#নীরদের_বিষাদিনী -(৫)
জাবির রাফার প্রাক্তন নয়।তাদের বিচ্ছেদও হয়নি।তবুও এতোদিন পর মুখটা দেখে রাফার অন্তঃকরণে তীব্র ঘূর্ণিঝড় বয়ে চলেছে।যন্ত্রণা,শূন্যতা সব একত্রে নিয়ে সোফায় সটান হয়ে বসে আছে মেয়েটি।দূর থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেললো আবিদা।বড় মেয়ের দুঃখকে গি লে ছোট মেয়ের সুখের তোড়জোড় করতে হচ্ছে।প্রায় ছয় মাস পর রিনি নিজের বাড়ীতে এলো।দীর্ঘ সময়টিতে তার বাবা কামাল বিয়েটা মানতে নারাজ ছিলেন।তবে মেয়ের থেকে কতোদিন দূরে থাকবে আর?
রাফা একমনে রিনিকে দেখছে।চেহারাতে দারুণ উজ্জ্বলতা ফুটে উঠেছে।শান্ত মেয়েটি ছটফট করে করে মায়ের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে।অন্যদিকে রাফা?পানসে ফ্যাকাশে মুখ,রোগাটে দেহ,ভঙ্গুর কণ্ঠস্বর,এলেমেলো চুল।কেন তফাৎ আজ দু বোনের মধ্যে?
“রাফা, তোমার পড়াশোনার কী খবর?”
জাবির পরিবেশকে সহজ করার জন্য প্রশ্নটি শুধালো।অন্যদিকে রাফা এক দৃষ্টিতে তাকে দেখছে।
“এতো নাটকীয় কেন জাবির ভাই?খুব ভালো করে জানেন।কখনো আমাদের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্কের প্রশ্নগুলো আসবে না।”
“কেন নয়?তুমি আমার স্ত্রীর বড় বোন।সম্মানীয়।”
“বেশ।এইতো বসে আছি। কদমবুসি করবেন না?”
জাবির থতমত খেয়ে গেলো।মেয়েটিকে বিব্রত করতে গিয়ে নিজেই চরম অপমানিত হলো।কপাল সামান্য কুঁচকে বলল,
“অপমান করলে?তুমি বড় অহংকারী রাফা।তোমার সান্নিধ্যে থেকেও রিনিকে পছন্দ হলো কেন ওর সাথে সম্পর্ক কেন গড়ে তুললাম তা একবার ভেবেছো?রিনি সুন্দর তুমিও সুন্দরী।কিন্তু মায়া,স্নিগ্ধতা একদম নেই।এখন তো রোগাটে।ব্যক্তিত্বও কলসির তলানীতে চলে এসেছে।রিনিকে একবার উপলব্ধি করিও।চমৎকার একজন মানুষ।যতো দেখি মুগ্ধ হই।তোমার চেহারার মতোন ব্যবহার মলিন।”
জাবির সামনে রাখা কফির মগে ছোট্ট একটা চুমুক দিলো।রাফা শূন্য দৃষ্টিতে দেখছে তাকে।অধরোষ্ঠ ঈষৎ আন্দোলিত হচ্ছে।
“তোমার মধ্যে অনেক কিছু ছিলনা দেখে মাইন্ড ফ্রেশ করার মাধ্যমে ছাড়া তুমি কিছুই নও আমার নিকট।গত ছয়মাসে রিনি রোজ তার পরিবারের জন্য কাঁদতো।সেজন্য এখন তোমাকে শুধু ঘৃণা করি।তবুও ভেবেছিলাম সব ঠিক থাকুক।নূন্যতম সৌজন্যেতাবোধ..।”
রাফা শব্দ করে হাই তুললো।সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,
