#অতৃপ্তির_মাঝে_তৃপ্তিময়_সে
#লেখিকা- সালসাবিল সারা
পর্ব-৩১
__________________
৬৮.
–“আমি আমার মেয়েকে নিয়ে যেতে চাই।এটা রীতিমত ধোঁকাবাজি।আমাকে রিয়ানা বলেছিল এক কথা,কিন্তু এইযে বেলা গড়াতেই আপনাদের সত্যতা বেরিয়ে আসলো।বাড়িতে অজ্ঞাতনামা চিঠি না এলে আমি আজ এতকিছু জানতামই না।আমার মেয়েকে আমি ফেরত চাই।”
অরিত্রনের কণ্ঠ উদ্ধিগ্ন সাথে তেজী।লোকটা মিথ্যা কাহিনীকে সত্য মনে করে বেজায় আঘাত পেয়েছে। অত্র অজ্ঞাতনামা চিঠিতে স্পষ্ট লিখা ছিলো গতরাতের সকল ঘটনা।সিসিটিভি ফুটেজ হতে সংগৃহীত কিছু ছবিও দেওয়া হয়েছিল।যেখানে তৃপ্তির উপস্থিতি,
আদ্রিনের তাকে উদ্ধার করার বেশ কতক দৃশ্য ফুটে উঠেছে।অরিত্রনের আঁখি যেনো অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। দুই চোখে তার মেয়েকে দেখার তৃষ্ণা।
এমন চেচামেচি পছন্দ নয় ইনায়ার।তবে,আজ উনি বেশ শান্ত সুরেই বললেন,
–“এটা একটা অ্যাকসিডেন্ট ছিলো।মূলত আপনার মেয়ে আর আমার ছেলের আজকের এই দিনটাকে অশুভ করতেই পরিকল্পনা ছিলো অজানা বা জানা কারো।”
অরিত্রন তাও চুপ হচ্ছে না।তার মাথায় কেবল একটাই ভাবনা,মেয়েটা রাত থেকে কি কি সহ্য করেছে! মেয়েটার যদি কিছু হতো?উত্তেজিত অরিত্রনের মাথায় এটাই আসছে না,চিঠি পাঠানো লোকটাকে একবার খোঁজা উচিত।রহস্যের জাল তো ভাঙবে!কিন্তু নাহ,
লোকটা একাধারে মেয়ে মেয়ে বলে হাঁক ছাড়ছে।ইনায়া এইবার রেগে যায়।বেশ গমগমে সুরে বলে উঠে,
–“আপনাকে চিঠি যে পাঠিয়েছে তাকে বের করুন।সব ঘটনা আপনাআপনি বেরিয়ে যাবে।”
অরিত্রন খেঁকিয়ে উঠে দ্বিগুণ উত্তেজনায়,
–“প্রথমেই নিয়েছি খোঁজ।এক বাচ্চা দিলো চিঠি।আর সেই বাচ্চা কই গায়েব হলো জানিনা।আমার কাছে আর্থিক সাহায্যের জন্যে এমন চিঠি অহরহ আসে।আজকের দিনে এমন ভয়াবহ চিঠি পাবো বলে আমি আশা করেছিলাম কি?”
