#কুঁড়েঘর
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
[ দ্বিতীয় পরিচ্ছদ ]
। পর্ব ৩০।
আজকে নিশাদ তার চাকরির প্রথম ইন্টার্ভিউ দিতে যাচ্ছে। ইন্টার্ভিউর টাইম হয়ে গিয়েছে আগেই নিশাদ রাতে দেড়িতে ঘুমানোর কারণে লেট হয়ে যায়। তৈরি হয়েই কোনোরকমে দৌঁড়ে বেরিয়ে যায় নিশাদ।
রিধিশা ভার্সিটিতে এসে আকাশ কুসুম চিন্তা করছে।
” আজকে সকালে নিশাদকে কোথাও দেখলাম না। এমনি তো প্রতিদিনই দাঁড়িয়ে থাকে আমাকে জ্বালানোর জন্য।” জোতি রিধিশাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো
” কিরে এতো কি ভাবিস তুই? তুই ও কি বয়ফ্রেন্ড পেয়েছিস? নাকি নিশাদ ভাইয়াকে নিয়ে ভাবিস?”
রিধিশা বিরক্ত প্রকাশ করে বললো
” কেনো এসব ছাড়া কি আর কিছু নিয়ে ভাবা যায় না নাকি? আর নিশাদকে নিয়ে কেনো ভাববো আমি?”
জোতি মুখ টিপে হেসে বললো
” তোদের ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধ তো সব সময় লেগে থাকে। তোদের মাঝে প্রেম টেম হয়ে যায়নি তো!”
রিধিশা চোখ রাঙ্গিয়ে তাকায়
” তুই বেশি বেশি বলছিস। ওই বদ ছেলের সাথে আমার প্রেম হবে? মানুষের কি অভাব পড়েছে নাকি?”
জোতি নিশ্বাস ফেলে বললো
” হাহ তা তো দেখতেই পাবো সামনে।”
” তুই তোর কথা বল। তুই যে কালকে ঝগড়া করলি রেহান ভাইয়ার সাথে। সেটার মিটমাট করেছিস?’
জোতি রাগি গলায় বললো
” খবরদার ওর কথা বলবি না। কালকে লং ড্রাইভে নিয়ে যাবে বলে একটা পার্কে নিয়ে গিয়েছে আমাকে! তাও আবার ভার্সিটির উল্টো দিকে যেই পার্কটা সেখানে নিয়ে গিয়েছে। বাচ্চারা ফুটবল খেলছিলো পার্কে। তারপর রেহান আমাকে আইসক্রিম কিনে আনবে বলে বসিয়ে চলে যায়। পড়ে খুঁজে বের করে দেখি এই ছেলে আরেক মেয়ের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। আর হাতের আইসক্রিম গলে পানির মতো হাত থেকে পরছিলো। আমার রাগে মাথা ফেটে যায়। আর আমি চলে আসি।”
জোতি মুখ ফুলিয়ে আবার বললো
” কি করবো বলতো! ভালোবাসি বলেই কথা না বলে থাকতে পারি না। আমি কথা না বলা পর্যন্ত রেহানের দোষ না থাকলেও কতোবার সরি বলে ক্ষমা চায়। ওর কথার রেসপন্স না দিলে মনের ভেতর ছটফট করে।” রিধিশা আলতো হাসলো। জোতি রিধিশার হাত ধরে গরম লাগায় কপাল ছুঁয়ে বলে
” কিরে তোর তো জ্বর! তুই জ্বর নিয়ে চলে এসেছিস?”
” আরে একটু খানি জ্বর। এতে কিছু হবে না। ক্লাসে মন দে স্যার আসছে।”
ভার্সিটি শেষে রিধিশা বাসায় আসার জন্য পথ দেয়। সকাল থেকে শরীর কিছুটা খারাপ থাকলেও ব্রেক টাইমের পর থেকে বেশি শরীর খারাপ লাগছে তাই টিউশনিতে যাওয়ার ইচ্ছে হলো না। শরীর ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পড়ার মতো অবস্থা।
” রিধিশা!”
