ভয় আছে পথ হারাবার পর্ব -১০+১১+১২+১৩

#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ (ছদ্মনাম)

১০,,

ওদের আতিথেয়তায় পরিপূর্ণ একটা অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে বিকাল হয়ে গেলো। তিলোর চাচা আর ফুফু তাদের পরিবার নিয়ে রওনা হলো এখান থেকে খানিক দূরে, তিলোর দাদাবাড়ীর উদ্দেশ্যে। তারা আজ রাতটা সেখানেই থাকবে। তাদের বাড়ি ফেরা সম্ভব হয়ে উঠবে না আজ রাতে। যাওয়ার আগে আগামী শুক্রবার অরিকদের বাড়িতে দাওয়াতটা পড়লো ওদের। সেদিন আবারও একইরকম অনুষ্ঠান হবে শুধু জায়গা ভিন্ন। আর কিছু চরিত্র বদলে যাবে। যেমন সেদিন অতিথি হয়ে যাবে তিলোরা।

ওরা বেরিয়ে যাওয়ার আগে নাসীরা পারভীন কলির হাতে একটা বড়সড় শপিং ব্যাগ ধরিয়ে দিলেন। তিলো আগেই বুঝতে পেরেছিলো নাসীরা পারভীন আর তুলি আগেরদিন মার্কেটে কলির জন্য কিছু কিনতেই গিয়েছিলো আসলে। সাথে ইশানের জন্যও।

অরিক বেরিয়ে যাওয়ার আগে তিলোর কাছে এসে গলার স্বর একেবারে খাদে নামিয়ে বললো,

-আজকে ভালো করলি না তিল। ভুলে যাসনা আমি তোর প্রফেসর।

তিলো কপট রাগ দেখিয়ে গলার স্বর নিচু করেই বললো,

-তোর দম্ভ ভার্সিটিতে দেখাস। এটা আমার বাড়ি। তুই বের হ।

অরিক আজ ওর আচরণে একের পর এক চমক পাচ্ছে। যে তিল কারো সাথে ঠিকমতো কথা বলতো না, বললেও বিড়ালের মতো মিনমিনে স্বরে বলতো, আজ যেন তার সমস্ত সংকোচবোধের দেওয়াল ভেঙে গিয়েছে। ফাহাদের থেকে আঘাত পেয়ে ড্যাম কেয়ার ধরনের একটা মনোভাব তার ভেতর পরিলক্ষিত। অরিক ওর থেকে পাওয়া আচরণটা হজম করতেই সময় লেগে গেলো। কিছু না বলেই চলে গেলো। বাইরে এসে নীল গাড়িটার ড্রাইভিং সীটে বসে একবার আড়চোখে তিলোর দিকে তাকালো। সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিলো মুখে বিরাট এক হাসি ঝুলিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আনিস সাহেব আর নাসিরা পারভীনের সাথে সবাইকে বিদায় জানাচ্ছে। ভাবটা এমন, পুরো অনুষ্ঠানের ইনচার্জ যেন সেই ছিলো এবং সফলতার সাথে সেটা পালন করতে পেরে সে নিজেকে নিয়ে গর্বিত। অনুষ্ঠানের পুরোটা সময় সে খুশিই ছিলো এবং আঘাত পাওয়ার মতো কিছুই আসলে তার সাথে ঘটেনি।

নাসিরা পারভীন এবং আনিস সাহেব তিলোর এহেন আচরণ লক্ষ্য করে মনে মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি পাচ্ছেন। যেন বড় একটা ভার তাদের উপর থেকে সরে গেলো। অনুষ্ঠানটা সফল হওয়ায় যতোটা না খুশি, তার থেকে এই মূহুর্তে ওনারা বেশি খুশি।

রাত প্রায় একটা বেজে গিয়েছে, তিলোর চোখে ঘুম নেই। হঠাৎ পরিহিত মুখোশটা ওকে আরো বেশি পীড়া দিচ্ছে। নিজেকে ঢেকে হাসি মুখে থাকাটা! সময়টা কঠিন ছিলো।
তিলো তার বারান্দায় বসে আছে। তিলোর রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দাটায় সাদা টাইলসের মেঝের উপর একটা দেওয়ালের সাথে লাগিয়ে ছোট একটা তোষক বিছানো। সেখানে কয়েকটা কুশন আছে। তিলো পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখে জায়গাটা। বসার জন্য কেবল এটাই রয়েছে। নিজেকে গুটিয়ে শুয়েও থাকা যায় এখানে। কোনো চেয়ার নেই। একটা এলইডি লাইট জ্বলছে। তিলো দেওয়ালটায় মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে। মাথাটা ভীষণ ধরেছে। এখন ঘুমানো উচিত ও বুঝতে পারছে। কিন্তু ঘুম আসছে না।
তিলো চোখ মেলে আকাশের দিকে তাকালো। তারাভরা আকাশ। তবে কৃত্রিম আলোয় তারাদের বোঝা দ্বায়। তিলো নিজের মনেই হেসে উঠলো। রাতটা তার মতোই কালো।
তিলো আশেপাশে তাকাতেই একসময় একটা কালো টিকটিকির বাচ্চা ওর চোখে পড়লো যেটা সাদা টাইলসের ফ্লোরের উপর থেকে দ্রুত বেগে হেঁটে চলেছে। মাঝ পর্যায়ে সেটা থামলো। শরীরের তুলনায় বড় মাথাটা তুলে কুচকুচে কালো চোখজোড়া তিলোর উপর আবদ্ধ করলো। তিলো মৃদু হেসে পাশে মশার জমিয়ে রাখা লাশগুলো থেকে একটা লাশ তুলে ওর আর বাচ্চা টিকটিকিটার মাঝামাঝি একটা দূরত্বে রাখলো। এতোক্ষণ ওকে মশা কামড়িয়েছে। এখনও কামড়াচ্ছে৷ কিন্তু তিলো সেগুলো তাড়ানোর বিষয়ে কোনোপ্রকার উদ্যোগ গ্রহণের তাগিদ অনুভব করছে না।
টিকটিকিটা প্রথমে কিছু করেনি। তিলো পিছনে সরে গিয়ে সেটার থেকে চোখ সরিয়ে নেওয়ার কিছু সময় পর টিকটিকির বাচ্চাটা সেটা খেয়ে নিলো। তিলো সেটা বুঝতে পেরে টিকটিকিটার দিকে ফিরে বহুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎই আদেশের সুরে বললো,

