#অতৃপ্তির_মাঝে_তৃপ্তিময়_সে
#লেখিকা- সালসাবিল সারা
পর্ব-৩৪
__________________
৭৪.
–“এতটুক বুঝলাম,কালপ্রিট বারবার তৃপ্তি ম্যাডামকে টার্গেট করছে।আর আপনার মনোবল ভাঙার জন্যেই অফিসের এমন ক্ষতি।কিন্তু, মূল উদ্দেশ্য তৃপ্তি ম্যাডামকে আঘাত করে আপনাকে কষ্ট দেওয়া।”
তন্ময়ের কণ্ঠে চিন্তা সুস্পষ্ট।
ঘটনার এতদিন পরেও সবকিছু ধোঁয়াশা।কাউকেই সুনিশ্চিতভাবে ধরতে পারছে না।আদ্রিন গম্ভীর,
বিচলিত।কাশেম মারা না গেলে আজ এতো দুর্ভোগ পোহাতে হতো না।যেই দুজন প্রধান আসামি ছিলো তারাই দুনিয়ায় নেই।আদ্রিনের চোখে তৃপ্তির হাসিময় মুখ।মেয়েটা তার প্রাণভোমরা এটা কাছের লোকেরাই জানে।কিন্তু,কোন কাছের লোক এমন উঠে পড়ে লেগেছে তাদের পিছে এটাই অজানা।একবার জানলে আদ্রিন কি তাকে ছেড়ে দিবে?কস্মিনকালে না।কঠোর শাস্তির ব্যাবস্থা আদ্রিন নিজ হাতে করবে।
–“তন্ময়,আমাদের সবদিকে নজর রাখতে হবে।অফিসে ক্ষতি করা ওদের একটা চাল,যেনো আমরা তৃপ্তির উপর হামলাকে গুরুত্ব না দিই।দোষী আমার পরিবারের বা তৃপ্তির পরিবারের কেউ একজন। সিনুকে ফোন করো।দ্রুত একটা সুসংবাদ আমি পেতে চাই।”
আদ্রিন চেয়ারে হেলান দেয়। ঘাড়ে হাত বুলায়।কিঞ্চিৎ ব্যাথা ঘাড়ে। তন্দ্রাসক্ত তৃপ্তির পানেই নিষ্পলক চেয়ে থাকার ফলাফল।আদ্রিনের কি বা করার আছে!তার প্রেয়সীই এমন চেয়ে থাকার যোগ্য।বিয়ের পর থেকে মেয়েটার বাহ্যিক গঠনেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।তার প্রতি নেশা লেগেই থাকে আদ্রিনের চক্ষে।
তৃপ্তির ক্ষতি করলে আদ্রিনকে দূর্বল করা সম্ভব তাই,বিপক্ষ দল মেয়েটাকেই বারবার হেনস্তা করতে চেয়েও পারছে না।আদ্রিন যে মেয়েটার ঢাল,তাকে রক্ষা করার কবজ।
তন্ময়ের ফোনকল মনোযোগ দিয়ে শুনে আদ্রিন।তার সকল কথা আদ্রিনের শিখিয়ে দেওয়া। জাল চারিদিকে ছড়িয়ে।মাছ ধরা দিবে নাহয় যেকোনো সামুদ্রিক প্রাণী বা যেকোনো সামুদ্রিক বর্জ্য।কিছু তো একটা আটকাবেই। তন্ময়ের মোবাইলে এলার্ম বাজে।সোজা হয়ে দাঁড়ায় সে।আদ্রিনকে মনে করিয়ে দেয়,
–“স্যার,আমাদের মিটিং আছে।আমরা ডিলটা শেয়ার করছি পিয়াল গ্রুপের সাথে।”
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আদ্রিন প্রস্তুতি নেয়।টাকা লস হওয়ার কারণে তার শেয়ার দরকার।আর এমন বিপদের সময়ে তার পানে হাত এগিয়ে দেয় পিয়াল।লোকটা ভদ্র এবং মর্যাদাসম্পন্ন।মিটিং রুমের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে আদ্রিন তন্ময়কে নির্দেশ দেয়,
–“গার্ডকে খেয়াল রাখতে বলো আমার কেবিনের টেলিফোন বাজে কিনা।তৃপ্তি ক্লাসে।আমাকে বা তোমাকে ফোনে না পেলে কেবিনের নাম্বারে ফোন করবে।গার্ডকে এই ব্যাপারে সতর্ক করো।আমার কেবিনের সামনেই থাকতে বলো।”
কোটের বোতাম লাগিয়ে দ্রুত গতিতে আদ্রিন হাঁটে।
তন্ময় তার স্যারের নির্দেশনা পালনে উল্টো পথ অবলম্বন করে।আদ্রিন এবং তৃপ্তির সম্পর্ক তার বড্ড প্রিয়।
———–
–“আপনি আমাকে নিতে আসবেন,আদ্রিন?”
এমন এক মেসেজ পাঠিয়ে চুপচাপ বসে রয় তৃপ্তি।ভার্সিটির আঙিনায় ব্যাপক মানুষ। কারো ক্লাস শেষ হলে আবার কারো শুরু।এই নিয়ে সকলের তাড়া।তৃপ্তি এসেছিলো সকাল নয়টায়।ঘুমে ঢুলুঢুলু ছিলো সে একপ্রকার।গত রাতে আদ্রিনের অতিরিক্ত ভালোবাসায় মত্ত হলে সারারাত কাটে।ঘুমায় সে ভোরে।আবার উঠেও যেতে হয় দ্রুত।ভার্সিটির শেষ বর্ষে সে।এই অবস্থায় ক্লাস মিস দেওয়ার কোনো উপায়ন্তর নেই।পাশে তার আলেয়া বসে।সে নোটস এ চোখ বোলাচ্ছে।গত দুইদিন জ্বরের কারণে না আসলেও আজ না এসে পারলো না।ক্লাসের স্যারদের মতো সুন্দর করে কেউ পড়া বুঝায় না।
পাশে বিদ্যমান তৃপ্তির অবস্থা অবলোকন করে হেসে উঠে আলেয়া।তৃপ্তি একবার মোবাইল দেখছে তো আরেকবার নখ কামড়াচ্ছে।নিশ্চয় আদ্রিনের সাথে তার যোগাযোগ হচ্ছে না!