–“উফ,অরিত্রন ভাই! আপনি শান্ত হোন।অর্ক,তোমার কাকাকে বলো শান্ত হতে।”
ইনায়াও আজ কেমন ধৈর্য্যশীল হচ্ছে।তৃপ্তি এখন তার ছেলের বউ বলে?মেয়েটাকে অরিত্রন নিয়ে যাবে বলে ইনায়া বেশ আতংকে।তার ছেলে যদি একবার জানে এইসব,চুপ থাকবে না আদ্রিন।ছেলেটা কি করে এই নিয়েই দুনিয়ার কল্পনা জল্পনা ইনায়ার।তার উপর আদ্রিন বাসায় নেই।কিছু কাজে বাহিরে।ফিরবে হয়তো আর ঘন্টা খানেকের মধ্যে।
–“কাকা আপনি এমন করছেন কেনো?ওদের অনুষ্ঠান আজ।আর এই অনুষ্ঠানের পর আপনি এই ব্যাপারটা ভেবে দেখবেন।কে বা কারা দুই পরিবারের মধ্যে গরমিল করতে চাচ্ছে,ব্যাপারটা সত্যি ভাবুন একবার।”
অর্কের কথায় দমলো না অরিত্রন,
–“তৃপ্তিকে আসতে বল।ওকে নিয়ে আমি বাড়ি যায়।মেয়েকে আজ বিদায় দিবো।আমার চোখের সামনেই থাকুক আমার মেয়ে।”
ইনায়াও কপট রাগ দেখিয়ে একটা একটা বলছে। অরিত্রনও থেমে নেই।
রিয়ানা চুপচাপ দাঁড়িয়ে।মনে মনে ভাইকে খুঁজছে।কিসব গ্যাঞ্জাম লাগলো হঠাৎ!বাসা ভর্তি মেহমান।উনার কি বা ভাবছেন!আয়ত্বে নেই কারো।সেই দুজন নিজেদের দুনিয়ায় কথা কাটাকাটিতে ব্যস্ত।রিয়ানা হাল ছাড়ে।খাবারের উসিলায় সকল মেহমানকে ডাইনিংয়ে যেতে অনুরোধ করে।ডাইনিংয়ে বিশাল আয়োজন করা হয়েছে দুপুরের খাবারের।মেহমানরা সব নিকট আত্মীয়।তাই তারাও আর মাথা ঘামায়নি এই ঘরের ব্যক্তিগত বাপরে। রিয়ানা সেদিক সামলে তৃপ্তির নিকট যেতে চায়।অমনি বায়না ধরে সাফা।তার জন্যে প্লেটে ভাত নিয়ে দ্রুত নিজ কাজ সারতে উদ্যত হয় রিয়ানা।
তৃপ্তিকে সে অনেক আগেই ঘুম থেকে জাগাতো।কিন্তু তার ভাই মানা করেছে।যাওয়ার আগে বলেছিল,তৃপ্তি নিজ থেকে উঠলে তবেই যেনো ওকে খেতে ডাকা হয়।রাতভর দুর্বলতায় নেতিয়ে ছিলো সে আদ্রিনের বক্ষঃস্থলে।
তৃপ্তির ঘুম ভেঙেছে বেশ সময় হলো। এখন অব্দি রুমে আসেনি কেউ।কেমন যেনো ঠান্ডা পরিবেশ।অথচ,এই সময়ে তৃপ্তির বাসায় নিশ্চয় সবাই কাজে হুরুস্তুল কান্ড বাঁধিয়েছে! মলিন হাসে তৃপ্তি।রাতভর আদ্রিনের সন্নিকটে থেকে তার মনে হচ্ছে আদ্রিনের গায়ের সুভাস তার তনুয় ছাপিয়েছে। আড়মোড়া ভাঙে সে।ধীর পায়ে নামে বিছানা হতে।পায়ের ব্যথা কমেছে।কোমরেও তেমন পীড়া নেই। তবে,অনুভব হচ্ছে কিঞ্চিৎ ব্যথার আক্রোশ।
হাত মুখ ধুয়েও বেশ সময় রুমেই ছিলো তৃপ্তি। এখন ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে তার।শাড়ি ঠিক করে সে কামরা হতে বেরোয়।এলোমেলো পদক্ষেপে সে সম্মুখে আগাতে থাকে।কিছুদূর যেতেই বাবার গলার সর শুনে বিচলিত হয় তৃপ্তি।পদচারণ দ্রুত করলে গোড়ালিতে চাপ অনুভব করে সে।মুখের রং বদলাতে আরম্ভ করে ব্যথায়।তাও সে হেঁটে চলেছে দ্রুত।নিচে কোনো গন্ডগোল হয়নি তো!
তৃপ্তি নিচে নামতেই ইনায়া চিন্তিত সুরে প্রশ্ন করে,
–“একি,নিচে নামলে কেনো!”
–“নাহ মানে আন্টি…”
তৃপ্তির কথার মাঝে অরিত্রন চেঁচিয়ে উঠে,
–“মিথ্যা বলতে শিখেছিস?সারারাত বিপদে ছিলি, জানাসনি কিছু।কি হয়েছিল গতকাল?”
