চুপি চুপি ইচ্ছেরা পর্ব -১০

চুপি চুপি ইচ্ছেরা
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি
১০

পানির ছটা চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙ্গে গেলো নিঝুমের। ওঠেই খপ করে বিভাকে ধরতে নিয়েও পারলো না। ঠিক পালিয়ে গেছে। মেয়েটাকে নিয়ে আর পারেনা নিঝুম। ভারী পাজিঁ হয়ে গেছে। প্রতিদিন মুখে এতগুলো পানি দিয়ে পালিয়ে যাবে। অথচ নিঝুম! সে কি সুন্দর রাতে বুকে নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। নিঝুম বিরবির করে বলে,

‘ এরেই বলে কপাল, নিঝুম এরেই বলে কপাল! বউয়ের আদর তো আর ভাগ্যে নাই! পানি খেয়ে ঘুম থেকে ওঠ! ‘

বিভা বারান্দায় দাড়িয়ে। গতকাল রাতে শায়লা নিঝুম আর বিভাকে কক্সবাজার পাঠিয়েছে। একা সময় কাটাতে। এখানে নিঝুম আর তিতলির নামে আলাদা আলাদা ফ্ল্যাট আছে। নিঝুমের বাবার দেয়া। নিঝুম পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরে বিভাকে। কাধে চিবুক রেখে বলে,

‘ কি ভাবো? ‘

‘ কই কিছু না তো? ‘

নিঝুমের চুল থেকে সুন্দর গন্ধ আসছে। খালি গায়েই জড়িয়ে ধরে আছে বিভাকে। বিভা অস্বস্তিতে পড়ে যায়। নিঝুম দ্রুত বিভাকে বলে,

‘ আচ্ছা আজ দুপুরে আমি রাঁধি? এর পর প্রতিবারই অর্ডার করেই খাওয়া হবে। ‘

বিভা সচকিত! মাথা ঘুড়িয়ে উচ্চাস নিয়ে বলে,
‘ আপনি রাঁধতেও পারেন? ‘

‘ তোমার জামাই সব পারে। ‘
দুজন সকালের খাবার খেলো দশটায়। তারপর নিঝুম রান্না শুরু করলো। বিভা টুকটাক সাহায্য করেছে। গ্রামের মেয়ে সবই পারে। খাওয়া দাওয়া শেষ হল।
বিকালে নামলো ঝুম বৃষ্টি। বিশাল বারান্দার উপরে খোলা আকাশ। খুব সহজেই বৃষ্টি বিলাস করা যায়। বিভা জোর করে নিঝুমকে নিয়ে গেল বৃষ্টিতে ভিজতে।

আকাশ বেশ মেঘলা। খাগড়াছড়ি শহড় থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে মাটিরাঙ্গার আলুটিলায় ঘুরতে এলো তিতির আর ষশ্মিথ। এর স্থানীয় নাম মাতাই হাকড়। সমতল থেকে ৩০০০ফুট উচ্চতায় পাহাড়। টিকেট কেটে ভেতরে ডুকলো ওরা। পাহাড় থেকে ২৬৬টি সিড়ি নেমে মশালে আগুন দিলো। শিলা পাথর আর পানি ডুকে গেছে গুহার অতলে। তিতির হাত দিয়ে খামচে ধরলো ষশ্মিথকে। অন্ধকার খুব ভয় পায় তিতির। ষশ্মিথ তিতিরের কান্ডে হেসে বললো,

‘ জুতা খুলে দাও আমার কাছে। ‘

তিতির অবাক হয়। চোখ ছোট ছোট করে বললো,
‘ কেনো? ‘

‘ পাথরে শ্যাওলা আছে। পায়ে জুতা থাকলে পিছলে যাবে। ‘

মলাল আর দুজনে জুতা হাতে নিয়ে আরেক হাতে তিতিরকে ধরে ভেতরে ডুকলো দু’জন। তিতিরের বেশ ভয় আর আনন্দ হচ্ছে। পনের মিনিটে ৩৫০ফুট সুরঙ্গ পার করলো। তারপর রিসাং ঝর্ণা দেখতে আরো ২কি.মি. উত্তরে গেলো। রিসাং ঝর্ণাও দুটো। প্রথমটাতে পাকা সিড়ি রয়েছে ঝর্ণা পর্যন্ত। তাই খুব সহজেই পৌঁছে যেতে পারলো।
প্রায় ১০০ফুট উচুঁ থেকে পানি ঝাপড়ে পড়ছে পাথরের উপর। ২য় ঝর্ণা অর্থাৎ অপ ঝর্ণায় যাওয়ার পথটা বেশ দুর্গম। তারপর খাওয়া দাওয়া সেড়ে নিয়ে মহাছড়ির দেবতা পুকুর দেখে গেলো হাতি মাথা।

