ে হয়ে যায়।কিন্তু তরী আপু সেখানে ভালো থাকেনি।ডিভোর্স হয়ে যায় আর এর পিছনে তরী আপুর দোষ থাকে না। তরী আপু অনেক ভালো মেয়ে। জীবন যুদ্ধে হেরে গিয়েছে শুধু। ভাইয়া এখনও আপুকে ভালোবাসে।সমাজের অন্য মানুষের মতো তরী আপু ডিভোর্সি বলে তোমরা আপত্তি করো না। তাহলে ভাইয়াকে হারাতে হবে। তোমাদের ঘরেও একটা মেয়ে আছে, আজ যদি আমারও কোনো কারণে ডিভোর্স হয় তাহলে আমাকেও কেউ বিয়ে করতে চাইবে না। বাবা, ভাইয়াকে আমি ভীষণ ভালোবাসি।আমাদের কিছুর অভাব নেই। ভাইয়াকে তোমরা কোনো কিছুর অভাবে রাখোনি। তাই এই অভাবটাও রেখো না। যে অভাবে মানুষ থেকে মানসিক রোগী হয়ে যাবে ভাইয়া।টাকা পয়সা ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে কিন্তু ভালোবাসা ছাড়া কেউ বাঁচতে পারে না।ভাইয়া দীর্ঘদিন মানসিক অসুখে আছে, সুখের অসুখ তাড়া করে বেড়াচ্ছে। তোমরা প্লিজ তরী আপুকে মেনে নাও তোমরা। তরী আপু সুস্থ হলে তোমরা তরী আপুর কাছে যাবে ভাইয়ার জন্য। আপুকে বুঝাবে ভাইয়াকে বিয়ে করার জন্য। তরী আপুর আগের শাশুড়ি খুব খারাপ ছিল। মা – বাবাও নেই। বোনেরা ও কেউ কোনো খোঁজ রাখেনি। ভালোবাসার মতো কেউ নেই। প্লিজ আম্মু-বাবা তোমরা আমাকে যে ভালোবাসা দিয়েছ সেই ভালবাসাটা তরী আপুকে দিয়ো।তরী আপুকে বুঝতে দিয়ো না যে সব শাশুড়ি খারাপ হয়। আমার খুব কষ্ট হয় আপুর জন্য। ভাইয়ার জন্য আমরা হয়তো অনেক ভালো ফ্যামিলির শিক্ষিতা সুন্দরী মেয়ে আনতে পারব। কিন্তু ভাইয়া তাতে সুখী হবে না। ভাইয়ার চোখে তরী আপুই বিশ্ব সুন্দরী। দ্বিতীয় কোনো নারীকে আর ভালো লাগবে না। তাছাড়া তরী আপু যে-কোনো সুন্দরী আর শিক্ষিতা মেয়ের থেকে কম নয়। তরী আপুর মন থেকে ভালোবাসা নামক জিনিস উঠে গিয়েছে। তোমরা আপুর কাছে গিয়ে বুঝাবে জীবনে দ্বিতীয় বার মুভ অন করা যায়। সেই সেটা হয় দারুণ আনন্দের।
মৃন্ময়ের বাবা এসে আমার সাথে কথা বলছেন। মৃন্ময়ের মা মৃন্ময়ের পাশে গিয়ে বসলেন। পৃথিবীতে সব মা খারাপ হয় না।মৃন্ময়ের মা চমৎকার একজন মানুষ। ছেলের চোখের পানি মুছিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বললেন, ‘কী হয়েছে বাবু, তোমার এ অবস্থা কেন?’
মৃন্ময় মায়ের বুকে মাথা গুঁজে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। যে ছেলেটা চঞ্চল, ডানপিটে ভালোবাসার জন্য সে ছেলেটাও আজ কাঁদছে। মৃন্ময় কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আম্মু তোমার পরে আমি যাকে ভালোবেসেছি সেই মেয়েটা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। আমি ওকে ভীষণ ভালোবাসি। ওর এই খারাপ অবস্থা একদমই নিতে পারছি না। নিঃশ্বাস আটকে আসছে আমার।’
‘আমাকে এতদিন কেন বলনি বাবু? আমি আমার বউমাকে আমার বাড়ি নিয়ে যেতাম।কেন শুধু শুধু কষ্ট পেয়েছ?’
________________
সন্ধ্যার পরে তরীর জ্ঞান ফিরে এসেছে। আইসি ইউ থেকে বের করা হয়েছে। তরী রোহানের নাম ধরে ডাকছে। আইসিইউ থেকে বের করে বেডে শিফট করানো হয়েছে। রোহান তরীর গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। ছেলেকে অজস্র চুমু দিয়ে ভরিয়ে দিল তরী। ছেলে ছাড়া আর কেউ নেই তরীর যার জন্য মানসিক শান্তি আসে। সবাই তরীর সাথে কথা বলছে। মৃন্ময় অবাক চোখে তাকিয়ে আছে সবার ভিড়ে। রোশান স্যার বললেন,
‘তরী এতটা বেখেয়ালি তুমি কীভাবে হলে? আমরা সবাই চিন্তায় ছিলাম। আমার জীবনের কয়েকটা চাওয়ার মাঝে একটা চাওয়া ছিল তোমার সুস্থতা।’
তরীর কপালে চুমু দিয়ে বললাম, ‘বেবি আই লাভ ইউ।’
তরী মৃদু হাসল।
আমি রোশান স্যারকে ফাঁকায় ডেকে নিয়ে বললাম, একটা কথা আছে।’
‘কী কথা? মানুষের ভিড় থেকে ফাঁকায় আনলে! বিশেষ কোনো সংবাদ আছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘কী?’
