#পুনর্মিলন
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_৩৭
হসপিটালের সামন বরাবর এক কোনায় সারি বাঁধা ইট সিমেন্টের বসার জায়গা হিসেবে আছে চারটে ব্রেঞ্চ। রুগিদের সাথে আসা বিভিন্ন আত্মীয় স্বজনদের উদ্দেশ্য বানানো হয়েছে ব্রেঞ্চগুলো। তন্মধ্যে একটা ব্রেঞ্চে বসে আছে ফাল্গুনী আর জাগ্রত।
হসপিটাল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে ঘন্টা খানেক হলো। ফাল্গুনী কাকে একটা ফোন করে ঝিমলির বাবার নম্বর জোগাড় করেছিল। তা নিয়ে বাড়িতে জানানো হয়েছে ঝিমলির কথা। কথা বলেছে জাগ্রত। প্রথমেই সু ই সা ই ডে র কথাটা বলতে গলা কাঁপছিল, সায় দিচ্ছিল না ভেতরটা। তাই বলেছিল, ঝিমলি গুরুতর অসুস্থ; গাজীপুরের একটা হসপিটালে ভর্তি আছে। তারা যেন যতটা সম্ভব শীগ্রই চলে আসে। ঠিকানা বলতে চাইলে ওদিক থেকে ঝিমলির বাবা বলে দেয় তাদের ঝিমলি নামের কোন মেয়ে নেই। সব সম্পর্কের পাঠ নাকি এক বছর আগেই চুকিয়ে দিয়েছে ঝিমলি। তাদের কাছে নাকি ঝিমলি মৃ ত। এমন কথার পর তৎক্ষনাৎ কি জবাব দেবে তা বুঝে উঠেনি জাগ্রত। কিছুসময় চুপ থেকে শক্ত করেছে নিজেকে, গুছিয়ে নিয়েছে কথা। ওদিক থেকে পরিচয় চাইলে পরিচয় না দিয়ে বলেছিল, “ঝিমলি আর সত্যিই নেই। সু ই সা ই ড করেছে ও। ওর ব ডি টা পুলিশ নিয়ে গেছে ম য় না তদন্তের জন্য। তাঁদের কাজ হয়ে গেলে আপনাদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে ওর ব ডি। দয়া করে গাজীপুর থানার পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।”
এতটুকু বলেই কেটে দিয়েছিল ফোন। ওদিকে ঝিমলির বাবা যে মেয়েটাকে মৃ ত মনে করে বলছিল সে মেয়েটা যে আজ সত্যিই মৃ ত তা শুনে কেমন অবস্থায় আছে তা বোঝার জন্য ফোনের এপাশে অপেক্ষা করল না। হয়তো ভয়ে। যদি আরও কোন প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় কি জবাব দেবে?
ওদিকে সোহাগ এখন পুলিশের হেফাজতে আছে। রেস্টুরেন্টের মানুষগুলো আঁটকে রেখেছিল সোহাগ কে। তারপর পুলিশ আসলে ধরে নিয়ে যায় ওকে। সাথে পেয়ে যায় ঝিমলির ব্যাগ। তা থেকে উদ্ধার করে একটি চিঠি আর একটি মোবাইল। চিঠি পড়ে পুলিশের কাছে সবটা জলের মতো স্পষ্ট যে ঝিমলি আ ত্ম হ ত্যা করবে বলে আগে থেকেই প্ল্যান করে এসেছিল রেস্টুরেন্টে। আর আ ত্ম হ ত্যা র মুল কারণ হচ্ছে সোহাগের অ/মান/বিক মানসিক ও শারীরিক নি র্যা তন। সোহাগের সাথে প্রেমের শুরু তারপর জাগ্রতর সাথে বিয়ের আসর হতে পালিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সব লেখা ছিল সেই চিঠিতে। ঝিমলির অন্তরঙ্গ মুহুর্তের ছবি আর ভিডিও দিয়ে সোহাগ ওকে ব্ল্যা/কমে/ইল করে এতোদিন যাবত ধ র্ষ ণ করে যাচ্ছিল আর নিজের খেয়াল খুশি মতো নাচিয়ে যাচ্ছিল কিভাবে তাও বর্ণনা সমেত লেখা ছিল। ঝিমলির বাবা-মা বিয়ে ঠিক করেছিল শুনে আরও অমানবিক অত্যাচার করে গেছে প্রতিনিয়ত। বিয়ে করতে দেয়নি ঝিমলিকে। ঝিমলি মুক্তি