–“বাবা,আমি..”
–“কি বাবা?বাবা আমি কি? কাল যদি কিছু হতো তোর?আদ্রিন কোথায়?ওর সাথে আমার বোঝাপড়া আছে।”
অরিত্রনের কথার পিছে তৃপ্তি বলে,
–“সরি বাবা।তুমি এমন উত্তেজিত হবে না।তোমার শরীর ভালো নেই। চোট এখনো কাঁচা তোমার।”
বাবার মাত্রারিক্ত রাগী কণ্ঠে তৃপ্তি বিচলিত হয়।আঁখি ছলছল মেয়েটার।
এর মাঝেই আগমন ঘটে আদ্রিনের।তার হাতে মোবাইলের প্যাকেট।অরিত্রন,অর্ক,ইনায়া,তৃপ্তি,দাদী এবং পরিবারের সকলকে একসাথে দেখে ভ্রু কুঁচকে যায় আদ্রিনের।তৃপ্তির মুখটাও কেমন ভীত।কাহিনী জানতে সে অরিত্রনকে প্রশ্ন করে,
–“সব ঠিকঠাক আঙ্কেল?”
–“কি ঠিকঠাক হবে?মেয়েকে নিয়ে যেতে এসেছি।যেতে দাও।”
অরিত্রনের তেজী কণ্ঠে ধীরে ধীরে মেজাজ জ্বলজ্বল করতে আরম্ভ করে আদ্রিনের।রাশভারী কণ্ঠে সে শুধায়,
–“কেনো?তৃপ্তি এইখানে থাকলে সমস্যা কি?অনুষ্ঠান রাতে এইখানেই হচ্ছে।তাহলে?”
–“মেয়ে আমার সারারাত বিপদে ছিলো।আমি জানিনি কিছুই।যদি কিছু হতো আমার মেয়ের?”
–“আমি থাকতে আপনার মেয়ে নিরাপদ।”
আদ্রিন কথাটা বলতে বলতে সম্মুখে দাঁড়ায় তৃপ্তির।অর্ধেক তনু ঢেকে যায় মেয়েটার,আদ্রিনের অবয়বের কারণে।
–“মুখে বললে হয় না। কাল রাতের ভয়াবহ দৃশ্যের ছবি আমি দেখেছি।আমার কাছে চিঠি এসেছিল।”
অরিত্রনের কথার বিপরীত মুখ খুলে আদ্রিন,
–“আঙ্কেল আপনি ভাবতে পারছেন না আমাদের দুই ফ্যামিলির ভেতর দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে কেউ একজন বা কয়েকজন মরিয়া হচ্ছে। গত রাতে আমার রূপে আপনার মেয়েকে কেউ মেসেজ দিয়ে ঘর থেকে বাহিরে নিয়ে সেই টর্চার সেলের প্রশাসনিক ভবনে পাঠিয়েছিল।সন্ত্রাসী হামলাও হয় সেখানে।যদিও আমি আপনার মেয়েকে রক্ষা করেছি,আল্লাহ্ এর রহমত বলতে পারেন। কিন্তু,আজ সকালে আমি সিসিটিভি ফুটেজের সন্ধান করতে গিয়েও পায়নি।সিসিটিভি ক্যামেরা ভাঙ্গা,সাথে সকল মনিটরে শুট করা।আবার আপনি বলছেন সিসিটিভি ফুটেজের ছবি পেয়েছেন!”
অরিত্রন মাথায় হাত রেখে ভাবুক কণ্ঠে শুধায়,
–“এর মানে?”