হাটার মাঝে হঠাৎ পেছন থেকে ডাক শুনে রিধিশা তাকিয়ে দেখে নিশাদ দ্রুত পায়ে তার কাছেই আসছে। রিধিশা শান্ত দৃষ্টিতে নিশাদের দিকে তাকালো। নিশাদ ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো
” এদিকে কোথায় যাও? তোমার না এই সময় টিউশনি থাকে?” রিধিশা ধীর গলায় বললো
” বাসায় যাচ্ছি।” নিশাদ ভ্রু কুঁচকে বললো
” তোমার শরীর খারাপ? গলা এমন লাগছে কেনো?”
” নাহ এমনি, আপনি কোথা থেকে আসলেন?”
কথা শেষ করতেই রিধিশার চোখের সামনের সব ঝাপসা হয়ে যায়।
নিশাদ বলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলো কিন্তু তার আগেই রিধিশা মাথা ঘুরে পড়ে যায়। নিশাদ রিধিশা বলে চেঁচিয়ে রিধিশাকে আগলে ধরে। নিশাদ রিধিশার কপালে হাত রেখে চমকে বিড়বিড় করে বললো
” মেয়েটার গায়ে এতো জ্বর! শরীর খারাপ নিয়ে ঘুরছে আবার বলে শরীর খারাপ না!”
নিশাদ ব্যস্ততার সঙ্গে তড়িঘড়ি করে গাড়ি ডেকে রিধিশাকে নিয়ে হসপিটালের দিকে রওনা দেয়।
.
ডক্টর রিধিশার চেকাপ করছে। নিশাদের চিন্তায় কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে। অস্বাভাবিক ভাবে বুক ধড়ফড় করছে নিশাদের। পথে রিধিশার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করেছিলো কিন্তু জ্ঞান ফিরেনি। নিশাদ রেহানকে কল করে কিন্তু রেহানের কল রিসিভ হয়নি। ডক্টর বের হতেই নিশাদ দ্রুত পায়ে তার কাছে
যেতেই ডক্টর বললো
“১০৫ ডিগ্রি জ্বরের তাপমাত্রা। শরীর এমনিতে দুর্বল থাকায় প্রচণ্ড জ্বরে আরো প্রভাব পড়েছে তাই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। স্যালাইন দিতে হয়েছে কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরবে।”
নিশাদ ঢোক গিলে চিন্তিত হয়ে বললো
” এছাড়া আর সব ঠিকাছে তো? মানে হঠাৎ করে এতো জ্বর কিভাবে হলো?”
ডক্টর হেসে বলে
” সবই ঠিকাছে। জ্বর খুব বেশি তাই ইনজেকশন দিয়েছি। আশাকরছি কয়েকঘন্টায় জ্বর কিছুটা কমে যাবে।” ডক্টর চলে যায়। নিশাদ কেবিনে ঢুকে পড়লো। রিধিশার দিকে তাকিয়ে নিশাদ রাগি গলায় বললো
” জেদি একটা মেয়ে। একা থেকে মরে গেলেও কি হয়েছে সেটা বলবে না। এতো জ্বর নিয়ে ভার্সিটিতে যাওয়ার কি দরকার ছিলো?” নিশাস রেগে বাইরে চলে গেলো আবার ফিরে এসে বেডের পাশে চেয়ার টেনে বসে। রেহান, সূর্যকে কল করতে থাকে রেহান ধরেনি একবারও। সূর্যকে দ্বিতীয় বার কল করতেই রিসিভ করে। নিশাদ রেগে বলে উঠে
” তোদের সব গুলোর কি একসাথে ইন্তেকাল হইছে? রেহান কই? দুইঘন্টা ধরে কয়টা কল দিছি ওর খেয়াল আছে?”
” আরে রেহানকে দেখছি ফুটবল খেলতেছিলো মাঠে। মোবাইল হয়তো ব্যাগে রেখে দিছে। কিন্তু এতো কল কেনো? তোর চাকরি হইছে তো?”
