#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]
০৭,,
তিলো নিজের অনুভূতিগুলোকে প্রশ্রয় না দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। সে কারো সামনে নিজের স্বাভাবিক প্রকাশ ভঙ্গিমায় কোনো বিকার আনবে না। এই চুক্তিটা সে নিজের সাথে করে ফেলেছে। এরপরও মাঝে মাঝেই সে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে, তা সে বুঝতে পারছে। তিলো দ্রুত তৈরি হয়ে নিলো। সে থাকবে না এখন বাড়িতে। সে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে বাড়ির বাইরে যাওয়ার আগে আনিস সাহেবের সাথে ওর দেখা হলো। আনিস সাহেব সবটা বুঝতে পেরেও অনাবশ্যক অবাক হওয়ার ভঙ্গিমায় ওকে জিজ্ঞাসা করলেন,
-কোথায় যাচ্ছিস তিল?
তিলো নিজের কন্ঠস্বরকে স্বাভাবিক করে বললো,
-আমার বন্ধুর বাড়িতে।
আনিস সাহেব কন্ঠে স্নেহ ঢেলে বললেন,
-আজকে যাসনা।
তিলো কিছু সময় থমকে দাঁড়িয়ে কথাটা গুছিয়ে নিলো নিজের মস্তিষ্কে। এরপরই বললো,
-আজকে যাই আব্বু। সন্ধ্যার আগে ফিরে আসবো।
-একটু সহ্য করে নে মা। ভেবে দেখ, তুই না থাকলে কথা উঠবে এটা নিয়ে।
তিলো নিজেও এবার ভেবে দেখলো। আসলেই, ও না থাকলে কথা উঠবে। অন্তত ওর ফুফু অর্থাৎ ফাহাদের মা, যার কিনা অভ্যাসই যেকোনো তুচ্ছ বিষয়কে বড় করে উপস্থাপন করা, সে তুলবেই। এবার বোধহয় তিলো তুলির কেচ্ছায় ছাড় পেতেও পারে। তিলো চলে গেলে, এটা ওর দূর্বল মনোবলের পরিচয় দেবে। সে অতীত ভুলে এগিয়ে যেতে পারে না, এমনটাই ভাববে সকলে, যা তিলো একদমই চায়না। খোঁটা দিতে কেউ পিছু হটবে না।
তিলো থেমে গেলো। সে আর গেলোনা। তাকে প্রমাণ করতে হবে, সে ফাহাদের পরোয়া করে না। সেদিনের অপমান ওকে সম্পূর্ণ ভেঙে দিতে পারেনি।
তিলো আনিস সাহেবের দিকে তাকিয়ে শ্লেষাত্মক কন্ঠে বললো,
-ঠিক আছে আব্বু, আমি যাচ্ছি না।
আনিস সাহেব তিলোর এই সিদ্ধান্তে যেন খুশিই হলেন। তিলোকে একটা মমতামিশ্রিত এবং তিনি যে ওর সিদ্ধান্তে খুশি এমন প্রকাশক হাসি উপহার দিয়ে আবারও বাজারে বের হলেন মিষ্টি কিনতে। তিলো ফিরে এলো নিজের রুমে। সেই অপমানটা তিলো আজও ভুলতে পারেনি। তিলোর হঠাৎই মনে হলো, ও কি সত্যিই ফাহাদকে এতোটা ভালোবেসেছিল কখনো? ফাহাদের অপমানে ও আসলে লজ্জিত। আর কিই বা হতে পারে সে? সে সত্যিই কখনো মরতে চায়নি ফাহাদকে হারিয়ে। তাহলে তো উপায় ছিলো মরার। কিন্তু ও মরেনি। তিলোর সেদিনের কথা মনে পড়লো যেদিন ও আর সহ্য করতে না পেরে ফাহাদকে সরাসরি নিজের মনের কথা বলে ফেলেছিলো–
ফাহাদ, তিলোর ফুফু আর ফুফা এসেছিলো সেদিন তিলোদের বাড়িতে ফাহাদের বিয়ের দাওয়াত দিতে। সাথে চাচাদের বাড়ির সবাই, দাদীসমেত। ফাহাদ ফুফুর একমাত্র ছেলে, তাই আয়োজনটাও বড় করে করছেন তারা। তিলো জানতো ফাহাদের জন্য মেয়ে দেখা হচ্ছে। যেদিন থেকে জানতো, সেদিন থেকেই ওর ভেতর তীব্র অসন্তোষ আর অস্থিরতা শুরু হয়। তিলো কিশোরী বয়স থেকেই ফাহাদের প্রেমে পড়েছিলো। মধ্যবিত্তরা আসলেই বোধহয় প্রথম প্রেমের স্বাদ পায় কাজিনের থেকে। তিলো নানাভাবে ফাহাদকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে। কোনোকিছুতেই লাভ হয়নি। আসলে এটা পূর্বপরিকল্পিত এবং ইচ্ছাকৃত ছিলো। ফাহাদ বুঝেও বরাবর না বোঝার ভান করে গিয়েছে। তিলোও বুঝতে পারতো বিষয়টা। সেদিন যখন ওরা তিলোদের বাড়িতে আসলো, তিলো ঝোঁকের বশেই কাজটা করে ফেলেছিলো।