–“এর মানে হলো,ঘটনার মাঝে অন্যতম প্ল্যান ছিলো আপনার জন্যে সেই মুহূর্তের কিছু ক্লিপ তুলে রেখে সিসিটিভি ফুটেজের মনিটর ড্যামেজ করা। করেছেও।এইবার বুঝছেন! কেউ তো আছে যে আমাদের শান্তিতে থাকাটা পছন্দ করছে না।”
কথার ছলে নিজের হাতে থাকা মোবাইলের প্যাকেট তৃপ্তিকে ধরিয়ে দেয় আদ্রিন।সাফা এবং রিয়ানাও এসে দাঁড়িয়েছে মজলিশে।অরিত্রন ভোঁতা মুখে আদ্রিনকে বলে,
–“ওকে দিয়ে দাও।আমার চোখের সামনে থাকলে আমি শান্তিতে থাকবো।তৃপ্তি চল।”
–“আঙ্কেল ও তো নাস্তা করেনি।আপনারাও বসুন।একসাথে সবাই মিলে খাওয়ার পর্ব সারলে আন্তরিকতা বাড়বে।”
রিয়ানা হেসে বলে উঠে।
–“নাহ মা। বাড়িতে কাজ আছে।মেয়েটাকে এইখানে রেখে যাওয়ার ইচ্ছা নেই।চল,তৃপ্তি।”
অরিত্রনের কথা শুনে তৃপ্তি আদ্রিনের পানে তাকায়।লোকটার মুখভঙ্গি চেনা দায়।কি ভাবছে কিজানি!ফট করে যদি বিয়ের কথাটা উগলে দেয়?
–“কয়েক ঘন্টা পরে এইভাবেই তো সবাই আসবেন আমাদের বাড়িতে।শুধু শুধু ঝামেলা করে লাভ নেই।তৃপ্তি রুমে যাও রিয়ানা আপুর সাথে।মোবাইলটা তোমার।নতুন সিম অ্যাডজাস্ট করো।নাস্তা পাঠানো হবে।”
আদ্রিনের কণ্ঠের পরিবর্তন আন্দাজ করছে ইনায়া।ছেলেটা যদি এখন রেগে যায়,দেখা যাবে তৃপ্তিকে নিয়ে সে গতকালের মতো জিদ করবে।ছেলের কথা ভেবে মাথা নাড়ে ইনায়া।তার ছেলেটা এমন গম্ভীর আর রগচটা কেনো?
–“বাবা আর বাড়াবাড়ি করো না।আমার কষ্টটা বুঝো একটু।”
অরিত্রন অনুরোধ করে।মায়া হয় তৃপ্তির।আদ্রিনকে সে বলতেই নিচ্ছিলো, সে বাবার সাথে বাসায় যাবে।কিন্তু বলা হলো না। আদ্রিনের গমগমে সুরে ছেলেটার পিঠের শার্ট মুচড়ে ধরলো।
–“আঙ্কেল আপনার মেয়ে ব্যথা পেয়েছে গতকাল পায়ে।এখন জার্নি করে যাবে আবারও আসবে।আপনি ভাবতে পারছেন ওর অবস্থাটা কি হবে? এইভাবেও আপনার মেয়ের প্রেসার লো থাকে।আমি এই নিয়ে তর্ক করতে চাই না।”
আদ্রিন থামে।পরপর নিজের চুল আঙ্গুলের সাহায্যে উপরে ঠেলে।তৃপ্তি এখনো শার্ট চেপে তার।
–“কাকা,চলো আমরা যায়।আদ্রিনের কথাটা ঠিক।”
অর্কের কথায় সায় দেয় এইবার অরিত্রন। ব্যথাদায়ক হৃদয়ে সে বাক্য বিনিময় করে,
–“মেয়েটাকে রেখে যাচ্ছি।একটু খেয়াল রেখো আদ্রিন।”
তৃপ্তির হঠাৎই মন খারাপ হয়।মেয়েটার বাবার জন্যে মনটা কেমন ফুঁপিয়ে উঠলো।বাবা না জানুক সে তো জানে মেয়েটা বিবাহিত এখন।বাবার চলে যাওয়া মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে পীড়াদায়ক।বুকে ভার অনুভব করে তৃপ্তি।
–“খেয়ে যাবেন।এইভাবে যেতে দিবো না।”
ইনায়া হাসিমুখে বলে।
–“জ্বী আঙ্কেল।অর্ক বস।”
আদ্রিনও সহমত জানায় মায়ের কথায়।
অরিত্রন এগিয়ে আসে,মেয়েটার মাথায় হাত বুলায়।জড়িয়ে ধরে তৃপ্তি তার বাবাকে।অবাধ্য জল গড়িয়ে পড়ে গালে।
বাবাকে ছাড়তেই দ্রুত চোখের পানি মুছে। রক্তিম নাক,গাল,চোখ এড়িয়ে যায়নি আদ্রিনের দৃষ্টি হতে।
–“অনেক কাজ বাড়িতে।রাতে দেখা হবে।সাবধানে থাকিস মা।”
পুনরায় মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে চলে যায় অরিত্রন অর্ক সমেত।
তৃপ্তিকে রিয়ানা নিয়ে যায় আদ্রিনের কক্ষে।সেখানেই নাস্তা সাড়ে সে।
নিচের কিছু কাজ শেষ করে উপরে যেতে নিলে আদ্রিনকে পিছু ডাকে ইনায়া,
–“কোনো খবর পেয়েছো?কে বা কারা এইসব করেছে?”