চেয়েছে বারংবার। সোহাগ দেয়নি ওকে মুক্তির স্বাদ। আরও নিত্য নতুনভাবে যন্ত্রণা দিয়ে দিয়ে বিষিয়ে তুলেছিল ওর জীবনটাকে। ওদিকে বারবার বিয়েতে না করে দেওয়া আর মাঝেমধ্যে হুট করে গায়েব হয়ে যাওয়া নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয় বাবা-মায়ের সাথে আর আলাদা হয়ে যায় এক বছর আগে। তারপর থেকে একা একা থাকতো। বাবা-মা এমন কুসন্তান রাখেননি নিজের সাথে। একদিকে একাকিত্ব আরেকদিকে সোহাগের নির্যাতন তারওপর আবার সম্মান হারানোর ভয় অতিষ্ঠ করে তুলেছিল ঝিমলি কে। একটা মেয়ের কাছে তার সম্মানের ওপর আর কি আছে। ওর বিশ্বাস ছিল সোহাগ একদিন না একদিন নিজের সাধ মিটিয়ে নিয়ে ভিডিও গুলো ঠিক ভাইরাল করে দেবে। শেষ হয়ে যাবে ওর সব। এ ভয়টা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল ওকে রোজ। পাশে ছিল না কেউ। শুধু মনে হতো যেই সুন্দর শরীরটা একসময় সেজেগুজে আয়নার সামনে ঘুরেফিরে দেখতো কতোটা সুন্দর লাগছে সেই শরীরটাই সামনের দিনগুলোতে পুরো দুনিয়া দেখতে চলেছে। ঘৃন্য নজরে ঝাঁকতে চলেছে তাকে এ সমাজ। যার দরুন শেষ মুহুর্তে এসে এমন এক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বাধ্য হয়েছে ও। শেষে আকুতি নিয়ে লিখেছে, আত্মহত্যার মতো এমন মহাপাপের সাগরে যে ওকে ধাক্কিয়ে ফেলে দিয়েছে গলায় কলসি বেধে তার যেন কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তি হয়। সোহাগ যেন কোনমতেই ছাড় না পায়। নরকে পরিণত হয় যেন ওর জীবনটা। আর কোনমতে যদি ওর কোন ছবি বা ভিডিও ভাইরাল করতে সক্ষম হয় সোহাগ সে ভিডিও যেন ওর বাবা মা না দেখে। তাহলে মরে যাওয়ার পরেও শতবার মৃত্যুর স্বাদ নেবে ও। এমনটাই লেখা ছিল চিঠিতে।
সোহাগের শাস্তি নিশ্চিত। ওর ফোন ঘেঁটে পুলিশ কিছু আপত্তিকর ভিডিও আর শ’খানেক ছবি পেয়েছে ঝিমলির। যা ঝিমলির কথাগুলো সত্য নিশ্চিত করে।
জাগ্রত আর ফাল্গুনী চলে এসেছে বাসায়। রেস্টুরেন্টে তেমন খাওয়া হয়নি দুজনের কারও। বাসায় এসে ফাল্গুনী ভেঙে পড়লো জাগ্রতর বুকে। কান্নার দোহাই দিয়ে তথাকথিত হালকা করতে চাইলো বুকটাকে। কিন্তু হলো না। বুকটা যেন ক্রমশঃ ভারী হয়ে উঠছে। ভেসে উঠছে চোখের সামনে সবটা। ঝিমলির গলায় ঝুলে থাকা ছু ড়ি টা যেন এখনও ঝুলে আছে। এখনও যেন ভেজাচোখে চেয়ে আছে মেয়েটা। ঝিমলির মুখটা ফাল্গুনীর চোখের সামনে থেকে সরছেই না। জাগ্রতর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ফাল্গুনীর এমন অবস্থা দেখে। ইচ্ছে করছে বুকের মাঝে পিষে ফেলতে ফাল্গুনীর সব কষ্ট। কিন্তু কি বলে ফাল্গুনীকে শান্তনা দেবে তা বুঝতে পারছে না। তার নিজেরও তো কষ্ট হচ্ছে ঝিমলির জন্য। কিন্তু ফাল্গুনীর বুক চিরিয়ে কান্না যেন তার থেকেও বেশি হাহাকার এর আন্দোলন তুলছে বুকে। ফাল্গুনীর পুরো রাতটা কাটলো জাগ্রতর বুকেই। রাতটায় ঘুমোতে পারেনি বলে সকালটায় বেঘোরে ঘুমাচ্ছে ফাল্গুনী। দিনটা শুক্রবার, তাই জাগ্রতর অফিস যাওয়ার তাড়া নেই। ঘুম ভাঙলেও ফাল্গুনীকে বুকে নিয়ে শুয়ে রইলো একভাবে। বেলা নয়টার দিকে ঘুম ভাঙলো ফাল্গুনীর। কেমন একটা চুপ মেরে পড়ে রইলো জাগ্রতর বুকে। জাগ্রত ফাল্গুনীকে উঠিয়ে বলল,