–“নখ না কামড়িয়ে ভাইয়াকে ফোন দে।”
আলেয়ার কথায় তৃপ্তি মোবাইল হতে মনোযোগ সরায়।
অধরে হাসি ঝুলিয়ে বলে,
–“মেসেজ দিয়েছি।উনি মিটিংয়ে থাকেন এই সময়ে।ফোন দিতে ভয় করে।”
–“তুই বউ,তোর যখন ইচ্ছা ফোন দিবি।এখানে ভয়ের কি?”
আলেয়ার প্রশ্নে তৃপ্তির মন ভাবুক হয়।আলেয়া তো জানেনা একটার বেশি ফোনকল দিলে আদ্রিন চিন্তিত হবে।আর সেই চিন্তায় সে সব মিটিং,কাজ ফেলে দিশেহারা হবে তৃপ্তির জন্যে।তাই সচরাচর অফিস থাকলে সে তন্ময় থেকে খবরাখবর নেয় সব।আর আদ্রিনকে টুকটাক মেসেজ করে।সময় হলে আদ্রিন নিজেই ফোন দেয় প্রিয়তমার খোঁজে।আলেয়া কখনোই জানবে না,তৃপ্তির প্রতি আদ্রিনের উন্মাদনা।এছাড়াও তৃপ্তি চায় না তার জন্যে অহেতুক আদ্রিন চিন্তা করুক। এইভাবেও ব্যবসায় লস হওয়ার পর থেকে আদ্রিন নিজের কোম্পানির জন্যে বেশ খাটছে।পূর্বের মতো কোম্পানিকে উঁচুতে তুলতে ছেলেটা করছে কঠোর পরিশ্রম।
তৃপ্তি মোবাইল ব্যাগে রাখে।আলেয়াকে জবাব দেয়,
–“উনি ব্যস্ত থাকে।তাও,জিজ্ঞেস করলাম নিতে আসবে কিনা।যদিও জানি আসবে না।কিন্তু,মন চায় উনি আসুক।”
–“আহারে,লাভ বার্ডস।উনাকে দেখিসনি কয়েক ঘণ্টা হলো। এতেই এমন ছটফট!”
হাসে আলেয়া।
তৃপ্তি বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে উত্তর দিলো,
–“সবাই এমন হয়।এইযে তুই,তোর প্রেমিক ফোন না দিলে আমাকে কেঁদে কুটে নালিশ করিস ওগুলো কিছু না?”
কথায় পয়েন্ট আছে তৃপ্তির।আলেয়া চুপ করে।সত্যি তো।তার প্রেমিকের ফোন আসতে একটু উনিশ বিশ হলেই মেয়েটা চিন্তায় পড়ে যায়।কথার টপিক এড়াতে আলেয়া বলে উঠে,
–“তোর ড্রইং ক্লাস না করানোর কারণ কি?”
–“সময় পাই না। সাফা আসে শুধু প্রত্যেক বৃহস্পতিবার।আর তোর সাথে ছোট্ট বিজনেসটা করছি এটাই অনেক।”
–“তুই ছাড়া আমি ঐ বিজনেস একা চালাতে পারবো না।”
–“পারতে হবে না।চল কিছু খাই।”
তৃপ্তি কাঁধের এক পাশে ব্যাগ ঝুলিয়ে নেয়।মাথার কাপড় ঠিক করে।সে আর আলেয়া রেস্তোরায় যাবে সিদ্ধান্ত নিলে,আলেয়ার মায়ের ফোনে বাড়ি ফিরে।
ড্রাইভার ফোন করলে সে তাকে আলেয়ার বাসায় আসতে বলবে ভাবলো তৃপ্তি।
আলেয়ার মায়ের রান্না দুজনে আয়েশ করে খায়।পরপর তারা নতুন কিছু ডিজাইন ঠিক করার জন্যে উৎসুক হয়।
ঘন্টা খানেক বাদে ড্রাইভার তাকে ফোন করে। ট্র্যাফিকের কারণে দেরী হয় বলে জানায়।তৃপ্তি উনাকে আলেয়ার ঠিকানায় আসতে বলে।
পুনরায় তৃপ্তি কাজে মশগুল হলে আবারও বিপত্তি ঘটে ফোনকলে।নাম্বার দেখে অবাক সে।আদ্রিন ফোন করেছে।
তৃপ্তি ফোন রিসিভ করার সাথে সাথেই আদ্রিন তাকে প্রশ্ন করে,
–“খেয়েছো?ঘুম নাকি?”
–“খেয়েছি।ঘুম না।আমি আলেয়ার বাসায়।”
তৃপ্তি জবাব দিলো।
–“কবে গিয়েছো?”
আদ্রিনের পুনরায় প্রশ্ন।
–“ভার্সিটি ছুটির পরে।চিন্তা করবেন না।ড্রাইভার আসছে নিতে।”
তৃপ্তির জবাব পছন্দ হয়নি আদ্রিনের।বারবার মানা করা সত্ত্বেও গাড়ি ছাড়া বেরিয়েছে সে!মেয়েটা কেনো ভুলে বসে তার ক্ষতি করার জন্যে কতজন ওঁত পেতে আছে!
আদ্রিনের রাগ বাড়ে,
–“তোমার সমস্যাটা কি?বারবার বলি একা না বেরুতে।কথা শোনা যায় না?”
–“আলেয়া ছিলো আমার সাথে।”
তৃপ্তি ইতস্তত ভঙ্গিতে জবাব দেয়।
–“কোনো অঘটন হলে আলেয়া তোমাকে বাঁচাবে?ড্রাইভারের সাথে একটা গার্ড রেখেছি কার জন্যে ?তুমি একা একা ঘোরার জন্যে?তৃপ্তি তুমি কেনো বুঝো না আমাকে?তোমাকে আমি হাজার বার বলেছি একা না বেরুতে।”
আদ্রিনের একেক ধমকে শক্ত মনের তৃপ্তির অন্তরে বিষাদ হানা দেয়।পরিসরে,উত্তর না দিয়ে ফোন কাটে তৃপ্তি।
মেয়েটাও কম অভিমানী নয়। পরপর আদ্রিন বার কয়েক ফোন দেয়,তৃপ্তি উঠায়নি।কেনো উঠাবে?আবারও ধমক শুনতে?