–“সিসিটিভি ফুটেজ ড্যামেজ করা।তৃপ্তির মোবাইল খুঁজে পাওয়া যায়নি।সন্ত্রাসী দলের কেউ এসবের সাথে জড়িত নয়।তাদের হামলার কথা পূর্ব থেকে জেনে ঝামেলা করানো হয়েছে।তাদের সাথে আমাদের লিংক নেই।ওরা জাস্ট একটা গুটি ছিলো গতকালের ঘটনার জন্যে।”
আদ্রিন বুকে হাত গুঁজে জবাব দেয়।
–“আমি দেখি আমার পক্ষ থেকে কিভাবে হেল্প করা যায়। ঘুমিয়ে নাও কিছুক্ষণ।তোমাকে টায়ার্ড দেখাচ্ছে।”
ইনায়া উত্তর দেয়।তার ছেলেটা হয়তো ধীরে ধীরে সহজ হচ্ছে তার সাথে।তৃপ্তিকে সে পেয়েছে বলে!আপত্তি নেই এখন আর ইনায়ার।ছেলেকে সে আবারও ছোটবেলার মতো নিজের করে পেতে চায়।
–“ওকে। পরে দেখা হবে, আম্মি।”
আদ্রিন উপরে উঠে যায়।ইনায়ার দৃষ্টি জ্বলজ্বল।তৃপ্তির আগমনে ছেলেটা মায়ের সাথে সহজ হবে জানলে সে বহুত পূর্বেই মেয়েটাকে ছেলের বউ করতো।অযথা ঝামেলা করার খেয়াল আসতোই না তার মন ও মস্তিষ্কে।
৬৯.
আদ্রিন রুমের কাছাকাছি যেতেই দেখে রিয়ানা কক্ষ হতে বেরুচ্ছে।সাফা কাদঁছে হাত পা ছড়িয়ে।রিয়ানা বেগ পাচ্ছে তাকে সামলাতে।আদ্রিন এগিয়ে হাত মেলে দেয় সাফার সম্মুখে,
–“কাদঁছো কেনো?”
–“মা পঁচা।আমাকে মামীর সাথে থাকতে দিচ্ছে না।”
সাফা কেঁদে বললো।
–“দেখ,তুই যাবি এখন রুমে।আর মেয়েটা তৃপ্তিকে ছাড়া আসতে চাইছে না।”
–“আমি যাবো তো কি হবে?দিন দুপুরে আমার অসুস্থ বউটাকে আমি কিছু করবো?তোমার মাইন্ড এতো ন্যারো”!
আদ্রিন সাফাকে কোলে নেয়।ভেতরে যেতে যেতে সে শুনতে পায় তার বোন চিল্লিয়ে জবাব দিলো,
–“কি ঠোঁট কাটা তুই!বড় বোনের সামনে কি বলবি মাথায় নেই?”
–“বাজে কিছু বলেছি? তোমার মাইন্ড বাজে।আমার না।”
আদ্রিন বাঁকা হাসে।বোনকে জব্দ করার মজায় যেনো আলাদা।তার আর বোনের এমন হাজারো খুনসুটি মাখা স্মৃতি আছে।
রুমে প্রবেশ করতেই আদ্রিন দেখে তৃপ্তি দরজার দিকেই আসছিল।
–“কই যাও?”