” আরে চাকরির কথা বাসায় এসে বলবো। রিধিশা হসপিটালে আছে রেহানকে গিয়ে বল জোতি’কে নিয়ে আসতে।”
” আচ্ছা যাচ্ছি আমি।” নিশাদ রিধিশার দিকে তাকিয়ে থাকে।
.
পিটপিট করে চোখ খুলে রিধিশা। চোখের সামনের ঝাপসা ঝাপসা ভাবটা কেটে ধীরেধীরে স্পষ্ট হলো। রিধিশা পাশে তাকিয়ে নিশাদকে কপালে হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখে। রিধিশার রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার কথা মনে আসে। রিধিশা কথা বলার শক্তি পেলো না। বা হাতের আঙুল নাড়িয়ে নিশাদের হাত ছোঁয়।
নিশাদ চমকে রিধিশার দিকে তাকিয়ে উৎসাহিত গলায় বললো
” তোমার জ্ঞান ফিরেছে? কেমন লাগছে এখন? তোমার জ্ঞান ফেরার অপেক্ষা করছি কতোক্ষণ ধরে।”
রিধিশা দুর্বল আর অবুঝ দৃষ্টিতে তাকায়। নিশাদ নিজের কপাল থাপড়ে বিরবির করে বললো
” কি উল্টো পাল্টা কথা বলছি আমি? পাগল হয়ে গিয়েছি বোধয়।” নিশাদ রিধিশার হাতের উপর হাত রেখে বললো
” এখন কেমন লাগছে?”
” ভা…লো।” রিধিশা কোনোরকমে উত্তর দেওয়া চেষ্টা করে। নিশাদ এবার শক্ত গলায় বললো
” হ্যা, কেমন ভালো তা দেখতেই পাচ্ছি। এতো জ্বর নিয়ে ভার্সিটিতে যাওয়ার শখ উঠেছিলো কেনো তোমার? জ্বরের জন্য রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে গেলে আজকে আমি না থাকলে তোমাকে কেউ এসে বাঁচাতো? কতো গাড়ি আসে সেই রাস্তা দিয়ে যদি কোনো অঘটন… আর বললাম না।”
রিধিশা শান্ত দৃষ্টিতে নিশাদকে দেখছে। নিশাদের চোখে মুখে নিজের জন্য চিন্তার ছাপ দেখতে পাচ্ছে। নিশাদ রাগি গলায় বললো
” কিছু বলবে তো!” রিধিশা ঠোঁট জোড়া নাড়িয়ে অস্পষ্ট ভাবে কিছু কথা বলে কিন্তু নিশাদের কান পর্যন্ত আসলো না কথা গুলো। জোড়ে বলার জন্য গায়ে একদমই শক্তি নেই। নিশাদ কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললো
” খারাপ লাগছে? ডক্টরকে ডাকবো?” রিধিশা চোখের ইশারায় না বোঝালো। নিশাদ রিধিশার পাশে বসে বলল
” সুস্থ হও তারপর নাহয় কথা বলবো সব। একটা গুড নিউজ বলতে এসেছিলাম আর এরমাঝেই অঘটন ঘটে গেলো।” রিধিশা জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকায়। এরমাঝে ডক্টর ঢোকে কেবিনে।
ডক্টর রিধিশাকে দেখতে দেখতে নিশাদের উদ্দেশ্যে বললো
” এখন শান্তি পাচ্ছেন? দুপুর থেকে ৪চারবার ডেকে এনেছেন জ্ঞান ফিরছে না দেখে। এখন জ্ঞান ফিরেছে।” ডক্টরের কথায় রিধিশা নিশাদের দিকে তাকায়। নিশাদ লজ্জা পেয়ে যায়।
তখন তো চিন্তায় মাথায় কাজ করেনি এতো কিছু কি আর ভেবেছে?