মিনিট বিশেক পর ড্রাইভার এলে তৃপ্তি বেরিয়ে যায়।গাড়িতে অবশ্য ড্রাইভারের সাথে আদ্রিনের কথোপকথন আন্দাজ করে তৃপ্তি।মনে মনে সে আদ্রিনকে শাসায়,
–“বেশি ধমক দিতে জানেন তো!আজকে এমন মজা দেখাবো আপনাকে।এই তৃপ্তি আপনার সাথে আজ আর কথাই বলবে না।”
৭৫.
তৃপ্তি সকলের সাথে বসার ঘরে।বিয়ের পর হতে এই ঘরের সবাই তার আপনজনের খাতায় নাম লেখায়।কতো যত্ন করে সকলে।আদ্রিনের চাচাতো ভাই বোন কয়েকজন আছে পিচ্চি।এরা তৃপ্তি বলতেই অজ্ঞান। ইনায়ার মাঝে ব্যাপক পরিবর্তন।সে তৃপ্তির ছোটখাটো ব্যাপারও এখন খেয়াল রাখে।তার ছেলের একমাত্র স্নেহের পাত্রী এই মেয়ে।অনেকক্ষণ হলো ইনায়া আন্দাজ করছে তৃপ্তি কেমন চুপচাপ।অথচ,তার ছোট জায়ের ছেলেমেয়ের সাথে মেয়েটা কতো বকবক করে সাধারণত।
আজ কি হলো?পান্নার চেহারার কারণে তৃপ্তিকে তার ঘৃণা হতো।কিন্তু,এখন সেই চেহারার এই মেয়েটার কিছু হলেই ইনায়া ঘাবড়ে যায়।
ইনায়া সিট পরিবর্তন করে।তৃপ্তির পাশে বসে।মলিন হাসে তৃপ্তি।ইনায়া সোজা সাপ্টা মানুষ।ভনিতা ছাড়া তৃপ্তিকে জিজ্ঞেস করে,
–“কি হলো তোমার?শরীর ভালো?”
তৃপ্তির মন ভালো হয়।নিজ মা না থাকলেও এই মা এখন তৃপ্তির জন্যে ঢের।
তৃপ্তি কৃত্রিম হেসে জবাব দেয়,
–“ঠিক আছি,আম্মি।”
–“মনে হচ্ছে না।কিছু হয়েছে আদ্রিনের সাথে?”
ইনায়া তৃপ্তির থুতনিতে আঙ্গুল স্পর্শ করে।
তৃপ্তি অবাক হয়।মায়ের থেকে কিছু লুকানো দায়।মা সব বুঝে।
–“আপনার ছেলে কিছু বুঝে না।শুধু আমাকে বকে।একটা জিনিস শোনার আগেই রিয়েক্ট করে।”
তৃপ্তির কণ্ঠ নরম।আবেগে আপ্লুত।
ইনায়া স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে তৃপ্তিকে অবলোকন করে।ছেলের বউ আর ছেলের মাঝে মনোমালিন্য হয়েছে।পুরো ঘটনা জানায় তৃপ্তি তাকে।ইনায়া তৃপ্তির মাথায় হাত বুলায়,
–“আমার ছেলেটা একমাত্র তোমাকে নিয়ে ভয় পায়।তাই,একটু বেশি রিয়েক্ট করে তোমার সব ব্যাপারে।”
তৃপ্তি সন্তুষ্ট হয়েও হলো না।সব ঠিকাছে,কিন্তু অসময়ে কেনো বকবে?
পাশ থেকে আদিবা সব শুনে,সেও শামিল হয় তাদের কথোপকথনে,
–“আমাদের আদ্রিন তুমি ছাড়া কিছু বুঝে?সেদিন বাগানে বার্বিকিউ পার্টিতেও আসতে দেয়নি তোমাকে।কেনো?তার অফিসের এবং বড় ভাবীর পার্টির লোকেরা ছিলো বলে।ছেলেটা তোমাকে চোখে হারায়।”
তৃপ্তির লজ্জা জাগে।গাল খানা রক্তিম হচ্ছে।চেয়েও লজ্জা নিবারণ করা দায় তার।
এইতো সেদিনের ঘটনা।বাগানে পার্টি ছিলো।অনেকেই আমন্ত্রিত হয়।তৃপ্তির পরিবারের সবাই আসে।জনসমাবেশে তৃপ্তির উপস্থিতি মানতে নারাজ আদ্রিন।সে বেশ গমগমে কণ্ঠেই তৃপ্তিকে আলিঙ্গন করে বলেছিল,
–“বাগানে একদম যাবে না,মেহেবুবা।তোমার উপর কারো নজর কি, ছায়া পড়াও বারণ।”
অতঃপর তৃপ্তিকে সাফার সাথে বাড়িতেই থাকতে হলো।অবশ্য তার কাকাতো ভাইবোন,রিয়ানা সবাই তৃপ্তির সঙ্গ দিয়েছে সর্বক্ষণ।
অতীতের কথা সাথে বর্তমানের সবার খুনসুটি মূলক কথার মাঝে আদ্রিন উপস্থিত হয়।তাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে।গায়ের কোট কাঁধে ঝুলানো। হাতে কিছু একটার প্যাকেট।আদ্রিনকে দেখে তৃপ্তি চমকায়।পরিবারের সকলে হাসাহাসি করে।মিনা খোঁচা মেরে বলে উঠে,
–“তৃপ্তির উন্মাদের নাম নিলো সবাই,আর সে হাজির।”
আদ্রিন ভ্রু কুঁচকে তাকায়।তার বউটা লজ্জায় আড়ষ্ট।স্বভাবগত তৃপ্তি নিজ লাজ আদ্রিন ব্যতীত কারো সম্মুখে প্রকাশ করে না।তাহলে আজ কি হলো?মেয়েটা এমন লাজে রঞ্জিত কেনো?
আদ্রিন দুহাত বুকে গুঁজে।তৃপ্তি নজর সরায়।ছলনার ভঙ্গিতে আদ্রিন সকলের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে,
–“আমার বউকে কি লজ্জা দেওয়া হচ্ছে?”
