মেঘের আড়ালে চাঁদ পর্ব ২৯

#মেঘের আড়ালে চাঁদ ❤
#writer: মহসিনা মুক্তি
#পর্বঃ উনত্রিশ

রিভলবার দিয়ে ইশারা করে কাছে আসতে বলে। কিন্তু তুলতুল ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। সে নড়ছে না যেনো পুতুল হয়ে গিয়েছে। লোকটি তুলতুলকে দেখার পরই তুলতুলকে এ পযন্ত দুবার ডেকেছে কিন্তু তুলতুল ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। লোকটি রাগী দৃষ্টিতে তুলতুলের দিকে তাকিয়ে ওর দিকে এগোতে লাগে তখন তুলতুলের হুঁশ হয়। সে পাশে তাকায় দেখে পাশের মেয়েটি তাকে ফেলেই চলে গেছে। কি স্বার্থপর! তাকে নিতে যেয়েই তো লোকটার নজর তুলতুলের দিকে পড়লো আর মেয়েটা ওকে ফেলে চলে গেলো। তুলতুল আর কিছু না ভেবে পিছনে ফিরে দৌড় দেয়। ঐ লোকটিও তুলতুলের পেছনে আসতে আসতে তাকে থামতে বলে, কিন্তু তুলতুল থামে না। ওকে গুলির ভয় দেখালেও থামে না। তুলতুলের মাথায় ঘুরছে একবার যখন দৌড় দিয়েছে যাই হয়ে যাক না কেন সে থামবে না, গুলি চালালেও না। তুলতুল দৌড়ে কলেজ গেটের দিকে অগ্রসর হয়, যাতে এখান থেকে বেরোতে পারে। কিন্তু তুলতুলের ভাগ্য খারাপ। গেট লক করে রেখেছে, তুলতুল টানাটানি করেও খুলতে পারে না। আর লোকটি পেছনে এসে বিদঘুটে হাসি দিয়ে বলে

-” হা হা হা, খুলছে না বুঝি? কাম টু মি, আমি তোমাকে বাইরে যাওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দিচ্ছি।” বলে লোলুপ দৃষ্টিতে তুলতুলের দিকে তাকায় তারপর ওর দিকে এগিয়ে আসতে লাগে। তুলতুলের নিঃশ্বাস আঁটকে আসছে, চোখ ভিজে যাচ্ছে, ভয়তে তার দাঁড়িয়ে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে। তারপরও তুলতুল নিজেকে শক্ত করে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে চেঁচিয়ে বলে

-” আমার কাছে আসবি না খবরদার বলে দিলাম। ভালো হবে না কিন্তু।”

-“উপস! ভয় পেয়েছি।” বলে লোকটি বুকে হাত দিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে পড়ে আবার বললো

-” রুশান ভাই আমার ঠিকই বলে, প্রান্তর বোন একটা জিনিস বটে। আমিও নিজের চোখে দেখে বলছি সেই” তারপর সুর করে ব্যাঙ্গাত্মক ভাবে বলে

-” ওওও ললনা তোমার শাড়ির আঁচল… ” আর বলতে পারে না। তুলতুল পাশ থেকে ভাঙা মোটা গাছের ডাল লোকটির দিকে ঢিল মারে। এতে লোকটির চোয়াল আর চোখের নিচের দিকে কেটে রক্ত বের হয়। বড় না হলেও মাঝারি সাইজের হওয়ার সাময়িক সময়ের মতো লোকটি ব্যালেন্স হারায়। এই ফাঁকে তুলতুল অন্যদিকে ছুট দেয়। কিন্তু লোকটি নিজের মুখ থেকে হাত সরিয়ে তুলতুলের দিকে ক্রুর ভাবে তেড়ে যায়

