#প্রণয়ের_জলসাঘরে
#পর্বঃ১৭ #লেখনীতে_রেহানা_পুতুল
‘ ভালবাসি স্যার ‘ আপনার জন্য সাজিয়েছি আমার ছোট্ট হৃদয়ের চিলেকোঠায় প্রণয়ের জলসাঘর। আপনার মতো কারো জন্য অপেক্ষার সীমানায় দাঁড়িয়ে প্রতিক্ষার প্রহর গুনব অনন্তকাল। যে কালের কোন শেষ নেই। কিন্তু সময় গড়িয়ে যাচ্ছে শুভ স্যার কেন এখনো আসছেনা।
আলিশার মন খারাপ হতে লাগল ক্রমশ। বারবার শুভকে কল দিয়েও পাচ্ছেনা। সুইচড অফ। মেসেজ দিল। বাট নো রিপ্লাই। বাথরুমে ঢুকে আলিশা লুকিয়ে কাঁদল। সে কিন্তু কাঁদতে চায়নি। কিন্তু কেন যে চোখ ভিজে ভরা বর্ষার মতো টইটুম্বুর হয়ে গেল। তাহলে কি সে আসলেই অনেক বেশী ভালোবেসে ফেলছে শুভ স্যারকে। হ্যাঁ তাইতো দেখতে পাচ্ছে।
গায়ে হলুদের প্রায় মাঝামাঝির দিকে কলিংবেল বেজে উঠলো। শুভ এলো। আলিশা খুশীতে পাগল পাগল দশা।
নাও তোমার জন্য এটা।
আলিশা হাত বাড়িয়ে গোলাপগুচ্ছটি ধরলো। খুশীতে টগবগিয়ে উঠল সে। আগে বলেন লেট হলো কেন?
ইচ্ছে করেই। মুচকি হেসে জবাব দিল শুভ।
অনেক ধন্যবাদ স্যার। এটা কেমন কথা হলো। ইচ্ছে করেই। গাল ফুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো আলিশা।
আরেহ নাহ। ফুলের তোড়া দুটো রেডি করতেই দোকানে লেট হলো । লম্বা সিরিয়াল। আলিশার দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বলল শুভ। তোমাকে দূর বনের মায়াবিনীর মতো লাগছে।
পিয়াসার অন্তর নেচে উঠল পেখম তোলা ময়ুরের মতো। বলল,আপনাকেও পাঞ্জাবীতে দারুণ লাগছে ৷
ধন্যবাদ আলিশা।
ফুল ওগুলো আপুর জন্য?
হ্যাঁ। ওর জন্য নিতে গিয়েই ভাবলাম তোমার জন্যও নিই । বলেই শুভ পিয়াসার সামনে গিয়ে রজনীগন্ধা ফুলের ফুলের তোড়াটি এগিয়ে ধরলো। কংগ্রাচুলেশন পিয়াসা৷
পিয়াসা ফুল হাতে নিয়ে হাসিমুখে ধন্যবাদ জানালো শুভকে। আয়মান পাশাপাশি বসা ছিল তার গায়ে হলুদের স্টেজে। বাঁকা চোখে দেখল পিয়াসাকে। বিশেষ খুশী হলোনা পিয়াসা খুশী হলো বলে। ওর মন চাচ্ছে ঠিক সেদিনের মতো এই ফুলগুলোকে পায়ের নিচে ফেলে দুমড়েমুচড়ে দিতে। কিন্তু তা এখন সম্ভব নয়।
মনে মনে বলল, আগে আমার হও একবার। তখন ফুল কেন গাছের পাতাও কেউ তোমাকে দিতে পারবেনা। এখন হজম করি নিলাম কাশির সিরাপের মতো। আয়মানকে সবাই হলুদ দেয়া শেষ করলে সে উঠে চলে গেল। পিয়াসা উদাস চোখে বসে রইলো গায়ের হলুদের স্টেজে ।
রায়হান উপস্থিত নেই আজ। সে শিক্ষকতার পেশা ছেড়ে দিয়ে দেশের বাইরে চলে গিয়েছে। পিয়াসার রায়হান স্যারের কথা মনে হলো। বাবার কথা মনে হলো। স্কুল কলেজের গ্লু বাহিনী নামের বন্ধুদের কথা মনে হলো। ভার্সিটিতে গিয়ে একেকজন একেকদিকে ছিটকে গিয়েছে। তারা কাছে থাকলে এখন খুব ভালো লাগতো পিয়াসার।
এই বুঝি জীবন। এই বুঝি জীবন নামক খেলা ঘর। এই ভালো এই মন্দ। এই হাসি এই কান্না। এই প্রণয় এই বিষাদ। এই মিলন এই বিরহ।
নিজের জীবনের ভগ্নদশা অতীতের কথা মনে হলো তার । দুই আঁখিকোন ভিজে উঠলো। আয়মানের মা হলুদ দেয়া শেষে পিয়াসার চোখের কোন নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে দিল।
বলল, এ অশ্রুর ভাষা আমি বুঝি মা। ভাগ্যের উপরে কারো হাত নেই। এখন বিয়ের সময়। এমন মনমরা হয়ে থেকনা। একটু হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করো।
গায়ে হলুদের সামনের চেয়ার গুলোতে বসে গানের কলি খেলছে আলিশার কাজিনেরা । সেখানে যোগ দিল আলিশা ও শুভ।
আলিশা বলল, এই গান কি শুধু বাংলায় হবে? নাকি মিক্স ?