–“মোটেও না।আমরা কেবল তোমার গুণগান গাচ্ছিলাম।”
আদিবা হেসে বলে।
চাচীর কথায় আদ্রিন বুঝে,মূলত তাকে নিয়েই মেয়েটাকে জর্জরিত করছে।
–“তৃপ্তি,গ্লুকোজ আনবে।আমি রুমে যাচ্ছি।”
ঠাট্টা মশকরা সব উহ্য করে আদ্রিন সম্মুখে পা ফেলে।
সে যেতেই মিনা আওড়ায়,
–“গ্লুকোজ তো বাহানা।এটা ছিল ভদ্রভাবে বউকে রুমে ডাকার নিয়ম।”
অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে সকলে।তৃপ্তির অসহায়ত্ব অবলোকন করে ইনায়া মিছে রাগ দেখায়,
–“ব্যস।আজকের জন্যে যথেষ্ট হয়েছে।তৃপ্তি তুমি যাও।ছেলেটা আবার রেগে না যায়।”
মাথা নাড়ায় তৃপ্তি।রান্নাঘরে যায়।প্রথমে ভাবে গ্লুকোজে লবণ দিয়ে খাওয়ার অযোগ্য করবে।পরক্ষণে প্রিয়তমের মলিন ক্লান্ত মুখ ভেসে উঠলে তৃপ্তি পরিকল্পনা বাতিল করে।গ্লুকোজের গ্লাস নিয়ে রুমে যায়।
আদ্রিন ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে সোফায় বসে। তাওয়াল দিয়ে মাথা মুছে।তৃপ্তিকে দেখে নিজ উরুতে হাত চাপড়ে বসার ইশারা করে।তৃপ্তি ভ্রু কুঁচকায়।দুপুরের অভিমান কি এই লোক ভুলেছে?কিন্তু,তৃপ্তি ভুলেনি।আদ্রিনের নিকট দূরত্ব বজায় রেখে গ্লাস রাখে সে ছোট্ট টেবিলে।
আদ্রিনের কথা অমান্য করলে সে রাগ দেখাতে গিয়েও দেখায় না।স্বাভাবিক সুরে বলে,
–“ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে প্যাকেটটা দাও।”
বিনা বাক্যে তৃপ্তি তার আদেশ পালন করে।
হাতে হাতে প্যাকেট দিতে গেলে মেয়েটা পড়ে যায় বিপাকে।আদ্রিন তার হাত চেপে ধরে। এক টানে নিজ উরুতে বসায়।তৃপ্তি উঠতে চাইলে আদ্রিন আক্রমণ করে তার মেহেবুবার গলার ভাঁজে।এই স্পর্শে মেয়েটা দমে যায়।তাও মুখ খুলে,
–“সারাক্ষণ বকাবকি,আর সামনে এলে সব ভালোবাসা?”
–“বকাগুলোই ভালোবাসা।বুঝবে না,জান।”
আদ্রিন টেবিলে প্যাকেট রেখে গ্লুকোজের গ্লাস খালি করে। অপর হাতে তার বউকে আটকে রেখেছে সে।
–“রেডি হও।বের হবো।”
–“কোথায়?”
তৃপ্তি চমকিত।
–“দেখা যাক।”
আদ্রিনের বাকি ভালোবাসার বোঝাপড়া শেষে সে ছাড়ে মেয়েটাকে।তৃপ্তি নিজেকে সামলে নেয়।আদ্রিনের সাথে তৈরি হয় বেরুনোর জন্যে।প্যাকেট হতে একটা তাজা ফুলের গাজরা বের করে তার হাতে পড়ায় আদ্রিন।সেই হাত টেনে নিয়ে অধর ছোঁয়ায় ছেলেটা।তৃপ্তি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রয়।এই লম্বা মানবটা এমন কেনো?রাগ করে থাকবে আর কিভাবে সে?তৃপ্তির কি হলো!সে লোকটার বাহুতে নিজেকে সঁপে দেয়।আদ্রিন তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।মিশিয়ে নেয় নিজ বক্ষঃস্থলে।
———-
ঘড়িতে রাত দশটা।হালকা শীতের আভাস।অক্টোবর মাস চলছে।দুইজন রাতের খাবার সাড়ে রেস্তোরায়।রাস্তাঘাটে আলোর কমতি না হলেও মানুষের কমতি আছে।এইদিকে হাই সোসাইটি হওয়ায় সবাই নিজ প্রাইভেট কার বা যানবাহনে মাতোয়ারা থাকে। তাই মানুষের হাঁটাহাঁটির ঘটনা এইখানে বিরল।তৃপ্তি আদ্রিনের বাহু আঁকড়ে।আদ্রিন মুঠোফোনে ব্যস্ত। সিনু ফোন করেছে।দুদিনের মাঝে একটা সুখবর দিবে বলে আশ্বাস দেয়।আদ্রিন আবার ফোন করে তন্ময়কে।
এইভাবেই আদ্রিন সময় পার করলেও তৃপ্তির বিরক্ত জমে।লোকটার সারাজীবন কাজে কাজে দিন যায়।
ফোন রাখলে আদ্রিন তৃপ্তি বলে উঠে,
–“আমি রিক্সা করে ঘুরতে চাই।চাই মানে চাই।”
আদ্রিন বাঁকা হাসে।তৃপ্তির অভিমানী গাল টানে,
–“রিক্সা কই পাবো?”
–“জানিনা।”
তৃপ্তি মিছে রাগ দেখায়।
–“মেইন রোড থেকে নিতে হবে রিক্সা।এতো কষ্ট করবো তোমার জন্যে,কি পাবো বিনিময়ে?”
