চুপি চুপি ইচ্ছেরা পর্ব -০৪

চুপি চুপি ইচ্ছেরা
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি

ছোট হাতে পানি মুঠোয় তুলে সেগুলো সামনে ছিটিয়ে দিয়ে খুশিতে নেচে ওঠলো পিচ্চি মেয়েটা। ছোট ছোট পানিকণা গুলো টুপ করে পানিতে পড়ে তরঙ্গের সৃষ্টি করে, কিছু কিছু আবার ছিটকে সরে আসে। তাতেই কি আনন্দ বাচ্চা মেয়েটার। খিল খিল করে হাসতে থাকে।সামনের দাঁত দুটোও যেনো হাসে। চারটে দাঁতের ফোকলা হাসিতে কি মার্ধুয্য! হাসতে হাসতে ধুপ করে নৌকা থেকে পড়ে গেলো বাচ্চাটা।

লাফ মেরে ওঠে বসে পড়ে ষশ্মিথ শোয়া থেকে। কপালে বিন্দু বিন্দু পানি কণারা ভীর করছে। তিতির বাচ্চাদের মতন ঘুমাচ্ছে ওর পাশে। তাহলে স্বপ্ন ছিল এটা। কিন্তু এরকম স্বপ্নের মানেটা কি? বুঝে পেলো না ষশ্মিথ।ওঠে ডায়েনিং এ গিয়ে ঢক ঢক করে দু’গ্লাস পানি খেয়ে নিলো। রুমে ডুকেই তিতিরের পাশে বসে গভীর চোখে পরখ করে নিলো তাকে। বাম হাতটা মাথার নিচে দিয়ে পরম শান্তিতে ঘুমাচ্ছে তিতির। একমাস হলো মেয়েটা তার কাছে এসছে। আস্তে আস্তে তিতিরের চুলে বিলি কেটে দিলো ষশ্মিথ। আর মেয়েটা এতোই ভালোবাসা কাতর, নরে চরে এসে ঘুমের মাঝেই,ষশ্মিথের বুকে কিছুক্ষন নাক ঘষেঁ মুখ ডুবিয়ে ঘুমিয়ে গেল আবার।

ষশ্মিথের আজ নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছে।তিতিরকে জড়িয়ে ধরে পরম শান্তিতে চোখ বুজলো ষশ্মিথ।
সকালে ঘুম ভাঙ্গে হালকা পানির ঝাপটায়। চোখ দুটো মিট মিট করে খুলে ষশ্মিথ। পাশে তাকাতেই সদ্য গোসল করে আসা তিতিরকে দেখে সব ঘুম পালিয়ে গেলো নিমিষেই। মেয়েটা যেনো চার্জ করে দিলো ষশ্মিথকে। হালকা হলুদ আর গোলাপির কম্বিনেশনে সেলোয়ার কামিজ পড়েছে তিতির। ষশ্মিথ ওঠেছে খেয়াল করেনি। তাই ওড়নাটা এখনো সোফাতেই এলোমেলো ভাবে পড়ে আছে। গভীর মনোযোগ দিয়ে চুল মুছছে তিতির। তাও টপটপ করে পানি পড়ে পিঠের অনেকটা জামা ভিজে গেছে। ষশ্মিথের বেশ ভালো মতো ঘোর লেগেছে। চোখের স্নায়ু মস্তিষ্কে টোকা দিতেই মাথা হ্যাং হয়ে গেছে। এতো মিষ্টি কেনো মেয়েটা ষশ্মিথ ভেবে পায়না!