-” আমার সাথে চালাকি তাইনা? নাঈমের সাথে বিটলামি করিস? আজকে তোর সব তেজ আমি ছুটাবো।” তুলতুল লোকটার কথা শুনে আরো জোরে দৌড় দেয়, সে ক্লাস রুমের বারান্দায় উঠে দৌড় দেয়। নাঈম পাশ থেকে গুলি ছোড়ে কিন্তু সেটা একটু জন্য তুলতুলের গায়ে না লেগে তার সামনে একটা ক্লাস রুমের কাঁচের জানালায় লাগে। কাচ ভেঙে ঝনঝন শব্দ হয়। তুলতুলের পায়ের সামনেও কাচ সিটকে পড়েছে। সেটা দেখে তুলতুলের জান যায়যায় অবস্থা। কে বাঁচাবে এখন তাঁকে? তুলতুল দ্রুত পাশের একটা রুমে ঢুকে দরজা লাগাতে যাবে কিন্তু নাঈম এসে দরজা হাত দিয়ে ঠেকায়, পাশ থেকে তুলতুল অনবরত জোরে ধাক্কা দিচ্ছে কিন্তু পারছে না। নাঈম দাঁত বের করে বিশ্রী হেসে বলে

-” এবার যাবি কোথায়? কে বাচাবে তোকে?” চোখ আর চোয়াল থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ায় তাকে আরো খারাপ লাগছে। হাসার কারণে কিছু রক্ত দাঁতের ওপরও পড়ে বিশ্রী লাগছে। সে গায়ের জোর দিয়ে দরজা ধাক্কা দেয়, দরজা খুলে যায় এতে আর তুলতুল ফ্লোরে সিটকে পড়ে যায়। পড়ে যাওয়ার কারণে শাড়ি টাখনুর একটু ওপরে ওঠে। পা বেশি দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু নাঈমের কলুষিত মন এতেই তুলতুলকে চোখ দিয়ে গিয়ে খাওয়ার মতো করে তাকায়। তুলতুল তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায়, যদিও হাঁটুতে লেগেছে কিছুটা কিন্তু এ ব্যাথা এখন তার কাছে কিছু না। তার নিজেরই নিজেকে বাঁচাতে হবে, কেউ আসবে না তাকে বাঁচাতে। তুলতুল এদিক সেদিক তাকায় ক্লাসের কিন্তু নিজেকে রক্ষা করার মতো কিছুই দেখতে পায় না। সে অসহায়ের মতো কিছু না কিছু খুঁজতে থাকে, তা দেখে নাঈম দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে

-” আহারে! কিছু পাচ্ছো না বুঝি? দরকার নেই আমি আছি তো। পালানোর উপায় তো নেই আবার বাইরেও আমার লোকজন দাড়ানো। হা হা হা।” নাঈম ক্লাস রুমের স্টিলের দরজা ঠাস করে লাগিয়ে লক করে দেয়। কেউ হাজার ধাক্কা দিলেও ভাঙবে না। দরজা লাগানো দেখে তুলতুলের কলিজা কেঁপে ওঠে। আর কি কিছুই করার রইল না তার? তার ওপর হিংস্রর মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে হয়তো। তুলতুল আল্লাহ, আল্লাহ করছে। সে যেনো কোনোভাবে এ বিপদ থেকে রক্ষা পায়। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে তুলতুল , তা দেখে নাঈম পৈচাশিক আনন্দ পায়। তুলতুলের কান্না কেউ শুনছে না। এই বদ্ধ রুমের দেয়ালে চিৎকারের মতো কান্না গুলো মিশে যাচ্ছে। কেউ নিজের মানসম্মান হারানোর ভয়ে আর্তনাদ করছে, আর কেউ তা দেখে হাসি দিচ্ছে, অথচ বন্ধ দরজার ওপাশে সবকিছু ঠান্ডা, নিরব, যেনো কিছুই হয়নি। কিছু মানুষ রুপি পশু জানে মেয়েটির সাথে কি হবে কিন্তু তারা নিজের চোখ কান বন্ধ করে নিজের কাজ করবে, আদেশ পালন করবে, কিন্তু কারোরই মেয়েটিকে বাঁচানোর ইচ্ছা নেই। থাকতে কিভাবে তারাও যে একই ধরনের মানুষ, বন্ধ দরজার আড়ালের মানুষের চিৎকার শুনে তারা তৃপ্তি পায়, তাদের কাছে মনে হয় তাদের দলপ্রধান সাহসী, কিন্তু তারা একটি বার নিজের পরিবারের কথা ভাবে না যে এই রকম অবস্থায় যদি তাদের পরিবারের সদস্য কেউ পড়তো তখনও কি এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতো আর মজা নিত? নাঈম তুলতুলের কাছে এগিয়ে এসে ওর গালে হাত দিতে গেলে তুলতুল পিছিয়ে গিয়ে বলে