আদ্রিনের কথায় অবাক হয় তৃপ্তি।
গাড়ি চালাবে ড্রাইভার তার কিসের কষ্ট?আজকাল ছেলেটাকে তার স্বার্থপর মনে হয়।এটা সেটার জন্যে শর্ত খুঁজে।আর শর্তের মূল উদ্দেশ্য তৃপ্তি।
সবটা বুঝে তৃপ্তি তার বাহুতে চড় দেয়,
–“স্বার্থপর,লোভী আপনি।”
আদ্রিন আঁকড়ে ধরে তৃপ্তির কোমর।তার মাথায় নাক ঘষে জবাব দেয়,
–“তোমার প্রতি কেবল।”
–“হয়েছে।জলদি ঘুরতে হবে।বাসায় ফিরবো।”
তৃপ্তি তাড়া দেয়।
–“আজ কোনো তাড়া নেই।আমার বাড়িতে থাকবো আজ।আম্মিকে জানিয়ে এসেছি।”
স্নেহের সুরে বলে আদ্রিন।
তৃপ্তি খুশি হয়।কিছুদিন আগেও সেই বাড়িতে যাওয়ার বায়না করেছিল।আদ্রিন কেইস নিয়ে,রহস্য উদঘাটনে দৌড়াদৌড়ি করায় প্রিয়তমার কথা রাখতে পারেনি।তবে ভুলেনি সে।মেয়েটার সব কথা মনে রেখেছে।
তৃপ্তি আদ্রিনের পানে তাকায় ঘাড় উচুঁ করে।চোখ দুটি কি সুন্দর তার! আনন্দে যেনো চিকচিক করছে।তৃপ্তিকে খেপিয়ে লোকটা দারুণ মজা নেয়।
শেষমেশ তৃপ্তির কথা রাখে আদ্রিন।রাস্তার মোড় হতে রিক্সা নিলো।পেছনে তাদের গাড়ি ফলো করছে।নিজ কোমরের পেছনে হাত দিয়ে আদ্রিন তার লাইসেন্সপ্রাপ্ত রিভলবার চেক করে নেয়।সাবধানের মার নেই।
তৃপ্তি নিশ্চিন্ত মনে শহরের বুকে রিক্সা ভ্রমণে মগ্ন।পাশে তার প্রিয়তম।সে এক হাতে তার পিঠে আগলে রেখেছে।একদম নিরাপদ মেয়েটা।ধীরে সে আদ্রিনের কাঁধে মাথা রাখে।শীতল পবন তনু স্পর্শ করলে চোখ বুঁজে।আবেগী হয়ে বলে,
–“সবার সাথে রাগ করলেও আমি আপনার সাথে রাগ দেখাতে পারি না।কেনো?”
আদ্রিন আঙ্গুল স্পর্শ করে মেয়েটার গালে।এই শহরের যান্ত্রিক ব্যস্ততা ভুলে কেবল প্রেয়সীর কথার গভীরতা আঁচ করে।সুশীল কণ্ঠে শুধায়,
–“মেয়েরা অনেক সেনসিটিভ হয়।ছেলেরা যতটুক রাগ দেখায় তার ভালোবাসার মানুষের প্রতি,মেয়েরা তা পারে না।ভালোবাসার মানুষের সাথে রাগ করার আগে তারা হাজারবার ভাবে।তবে হ্যাঁ,আজ তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।আমি তোমাকে রাগ দেখায়,বা বকা দিই,দিন শেষে আমি তোমার মুখ দেখেই স্বস্তি পাই।তোমার কোনো বিপদ যেনো না আসে তাই আমার এমন কঠোরতা তোমার প্রতি।আমার এই দুনিয়ায় সম্পূর্ণ অংশেই তোমার রাজ,মেহেবুবা।”
আদ্রিনের প্রত্যেকটা কথায় শিহরণ জাগে তৃপ্তির মনে।আবেশে মনটা হালকা হয়।মেয়েটা আরো এগিয়ে যায় আদ্রিনের প্রতি।বুকের সর্বত্র কেমন প্রশান্তিতে ভরে উঠেছে।
#অতৃপ্তির_মাঝে_তৃপ্তিময়_সে
#লেখিকা- সালসাবিল সারা
পর্ব-৩৫
_____________
৭৬.
–“শেষ খবর হলো,কালপ্রিট আপনার পরিবারের একজন,আদ্রিন স্যার।”
এমন বার্তা দেখে থমকে যায় আদ্রিন।সে এমনটা আশা করেনি।যতটুক ভেবেছিলো, তৃপ্তির পরিবারের গোপন কেউ এই ঘটনার সাথে জড়িত।নাস্তাটা যেনো গলায় আটকে যায়।দ্রুত পানি খায় সে।নিজ পরিবারের কে এমন জঘন্য কাজটা করতে পারে!তৃপ্তি মেয়েটা মিশুক।বিয়ের পর থেকে তার সম্পর্ক পরিবারের সাথে বড্ড মধুর।পরিবারের সবাই আবার তৃপ্তির প্রতি বেশ যত্নশীল।তাহলে কি হলো!কে দায়ী এইসবে?
ভাবুক হয় আদ্রিন।মাথার পেছনে সূক্ষ্ম পীড়া।
আপনজনদের মাঝে কাকে বা সন্দেহ করবে?তৃপ্তিকে জিজ্ঞাসা করা দরকার।কেউ কি মেয়েটার সাথে তার আড়ালে খারাপ ব্যবহার করছে?
নাস্তা প্লেটে বিদ্যমান।আদ্রিন নানান কিছুতে ভাবতে থাকে।তৃপ্তি কফির মগ হাতে ডাইনিং রুমে আসে। সকালে লোকটা তাড়া দিলো জলদি নাস্তা দিতে।অথচ এখনো নাস্তার রূপ পরিবর্তন হয়েছে অল্প।তৃপ্তি কফির মগ রাখে টেবিলে।আদ্রিনের কাঁধ ছুঁয়ে বলে,
–“কি হলো?খাচ্ছেন না কেনো?”
আদ্রিন সম্বিত ফিরে পায়।তবে,তৃপ্তির কথা তার বোধগম্য হয়নি। সে প্রশ্ন করে,
–“কিছু বললে মেহেবুবা?”
তৃপ্তি অবাক হয়।লোকটা কি ভাবছে এতো!
–“বলছি,নাস্তা খাবেন না?সকালে আমাকে বলেছে জলদি নাস্তার ব্যবস্থা করতে।”
–“এইতো খাচ্ছি।”
কথাটা বললেও,আদ্রিন তৃপ্তির পানে চেয়ে রয়।মেয়েটার আঁচল কোমরে গুঁজে।হালকা ঘেমে আছে।কয়েকটা চুল কপালের ঘামে লেপ্টে।আদ্রিন তার হাত ধরে।কোলে বসাতে চায়।কিন্তু, তৃপ্তি ঠাঁই দাঁড়িয়ে,
–“বসার ঘরে,কিচেনে সার্ভেন্ট আছে।কি ভাববে উনারা!”