কয়েক মিনিট পর খাটের দিকে তাকাতেই ভিষণ রকমভাবে লজ্জায় পড়লো তিতির। লোকটা এমন ভ্যাক ভ্যাক করে তাকিয়ে আছে কেনো ওর দিকে? ওকি কোনো শো’পিছ নাকি! ওরনাটা একটানে গায়ে জড়িয়ে বের হয়ে গেলো রুম থেকে তিতির। আর তার কান্ড দেখে মুচকি হাসলো ষশ্মিথ।

রান্নাঘরে ইরিনা রুটি বেলছে সবার জন্য। তিতির ও তার সামনে গিয়ে ধপাস করে বসে পড়লো মেঝেতে। গভীর মনোযোগ দিয়ে রুটি বেলা দেখতে দেখতে টুকিটাকি গল্পও সেরে নিচ্ছে দুই জা’এতে। তিতির মাঝে জোরযবর দস্তি করে ইরিনা থেকে বেলুনি আর পিরি নিয়ে নিলো। শৈলী তিতিরকে রুটি বেলতে উৎসাহ আর রুটির সাইজ দেখে হাসতে হাসতে শেষ। হাসি থামিয়ে বলল,
‘ মা ছাড়ো ওটা তোমার দ্বারা হবে না, তুমি বরং সেকে দিও তাতেই হবে। ‘

ইরিনাকে বেশ পছন্দ তিতিরের। হিন্দি সিরিয়ালের নায়িকা মনে হয় ওর ইরিনাকে। সারাক্ষন লক্ষী বউ সেজে ঘরের কাজ করে। এদিকে তিতির তো রান্নাটুকুও পারেনা। একমাসে শুধু ভাত, ডিম ভাজি, আলু ভর্তা, ডাল রান্না, রুটি সেকা আর চা বানানো শিখেছে। চাওমিনটা আগে থেকেই পারতো। আর ষশ্মিথ বিড়িয়ানি আর মাংস রান্না করা শিখিয়েছে। ষশ্মিথ রান্নাতে এক্সপার্ট, হাতের স্বাদও ভালো। সেদিন যখন কষা মাংস রান্না করেছিলো হাত শুদ্ধু চেটেপুটে খেয়েছিল তিতির। এতো গুনধর স্বামী তার আর সে সামান্য রুটিও বেলতে পারেনা! ভাবতেই গর্বে বুক ফুলে যায় তিতিরের।

সাথে সাথেই মনের গহীনে কোথায় গিয়ে যেনো লাগলো কথাটা। চিলিক মেরে ওঠলো একটা হালকা সূক্ষ ব্যাথা। ওকি আদো কোনোদিন এ জায়গায় ষশ্মিথকে চেয়েছিল? যাকে চাইতো তাকে কেনো পেলনা এভাবে? নিঝুম তো কোনো দিন ওর জন্য কিছু করেনি! তিতিরের খুব ইচ্ছা ছিলো নিঝুম ওকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াবে, একদিনের জন্যই হোক। কিন্তু নিঝুমের মতে এটা শুধু মেয়েদের কাজ। ও কেনো রান্না করতে যাবে? মামি নাহয় বিয়ের কথাটা হঠাৎ যানতে পেরে রাগ করেছে একটু, তবে ষশ্মিথের ফোনে নিঝুম কেনো অবিশ্বাস করবে ওকে?

তবে ষশ্মিথ আলাদা। সবার থেকে আলাদা। লোকটার কাছে একমাস থাকতেই কেমন মায়ায় ধরেছে ওকে। আসলে এবাড়ির সবাই ভালো একমাত্র ষশ্মিথের ফুফুটা বাদে। এই মহিলার বয়স হয়েছে ঠিকি তবে শয়তানি গেলো না। ইরিনা আর তিতিরের নামে খালি কান ভরায় দুই ভাতিজার কাছে। তিতিরের ভাষ্যমতে কুটনি ডাইনি একটা।
তিতির রান্নাতে হ্যাল্প করলো ইরিনাকে। সকালের আলুর দম আর ডিম ভাজি নিজ হাতে তৈরী করছে তিতির। ইরিনা সালাদ বানিয়ে নিয়েছে ফাঁকে। খাবার টেবিলে বসে খুব গম্ভীর কন্ঠে তিতির আর ষশ্মিথকে ষাহবাব বললেন,