-” কেনো এমন করছেন? আমাকে যেতে দিন। আপনার পরিবারের কারো সাথে যদি কেউ এমন করত তাহলে নিশ্চয়ই আপনার ভালো লাগতো না।”

-” ওহো! তুই থেকে আপনি? বাহ ভালো! আর আমাকে ইমোশনাল ব্লাকমেইল করার চেষ্টা করে লাভ নেই। দূরে কেনো কাছে আসো কি যেনো বলছিল?” বলে তুলতুলের শাড়ির আঁচলে হাত দেয় আর তুলতুল বেঞ্চের নিচে পড়ে থাকা ডাস্টার উঠিয়ে কোণা দিয়ে নাঈম চোখ বরাবর আঘাত করে। নাঈম এতে চিৎকার দিয়ে উঠে বসে পড়ে। তার হাতে এখনো আঁচল রয়েছে। তুলতুল জোরে টান দিয়ে হাত থেকে ছাড়িয়ে নেয়। ভাগ্যিস সে দুইটা সেফটিপিন লাগিয়েছিল আর শাড়ির আঁচলও বড় ছিল। এজন্য আঁচল টান দিলেও সরে নি।

-” ভালো করে নিজের দিকে তাকা। আমার কেউ লাগে না বুঝলি।” তুলতুল ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বলে দরজার দিকে আগায়। আর নাঈম একহাত দিয়ে চোখ চেপে ধরে আরেক হাত দিয়ে তুলতুলের দিকে গুলি ছোড়ে। এতে তুলতুল স্তব্ধ হয়ে যায়। গুলিটা কি তার লেগেছে? সে কি এখন এই বন্ধ দরজার ভেতরই মারা যাবে? শেষমেশ কি নিজেকে বাঁচাতে পারলো না? কেউ কি আর তাকে খুঁজে পাবে না? কিন্তু সে ব্যাথা অনুভব করছে না কেন? তাহলে কি সাথে সাথে মরে গিয়ে ভূত হয়ে গিয়েছে? নাহ তা হতে পারে না। তুলতুল নিজের দিকে তাকিয়ে রক্ত আছে নাকি কোথাও খুঁজে। তারপর নাঈমের দিকে তাকায় দেখে নাঈম ট্রিগার চাপ দিচ্ছে তুলতুল চোখ বড় করে দ্রুত ব্যাঙের মতো করে একটা লাফ দিয়ে বেঞ্চের সাথে ধাক্কা খায়, আর গুলি দরজায় লাগে। স্টিলের দরজা ফুটো হয়ে গুলি বের হয়ে গিয়েছে। তখন নাঈম একচোখ দিয়ে দেখেছে বিধায় নিশানা সঠিক হয়নি। আর এখন তুলতুল একটুর জন্য বেঁচে গেলো। নাঈম ক্রোধ নিয়ে উঠে দাঁড়ায়, চোখের কোণায় রক্ত রয়েছে, রক্তচক্ষু নিয়ে তুলতুলের দিকে এগিয়ে গিয়ে তুলতুলের গলা চেপে দেয়ালে সাথে লাগায়। জোরে হওয়ায় তুলতুল মাথায় আঘাত পায়।

