তোমাকে শুধু তোমাকে চাই
পঞ্চম পর্ব
জানালার সাথে মাথা ঠেকিয়ে দূর আকাশের দিকে চেয়ে বসে রইল অনিমা I অনেকক্ষণ হয়ে গেছে নামতে ইচ্ছা করছে না I অনিমার দেশের বাড়ি পঞ্চগড় Iওদের এই দোতালা বাড়িটার জানালা দিয়ে দূরে মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকতে খুব ভালো লাগে I ঢাকায় যাবার পর এই জায়গাটা ও সবচেয়ে বেশি মিস করেছেI ওকে এভাবে একা আসতে দেখে বাবা-মা দুজনই খুব অবাক হয়েছেন I ঢাকা থেকে আসতে বেশ অনেকটা সময় লাগে I ভেঙে ভেঙে আসতে হয় I তাছাড়া এর আগে অনিমা কখন এত দূরে একা থাকেনি I তাই ওকে একা আসতে নিষেধ করে সবসময় I বছরে তিন চারবার বাবা এসে নিয়ে যায় I ঈদের সময় , পরীক্ষা শেষ হলে কিংবা লম্বা কোন ছুটি থাকলে I অবাক হলেও বাবা-মা দুজনই খুব খুশি হয়েছেন I
বাবার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না I অনিমা এসে বলল তোমাদের খুব দেখতে ইচ্ছা করছিল Iগতকাল বিকেলে এসে পৌঁছেছে ও I অনেক কিছু রান্না করেছিলেন মা ওর আসা উপলক্ষে I অনিমা বিশেষ একটা খেতে পারেনি I বাবা মায়ের মন রাখতে একটুখানি মুখে দিয়েছে I সকাল থেকে এখানেই বসে আছে I বারবার শুধু আগের কথা মনে পড়ছে I
ক্লাস শুরু হবার অনেকদিন পর্যন্ত মুনিরের সঙ্গে কখনো কথা হয়নি ওর I প্রথম কথা হলো যেদিন ,প্রথম ক্লাস টেস্টের রেজাল্ট দিল I প্রথম পরীক্ষা বলে সবাই খুব হালকাভাবে নিয়েছিল I ঢাকার বিখ্যাত কলেজ থেকে পাস করা অনেকেই ওভার কনফিডেন্ট ছিল I সেই তুলনায় আত্মবিশ্বাসের অভাবি অনিমা পরিশ্রম করেছিল অনেক I হয়তো সেই কারণেই ওর নাম্বার সবচাইতে বেশি ছিল টেস্টে I ক্লাসের মধ্যে চুপচাপ ,এক কোনায় বসে থাকা মেয়েটার এইরকম রেজাল্ট কেউ আশা করতে পারেনি I সবচাইতে বেশি ধাক্কা খেয়েছিল মুনির I আজ পর্যন্ত কোন পরীক্ষায় সেকেন্ড না হওয়া মুনিরের এই রেজাল্টটা মেনে নিতে কষ্ট হয়েছিল খুবI পাশাপাশি কৌতুহল ও হয়েছিল যে মেয়েটা কি এমন লিখল যেটা ও লিখতে পারেনি I পরদিন অনিমা সেমিনারে বসে নোট তৈরি করেছিল, মুনির কাছাকাছি এসে বলল
– একটু বসতে পারি ?
অবাক হয়েছিল সেদিন অনিমা I সহপাঠী একজন এরকম ভাবে কথা বলে ,ভাবতে পারেনি I একটু হেসে বলেছিল
– অবশ্যই
– আসলে পরীক্ষার ব্যাপারে একটু কথা বলতে চাচ্ছিলাম I
– হ্যাঁ বল
– মানে আমি ঠিক বুঝতে পারছি না আমার নাম্বার কেন কম এসেছে
– তুমি কি আমার কাছে এটা জানতে এসেছো , নাকি আমার নাম্বার বেশি কেন এসেছে সেটা জানতে চাও ?
মুনির ধাক্কার মতো খেল I মেয়েটাকে দেখে বোঝা যায় না যে ও কথাবার্তায় এতটা স্মার্ট I কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলনা ও I অনিমা নিজে থেকেই বলল
– শোনো, আমি বলছি কেন আমার মার্কস বেশি এসেছে I তোমরা শুধু বইয়ের পয়েন্ট গুলো দিয়েছে I কিন্তু ক্লাস লেকচারে স্যার আরো চারটা পয়েন্ট বলেছিলেন I আমি সেগুলো ও লিখেছিলাম I তাই হয়তো ওনার ভালো লেগেছে I মুনির বেশ অবাক হলো I অনিমা নোট তৈরি করেছে কিনা জানতে চাইল ও I অনিমা অবলীলায় ওর খাতা এগিয়ে দিয়ে বলল
– এখানেই সব আছে I আমি আসলে খাতায় লিখি I
– আমি কি একটু দেখতে পারি ?