‘ তোমাদের বিয়েটা একটা এমন সময় হয়েছিল যখন তোমরা দুজনেই অদায়িত্বশীল ছিলে। আর ষহবাবা শাহরিয়ারের ছেলে বলে কথা, তোমার বউকে ডিফেন্সের কেউ চিনে না এখনো। তাই কাল তোমাদের জন্য একটা গ্রেন্ড রিসিপশন হবে এন্ড স্পট থেকেই তোমরা এয়ারপোর্ট যাবে। সিংগাপুর যাচ্ছো তোমরা।এবং নিজেদের সময় বেশি দেয়ার চেষ্টা কর এখন। ‘

কেউ কিছু বলে ওঠার আগেই ষশ্মিথ লাফিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো ষাহবাবকে,
‘ ওয়াও,আব্বু ইউ আর রিয়েলি গ্রেট। থ্যাংকস। ‘
তিতির হা করে শুধু হজম করলো সবটা। ওর তো ঘুরতে বেশ লাগে সে তা যেকোনো জায়গাই হোক!

বারান্দার কর্ণারে দাড়িয়ে সিগেরেট টানছে ষশ্মিথ। আজ হঠাৎ বাতাস বেড়ে গেছে। সাথে হালকা বৃষ্টিও আছে। গাছের সব পাতাগুলো রাতের আধারে পানিকণার ছন্দের সাথে সমান তাল মিলিয়ে চিলিক দিচ্ছে একটু পর পর। আকাশটাও পরিষ্কার। সূক্ষ এক ফাঁলি হলুদ চাঁদ, আর পাশে কয়েক তারা। ঠান্ডা আবহাওয়া। ভালোই লাগছে। তিতির এখনো ইরিনার সাথে ব্যাস্ত। ইরিনার এক্সাইটমেন্টই বেশি। দৌড়ে দৌড়ে এটা ওটা করে দিচ্ছে।

তিতির ঘরে এসে দেখলো লাইট বন্ধ। চাঁদের মৃদু নীল আলোতে বেশ ভালোই দেখা যাচ্ছে পুরো ঘরটা। বিরক্তির একটা সূক্ষ রেখা কপালে টেনে চাদর মুরি দিয়ে শুয়ে পড়লো তিতির। বারান্দা এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ষশ্মিথকে ভালো ভাবে খেয়াল করছে তিতির। সিগেরেটের ধোঁয়া ছাড়ার সময় বেশ লাগে ওনাকে। মায়াবী মনে হয়। ষশ্মিথ বারান্দা থেকে বার বার উঁকি দিয়ে দেখছে তিতিরকে। তিতিরের কাছে বেশ ভালোই লাগছে ব্যাপারটা। ষশ্মিথকে খুব বলতে ইচ্ছা করছে আপনি যখন সিগেরেট খান না, সেই লাগে আমার কাছে!

কিন্তু বলার কি উপায় আছে? সিগেরেট ভালো না। তাছাড়া ভালোলাগার কথা মরে গেলেও মুখ দিয়ে বের হবে না ওর। কথাটা ভেবেই লজ্জায় লাল হয়ে গেছে তিতিরের কান দুটো। ও ভালোবাসেনা ষশ্মিথকে তাহলে কেনো এই অনুভূতির লুকুচুরি? কেনো এত লজ্জা? নজরে নজরে কেনো এই ভালোবাসার প্রকাশ? কেনো শান্তি নেই মনে?

কোনো উত্তর আসে না ভেতর থেকে। চুপচাপ ওঠে বারান্দায় আসে তিতির। ষশ্মিথ তখন বারান্দার শেষ প্রান্তে দেয়ালে মাথা ঠেকে চোখ বুজে রেলিংএ বসে আছে। হাতে আধখাওয়া সিগেরেট। তিতিরের ভালোলাগা স্বত্তেও কাছে গিয়ে একটানে সিগেরটটা ফেলে দিলো। ষশ্মিথ না তাকিয়েই মুচকি হাসলো। তিতির অভিমানী সুরে বললো,

‘ কেনো কষ্ট দেন নিজেকে? ‘

‘ কারণটা তুমি। ‘

‘ একবার চেষ্টা তো করতে পারি। ‘

‘ কি হবে চেষ্টা করে? নেমে আসবে কি ভালোবাসা ধুপ করে? আমার জন্য। আমি যতই সাঁতরে বাঁচার চেষ্টা করছি তোমার মোহের সমুদ্রু থেকে ততই কেনো ডুবাচ্ছো আমায়? ‘