“আমি বাইরে থেকে কিছু খাবার নিয়ে আসছি তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও।”
জাগ্রত বেরিয়ে যাওয়ার পর ফাল্গুনী দরজা আঁটকে ওয়াশরুমে ঢুকতে যাবে তখনই দরজায় নক করল কেউ। ফাল্গুনী ভাবল জাগ্রত হয়তো কিছু ফেলে গেছে বলে ফিরে এসেছে। তাই বাইরে কে তা চেক না করেই দরজা খুলে দিল। কিন্তু বাইরে জাগ্রত নয়, দাঁড়িয়ে আছে গতকাল রেস্টুরেন্টে পরিচয় হওয়া আশিকুর রহমান এর স্ত্রী আয়েশা। আয়েশাকে দেখে অবাক হলো ফাল্গুনী। পিছনে চেয়ে খুঁজে দেখার চেষ্টা করলো কোথাও ড. আশিকুর আছেন কিনা। কিন্তু না, কেউ নেই। আয়েশা একাই এসেছে। আয়েশাকে ভেতরে আসার সুযোগ করে দিল সবিনয়ে। বসতেও বলল। আয়েশা বসল না। কেমন ছটফটে গলায় জিজ্ঞেস করল,
“তোমার স্বামী কখন আসবে বোন?”
ফাল্গুনী ধীর কন্ঠে বলল, “দশ পনেরো মিনিট পর হয়তো চলে আসবে। আপনি বসুন, দূরে যায় নি চলে আসবে।”
আয়েশা শুকনো ঢোক গিলে বলল, “এক গ্লাস পানি দেবে?”
ফাল্গুনী জল দিতেই আয়েশা ঢকঢক করে গিলে নিল এক দমে। গ্লাসটা ফাল্গুনীর হাতে দিয়ে বলল, “বোন আমার হাতে বেশি সময় নেই। তোমার স্বামী আসার আগেই আমার কথাগুলো বলে চলে যেতে চাই। কোন প্রশ্ন করো না দয়া করে শুধু শুনে যেও।”
“আপনি কি আমার শ্বাশুড়ী মায়ের মৃ ত্যু সম্পর্কে কিছু জানেন? তাই কি বলতে এসেছেন?”
“বোন আমি এ টু জেট ডিটেইলস জানি না। তবে যেটুকু জানি তা শুনলে তোমার কাজে আসবে আর বললে আমিও ভার মুক্ত হব। আমি প্রথম থেকেই অল্প অল্প জানতাম। গতকাল রাতে রেস্টুরেন্ট থেকে ফিরে গিয়ে আমার স্বামী হাসফাস করছিল। জিজ্ঞেস করায় আরও কিছুটা বলেছে। আমি যে এখানে এসেছি তা সে জানে না। এখানে আমার বাবার বাড়ি। বেড়াতে এসেছিলাম ওদের নিয়ে। ছুটি আছে আরও দু’দিন, কিন্তু থাকবে না বলছে। বলেছে আজ দুপুরেই চলে যাবে।”
“আপনি বাসা কি করে চিনলেন?”
“গতকাল জাগ্রতই বলেছিল তোমরা এখানে থাক। তুমি এসব বাদ দাও। আমার কথা শোন। তুমি জানতে চাও তো তোমার শ্বাশুড়ী কিভাবে মারা গেছিল? অসুস্থ না হওয়া সত্ত্বেও সেই অসুস্থতা থেকে কি করে মৃত্যু হলো? তোমার শ্বাশুড়ীর মৃত্যু অসুস্থতা থেকে হয়নি। তিনি কোনকালে মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেনই না। তার মৃ ত্যু হয়েছে তোমার স্বামীর হাতে। আর তার একমাত্র সাক্ষী আমার স্বামী আর জাগ্রতর মামা।”
ফাল্গুনী যেন নিজের কানে ভুল শুনলো বলে মনে করলো। এমনি গতকাল থেকে মন মস্তিষ্ক এক জায়গায় আঁটকে আছে তাই হয়তো ভুল শুনেছে। এমনটা ভেবে ঠান্ডা গলায় স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞেস করল, “বুঝলাম না। কার হাতে? কে মে রে ছে?”