-” ভাবছিলাম তোরে পরে মারমু কিন্তু তুই জিনিস সুবিধার না। তোরে তো আমি এহনি মারমু!” নাঈম গর্জন দিয়ে বলে ওঠে। তুলতুল গলা থেকে নাঈমের হাত সরাতে চেষ্টা করে, তা দেখে নাঈম হাতে নিয়ে আসা সেই ডাস্টার দিয়ে তুলতুলের পেটে জোরে আঘাত করে। আঘাতে তুলতুল ককিয়ে উঠে কিন্তু তার গলা দিয়ে শব্দ বের হয় না নাঈমের চেপে ধরার কারণে। তুলতুল মুখ হা করে শ্বাস নিচ্ছে তাও ভালো মতো পারছে না, এতো জোরে চেপে ধরেছে গলা, তার চোখ উল্টে আসছে। তখনই বিরাট শব্দে জানালার কাচ ভেঙে ঝনঝন শব্দ হয়। তারপর কেউ বাইরে থেকে দরজায় পরপর কয়েকটা গুলি মারে, গুলি দরজা ভেদ করে ভেতর বেঞ্চে লাগে। নাঈম এতে তুলতুলের গলা ছেড়ে দেয়। তুলতুল গলায় হাত দিয়ে নিচে বসে ছটফট করতে থাকে শ্বাস নেওয়ার জন্য। তার শ্বাস নিতেও এখন কষ্ট হচ্ছে। আর নাঈম দাঁত কিড়মিড় করে দরজা খুলে দেখতে যায় কে এমন করেছে, তার ধারণা তার দলের লোকেরা কেউ করেছে কারন আর কেউ তার জানা মতে আসেনি। ওদের শিক্ষা দিয়ে এসে আবার একে দেখবে। নাঈম দরজা খোলার সাথে সাথে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে। দরজা ধাক্কা দিয়ে আবির ভেতরে ঢুকে নাঈমের দিকে রিভলবার তাক করে, আর নাঈম বিস্ফারিত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর রাফসান আস্তে ধীরে পকেটে হাত দিয়ে প্রবেশ করে।

-” কিরে ব্যাটা পড়ে আছোস কেন? ওঠ, লড়াই করবি না? আমার কলেজে এসে কলেজের ভেতর হামলা করিস, সাহস কতো! রাফসানকে এখনো চিনিস নাই তাইনা? শালা লোকজন নিয়ে আসছিস বলে কি ভাবছিস তোর কিছু হবে না? আরে তোর লোকজন আর তোরে শেষ করার জন্য আমার বেশি সময় লাগবে না।” রাফসান তারপর ভালো করে নাঈমের দিকে তাকিয়ে দেখে মুচকি হেঁসে দুঃখজনক শব্দ করে বলে

-” ইশশ! জব্বর মার খাইছিস মনে হয়। শুনলাম কারে নিয়ে যেনো রুমে ঢুকছিস? কে সেই মেয়ে যে তোর এই অবস্থা করছে? কাপুরষ একটা! একটা মেয়ের কাছে এভাবে মার খেয়ে লজ্জা হয় না। তো কই সে মেয়ে তাকে তো সালাম জানাতে হয় নাকি?” বলে রাফসান রুমের ভেতরে চোখ বুলায়, তার চোখ যায় গলায় হাত দিয়ে বসে ছটফট করতে থাকা তুলতুলের দিকে, রাফসান একমুহূর্তের জন্য থমকে যায়। মনে হলো তার ভেতর কেউ ছুরিকাঘাত করছে, আর মেয়েটিকে দেখে তার দম আঁটকে আসছে। কি অবস্থা হয়েছে মুখের, চোখ দিয়ে পানি পড়ছে, চোখ মুখ লাল হয়ে আছে, চুলগুলো কেমন আউলা ঝাউলা, গলায় হাত দিয়ে কেমন যেন করছে, বিধ্বস্ত অবস্থা তার। রাফসান এতোক্ষণ মজা নিয়ে কথা বলছিল কিন্তু তুলতুলের এই অবস্থা দেখে তার নিজেরই গলায় কথা আঁটকে যায়। সে তাও নিজেকে সামলিয়ে কঠিন ভাবে আবিরকে বলে

-” আবির এর মুখে টেপ লাগা, আর দা টা আমার কাছে দে।” রাফসানের কথা অনুযায়ী আবির তাই করে। টেপ লাগানোর পরে রাফসান দা টা দেখতে থাকে। আর নাঈম গুঙিয়ে মানা করছে রাফসান কে নিচে বসে যেনো তার কিছু না করে।