আদ্রিনের প্রশ্নে পা থামে তৃপ্তির।সাফার গালে হাত বুলিয়ে বলে,
–“সাফার কাছেই যাচ্ছিলাম।আপু ওকে কেনো নিয়ে যাচ্ছিলো?”
সাফাকে কাঁধে চেপে আদ্রিন ঝুঁকে।তার মেহেবুবার কানে ফিসফিসিয়ে বলে,
–“আপু ভেবেছে,আমি রুমে আসলেই আমাদের মাঝে কিছু হবে।কিন্তু,আপু জানেনা।আদ্রিন ধৈর্য্যশীল।অসুস্থ বউকে কিভাবে সে গভীর ভালোবাসায় মুড়িয়ে নিবে!”
তৃপ্তি অবাক হয়ে তাকায়। মিছে রাগ করে চড় দেয় তার বাহুতে,
–“ছি,বোনের সাথে কেউ এইসব বলে?নির্লজ্জ।”
–“তোমরা মেয়েরা এমন কেনো?কিছু হলেই, ছি ছি করো।অদ্ভুত!”
আদ্রিনের কথায় ঠাট্টার সুর।
–“মামী কোলে নাও।”
সাফার কথায় আদ্রিন তাকে বিছানায় বসায়। তৃপ্তিকেও বসার নির্দেশ দেয় ইশারায়।
–“মামী এখন কোলে নিতে পারবে না।এখন সাফা ঘুমাবে।আর মামী তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে।”
বাচ্চাদের সাথে আদ্রিনের এমন আদুরে ভঙ্গিতে কথা বলা স্নেহের নজরে দেখেছে তৃপ্তি।অজানা শিহরণ জাগে শরীরে।লোকটাকে তার দেখে যেতেই ইচ্ছে করছে।মুচকি হাসি দারুণ মানায় তার প্রিয়মতের মুখশ্রীতে।
সাফা শুয়ে পড়তেই তৃপ্তি নজর সরায়।আলতো হাতে চুল ছুঁয়ে দিতেই মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়লো।তৃপ্তি অনুভব করে,ঘুমের কারণেই মেয়েটা এমন বায়না করছিলো।
সোফা হতে আদ্রিন উঠে আসে।এতক্ষণ যাবত তার দৃষ্টি সাফা এবং তৃপ্তির কারসাজিতে সীমাবদ্ধ ছিলো।
আদ্রিন শার্ট খুলতেই তৃপ্তির সেই অস্থিরতা আবারও জেঁকে ধরে।উদোম শরীরের লোকটার দিকে তাকানো যায় না।চোখ জ্বলে তৃপ্তির।বেহায়া হয়ে যায় নজর।কয়েক পলক ফেলতেই আদ্রিন তার সামনে এসে হাজির।
অস্থিরতায় মগ্ন তৃপ্তি ফিচেল কণ্ঠে বলে,
–“শার্ট খুললেন কেনো?”
–“রুমে আমি এমন থাকি।অশান্তি লাগে।”
কথাটা বলতে বলতেই আদ্রিন ফার্স্ট এইড বক্স হাতে বিছানায় বসে।তৃপ্তির শাড়ি গোড়ালির উপর কিঞ্চিৎ সরিয়ে সেথায় স্প্রে করে।পায়ের ফোলা কমেছে হালকা।তৃপ্তির সাথে নজর মিলতেই সে শুধায়,
–“কোমর দেখি!ব্যথা কমেছে?”
–“দেখা লাগবে না।কমেছে।”
ইতস্তত হয় তৃপ্তি।একে আদ্রিন তাকে আকৃষ্ট করছে,তার উপর আদ্রিনের এমন যত্নাদি।মেয়েটার ভেতরটা যেনো মরুভূমির ন্যায় হাহাকারে ভরপুর।
এক ভ্রু উঁচু করে আদ্রিন।তৃপ্তির বাম বাহু ধরে তাকে হালকা বাঁকা করে।কোমরের ক্ষত পর্যবেক্ষণ করে সেথায় অয়েনমেন্ট লাগানো অবস্থায় বলে উঠে,
–“সব ব্যাপারে মানা শুনবো।শুধু তোমার অসুস্থতা বা তোমার কাছে আসার ব্যাপারে কোনো মানা আমি শুনবো না।এই ক্ষেত্রে আমার কানে তালা ঝুলালাম।”
তৃপ্তি হাসে।নিজ মুখ হাত রাখে,
–“আপনার সাথে কথায় পেরে ওঠা অসম্ভব।”
–“তোমার জামাই বলে কথা!”
