মাত্র তিন মাস
পর্বঃ ৬
উৎস ফুল গুলো হাতে নিয়ে যেই না আমাকে দেয়ার জন্য চেয়ার থেকে নেমে গিয়ে হাঁটু গেড়ে ছাদে বসেছে।
আর তখনই আমার ফোনটা বেজে উঠে।
সায়ান ইজ কলিং…
উৎসর মুখটা মলিন হয়ে যায়।
আমি থতমত খেয়ে যাই।
ফোনটা হাতে নিয়ে রিসিভ করি,
-হ্যালো সায়ান।
-হুম,কেমন আছো অনামিকা?
-হুম ভালো।তুমি?
-এইতো ভালো।
-দাদুর অবস্থা তেমন একটা ভালোনা।
কি থেকে কি হয়ে যায় বলা যায়না।
তাই সবাই বলছে কিছু দিন থেকে যেতে।
আর দাদুও আমাকে ছাড়তে চাইছেন না।
তুমি আর কয়টা দিন ধৈর্য্য ধরো।
দাদু সুস্থ্য হোক একটু।
আমি চলে আসবো।
-আচ্ছা ঠিকাছে।
-বাসায় একদম নেট পাওয়া যায়না।
তাই বাইরে রাস্তায় এসে ফোন দিতে হয়।
-থাক সমস্যা নেই।
চিন্তা করোনা।সমস্যা হলে ফোন দিতে হবেনা।
এসেই একবারে ফোন দিও।
দাদুর কাছেকাছে থেকো।
-আচ্ছা ঠিক আছে।
নিজের যত্ন নিও।
-আচ্ছা তুমিও।
সায়ান ফোন রেখে দেয়।
আর উৎস উঠে দাঁড়িয়ে যায়।
ফুল গুলো টেবিলে রেখে দেয়।
-চলো নিচে চলো।ঘুম পাচ্ছে।
-হুম চলুন।
রুমে এসে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি।
পরের দিন সকালে আম্মুর ফোন।
-হ্যালো!
-কিরে একবারে ভুলেই গেলি আমাদের?
দেখতে না হয় আসিস না।
তাই বলে ফোনও দিবি না?
একটা দিন ফোনও তো দিস না।
ফোন দিলে রিসিভও করিসনা।
লাইন কেটে ফোন বন্ধ করে রাখিস।
হয়েছে কি তোর?
এমন কেন করিস?
-বাহ রে। জানোনা কি হয়েছে আমার?জানোনা এমন কেন করি?
তোমাদের ইচ্ছে হয়েছে বিয়ে দিয়েছো।
আপদ বিদেয় করেছো।
আমার ইচ্ছে আমি আর ও বাড়ীতে পা রাখবোনা।
তোমরা সুখে শান্তিতে থাকো।
-দেখ অনামিকা।উৎস তোর বাবার বন্ধুর ছেলে।আর ও খুব ভালো ছেলে।
দেখবি ও তোকে খুব ভালো রাখবে।
শুধু সংসার টা মন দিয়ে করে যা।সবাইকে আপন করে নে।
দেখবি ওই পরিবার তোর কত আপন।
-আমার এত কিছু করা লাগবেনা মা।
তুমি রাখো এবার ফোন।
আমার কাজ আছে।
এই বলে ফোনটা আমি রেখে দেই।
আমার রাগ এখনো কমেনি তাদের উপর থেকে।তাদের জন্যই আজ আমার জীবন টা এমন।দুই নৌকার মাঝ খানে পড়ে আছি আমি।
-অনামিকা এই অনামিকা।
-জ্বী ভাবী।আসছি।
-কি করছিলে গো?
-কিছু না ভাবী।
-গত কালকের সারপ্রাইজ টা কেমন ছিলো বলোতো?
-ভালো ছিলো ভাবী।
-জানো,উৎস না সব সময় আমাকে বলতো।
অনামিকার বাবা একবার রাজি হোক বিয়ের জন্য,আমি প্রতিমাসে ওকে নিয়ে ক্যান্ডেল নাইট ডিনার করবো।
ও চাওয়ার আগেই সব কিছু এনে হাজির করবো।
লোকেরাও বউ পালে আর আমিও বউ পালবো।
বউকে এত আদর যত্ন করবো যে বাবার বাড়ীই যেতে চাইবেনা।
-সত্যিই কি আমার দেবর খুব আদর যত্ন করে?আর তাই বুঝি বাবার বাড়ীর নামই নাওনা।
আমি চুপ করে থাকি।
-থাক ভাই আর লজ্জা পেতে হবেনা।
জানোতো,উৎস খুব ভালো একটা ছেলে।
তোমার ভাইয়ের ইনকাম কম।
পুরো সংসারের দায়িত্ব ও নিয়েছে।
যাবতীয় খরচ ও চালায়।
অন্য কেউ হলে হয়তো এমন টা করতোনা।
এ যুগের ছেলে,চাইলেই টাকা পয়সা উড়াতে পারতো।কিন্তু ও এমন না।
এমন স্বামী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার বুঝলে?