নিশাদের ভাবনার মাঝে ডক্টর বললো
” আজকের রাতটা থাকতে হবে এখানে। শরীর বেশি দুর্বল পেশেন্টের। কন্ডিশন খারাপও হতে পারে আবার তাই রিস্ক না নেওয়া বেটার।” ডক্টর চলে যায়।
নিশাদ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আবার ফোন করলো রেহানকে। ফোন রিং হচ্ছে এখনও। নিশাদ রেহানের ফোনের রিংটোনের শব্দ শুনতে পেয়ে বাইরে তাকায়।
রেহান আর জোতি কেবিনে ঢুকতেই নিশাদ ক্ষিপ্ত গলায় বললো
” কতো ঘন্টা আগে তোদের জানিয়েছি আসার জন্য?
দুপুর পেড়িয়ে সন্ধ্যা হয়েছে আর তোদের আসার সময় হয়েছে? না আসলেই হতো!”
” আরে হোস্টেল থেকে বের হতেই দিচ্ছিলো না। কিসের নাকি স্ট্রেট রুলস করেছে। কতো কিছু করে এসেছি!”
জোতি রিধিশার কাছে গিয়ে দেখে রিধিশা আবার ঘুমিয়ে গিয়েছে। নিশাদ জোতিকে বললো
” তুমি জানতে না রিধিশার জ্বর ছিলো?” জোতি মাথা নেড়ে বললো
” হ্যা জানতাম। ক্লাসে ওকে বলেছিলাম বাসায় ফিরে রেস্ট নিতে কিন্তু রিধি বললো একটু জ্বরে কিছু হবে না। ক্লাসে আরো বলেছিলাম কিন্তু শোনেনি।
রিধিশার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকায় নিশাদ। এতো জেদি কেনো বুঝে না নিশাদ।
চলবে………#কুঁড়েঘর
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
[ দ্বিতীয় পরিচ্ছদ ]
। পর্ব ২৪।
লিমা বেগম দীর্ঘ নিশ্বাস আড়াল করে আলতো হেসে বললো
” পরিচয় করিয়ে দেবো। আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো? আমাকে জানালি না কেনো আসার আগে?” রিধিশা হেসে বললো
” কোনো সমস্যা নেই। জানিয়ে আসলে তোমাকে সারপ্রাইজ তো আর দিতে পারতাম না তাই না!”
রিধিশার কথায় লিমা বেগম হাসলো।
লিমা বেগম রিধিশাকে দুজনের কাছে নিয়ে মহিলাকে দেখিয়ে বললো
” উনি তোর ছোট মনি আর ছেলেটা তোর ভাইয়া হৃদ।”
রিধিশা আলতো হেসে দুজনকে কেমন আছে জিজ্ঞেস করে। রিধিশার ছোট মনি মুচকি হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো
” কতো বড় হয়ে গিয়েছো তুমি। জার্নি করে এসেছো গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।” রিধিশা মাথা নাড়ে। লিমা বেগম রিধিশাকে তার রুমে নিয়ে যায়।
রিধিশা নিজের ঢুকে হাসলো। লিমা বেগম প্রতিদিনই রুমটা পরিষ্কার করে রাখে। লিমা বেগম চলে যেতে নিলে রিধিশা ডেকে বললো
” আম্মু ছোট মনি বা ভাইয়া দুজনকে ছোট বেলায় বা আগে তো কখনো দেখিনি। কোথায় ছিলো এতোদিন?” লিমা বেগম হাসি মুখে বললো