কেউ বলল বাংলা গান। কেউ সজোরে বাধা দিল। বলল না মিক্স।
শুভ গলা তুলে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা গান কি বিয়ের গান হতে হবে? নাকি যে কোন রকম হলেই হবে?
আপনি চাইলে বিরহের গান ও গাইতে পারেন। কিটকিটিয়ে হেসে বলল আলিশার এক ভাবি।
যার যা ইচ্ছে বলল কেউ একজন।
সুখ সুখ গলায় বলল আলিশা। ওক্কে গাইস। শুরু হউক গায়ে হলুদের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্ব গানের কলি খেলা। যে বর্ণে গিয়ে গান শেষ হবে। ঠিক সেই বর্ণ বা আদ্যাক্ষর দিয়েই পরেরজন পরবর্তী গান গাইবে।
শুভ লুকিয়ে লুকিয়ে নেশাতুর চাহনিতে আলিশাকে দেখছে। চোখের কোণে দুষ্টময় হাসি খেলে যাচ্ছে ৷
এভাবে শাড়ি পরা আর কখনোই দেখেনি আলিশাকে । শাড়িতে মেয়েদের এত আবেদনময়ী লাগে এই প্রথম শুভ উপলব্ধি করতে পারলো। আলিশা ও আড়চোখে শুভকে দেখছে। ইসসস! কি রোমান্টিক প্রেমিক পুরুষ লাগছে আমার শুভ স্যারটাকে।
আচ্ছা স্যার জানে আমি তাকে পছন্দ করি। কিন্তু তবুও সে কেন আমাকে ভালোবাসতেছেনা। আমি কি দেখতে কিছুতেই কম নাকি। আগে একবার পটাই ভালো করে। পরে মজা দেখাব। আনমনা হয়ে গেল আলিশা। শুভ’র সাথে চোখাচোখি হতেই লজ্জায় লাল হয়ে গেল। অন্যকিছু দেখার বাহানায় ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যদিকে চাইলো।
গান শুরু করলো আলিশার মামাতো বোন,
” যদি বউ সাজোগো… তবে সুন্দর লাগবেগো…
বলো.. বলো..আরো বলো.. ”
‘ ল ‘ দিয়ে শুরু করতে হবে এনি ওয়ান। বলল আলিশার খালাতো বোন মিতু।
‘” লে যায়েঙ্গে লে যায়েঙ্গে , দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে।”
গানটি গাইলো শুভ। সবাই পুলকিত চোখে শুভ’র দিকে চেয়ে বলল,
এই ভাইয়া আপনিতো ভালোই গান দেখি।
শুভ হেসে বলল। শুকরিয়া শুকরিয়া। আপকা বহত বড়া শুকরিয়া
এবার ‘ গ ‘ দিয়ে কে বলবে?
” গভীর রাতে জেগে খুঁজি তোমারে।
দূর গগনে প্রিয় তিমির-পারে
গভীর রাতে জেগে খুঁজি তোমারে।
জেগে যবে দেখি হায় তুমি নাই কাছে।
আঙিনায় ফোঁটা ফুল ঝরে পড়ে আছে।
আহত এ মম তব লুটায়ে লুটায়ে কাঁদে আঁধারে। ”
ওমা কি জটিল গাইলে আলিশা। কবে থেকে প্রণয় সঙ্গীতের চর্চা করিস তুই? চাচাতো ভাই রিমন জিজ্ঞেস করল চোখ বড় বড় করে।
আলিশা চোখের ইশারায় ধমক দিয়ে থামালো তাকে।
এবার র বা এ দিয়ে শুরু হোক।
শুভ একটু ঘুরে বসল আলিশার দিকে। মুখোমুখি চেয়ে গাইলো,
” এই ভালোবাসা তোমাকেই পেতে চায়।
ওই দুটি চোখ যেন কিছু বলে যায়।
কবে তুমি নাম ধরে ডাকবে?