তাছাড়া তোমাকে খুব বেশি ভালবাসে ও।
ওর মুখেই শুনেছি,সেই ছোট থেকে নাকি তোমাকে নিয়ে মনে মনে স্বপ্ন দেখেছে।
আসলেই,কেউ মন থেকে কিছু চাইলে আল্লাহ্ তাকে নিরাশ করেন না।
ছেলেটা বড্ড ভালো।
ওকে কোন দিন কষ্ট দিওনা ভাই।
আমি আসছি।
ভাবী চলে গেলেন।
কিন্তু আমার বুকের ভেতর যেন ঝড় বইছে।
এক নিমিষেই যেন সব ভেঙেচুড়ে যাবে।
এত ভালো একটা ছেলেকে আমি দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে কিভাবে নিজে সুখের রাজ্যে পা রাখবো?
উফফ কিচ্ছু ভাবতে পারছিনা আমি।
এ কোন পরীক্ষায় ফেললে তুমি আমায় খোদা।
আমি যে কোন পথ দেখতে পাচ্ছিনা।
দুজন মানুষ।দুজনই আমাকে মন প্রাণ উজাড় করে ভালবাসে।
কিন্তু আমি তো একা মানুষ।একজন কে ভালো রাখতে গেলে অন্য জন কে দুঃখ দিতে হবে।
কি করবো আমি?
কি করা উচিৎ আমার?
দেখতে দেখতে কেটে গেলো অনেক গুলো দিন।
-অনু!
-জ্বী,
-শরীর খারাপ?
-না।
-তুমি এমন মন মরা হয়ে বসে থাকো কেন ইদানীং বলোতো?
আগের মত চঞ্চলতা টা যেন নেই আর তোমার মাঝে।
কি হয়েছে?
-কিছু হয়নি।
কিছু লাগবে?চা খাবেন?
-না,কফি খাবো।
-আচ্ছা বসুন আমি নিয়ে আসছি।
-না তুমি বসো।আমি নিয়ে আসি।
-আচ্ছা।
উৎস আমাদের দুজনের জন্য কফি করে নিয়ে আসে।
-আমার সাথে একটু ছাদে যাবে?
-হুম।
আকাশ টা খুব সুন্দর দেখাচ্ছে তাইনা?
-হ্যাঁ।
-আমার আকাশ দেখতে খুব ভালো লাগে।
-আর?
-রজনীগন্ধা।
-রজনীগন্ধাও কারো প্রিয় ফুল হয়?
-হবেনা কেন?আমার প্রিয়।
-আর?
-কফি।
-আর?
-ঝুম বৃষ্টি।
-ওহ আচ্ছা।
-আর কি জিজ্ঞেস করবেনা?
-কি?
-তুমি!
তুমি আমার খুব প্রিয়।
সব কিছুর উর্ধে
-আচ্ছা চলুন নিচে যাই।
-সায়ান ফোন দিয়েছিলো?
-না।
-তুমি দাওনি?
-ওর ওখানে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়না।
গ্রাম থেকে ফিরলে আমি ওকে ফোন দিতে বলেছি।
-আচ্ছা।
অনু!
-জ্বী।
-একটা সত্যি কথা বলবে?
-কি?
-এই এত গুলো দিন আমাদের এক ছাদের নিচে বসবাস।
এই এত গুলো দিনে আমার জন্য কি তোমার মনে এক চিলতেও ভালবাসা কিংবা মায়া অনুভূত হয়নি?
আবির্ভাব ঘটেনি?
-জানিনা।
-মেয়েরা জানিনা বললে সেই জানিনার ভেতরে ৯০% হ্যাঁ লুকায়িত থাকে।
আমি কোনটা ধরে নেবো?
৯০% নাকি ১০% টা?
-মা ডাকছে,চলুন নিচে চলুন।
-তোমার ফোন নিচে রেখে এসেছো বলে বার বার নিচে যেতে চাইছো তাইনা?
-যদি তাই ভাবেন তবে তাই।
আমি কথাটা বলে নিচে চলে এলাম।
নিচে আসতেই দেখি আমার ফোন বাজছে।
-হ্যালো সায়ান।
-কোথায় ছিলে তুমি?সেই কখন থেকে ফোন করে যাচ্ছি।
ওই তো একটু ছাদে গিয়েছিলাম।
-ওহ আচ্ছা।
-আমি ফিরেছি।
এত দিন নানান সমস্যা,নেটের সমস্যা,দাদুর অসুস্থতার জন্য ফোন দিতে পারিনি।
তুমি আগামীকাল ঠিক সকাল ৯ টায় আমার দেয়া ঠিকানা মত চলে আসবে।
তারপর আমরা ডিভোর্স লেটার এখান থেকেই পাঠিয়ে দিবো।
-বুঝেছো?
-হুম।
-ফোন রাখছি আমি।
-আচ্ছা।
:
:
-সায়ান ফোন দিয়েছিলো?