” মাত্রই তো এলি। ধীরেধীরে সব জানতে পারবি।” রিধিশা আর কিছু বললো না। লিমা বেগম চলে গেলে রিধিশা দরজা লাগাতে লাগতে ঠোঁট উল্টে বললো
” মনে হচ্ছে গভীর কোনো গর্তে খিচুড়ি পাকাচ্ছে।”
রিধিশা ড্রেস বের করে ওয়াসরুমে ঢুকে পড়লো।
লিমা বেগম দ্রুত পা চালিয়ে ড্রইংরুমে আসে। সাদিয়া বেগম আর হৃদের দিকে তাকিয়ে বললো
” কি করবে এখন? আমার চিন্তা হচ্ছে। রিধিশার বাবাও তো নেই, রাতে আসবে সে। রিধিশা এভাবে চলে আসবে শেটা তো ভাবিই নি।” সাদিয়া বেগম আশ্বাস দিয়ে বললো
” তুমি চিন্তা করো না। হৃদ তুই ব্যাগ গুছিয়ে নে। ওই বাড়িতে চলে যাবো আজকে।”
হৃদ দুজনের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো
” এভাবে পালিয়ে কতোদিন সত্য লুকিয়ে রাখবে তোমরা তিনজন? সত্যিটা বেশিদিন লুকানো যায় না, আমি যেভাবে জানতে পেরেছি রিধিশাও একদিন জানতে পেরে যাবে। ভালো কথা বলছি এখনই রিধিশাকে সব সত্য জানিয়ে দাও। নাহলে আমি জানাবো। আমার বোনকে আমার মতো অন্ধকারে থাকতে দেবো না আমি! আর আমি কোথাও যাবোও না।”
হৃদ পা চালিয়ে তার রুমে চলে গেলো। সাদিয়া বেগম অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়। লিমা বেগম মলিন গলায় বললো
” হৃদ ঠিকই বলেছে। এভাবে কতোদিন মেয়েটাকে অন্ধকারে ঠেলে রাখবো? সব বলে দেওয়াই ঠিক হবে।”
” কিন্তু রিধিশা কষ্ট পাবে। প্রথমদিন জানতে পেরে তুমি যতো ভেঙ্গে পরেছিলে রিধিশাও যদি ভেঙ্গে পড়ে।”
লিমা বেগম আলতো হেসে বললো
” চিন্তা করো না। আমার মেয়ে এই কয়েকমাসে এমনই শক্ত হয়ে গিয়েছে। এখন ভেঙ্গে গেলে উঠেও দাঁড়াবে আর এটা তো স্বাভাবিক একটা বিষয়। এমন পরিস্থিতি মুখোমুখি প্রতিনিয়ত কতো মানুষই হয়। জানতে পারলে একটু কষ্ট পাওয়া স্বাভাবিক তবে সত্যি টা আর লুকিয়ে রাখতে চাই না।” সাদিয়া বেগম দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো।
রিধিশা শাওয়ার নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। পুরো বাড়ি ঘুরে দেখলো একা একা। দোতলায় রিধিশার রুম সহ তিনটে রুম। ঘুরে ঘুরে বুঝলো তার ছোট মনি আর হৃদ বাকি দুই রুমেই থাকে।
রিধিশা রান্না ঘরে গিয়ে দেখে সাদিয়া বেগম আর লিমা বেগম রান্না করছে। রিধিশাকে দেখে সাদিয়া বেগম বললো
” আরে রিধিশা ভেতরে এসো!” রিধিশা হেসে ভেতরে ঢুকে বললো
” আমাকে দিন আমি হেল্প করছি আম্মুর।”
” না মা তোমার কিছু করা লাগবে না। গিয়ে বসে থাকো।” লিমা বেগম বললো
” কি কি খাবি সেটা বল। রাতে তোর জন্য সব রান্না করবো।”
” খাবো তো অনেক কিছু বাবা বাসায় কখন আসবে?”