কবে তুমি হাতে হাত রাখবে? ”
সবার হাততালিতে মুখরিত হলো আয়মান পিয়াসার হলুদ সন্ধ্যা। আলিশা বিমোহিত শুভ স্যারের মুখে এমন প্রণয়মাখা রোমান্টিক গান শুনে। তার খুব ইচ্ছে করছে শুভ’র হাতে একটু হাত রাখতে।
অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেল। সবাই একসাথে ডিনার করলো। বিফ তেহারি ছিল আয়োজনে। আলিশা ঘুরেফিরে শুভ’র কাছাকাছি যাচ্ছে একটু সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য। শুভ তা বুঝে মিটমিট করে হাসছে। চলে যাওয়ার সময় আলিশা সিঁড়িতে নেমে স্যার বলে ডাকল।
শুভ মুখ তুলে, কিই বল?
কিছু বললেন না যে?
শুভ বিষম খাওয়ার ভান করলো অনুধাবন করতে পেরেও। বলল ও হ্যাঁ। তেহারিটা দারুণ টেস্টি হয়েছে। বাবুর্চিকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আর রসগোল্লাটাও বেশ তুলতুলে ছিল।
আলিশা অনিমেষ চেয়ে রইলো শুভর পানে।
শুভ আলিশার বাম গালে তার চার আঙুলের পিঠের আদুরে ছোঁয়া বুলিয়ে দিয়ে নেমে গেল সিঁড়ি ভেঙ্গে। শুভ’র চলে যাওয়ার পিছন দিয়ে আলিশা মনে মনে বলল পঁচা শামুক তুমি।
আজ পিয়াসার বিয়ে। চোখ ধাঁধানো হরেক রকম বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে বাড়ির উপর থেকে নিচ পর্যন্ত। বিয়ে হয়েছে পাশের
‘ বধু বরণ ‘ কমিউনিটি সেন্টারে। সাধ্যের ভিতরে সাজ সজ্জার কমতি রাখেনি আয়মান ও তার মা। পিয়াসা যেন নিজের বিয়ে নিয়ে কোন আক্ষেপ না থাকে। যদিও কিছু ধারদেনা করতে হয়েছে তাদের।
বিয়ের আনন্দ জীবনে একবারই আসে। তাই সেভাবেই সবকিছুর ব্যবস্থা করা হয়েছে। ছবি তোলা, ফটোগ্রাফার দিয়ে ভিডিও করা কিছুই বাকি থাকেনি। পিয়াসাকে ব্যয়বহুল বিউটি পার্লার থেকে গায়ে হলুদের মত করেই বউর সাজে সাজানো হয়েছে। দুই হাত ভর্তি মেহেদীর আলপনা আঁকা হয়েছে। পরানো হয়েছে লাল টুকটুক রক্ত জবার মতো কাতান শাড়ি। বাসর ঘর সাজানো হয়েছে মনোরম করে।
আয়মান অন্যদিকে কাজ নিয়ে ব্যস্ত। পিয়াসাকে আলিশা ও তার কাজিনেরা মিলে আয়মানের রুমে বাসর ঘরে নিয়ে বসালো। তার আগে পিয়াসা বাসায় ঢুকেই শ্বাশুড়ির পা ধরে সালাম দিল। তিনি পিয়াসাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। ভেজা গলায় বললেন, আজ যদি তিনি বেঁচে থাকতেন কত খুশী হতেন তোমার মতো মেয়েকে পুত্রবধূ হিসেবে পেয়ে ৷ পিয়াসাকে মিষ্টি মুখ করালেন। পিয়াসা ও শ্বাশুড়িকে মিষ্টি খাওয়ালো। ননদ আলিশাকে ও খাওয়ালো।
তারা চলে গেল দরজা চাপিয়ে দিয়ে। পিয়াসা সীমাহীন লজ্জায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। বুকের ধুকপুকানি ক্রমাগত বেড়েই যাচ্ছে। আয়মানের ও কেমন যেন লাগছে। এদিক ওদিক ঘুরছে রুমে ঢুকছেনা। তা দেখে তার কাজিন আর ভাবিরা মিলে তাকে রুমের ভিতরে ঠেলে দিল।
