আজ ফাহাদ ভাইয়ার বিয়ে। বাড়ির সকলেই সেখানে গিয়েছে। তাও গতকাল। সেখানে যেতে আসতে সময় লাগে। তারা থাকে আরেক জেলায়। সকলে বলতে বাবা, মা আর ভাই। তিলোকে কেউ নিয়ে যায়নি। ও নিজেও মুখ ফুটে বলেনি ওকে নিয়ে যাওয়ার কথা। তিলোর ফুফু অর্থাৎ ফাহাদের মা’ই নিষেধ করেছে। সাথে প্রত্যেকেই ওকে না নিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী। কারণ? কারণ হলো, সে যে ভালোবাসতো ফাহাদকে আর এ কারো অজানা নয়।
বাইরে ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। বাড়িতে কেউ না থাকার সুবাদে তিলোর বরং সুবিধাই হয়েছে। তিলো বৃষ্টি শুরু হতেই ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে। কোনোদিনই সে বৃষ্টি উপভোগ করতে বা সেই আনন্দে ধেই ধেই করে নেচে ওঠেনি। খুব বেশি হলে গুনগুনিয়ে গান গেয়েছে। তার সঙ্গী ছিলো তার বড় বোন তুলি। তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে দুবছর। একমাসের বয়সী একটা ছেলেও আছে। তুলি খুবই সুন্দরী হওয়ায় খুব ভালো বড় পরিবারে বিয়ে হয়েছে খুব কম বয়সে। বয়স উনিশ হতেই বিয়ে হয়ে গিয়েছে তার। তবে বর্তমানে তিলো শুনতে পায়, বোনের সংসারে অশান্তি চলছে। কেন? ও জিজ্ঞাসা করেনি কখনো।
আজ বৃষ্টিতে ছাদের কিনারে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি রাস্তার উপর আবদ্ধ রেখে তিলোর চোখে পানি টলমল করছে। ফাহাদ যে কোনোদিনই তার হওয়ার নয়, তা তো সে জানতো। এরপরও কেন এতো কষ্ট হচ্ছে ওর? বৃষ্টিকে আজকে তার বিশেষ ধন্যবাদ। তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানি একেবারে অস্পষ্ট করে দিচ্ছে সে। যদিও কেউই সেটা দেখার নেই। তিলোর বুক ফেটে কান্না আসছে। তার গাত্রবর্ণটিই কি তার থেকে সবার মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য দ্বায়ী? সবাই তো মানুষ। উপরের আবরণে কি আসে যায়? সে কালো। খুব কালো নয়। শ্যামলা বর্ণ, যা এই পরিবারে বেজায় বেমানান। পরিবারের সকলেই ফর্সা। কিভাবে যে তিলো কালো বর্ণের হয়ে জন্মালো, সেটা নিয়ে তিলো নিজেও দ্বিধায় ভোগে। তিলোর মা বাবা কখনো কিছু না বললেও দাদী, ফুফু, চাচী বেশ কথা শোনায়। আবার নতুন ভার্সিটি উঠে কিন্তু সে এমন বঞ্চনার শিকার হয়নি। বেশ কয়েকজনের একটা ফ্রেন্ড সার্কেলের সদস্য ও। বলতে গেলে মধ্যমণি। ওর সুরেলা কণ্ঠ আর ব্যবহারের কারণে সকলেই ওকে পছন্দ করে।
বাড়ির কয়েকজন মানুষ যে কেন এমন সেটাই তিলো বোঝে না। একবার ওর মাকে বলতে শুনেছিলো, তুলির জন্মের সময় থেকেই দাদী আর ফুফু শুধু ছেলে চাইতো। তুলির জন্মের পর মেনে নিলেও দ্বিতীয়বারের মতো ওদের আশাহত করায় তারা বেশ নারাজ। তিলো মেনে নিয়েছে সবই। তিলোর রূপ নেই। তাই বলে কি ভালোবাসতে নেই? সে তো ভালোবেসেছিল, খুব খুব ভালোবেসেছিল ফাহাদ ভাইয়াকে। বুঝেও কেন মানুষটা ওকে সহ্য করতে পারতোনা। আর সেদিনকার অপমানটা! তিলো মেনে নিতে পারছিল না। তিলো ফাহাদের বউয়ের ছবি দেখেছে। কি সুন্দর মেয়েটা! আসলেই, ওকে কে মেনে নেবে?