“তোমার স্বামী। জাগ্রত নিজ হাতে খু ন করেছে।”
ফাল্গুনী এবার আর নিজের কানকে অবিশ্বাস করল না। ভেতর টা জ্বলে উঠলো। গলা শুকিয়ে উঠলো মুহুর্তের মধ্যে। ফাঁকা ঢোক গিলল গলাটা ভেজাতে। কিন্তু ঢোকটা-ও যেন বিশাল পাথরের আকারে বিঁধে রইলো বুকের মাঝ বরাবর। নিজেকে যথা সাধ্য শক্ত রাখার চেষ্টা করলো। আয়েশা ফাল্গুনীর কাঁধে হাত রেখে বলল,
“এটুকু শুনেই ভেঙে পড়লেই চলবে বোন? আমার স্বামী আসলে হয়তো সবটা গুছিয়ে বলতে পারতো। তোমার বুঝতেও সুবিধা হতো। কিন্তু সে আসবে না। জাগ্রতর মামার সাথে এখনও যোগাযোগ আছে আমার স্বামীর সাথে। তার করা বারণ আছে যে তাই হয়তো আসবে না। আর আমার স্বামীও তো দোষী। তাই সে ভয় পায়। কিন্তু মনে মনে প্রচন্ড কষ্ট আর অনুতাপে ভোগে মানুষটা। তাই আমি আমার সাধ্য অনুযায়ী তোমায় বলতে এসেছি। অন্যকারও কাছ থেকে তুমি জানলে যদি হিতে-বিপরীত হয় তাই আমি চেয়েছি তুমি আমার মুখ থেকেই শোন।”
ফাল্গুনীর অচেতন হৃদয় বলছে জাগ্রত নির্দোষ। ও কোন খারাপ কিছু করতেই পারে না। আবার মস্তিষ্কের হিসেব বলছে অন্যকিছু। অনেক ভেবেচিন্তে ফাল্গুনী কঠিন মুখে জিজ্ঞেস করল,
“আপনি আমার বাড়ি বয়ে এসে আমার-ই স্বামীর নামে এত বড় অভিযোগ করছেন। বুঝতে পারছেন তো কি করছেন? এমন নয়তো যে নিজের স্বামীর কুকর্ম ঢাকতে আমার স্বামীর গায়ে যেচে কাঁদা লাগাতে এসেছেন?”
“তুমি তোমার জায়গা থেকো সঠিক বলছো। তবে প্রমাণ বলতে আমার কাছে কিছু নেই। তবে জাগ্রতর মামা সব জানে আর দেখেছেন-ও। আর হ্যাঁ, জাগ্রতর রিপোর্টগুলোও ওনার কাছেই আছে।”
ফাল্গুনী বিক্ষুব্ধ হয়ে বলল, “যা বলার পরিষ্কার করে বলুন। এখানে জাগ্রতর রিপোর্টের কথা কোথা থেকে এলো? পাগল হওয়ার নাটক করেছে ওর মা ও নয়।”
“প্লিজ বোন রেগে যেও না তুমি। আমি গুছিয়ে বলতে পারছি না কথা। গুলিয়ে ফেলছি তাড়াহুড়োতে। কোথা থেকে যে শুরু করব বুঝতে পারছি না।”
“আপনার কাছে হাত জোর করছি প্লিজ উল্টো পাল্টা কথাতে আমাকে এভাবে ভেঙে দেবেন না। আমি এমনিতেই ভেঙে গুড়িয়ে আছি। আপনি চলে যান।”
“কথা শেষ না করে কেথাও যাচ্ছি না আমি। আমি চেষ্টা করছি গুছিয়ে বলার। প্রমাণ না হয় তোমার মামা শ্বশুর এর থেকে নিও। শোন…”
এরমাঝে দরজায় নক হল। আয়েশা নেকাব দিয়ে ঢেকে ফেলল মুখ। ফাল্গুনী দরজার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, “কে?”