‘মৃন্ময়কে কেমন লাগে?’
‘ভালো।’
‘আমি তরীর বিয়ে দিতে চাই মৃন্ময়ের সাথে।’
‘আমিও এই তিন দিন দেখলাম মৃন্ময়ের পা*গ*লা*মো।’
‘দেখুন, মানুষেরটা দেখে শিখুন। মানুষ আপনার মতো না।’
‘আমি কেমন?’
‘আপনি সারারাত বাইরে থাকে। ঘরে বউ আছে কেয়ারই করেন না।’
‘কেন বাইরে থাকি জানতে পারবা।’
‘কী জানব?’
‘সময় হোক।’
‘কবে হবে সময়?’
‘তোমার এমবিএ শেষ হলে।’
‘সে তো এখনও অনেক বছর।’
‘কোথায় অনেক বছর? তুমি তো বিবিএ ফাইনাল ইয়ারে। কয়েক মাস পরেই ফাইনাল পরীক্ষা। মোটামুটি দুই বছর ধরতে পারি। আমাদের চতুর্থ বিবাহবার্ষিকী-তে দেব।’
‘মানে কী, হ্যাঁ? আমি বুড়ি হয়ে গেলে দিবেন?। এমন কী জিনিস যে এত বছর লাগবে?’
‘বুড়ি হবে কেন? বিয়ের দুই বছর কেটে গিয়েছে, আর মাত্র কিছুদিন।’
‘এই দুই বছর ভাবতে ভাবতে পা*গ*ল হয়ে যাব।’
_________
একে একে সবাই কথা বলা শেষ করে বেড ফাঁকা করল। নার্স তরীকে বলল আপনার হাজবেন্ড আপনাকে অনেক ভালোবাসে। যে ভাবে ছুটাছুটি আর কান্নাকাটি করেছে এমন মানুষ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। তরী ছলছল চোখে মৃন্ময়ের দিকে তাকিয়ে মৃন্ময়কে ডাকল।
মৃন্ময় বলল, ‘কেমন আছো এখন? কেমন লাগছে?’
‘ভালো লাগছে না।’
‘সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘সব কীভাবে ঠিক হবে, যদি আপনি এমন করেন? নিজের দিকে তাকিয়ে দেখেছেন ,কী অবস্থা!’
‘দেখার সময় পাইনি।’
‘খেয়েছেন?’
‘হুম।’
‘মিথ্যা বলছেন কেন?’
‘তুমি তিন দিন না খেয়ে আই সি ইউতে আর আমি খাব!’
‘কেন খাবেন না বলুন তো? কী আছে আমার মাঝে? কেন এমন করেন?’
‘এসব প্রশ্ন করো না।’
‘খেয়ে নিন।’
‘এখন তুমি না বললেও খাব।’
‘আপনি এখনি বাসায় যান, গিয়ে খেয়ে রেস্ট করুন।’
‘আমি কোথাও যাবো না।’
‘এমন করছেন কেন?’
‘যতদিন না আমার আম্মুর বউমা হবে তত দিন এমন করব।’
‘আবার এসব কথা?’
‘হুম, এসব কথা।’
‘মৃন্ময়ের মা-বাবা তরীর কাছে এসে বললেন, ‘মা কেমন লাগছে এখন?’
‘জি, ভালো’
‘তোমাকে আর এইবার ছাড়ছি না। আমার ছেলের জন্য তোমাকে নিয়েই যাব এইবার।কেউ আটকাতে পারবে না। শ্বশুর আর বউমা দুজনে মিলে ব্যবসা করবে। আমি আর আমার ছেলে বসে বসে শুধু খাব।’
‘আন্টি এসব কী বলছেন?’
‘ঠিকই বলছি, আর কোনো বাহানা নয় মা।আমার একটা মাত্র ছেলে। তাকে আমরা সুখী দেখতে চাই। সাথে তোমাকেও সুখী দেখতে চাই, বুঝলে?’
তরী মৃন্ময়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল।ভেতর থেকে হয়তো সিগন্যালটা এবার পেয়েই গেল।
এভাবে কেটে গেল আরো কিছু দিন। তরী এখন সুস্থ। সবার সব কিছুই যেন সুন্দর ভাবে চলছে কোথাও কোনো ঝামেলা নেই।আমাদের ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষার ডেট দিয়ে দিয়েছে। তবে ছোঁয়ার শারীরিক অবস্থা এখন ভালো নেই। হাই প্রেশার হয়েছে।প্রায়ই খিঁচুনি হচ্ছে। বাচ্চার মুভমেন্ট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
চলবে?..