-” গ্যাংস্টার, মাফিয়া এরা হেরে গেলে কি করে জানিস তো? হয় নিজে মরে যায় নাহয় যার কাছে হারে তার হাতে মরে। আর দলনেতাকে কেউ একা পেলে কোনো কারন ছাড়া মেরে ফেলে, আমার কাছে তো তোকে মারার অনেক কারন আছে। তারপর তুই এমন কারো দিকে হাত বাড়িয়েছিস যে আমার.. কি দরকার তোকে বলে। তোকে একটা সুযোগ দেব ভাবছিলাম কিন্তু তুই নিজে সেটা হারালি।” বলে রাফসান নাঈমের হাতের বাহুর ওপর কোপ দেয়। হাত কেটে নিচে পরে যায় কিন্তু নাঈমের গোঙানি ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না। রাফসান নাঈমের পায়ে আবার কোপ দেয়, এতে পা কেটে যায়। নাঈম অজ্ঞান হয়ে যায় দেখে রাফসান আর কিছু করে না কারন এখন মেরে সে মজা পাবে না। সে চায় সব ব্যাথা যেনো ও জ্ঞান থাকা অবস্থায় সহ্য করুক।

-“আবির নিয়ে যা ওকে, জায়গা মতো রেখে পানিতে চুবিয়ে জ্ঞান ফেরাবি। যা নিয়ে যেতে বল।” রাফসানের কথায় আবির লোকজনকে ইশারা করে ওরা এসে নাঈমকে নিয়ে যায়। আবিরও রাফসানকে রেখে চলে যায়। রাফসান তুলতুলের কাছে গিয়ে বসে ওর গালে হাত দিয়ে নাম ধরে ডাকে কিন্তু তুলতুল কিছু বলে না, সে তো কিভাবে নিঃশ্বাস নেবে সেই দিকে ব্যস্ত, নিঃশ্বাস নিতেও তার ভারি কষ্ট হচ্ছে, আশেপাশের কিছুই তার কর্ণকুহরে যায় নি। জোরে গলা চেপে ধরার কারণে লাল দাগ হয়ে আছে যেনো এখনি রক্ত বের হবে। রাফসান তুলতুলকে এভাবে দেখে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে। একে তো নিঃশ্বাস নিতে পারছে না অন্য দিকে ভয়ে সে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছে। কথা বলতে পারছে না।

-” কুল! কিছু হয়নি। আমি আছি, সব ঠিক হয়ে যাবে। ভয় বাদ দিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নাও।” রাফসান তুলতুলের পিঠে হালকা চাপড় দেয় যাতে সে স্বাভাবিক হয়। তুলতুল রাফসানের কথা শুনে ভরসা পায় নিজেকে স্বাভাবিক করার জন্য জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয়। কিছুক্ষন ওভাবেই থেকে রাফসানের শার্ট আকড়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে। কি হতে যাচ্ছল তার সাথে ভেবে। সে যে আদৌও বেচে আছে তার বিশ্বাস হচ্ছে না। রাফসান কিছুই বললো না, সে নিজের অজান্তেই তুলতুলের মাথায় হাত বুলাতে লাগলো। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর যখন তুলতুলের কোনো আওয়াজ পায় না তখন রাফসান তাকে সামনে এনে দেখে তুলতুল জ্ঞান হারিয়েছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে তুলতুলকে কোলে তুলে নিয়ে গাড়ির দিকে যায়। এতো স্ট্রেস নিতে না পেরে জ্ঞান হারিয়েছে, তারপর আবার আঘাতও পেয়েছে, মেয়েটার স্নায়ুবিক দূর্বলতা আছে নাকি,কে জানে? রাফসান তুলতুলকে গাড়িতে নিয়ে বসিয়ে নিজে পাশে বসে, তারপর তুলতুলকে নিজের গায়ের সাথে হেলান দিয়ে হাত দিয়ে তাকে ধরে রাখে। সবকিছুই আবির পর্যবেক্ষণ করে কিন্তু কিছু বলে না।

-” আবির গাড়ি কোনো হাসপাতালের সামনে রাখ, ওকে হাসপাতালে নিয়ে ওর বাড়ির লোককে ফোন দিয়ে আসতে বলবি।” রাফসানের কথায় আবির চিন্তায় পড়ে যায়। সে তো ভেবেছিল তুলতুলকে রাফসান তার বাড়ি নিয়ে যাবে এতে তার আর কষ্ট করতে হবে না, কারন দাদীযে তাকে যেকোনো ভাবে রাফসানের মাধ্যমে তুলতুলকে বাড়ি নিতে বলেছে। এখন আবির কি করবে? সে নখ কামড়ে ভাবে কি করবে আর পেছন থেকে রাফসান ধমকে ওঠে বলে

-” কোন ধ্যানে বসে পড়লি? গাড়ি স্টার্ট কর তাড়াতাড়ি।” তখনই আবিরের ফোন বেজে ওঠে তা দেখে রাফসান আবার বিরক্তি নিয়ে বলে

-” এখন আবার কে ফোন করলো?”