“আপনি ভীষণ অপদার্থ একজন মানুষ।নীরদ নামের সেই পদার্থটিকে আজ ভীষণ ধন্যবাদ দিতে মন চাচ্ছে।বহুকাল আগে বলেছিল ‘বিষাদিনী,আমি ভালো খারাপ মানুষ চিনতে পারি।জোড়া হবে বা টিকবে কীনা বলতে পারি।’ সেদিন ভেবেছিলাম আত্ন অ হ ং কা রী ব্যক্তি।তবে আজ উপলব্ধি হলো কথাটির গভীরতা।”
জাবির এখনও রাফার মুখ থেকে অপদার্থ কথাটি হজম করতে পারেনি।কিন্তু সেদিকে ততোটা মন দিতে পারলো না।মেয়েটির মুখ নিঃসৃত নীরদ নামটি তার অন্তরে সুঁ চ ফোঁটালো।বিরস মুখে কফিতে চুমুক দিলো।সবটা কেমন শীতল হয়ে যাচ্ছে।
———————————————
“এতো সেজে কোথায় যাচ্ছো নীরদ?ভেতরে এসো।”
“আম্মু যেদিন আমি বিশেষ ভাবে তৈরী হই সেদিনই কেন তোমার নজরে আসি।”
নীরদের করুণ সুরে জবা হেসে ফেললো।ছেলেটা এখনও তার বাচ্চা রয়ে গেছে যেন।মা ডাকতেই ছুটে এসে কোলে মাথা দিয়ে বসে পড়লো।জবা ছেলের গোছালো চুলগুলোকে এলেমেলো করে দিয়ে শুধালো,
“কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি?আপনাকে রোজ সব অবস্থায় খেয়াল করি আমি।বলিনা শুধু।বিশেষ দিন ছাড়া।”
“আবিদা আন্টি ডেকেছে।”
“বাব্বাহ,তাহলে রাগ মাটি হলো এবার।”
“কোনকালে রাগ ছিলনা আমার।সংকোচ হতো বরং।তুমি আজ হসপিটালে যাওনি কেন?”
“কয়দিন পর তো একেবারে হসপিটাল ছেড়ে দিচ্ছি।তাই আগে থেকে অভ্যেস করে নিলাম।তোমার বাবাও ভাবছে।”
“হুঁ?মটেও তোমরা হসপিটাল ছাড়বেনা।”
“এতোটা কনফিডেন্স ছেলে?”
“নিজের মা,বাবাকে চিনি আমি।”
নীরদে মায়ের কোলে মাথা ঠেকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।শূন্যে আঁকিবুঁকি করে বলল,
“তরীকে কেমন দেখলে?ভাইয়ের সাথে এখনও রেগে আছে সে?”
“সে তোমাকে বিশেষ বার্তা পাঠিয়েছে।খুব ভালো আছে ও।”
মুহুর্তেই নীরদের মুখখানা শুভ্র হয়ে উঠলো।মায়ের হাত দুটো চেপে বলল,
“তাহলে ভুল ছিলনা আমার চিন্তা।তরীর বিয়ে ঠিক হওয়ার পর রোহান যখন বলল তারা একে অপরকে পছন্দ করে।আমি মটেও মেনে নেয়নি।তোমরা সকলে তাদের সম্পর্কে মত দিলেও।একমাত্র আমার জন্য বিয়ে অবধি গড়ায়নি।সকলের চক্ষশূল হলাম।রোহান,রাফা ঘৃণা করলো।তরী ভাই বলে দূরে ঠেলতে পারলো না।অথচ কেউ কী দেখেনি রোহান,তরীর স্বপ্ন আলাদা।দুজনের চিন্তা ধারাও আলাদা।ভালোলাগা ক্ষণস্থায়ী।তবে স্বপ্ন ছিল তাদের ভালোবাসা।এই দুজন কীভাবে এক ভালোলাগায় পুরো জীবন কাঁটিয়ে দিতো?তরীর অনুভূতি কাঁটতে ছয় মাসও লাগেনি।আমি কী ভুল ছিলাম মা বলো তো?তাহলে এতো ঘৃণা কেন পেলাম?”