-লুকিয়ে পড়ো চোর কোথাকার! তুমি রাতের রঙ চুরি করেছো। তুমি রাতের মতোই কালো। তুমি আমার মতোই কালো। লুকিয়ে পড়ো। পুলিশ আসছে। তোমাকে তোমার চুরিকৃত রঙ নিয়ে খুব কথা শোনাবে আর শাস্তি দিবে।

বাচ্চা টিকটিকিটা ওর ভাষা তো আর বুঝতে পারলোনা। তিলো বিরক্ত হলো এতে। এই মূহুর্তে ওর ভেতর বাচ্চামি ভাবটা প্রবলভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। ও জানে ওর কাজটা অযৌক্তিক। এরপরও ও নিজেকে সেটা করা থেকে বিরত রাখতে পারছে না।

তিলো উঠে দাঁড়ালো। এতে টিকটিকির বাচ্চাটা সরে গেলো দূরে। তিলো সেদিকে না তাকিয়েই গটগট করে হেঁটে রুমে চলে আসলো।

পরদিন খুব ভোরে অনি ওকে কল করলো। তিলো তখন সবে ঘুমিয়েছিলো সারারাত জেগে থেকে। ফোনটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে অনি নামটা দেখে ওর মেজাজটা মারাত্মক বিগড়ে গেলো। তিলো ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরেই কয়েকটা গালাগাল করলো ওকে। অনি অপেক্ষা করছিলো, ওর গালাগাল শেষ হওয়ার। তিলো থামার পর অনি স্বাভাবিক কন্ঠেই বললো,

-শেষ হয়েছে? নাকি আরো বলবি?

-কূটনি তুই এখন ফোন করলি ক্যান? আমার আর এখন মনে পড়ছে না।

-বুঝলাম। ঘুমের মাঝে গালাগালির ভান্ডারও চুরি হয়ে যায়। যাই হোক, শোন আজ ভার্সিটিতে আসা লাগবে না। রিয়া আর আহান পালাবে। ওদের নিয়ে কাজি অফিস যাবো।

অনির কথা শুনে তিলোর ঘুম ঘুমভাব সম্পূর্ণ কেটে গিয়েছে। ও তড়িৎ বেগে উঠে বসে উত্তেজিত কন্ঠে তুতলিয়ে তুতলিয়ে বললো,

-মা…মা…মানে? মানে ওরা পালা…পালাবে কেন? আর হঠাৎ করে এ…এই সিদ্ধান্ত কেন? আমি কিছু জানি না কেন? তোকে কে বললো?

তিলোর প্রশ্নগুলোতে অনি খুব একটা বিরক্ত না হলেও ওর তোতলানোতে বেশ বিরক্ত। অনি বিরক্ত মিশ্রিত কন্ঠেই বললো,

-ব্যস্ত হচ্ছোস কিল্লাই? ঠিক কইরা কওন যায়না?

তিলো রাগত্ব স্বরে বললো,

-তোর ফাজিল মার্কা ভাষা বাদ দিয়ে বল সবটা।

অনি ক্ষুন্নস্বরে বলতে শুরু করলো,

-আরে আহানের আব্বু আম্মু গিয়েছিলো রিয়াদের বাড়িতে। রিয়ার আব্বুর কাছে সময় চেয়ে নিতে গিয়েছিলো যাতে আহান কিছু করার পর ওদের বিয়েটা দিতে রাজি হন ওনি। গতকালই গিয়েছিলো। কিন্তু রিয়ার আব্বু আহানদের অবস্থা দেখে আরো বিগড়ে গিয়েছেন। ওনি কোনোমতে রাজি তো হলেনই না উল্টো আহানের প্যারেন্টসকে অপমান করেছেন বাজে ভাবে। এতে আহানও খেপে গিয়েছে। আবার রিয়ার আব্বু আজ দুপুরেই রিয়ার বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন ইউএসে চাকরি করা এক ছেলের সাথে। সব মিলিয়ে একটা জগাখিচুরি মার্কা অবস্থা। তাই ওরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সকাল দশটার ভেতর পালিয়ে বিয়ে করে নেবে। সাক্ষী আমরা। সিম্পল।

তিলোর এসবে কখনোই মত থাকে না। আজও নেই। আবার ওদের ভালোবাসার বিচ্ছেদও তিলো একদমই চায়না৷ উভয়সংকটে পড়েছে ও। খুক খুক করে দুবার কেশে গলাটা পরিষ্কার করে বললো,

-এটা কি ঠিক হবে অনি? বাবা মায়ের অমতে কি ওরা সুখী হবে?

অনি বিরক্ত হয়ে বললো,

-মানুষ মাত্রই ভুল হয়। আঙ্কেলের যে ভুল হচ্ছে না, তার কোনো গ্যারান্টি আছে। তাছাড়া ওরা একে অপরকে ছেড়ে সুখী হবে না। এখন একসাথে থেকেই না হয় দেখুক। তুই দয়া করে নীতিকথার ঝুড়ি নিয়ে লেকচার দিতে বসিস না তোর প্রফেসর ভাইয়ের মতো। পিলিজ বুন্ডি। মাইনা নে।

একটু থেমে আবার বললো,

-থাক তোর আসা লাগবে না। আমরা যথেষ্ট ওদের জন্য। তুই বরং ক্লাস করে পরে আমাদের নোটস দিস। কাজটা রিপার ছিলো। এখন তুই নে দ্বায়িত্ব।

তিলো ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,

-এই হেই, রাগ করছিস নাকি? সরি সরি। আর বলছি না। আমি যাবো তোদের সাথে। কখনো এমন বিয়ে দেখিনি। আজ সেই সাধও পূরণ হবে। রাগ করিস না প্লিজ।

অনি অভিমানী সুরে বললো,

-আচ্ছা ঠিক আছে। সকাল আটটার মধ্যে রিয়ার বাড়ির মোড়ের মাথার গ্রোসারি সুপারশপের সামনে গিয়ে দাঁড়াস। আমরাও যাবো।