ওদিক থেকে আওয়াজ এলো জাগ্রতর। ফাল্গুনী যেই দরজা খুলতে যাবে ওমনি আয়েশা এসে আটকালো। ফিসফিস করে বলল,
“আমি চাইনা তোমার স্বামী আমায় দেখুক আর প্রশ্ন করুক। আমি কোন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে চাই না। তুমি আমায় লুকিয়ে বের করে দাও বোন আর ফোন নম্বরটা দিয়ে দাও। আমি বাকিটা তোমায় পরে বলব।”
ফাল্গুনী দু সেকেন্ড সময় নিয়ে কিছু ভাবল। অতঃপর আয়েশাকে বেডরুমে নিয়ে বসতে বলল বিছানায়। রুমে কোন শব্দ না করে চুপচাপ বসে থাকতে বলল। আয়েশা বলল, “কিন্তু তোমার স্বামী যদি রুমে চলে আসে? এভাবে বিছানায় বসে থাকলে তো অনায়াসেই দেখে ফেলবে।”
ফাল্গুনী কাঠের পুতুলের ন্যায় জবাব দিল,
“আসবে না। আপনি বসুন।”
আয়েশাকে বসিয়ে রেখে দরজা টেনে দিল ফাল্গুনী। গিয়ে দরজা খুলে দিল ধীরগতিতে। জাগ্রত ভেতরে এসে ফাল্গুনীকে বুকে জাপটে ধরল। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “দরজা খুলতে এতোক্ষণ কেন লাগল? তুমি ঠিক আছো?”
ফাল্গুনী ভাবলেশহীন। জবাব দিল না কোন। বিনা প্রতিক্রিয়ায় বুক থেকে সরে এসে সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “কি খাবার এনেছেন?”
জাগ্রত বলল, “পরোটা এনেছি। সাথে ডাল, সবজি আর ডিম আছে।”
ফাল্গুনী বলল, “টেবিলে বসুন। আমি প্লেটে দিয়ে দিচ্ছি।”
জাগ্রত পিছন থেকে হাত টেনে ধরলো ফাল্গুনীর। কাছাকাছি দাঁড় করিয়ে এক হাতে গাল স্পর্শ করলো আলতো করে। ঠিক যেন গোলাপের পাপড়িতে হাত রাখল। স্পর্শ করল এমন গতিতে যেন মূর্ছা না যায় ফুলের অঙ্গ। সেকেন্ড পাঁচেক সময় নিয়ে গভীর চুমু খেল কপালের মাঝখানটায়। জাগ্রতর ঠোঁটের তপ্ততা উষ্ণতা আনল ফাল্গুনীর বুকে। সাথে আনল নয়ন ভর্তি অশ্রু। গড়িয়ে গেল তা দু ফোঁটায় বিভক্ত হয়ে। ফাল্গুনীর অন্তরাত্মা স্বগতোক্তি করে বলল,
“শেষ নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ুক আপনার বুকে।
আমার শেষ হাসি ঝড়ে পড়ুক আপনার মুখে।
শেষ বার সুখ আসুক আপনার সুখে।
শুধু চোখে না আসুক বিচ্ছেদের অশ্রু, দুনয়ন যদি ভিজতেই হয় তবে আপনার প্রেমে উন্মাদ হয়ে আসুক চোখে অশ্রু, ভিজুক এ দুনয়ন, ভিজুক গাল; ভিজুক দেহ, ভিজুক খানিক হৃদয়টা-ও।
সুখ অসুখের হিসেব নিকেশ যাক সব চুকে।”
ফাল্গুনীর কপালের যেইখানটায় চুমু একেছে খানিক আগে জাগ্রত, সেইখানটায় নাক ছোঁয়াল এবার। নাকের ডগা দিয়ে আলতো করে কপাল নেড়ে বলল, “বি স্ট্রং।”
ফাল্গুনী মাথা নেড়ে সায় জানাল। অতঃপর চলে গেল রান্নাঘরে প্লেট আর বাটি আনতে। দুটো প্লেট আর দুটো বাটি নিয়ে এসে খাবার বেরে রাখল টেবিলে। জাগ্রতকে বসতে বলে ওয়াশরুমে গিয়ে মুখটা কোনমতে ধুয়ে এসে বসল খাবার সামনে নিয়ে। জাগ্রত পরোটা ছিঁড়ে প্রথমেই তুলে দিল ফাল্গুনীর মুখে। ফাল্গুনী খেতে খেতে প্রশ্ন করলো,
“মামা-মাসিদের বাসায় আনবেন না? তারা জানেন আমার কথা? আগের মতো তেমন কথা হয় তাঁদের সঙ্গে?”