খাগড়াছড়ি জেলার উপজেলা সদরের পেরাছড়া ইউনিয়নের মায়ুং কপাল (Hatimura) হচ্ছে একটি পাহাড়ি উঁচু পথ। স্থানীয় অনেকেই আবার একে হাতি মাথা ডাকে। চাকমা ভাষায় যার নাম – এদো সিরে মোন। খাড়া পাহাড় ডিঙ্গিয়ে দুর্গম এই পথে যাতায়াত করে ১৫টি গ্রামের মানুষ। সদর উপজেলা ও মাটিরাঙ্গা উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম ভাঙ্গামুড়া, বাদলছড়া, মাখণ তৈসা পাড়া,কিনাপা পাড়া,হাজা পাড়া,বগড়া পাড়া,কেশব মহাজনপাড়া, সাধুপাড়া, কাপতলাপাড়ার মানুষের জীবন যাত্রাকে একটিু সহজ করার জন্য নির্মিত হয়েছে ৩০৮ ফুট লম্বা লোহার তৈরি সিঁড়ি।

তিতিররা প্রথমে খাগড়াছড়ি সদর থেকে পানছড়ি যাওয়ার পথে জামতলীস্থ যাত্রী ছাউনির সামনে নামে। খাগড়াছড়ি সদর থেকে জামতলী পর্যন্ত গাড়ী ভাড়া জন প্রতি ১৫ টাকা। এরপর জামতলীস্থ যাত্রী ছাউনির বামদিকের রাস্তা ধরে সোজা গিয়ে চেঙ্গী নদী পার হয়ে ডান দিকে স্কুলের রাস্তার দিকে যায়। স্কুলের নাম পল্টনজয় সঃ প্রাঃ বিদ্যালয়। ওখানে গিয়ে একটি দোকান আছে। দোকানের সামনে দিয়ে ডানের রাস্তা ধরে যায়। দুটি বাঁশের সাঁকো আছে।

তিতির এর আগে কখনো সাঁকো দেখেনি। ষশ্মিথের সাহায্যে পার হলো। এরপর ডানদিকে ছড়ার পাশ দিয়ে যে ছোট্ট রাস্তা ধরে গিয়ে আরেকটি বাঁশ-গাছের সাঁকো পার হয়ে এবার সোজা পথ ধরে এগিয়ে যায়। এখানে বগড়া পাড়া নামে একটি পাড়া পড়ে। এরপর সামনে এগুলে বিস্তৃত ছড়া। এরপর একটি বড় টিলা পার হয়। এটি পার হলে একটি লোকালয় পাওয়া যায়, ষশ্মিথ তিতির কে বললো,

‘ এই তো এসেই গেছি। এই এলাকার নাম কাপতলা। ‘

এরপর হাতের ডান দিকে নিচু পথ ধরে এগিয়ে যেতে হবে, যেতে যেতে সামনে দুইটি রাস্তা পায় এবং ডান দিকের রাস্তা ধরে এগুতেই দেখা মিলে অসাধারণ মায়ুংকপাল/হাতি মুড়া। সব মিলিয়ে পৌঁছাতে সময় লাগে ঘন্টা দেড়েক। ট্রেকিং মোটামুটি কষ্টকরই ছিল। কারন ছোট খাটো পাহাড় পাড়ি দিতে হয়েছে। এরপর নিউজিল্যান্ড পাড়া। তবে নিউজিল্যান্ট পাড়া তিতিরের তেমন একটা ভালোলাগেনি। দেখতে দেখতে সময় কেটে যায়। তিতিরের ফিরে যাওয়ার সময়ও ঘনিয়ে আসে। কাল সকালের বাস ধরেই চলে যেতে হবে তাকে কুমিল্লা। ভাবতেই তিতিরের কান্না পায়। পুরোটা রাত ষশ্মিথের বুকে মাথা রেখে কেঁদে গিয়েছে মেয়েটা। অসহায় লাগছে। মানুষের জীবনটা এমন কেনো? একটু স্বাচ্ছন্দ্যে থাকার জন্য নিজের প্রিয় মানুষের মায়াজাল অগ্রাহ্য করে দূরে সরে যেতে হয় কেনো বারেবারে!