-” দাদি ফোন করেছে।”

-” ফোন ধরে কথা বল।” দাদীর কথা শুনে রাফসান নরম হয়।

-” হ্যালো দাদী! হ্যাঁ বলো।”

-” হ্যাঁ বলো মানে? বলবি তো তুই ব্যাটা। কানের নিচে এমন দিমু না একবারে বইরা হইয়া যাবি। কবে তোরে কইছি মেয়েটারে বাড়ি নিয়ে আইতে? আজকা বাড়ি আয় তোর হাত পা আমি ভাঙমু।” রোমানা চৌধুরী চিবিয়ে চিবিয়ে কথা গুলো বললো। এতে আবিরের মাথায় একটা বুদ্ধি আসলো। সে দ্রুত বলে

-” হ্যাঁ, হ্যাঁ দাদী আমারা আসছি। তুমি চিন্তা করো না।” বলে ফোন টুপ করে কেটে দেয়। সে মনে মনে ভয় পায় এভাবে ফোন কাটার জন্য কিন্তু পরে যখন কারন শুনবে তখন আর কিছু বলবে না। আবির ফোন কাটার পর রাফসান জিজ্ঞেস করে কি বললো। আবির একটু অভিনয় করে অস্থির হওয়ার ভান করে বলে

-” ভাই, দাদীর প্রেশার বেড়েছে,খারাপ লাগছে। আমাদের এক্ষুনি বাড়ি যেতে বলেছে।” রাফসান ঘাবড়ে যায় এতে সে দ্রুত আবিরকে ধমক দিয়ে বলে

-” বসে আছিস কেন? ডাফার! গাড়ি স্টার্ট কর তাড়াতাড়ি। ”

-” কিন্তু ভাই মেয়েটা?”

-” ও আমাদের সাথে বাড়ি যাবে, তুই যদি আর একটা কথা ও বলিস তো আমি তোকে শুট করবো।” রাফসানের কথা শুনে আবির দ্রুত গাড়ি স্টার্ট করে, আর মনে মনে হাসে তার প্ল্যান সাকসেসফুল হয়েছে। আর রাফসান অস্থির হয়ে পড়ে, ওই একটা মানুষই তো আছে নিজের বলতে তারও যদি কিছু হয় তো সে কিভাবে বাঁচবে, সে সময় তুলতুলের মাথা রাফসানের বুকে এসে লাগে। রাফসান চমকে তুলতুলের দিকে তাকায়। মাথা সরিয়ে দিতে গিয়ে কি মনে করে যেনো সরায় না। সে তুলতুলের মুখের দিকে তাকায় কান্নার কারণে কাজল লেপ্টে রয়েছে। রাফসান হাত দিয়ে লেপ্টে থাকা কাজল মুছে দেয়। এরপর তুলতুলের আউলা ঝাউলা চুল হাত দিয়ে ঠিক কটে দেয়। কেন করলো সে নিজেও জানে না। কিন্তু মেয়েটাকে ওভাবে দেখতে তার মোটেও ভালো লাগছিল না। তারপর তুলতুলকে একহাত দিয়ে ধরে রাখে। আবির সামনে মিররে তা দেখে মুচকি হেঁসে গাড়ি চালানোয় মন দেয়। চারপাশে অন্ধকার হয়ে গিয়েছে।

.