তিলো সম্মতি দিয়ে ফোন কেটে দিলো। তিলো পুরো বিষয়টা নিয়ে বেশ উত্তেজনা অনুভব করছে। রোমাঞ্চের গন্ধ পাচ্ছে। ওর বেশ ভালোই লাগছে। এর আগে কাউকে ও এই ধরনের বিষয়ে সাহায্য করেনি। আর না নিজে কখনো ভেবে দেখেছে। আজ প্রথম অন্যরকম অভিজ্ঞতা হতে চলেছে। তিলো নিজের অজান্তেই ওদের সুখের জন্য প্রার্থনা করলো। বিছানা ছেড়ে নেমে ওয়াশরুমে ঢুকে জোরে শাওয়ার ছেড়ে তার নিচে দাঁড়ালো। এখন একটু ভালো লাগছে। তীব্র মাথা ধরাটা শাওয়ারের পানির সাথে অনেকটাই চলে যাচ্ছে যেন। লম্বা একটা শাওয়ার সেরে তিলো রেডি হয়ে নিলো বাইরে যাবে বলে।

রুম থেকে বেরিয়ে নাসিরা পারভীনকে দেখলো রান্নাঘরে সকালের নাস্তা তৈরি করতে। ওনি ফজরের নামাজ আদায় করেই কাজটা করেন। আনিস সাহেবের আবার সকাল সাড়ে আটটার ভেতর বের হতে হয়। তিলো বের হতেই নাসিরা পারভীন ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে বললেন,

-এতো সকালে যে কুঁড়ে কুমারীর ঘুম ভেঙে গেলো! তা এখন কোথায় যাচ্ছো?

তিলো এক মূহুর্ত ভেবে তারপর বললো,

-দ্রুত যেতে হবে আজকে আম্মা। একটু কাজ আছে। নাস্তা কি রেডি হয়েছে?

নাসিরা পারভীন বললেন,

-হুম। নাস্তা এখনি করবে? ভার্সিটির আগে বাড়ি ফিরবে না?

তিলো টেবিলে বসতে বসতে বললো,

-সময় হবে না। এখনি দাও।

নাসিরা পারভীন তৈরি হওয়া রুটি আর একটা বাটিতে সবজি আর মাংস তুলতে তুলতে বললেন,

-তোরও আবার ব্যস্ততা! বাব বাহ্! মেয়ে আমার বড় হয়েছে।

তিলো ওনার কথার প্রত্যুত্তরে কেবল হাসলো। ওর মাথায় এখন অন্য চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। রিয়া কি ঠিকমতো পালাতে পারবে? ওদের বিয়েটা নির্দ্বিধায় হবে তো? ইত্যাদি ইত্যাদি।
তিলো কোনোরকমে খেয়ে বেরিয়ে গেলো গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

#চলবে

*মন্তব্য করবেন অনুগ্রহপূর্বক।#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]

১১,,

তিলো সকলের আগে গিয়েই রিয়ার বাড়ির মোড়ের মাথায় গ্রোসারি সুপারশপের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে ভেবেছিলো। কিন্তু সে হতাশ হলো। সকলেই প্রায় দাঁড়িয়ে আছে। আহানের মাঝে আজ এক অন্যরকম ব্যস্ততা। তার চোখে মুখে উত্তেজনার আভাস। ওর ভঙ্গিমায় প্রকাশ পাচ্ছে, ও আসলে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। রিয়া আদৌ আসার সুযোগ পাবে কিনা, এটা সকলকেই ভাবাচ্ছে।
সকলের ভেতরেই এক প্রকার উদগ্রীবতা কাজ করছে৷ অনি যেন আহানের চাইতে বেশি অধৈর্য্য। কারণটাও স্পষ্ট। নির্ধারিত সময় আরো আগেই পার হয়ে গিয়েছে। আহান কয়েকবার রিয়াকে ফোনে ট্রাই করলো। ফোনটা বন্ধ। আহানের ভেতরকার উত্তেজনা এখন হতাশায় পরিণত হয়েছে। শরীরের রক্ত যেন রাতের ফাঁকা হাইওয়ে ছেড়ে উন্মত্ত অরন্যের রাস্তায় চলেছে। মিরা রিয়াকে দুটো গালিও দিল। এরপরও ওরা প্রায় দুই ঘন্টা যাবৎ দাঁড়িয়েছিল। এক সময় হতাশ হয়ে চলে আসতে নেবে, তখনই রিয়ার আগমন। সে দৌড়ে এসে ক্লান্ত। ওদের সামনে দাঁড়িয়ে হাঁটুতে হাত রেখে রুকুর ভঙ্গিমায় হাপাচ্ছে। ওকে দেখতে পেয়ে সবার ভেতরেই একটা চাপা উচ্ছ্বাস কাজ করছে, যা ওরা কেউ কেউ প্রকাশ করেই ফেললো। আর কেউ কেউ প্রাধান্য দিলো রাগটাকে। রিয়ার হাতে কোন ব্যাগ ছিল না। একেবারে এক কাপড়ে বেরিয়ে এসেছে যেন। আহান ব্যস্ত ভঙ্গিমায় ছুটে গেলো রিয়া দিকে।
রিয়া হঠাৎই আহানকে জড়িয়ে ধরলো। আর নিজের আবেগটাকে আটকে রাখতে পারল না। হুহু করে কেঁদে দিলো। ওরা হয়তো ওদের দুজনের ভিতরে ঢুকতে চাইনি। কেউ কোনো কথা বলল না যতক্ষণ না ওদের ভিতরকার নাটকীয়তা বা আবেগের আদানপ্রদান শেষ হলো।
তিলোর হঠাৎই একটা উদ্ভট ইচ্ছা হলো। নিজের অবাধ্য মন, যার কারনে সে পরবর্তীতে নিজেই লজ্জা পেয়েছে। ইচ্ছেটার সাথে আসলে সে নিজেই আরামদায়ক অনুভব করছিল না। অস্বস্তিকর একটা মুহূর্ত!