লিমা বেগম হেসে বললো
” সন্ধ্যার পর আসবে। টেবিলে গিয়ে বস আর তোর ভাইয়াকে ডেকে নিয়ে আয় খেতে বসবি এখন।”
রিধিশা মাথা বেড়ে উপরে চলে যায়।
রিধিশা হৃদের রুমের দরজা আধখোলা দেখে নক করে। ভেতর থেকে হৃদ এসে দরজা পুরোপুরি খুলে দেয়। রিধিশা দেখে অবাক হয়ে বললো
” তুমি! কিছু বলবে?” রিধিশা আমতা আমতা করে বলে
” হ্যা,আম্মু বললো নিচে খেতে খাওয়ার জন্য।” হৃদ হেসে বললো
” ভেতরে এসো!” রিধিশা একটু একটু করে ভেতরে যেতে থাকে তা দেঝে হৃদ হেসে বললো
” নিজের ভাইয়ের রুমে আসতে এমন করছো? এসে বসো এখানে।” রিধিশা লজ্জা পেয়ে গিয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়ে।
হৃদ রুমের আলমারি থেকে একটা গিফট বক্স এনে রিধিশার হাতে দিয়ে বললো
” এটা তোমার জন্য।” রিধিশা গিফটের দিকে তাকিয়ে অবাক স্বরে বললো
” আমার জন্য গিফট কেনো?” হৃদ পাশে বসে বললো
” প্রথমদিন আসার আগে সবার জন্য গিফট কিনেছিলাম তোমার জন্যও কিনেছিলাম কিন্তু তুমি তো ছিলে না তাই দেওয়া হয়নি। তোমার জন্য তোলা ছিলো।”
রিধিশা হৃদের দিকে তাকিয়ে বললো
” আপনি আমাকে চিনেন?” হৃদ মাথা নেড়ে বললো
” হ্যা, ছোট থেকে চিনি।” রিধিশা ভ্রু কুঁচকে বললো
” কিন্তু আমি তো কখনো দেখিনি আপনাকে চিনিও না।” হৃদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো
” একটা অন্ধকার রুমে যখন কেউ থাকে তখন অন্যকারো উপস্থিত থাকলেও তাকে দেখতে পায় না আর চিনতেও পারে না। সেই রুমে আলো জ্বললেই তার পাশের মানুষটাকে দেখতে পাবে আর চিনতেও পারবে।”
” কিন্তু আপন মানুষ হলে অন্ধকারেও সেই ব্যাক্তিকে চেনা যায়।” হৃদ মুচকি হাসে রিধিশার কথায়।
” আপন মানুষকে চেনার জন্য প্রথমে আলোরই প্রয়োজন হয়। অন্ধকারে থেকে কখনো আসল সম্পর্কের মূল্যও বোঝা যায় না আর আপন মানুষও চেনা যায় না।”
রিধিশা অবুঝ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো
” তাও ঠিক, আচ্ছা তা নাহয় বুঝলাম কিন্তু আমার আপনাকে চেনা না চেনার মধ্যে এই কথার কি সম্পর্ক? আমি তো আলোতেও আগে আপনাকে দেখিনি আর অন্ধকারেও আপনাকে দেখিনি।” হৃদ সশব্দ করে হেসে উঠে
” বোঝনি আমার কথা তবে বুঝতে পারবে তাড়াতাড়ি। আচ্ছা চলো খেতে যাই পরে তোমার সাথে গল্প করবো।” রিধিশা মাথা নেড়ে হৃদের সাথে নিচে আসে। গিফট বক্স নিজের রুমে রেখে এসে টেবিলে বসে পড়ে।
সন্ধ্যার পর রিধিশার বাবা বাড়িতে আসে। রিধিশা ড্রইংরুমে বসেছিলো সবার সাথে। রিধিশার বাবা শফিক উদ্দিন প্রথমে রিধিশাল খেয়াল না করলেও পড়ে খেয়াল হতেই অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। হৃদ তা দেখে তাচ্ছিল্য হাসি দেয়। রিধিশা ধীর গলায় জিজ্ঞেস করে
” কেমন আছেন বাবা?” শফিক উদ্দিন কাঁপাকাঁপা গলায় উত্তর দেয়
” ভালো তুমি কেমন আছো?কখন এসেছো?”
” দুপুরে।” শফিক উদ্দিনের কপাল বেয়ে ঘাম পড়তে থাকে। তিনি দ্রুত পা চালিয়ে রুম চলে গেলো।
হৃদ লিমা বেগমকে বললো
” মনি রিধিশাকে সব কখন বলবে?” লিমা বেগম রিধিশার দিকে তাকায়। চিন্তিত গলায় বললো
” কিভাবে বলবো বুঝতে পারছি না।”
” যতো তাড়াতাড়ি বলবে ততোই ভালো।”
.