আয়মান দরজা বন্ধ করে দিল ভিতর থেকে । গলা খাঁকারি দিয়ে বিছানার একপাশে গিয়ে বসল। পিয়াসা কিছুই বলছেনা। চুপটি হয়ে বসে আছে ঘোমটার ভিতরে। আয়মান পিয়াসার হাতের পিঠে উষ্ণ চুমু খেল। বলল, অনেক ভালোবাসি প্রণয়ীনি ।
সে চাচ্ছে পিয়াসাও বলুক অনেক ভালোবাসি। কিন্ত পিয়াসা কিছুই বলছেনা। আয়মান বলল, কিছু একটা বল।
পিয়াসার বুকের ভিতর টিপটিপ করছে৷ তার অনুভূতি কেমন যেন উড়ুউড়ু হয়ে গেল। ঠিক বুঝতেছেনা। তবুও ছোট্ট করে মিষ্টি গলায় বলল,
একটা ধাঁধা বলব। উত্তর দেন পারলে ” চারদিকে কাঁটা বেত। মাথায় মুকুট। খান সাহেবের নাম কি? ”
আয়মান ফিক করে হেসে ফেলল। বাসর করে আর কথা খুঁজে পেলেনা তুমি? আমি শুনছি বাসর ঘরে স্বামী স্ত্রীর গল্প ফুরোয়না। কিন্তু রাত ফুরিয়ে যায়। আর তুমি কি হাবিজাবি ধাঁধা নিয়ে আসছ। ফাজিল কোথাকার।
নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা। পারেন না সেটা বলেন।
পারিনা নাহ? বলে আয়মান পিয়াসার হাত ধরে উল্টো দিকে মোচড় দেওয়ার মতো করে জিজ্ঞেস করলো,
আগে বল সেদিন বইয়ের ভিতরে পাওয়া চিরকুটে ডুবে ডুবে ভালোবাসি কার উদ্দেশ্য নিয়ে লিখছ?
আহ লাগছেতো। ধাঁধা পারেন না?
না পারার কি। এটা কাঁঠাল। এবার বল।
জানিনা।
বল। নইলে ব্যথা দিব এভাবে।
আপনার জন্য লিখছি।
ইয়েহ! বলে আয়মান খুশীতে আত্মহারা হয়ে উঠলো। খুশীর ফল্গুধারার ভেসে যাচ্ছে তাদের দুজনের দুটি হৃদয়। পিয়াসার মুখের দুপাশে তার দুহাত দিয়ে চেপে ধরলো। মোহাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে ঠায় চেয়ে রইলো পিয়াসার দিকে। নড়োনা তুমি প্লিজ। মন ভরে দেখতে দাও আমার প্রণয়ের জলসাঘরের মধুবালাটাকে । লেখিকা রেহানা পুতুল এর সাথেই যুক্ত হোন দারুণ স্বাদের সব গল্প পেতে।
আয়মান পিয়াসার কোলে মাথা রাখল। পিয়াসা মাথায় হাত বোলাতে লাগল। এক অপার্থিব ভালোলাগায় আয়মানের আঁখিপল্লব বুঁজে এলো।
পিয়াসা বলল। নিজে ঘুমালে হবে? আমি ঘুমাবনা?
আয়মান শাড়ির উপর দিয়ে পিয়াসার পেটের উপর নাকমুখ ঘষতে ঘষতে বলল,
কিসের ঘুম? এতদিন ঘুমাওনি? আজ তোমার মাঝে গচ্ছিত থাকা সব নতুনের খুশবু নিব আমি। নিঃশ্বাস ভরে প্রাণ উজাড় করে। তুমি শুধুই আমার। একান্তই আমার। তোমার সমস্তটা আমি দখল করবো বীরদর্পে।
” ফুলের বনে দারুন খরা, চাই অনেক বৃষ্টি।
শুদ্ধ জলে চাই ভিজাতে কামনারই দৃষ্টি। ”
পিয়াসা আপ্লুত স্বরে জানতে চাইলো আয়মানের কাছে ,
এত প্রেম , এত অনুরাগ, এত নিবেদন,এত আরাধনা, হৃদয় কুঠিরে পুঞ্জীভূত রেখে এতদিন কিভাবে ছিলেন আপনি ?
চলবে ঃ ১৭