সে আসলে চাইছিলো, রিয়ার জীবনে আহানের মতো তার জীবনে কেউ থাকুক। যে তাকে ঠিক এতোটাই ভালোবাসবে আর তিলো তার জন্য সবকিছু ছেড়ে দিতেও দ্বিধাবোধ করবে না। সে নিশ্চিন্তেই তার হাত আঁকড়ে ধরতে পারবে। একটা ভরসা করার মতো হাত, একটা কাঁধ যেখানে ও কাঁদতে পারবে, নিজের সমস্ত দুঃখ উজাড় করে দিতে পারবে চোখের পানিতে, যেটা সেই আস্থাপূর্ণ কাঁধটা ভিজিয়ে দিতে পারবে। এবং সেই ভরসাযোগ্য হাতটা ওর চোখের পানি মুছিয়ে দেবে। ব্যাস, এটুকুই। এটা কি খুব বেশি কিছু? তিলোর মনে প্রশ্ন জাগলো। তবে তার উত্তর খুঁজে পাওয়ার তাগিদ ও এখনই অনুভব করছে না। তিলো যেতে দিলো বিষয়টাকে একেবারে অস্পর্শ রেখে।

রিয়া জানালো, তাকে পালাতে বেশ কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে। ওর বাবা বাসায় ছিল আর ওর উপর ছিল নজরদারি। কাজের মেয়েটাকে নিজের লেটেস্ট মডেলের স্যামসাংয়ের ফোনটা উৎকোচ দিয়ে বেরিয়ে আসতে হয়েছে। রিয়াকে আর কেউই কিছু বলল না দেরি করে আসার জন্য।
ওরা উৎফুল্ল মনে রওনা হলো কাজী অফিসের দিকে। তৌকির তার বাবার গাড়িটা নিয়ে এসেছিল। আহান আর অনিকেত নিজেদের মোটরসাইকেল। অনিকেতের পেছনে মিরা উঠলো। রিয়া তৌকিরের গাড়িতেই উঠলো।

বন্ধুদের অংশগ্রহণে ছোটখাটো একটা আন্তরিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই সম্পন্ন হলো আহান এবং রিয়ার বিয়ে। ওদের সাথে যোগ দিয়েছিল আহান এবং রিয়ার কয়েকজন কাজিন। এরপর ওরা কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে দুপুরে আহান খাওয়ালো সবাই কে। আর ওর বন্ধুরা! আহানের খেয়ে ওকেই বারবার লজ্জায় ফেলছে। ওদের কথাগুলো তো মাঝে মাঝেই লাগামছাড়া হয়ে যাচ্ছে, এতে রিয়া খুব বেশিই লজ্জা পাচ্ছে। মনের সাথে তার নিজের ভেতরকার উচ্ছ্বাস চেপে রাখার ভীষণ লড়াই হচ্ছে। এর উপর ওদের দেওয়া যন্ত্রণা! রিয়ার তো টিকে থাকাই দ্বায় ওদের মাঝে।

আহান বিকালের দিকে রিয়াকে নিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরলো। আহানের বাবা-মা উভয়েই ছোটখাটো একটা ধাক্কা খেয়েছে। আহান যে এমন করতে পারে, এটা ওনাদের ধারণাতীত ছিলো। আহানের মা বিষয়টায় খুশি হলেও মনে হলো না যে, আহানের বাবা খুব একটা খুশি হয়েছে বলে। ওর বন্ধুরাও ছিলো সাথে। আহানের বাবা ওদের দেখে মুখে কিছু না বলেই ভেতরে চলে গেলেন। আহান বিষয়টা খেয়াল করে নিজেও ওনার পেছনে পেছনে ঢুকলো। তবে বেরিয়ে এসে ওর ভাবভঙ্গি ভালো ছিলো না। ওর বন্ধুরা ওকে জিজ্ঞাসা করলো কি হয়েছে। ও কিছু না বলেই রিয়ার হাত ধরে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলো। কেবল ফিরোজকে বললো ওদের অন্তত আজ রাতের জন্য ওর ফ্ল্যাটটায় জায়গা দিতে। এরপর ও কোনো না কোনো একটা ব্যবস্থা করেই নেবে। ওরা প্রায় প্রত্যেকেই ঘটনাটায় ব্যথিত হলো।
ফিরোজ বিনাবাক্য ব্যয়ে ওদের নিয়ে চললো নিজের ফ্ল্যাটে। ফিরোজের বাবা রাজশাহীর একজন সনামধন্য ব্যবসায়ী। ছেলের এই শহরে হোস্টেলে থাকতে কষ্ট হবে চিন্তা করে তিনি এখানকার ফ্ল্যাটটায় ছেলেকে থাকতে দিয়েছেন। তবে ফিরোজ যতোগুলো রাত ওই ফ্ল্যাটটায় না কাটিয়েছে তার থেকে বেশি ও বন্ধুদের বাড়িতে কাটিয়েছে। তাদের বাড়ির ছাদে আড্ডা দিয়ে রাত পার করেছে। বিয়ার খেয়ে ফ্ল্যাট ভবনটার ছাদে চিৎপটাং হয়ে কাটিয়েছে।
ফিরোজ আহানকে আশ্বস্ত করলো যে, ও যতোদিন ইচ্ছা থাকতে পারে ওর সাথে।