লিমা বেগম রিধিশাকে বসিয়ে রেখে নিজেও সামনে বসে আছে। কিভাবে কথা শুরু করবে বুঝতে পারছে না। শ্বাস রুদ্ধ একটা সময় মনে হচ্ছে তার। রিধিশা ধৈর্য ভেঙ্গে বললো
” কতোক্ষণ বসিয়ে রাখবে আম্মু বলছো না কেনো কি বলবে?” লিমা বেগম বড় একটা নিঃশ্বাস নেয়।
” আমার আর তোর বাবার পারিবারিক ভাবে বিয়ে হয়েছিলো। তোর দাদা, দাদি আমাদের সঙ্গে থাকতো। অনেক চেষ্টা করার পরও প্রায় ৬ বছর পেড়িয়ে যায় আমাদের বাচ্চা হচ্ছিলো না। তোর বাবা ছিলো বাচ্চা পাগল। তোর দাদা, দাদিও মাঝে মাঝে কথা শোনাতো আমাকে বাচ্চা না হওয়ার জন্য। তারপর ৭ বছরের মাথায় জানতে পারি আমি প্রেগন্যান্ট। বাড়িতে খুশির জোয়ার নেমেছিলো। তোর জন্মের পর তোর বাবা তোকে আদরের দুলালী করে রাখে। তোকে প্রচুর ভালোবাসতো। তোকে একটু ব্যাথাও পেতে দিতো না।
দিনকাল ভালোই যাচ্ছিলো তারপর তোর বাবার ব্যবসায়ীক সূত্রে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাথে অনেক ঝগড়া হয়, সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। এর সপ্তাহ খানেকের মাথায় তোর বন্ধুর বাবা বাড়িতে আসে যখন তোর বাবা বাসায় ছিলো না। আমার আর আমার শশুড়, শাশুড়ির কাছে তোর বাবার সবচেয়ে বড় সত্যি বলে যায়। আমাদের বিয়ের ২বছর হয়ে গিয়েছিলো কিন্তু বাচ্চা হয়নি দেখে তোর বাবা আড়ালে বিয়ে করে এক মেয়েকে। তখন আমরা বাড়ির কেউ বিশ্বাস করিনি। তোর বাবার বন্ধু কিছু ছবি সহ আরো কিছু প্রমাণ দিয়ে যায়। তারপর আমাদের উপর আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। আমার শাশুড়ি কাঁদতে কাঁদতে আমার পায়ে পড়ে যায় আর বলে এই কথা যেনো বাইরে না যায়। আমি চুপচাপ ছিলাম এসব শোনার পরও। তারপর আমি আড়ালে খুঁজতে থাকি তোর বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী’কে পেয়েও যাই। সাদিয়া বাড়ি কিশোরগঞ্জ ছিলো। সব কিছু বলার পর সাদিয়া আমাকে জানায় সাদিয়া এসব কিছুই জানতো না। তাদের বিয়ের ৬ বছর হয়েছে আর তাদের ছেলে ছিলো হৃদ।
তারপর আমি আর সাদিয়া তোর বাবার বন্ধুর থেকে জানতে পারি। সে আর তোর বাবাই সাদিয়ার মা, বাবার বিয়ের প্রস্তাব দেয় তারপর বিয়ে পর্যন্ত এগিয়েছে। তোর বাবা সব কিছু আড়ালে রাখতে চেয়েছে আমাদের থেকে। ব্যবসার কথা বলে প্রতি মাসে সাদিয়ার কাছেই যেতো। সাদিয়া বিয়ের হওয়ার আগে থেকে জানতো তোর বাবা সাদিয়াকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে আর তোর বাবা অনাথ।
