তোমাকে শুধু তোমাকে চাই
তৃতীয় পর্ব
মুনির অনেকক্ষণ ধরে হলের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে I দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে ,এখন পর্যন্ত অনিমার কোন দেখা নেই I অনেক বার কল দেয়ার পর জানা গেছে ও রুমে নেই I
অনিমা চলে যাবার পর ও পাগলের মত নিচে নেমে সারা চত্বরে খুঁজেছে I কোথাও ওর কোনো চিহ্ন নেই I কয়েক হাজার বার ওকে ফোন করার পরও ফোন ধরেনি I আর এখন ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে I ফোন বন্ধ দেখে ও মেসেঞ্জারে ফোন দিল I সেখানেও ধরছেনা I অসংখ্য মেসেজ করলোI কিন্তু কোন জবাব এলোনা I মুনির সন্ধ্যা পর্যন্ত হলের বাইরে অপেক্ষা করল I তারপর রাত বাড়ার পর নিজের হলে চলে গেল I
মুনির হলেএকটা সিট নিয়ে রেখেছে যদিও সাধারণত ও বাসায় থাকে I নিজের রুমে না গিয়ে ও হাসিবের রুমে গেল I হাসিব ওকে দেখে বলল
– আরে ,কই পালায় গেছিলা মামু
মুনির জবাব দিল না I দুই হাতে মাথার চুল খামচে ধরে বিছানায় বসে পড়ল I হাসিব চিন্তিত কন্ঠে বলল
কি হইছে ?
অনেক বড় ঝামেলা হয়ে গেছে
কি ? নীলা মানা করে দিছে ?
কে ?
আরে নীলা I ওরে দেইখা তো মনে হইল পজেটিভ
মুনির দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
– সব ওলট-পালট হয়ে গেছে হাসিব I আমি মনে হয় ওকে চিরকালের জন্য হারিয়ে ফেললাম I ও আর আমার কাছে আসবে না
– কে? কে আসবেনা?
– অনিমা
-কেন I কি হইছে ? কেউ কিছু বলছে ?
মুনির কিছু বলল না I তাকিয়ে রইল I হাসিব বিরক্ত কন্ঠে বলল
– কথা কস না ক্যান ?
সবটা শুনে হাসিব বললো
– আমিতো তোরে আগেই কইছিলাম I তখন তো খালি , জাস্ট ফ্রেন্ড ,জাস্ট ফ্রেন্ড করছিস I আরে, চেহারা দেইখা প্রেম হয় না কি ? ওই নীলা খালি দেখতেই সুন্দর I ব্যবহার জংলিদের মত I
মুনির জবাব দিল না দুইহাতে মুখ ঢেকে বসে রইল I হাসিব আস্তে আস্তে ওর কাছে এসে ,কাঁধে হাত রেখে বলল
– এত চিন্তা করিস না I কালকে সকালে হলে গিয়া কথা বলে নে
– আমি দুপুর থেকে ওর হলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম I অনেকবার কল পাঠিয়েছি I ফোন করেছি I মেসেজ দিয়েছি I কোন রিপ্লাই নেই I
– আচ্ছা আচ্ছা হইছে I হল থেকে কই যাইব I মেসেজ দিয়া রাখ I সময় মত দেখবো I ওঠ এখন I চল খাবি I
মুনির খেতে পারল না I সারারাত ছটফট করল I শেষ রাতের দিকে ঘুম এল I সেই ঘুম ভাঙলো অনেক দেরিতে I আজ শুক্রবার তাই কারো অ্যালার্ম বাজেনি I ঘুম ভেঙে দেখল সাড়ে এগারোটা বাজে I কোনমতে তৈরি হয় ও অনিমার হলে চলে গেল I আজ ও কালকের মতই অবস্থা I অনেক বার কল পাঠানোর পরও কোনো রিপ্লাই আসছেনা I যথারীতি ওর ফোন বন্ধ I উপায়ন্তর না দেখে মুনির রাস্তার ধারেই একটা চিঠি লিখতে বসল I কিছু মাথায় আসছে না I মাথা কেমন ফাঁকা হয়ে আছে I মুনির কোনমতে লিখল
সরি সরি সরি আমার সঙ্গে একবার দেখা করো প্লিজ প্লিজ প্লিজ
কিছুক্ষণ পর নীলাকে নেমে আসতে দেখা গেল Iনীলা এসে হাসতে হাসতে বলল
– এতবার সরি বলতে হবে না মুনির I তোমার তো এখানে কোন দোষ নেই I
– ওয়েট ওয়েট i আমি তোমাকে কখন সরি বললাম ?