ফাহাদ তখন তিলোদের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলো। ঠিক দাঁড়িয়ে ছিলো না। ও তখন কলির সাথে একান্তে কথা বলতেই ছাদে একা উঠেছিল। তিলো এমনই একটা সুযোগ চাচ্ছিলো মনে মনে। সেও একান্তেই ফাহাদকে বলতে চায়।
ফাহাদ কথা শেষ করে ফোনটা পকেটে রেখে রেলিঙের উপর হাতের ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ন্ত বিকালের লাল টুকটুকে সূর্যটার দরুন রঙিন আকাশটা দেখছিলো। কলির সাথে কথা বলে মনটাও ফুরফুরে ছিলো তার। মাঝে মাঝেই কিছু কথা মনে পড়ে মুচকি মুচকি হাসছিলো। তিলো ওর কথা শেষ হওয়ার অপেক্ষায় ছিলো এতক্ষণ। ও ছিলো সিঁড়িঘরের সাথে লাগোয়া চিলেকোঠায় দাঁড়িয়ে। ফাহাদের কথা শেষ হতেই ও ফাহাদের পাশে এসে দাঁড়ালো। ফাহাদ আগেই টের পেয়েছিলো ওকে। তিলোর শরীর থেকে হু হু করে বাতাসের সাথে মিলিয়ে যাওয়া আচ্ছন্ন করে দেওয়ার ক্ষমতাযুক্ত পারফিউমের সুঘ্রাণটা আগেই ফাহাদের নাকে এসে ঠেকেছে। ফাহাদ ওর দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারছে, তিলো আজকে সেজেছে। সে ফাহাদের পছন্দের লাল খয়েরী রঙের একটা শাড়ি পড়েছে। হালকা মেকআপ করেছে।
ফাহাদ মৃদু হেসে ওর দিকে না ফিরেই বললো,
-তিলোত্তমা, আজ এভাবে সাজলি যে?
‘তিলোত্তমা’! হ্যাঁ, ফাহাদ ওর ভালো নাম ধরে ডাকে। তিলো জানে যে, ফাহাদ জানে তিলোর সাজের কারণ। এরপরও অমূলক একটা প্রশ্ন করলো। তিলো যতোটা সম্ভব নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করলো। কিন্তু সেই অসভ্য মস্তিষ্ক! সে যে মাঝে মাঝেই বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সম্পূর্ণ অযাচিতভাবে, তিলো নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফাহাদের একটা হাত নিজের দুইহাতে স্যান্ডউইচের মতো করে আঁকড়ে ধরলো। ও জানে না তখনও ও কি করছে! কেবল ওর মস্তিষ্ক বলছে, তিলো কিছু করো। কিছু করো বড্ড দেরি হয়ে যাওয়ার আগে৷ তিলো এতোদিন ফাহাদের জন্য জমিয়ে রাখা সমস্ত ভালোবাসা তার চোখজোড়ায় ধারণ করে নমনীয় আবেদন এবং একইসাথে প্রেমময় কন্ঠে বললো,
-ফাহাদ ভাই, তুমি কি সত্যিই বোঝো না আমার অনুভূতিগুলোকে? আমি জানি, তুমি বুঝতে পারো। এরপরও কেন তুমি আর কাউকে বিয়ে করছো আমায় রেখে? আমি আমার সবটা উজাড় করে তোমাকে ভালো রাখবো। চেষ্টা করবো আমার সবটুকু দিয়ে৷ আমি যে থাকতে পারবোনা তোমাকে ছাড়া। কেন বোঝো না তুমি? আমি জানি, আমি দেখতে খারাপ। কিন্তু বিশ্বাস করো, তোমার প্রতি আমার অনুভূতিগুলোর চেহারা এমন নয়। আমি সত্যিই তোমাকে ভালো…।
কথাটা তিলো শেষ করতে পারলোনা। ফাহাদ একটানে নিজের হাতটা ওর হাতের তৈরি খাঁচা থেকে মুক্ত করে নিলো। তিলোরও হঠাৎই বোধোদয় হলো। সে কি করলো এটা! কথাগুলো বাড়াবাড়ি পর্যায়ের ছিলো, যেগুলো তিলোর গভীর আবেগের প্রকাশরূপ। তিলোর নিয়ন্ত্রণহীন আবেগের পঙক্তিমালা। হয়তো বাঁধা না পেলে সেটা আরো বিস্তৃত হতো। ফাহাদের চোখজোড়া! সেটাই তো তিলোকে নেশাগ্রস্ত বানিয়ে ফেলার মাদক।
তিলোর লজ্জায় এখন নিজেকে নিজেরই খুন করতে ইচ্ছা করছে। সে বোকামি করেছে। সে তৎক্ষনাৎ নিজেকে সামলে, সে যে দুঃখিত সেটা প্রকাশ করতে যাবে, তার আগেই তিলোর গোলগাল মুখটায় একটা থাপ্পড় পড়লো। তিলো নিজের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগও পায়নি৷ ফাহাদ দাঁত কিড়মিড় করে বলে উঠলো,
-তোর সাহস কি করে হলো রে তিল? লজ্জার মাথা খেয়ে বসে আছিস নাকি?