– আমাকে আসলে এখন যেতে হবে I তা না হলে বাস মিস করবো I তুমি চাইলে খাতাটা নিয়ে যেতে পারো I কালকে ফেরত দিলেই হবে I
মুনির হতভম্ব হয়ে গেল I ডিপার্টমেন্টে কেউ নোট দেয়া তো দূরে থাক ,দেখতে পর্যন্ত দেয় না I সেখানে এই মেয়ে হাইয়েস্ট মার্কস পেয়েও অবলীলায় নিজের নোট দিয়ে দিল I
পরদিন যখন খাতাটা ফেরত দিয়েছিল ,মুনির একটা খুব অদ্ভুত প্রশ্ন করলো I অনিমা সেটা ঠিক আশা করেনি I
– তুমি কি গান গাও ?
– হ্যাঁ I কেন ?
– তোমার খাতার মধ্যে অনেকগুলো গান লেখা দেখলাম I
– ও হ্যাঁ I এটা আগে আমার গানের খাতা ছিল I
– তুমি কতদিন ধরে গান গাও ?
– ছোটবেলা থেকেই
– স্টেজে গান করেছো কখনো ?
– অনেকবার I আমি জেলা পর্যায়ের চ্যাম্পিয়ন ছিলাম I ঢাকায় একবার এসেছিলাম একটা কম্পিটিশনে I
– তাহলে ডিপার্টমেন্টের অনুষ্ঠানে গান করো না কেন ? মুনির অবাক হয়ে জানতে চাইল I অনিমা মাথা নিচু করে বলল
– এমনি
– সামনেই তো পিকনিক I আমরা কাউকে খুঁজছি গানের জন্য I আর আমাদের হাতের কাছেই এত বড় শিল্পী I দাঁড়াও আমি এখনই হাসিব কে ডাকছি I
সেই থেকেই অনিমার ডিপার্টমেন্ট এ গান গাওয়া আর মুনিরের সঙ্গে বন্ধুত্বের সূচনা I মুনিরের সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব নিয়ে সবাই হাসাহাসি গা টেপাটেপি করেছিল I ওর মতো একটা মেয়ের সঙ্গে , আদ্যোপান্ত ঢাকায় থাকা স্মার্ট মুনিরের বন্ধুত্বটা সবাই ঠিক মেনে নিতে পারছিল না I মুনির অবশ্য পাত্তা দেয়নি I কখনো-কখনো অনিমার মনে হয়েছে সবাই এরকম করছে বলে হয়তো ইচ্ছে করেই মুনির ওর সঙ্গে আরও বেশি করে মিশছে I মাঝে মাঝে কোনো কারণ ছাড়াই এসে বলতো চলো চা খাই I প্রথম দিকে অনিমা অবাক হতো I মনে হত পুরোটাই হয়তো একটা ভান I কিন্তু একটা সময় পরে বুঝতে পেরেছিল মুনির আসলে অন্য সবার মতন নয় I ওর মধ্যে কোন অহংকার নেই I কখনো কোন স্বার্থের কারণে অনিমার কাছে আসেনি I সব সময় খুব সহজ ভাবে মিশেছে I আর অনিমা তো বরাবরই খুব আন্তরিক I তাই এদের বন্ধুত্বটা হয়েছিল খুব তাড়াতাড়ি I
ক্লাসের অন্য কোন মেয়ের সঙ্গে অনিমার বন্ধুত্ব হয়নি I খুব বেশি মেয়ে ছিল না ওদের ক্লাসে I এই গোটা দশেক I এর মধ্যে সবাই ঢাকার I সবার ঝকঝকে পোশাক-আশাক , ইংরেজি ঢঙে বাংলা উচ্চারণ ,এসবের সাথে মানিয়ে নিতে পারেনি অনিমা I ওদের মত করে নিজেকে পরিবর্তন করার চেষ্টা ও করেনি কখনো I হলের পাশের রুমের রেবা , ওর ও একই অবস্থা I ইকোনমিক্স এ চান্স পেয়েছে I এসেছে একেবারে অজ পাড়া গাঁ থেকে I ওদের দুজনের বন্ধুত্ব হয়েছিল ভালোই I মনমানসিকতায় বেশ ভালো মিলেছিল I কিন্তু সমস্যা ও ছিল একই রকম I ওদের পুরাতন ছাটের জামা , তেল মাখানো চুলে লম্বা বেণী সহপাঠীদের হাসির খোরাক হয়েছে সব সময় I
অনিমা একদিন সকাল সকাল গোসল করে ভেজা চুল খুলে এসেছিল I অনেকখানি লম্বা চুল ওর I খুব সাধারন একটা গোলাপী জামা পরে এসেছিল I ক্লাসের অনেকেই আড় চোখে দেখছিল ওকে I একটা ক্লাস অফ আর তারপরেই ক্লাস টেস্ট I অনিমা লাইব্রেরীতে বসে পড়ছিল I কোত্থেকে হঠাৎ মুনির এসে বলল
– আর পড়তে হবে না I চলো চা খেয়ে আসি I
অনিমা একটু অবাক হল I এই সময়ে সাধারণত সবাই ডিপার্টমেন্ট এর পেছনে গিয়ে চা খায় I দুজনকে একসঙ্গে দেখে সবাই একটু ফিসফিস করছিল I মুনির গুরুত্ব দেয়নি I ওদের সঙ্গে দাঁড়ায়নি সেখানে I কাগজের কাপে চা নিয়ে বলল
– চলো হাঁটতে হাঁটতে চা খাই
তখন বসন্ত শেষ হয়ে এসেছে I চারিদিকে প্রচুর জারুল ফুটেছে I কৃষ্ণচূড়ায় রঙ ধরতে শুরু করেছে I হাঁটতে হাঁটতে ওরা কার্জন হলের ভেতরে চলে গেল I কিছুটা দূরে গিয়ে মুনির বলল
– বসবে ?