নীলা শব্দ করে হাসতে আরম্ভ করলো I তারপর ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে বললো I
– তাহলে এটা কি ?তুমি কি বলতে চাও এবার ও আগের মতো ভুল করে এটা আমার কাছে চলে এসেছে I তুমি আসলে ওই অনিমাকে সরি বলছিলে ?
মুনির হতভম্ব হয়ে গেল I এবং প্রথমবারের মতো ও বুঝতে পারল ভুলটা কোথায় হয়েছে I অনিমার হলে এসে ও প্রায়ই কল দিত I ওর রুম নাম্বারটা ও ভালোই জানে I সেদিন পার্সেল দিতে এসে ও অনিমার রুম নাম্বারটাই লিখেছিল I যে পার্সেলটা পৌঁছে দিয়েছে সে কোন ভুল করেনি I আজও একইভাবেই বাংলাতেই লিখে দিয়েছিল চুয়াল্লিশ I কিন্তু যে পৌছে দিতে গেছে সে ভুল করে অন্য রুমে দিয়ে দিয়েছে I মুনির চিঠিটা টেনে নিয়ে বলল
– এটা তোমার জন্য ছিল না
– মানে ?
– আমি তোমাকে কেন সরি বলবো ? বরং তোমার উচিত অনিমাকে সরি বলা I
– আমি সরি বলবো ? তাও আবার অনিমাকে I ওর মত একটা ফালতু মেয়েকে আমি সরি বলবো ? তোমার মাথা ঠিক আছে তো ?
– তোমাকে একটা কথা বলব নীলা ?
– কি ?
– থ্যাঙ্ক ইউ Iথ্যাংক ইউ সো মাচ I
নীলাকে এবার একটু প্রসন্ন মনে হলো I একটু হেসে বলল
– আমি এখনো হ্যা বলেনি I তার আগেই থ্যাংক ইউ বলছ
– তাতে আসলে কিছু যায় আসে না I তুমি যা করেছ সেটাই অনেক I আমি চিরকাল তোমার আছে কৃতজ্ঞ থাকব I
নীলার মনটাই ভালো হয়ে গেল I নবীন বরণের দিন নীলা খুব যত্ন করে সেজেছিল I কেন জানিনা ওর মনে হচ্ছিল আজ হয়তো মুনির ওকে প্রপোজ করবে I কিন্তু মুনির ওকে দেখে চোখ মুখ অন্ধকার করে ফেললো I ওর ধারে- কাছেও আসলো না I অনুষ্ঠান শুরুর কিছুক্ষণ আগে হাসিব জোর করে ওকে ধরে নিয়ে এলো I তারপর বলল ফাইনাল রিহার্সেল টুকু করে ফেলতে I এখনই আনুষ্ঠানিকভাবে অনুষ্ঠানের সূচনা করা হবে I প্রথমেই থাকবে ওদের যুগল উপস্থাপনা I মুনিরকে খুব নার্ভাস দেখাচ্ছিলো I রিহার্সালেরএক পর্যায়ে মুনির আস্তে আস্তে বলল
– তুমি কি আমার পার্সেলটা পেয়েছ ?
– কিসের পার্সেল ?
মুনির অবাক হয়ে বলল
– পাওনি?
– না I কি ছিল ওটাতে ?
– একটা শাড়ি আর …
– আর কি ?
নীলা কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইল I
মুনির জবাব দিল না I গভীর চিন্তায় ডুবে গেল I কেন যেন মনে হচ্ছে কোথাও একটা ভুল হয়েছে I ও কি রুম নাম্বার লিখেছিল কিছুতেই মনে করতে পারল না I
নীলা আবারো কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইল I
– কি হলো I বললে না কি ছিল ? প্রেমপত্র ছিল নাকি
– ওই রকমই I
মুনির আনমনা হয়ে বলল I নীলা হাসতে হাসতে বলল
– দেখো আবার তোমার প্রেমপত্র কার হাতে গিয়ে পড়ে I
হঠাৎ মুনিরের মাথায় ভয়ঙ্কর একটা চিন্তা এলো I ও বোধহয় ভুল করে অনিমার রুম নাম্বার লিখে ফেলেছে I এখন যদি অনিমা ধরে নেয় ওটা ওর জন্য ছিল I তাহলে কি হবে ? না না নিশ্চয় সে রকম কিছু হবে না I সেরকম হলে তো অনিমা ওকে ফোন করতো I এত দেরি হয়ে গেল এখনও আসছে না কেন ?
অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হয়ে গেছে I ওরা দুজন স্টেজে উঠে গেল Iমুনির কিছুতেই মন বসাতে পারছেনা Iথেকে থেকে ভীষন চিন্তা হচ্ছে I অনিমাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না I অথচ এখনই ওর গান শুরু হওয়ার কথা I মুনির পাশ ফিরে হাসিবের দিকে তাকালো I স্টেজ এর বাইরে থেকে হাসিব হাত তুলে ইশারা করলো সব ঠিক আছে I গানের অ্যানাউন্সমেন্ট যেন করে ফেলা হয় I স্টেজ থেকে নেমে মুনির একপাশে দাঁড়িয়ে রইল I যে ভয়টা পেয়েছিল সেটাই হয়েছে I ও কি করে অনিমাকে এটা বলবে যে এই শাড়িটা ওর জন্য ছিল না I অনিমা ভীষণ কষ্ট পাবে I এই কথাটা ওকে কোন ভাবেই বলা সম্ভব না I কিন্তু সত্যিটা তো বলতে হবে I নীলা হাসতে হাসতে কাছে এসে বলল
– দেখেছ কি মজা হয়েছে
– কি ? মুনির অবাক হয়ে জানতে চাইল
– আরে ,অনিমা তোমার শাড়িটা পড়ে এসেছে I ওই মেয়ে ভেবেছে তুমি ওকে প্রপোজ করেছ I কি হাস্যকর I
– এতে হাস্যকর কি আছে ?
– হাসির ব্যাপারই তো I দাঁড়াও আমি এখনই ওকে বলছি I
নীলা স্টেজের দিকে দৌড়ে গেল Iমুনির অনেক চেষ্টা করল ওকে আটকানোর কিন্তু কোন লাভ হল না I অনিমাকে অপমান করার এত চমৎকার সুযোগ ও কিছুতেই হাতছাড়া করবে না I এমনিতেই সারাক্ষণ মুনিরের সঙ্গে আঠার মতো লেগে থাকে I এবার ওর আচ্ছা মতন শিক্ষা হবে I নীলা ওর মনের সমস্ত রাগ উগরে দিল I খুবই আনন্দ হচ্ছিল ওর I কিন্তু মাঝখান থেকে মুনির বলে বসল যে এই ঘটনাটা না ঘটলে নাকি ও জানতেই পারতো না যে নিলা কেমন I এই কথার মানে কি ? সে যাই হোক I এখন তো নিজে থেকে এসেই সরি বলছে I শুধু সরি না থ্যাংক ইউ বলেছে I আবার কৃতজ্ঞ একথা ও বলছে ? দারুন I নীলা খুশি মনে বললো
– আর কৃতজ্ঞ হতে হবে না I তবে তোমাকে একটা কথা বলে রাখছি I আমার সঙ্গে থাকতে গেলে আর ওই অনিমার নাম মুখে আনা যাবেনা I
-সেটা তো সম্ভব না I অনিমা আমার লাইফের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ I ওকে ছাড়া আমার একটুও চলবে না I
– তাহলে আমার কাছে কেন এসেছে ?
– আমিতো তোমার কাছে আসেনি I তুমি নেমে এলে I আমি ওর কাছে এসেছিলাম I তবে তোমার সঙ্গে কথা হল I এটা ও খারাপ না I তোমাকে ধন্যবাদ জানানোটা ও জরুরী ছিল I তুমি না থাকলে আমি কোনদিন বুঝতেই পারতাম না যে আমি ওকে কতটা ভালোবাসি I আমি ওর মধ্যে এতটাই ডুবে ছিলাম যে আলাদা করে ওকে কখনো বুঝতেই পারিনি Iঠিক যেমন আমরা বাতাসের মধ্যে ডুবে থাকি I আর যেই মুহূর্তে সেদিন ও দৌড়ে চলে যাচ্ছিলো আমি বুঝলাম বাতাস ছাড়া তো আমরা এক মুহূর্ত বাঁচতে পারব না I নিঃশ্বাসই নিতে পারব না I সেই মুহূর্তে আমি রিয়েলাইজ করলাম ওকে ছাড়া ও আমি বাঁচতে পারব না I
নীলার সমস্ত শরীর যেন অগ্নিদগ্ধ হতে লাগল I ও কাটা কাটা গলায় বলল
– তাহলে তো তুমি দেরি করে ফেলেছে I তোমার বাতাস বা অক্সিজেন তো সকালবেলায় বাক্স-পেটরা গুছিয়ে চলে গেছে I
-কোথায় গেছে ? মুনির চিন্তিত গলায় বলল
– তার আমি কি জানি ? তোমার অক্সিজেন তুমি খুঁজে বের করো I
চলবে………