জাগ্রত খেতে খেতেই বলল,
“বলেছি সবাইকেই। মামা আসতে চেয়েছিল প্রথমদিনেই। কিন্তু মামি আর মাসিরা বলল সবাই মিলে একসাথে আসলে ভাল হয়। আর দুই একদিনের মধ্যে বলার সাথে সাথেই তো সবার একসাথে সময় বের হয় না। বোঝই তো। ছুটি কি জিনিস! তাই সবাই মিলে ঠিক করেছে আগামী শুক্রবার আসবে। আসলে আজকেই আসার কথা ছিল সবার। আমি রাতে ঘুমানোর আগে ফোন করে বলেছিলাম দুদিন পর আসতে। ঝিমলির খবরটা দিয়েছি সবাইকে। সবাই ঝিমলির কথা শুনে বলেছে আগামী শুক্রবার-ই আসবে। আজ আসলে তোমার ওপর চাপ পড়বে। এক সপ্তাহ পর আসলে সে অবধি তুমি একটু ধাতস্থ করে নেবে নিজেকে।”
ফাল্গুনী চুপচাপ শুনলো জাগ্রতর কথা। তারপর
খাওয়া শেষ হতে না হতেই ফাল্গুনী জাগ্রতকে বলল, “একটু থানায় যাবেন? ওদিকে কি অবস্থা একটু দেখবেন? জেঠু আর বড়মা ওরা এলো কিনা একটু দেখে আসুন। আমার ভীষণ মাথা ব্যাথা করছে নয়তো আমিও যেতাম আপনার সাথে। আপাতত একটা টাফনিল খেয়ে একটু শোব।”
জাগ্রত বলল, “একটু পরে গেলে হয় না? তোমার পাশে বসে মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিই; তুমি ঘুমিয়ে গেলে চলে যাব না-হয়।”
ফাল্গুনী সঙ্গে সঙ্গে বলল, “দরকার নেই। চুপচাপ একটু শুয়ে থাকলেই ব্যাথাটা পরে যাবে। আপনি এক্ষুনি যান। আমি ঘুমিয়ে গেলে দরজা লক কে করবে? আর আপনি বাইরে থেকে যদি লক করে যান তাহলে আমার কোন কারণে আমাকে বেরোতে হলে আমি বেরোব কি করে? বাই চান্স আপনার তো আসতে দেরিও হতে পারে!”
জাগ্রত দু’হাতে ফাল্গুনীর দুই গাল জাপটে ধরে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে যাচ্ছি। তুমি ওষুধ টা খেয়ে ঘুমোও।”
জাগ্রত চলে যাওয়ার পর ফাল্গুনী দরজায় সিটকিনি তুলে দিয়ে চলে এলো বেডরুমে। কিন্তু আয়েশাকে কোথাও দেখতে পেল না। একবার আয়েশা আন্টি বলে ডাক দিতেই আলমারির কোনা থেকে বেরিয়ে এলো সে। ফাল্গুনী আয়েশাকে নিয়ে বসলো বিছানায়। আয়েশার হাত তুলে নিল নিজ হাতে। আবেগি ধরা গলা অথচ দৃঢ় ও কঠিন কন্ঠে বলে উঠলো, “যে মানুষটাকে খু নো খু নি করার কথা বলছেন সে মানুষটাকে আমি আমার সবটা দিয়ে ভালোবাসি। আপনার কাছে অনুরোধ রইলো যতটুকু নিশ্চিত রূপে জানেন ততটুকুই বলবেন। আন্দাজ করে অথবা অনিশ্চিত শোনা কথা বলে আমায় বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবেন না দয়া করে। আবারও বলছি মানুষটাকে আমি অনেক অনেক ভালবাসি। তাই বুঝে শুনে কথা বলবেন। জাগ্রতকে নিয়ে বলা একটা কথাও যদি কোনভাবে মিথ্যে প্রমাণিত হয় তাহলে কিন্তু যেই কাজের অভিযোগে ওকে অভিযুক্ত করছেন সেই কাজটা আমিও করতে পারি। মানে খু ন। কাকে করবো বুঝতে পারছেন তো? অভিযোগকারীকে!”
~চলবে
আজকের পর্বে সবার মন্তব্য চাইছি। জানতে চাই কার কি মনে হচ্ছে। আশা করি সবাই গঠনমূলক মন্তব্য করবেন।