আদ্রিনের দুষ্টুমি ভরা আদরে দিশেহারা হয় তৃপ্তি।নখ দেবে যায় ছেলেটার ঘাড়ে।কিয়ৎপল বাদে আদ্রিন থামে। বালিশ রাখে তৃপ্তির কোলে,
–“লজ্জা না পেয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দাও।ঘুম আসছে।রাতভর তোমাকে দেখতে গিয়ে আর ঘুমাইনি।”
উবু হয়ে শুয়ে পড়ে সে তৃপ্তির কোলে রাখা বালিশেই।লজ্জায় আবৃত তৃপ্তি কোনো কথা বলেনি।কেবল নুয়ে যাওয়া ভঙ্গিতে আদ্রিনের চুলের গভীরতায় আঙ্গুল চালাচ্ছে।ধীরে ধীরে সে অনুভব করে,আদ্রিনের দুইহাতের দখলে চলে যাচ্ছে তার কোমর।ছেলেটা দৃঢ়ভাবে আলিঙ্গন করে প্রিয়তমাকে।তলিয়ে যাচ্ছে সে গভীর তন্দ্রায়,প্রেয়সীর আদুরে স্পর্শে।
.
রাতের অনুষ্ঠানের জন্যে সকলে প্রস্তুত।তৃপ্তিকে পড়ানো হয় লম্বা লাল রঙের গাউন।আদ্রিনের পছন্দ।উচুঁ খোঁপায় গাঁথা আছে গোলাপের সমারোহ, তার উপর ভারী দুপাট্টা।মাথার একপাশে ঝাপটা,মাঝ বরাবর সুন্দর টিকলি।কানের দুল অতটা ভারী নয়।তবে নাকের নোলক বেশ জমকালো। কড়া লিপস্টিক আর বৌসাজে মেয়েটাকে দেখতে অপরূপ লাগছে।চেহারার কাটের সাথে তার এই সাজটাই যেনো মানানসই। হাতে গোল্ডের চুড়ির পাশাপাশি কৃত্রিম ফুলের চুড়িও আছে।সকল আত্মীয় স্বজন আদ্রিনের রুমে এসেই সাক্ষাৎ করছে তৃপ্তির সাথে।আদ্রিনের কড়া নিষেধাজ্ঞা তৃপ্তি যেনো মিডিয়ার সামনে না যায়।ইনায়াও ছেলের এই ব্যাপারে সহমত জানায়।ইদানিং তার ছেলেকে টার্গেট করছে তার প্রতিপক্ষ।আর তার ছেলের দূর্বলতা কেবল এই মেয়েটাই।
তৃপ্তির সাথে নিজের পার্সোনাল ফটোগ্রাফারের মাধ্যমে পার্টির নেত্রীর সাথে ছবি তুললো ইনায়া আদ্রিনের রুমেই।রুমের ভেতর ফুলে সাজানো না হলেও,লাইটিং এর দরুণ এবং দামী আসবাবপত্রের কারণে রাজকীয় লাগছে রুমের ভেতরটা।
খানিক বাদে আদ্রিন আসে।দুই পরিবারের সবাই উপস্থিত হয়।এছাড়া বাহিরের সকল মানুষ গার্ডেনে অবস্থানরত।খেতে ব্যস্ত তারা।
অতঃপর পুনরায় ইসলামিক এবিং সিগনেচারের মাধ্যমে বিয়ে সম্পন্ন হয় আদ্রিন তৃপ্তির।মেয়েটার বাসায় দেখানোর জন্যে আবারও কাজী দ্বারা বিয়ে করতে হলো তাদের।মেয়েটার পরিবার যে কিছুই জানতো না।
হঠাৎ, রিয়ানা আসে একটা আয়না নিয়ে।রাখা হয় দুইজনের সামনে।দুজনকে দুজনে যখন আয়নায় দেখে,আলাদা এক অনুভূতির জাগরণ হয় প্রেমিক যুগলের অন্তঃস্থলে।
এক পর্যায়ে রিয়ানা জিজ্ঞেস করে,
–“আদ্রিন কাকে দেখতে পাচ্ছিস আয়নায়?”