সময় যেন কাটতেই চায় না। কুমিল্লাতে নিজেকে খুবই একা একা লাগে তিতিরের। যদিও ষশ্মিথ প্রত্যেক মাসেই দু’তিনবার আসছে। তাও তিতিরের মনে হয় যেন বছর পেরিয়ে যায়। ভালোবাসার গভীরতা দেখিয়েছে ষশ্মিথ ওকে।সারাক্ষণে ডুকে থাকতে ইচ্ছে করে।মানুষটাকে ছাড়া যেন সব শূণ্য।
দু দন্ড শান্তি দেয়না লোকটা ওকে।মনের গহীনে ডুকে কি রাজত্বটাই না চালাচ্ছে। কিন্তু তিতির ও যে তাই চায়। তবে তিতির আজ খুব খুশি। সকাল থেকে মনের খুশিতে রান্না করছে। আলু মুরগির তরকারি, পটল ভাজা, বেগুন ভাজা, আলুর ঝুঁড়ি ভাজা, সাদা ভাত আর পায়েশ। এর বেশি রাঁধতে জানেনা। ষশ্মিথ আসছে ওকে নিয়ে যাবে বলে। দেখতে দেখতে পাঁচটা বছর কেমনে যেনো কেটে গেলো। একেকটা বছর যেন একেকটা যুগের সমান ছিল।

আজ সে নিজের বাড়িতে যাবে। ফেলে আসা সাজানো গোছানো সংসারে। যেখানে ভালোবাসা আছে। পরিবার আছে। প্রিয় মানুষগুলো আছে। আছে ওর ষশ্মিথ। ইশঃ!ভাবতেই তিতিরের ভেতর ঠান্ডা হয়ে গেল। হাত পা শিরশির করতে লাগলো। বিরবির করে বলতে লাগলো,

‘ আমারও ছোট্ট একটা সংসার হবে। ইশঃ! ‘

লজ্জায় দু’হাত দিয়ে মুখ ডেকে নিল তিতির। আজ বোধ হয় একটু বেশিই লজ্জা লাগছে!
ষশ্মিথ এসে ফ্রেশ হয়ে নিল। খুশির চোটে ব্যাগপত্র তিতির আগেই গুছিয়ে নিয়েছে। দৌড়ে দৌড়ে সব কাজ সেরে ফেলছে। ষশ্মিথ বার্থরুম থেকে গোসল সেরে এসে দেখে তিতির শাড়ি পড়ে নিয়েছে। কালো শাড়ি। চুল কোমড় অবদি ছাড়া। হাতে কালো কাঁচের চুরি। ব্যাছ! তিতিরকে পুরোই মায়াবীনি লাগছে। ষশ্মিথ তিতিরের কাছে এগিয়ে গিয়ে পেছনে হাত দিয়ে চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে এলো নিজের একদম কাছে। ষশ্মিথের উন্মুক্ত বুকে ল্যাপ্টে আছে তিতির। মাঝে বাতাস যাওয়ার জায়গাটুকু নেই।

তিতিরের শরীরময় অজানা শিহরন বয়ে গেল। মেরুদন্ড বেয়ে একগুচ্ছ ঠান্ডা তরল নেমে গেল। ষশ্মিথের চাহনি মারছে ওকে। লজ্জায় চোখ নামিয়ে রাখলো। ইচ্ছে করছিল ষশ্মিথের বুকে মুখ লুকাতে। কিন্তু চুল ধরে রাখায় পারলো না। ষশ্মিথের হাত একটু হালকা হয়ে গেল। পেছন থেকে ঘাড় চেঁপে তিতিরে চোখে তাকিয়ে ষশ্মিথ বললো,

‘ কেনো এত কাছের তুমি? কেন এত প্রিয়? কেনো এই কাজলহীনা চোখে আমাকে লুকিয়ে নাও? বলো কেনো? ‘

‘ জা…জানি না। ‘

তিতিরের কন্ঠ কাঁপছে। সে দিকে ষশ্মিথের হুঁশ নেই। নেশা লেগে গেছে ষশ্মিথের। মাতালের মতো দেখছে তিতিরের চোখ। কপালে হালকা করে একটা চুমু খেয়ে বললো,
‘ কেনো এই ঠোঁটের ছোট্ট একটা হাসি এক প্রিয়? কেনো এই চোখ কাঁদলে হৃৎপিন্ড টেনে বের করে ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছা হয়? ‘