তিলোর আজকে মিশ্র অনুভূতি অনুভূত হচ্ছে। আহান এবং রিয়ার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় ও খুশি হচ্ছে ঠিকই তবে ওদের বাড়িছাড়া হওয়ার ঘটনায় খারাপও লাগছে। তিলোর মনে হয়না, আহান বা রিয়া অনেক বেশি কষ্ট পেয়েছে।
কিছুক্ষণ আগে রিপা ওকে নোটস পাঠিয়েছে। তিলো সেগুলোই খাতায় তুলে নিয়ে সবে শেষ করলো। রাত সাড়ে এগারোটা বাজে সবে। এগারোটার ভেতরই ওদের বাড়ির সকলের খাওয়া দাওয়া শেষ হয়ে যায়। ওর আজকে চোখের পাতা ভেঙে ঘুম আসছে। গতরাতে ঘুমাতে পারেনি৷ আর আজকে খানিকটা স্ট্রেস গিয়েছে ওর ওপর থেকেও। দুটো নতুন উপন্যাসের বই কিনেছে। পড়বে ভেবেছিলো। কিন্তু আজ আর তার শক্তি নেই যেন৷ তিলো জানালাটা খুলে লাইট অফ করে শুয়ে পড়লো। আর প্রায় সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমিয়ে সে সুন্দর একটা স্বপ্নও দেখলো। কিন্তু সেই স্বপ্নের মাঝখানেই ওকে সমাপ্তি টানতে হলো সেই বিশেষ বিরক্তিকর যন্ত্রের যন্ত্রণায়।
নিস্তব্ধ রাতের নির্জনতার পর্দা ফুঁড়ে সেই তীক্ষ্ণ শব্দ তিলোর ঘুম ভাঙিয়ে ওর চোখে মুখে আপনাআপনি বিরক্তি ঢেলে দিলো। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই ওর ভ্রু কুঁচকে মুখ থেকে বিরক্তি প্রকাশক ‘চঁ’ জাতীয় শব্দ বেরিয়ে আসলো। তিলো চোখ বন্ধ অবস্থাতেই হাতড়ে ফোনটা তুলে কেটে দিলো। যতো গুরুত্বপূর্ণ হোক, ওর ধরার ইচ্ছা নেই। কিন্তু অসভ্য যন্ত্রটা আবারও বেজে উঠলো। তিলো এবার ফোন বন্ধ করতে পাওয়ার বাটনে চাপ দিয়ে পাওয়ার অফ অপশনটায় আঙুল ছোঁয়াতে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই একপ্রকার আঁতকে উঠলো।
নতুন ফোন কেনার পর প্রায় সবার নাম্বার নিয়েই তিলো সেভ করে রেখেছিলো যদিও অর্ধেকের বেশি মানুষকে ও কখনো ফোন করেনি, শুধুই সেভ করেছিলো। সেরকমই একজন, যাকে ও কোনোদিন কল করেনি। ফোনের স্ক্রিনে অরিকের নামটা ভেসে উঠেছে। তিলোর যেন বিশ্বাস হলোনা। একমুহূর্তের জন্য ওর ভেতর অবচেতন একটা আনন্দ ছেঁয়ে গেলো একদম সমুদ্রের একটা ঢেউয়ের মতো, যেটা একবার ছুঁয়ে চলে গেলো, এজন্য যে, অরিক ওকে কল করেছে! মানে ও কি গুরুত্বপূর্ণ কেউ?
পরমুহূর্তে তিলোর রাগ হলো। ভীষণ রাগ হলো ওর ঘুমটা ভাঙিয়ে দেওয়ার জন্য। তিলো একটু থেমে মনে করার চেষ্টা করলো এতক্ষণ ধরে দেখতে থাকা স্বপ্নটাকে। ও কিছুতেই মনে করতে পারলোনা। এটুকু জানে যে, স্বপ্নটা সুন্দর ছিলো যা ও উপভোগ করে ঘুমের মাঝেই একটা আনন্দ অনুভব করতে পারছিলো। স্বপ্নটার জন্য ওর আফসোস হচ্ছে, যেটা অরিকের উপর রাগ হিসাবে জমা হচ্ছে ও কতৃক। তিলোর ভাবনার মাঝে ফোনটা কেটে আবার বেজে উঠলো। তিলো কঠিন কিছু কথা ওকে শোনানোর উদ্দেশ্যে কলটা রিসিভ করে কানে ধরে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই অরিক গলা খাঁকারি দিয়ে বলে ওঠে,

-ফোন ধরতে এতো সময় লাগে কেন তোর? কি করছিলি বসে বসে?

বিগত ২৪ ঘন্টার মধ্যে তিলো এই তৃতীয়বারের মতো অবাক হলো। অরিকের কন্ঠে স্পষ্ট অধিকারবোধ। তিলো নিজের অবাক হওয়ার পর্যায় থেকে দ্রুত নেমে এলো। এতোরাতে মানুষ কি করে? এটাও প্রশ্ন?
তিলো ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,

-তোর সমস্যা কি আগে সেটা বল। এতো রাতে মানুষ কি করে? কি করে হ্যাঁ? একটা মানুষের ঘুম ভাঙিয়ে জিজ্ঞাসা করছিস, সে কি করছে?

-তুই ঘুমাচ্ছিলি?
অরিকের কন্ঠে আশ্চর্য।
-কেবল সাড়ে বারোটা বাজে আর তুই ঘুমাচ্ছিলি? এতো তাড়াতাড়ি ঘুমালে পড়বে কে? আজকে ভার্সিটি আসিসনি কেন? বাড়িতে জানে? না আমি জানাবো? দেখ তিল, তুই অনেক ফাঁকি দিচ্ছিস। সেমিস্টার পরীক্ষায় কি করবি?

-তোকে ভাবতে হবে না সেটা নিয়ে। আমার লাইফ আমি দেখবো। ভার্সিটি আমার বাপের টাকায় আমি পড়ি। তোর কি? আমি ফাঁকি দিলে আমি ভুগবো। তোর কি? এমনিতে তো আমার সাথে কারো যোগাযোগ থাকা না থাকা সমান। এখন এতো জ্ঞান দিচ্ছিস কেন?

অরিক তিলোর শেষ কথাটায় সামান্য আঘাত পেলেও সেটা লুকিয়ে কিছু বলার আগে তিলো আরো কিছু কথা শুনিয়ে ফোন কেটে দিলো। তিলো ফোন কেটে দেওয়ার পরও কিছু সময় পর্যন্ত অরিক কানে ফোনটা ধরে রাখলো। ওর ভেতর একটা জড়তা হঠাৎই পরজীবি হয়ে অবস্থান করে নিয়েছে। ও যেন পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার শক্তিটুকুই হারিয়ে ফেলেছে।

তিলো ফোন কেটে দেওয়ার পরওর আর ঘুম আসছে না৷ অরিকের উপর ও মহাবিরক্ত। ছোটখাটো প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছা করছে। কিছু সময় ভেবেই একটা উপায় ও বের করে ফেললো। আর সেটা সেই মূহুর্তেই কার্যকর করার পদক্ষেপ নিয়ে নিলো।