‘ বেঁচে যাওয়াটা খুব জরুরি কি? ‘

ষশ্মিথ অনেকক্ষন অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো তিতিরের দিকে। কি বললো তিতির? তিতির চলে যাওয়ার জন্য উল্টো দিকে ফিরতেই ষশ্মিথের হাত উল্টো করে পেঁচিয়ে দেয়ালে চেপে ধরে তিতিরকে। হাত মচকে পেছনে ধরায় তিতির প্রচন্ড ব্যাথায় “আহ” বলে চিৎকার করে ওঠলো। ষশ্মিথ ওকে আরো জোরে চেঁপে ধরে পেছন থেকে গলায় নাক ঘঁষে দৃঢ় শ্বাস নিয়ে বললো,

‘ তোর এই দূরে থাকাটা যে আর সহ্য হয় না আমার। কবে বুঝবি তুই! ‘

ষশ্মিথ তিতিরকে ধাক্কা দিয়ে হাতটা ছেড়ে চলে গেলো রুম থেকে। তিতিরও চোখ বুঝে ঠোঁটে কামরে সহ্য করে নেয় ব্যাপারটা। তবে খারাপ লাগেনি। বরং মনের ভিতরে একটা অন্যরকম ভালোলাগা খেলে গেলো। ষশ্মিথের এই ভালোবাসা গুলো সবসময় তিতিরের ভেতর এক অন্য স্বত্তাকে জাগিয়ে তুলে। পরিচয় করিয়ে দেয়া অন্যরকম অনুভূতির সাথে।
চোখের এককোণা ভিজে গেল তিতিরের। সবার কাছ থেকে জীবনে অবহেলা ছাড়া আর কিছুই পায়নি। এই মানুষটার ছোঁয়া পেয়ে এখন হঠাৎ ভালোবাসা পেতে ইচ্ছা করে, খুব করে।

কাঁচের পানির জগটা উল্টে ফেলে দিলো নিঝুম। আজ রাগ হচ্ছে না। ক্ষোভ নেই মনে কোনো। অভিমান ও হচ্ছে না। কষ্ট হচ্ছে। বুকটা চিড়ে ফেলতে ইচ্ছা করছে। মাথাটা ভনভন করছে। চোখে ঝাপসা দেখছে সব। বমি বমি পাচ্ছে। ধপাস করে ফ্লোরে বসে চুল টেনে ধরেছে নিঝুম।
তিতির নিঝুমের কাছে চলে গিয়েছে একমাস। আর শায়লা আজ জানালো নিঝুমকে! কান্নায় চোখ ফেটে আসছে নিঝুমের। চুল টেনে জোরে চিৎকার করে কান্না করতে লাগলো সে এক পর্যায়ে। কষ্টটা আস্তে আস্তে মস্তিষ্ক থেকে মেরুদন্ড দিয়ে এক শীতল বস্তুর মতো স্রোতে বয়ে যেতে লাগলো। শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে। একমাস ইন্ডিয়া থাকার পর যখন দেশে আসে নিঝুম, তিতির আর ষশ্মিথ তখন দেশ ছেড়েছে। কি করবে এখন সে ভেবে পাচ্ছে না। তার তিতিরকে অন্য কেউ নিয়ে গেলো! তার আর পাওয়া হলো না।

মাত্র একটু আগেই সিংগাপুরের মাটিতে পা রেখেছে ষশ্মিথ আর তিতির। তিতিরের এক্সাইটমেন্ট খুব বেশি, এই প্রথম ও বাংলাদেশের বাহিরে পা রেখেছে তাই হয়তো। ষশ্মিথ ওর পাগলামো দেখে মুচকি হেসে বললো,
‘ কতো সুন্দর এই দেশটা তাই না তিতিরপাখি? ‘