তিলো আবারও কিছু বলার চেষ্টা করলো। ফাহাদ সে সুযোগ ওকে দিলো না। সে আবারও বললো,
-নিজেকে তো রোজই আয়নায় দেখিস, স্বীকারও করলি। এরপরও কিভাবে তুই আমার পাশে দাঁড়াতে চাস? এই শিক্ষা দিয়েছে মামা মামী তোকে? আমার বিয়ে ভাঙতে চাস? তোর রূপ তো কেউ পছন্দ করে না। এরপরও!
তিলো আবারও কিছু বলবে তখন ফাহাদ সেখান থেকে চলে আসতে আসতে বললো,
-বড্ড বেড়েছিস তুই। আজ এর একটা বিহিত করেই আমি ছাড়বো।
তিলোর চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে৷ ভুলটা করে ও যথেষ্ট লজ্জিত। লজ্জায় কথা বলতে পারছে না। আসলে ও চায় কি ও নিজেও বুঝতে পারছে না। ফাহাদের বিয়ে ভাঙতে ও পারবে না। তবুও এই বৃথা চেষ্টার মানে কি? তিলো তখনও বুঝতে পারেনি, ফাহাদের এই আচরণটুকু ছিলো আসলে কোনোকিছুর শুরু। কিছু একটার শুরু। ফাহাদের এই আচরণটুকু কিছুই নয় আসলে।
তিলো নিজের চোখ মুছে নিচে গেলো। ফাহাদ আগেই নেমে এসেছে। কাজল লেপ্টে ওকে এখনই বরং বাজে দেখাচ্ছে।
তিলো নিচে নামতেই তিলোর গালে দ্বিতীয় থাপ্পড়টা পড়লো যেটা নাসিরা পারভীন দিলেন। সবার সামনে লিভিং রুমে দাঁড়িয়ে। তিলো হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিলো ওনার দিকে। ওনি নিজেও কেঁদে দিয়ে চিৎকার করে বললেন,
-বেহায়া মেয়ে কোথাকার! এই শিক্ষা দিয়েছি আমি তোকে? ভাইকে নিয়ে এমন কথা ভাবলি কিভাবে? ভাইকে এই জঘন্য প্রস্তাব কোনো কলঙ্কিনিও দেয়না। আমার পেটের কলঙ্ক তুই। নষ্টা মেয়ে কোথাকার! হারা**। বে**।
নিজের মায়ের মুখে গালিগুলো তিলোর খুব গায়ে লাগলো। নাসিরা পারভীনকে আনিস সাহেব শান্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তিলোর আরো বেশি কান্না পাচ্ছে। সত্যিই মনে হচ্ছে, ও মরে যাক। তিলো আরো বুঝতে পারলো, ফাহাদ ঘটনাটাকে আরো রঙ চড়িয়ে বর্ণনা করেছে। না হলে নাসিরা পারভীন এমন কুৎসিত ভাষায় গালিগালাজ করার মতো মহিলা নন। তিলোকে ওর ফুফু, দাদী, চাচীও অনেক কিছু বললো, যার একবর্ণও ওর কানে ঢোকেনি। ও তো কেবল ওর মায়ের দেওয়া আঘাতটা সামলাতে মরিয়া তখন মনে মনে। তিলো বেশি সময় সেখানে দাঁড়ালো না। ও নিজের ঘরে চলে এলো। দরজাটা বন্ধ করে সেই দরজাতেই পিঠ ঠেকিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লো। এখন আর ও কাঁদছে না। ফাহাদের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। তিলোকে যখন কথা শোনানো হচ্ছিলো, সে তখন ছিলো একদমই নির্বিকার। তিলোর সত্যিই ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ফাহাদ কতোটা রঙ চড়িয়েছে, সেটা তিলো তার মায়ের বলা গালিগুলো থেকে আন্দাজ করতে পারছে। জঘন্য প্রস্তাব! সেটা তিলো কখন দিলো। তিলো যেন কাঁদতেও ভুলে গিয়েছে।
ঘটনাটার পর ওরা আর বসলো না। ফিরে গেলো সকলে। এরপর তিলোর দরজায় নক পড়লো। তিলো প্রথমে নিজের ধ্যানে থাকায় শুনতে পেলো না৷ তবে আনিস সাহেব ডাকাডাকি শুরু করতেই ও আর ওনার ডাক উপেক্ষা করতে পারলোনা। তিলো দরজা খুলে দিলে আনিস সাহেব ওর রুমে ঢুকলেন। তিলো কিছু বললো না। আনিস সাহেব স্নেহমিশ্রিত কন্ঠে বললেন,
-ছোটমা! আমি জানি তুমি এমন কোনো কথা ফাহাদকে বলোনি৷ আমি জানি তুমি ওকে ভালোবাসো৷ কিন্তু এমন কথা বলার মেয়ে তুমি নও, সে বিশ্বাস আমার আছে কারণ আমি তোমার বাবা। যে যাই বলুক মা, তুমি কিন্তু ভেঙে পড়ো না৷