তিলোর নিজের চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে চাইলো। গলা থেকে স্বর বের হচ্ছে না যেন। তিলো যেন এই বৃষ্টির কাছেই নিজের অভিযোগ রাখছে,
‘কেন ফাহাদ ভাইয়া? আমার রূপ নেই বলেই কি আমি কোনোদিনও তোমার পাশে দাঁড়ানোর যোগ্যতা রাখি না? একবার সুযোগ দিতে। শুধু একবার। তোমাকে আমার ভালোবাসার চাদরে মুড়ে রাখতাম।’
তিলো কেবল কাঁদছেই না এবার একটা ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নিলো। ছাদের রেলিঙের উপর উঠে দাঁড়ালো ও। যদিও ও নিশ্চিত না, এই একতলার ছাদ থেকে পড়ে কেউ কোনোদিনও মারা গিয়েছে কিনা। রাস্তাতেও পানি জমেছে। তিলোর মরতে ইচ্ছা করছে। আবার ভয়ও করছে। তিলো চোখ বন্ধ করে গভীর একটা শ্বাস নিয়ে লাফ দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে নিতেই রাস্তার হাঁটু সমান পানি চিড়ে একটা রিক্সাকে ওদের বাড়ির গেটের সামনে থামতে দেখে তিলোও থেমে গেলো। রিক্সা থেকে তুলি নামলো। কোলে সাদা তোয়ালে মোড়ানো ছোট্ট ছেলেটা তার। এই ভারী বর্ষণে, বিরাট দূর্যোগে তুলিকে আসতে দেখে তিলো নিজেও থমকে দাঁড়ালো। মরার আগে তুলির আগমনের কারণ জানার ইচ্ছা জাগলো ওর। এটা না হয়, ওর শেষ ইচ্ছা। একবার পুঁচকেটাকেও দেখা যাবে। তিলো খুবই ভালোবাসে পিচ্চিটাকে। প্রথমবার খালা হয়েছে শুনে সেদিন যে ও কতো খুশি হয়েছিলো, তা ওর নিজেরই ধারণার বাইরে ছিলো। তিলো রেলিঙের উপর থেকে নেমে একছুটে নিচে গেলো। তবে সাবধানে। না হলে নিজের গা থেকে ঝড়া পানিতে নিজেই চিৎপটাং হয়ে পড়তো।
তুলি রিক্সা ভাড়া মিটিয়ে ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে একপ্রকার দৌড়ে এসে দাঁড়ালো বাড়ির গেট পেরিয়ে মূল দরজার সামনে ছাউনিটায়। ছেলেটা তার কাঁদছে না কেন, সে বুঝতে পারছে না। নিজের দগ্ধ হৃদয়েই মলম লাগাতে সে এটা কিছু সময় পর খেয়াল করলো। কলিং বেল প্রেস করার আগেই তিলো দরজা খুলে দিলো। ভেজা শরীরে দাঁড়িয়ে সে হাঁপাচ্ছে। তুলিও ভিজে একাকার। ছেলের তোয়ালেটাও ভিজে চুপচুপ। তুলি দ্রুত ঘরে ঢুকে ভাঙা কন্ঠে তিলোকে বললো,
‘তিল, দ্রুত কিছু নিয়ে আয়। আমার বাবুটা ভিজে গিয়েছে।’
তিলো দাঁড়ালো না। ভিতর থেকে ছোট কাঁথা (পিচ্চিটার জন্যই ওদের মা বানিয়ে রেখেছিলো), তোয়ালে সব নিয়ে এসে তুলির হাতে দিলো। তুলি দ্রুত বাচ্চাটাকে মুছিয়ে দিয়ে কাঁথা পাল্টে মুড়ে ফেললো। ছেলেটা এখন একটু কাঁদলো। তবে তার কন্ঠ ক্ষীণ। তিলো ওর কপালে হাত দিয়ে দেখলো বাচ্চাটার ভীষণ জ্বর।
তুলি বাচ্চাটাকে বুকে আঁকড়ে ধরে দুধ খাওয়াতে শুরু করলো। তিলো তখনও ভেজা কাপড়ে দাঁড়িয়ে আছে। তুলিও ভেজা অবস্থায় আছে। তবে বুকের উপর তোয়ালে দিয়ে বাচ্চাটার পুনরায় ভিজে যাওয়া আটকাচ্ছে। তিলো কৌতুহলী দৃষ্টিতে তুলির দিকে তাকিয়ে এই মূহুর্তে এখানে আসার কারণ জানতে চাইলে তুলি ফুপিয়ে কেঁদে দিলো। তিলো অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে এতে। কাঁদতে কাঁদতেই তুলি বললো,
‘তিলরে, আমার সর্বনাশ হয়েছে। তোর দুলাভাই আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। ইমনের সাথে আমার ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে।’
কথাটা শুনে তিলোর মাথায় যেন বাইরের বর্জ্রপাতহীন বৃষ্টি হলেও একটা অদৃশ্য বাজ পড়লো। এই দূর্যোগে কিভাবে একজন স্বামী তার নিজেরই একমাস বয়সী ছেলেকেসহ বউকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারে?
#চলবে??
#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
#সূচনা পর্ব
#ফারিশতা রাদওয়া (ছদ্মনাম)