তিতির ও মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।

‘ অথচ একটা সময় পৃথিবীর অনুন্নত দেশগুলোর মধ্যে একটি ছিল। সমস্ত দুর্দশাকে পিছনে ফেলে সিঙ্গাপুর আজ পৃথিবীর ২২ তম ধনি দেশ। সিঙ্গাপুরের জীবন যাত্রার মান উন্নতির দিক থেকে এশিয়ার মধ্যে চতুর্থ। ‘

সেখানে আগেই গাড়ি পৌঁছে ছিল ওদের ড্রপ করার জন্য। পনের দিনের জন্য এসেছে এখানে ওরা। রাস্তায় যাওয়ার সময় একটু পর পরই তিতির হাউজিং এস্টেটে খেয়াল করেছে। এখানকার ৮৩ শতাংশ মানুষই উন্নত হাউজিং এস্টেটে বসবাস করে। এসব পরিসংখ্যানই বলে দেয় যে সিঙ্গাপুর আজ ইউরোপের কোন উন্নত রাষ্ট্রের চাইতে কোন অংশে কম না।
কিছুক্ষণের মধ্যেই হোটেল “ইন্টার কণ্টীনেণ্টাল সিঙ্গাপুর” এর সামনে এসে থামলো গাড়ি। ষশ্মিথের বাবা আগে থেকেই বুকিং করে রাখেছে রুম। এখানে ভালো রুম পাওয়া কষ্টসাধ্য হলেও যেহেতু মি.ষাহবাবের এখানে প্রায়ই যাতায়াত পড়ে তাই আর বেশি কষ্ট করতে হয়নি। দশদিনের বুকিং এই একটা আকর্ষণীয় রুম পেয়ে গেলো।
হোটেলের ভিতরে ওদের হানিমুনে আসা কাপলদের মতোই অয়েলকাম করা হয়েছে। তিতিরের বেশ ভালোই লেগেছে ব্যাপারটা। রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিয়ে নিলো দুজন। ঘুম থেকে ওঠে হোটেলেই খাবার অর্ডার করে দিলো ষশ্মিথ। বেশ কিছুক্ষনের মধ্যেই একজন স্টাফ এসে খাবার দিয়ে গেলেন। তিতির ফ্রেশ হয়ে আসতে আসতে ষশ্মিথ ট্রে থেকে সব খাবার সার্ভ করে নিল। তিতির আসতেই খাবার এগিয়ে দিলো তিতিরের কাছে। তিতিরের তো খাবার দেখে যায় যায় অবস্থা। নাক ছিটকে বললো,

‘ এগুলো কি? এখন কি নাস্তা করব নাকি? ভাত খাবো না! ‘

‘ তিতির এখানটাতে তো সবাই ভাত খায় না। এখন এটা দিয়েই কাজ চালিয়ে নাও পাখিটা। রাতে তোমাকে এশিয়ান রেস্টুরেন্ট ‘Camdlenust’ এ নিয়ে যাবো। তাছাড়া এগুলোও অসাধারণ। নাও একবার খাও ভালো না লাগলে খেও না। ‘

ষশ্মিথ নিজ হাতে ‘স্যাতে’ খাইয়ে দিলো তিতিরকে।
স্যাতে খুবই সাধারণ এবং জনপ্রিয় একটি খাবার। মাংসের কিমা আগুনে ঝলসিয়ে এর ওপরে বিভিন্ন ধরনের মসলা ছিটিয়ে দিয়ে পরিবেশন করা হয়। আগুনে ঝলসানোর কারণে মাংসের ওপরের দিকটা মচমচে হয় এবং ভিতরের দিকটা নরম। সিঙ্গাপুরের জনপ্রিয় স্ট্রিট ফুড গুলোর মধ্যে এটা খুবই পরিচিত একটি খাবার। তিতিরের কাছেও বেশ লেগেছে খাবারটা। ঠিক কাবাব আর ফ্রাইয়ে মাঝামাঝি তবে সুস্বাদু একটা রেসিপি। সাথে সাম্বাল স্ট্রিংরে। সাম্বাল স্ট্রিংরে সিংগাপুরে ইকান বাকার নামেও বেশ পরিচিত। সাম্বাল স্ট্রিংরে সিঙ্গাপুরের হালের জনপ্রিয় একটি খাবার এবং এটা সিঙ্গাপুরের মানুষের পছন্দের উপরের দিকেই রয়েছে। স্ট্রিংরে মাছ কলার পাতায় মুড়িয়ে পোড়ানো হয়। এরপর মাছ কেটে চিংড়ির পেস্ট, পেঁয়াজ এবং মসলা দিয়ে তৈরি সিঙ্গাপুরের জনপ্রিয় সাম্বাল সস দিয়ে পরিবেশন করা হয়।