সব কিছু মিথ্যা মনে হয়েছিলো। তারপর আমরা দুজনই তোর বাবার সামনে আসি। তোর বাবা অবাক হয়ে গিয়েছিলো আমাদের একসাথে দেখে। তারপর সব সত্য প্রকাশ করে। আমি তোকে নিয়ে আমার বাবার বাড়ি চলে যাই। আমার মা,বাবা ছিলো না তাই ভাইয়ের বাড়িতে থাকতাম। ডিভোর্স চাইলে তো তোর বাবা আমাকেও ডিভোর্স দিতে চায় না আর সাদিয়াকেও না। কয়েক মাস পেড়িয়ে যায় আমার ভাই, শশুড়, শাশুড়ি অনেক বোঝায় তারপর অনিচ্ছা সত্ত্বেও তোর জন্য আবার ফিরে আসি। সাদিয়া নিজ থেকে সরে যেতে চায় আমাদের জীবন থেকে কিন্তু তোর বাবা ছিলো অনড়।
আমি ভাবতাম সাদিয়ার কোন দোষ ছিলো না কারণ আমি সন্তান জন্ম দিতে পারিনি তাই সে বিয়ে করেছে। তার প্রথম বিয়ে সম্পর্কে সাদিয়া অজানা ছিলো।
তাই আমি চাইনি সাদিয়া তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হোক। কিন্তু আমার শশুড় শাশুড়ি সাদিয়াকে বাড়ির বউ করে তুলতে চায়নি। এসব নিয়েও একদফা ঝামেলা করি আমি। তারপর সাদিয়া দূড়ে থাকার কথা বললো তারপর তোর বাবা সাদিয়া আর হৃদের দায়িত্ব, আমার আর তোর দায়িত্ব নেয়। দুই সন্তানকে খুব বেশি ভালোবাসতো। তবে এতো বছরে আমি আর সাদিয়া তাকে সেই আগের মতো ভালোবাসতে পারিনি।
আমাদের সম্পর্ক ছিলো লোক দেখানো। তোর দাদা, দাদিও মারা যায়। তোর বাবা এভাবেই দুটো সম্পর্ক আড়ালে আড়ালে নিজের সাথে জড়িয়ে রাখে। কখনো কাউকে জানতে দেয়নি আর তোকেও এসব জানতে দেইনি আর হৃদকেও না। তবে হৃদ ছোট থেকে জানতো তার একটা ছোট বোন আছে আর কিছুই জানতো না। তোর বাবার গাফলতির জন্য হৃদ কয়েক মাস আগে জানতে পেরে যায় সব।
রিধিশা মূর্তির মতো বসে রয়েছে। মুখ দিয়ে কথাও বের হলো না। বাবার সম্পর্কে এসব শুনে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার। লিমা বেগম মাথা নিচু করে বসে আছে।
” তোর বিয়ের জন্য হঠাৎ করে তোর বাবা পাগল হয়ে উঠেছিলো। হুট করে এমন ব্যবহারে অবাক হয়েছিলো সবাই। তুই চলে যাওয়ার পর সাদিয়ার সাথে যোগাযোগ করেও কিছু জানতে পারি না। তারপর সাদিয়া একদিন আমাকে জানায় হৃদ কিভাবে যেনো আমাদের সম্পর্কে সব জানতে পেরেছে। কিভাবে জেনেছে সেটা একমাত্র হৃদই জানে। হৃদ সাদিয়া আর তোর বাবার উপর রেগে তার বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।
তোর বাবা চায়না তুই সত্যিটা জানিস। তুই মাহিনের সাথে বিয়ে ভেঙ্গে দেওয়ায় তোর বাবা অসুস্থ হয়ে পরেছিলো তখন সাদিয়া এসেছিলো আর হৃদকে জোড় করে নিয়ে এসেছিলো। তোর বাবা ভেবেছিলো তুই তার উপর রেগে ঈদে বাড়িতে আসবি না তাই ওদেরকে বাড়িতে থাকতে বলে। কিন্তু হঠাৎ করে আজকে এসে পড়লি তুই । সত্যিটা বেশিদিন লুকিয়ে রাখা যায় না। হৃদ জানতে পেরেছে তাই আজকে সব সত্যি তোর সামনেও খোলাস করলাম।
চলবে……..