আদ্রিন হাসে।গলা হাঁকিয়ে ডাকে তাদের।অতঃপর নির্দেশ দেয় তাদের,তারা যেনো কিছুক্ষণের জন্যে লিভিংরুমে কাজ করে।এইদিকে না আসে।সবার মাথা নিচু। ডানে দোলে।পরপর হেঁটে যায় সকলে।
তৃপ্তি মাথায় হাত দেয়।অস্ফুট স্বরে বলে,
–“আপনি পাগল।”
–“আসো।”
হাত টেনে তৃপ্তিকে নিজ উরুর উপর বসায় আদ্রিন।বা হাত প্রেয়সীর উদরে স্থগিত। ডান হাতে সে নিজে নাস্তা মুখ তুলছে নিজের আবার তৃপ্তির।সুযোগ বুঝে আদ্রিন তৃপ্তিকে বলে,
–“বাসায় কেউ কি তোমার সাথে রুড ব্যবহার করে?আমি বাসায় না থাকলে তখন?”
হঠাৎ এই প্রশ্নে তৃপ্তি ঘাবড়ে যায়।মাঝে মাঝে দাদী একটু খোঁটা দিলেও,প্রবীণ মানুষের কথা গায়ে মাখে না তৃপ্তি।এই বয়সে মানুষ নিতান্তই বাচ্চার রূপ ধারণ করে।এছাড়া বাকি সবার সাথে ভালো সম্পর্ক তার।বাদ বাকি চাচাদের সাথে সেভাবে কথা হয়নি কখনো।
–“না তো।সবাই আমাকে ভালোই সময় দেয়।সবাই অনেক বেশি যত্ন করে আমার।”
তৃপ্তি নাস্তা চিবিয়ে বলে।
–“চাচারা বা চাচী কখনো বাজে ব্যবহার অর কিছু নিয়ে খারাপ হিন্ট দিয়েছে। আম্মি কিছু বলেছে?”(অর অর্থ অথবা)
কফির কাপে চুমুক দেয় আদ্রিন।
তৃপ্তি আদ্রিনের পানে ফিরে বসে।গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে।লোকটা আজ বেশি প্রশ্ন করছে না! তাও আবার নিজ পরিবারের মানুষদের নিয়ে।
–“আরে,বললাম না সবাই আমাকে দেখতে পারে! নিজ পরিবারকে কেউ সন্দেহ করে?”
ভ্রু যুগল উচুঁ করে উত্তরের আশায় তৃপ্তি।আদ্রিন সরাসরি তাকালে দৃষ্টি নামায়।লোকটার দৃষ্টি বড্ড মোহনীয়।বুকে উথাল পাথাল হয় তৃপ্তির।বিয়ের এতো সময় বাদেও লোকটার দৃষ্টিতে ছারখার হয় তৃপ্তির দেহ,মন,অন্তর।
আদ্রিন দু আঙুলের সাহায্যে তৃপ্তির গাল চেপে।মোলায়েম সুরে বলে,
–“তোমার আর আমার মাঝে যে ক্ষতি করতে চেয়েছে সে আমাদের পরিবারের একজন।দুইদিন তোমাকে ওই বাড়িতে রাখিনি কি এমনি এমনি?ইনভেস্টিগেশন চলছিল।আজকে প্রধান খবর পেয়েছি।”
–“মানে?”
তৃপ্তির অবাকের অন্ত নেই। কে করেছে এমনটা!এটা মিথ্যে সংবাদ নিঃসন্দেহে।
–“মানে কিছু না। আম্মি করেনি এটা শিউর।উল্টো আম্মি আমাকে বলেছিল সঠিক খবর না পাওয়া অব্দি তোমাকে এইখানে রাখার ব্যবস্থা করতে।”
আদ্রিনের বাক্য তৃপ্তির নিকট অবাস্তব ঠেকছে।
পরিবারের কেউ আবার একই পরিবারের সদস্যকে কষ্ট দিতে পারে!কিন্তু,কে করলো এমনটা?
তৃপ্তির চিন্তিত মুখশ্রী ঘাবড়ে দেয় আদ্রিনকে।তার আবার প্রেসার না লো হয়ে যায়!তাই আগ বাড়িয়ে তাড়া দেয় সে তৃপ্তিকে,
–“এইসব নিয়ে ভেবো না।আমি আছি।তুমি বাসায় থেকো।ভার্সিটি যাওয়ার দরকার নেই আজও।”
তৃপ্তির টনক নড়ে।ফাইনাল ইয়ারে উঠে ক্লাস মিস দিচ্ছে সে অহরহ।রেজাল্ট ভালো আসবে?
দ্বিমত করে সে আদ্রিনের কথায়,
–“আমার পড়ালেখার বারোটা বাজবে।আমি অনেক ক্লাস মিস দিয়েছি।আপনি দিয়ে আসুন।আবার নিয়েও আসবেন!”
–“কাজ আছে রে জান।নাহলে বলতে হতো না।এছাড়া যতক্ষণ না আসল দোষী কে, এটা বের করতে পারছি,ততক্ষণ আমার শান্তি হবে না।তুমি বাসায় থাকো।”
আদ্রিন অধর স্পর্শ করে তৃপ্তির মাথার পিছে।
–“আলেয়াকে নোট নিয়ে আসতে বলি?”
তৃপ্তি আদ্রিনের কোল হতে নামে।ছেলেটা এখনি বেরিয়ে যাবে।
–“হুঁ,বলো।আর রাতে খাবার খেয়ে যাবে আলেয়া।বাড়ির সকলে আর তোমার বাড়ির সবাই আজ এইখানে আসবে।”
আদ্রিন কোট জড়ায় গায়ে।
–“সত্যি!”