‘ আপনি ভালোবাসেন এই মেয়েটাকে তাই। ‘

‘ কেনো তুমি কাছে না থাকলে বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। কেনো তুমি অভিমাণ করলে পুরো পৃথিবী তোমার পায়ের কাছে এনে দিতে ইচ্ছে করে? তোমার ছোঁয়ার দহনে ছাড়খাড় হই আমি? কেনো? বলো কেনো এতো জ্বালাও আমায়? ‘

‘ ভালোবাসেন কেনো? ‘

‘ জানি না। ‘

‘ কেনো জানেন না? ‘ (তিতির)

‘ একদিন সত্যিই আমি খুন হবো। ‘

‘ আমার মাঝে! ‘

ষশ্মিথ নাক টিপে ধরলো তিতিরের। হাসতে হাসতে বললো,
‘ আমার পাগলিটা বড় হয়ে গেছে। ‘

‘ জি আর কদিন পর বুড়ি হয়ে যাবে। ‘

‘ তারপর তার বুড়াটা আরো অনেক অনেক বেশি ভালোবাসবে। ‘

‘ ইশঃ! আমার এখনি সব ভালোবাসা চাই। ‘

‘ এত ভালোবাসা দিয়ে কি করবে? ‘

‘ আলতো গায়ে মাখব। যত্ন তুলে রাখবো হৃদয়ের গোপন কুঠরিতে। ‘

‘ দিবো তাহলে? ‘

ষশ্মিথ দুষ্ট হাসি দিয়ে বললো। তিতির চট করে ষশ্মিথের চোখে তাকিয়ে লজ্জা পেলো। দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো। আমতা আমতা করে বলো,

‘ খারাপ লোক। ‘

ষশ্মিথ হো হো করে হেসে বললো,
‘ হুম আমি একটু খারাপই। ‘

তিতিরে কপালে চুম খেলো ষশ্মিথ। শিউলি ফুলের মোটা মালা পেচিয়ে ঢেকে দিলো খোঁপা। তিতির চোখ বুজে রইলো।

বিভার থার্ড ইয়ার ফাইনাল এক্সাম শেষ। নিঝুমকে পাগলের মতো ভালোবেসে ফেলেছে মেয়েটা। নিঝুম মিশে গেছে ওর রক্তে, ওর রন্ধ্রে। রাতে ছাদে দাড়িয়ে গুনগুনিয়ে রবীন্দ্র সংগীত গাইছে। নিঝুম এসে পাশে বসলো। বিভার হাতে হাত রাখলো। বিভা সচকিত হয়ে বললো,
‘ কখন এলেন? ‘

‘ যখন আমার ভাবনায় মগ্ন ছিলে! ‘

‘ ছাই!কে বলেছে আপনাকে নিয়ে ভাবছিলাম? ‘

নিঝুম বিভার নাকে নিজের নাক ঘষেঁ ঠোঁটে হালকা চুমু খেলো। আলতো জরানো কন্ঠে বললো,
‘ তোমার ভেতর যে শুধুই আমি বাস করি তা আমি জানি। ‘

‘ কিন্তু আপনার ভিতর শুধু আমি নই। ‘

বিভার কন্ঠে অভিমাণ স্পষ্ট। চোখের কার্ণিশ চিকচিক করছে। নিঝুম সরে এলো কিছুটা। বিভার কাছে সে অপরাধী। কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিন্মস্বরে বলল,

‘ আমি তোমাকে ভালোবাসি বিভা। ‘

বিভা ভূত দেখার মতো তাকালো নিঝুমের দিকে। আল্হাদি কন্ঠে বললো,
‘ হুম। ‘

থেমে ঠোঁট কাঁমরে কিছু একটা ভাবলো নিঝুম তারপর আবার বললো,
‘ তবে আমার হৃদয়ে তিতিরের অস্থিত্ব আমি অস্বীকার করতে পারব না। ওর প্রতি ভালোবাসাটা অভিমানে ঢাকা পড়ে গেছে। কিন্তু তুমি তোমার জায়গা ঠিক করে নিয়েছো। নতুন করে ভালোবেসেছি তোমায়। আমার অভ্যাসে পরিনত হয়েছ তুমি। ‘