অনি নিজের বেডরুমে লাইট অফ করে বিছানার উপর গোটগাট হয়ে বসে ল্যাপটপে একটা হরর মুভি দেখছে। প্রথমে যতোটা সাহস নিয়ে দেখা শুরু করেছিলো, মুভিটার যতো গভীরে যাচ্ছে ওর সাহস কমতে শুরু করেছে। এই মূহুর্তে ওর সাহসের লেভেল একেবারে শূন্য। রীতিমতো ওর হাত পা কাঁপছে। মাঝে মাঝেই মুখে হাত দিয়ে ঢেকে আঙুলের ফাঁকা থেকে দেখছে ও। মাঝে মাঝে মৃদু চিৎকার করে উঠছে। বাড়িতে কেবল ওর মা আছেন, যিনি ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছেন। অনির বাবা ওর ভাইকে নিয়ে ইন্ডিয়ার চেন্নাইতে গিয়েছে ডাক্তার দেখাতে। অনি এখন একপ্রকার স্বাধীন, যেটার পূর্ণ প্রয়োগ সে করছে।
অনির এবার একটু ওয়াশরুমে যাওয়ার প্রয়োজন পড়েছে। কিন্তু ও যেতে পারছে না, এতোটাই ভয় পেয়েছে। ও যেন নড়তে ভুলে গিয়েছে। দাঁতে দাঁত বাড়ি খাচ্ছে বলে ও মাঝে মাঝেই অনুভব করতে পারছে। খাট থেকে নিচে পা রাখলে যদি খাটের তলা থেকে কেউ হাত বাড়িয়ে ওর পা ধরে টান দেয়, সেই ভয়ে পা মাটিতে রেখে ওয়াশরুম পর্যন্ত যেতে পারছে না। রুমের লাইটের সুইচ দরজার পাশে যেখানে যেতে ওকে নামতেই হবে।
হরর মুভিতে ছোটখাটো চলাফেরাও আতঙ্ক। এরমধ্যে লিড ক্যারেক্টরের একটা ফোন আসে। ফোনটা বেজে উঠতেই সে আঁতকে ওঠে আর ভয়ংকর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক শুরু হয় এবং সেই মূহুর্তে অনির ফোনটাও বেজে উঠলো। অনি যেন একপ্রকার লাফিয়ে উঠলো হঠাৎ আওয়াজটায়। ওর বেগও বেড়ে গেলো। ভাগ্যিস পুরোপুরি হয়ে যায়নি। অনি বুকে থুতু দিয়ে ল্যাপটপের থেকে কিছুটা দূরে রাখা ফোনটা হাতে নিলো। নিজের হৃদপিণ্ডে হাতুড়ি পেটার শব্দ ওর কানে বেজে চলেছে। অনি স্ক্রিনে তাকিয়ে তিলোর নামটা দেখে কলটা রিসিভ করেই কয়েকটা গালি ছাড়লো ওকে। তিলো চুপ থেকে ওর গালাগালি শেষ হওয়ার পর বললো,

-অনিমা সুন্দরী, একটা উপকার করবি সোনা?

তিলোর মধু বর্ষণ কন্ঠ শুনে অনির ভ্রু যুগল আপনাআপনি কুঁচকে এলো। আর ওর পুরো নাম ধরে ডাকা! ওর ভেতরের ভয়টা অনেকটা কমে গিয়েছে। অনি ল্যাপটপটা হোল্ড করে বিছানা ছেড়ে নেমে ফোন কানে ধরেই ওয়াশরুমে ঢুকে তিলোকে পরে ফোন করছি বলে কেটে দিলো কলটা৷ কলটা কাটতেই আবারও ভয় করছে ওর। তবে আলো থাকায় তার তীব্রতা কম।
অনি ফ্রেশ হয়ে এসে ওকে কল করলো হোয়াটসঅ্যাপে। তিলো ওকে কেবল বললো,

-দোস্ত, তোকে একটা নাম্বার দিচ্ছি। প্লিজ কিছু কর। আমাকে জ্বালিয়ে মারছে এটা।

অনি সামান্য উদ্বেগ নিয়ে বললো,

-কি হয়েছে তোর? খুলে বল।

-খুলে, বন্ধ করে যেভাবেই বলিনা কেন, আসল কথা হলো, আননোন নাম্বার মেয়ের গলা পেলে যা হয় আরকি। সামনাসামনি না দেখে ওরা যা করে।

-তো এখানে আমি কি করবো?

-তুই কিসব হাবিজাবি গালাগালি করে এসব সামলে নিস। সেটাই করবি।

-তোকে কে বললো?

-গাধী, তুই নিজে বলেছিস আর এখন ভুলে যাচ্ছিস? যাই হোক, আমি তোকে টেক্সট করে পাঠাচ্ছি নাম্বারটা।

তিলো অনিকে কিছু বলতে না দিয়ে ফোন কেটে দিলো। অনি হ্যাবলার মতো ফোনটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। মনে করার চেষ্টা করছে, কবে ও তিলোকে এমন অদ্ভুত কোনো কথা বলেছে৷ কিন্তু ওর মনেই পড়ছে না।

তিলো ওকে সরাসরি অরিকের নাম্বার দিতে পারছে না। এতে অনিকে সায় দেওয়া হবে। তিলো আড়াল থেকে কাজটা করবে। অনিকে সরাসরি অরিকের সাথে যোগাযোগ করার সম্মতির বিষয়ে বলবে না। তিলো দুকূলই ঠিক রাখতে চায়। অরিক কিছু বললেও সে উত্তর ও প্রস্তুত রেখেছে।

#চলবে

**আমার অ্যাসাইনমেন্ট শুরু হয়েছে। এজন্য একটু ব্যস্ত আছি। তাই গল্প মাঝে মাঝে দিতে না পারলে আশা করবো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন বিষয়টা আমার ব্যক্তিগতদিক বিবেচনায়।

**আগেরদিন টিকটিকির বিষয়টা নিয়ে অনেকেই বিরক্ত ছিলেন হয়তো। এজন্য দুঃখিত। আসলে উপন্যাসের স্বার্থে মাঝে মাঝে পারিপার্শ্বিকতার সূক্ষ্ম বিবরণ প্রয়োজন হয়। আমি এমনটা শিক্ষা পেয়েছি একটা উপন্যাস থেকে। এটাই নয় তবে এমন হালকা সূক্ষ্ম অহেতুক বর্ণনা উপন্যাসটায় ছিলো, যে উপন্যাসটা নিউইয়র্ক টাইমস অনুযায়ী বেস্ট সেলার একটা উপন্যাস। লেখিকা তার আরেকটা উপন্যাসের জন্য বুকার পুরস্কার পেয়েছেন। ছোট ছোট কিছু বর্ণনা উপন্যাসের সৌন্দর্য বর্ধনে ব্যবহার করেছি কেবল।

ধন্যবাদ। হ্যাপি রিডিং।#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]

১৩,,

দুপুরের এই সময়টায় সাধারণত আশেপাশে মানুষের চলাচল তুলনামূলক কমে যায়। খুব ভিড় না হওয়ায় তিলো স্পষ্টভাবেই তুলিকে দেখতে পেয়েছে, যেটাকে সে চোখের ভুল বলতে পারেনা৷ রিকশাটা চলে যাওয়ার পর অনিও আসলো সেখানে। তিলোকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে একদিকে চেয়ে থাকতে দেখে সেও সেদিকে তাকালো তবে তার চোখে কিছুই পড়লোনা। রিকশাটার হুড ততক্ষণে উঠে গিয়েছে। অনি তিলোর কাঁধে হাত রেখে বললো,

-কিরে, ওভাবে ছুটে আসলি কেন? কাউকে দেখেছিস?