তিলো এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলোনা, ওর শরীরের হাড়গুলো যেন উবে গিয়েছে। ও আনিস সাহেবের সামনে হাঁটু ভেঙে বসে পড়লো হঠাৎ। ডুকরে কেঁদে উঠলো। আনিস সাহেবের হৃদয় ভেঙে গিয়েছে মেয়েকে এভাবে কাঁদতে দেখে। তিনি বুঝতে পেরেও তখন কিছু বলতে পারেননি। ফাহাদ অপরাধী হয়ে যেতো না হলে, আর তাদের আত্মীয়তার সম্পর্কগুলো নষ্ট হতো। কারণ সংখ্যাগুরু সমর্থন ফাহাদ পেতো। প্রথমত উপলক্ষটা ফাহাদ কেন্দ্রীক এবং তার থেকেও বড় কারণ বাড়িতে ছেলেদের পক্ষ নেওয়া হয় বেশি। মূল মুরব্বিরা, তারা ফাহাদের পক্ষে। ফাহাদও হয়তো এতোটা হবে ভাবেনি৷ মানুষ একটা শুনে রঙ চড়াতে গিয়ে মাঝে মাঝে একটু বেশিই করে ফেলে। সেটা হতে পারে অনিচ্ছাকৃত বা হয়তো ইচ্ছাকৃত।
#চলবে#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ (ছদ্মনাম)
০৮,,
তিলোর পক্ষে সেটা, তার সেই অপমানটুকু, নথিভুক্ত হতে সময় নেয়নি। এখন তার আত্মীয় স্বজনরা সকলেই তিলোকে তেমনি একটা মেয়ে ভাবছে, যেমনটা তারা ভেবে থাকে রাস্তার পতিতা-দের। তিলো ভেবে অবাক হলো, ফাহাদ সকলের সামনে এমন কথা বললো কিভাবে? তার মুখে বা রুচিতে কি বাঁধেনি। নাসিরা পারভীনও তখন নিজেকে আটকাতে পারেননি। আসলে তখন ওনার একমুহূর্তের জন্য ফাহাদের কথাগুলো সত্যি বলে মনে হয়েছিল। ওনি ঘটনাটার পর থেকে অপরাধবোধে ভুগছেন। তিলোর সামনে দাঁড়ানোর ক্ষমতাই যেন তিনি হারিয়ে ফেলেছেন।
রাতে তিলো চোখের পাতা এক করতে পারেনি। কাঁদতে কাঁদতে ওর আর এখন কান্নার শক্তিটুকুও নেই। রাতে খায়নি। আনিস সাহেব বারবার সেঁধেছেন। কিন্তু ওকে কোনোভাবে খাওয়াতে পারেননি।
রাত আড়াইটার দিকে তিলোর ফোন বেজে উঠল। তিলো চমকে উঠলো, হঠাৎ এই যান্ত্রিক আওয়াজটায়। তিলো অতি ধীরে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো স্ক্রিনে ‘ফাহাদ ভাই’ নামটা সগর্বে ভেসে উঠেছে। তিলো এই নাম্বারটা একসময় সেভ করেছিলো ফোনে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কখনোই এর আগে ওর সৌভাগ্য হয়নি নিজের ফোনের স্ক্রিনে এভাবে এটা দেখার। সবসময়ই তার এমন একটি প্রত্যাশা ছিলো। কামনা করতো এই কলটা। আজ তার সেই বাসনা পূরণ হওয়ায় যেখানে তার খুশি হওয়ার কথা ছিলো, সে আসলে হতে পারলোনা। বরং তার বদলে তাকে একরাশ ঘৃণা ঘিরে ধরলো, প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো সে। কট করে কলটা কেটে দিয়ে ফোনটা সাইলেন্ট করে পাশে রেখে দিলো। সে এই কল রিসিভ করবে না। কখনোই না।
তিলোর আবারও কান্না পাচ্ছে। ও আবারও কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে ও ঘুমিয়ে পড়েছিলো। তবে সে ঘুমটা খুব ভালো হয়নি। ভোরবেলাতেই ওর ঘুম ভেঙে যায়। আর বরাবরের অভ্যস্ততার খাতিরে ও হাতড়ে ফোনটা তুলে নেয় হাতে সময়টা দেখার জন্য। ফোন হাতে নিতেই ওর চক্ষু চড়কগাছ! ফাহাদ পুরো আটচল্লিশটা কল করেছে ওকে। ও যখন তখনও ফোন ধরেনি, ফাহাদ ওকে ভয়েস মেইল পাঠিয়েছে। তিলো একবার চিন্তা করলো, ও মেইলটা ওপেন করবে না। পরে আবারও কিছু ভেবে ও মেইলটা ওপেন করলো। ও আসলে লোভ এবং কৌতুহল কোনোটাই সামলিয়ে রাখতে পারেনি। মেইলটা ওপেন করে ও ফাহাদের কন্ঠ শুনতে পেলো। সেখানে স্পষ্ট অনুতাপবোধের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে, কাজটা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত ছিলো। ফাহাদের স্বীকারোক্তিটা ছিলো,