বিভা এবার চোখের জল চেঁপে রাখতে পারলো না। নিঝুমকে জড়িয়ে ধরলো। ভেজা কন্ঠে বললো,
‘ প্লিজ নিঝুম। আমার তোমার সবটা চাই, সবটা। তুমি শুধুই আমাকে ভালোবাসবে। শুধু আমার তুমি। ‘

নিঝুম ও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
‘ হুম মহারাণী!আমি তো আপনারই। ‘

‘ তাহলে কেন তিতির? বলো? আমার সব কিছুতেই কেনো তিতির নামটা থাকবে? আমি কি কম ভালোবাসছি তোমাকে? ‘

বিভার কান্নার গতি আরো বাড়লো। নিঝুমের প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে বিভার কান্নায়। কিন্তু মিথ্যে সে বলবে কি করে। ওর মনে তিতির আছে। তার মানেই তো এই নয় যে ও এখনো তিতিরে ডুবে আছে! ও বিভাকে ভালোবেসে।

‘ প্লিজ এমন করো না বিভা। ‘

‘ কেমন? তিতির, তিতির, তিতির! আমি আর সহ্য করতে পারছিনা এই নামটা। ‘

‘ বিভা আমি বলছি তো ও আমার অতীত।আমার বর্তমান,ভবিষ্যৎ শুধুই তুমি। এখন আমি চাইলেও তো অতীত ছুঁড়ে ফেলতে পারি না বলো! ‘

‘ বাহ! কিভাব? তোমার মনে বিচলন করবে তিতির আর ভালোবাসো আমায়? এখনো মাঝে মাঝেই আমাকে ডাকতে গিয়ে আনমনে তুমি তিতিরকে ডেকে ওঠো। প্রায় সময়ই বিভার নামের স্থানে তিতিরের নাম থাকে তোমার মুখে। কেনো বলতে পারো? তাহলে আমি কি করে তোমার বর্তমান? তিতির সব ছেড়ে গিয়েও যেনো সবকিছুর মাঝে আছে। মাও আমার চেয়ে তিতিরকে বেশি ভালোবাসেন। কেনো? তার সকল কিছুর দেখাশোনা আমি করি। তাহলে তিতিরকে কেনো আমার আগে প্রায়োরিটি দেয়া হবে? ‘

‘ বিভা আমি চাইলেই তো মনের উপর জোর খাটাতে পারিনা। একটু বুঝো এখন তো আর আমি ওকে নিয়ে ভাবছি না। তাছাড়া… ‘

নিঝুমকে বলতে না দিয়ে বিভা কাঁদতে কাঁদতে বললো,
‘ আর আমি? আর আমি তো ছয়টা বছর নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে তোমার তিতিরের প্রতি ভালোবাসা, টান সব মেনে নিচ্ছি তখন? আমার কষ্ট বলে কিছু নাই? এই একটা মেয়ে আমার জীবনটা ছাড়খাড় করে দিল। ‘

‘ বিভা একটু তো বুঝো। এখন শুধু তুমি আর আমি। যত ওকে টানবে ঝামেলা তত বাড়বে। আমি তো চেষ্টা করছি! ‘

‘ আমি না তুমি টানো ওকে। জাস্ট আন্সার মি, তুমি তিতিরকে পুরোপুরি ভুলে তোমার মনে শুধু আমার জায়গা দিতে পারবে? ‘

নিঝুম কিছুসময়ে আকাশের দিকে চেয়ে রইলো। তারপর বললো,
‘ তিতিরের প্রতি আমার ভালোবাসা কখনো কমবে না। কিন্তু তুমি আমার সব। ‘

বিভা কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে নিচে চলে গেলো। নিঝুম বড় একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। এটা অসম্ভব! প্রথম প্রেম কেউ ভুলতে পারে না। তাই বলে তো আর বিভার সাথে অন্যায় করছে না। এটা সত্য,এই ছয়টা বছর নিজের সবটা দিয়ে ভালোবেসেছে বিভাকে। বিভার কেন এত রাগ, হিংসা তিতিরের প্রতি?