তিলো ছোট করে ‘হুম’ বলে ফোনে ওর মাকে ডায়াল করলো। প্রথমবারেই নাসীরা পারভীন ফোনটা রিসিভ করলেন। আনুষ্ঠানিক কথাটুকু সেরেই তিলো জিজ্ঞাসা করলো,

-আপু কোথায় আম্মা?

-কে? তুলি? ও তো আজকে একটু বাইরে গিয়েছে। একটা ফোন কিনবে। তোর বাবার কাছে থেকে টাকা নিলো তো। আর ইশানের জন্য ফর্মূলা মিল্ক কিনবে। কেন রে?

তিলোর নিজের মস্তিষ্কে পুরো বিষয়টাকে একবার সাজিয়ে বললো,

-নাহ্। কিছু নাহ্। এমনিই। আচ্ছা রাখছি আমি। বাড়ি ফিরছি।

কথাটা বলে তিলো কল কেটে দিলো। নাসীরা পারভীন ওর কথায় খুব বেশি মাথা ঘামালেন না।
তিলো ফোনটা রাখতেই অনি একেবারে ছেঁকে ধরলো ওকে।

-কি সমস্যা তোর? আমাকে একবার একটু বলতে কি হয়? এদিকে কৌতুহলে আমার কেঁদে ফেলার যোগাড়। কি দেখেছিস তুই?

তিলো দোকানটার ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,

-একটা মেয়েকে দেখে তুলি আপু মনে হলো। তাই।

-সত্যি তুলি আপু এখানে?

তিলো পূর্বের চেয়ারটায় বসে বললো,

-জানি না। মেয়েটা একটা ছেলের হাত ধরে ছিলো। আপু কি করে হবে?

অনি গলতে শুরু করা আইসক্রিমের এক চামচ গালে দিয়ে বললো,

-সেটাই। তারজন্য পুরো আইসক্রিমের মজা তুই নষ্ট করলি। এখন খাওয়া শুরু কর।

তিলো চিন্তিত ভঙ্গিতে খাচ্ছে আর মনে মনে ভেবে চলেছে। অনেকটা ভাবার পর অনির দিকে না তাকিয়েই বললো,

-অনিমা, একটা কথা বলতো। হুট করে যে আপুর ডিভোর্স হয়ে গেলো। এই যে তার উপর এমন একটা ব্লেইম দিয়ে। আপু এতো চুপচাপ আছে কেন? আই মিন, একবারও সেটা মিথ্যা বলে দাবি নিয়ে গেলোনা ভাইয়ার বাড়িতে? আর ভাইয়ার বাড়ির লোকজনও সেদিন কিছুই বললো না? কেন?

এবার অনিরও ভাবান্তর হলো। ও হাতের ফোনটা টেবিলের উপর রেখে সেটার পাওয়ার বাটন টিপে স্ক্রিন অফ করে দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,

-জানি না। বুঝতে পারছি না। হয়তো সে ঝামেলা করতে চাচ্ছে না।

তিলো হুস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,

-এটা খোঁড়া যুক্তি। ইশানের কথা ভেবেও কি একবারও সে বলবে না ইমন ভাইয়াকে। আমি তো এই কয়েকদিনে ওকে একবারও ভাইয়ার সাথে যোগাযোগ করার নূন্যতম চেষ্টা করতেও দেখিনি। আম্মাও চুপচাপ। স্ট্রেঞ্জ!

-এটা তো আমি ভেবেও দেখিনি ইয়ার। ডিভোর্স হয়ে গেলেও তুলি আপুর মতো মেয়েরা অন্তত একবার তো নিজের উপর আনা মিথ্যা অভিযোগের বিরুদ্ধে ……

তিলো ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

-না, না, না। অভিযোগটা হয়তো মিথ্যা না। ভুল আপুর আছে। তাই সে চুপ করে আছে। বেশি ঘাটালে সেই আবর্জনাস্তুপে নিজে পড়বে।

অনি অবাক দৃষ্টিতে তিলোর দিকে তাকিয়ে বললো,

-তোর এখন নিজের বোনকে সন্দেহ হচ্ছে?

-না করার তো কারণ নেই। প্রকৃত কারণ ও আড়াল করে গিয়েছে। তাছাড়া কেউই পুরোপুরি পবিত্র হয়না। আমরা মানুষ। নিজের বোন বলে তার অপরাধ না দেখার তো কারণ নেই।

-তুলি আপু এটা তিল। ভুলে যাসনা।

-মানবমস্তি্স্ক না অনেক বেশি রহস্যময়। কখন কি ইচ্ছা করে সেটা হয়তো সেই মস্তিষ্ক ধারক মানুষটাও বুঝতে পারে না। তাই বিয়ের আগের তুলি আপু আর এখনকার তুলি আপুর মধ্যে পার্থক্য আসলেও সেটা অস্বাভাবিক কিছু না।

কথাটা শেষ হওয়ার সাথে সাথে তিলোর আইসক্রিমটুকুও শেষ হলো। তিলো উঠে দাঁড়ালো। অনি ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে উঠলো,

-উঠে পড়লি কেন? একটু বস। আমারটা শেষ হোক। একসাথে যাই।

তিলো কন্ঠে কোমলতা এনে বললো,

-সরি ইয়ার। বাড়ি যাওয়াটা জরুরি। তোর কচ্ছপ গতিতে খাওয়া শেষ হতে সময় লাগবে। পরে একদিন অপেক্ষা করবো। এখন যাই।