‘তিলোত্তমা! আমি জানি তুই আমার উপর রেগে আছিস। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিশ্বাস কর বোন, আমি নিজেও বুঝতে পারিনি বিষয়টা এতোটা গুরুতর হয়ে উঠবে। আমার কথার অর্থ আরো গভীরভাবে সকলে ভাববে। আমি বুঝে কথাগুলো বলিনি। আমি সত্যিই দুঃখিত। হ্যাঁ, আমি তোকে বোন হিসাবে ভালোবাসি। তুই কেন বুঝিস না, তোকে কোনোদিনও আমি বোন ছাড়া আর কোনো নজরে দেখিনি। আর কখনো দেখতেও পারবোনা। জানিস তো তিলোত্তমা, তোর নামটা আমার দেওয়া। তুই জন্মেছিলি, আমি যখন কেবল ছয় বছরের ছিলাম। যে সময়টায়, আসলেই কোনো শিশু তার একটা ভাই বা বোন চায়। বুঝতে শেখে, ভাই বোন থাকার আনন্দটা। তোকে ওটি থেকে বের করে নিয়ে এসে যখন ছোট মামার কোলে দেওয়া হলো, আমি উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম তোর দিকে। সাদা তোয়ালেতে মোড়ানো ঘন কৃষ্ণ বর্ণ আর অনেক ছোট। এতো ছোট যেন কয়লার একটা টুকরা। তুই প্রিম্যাচিউর ছিলি। আমি তখনও ভালো পড়াশোনা জানতাম না, তবুও নাম দিয়েছিলাম কোনো এক দৈব উপায়ে হয়তো, তিলোত্তমা! সংস্কৃতে যার অর্থ ‘তিলের বীজ’। তুই সেসময় থেকে কেবল আমার বোনই ছিলি। এখনো আছিস এবং ভবিষ্যতেও থাকবি। আমি তোর অনুভূতিগুলো বুঝতে পারি। কখনো প্রশ্রয় দিইনি। আজ যখন তুই সীমা লঙ্ঘন করে ফেলেছিলি, তখন আসলে আমি হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছিলাম। মুখে যা এসেছে, বলে ফেলেছি। আমায় ক্ষমা করে দে। আমি সকলের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবো আজকের জন্য। কিন্তু আমার তোর থেকে পাওয়া ক্ষমাটার বেশি প্রয়োজন। এটুকুই বলার ছিলো। বিনিময় হবে না হয়তো। কেবল আমিই বললাম। আমাদের আসলে আর কিছু বলার নেই নিজেদের ভেতর। ভালো থাকিস বোন। দোয়া করি, খুব ভালো একজন, যে তোকে পরিপূর্ণ মর্যাদা দিতে পারবে, তেমন একজন জীবনসঙ্গীকে খুব তাড়াতে খুঁজে পেয়ে যা।’
ভয়েস মেইলটা এখানেই সমাপ্ত। কথাগুলো তিলোকে আরেকবার আঘাত করলো। আসলে কখনোই ফাহাদ ওকে ভিন্নভাবে দেখেনি। তিলোর এটা ভেবেও লজ্জা করছে যে, সে আসলে কতোটা বেহায়া!
ফাহাদ পরদিন তিলোর বাড়িতে এসে সকলের কাছে ক্ষমা চেয়ে গিয়েছিল। নিজের বাড়ি এমনকি বড় চাচার বাড়িতে পর্যন্ত গিয়ে নিজের ভুল স্বীকার করে নিয়েছিলো। এই সাহসটুকু অর্জন করতে ফাহাদের একদিন সময় লেগেছে, নিজের সাথে যুদ্ধ করে জয়ী হতে হয়েছে। তবে সকলেই তখন জেনে যায়, যারা যারা জানতে বাকি ছিলো আরকি, যে, তিলো ফাহাদকে ভালোবাসে।
ফাহাদের এতো কথাও তিলোর ওর প্রতি অনুভূতিগুলোকে হত্যা করতে পারেনি কখনো। তিলো প্রকাশ করে না কিন্তু মনের কুঠুরিতে আজও ফাহাদের জায়গাটা সংরক্ষণ করে রেখেছে। তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারেনি সেখান থেকে। যা এখনো তিলোকে ক্ষণে ক্ষণে নির্জীবতা অনুভব করাতে যথেষ্ট, যা তাকে জীবনটা অর্থহীন মনে করায় মাঝে মাঝেই।
আজ যে কলিকে ফাহাদের পাশে দেখে তিলোর ভেতরটা একেবারে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে, চুরমার হয়ে ভেতরটা তার আকৃতি হারিয়ে কেবল একটা আবর্জনা স্তূপ সদৃশ স্তুপে পরিণত হতে চলেছে, এটা সকলে বুঝতে পারা সত্ত্বেও প্রত্যেকই নির্বিকার। তারা উপায়হীন একদিক থেকে। আনুষ্ঠানিকতা পালনে অলিখিত এবং প্রায় অঘোষিত একটা নির্দেশ তাদের উপর আছে। যা তিলোর জন্য কখনোই পালন না করা হবে না।
দুপুর হতে না হতেই ওরা আসতে শুরু করেছে। তিলোর জীবনের চরম অপমানের দিন অরিক উপস্থিত ছিলোনা। আজ সেও এসেছে। তিলোর একবার মনে হলো, সে অনিকে কল করে ডেকে আনে। কিন্তু সে এমনটা করলোনা। এখানে তিলোই গুরুত্বীন, এরপর ওর বন্ধুদের ডাকা চলে না।