হসপিটালে নতুন জয়েন করেছে তিতির। প্রথম দিন বলে ডিউটি ছিল দুটো পর্যন্ত। তারপর চলে এলো শায়লার সাথে দেখা করতে। বেল দিতেই বিভা ছুটে এলো। দরজা খুলেই মুকখানা চুপসে গেল বিভার। তিতির বিভাকে দেখে খুশি হয়েছে। মিষ্টি হেসে বললো,
‘ কেমন আছো? ‘

‘ ভালো। ‘

‘ মামি আছেন? ‘

‘ তার ঘরেই আছে। ‘

কথা বাড়ালো না বিভা। সোজা হেটে গেলো ঘরের দিকে। তিতির একটু ইতস্তত বোধ করলো। বিভার সাথে ওর এমনিতেও তেমন একটা কথা হয়নি। মেয়েটা হয়ত বেশি কথা বলে না। তিতির এসে দেখা করলো শায়লার সাথে। অনেক ভেঙ্গে পড়েছেন শায়লা। চোখ মুখে তাকানো যাচ্ছে না। তিতির গিয়ে শায়লাকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর ছেড়ে মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ এ কি অবস্থা করেছো নিজের। ঠিক মতো খাও না কেন? ‘

‘ আর কিছু ভালো লাগেনা রে মা। লোকটাই যে আমার সব ছিল। কেমনে ছাইড়া গেলো। ‘

তিতির দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
‘ ওসোব অত ভাববেনা। নিঝুম ভাইয়ার যে তোমাকে দরকার। তুমি ঠিক না থাকলে সে থাকবে বলো? আজ আমি নিজে রাঁধবো তারপর খাইয়েও দিব তোমায়। দুপুরে মনে হচ্ছে না খেয়েছ। ‘

শায়লা তিতিরের হাত দুটোতে চুম দিয়ে বললো,
‘ হুম রাঁধ। অনেক দিন খাইনা এই হাতের রান্না আজ মন, পেট ভরে খাব। ‘

তিতির রান্না ঘরে গিয়ে দেখে বিভা খাবার টেবিলে সাজাচ্ছে। তিতিরকে দেখেই বললো,
‘ আপু তুমি খাবে তো এখন? ‘

‘ আরে না না বোন, আজ মামিকপ নিজ হাতে রেঁধে খাওয়াতে মন চাইলো। রেঁধে তারপর একসাথে খাব। তুমি খেয়ে নাও। ‘

বিভা যেন হোঁচট খেলো। ত্রস্তভাবে বললো,
‘ মানে? আমি মার পছন্দ মতো সব রেঁধেছি। এটা আমার কাজ। তুমি কেনো রাঁধবে? ‘

‘ আমি ভাবলাম একটা দিন এসেছি নিজ হাতে রেঁধে খাওয়াই! আচ্ছা আমি মামিকে নিয়ে আসি। ‘

ততক্ষণে শায়লা চলে এসছে রান্নাঘরের দিকে। বিভার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,
‘ রোজ তো তুমিই রাঁধো বউমা। আজ একদিন নাহয় তিতিরের হাতে খেলাম? ‘

বিভা তীক্ষ চোখে তাকালো তিতিরের দিকে। কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
‘ না। এটা আমার কাজ। ও কেনো রাঁধবে মা। আপু তো মেহমান আপু রাঁধবে না। ‘

‘ বিভা! এটা কোন ধরনের ব্যবহার! ‘

রাগ করে শায়লা চলে এলেন নিজের ঘরে। দুপুরে আর কিছু খেলেনই রাগ করে না। তার বাড়িতে কেনো তার তিতির মা অপমানিত হবে। তিতিরকেও মন খারাপ নিয়েই বাসায় ফিরতে হলো।

ষশ্মিথ সেদিন রাতের বাসেই যাবে খাগড়াছড়ি। সব গোছানো শেষ। তিতিরের সেই কি কান্না। ও এখনি যাবে ষশ্মিথের সাথে। একদম বাচ্চাদের মতো অবুঝ হয়ে গেছে মেয়েটা। লাগেজ ধরে বসে আছে। ষশ্মিথ মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,

‘ ধুর পাগলি মেয়ে। এমন করে নাকি? আমি বলেছি তো ওখানে গিয়েই একমাসের মধ্যে সব ব্যবস্থা করে নিয়ে যাব তোমায়। ‘

‘ না না না। আমি আর একদিনও পারব না তোমাকে ছাড়া থাকতে। প্রতি মুহূর্তে তোমাকে চাই। প্রত্যেক নিঃশ্বাসে তোমার শরীরের গন্ধ চাই। তোমার প্রত্যেক চাহনীতে চাই। তোমার দুষ্ট প্রেম চাই। আমি পারব না থাকতে। প্লিজ নিয়ে চলো। দরকার নিচে বিছানা করে থাকবে দুজন। খাবার নিয়েও টেনশন করতে হবে না। আমি যাবই। ‘