জবা ছেলের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলো।সুপুরুষ বলে আখ্যায়িত তার এই সন্তানটিকে সে চোখে হারায়।জীবনের অনেকটা সময় ক্যারিয়ারকে দিয়ে এখন বড় আফসোস হয়।তবুও সবটা তো শেষ হয়নি।
“সকলে ভুল বুঝলেও একদিন বুঝবে।কিন্তু তুমিও তাদের একবারও নিজের চিন্তাধারা বলো নি।”
“ইচ্ছা হয়নি মা।সময়ের উপর সবটা দিয়ে রেখেছিলাম।তরী,আবিদা আন্টি বুঝেছে।রোহানও একদিন বুঝবে।সঠিক মানুষ ছাড়া জোড়া হয়?মা বলো তো।”
“না হয়না।একদম হয়না।তবে রাফা বুঝবে বলে মনে হয়?”
নীরদ স্লান হাসলো।মেয়েটা কখনো বুঝবে কীনা সে নিজেও তো জানেনা।উত্তর কী দিবে?
(——————————————–)
নীল রঙা শাড়ী পরনে রাফা আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো।প্রচুর কান্না করার দরুণ চোখ দুটে র ক্তি ম হয়ে আছে।মেদুর গালে মেঘ জমেছে।কান্না আড়াল করার জন্য চোখে কাজল টেনে নিলো।বাহির হতে কোলাহল শোনা যাচ্ছে।নব দম্পতি জাবির,রিনি এসেছে বিধায় বাড়ীতে ছোট করে গেট টুগেদারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।একটুও সেখানে যাওয়ার জন্য মন টানছেনা।আয়নায় নিজেকে দেখে আরো বেশী হতাশ হলো।আসলেও সে বড় রোগাটে।কলিং বেলের শব্দে ধ্যান ভাঙলো তার।সিক্ত চুলগুলোতে আঙুল চালিয়ে পানি ঝড়িয়ে নিলো।সকলে রান্নাঘরে ব্যস্ত থাকায় সে নিজেই যাচ্ছে দরজা খুলে দিতে।
নীরদ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নীলোৎপলকে দেখে উষ্ণ শ্বাস ছাড়লো।ভেতরে জমে থাকা যন্ত্রণা আবার বেড়ে গেলো।শুকনো ঢোক গিলে রাফার পিছনের পরিবেশকে দেখে নিলো।না কেউ নেই।সাহস করে বলে ফেললো,
“এই রুপ, এই সৌন্দর্যের ঐশ্বর্য।রাফা তুমি এতো সুন্দর কেন?দেখো আমার জ্বর এসে গেলো।”
অন্য সময় হলে রাফা নীরদের এই কথায় বিদ্রুপ করতো।হেসে খেলে উড়িয়ে দিতো।কিন্তু আজ কিছু একটা ছিল সমীরণে।নাক টেনে পুরুষটির সুগন্ধ নিলো।মস্তিস্কের নিউরনগুলোকে দূর্বল করে দিলো।দরজা ছেড়ে বাহিরে এসে দেয়ালে পিঠ ঠেকালো।নীরদ পিছিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে নিচ্ছে।রাফার চোখ দুটো এতো য ন্ত্র ণা কেন দিচ্ছে?নীরদ কী বলবে যে বিষাদিনী চলো সব ভুলে যাই।শুধু মনে রাখি আমি,তুমিকে।নীরবতার চাদরকে মুক্ত করে দিয়ে রাফা শুধালো,
“চারিদিকে এতো বিষাদ কেন ডাক্তার?আমি,আপনি কেন এমন?”
“কেমন রাফা?”
নীরদের কণ্ঠে আকুলতা।একটু করুণা পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে যাচ্ছে সে।ফিসফিস করে রাফা জবাব দিলো,
“বড্ড নির্বোধ।”
চলবে।