দুজন সিঁড়ির মধ্যে বসল একটু দুরত্ব রেখে I অনিমার কেন যেন মনে হলো মুনির কিছু বলতে চায় I কিন্তু ঠিক সহজ হতে পারছে না I
– তুমি কি কিছু বলতে চাও মুনির ? কোন সমস্যা ?
– হ্যাঁ I কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছিনা কিভাবে বলব I
অনিমা একটু কৌতূহল নিয়ে তাকালো I মুনির আবারো বললো
– তুমি আবার কি না কি মনে করো I
– বলে ফেলো I আমি কিছু মনে করব না
– আসলে প্রথম পরীক্ষায় তুমি যখন আমার থেকে বেশি নাম্বার পেলে আমার খুব রাগ হয়েছিল I আমার সঙ্গে কখনো এমন হয়নি I আমি সবসময়ই সবার চেয়ে ভালো রেজাল্ট করে এসেছি I কখনো আমার কম্পিটিটর কেউ ছিলনা I কোন ইনসিকিউরিটি কাজ করেনি কোন সময় I অপ্রতিদন্ধি ভাবে আমি সব সময় ভাল রেজাল্ট করে এসেছি I হয়তো এই কারণে ভেতরে ভেতরে একটু অহংকার ও ছিল I আমি দেখতে চাইছিলাম তুমি কি করে এটা করলে ? আন্তরিকতা নিয়ে তোমার কাছে যাইনি বরং এক ধরনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে গিয়েছিলাম I কথাটা তোমাকে না বললে মনের মধ্যে একটা খচখচানি থেকে যেত I কিন্তু সেদিন তোমার সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম যে তুমি আর সবার মতো না I
– আমি কিরকম ?
– তুমি একটু সহজ সরল I তবে যথেষ্ট বুদ্ধিমতি I আর তোমার মধ্যে কোন ভান নেই
অনিমা হেসে ফেললো I বলল
– আর ?
– আর গোলাপীতে তোমাকে খুব সুন্দর লাগে I
অনিমা চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল
– আমার বাবা ও এই কথা বলে
মুনিরের আচার-ব্যবহারে সব সময় ওর বাবার ছায়া দেখেছে অনিমা I নিজের অজান্তেই কখন ওর মনের একটা বড় অংশ দখল করে নিয়েছে ও নিজেই বুঝতে পারেনি I কিন্তু এই সবকিছুতো একতরফা ছিল I মুনির তো কখনো ওকে ভালোবাসেনি I এখন হয়তো খারাপ লাগছে ওর জন্য I দয়া হচ্ছে I কিন্তু অনিমা তো দয়া ,সহানুভূতি চায়নি I নিজে থেকে কিছু বলতোও না কখনো I
অনিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল I আর ওদের মুখোমুখি হতে ইচ্ছা করছে না I নীলা নিশ্চয় এতক্ষণে ক্লাস শুদ্ধ সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে I সেসব তবুও যাহোক সহ্য করে নেবে অনিমা I কিন্তু মুনিরের দয়াটা নিতে পারবেনা I
খুব ভালো হতো যদি আর ফিরে যেতে না হতো I মনে মনে চেয়েছিল ঠিকই ,কিন্তু তখন ও ভাবতেই পারেনি যে সত্যি সত্যি ওর আর ফিরে যাওয়া হবেনা I
চলবে ………..