আবেগপ্লুত হয় তৃপ্তি।
আদ্রিন হাসে।তার ছটফটে রাণীকে জড়িয়ে ধরে।পিঠে হাত বুলায়।মেয়েটা অল্পতেই খুশি হয়।
–“হ্যাঁ,আসবে।রিয়ানা আপু আসবে একটু পরে।সেদিন তুমি অনুষ্ঠানে যেতে পারোনি আমার জন্যে।তাই আজ তোমার জন্যে একটা সারপ্রাইজ রাখলাম।”
–“আমি অনেক অনেক খুশি।”
তৃপ্তি আরো মিশে যায় আদ্রিনের সমেত।পরক্ষণে ফোন বেজে উঠলে আদ্রিন তৃপ্তিকে ছাড়ে।কানে ফোন ঠেকিয়ে মেয়েটার সত্তায় ভালোবাসাময় স্পর্শ দিয়ে দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে সে।
তৃপ্তি আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে।মনটা তার সুখে ভাসছে।কতদিন পর সবাই একসাথে হবে!পরিবারের কেউ একজন তার ক্ষতি করতে চেয়েছে ব্যাপারটা তৃপ্তি ভুলেই গেলো।ঘরের সার্ভেন্টদের নিয়ে নানান কাজে লেগে পড়ে তৃপ্তি।
৭৭.
পরিবেশে শীতের আমেজ।অল্প ঠান্ডা অনুভব হয় এখন।পাঁচটা বিশ বাজতে না বাজতেই ধরণী কালচে হয়।বাহিরে ব্যাপক আলোয় ভরপুর কৃত্রিম লাইটের দরুণ।ছোটখাটো আয়োজন করা হয়েছে বাড়ির পেছনের দিকে।সুইমিং পুলের পাশেই সকল কিছুর প্রস্তুতি।রিয়ানা,তার শ্বশুর বাড়ির সকলেই উপস্থিত।আদ্রিনের মা, রাফি এবং চাচারা ব্যতীত বাকি সবাই এসেছে।তৃপ্তির বাড়ির লোক এখনো পৌঁছায়নি।
তৃপ্তি তৈরি হচ্ছে।আদ্রিনের জন্যে খয়েরী রঙের শার্ট বের করেছে সে।নিজের পরনের শাড়ির রংটাও খয়েরী।পারিবারিক অনুষ্ঠানে নিজেকে সাধারণ রাখলো সে।হালকা প্রসাধনীর পাশাপাশি নিজের কাঁধের নিচের পিঠ সমান চুল সমানতালে রেখেছে।কানে ছোট দুল পড়লো।আজকের অনুষ্ঠানের জন্যে সে বেজায় খুশি। সকলে আসবে বলে কথা! তৃপ্তির পিঠের উপর স্থায়ী চুলে চিরুনি চালিয়ে আলেয়া তাকে বলে,
–“শাড়িতে তোকে বেশি ভালো লাগে।”
তৃপ্তি হাসে।আয়নায় নিজেকে পরখ করে পুনরায় বলে,
–“তাই নাকি!”
আলেয়া মাথা নাড়ে,
–“অবশ্যই।আদ্রিন ভাই কই?উনি কবে আসবেন?”
–“উনি সারাজীবনের ব্যস্ত মানুষ।আসবে হয়তোবা একটু পরে।”
তৃপ্তি হাসিমুখে জবাব দেয়।
–“সারাদিনে ফোন দেয়নি?”
আলেয়ার প্রশ্নে তৃপ্তি আহত গলায় বলে,
–“না রে।উনি একটু ব্যস্ত থাকে অফিসে লসের পরপর।সুযোগ পেলেই ফোন দেয়।”
কথা শেষে তৃপ্তির মনে আসে সকালে বলা আদ্রিনের কথা।সে আলেয়ার হাত চেপে বলে,
–“জানিস দোস্ত,আমার সাথে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার সাথে উনার অফিসের লস এইসবের পিছে উনার বাড়ির কেউ একজন দায়ী।”
চমকে উঠে আলেয়া,
–“কি বলিস?”
–“হুম,উনি এইসবে খুবই চিন্তিত।”
তৃপ্তি আবারও জবাব দেয়।
–“ভাইয়ার ফ্যামিলি আসলে অনেক স্ট্রং।তোর ঐ শ্বশুর বাড়িতে একবার গিয়েই আমি বুঝেছি।সেই বাড়ির চেয়ে এই বাড়ি ঢের ভালো।”
আলেয়া ভীত।
–“আগে পরে আদ্রিন এবং আম্মি এইখানেই চলে আসবেন।এটা আদ্রিনের একার বাড়ি।উনার আব্বুর দেওয়া।”
–“ভালো হবে বেশ।”
আলেয়া মুচকি হাসে।
.
পরিপাটি হয়ে তৃপ্তি নিচে নামে আলেয়া সমেত।ঘরের ভেতরেও আজ সুন্দর করে সাজানো রঙিন লাইটের বাহারে।ঘরের পেছনের দিকে যেতেই একে একে সকল তার দৃষ্টিতে অবলোকন হয়। মেতে উঠে সে সকলের সাথে।সাফা নাছোড়বান্দা। তৃপ্তির কোলে উঠে বসে রইলো।নামার নাম নেই।এইদিকে তৃপ্তি হাঁসফাঁস করলেও কিছু বললো না।আদুরে বাচ্চাটার বায়না সহজে ফেলা যায়!খানিক বাদে তৃপ্তির পরিবারের সবাই এলে সাফা নিজে তৃপ্তির কোল থেকে নামে। ছুটে যায় অন্যদিকে।
রাত আটটা, সবাই উপস্থিত হয়।তবে, রাফি,তার বাবা এবং চাচা,ইনায়া এখনো আসেনি।উনাদের ফোন করা হলে জানায় আসছে।রাফির ফোন বন্ধ।তার হদিস নেই।
হঠাৎ,তন্ময়কে দেখেই তৃপ্তি তার পানে ছুটে।ইতস্তত ভঙ্গিতে বলে,
–” আদ্রিন ফিরেছে?”
–“জ্বী, ম্যাম। স্যার বাসার ভেতরে গেলো আর আমি এইখানে আসলাম।”
তন্ময় জবাব দেয়।
–“অফিসে গন্ডগোল হয়নি তো!”