–“আমার জান,আমার মেহেবুবাকে।”
মুহূর্তেই হাসির শব্দে মুখরিত হয় কক্ষ।পরপর আলেয়া তৃপ্তিকে জিজ্ঞেস করে,
–“তুই কাকে দেখছিস আয়নায়?”
তৃপ্তি চুপ করে রয় কিছু সময়।লজ্জামাখা সুরে বলে,
–“আমার আদ্রিন পাগলকে।”
আবারো হাসির সুর ভেসে যায় কক্ষে।খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষে একে একে সবাই বিদায় নেয়।স্বাভাবিকভাবে তৃপ্তির বিদায়বেলা না হলেও বাবা চলে যাওয়ার সময় প্রচুর কাদঁলো মেয়েটা। প্রিয়,রূপম দুইজনকে জড়িয়ে ধরে মনের সকল কষ্ট ত্যাগ করেছে।আজ থেকে চেয়েও সে এই দুইজনের সাথে মাসের পর মাস,বছরের পর বছর থাকতে পারবে না একসাথে।
রাত তিনটা।সবাই মাত্রই কাজ থেকে নিস্তার পেয়েছে।আদ্রিন নিচে ছিলো মায়ের সাথে জরুরি আলাপে।শেষবার তৃপ্তিকে যখন দেখতে যায় সে তখন মেয়েটা তার ভাই আর বোনের সাথে ভিডিও কলে কথা বলছিল।তাই,সেই ফাঁকে মায়ের সাথে গতরাতের ঘটনা তদন্তের ব্যাপারে কথা বলে।ইনায়া সর্বোচ্চ সাহায্যের আশ্বাস দেয় ছেলেকে।
রুমে ফিরতেই অবাক হয় আদ্রিন।তার বউ সাধারণ রূপে।চাদর মুড়িয়ে ঘুমিয়ে।তবে,চাদরের এক কোণ দিয়ে গা ঢেকেছে।বাকি চাদর মেঝেতে।আদ্রিন হাসে।ভারী মেকাপের পিছে এই সাধারণ চীন দেশীয় নারীর চেহারার গঠনের এই মুখশ্রী আদ্রিনের সর্বপ্রিয়।নিজ শেরওয়ানি খুলে সে ক্লথিং হ্যাঙারে রাখে।ফ্রেশ হয়ে এসে তৃপ্তির গায়ের চাদর ঠিক করতেই চোখ আটকে যায় মেয়েটার সত্তায়।তৃপ্তি পড়ে আছে আদ্রিনের টিশার্ট।তার চেয়েও বেশ ঢোলা।পাতলা টিশার্টে নিষিদ্ধ স্থানেও দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় আদ্রিনের।শুভ্র বক্ষদেশের বেশ খানিকটা দৃশ্যমান।আদ্রিন পলক ফেলে।দ্রুত গতিতে দৌড়ানো হৃদদেশে হাত বুলায়।ঠিকভাবে চাদর দিয়ে মুড়িয়ে দেয় প্রিয়তমাকে।দ্রুত নিজেও সেই চাদরের অভ্যন্তরে জায়গা করে নেয় নিজের।তৃপ্তির পিঠের নিচে হাত রেখে নিজের দিকে ফেরায় সে মেয়েটাকে।ফলস্বরূপ আবারও মেয়েটার অবয়বে আদ্রিনের দৃষ্টি,মন, সত্তা আবেশে মুড়ে যাচ্ছে।শক্ত করে নিজ বক্ষস্থলে চেপে ধরে সে তৃপ্তিকে।অধর ছোঁয়ায় তার কপালে।বিড়বিড় করে বলে,
–“তুমি মেয়েটা বড্ড পাষাণ।নিজ নেশায় বুদ করে মাতাল হতে দিলে না।”
চলবে…..