দিয়া তিয়াসের বাইকে বসে আছে। যাওয়ার সময় যতটা কাছে বসেছিল এখন ততটাই দূরত্ব রেখে বসেছে সে। তার অভিমান, হচ্ছে প্রচন্ড অভিমান হচ্ছে। সে মুখ গোমড়া করে বসে রইলো। তিয়াস সেটা খেয়াল করে দিয়ার মন ভালো করার জন্য বলে

-” কলেজে কি হয়েছে রে আজকে? শুনলাম অনুষ্ঠান ছিল?” কিন্তু এতেও দিয়া কিছু বললো না। তিয়াস আবার দিয়াকে একই কথা জিজ্ঞেস করে তারপরেও দিয়া কিছু বলে না। সেটা দেখে তিয়াসের রাগ হয়।

-” তুই বলবি নাকি আমি তোকে বাইক থেকে ফেলে দেব?” তিয়াসের কথায় দিয়া তিয়াসকে কড়া কিছু বলতে গিয়েও বলে না। সে আস্তে আস্তে কলেজের সবকিছু খুলে বলে। সব শুনে তিয়াস হেসে বলে

-” তারমানে কলেজে আজকে তোরা কামলা দিয়েছিস?”

-” কি বললেন আপনি, আমরা কামলা দিয়েছি?দিয়া রেগে বললো। তার এমনিতেও রাগ ছিল এখন আবার তিয়াসের কথায় তা বেড়ে গেলো। তিয়াস কিছু বলবে কিন্তু তার মাথায় একটা কথা আসে সে দিয়াকে বলে

-” তার মানে তুই আর তুলতুল একসাথে আসিস নি। তুই আসার পর কি তুলতুল বাড়ি এসেছে? নাকি আনিস স্যার আবার ওকে দিয়ে কাজ করিয়েছে? এই স্যারকে আমি ছাড়বো না।” তিয়াসের কথা শুনে দিয়াও চিন্তিত হয়। তারপর বলে

-” নাহ! এতসময় তো কলেজে থাকার কথা না। হয়তো চলে এসেছে। কারন কলেজ তো বন্ধ হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। ”

-” হতে পারে বাড়ি গিয়েছে, তারপরেও সিউর হতে পারছি না ও যে তুরতুরে কখন কোথায় যায় ঠিক নেই। দেখা গেলো বাবার দোকানে হয়তো বসে আছে। তারপরও টেনশন হচ্ছে।” তিয়াস কথায় দিয়া তাকে চিন্তা করতে মানা করে নিজেই তুলতুলকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলো। তার উচিত হয়নি তুলতুলকে রেখে আসা। তিয়াস দিয়াকে তার বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে বাইক স্টার্ট করে কিছুদূর গিয়ে জোরে দিয়াকে বলে

-” দিয়া তুই যা জানিস তা চারবছর আগের অতীত, আমার হারানো অতীত বুঝেছিস? ভুলে যা সবকিছু যা আমি বলেছি।” দিয়া হা করে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে ভেংচি কেটে বাড়ির দিকে এগোয় ভুলে যেতে বলছে তাকে হুহ্।

তিয়াস বাড়ি গিয়ে শোনে তুলতুল বাড়ি ফেরে নি, দোকানেও যায় নি। তিয়াসের মাথায় বাজ পড়ে এটা শুনে সে অন্তত এটা ধারনা করেছিল যে হয়তো দোকানে থাকবে, কিন্তু না। তিয়াস বাইক নিয়ে দ্রুত কলেজের দিকে রওনা দেয়। কোনো বিপদে পড়ে নি তো?
.

রোমানা চৌধুরী সোফায় বসে আছে গালে হাত দিয়ে। সে রাফসান আর আবিরের অপেক্ষা করছে কখন আসবে তারা। ভাবতে ভাবতেই সে রাফসানের গলা পায়। জোরে জোরে তাকে ডেকে বলছে “বুড়ি তুমি ঠিক আছো?” রাফসান তাকে দেখে শান্ত হয়ে তার দিকে এগিয়ে যায়। রোমানা চৌধুরী উঠে দাঁড়িয়ে রাফসানের কোলে অবস্থিত মেয়েটিকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে

-” মিনি!”

সে দ্রুতই রাফসানের কাছে যায়। যত কাছে এগোয় মেয়েটার চেহারা ততোই স্পষ্ট হয় আর তার মুখে মেদুর ছায়া পড়ে। সে যাকে ভেবেছিল সে নয়। কিন্তু দূর থেকে সে রকমই মনে হয়েছিল। আর রাফসান নামটা শুনে ওখানেই দাঁড়িয়ে যায় তুলতুলকে কোলে নিয়ে। তার ভেতরে ধক করে ওঠে নামটা শুনে।

চলবে…

ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here