তিলো নিজের রুম থেকে বের হয়নি৷ বাইরে কোলাহল ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফাহাদের মাইকের মতো কন্ঠস্বর তিলোর কানে প্রবেশ করছে বারংবার। এতো কেবল কানে প্রবেশ করছে না, তিলোর মস্তিষ্কে ঢুকে সেখান থেকে হৃদয়ে আঘাত হানার সংকেত যাচ্ছে একের পর এক। তিলো আর নিতে পারছে না৷ ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে ড্রয়ার খুলে ইয়ারফোনটা বের করলো। একমুহূর্ত সেটার দিকে তিলো তাকিয়ে চিন্তা করলো, ফাহাদের জানা উচিত, সেদিন তিলো মুখেই কেবল বলেছিলো যে ও ফাহাদকে ক্ষমা করে দিয়েছে। কিন্তু আসলে সে মন থেকে করতে পারেনি। তিলো দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেললো। এটা ফাহাদের জানা না জানার মধ্যে কোনো পার্থক্য রচনা করে না আসলে। তিলো, ভোডাফোনের পুরান জনপ্রিয় অ্যাডগুলোর ওই সাদা সাদা কার্টুনের মাথার মতো দেখতে ইয়ারফোন দুই কানেই গুঁজে নিলো। সে নিজেকে কড়া শাসনে রেখেছে, আজ কোনো ছ্যাঁকা খাওয়া গান শুনবে না। নিজেকে আনন্দ দেবে সে।
#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]
০৯,,
তিলোর কপালটা খুব একটা ভালো না হয়তো। কিছু সময় পরই ওর ডাক পড়লো। ওকে ডেকেছে ওর ফুফু। তাই ডাকতে এসেছে তুষার ওর মায়ের আদেশে। তিলোর দুইকানেই ইয়ারফোন থাকায় প্রথমে কিছু শুনতে পেলো না। একটা গান শেষ হয়ে অপর গান শুরু হওয়ার মাঝখানে তুষারের ডাক কানে এলো ওর।
তিলো বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে দিলে তুষার ফিচেল হেসে বললো,
-আম্মা তোকে ডাকছে।
তিলো তুষারের ধৈর্য্য দেখে মাঝে মাঝেই অবাক হয়ে যায়। বিশেষ করে ওর ধৈর্য্যের পরিচয় পাওয়া যায়, বাড়িতে আত্মীয় স্বজনের আগমনে। তিলোকে এতক্ষণ সাড়া না দেওয়ার জন্য কিছুই না বলে তুষার চলে গেলো।
তিলোর সংকোচবোধ হচ্ছে সবার সামনে যেতে। তবুও না যাওয়াটা অভদ্রতা বিধায় রুমের দরজা আটকে ভালো একটা জামা পড়ে নিলো। ওয়াশরুম থেকে ভালো করে মুখ ধুয়ে ক্রিম মেখে বেরিয়ে এলো।
লিভিং এ ঢুকে সবার উদ্দেশ্যে তিলো ছোট করে একটা সালাম দিলো। কারো কারো মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে তো কারো কারো হয়নি। তিলোকে দেখে ওর ফুফু মরিয়ম রহমান ওকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,
-এই তো তিল এসে গিয়েছে। এদিকে আয় তো। তোর ভাবির সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।
মরিয়ম রহমান কলির দিকে তাকিয়ে বললেন,
-কলি মা, এই হলো তিলোত্তমা। তোমার আরেক ননদ।
কলি তিলোর দিকে তাকিয়ে হাসি মুখেই সালাম দিলো। তিলোও মেকি হেসে তার উত্তর দিলো। সে তিলোকে সবার সাথেই বসতে বললো। তিলো খেয়াল করে দেখলো সোফায় একমাত্র অরিকের পাশের জায়গাটাই ফাঁকা আছে। তিলো একবার সেদিকে তাকিয়ে ডাইনিং থেকে চেয়ার টেনে এনে বসলো। অরিক তিলোর আচরণে কোনো এক অজানা কারণেই খানিকটা অপমানবোধ করলো যদিও তার কোনো ধারণা নেই, কেউ বিষয়টা লক্ষ্য করেছে কিনা। তবে অরিকের আরেকপাশে বসে থাকা ওর ছোট ভাই অভ্র বিষয়টা ঠিকই খেয়াল করেছে। তবুও সে কিছু বললো না।