তিতির বেশ মজা করেই খেলো মাছ আর স্যাতে।আসলে প্রথমে দেখে যতটাই খারাপ লেগেছিল ওর ঠিক ততোটাই ভালো খেতে। পেট ও ভরে গেছে। তারপর সামান্য কিছু আইসক্রিম আর পানীয় খেয়ে নিলো। সিংগাপুরের জনপ্রিয় ফল ডুরিয়ান ও খেলো। ডুরিয়ান সিঙ্গাপুরের জাতীয় ফল এবং সিঙ্গাপুরের অধিকাংশ মানুষ ডুরিয়ান খেতে পছন্দ করে। ডুরিয়ান আইসক্রিম, কেকসহ বিভিন্ন খাবারে ব্যবহার করা হয়, এমনকি এটা স্ট্রিট ফুড হিসেবেও বিক্রি করা হয়।

খাওয়া শেষ হলেই ষশ্মিথ তিতিরকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়। তিতিরের ছোটো বেলা থেকেই চায়নাটাউন দেখার খুব ইচ্ছা ছিল। তাই প্রথমে হোটেল থেকে চায়না টাওনের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় ওরা। সিংগাপুরের ছাদ খোল বাসগুলোতে ওঠে বসে তিতির আর ষশ্মিথ। বেশ খুশি তিতির এখানে এসে। প্রফুল্লতায় যেন আনাচকানাচে ভরে উঠেছে মেয়েটা! ষশ্মিথও অবাক। তিতিরকে দেখলে কেউ বলবেই না দু’দিন আগেই দুজনের মধ্যে এতটা দূরত্ব ছিল। তবে সে পেরেছে। পেরেছে নিজের আদর স্নেহের মাঝে নিঝুমের অস্তিত্বকে ভুলিয়ে রাখতে।

প্রায় চল্লিশ মিনিটের মাথায় ওঠা পৌঁছে যায় চায়নাটাউনে। চায়না টাউন খুব ছোট্টো একটা এলাকা ঘিরে তৈরী। চীনের ছোটো ছোটো দোকান থেকে শুরু করে,সকল ঐতিহ্যবাহী খাবার এবং পোশাক-আশাক ও দেখতে পাওয়া যায়। এমনি চীনের বিজ্ঞ্যাত উজ্জ্বল লাল লন্ঠন ও পাওয়া যায় এখানে। তিতির সেখান থেকে দুটো লন্ঠন কিনে নিলো। সিংগাপুরের মধ্যেই যেনো অন্য একটি দেশকে ফুটিয়ে তুলেছে এই চায়নাটাউনে। এখানে চীনা হেরিটেজ সেন্টার ও পরিদর্শন করার সুযোগ রয়েছে। এখানেই বিখ্যাত চিত্তাকর্ষক শ্রী মারিযাম্মান হিন্দু মন্দির। ষশ্মিথ আগেই তিতিরকে বলে দিয়েছে মন্দিরের ভেতরে তারা যাবেনা। চায়নাটাউনের সবচেয়ে বড় আকষর্ণ হলো চায়নাটাউনের বুদ্ধ টুথ রেলিক মন্দির। এই বুদ্ধমন্দির খুব সূক্ষভাবে সিংগাপুরীয়ান বুদ্ধদের শিল্প ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছে।
তিতির আর ষশ্মিথ চায়নাটাউন থেকে খেয়ে নিল। চাওমিন আর কর্ণের তৈরী একপ্রকার স্যুপ খেলো, যা এখানে স্ট্রিট ফুড হিসাবে বেশি পরিচিত। তিতির কিছু চীনা সামগ্রীও কিনে নিলো।