কথাটা বলে তিলো আর দাঁড়ালো না। দোকান থেকে বেরিয়ে গেলো। অনি ওকে দুবার ডেকে থেমে গিয়ে সামনে ফিরে স্বগতোক্তি করলো,

-খাওয়ালাম আমি। আর আমার জন্যই একটু সময় দাঁড়ালো না। লাগবে না আমার তোদের কাউকে।

অনিও দ্রুত শেষ করে বিলটা দিয়ে বেরিয়ে পড়লো নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে।

তিলো রিকশায় বসা অবস্থাতেই ভাড়াটা বের করে হাতে ধরে রাখলো। যেন এটুকু সময় দিতেও তার বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। নিজের ভেতরকার অস্থিরতা কাটাতে বারবার পা দোলাচ্ছে। বাড়ির সামনে রিকশাটা থামতেই তিলো খুচরা টাকা দিয়ে নেমে পড়লো। তড়িঘড়ি করে বাড়ির সামনের বারান্দাটায় দাঁড়িয়ে কলিং বেল টিপলো। দরজা খুলতে খুলতে একটু দেরি হচ্ছে দেখে তিলো আবারও বিরক্ত হয়ে আবারও বেল টিপলো। এবার নাসীরা পারভীনের গলা শোনা যাচ্ছে।

-আসছি তো। এরকম অভদ্রের মতো বেল বাজাচ্ছিস কেন?

বলতে বলতে ওনি দরজা খুলে দিলেন। ওনি দরজা খুলতেই তিলো ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,

-আপু এখনো আসেনি?

-নাহ্। ওর দেরি হবে আসতে, বলে গিয়েছিলো।

তিলো নিজেকে শান্ত করতে জোরে একটা শ্বাস নিয়ে বললো,

-আম্মা, আপুর কি আর কারো সাথে সম্পর্ক আছে?

তিলোর প্রশ্নটায় নাসীরা পারভীন চমকে উঠলেন। হঠাৎ করেই ওনি ঘামতে শুরু করেছেন। তিলোর জেনে যাওয়াটা এবং হাজার বারণ সত্ত্বেও তুলির স্পর্ধাটা ওনাকে একইসাথে কয়েক রকমের অনুভূতি এনে দিচ্ছে। কৌতূহল, তিলো জানলো কিভাবে? রাগ, তুলি ওনার বারণ সত্ত্বেও আবারও ওনার কথার অবাধ্য হওয়ার সাহস পেলো কিভাবে? ভয়, এখন কি সকলেই ধীরে ধীরে জেনে যাবে? বিরক্তি, এইমাত্র বাচ্চাটাকে ঘুম পাড়িয়ে এসে তিলোর প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার কারণে। সাথে সাহায্য পাওয়ার তাড়না।
এই মিশ্র অনুভূতিটা আরেক ধরনের অনুভূতির অবতারণা করছে। তা হলো, উত্তেজনা। ওনি নিজের কানের পাশ থেকে ঘামের সরু ধারার বয়ে চলা অনুভব করতে পারছেন। চুপ করে হতাশ দৃষ্টি ফেলে রেখেছেন তিলোর উপর।

ওনাকে চুপ করে থাকতে দেখে তিলো বললো,

-কি হলো কি? চুপ করে আছো কেন, তুমি জানো তাই না?

-কি…কি…কি জানবো? কি আজগুবি কথা বলছিস হঠাৎ করে। রাস্তার রোদে কি তোর মাথা গেলো নাকি? তুই বোস,আমি তোর জন্য শরবত আনছি।

কথাটা বলে ওনি পেছনে ফিরে রান্নাঘরের দিকে যেতে নিতেই তিলো শান্ত এবং একইসাথে কম্পিত কণ্ঠে বলে উঠলো,

-ইশান ইমন ভাইয়ার ছেলে না। তাই না আম্মা?

নাসীরা পারভীন থমকে দাঁড়ালেন তিলোর কথাটা ওনার কর্ণকুহরে প্রবেশমাত্র। ওনি হঠাৎই নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেন, যেটা ওনার অজানা থেকেই ঘটে গেলো। ওনি পেছনে ফিরলেন তিলোর দিকে। তিলোর মুখোমুখি হলেন এবং ওর চোখে চোখ রেখে তাকালেন। ওনার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো আর ওনি নিজের ডান হাতটা তুলে তিলোর গালে বসিয়ে দিলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় তিলো হতভম্ব হয়ে গেলো। তিলোর মুখটা একদিকে ঘুরে গেলো। ও গালে হাত দিয়ে ছলছল চোখে নাসীরা পারভীনের দিকে তাকালো। চোখে তার কৌতূহল।
নাসীরা পারভীন শক্ত গলায় দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

-তুলির নামে বাজে কথা একদম বলবি না। যা বলেছিস। ব্যাস। এই কথা বাইরে নিবি না। আমাদের তিনজনের বাইরে আর কেউ জানবে না একথা।

তিলো নিজের বুজে আসা গলাটা দুবার কেশে পরিষ্কার করে নিয়ে বললো,

-তাহলে সেটাই সত্যি?

-নাহ্। ইশান ইমনের ছেলে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তুই যে তুলির বিষয়ে আজকে কথাগুলো জেনে গেলি, এটা আর কাউকে বলবি না। তোর বাবাকেও না।

-তুমি আপুকে কিছু বলো না কেন?

-তিল, আর একটা কথাও বাড়াবে না তুমি এই নিয়ে। এখন ঘরে যাও।

-কিন্তু আম্মা আব্বুর থেকে লুকিয়ে ……।

-আমি তোমাকে থামতে বলেছি। বড় হয়েছো, কোথায় থেমে যাওয়া উচিত এটুকু যদি এখনো না শেখো তো কবে শিখবে? ফ্রেশ হয়ে এসো,আমি খেতে দিচ্ছি।

নাসীরা পারভীন তিলোকে আর কিছু বলতে না দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন। তিলো সেখান থেকে নিজের রুমে চলে আসলো। চোখ থেকে এখন পানি পড়ছে ওর। ঠেকিয়ে রাখতে পারলোনা। তিলোর অদ্ভুত লাগছে। পৃথিবীতে ও কাকে বিশ্বাস করতে পারে? নিজের এতোদিনের চেনা বোনটাও আজ বদলে গেলো।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here