ফাহাদ বসেছে কলির ঠিক পাশেই আর সে অরিকের বাবা আকবর সাহেবের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত। মাঝে মাঝে পাশে কলির দিকে ফিরে নিচুস্বরে কথা বলছে। নিশ্চয়ই সে খুব মজার কিছু বলছে হয়তো। কলি মুখ টিপে হেসে দিচ্ছে কথাগুলো শুনে। ফাহাদ একবারও তিলোর দিকে তাকাচ্ছে না। এটা তিলো খেয়াল করে দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেললো কেবল। ভুলটা তো ওর। কি অসম্ভব একটা চাহিদা সেটা! তিলো নিজেকে সামলে নিলো। এখন এসমস্ত কথা ভাবাও পাপ। ফাহাদ, ওর পাশে বসে থাকা বেগুনি রঙের ঢাকাই শাড়ি পড়া সুন্দরী মেয়েটার স্বামী এখন। মেয়েটার কি উজ্জ্বল গায়ের রং! হাসলে কি সুন্দর দেখায় তাকে! চোখে একটা চশমা পড়ে। এতে আরো মানিয়েছে যেন মেয়েটাকে।
মরিয়ম রহমান কথাপ্রসঙ্গে তুলির কথা তুলতেই নাসিরা পারভীন আর আনিস সাহেব সেটা সামলে নিলেন কোনোমতে ইমনের ঘাড়ে দোষগুলো চাপিয়ে। তুলি ততক্ষণে খাবার সাজানোর নাম করে সেখান থেকে বিদায় নিয়েছে। এরপরই মরিয়ম রহমান কলির উদ্দেশ্যে কোনো কারণ ছাড়াই বললেন,
-তিলের রং তো দেখি এখন খুলেছে। কলি তোমায় কি বলবো, জন্মের সময় ওকে যেমন দেখাতো না! এখনতো বয়সের সাথে সাথে উজ্জ্বল হচ্ছে।
নাসিরা পারভীন সম্মতির সুরে বললেন,
-তা ঠিক বলেছেন আপা। মেয়ের বিয়ের বয়স হচ্ছে, এখন তো রূপ খোলেই।
তিলোকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
– যা তো তিল, তোর বোনকে সাহায্য কর। মেয়েটা একা একা পেরে উঠবে না।
তিলো নিঃশব্দে উঠে গেলো সেখান থেকে। নাসিরা পারভীন যে এই প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতেই তিলোকে পাঠিয়েছেন, তিলো জানে। এখন না হলে, এই কথা চলতে থাকলে ওর দাদীও একসময় আরো অনেক কথাই এর সাথে লাগাবেন।
তিলো রান্নাঘরে এসে দেখে, ওদের কাজের মেয়েটিই সবকিছু করছে। আর তুলি এককোনায় দাঁড়িয়ে ইশানকে কোলে নিয়ে ফিডার খাওয়াচ্ছে আর কাজের মেয়েটাকে নির্দেশ দিচ্ছে। তবে তার কন্ঠ ইতিমধ্যে ভেঙে গিয়েছে। তুলি এতক্ষণ কেঁদেছে। আর এটা তিলোর বুঝতে একদমই সময় লাগলো না। তিলো তুলিকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা জানে না। সংসারের ঝুট ঝামেলা সম্পর্কে ও খুব কমই অবগত। এসবের শুরু কিভাবে, মিটমাট হয় কিভাবে বা আদৌও হয় কিনা ও কখনো ভেবে দেখেনি। ছোট থেকে নিজের পরিবারটাকে আদর্শ পরিবার দেখে এসেছে। আত্মীয় স্বজনসহ ওদের বাড়িতে যেই নিয়মিত আসে, সেই বলে, তিলোর বাবা মায়ের সম্পর্কটা আসলেই শিক্ষণীয়। ওদের মধ্যেকার বোঝাপড়া অত্যন্ত ভালো, যা সংসারটাকে এতোদিন কোনোরকম কোনো সূক্ষ্ম চিড় ছাড়াই সুন্দর রেখেছে। ওনাদের ঝগড়াও খুব কম হয়, যতটা হয়, বেশি সময় টেকেনা। দুজনের কেউ না কেউ সেটা খুব দ্রুতই নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেন। তিলো এমন একটা পরিবার দেখে অভ্যস্ত। ওর তুলির সংসার নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই আসলে।
তিলো ওর দিকে এগিয়ে এসে বললো,
-কি করতে হবে বল তো আপু।
তুলি ইশানের মুখের দিকে তাকিয়েই বললো,
-কিছু করতে চাস?
-হুম।
-তাহলে প্লেটগুলো সাজিয়ে ফেল। গ্লাসগুলো সাজাবি। আর চামচগুলো নিয়ে যা।
তিলো ব্যস্ত ভঙ্গিতে কাজ করতে শুরু করে দিলো। কিছু সময় পর, ওরা খেতে বসলে তিলো প্রস্থান করলো। ওকে আর ওদের মাঝে খুঁজে পাওয়া গেলোনা।
ছাদে দাঁড়িয়ে তিলো নিজেকেই দুষে যাচ্ছে। কেন আজও অবাধ্য চোখজোড়া ফাহাদ ভাইকে দেখে যাচ্ছিলো। সে তো সুখেই আছে। তিলো তো তাকে নিজের সমস্তটা দিয়ে সুখেই রাখতে চেয়েছিলো। সে তো তাই আছে। তবে কেন, তিলোর এখনো কষ্ট হয় ওর জন্য? নিজে মানতে পারছে না এখনো। চোখজোড়া ভিজে উঠেছে আবারও।
-ফাহাদ ভাইয়ের কথা ভাবছিস?