সেখান থেকে ক্যাবে করে চলে এলো ‘গার্ডেন্স বাই দ্য বে’ তে। এটি সিংগাপুরের সবচেয়ে বেশি আকষর্ণগুলো মধ্যে একটি। চায়নাটাউন থেকে টুকিটাকি ঘুরে গার্ডেন্স বাই দ্য বে’তে আসতে ওদের প্রায় ঘন্টা তিনেক লেগে গেলো। এর মাঝে সিংগাপুরের দুটো পার্কে ঘুরে এসছে তিতির আর ষশ্মিথ। গার্ডেন্স বাই দ্র বে তে প্রবেশের পর এক মুহূর্তের জন্য তিতির নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল। অসাধারণ সুন্দর এই স্থানটি। চারদিকে গাছের সমারোহ। মূলত উপর থেকে দেখতে অসম্ভব মনকারা। তিতির সত্যিই মুগ্ধ। গার্ডন্স বাই দ্য বে তিনটি ভাগে বিভক্ত। বে সেন্ট্রাল,বে সাউথ এবং বে ইস্ট। বাগানটি ওয়াটারফ্রন্ট রোডের সাহায্যে বাকি অংশ দুটোকে যুক্ত করেছে। তিনটি অংশের মধ্যে বে সাউথ সবচেয়ে বড়।বে সাউথ হলো উষ্ণমন্ডলীয় বাগান। এখানে ৫০ ফুট লম্বা গাছের কাঠামো রয়েছে।

সবকিছুর মাঝেই তিতির কিছুক্ষনের জন্য হারিয়ে গেছিলো।ধ্যান ফিরে যখন দুটো হাত পেছন থেকে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। তিতিরের শরীর বেয়ে আলাদা একটা শিহরণ বয়ে গেলো। তাড়াতাড়ি চোখ টিপ টিপ করে আশেপাশে দেখে নিলো। নাহ,এদিকটাতে তেমন কেউ নেই। আর থাকলেই বা কি সকলে ঘুরাঘুরিতে ব্যাস্ত ওদের দিকে তাকানো সময়টুকুও নেই কারো। ততক্ষনে ষশ্মিথ আরো শক্ত করে বাহুডোর আটকে নিয়েছে তিতিরকে। তিতির বেশ লজ্জা মাখা মুখ করেই বললো,

‘ এ…এই দেখুন এখানে লোকের অভাব নেই প্লিজ ছেড়ে দিন। ‘

‘ এখানে তো নেই। আমার বউ আমি ধরেছি কে কি বলবে? তবে হে বিয়ে ছাড়া জোর করে ধরলে হয়ত জেলে যেতে হত। ‘

তিতির মুচকি হাসলো।
‘ কেনো? ‘

‘ এখানের রুলস। কোনো মেয়েকেই বিরক্ত করা যাবেনা।বাংলাদেশ থেকে সিংগাপুরে এই বিষয়ের রুলস গুলো খুবি কঠোর। ওই যে পুলিশটা দেখছো না? শুধু একবার বলবে আমাকে চেনো না আর তোমাকে মোলেস্ট করেছি। ব্যাস আমার চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার কর ছাড়বে। ‘

‘ ওয়াও! ট্রাই করব তাহলে একবার?’ দুষ্ট হেসে বললো তিতির।

‘ তাহলে তো আর ধরাই যাবেনা দেখছি! ‘

‘ এই কেনো কেনো? ছেড়ে দিলেন কেনো! ‘

তিতিরের মুখে এই কথাটা শুনে ষশ্মিথ ভ্যবা চেঁকা খেয়ে তাকালো ওর দিকে। ওর লজ্জাবতী ততক্ষনে নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য নিজেই জিব কাটছে। ষশ্মিথ বেশ উপভোগ করলো ব্যাপারটা।

‘ এতো জড়িয়ে থাকার শখ স্বামীকে? একবার হোটেলে চলো আর কিন্তু ছাড়ছিনা। ‘

চলবে.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here