তৃপ্তির প্রশ্নে তন্ময়ের চেহারায় তিমির ছেয়ে গেলেও তন্ময় শক্ত রাখে নিজেকে,
–“কিছু হয়নি ম্যাম।”
–“ঠিক আছে।”
তৃপ্তি এলোমেলো পায়ে এগিয়ে যায়।কিছু একটা হয়েছে যেটা তন্ময় বলছে না।আদ্রিন আসুক তাকেই জিজ্ঞাসা করবে তৃপ্তি।
কিয়ৎপল কাটে।আদ্রিন আসে।মাথার চুল এখনো ভেজা।উচুঁ চুলগুলো পেছনের দিকে হেলিয়ে আছে।বুকের উপর দুইটা বোতাম খোলা।হাতের ফুল স্লিভ বোতামে আটকে। খেয়ালী হয়ে হাঁটছে সে।আলাপ সারছে।নজর তার ঘুর্ণিয়মান।তৃপ্তিকে খুঁজছে বুঝি!তৃপ্তি আলগোছে হাসে।লোকটাকে দেখে।আকর্ষিত করছে তাকে লোকটার সত্তা।তাদের ভালোবাসার মুহূর্তটুকু আঁখিতে ভাসমান হয় আনমনে।শরীরে অদ্ভুত উষ্ণভাব অনুভব করে তৃপ্তি।
লাজে আবৃত হয় আচমকা।
আদ্রিনের নজরে তার নজর মিললে আদ্রিন দ্রুত এগিয়ে আসে তৃপ্তির পানে।তার সম্মুখে বিদ্যমান চুল কানের পিছে গুঁজে বলে,
–“হাইড অ্যান্ড সিক খেলবে?”
তৃপ্তি মাথা নাড়ায়।
–“কেনো না?”
আদ্রিনের চোখে মাদকতা।ডুবে যায় তৃপ্তি।তার গালে বৃদ্ধাঙ্গুল ছুঁতেই তৃপ্তি অস্ফুট শব্দ করে,
–“আরে,বাড়ির সবাই আছে।”
–“কিছু করেছি আমি?”
আঁখি জোড়া ছোট করে তাকায় আদ্রিন।
–“গালে হাত দিচ্ছেন!সবাই দেখলে কি ভাববে?সাফা তাকিয়ে আছে।”
আদ্রিন ঘাড় বাঁকিয়ে পেছনে ফিরে।ছোট সাফা চেয়ারে বসে তাদের পানে তাকিয়ে।আদ্রিন তাকে হাতের ইশারায় ডাকে।সাফা মাথা দুলিয়ে আসতে থাকে।কাছাকাছি এলে আদ্রিন নিজেই কোলে তুলে নেয় সাফাকে,
–“তোমার মামী সুন্দর অনেক,তাই না?”
–“এত্তগুলো সুন্দর মামী।”
সাফা হাতের ইশারায় পরিমাণ বুঝায়।
–“তোমার মামা পঁচা তাই না সাফা?”
তৃপ্তি দুষ্টুমির আশায় বলে।
ছোট সাফা মাথা নাড়ায়। অতঃপর তিনজন হাসে।
তৃপ্তি হঠাৎই আদ্রিনের বাহুতে হাত রেখে শুধায়,
–“ক্লান্ত অনেক?”
–“উহুম।”
আদ্রিন ব্যস্ত সাফাকে নিয়ে।
–“অফিসে কিছু হয়েছে?”
–“নাহ রে বাবা।এতো চিন্তা করছো কেনো?”
তৃপ্তি নিজ গাল ঠেকায় আদ্রিনের বাহুতে,
–“জানিনা।ভয় করে অনেক।”
আদ্রিন এক হাতে সাফাকে স্থির ধরে অন্য হাতে নিজ বউয়ের কাঁধ আগলিয়ে নেয়। তৃপ্তি সরতে চেয়েও সরলো না।অজানা আশঙ্কায় তার মন কাঁদে।
–“ভয় পেও না,জান।আমি তোমার সব ভয়ের বিপক্ষে আছি।”
তৃপ্তি মাথা দোলায়।মনটা তার অশান্ত।কিছু অঘটন কি ঘটবে?লোকটার জন্যে ব্যাপক চিন্তা হয় তৃপ্তির।
তৃপ্তির মন খারাপ লক্ষ্য করে আদ্রিন সাফাকে বলে উঠে,
–“সাফা আকাশে এটা কি দেখা যায়?”
–“চাঁদ।”
সাফা জবাব দেয়।
–“ঐ চাঁদ সবার আর আমার পাশের চাঁদ শুধু আদ্রিনের।”
সাফা না বুঝলেও তৃপ্তি বুঝে। ঘাড় তুলে আদ্রিনের পানে তাকালেই সে অধর চৌখা করে চুমুর ইশারা করে।তৃপ্তি “ধেত” বলেই সরে যায়।
যেতে যেতে আদ্রিনকে শুনিয়ে যায়,
–“যখন তখন এইসব!মানুষ দেখে না?”
মেয়েটাকে হুটহাট রাগিয়ে শান্তি পায় আদ্রিন।তার এই মানিকটা বড্ড দামী তার জীবনে।আদ্রিনের অস্তিত্ব অনুষ্ঠানে থাকলেও তার দৃষ্টি কেবল তার প্রেয়সীর উপরেই সীমাবদ্ধ।
দূর হতেও মেয়েটাকে সে নজরে রেখেছে।সিগারেটের টানের সাথে তন্ময়ের নিকট আলাপে মগ্ন আদ্রিন।রাতে সীনু ভিডিও ক্লিপ পাঠাবে।
এরই মাঝে রাফি আসে।তাকে অপ্রস্তুত দেখাচ্ছে।আদ্রিনকে দেখে সরাসরি সে আদ্রিনের নিকট যায়।কানে কানে কিছু বলে।
তার পায়ের নিচ হতে মাটি সরে মুহূর্তেই।মিনিট এক বাদে খেয়াল করে লাল ডটের চিহ্ন।বুকটা আলোড়ন সৃষ্টি করে। ডটের চিহ্ন শিকার খুঁজছে।মস্তিষ্কে ভাটা পড়েছে আদ্রিনের।বুকে ব্যথা হয়।পায়ের গতি অটোমেটিক তৃপ্তির পানে ছুটে।
মনটা চিৎকার করে উঠে তার,
–“আমার মেহেবুবাকে হারালে আমি বাঁচবো না!”
চলবে……..