-হ্যাঁ।
-কি বল্লো?
-বল্লো আগামীকাল সকাল নয় টায় ওর কাছে চলে যেতে।
-তুমি কি বললে?
-বলেছি আচ্ছা।
-ওহ।
অনু!
-হুম।
-সত্যি সত্যি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে তুমি?
আমি কোন উত্তর না দিয়ে উৎসের পাশ কাটিয়ে মায়ের রুমে চলে আসি।
এখানে ভাবীও বসে আছে।
-অনামিকা!কিরে এত ক্ষণ কোথায় ছিলি?
ডাকলাম সাড়া দিলিনা।
-ছাদে ছিলাম মা।
-কেমন করে চুল গুলো ছেড়ে রেখেছিস।
আয় চুল গুলো বেধে দেই।
মা আমাকে কাছে ডেকে আমার চুল গুলো বেধে দিলেন।
ভাবী আমার হাতের দিকে পায়ের দিকে তাকিয়ে বলেন,
-ওমা, এত বড় বড় নখ।
আমি তো খেয়ালই করিনি এ কয়দিন।
এত বড় নখ রাখলে নামাজ হবেনা।
দাঁড়াও এক্ষুণি আমি কেটে দিচ্ছি।
আজ থেকেই নামাজ পড়বে কেমন?
ভাবী নেইলকাটার এনে আমার দু হাতের নখ গুলো কেটে ছোট করে দিলেন।
পায়ের গুলো আমিই কাটলাম।
উৎস দূর থেকে দাঁড়িয়ে সব কিছুই দেখছে।
আমি তাকাতেই ওর দিকে ও চলে গেলো।
ভাবী দেখেছে উৎস যে দাঁড়িয়ে ছিলো।
-অনামিকা,উৎসর কিছু লাগবে মনে হয় যাওতো।
-আচ্ছা ভাবী,যাচ্ছি।
মানুষ গুলোর এত আদর মায়া মমতা আমি কিভাবে ভুলবো?
খোদা!আমি তো এদের মায়ায় জড়িয়ে গেছি।এদের ছেড়ে কিভাবে যাবো আমি?
রুমে চলে গেলাম আমি।
দেখি উৎস কপালে হাত দিয়ে শুয়ে পড়েছে।
চোখ বরাবর হাত।
নাকি চোখ ঢাকার চেষ্টা করছে ঠিক বুঝতে পারছিনা।
-শুনছেন?
এই যে শুনছেন?
কিছু লাগবে আপনার?
কথা বলছেন না যে?
উৎস উঠে বসে পড়ে,
-হ্যাঁ হ্যাঁ লাগবে আমার।
দিতে পারবে আমায়?যা লাগবে আমার?
পারবে দিতে?
-কি?
-আমার তোমাকে লাগবে অনু।তোমাকে লাগবে।
শুধু তোমাকে লাগবে।দাওয়া আমায় এই তুমি টাকে।
আমার কিচ্ছুটি চাইনা।
তুমি সারাজীবন যা বলবে আমি তাই করবো।
তুমি যদি বলো তোমার গায়ে স্পর্শ করতে পারবোনা।
আমি করবোনা।শুধু তুমি থেকে যাও আমার জীবনে।
আমি বাঁচবোনা তোমায় ছাড়া অনু।
আমার দম বন্ধ হয়ে আসে তুমি ছাড়া নিজেকে ভাবলে।
প্লিজ অনু!আমি হাত জোর করছি।
আমাকে একটা সুযোগ দাও।
আমি তোমাকে সায়ানের চেয়ে বেশি ভালবাসবো।
তুমি সায়ানকে ভালবাসো বলেই ও তোমাকে চায়,ভালবাসে।
আর আমি তোমাকে একাই ভালবাসি।
পাগলের মত ভালবাসি।
তাহলে ভাবো একবার যদি তুমিও আমাকে ভালবাসতে,তাহলে আমি আরো কতটা ভাল বাসতাম তোমায়?
তোমাদের দু এক বছরের ভালবাসার জন্য আমার যুগ যুগের ভালবাসাটাকে পায়ে পিষে মেরে ফেলোনা প্লিজ।
আমি সইতে পারবোনা।
উৎস কথা গুলো বলে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলো রুম থেকে।
রাতে কেউ আমরা ডিনার করিনি।
দুজন দু দিকে ঘুরে শুয়ে আছি।
ঘুম নেই কারো চোখেই।
হঠাৎ উৎস আমাকে ডেকে বলে,
-তুমি উঠে একটু বসবে প্লিজ?
আমি তোমার কোলে একটু মাথা রাখতাম।
এটা আমার তোমার কাছে শেষ আবদার।
কাল তো চলেই যাবে চিরদিনের মত আমার জীবন থেকে।
আর কোন দিন আমাদের দেখা হবেনা।তুমি চাইলেও আমাদের আর দেখা হবেনা।
রাখবে আমার শেষ আবদার টা?
#চলবে