তিলোর ভাবনার মাঝেই কখন ওর পাশে অরিক এসে দাঁড়িয়েছে ও খেয়ালও করেনি। কথাটা ওই জিজ্ঞাসা করলো। তিলো চমকে উঠে পাশে তাকিয়ে অরিককে দেখে বিব্রত হয়ে পড়েছে। দ্রুত হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে বললো,
-ভাইয়ার কথা ভাবতে যাবো কেন অরিক ভাইয়া?
অরিক ছাদের রেলিঙের উপর হাত রেখে হেলে দাঁড়িয়ে বললো,
-পাপ করছিস। আবার মিথ্যা বলে আরো পাপ করছিস। কেন? নিজে দোষ করতে লজ্জা লাগে না। কিন্তু স্বীকার করতে লজ্জা লাগে?
তিলো এবার আরো লজ্জা পেলো। মাথা নিচু করে চোখে পুনরায় জমে যাওয়া পানি ছেড়ে দিলো। সেগুলো সোজা মাটিতে পড়লো। অরিক ওর দিকে না তাকিয়েই বুঝতে পারছে ও আবারও কাঁদছে৷ বিরক্ত হয়ে বললো,
-এই ছিচকাদুনে ন্যাকামি বন্ধ কর।
তিলো ওর দিকে তাকিয়ে কর্কশ গলায় বললো,
-আমার যা খুশি তাই করবো, তাতে তোর কি? তুই এসেছিস কেন, আমার সাথে গায়ে পড়ে কথা বলতে? বড় ভাই, যা না নিজের মতো ওদের সাথে আড্ডা দে। আমাকে বিরক্ত করছিস কেন?
তিলো এবার শব্দ করে কেঁদে দিলো, যা থামানোর উদ্যোগ ওর নিজের মাঝেই নেই। অরিক হতভম্ব হয়ে গিয়েছে ওর আচরণে। ও সাধারণত তিলোর সাথে খুবই কম কথা বলে। এর আগে কতোবার কথা বলেছে, সেটা ও আঙুল গুনে বলে দিতে পারবে। হঠাৎ করে তিলোর থেকে এমন আচরণ ও আশা করেনি। ও অবাক কন্ঠে বললো,
-তিল, আমি অরিক।
তিলো আরো তেতে উঠলো এতে।
-আমি জানি তুই কে। বলার কি আছে?
-তিলো তুই কিন্তু …
অরিকের কথা শেষ হওয়ার আগেই সেখানে অভ্র এসে উপস্থিত হলো। তিলোকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-তিল তোর মা তোকে ডাকে। যা নিচে, যা।
তিলো কটমট চোখে একবার অরিকের দিকে তাকিয়ে অভ্রকে উদ্দেশ্য করে ‘যাচ্ছি’ বলে নিচে নামতে যেতেই অভ্র বলে,
-আমার জন্য কোক পাঠিয়ে দিস তো। তখন খেতে পারিনি।
তিলো আচ্ছা বলে নিচে চলে গেলো। অরিক ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
-দেখেছিস মেয়েটার সাহস? আমাকে এতোগুলো কথা শুনিয়ে গেলো!
অভ্র মুচকি হেসে বললো,
-আরে ভাইয়া, বোন সে আমাদের। ও বলবে না তো কে বলবে? এটুকুও যদি ভাই হিসাবে মেনে না নিতে পারিস, তাহলে চলবে?
অরিক নিজেও জানে না ওর কি হলো। হঠাৎই কন্ঠস্বর ওর অজান্তেই পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। বিষন্ন স্বরে বললো,
-ও আমাদের বোন!
-হুম।
-ফাহাদও তো ওর ভাই। ও কিভাবে তাকে আলাদা নজরে দেখে, আর আমাকে নয়?
কথাটা বলে অরিক নিজেই চমকে উঠলো। ও নিজেকে তিলোর থেকে ফাহাদের জায়গাটায় প্রত্যাশা করে! এটা তো ওর কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত ও!
অভ্র সন্দেহের সুরে বললো,
-ফাহাদ ভাইকে যেভাবে দেখে, তুই কি জেলাস?
অরিক থতমত খেয়ে বললো,
-জেলাস মানে? তুই কি মনে করিস আমাকে?
-কিছুই না। শুধু বলবো মায়ের দিকটাও ভেবে দেখিস।
-মায়ের দিক মানে? অভ্র তুই …
এবারও অরিকের কথা শেষ হতে না হতেই অভ্র উধাও। নিচে চলে যাচ্ছে সে অরিককে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে।
#চলবে
#চলবে