‘ এমন করে নারে বউটা। তুমি এমন করলে আমার যেতে কষ্ট হবে। কি করে যাব বলতো তোমায় ছাড়া? ‘

‘ তো নিয়ে যান। ‘

ষশ্মিথ বুঝাতে ব্যর্থ হয়ে হাফ ছেড়ে চেয়ে থাকে তিতিরের দিকে। তিতির মিষ্টি করে বাচ্চা কন্ঠে বলে,
‘ না প্লিজ যাবেনা আমায় ছাড়া। ‘

তিতির জাপটে জড়িয়ে ধরলো ষশ্মিথকে। বুকে মাথা গুঁজে রাখলো। ষশ্মিথও নিজের সাথে চেঁপে ধরেছে তিতিরকে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে তিতির। তিতিরের কেনো যেনো মনে হচ্ছে আজ ছেড়ে দিলে হারিয়ে যাবে সব। হারিয়ে যাবে ওর ষশ্মিথ। খুঁজে পাবে না আর। খুব ভয় করছে। ষশ্মিথ হাজার বুঝানোর পরও সে মানতে নারাজ। সেভাবেই ছেড়ে যেতে হলো ষশ্মিথের তিতিরকে। তিতির কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেলে এক সময়। ইরিনাকে তিতিরের মাথার কাছে বসিয়ে দিল ষশ্মিথ। মেয়েটা ঘুমিয়েও কাঁদছে। বাম হাতের আঙ্গুল দিয়ে তিতিরের চোখের পানি মুছে দিল ষশ্মিথ। কি শান্ত লাগছে এখন মেয়েটাকে। অথচ একটু আগেই কি বায়না ধরে বসেছিল।

মেয়েটার প্রতি এত টান কেনো ষশ্মিথের? কেনো এতো ভালোলাগে? এত প্রেম? কেনো এত আদর করতে ইচ্ছে করে? জানা নেই। তবুও ভালোবাসে।

কপালে চুম এঁকে দিয়ে বের হয়ে যায় ষশ্মিথ। কাল থেকে জয়েন করতেই হবে। খাগড়াছড়ির ক্যান্টেরমেন্টের উপর কিছু পাহাড়ি সন্ত্র্যাস হামলা করেছিল। অনেক ডাক্তার প্রয়োজন। তাই যেতেই হলো। আর এই অবস্থায় তিতিরকে নিয়ে যাওয়াও অসম্ভব প্রায়। সারাটা রাস্তা ষশ্মিথ নিজেই কেঁদেছে তিতিরের জন্য। কিভাবে ধোঁকা দিয়ে ফেলে এলো মেয়েটাকে! উঠে যখন দেখবে সে নেই নিশ্চয়ই খুব করে কাঁদবে।

নিঝুম বেশ রেগে আছে বিভার উপর। মেয়েটাকে এতো বুঝানোর পরও কিছুই বুঝতে চায়না। তিতির রান্না করলেই কি এমন এসে যেত? মা তো আর না খেয়ে থাকতো না। এত অবুঝ কেন ওর বউ? আর কতো বুঝাবে ওর মনে এখন শুধুই বিভা? তিতির অতীত। বিভার আর ভালই লাগছেনা তিতিরকে। সারাক্ষণ শুধু মনে হয় কখন না জানি এসে ওর স্বামী সংসার কেড়ে নেয়। নিঝুমকে ছাড়া কিভাবে থাকবে ও? ওর কি দোষ! ও তো এই বাড়ির বউ নাকি! নিঝুমের, নিঝুমের মার খেয়াল রাখা তো ওর কাজ। অন্য একটা মেয়ে কেনই বা তা করবে?

কান্না পাচ্ছে। খুব কান্না পাচ্ছে। ও নিজেও বুঝছে ও যেটা করছে সেটা ঠিকনা। তবুও ও তো একটা মানুষ। একটা মেয়ে। কারো স্ত্রী। স্বামীর পূর্ব প্রেমিকার অবাধ যাওয়া আসা কেনো সহ্য করবে সে? করবে না তো। একদমই করবে না। নিঝুম ছাদে এলো। দেখে বিভা দাড়িয়ে দাড়িয়ে চাঁদ দেখছে। অপূর্ব মায়বতী লাগছে মেয়েটাকে চাঁদের আলোয়। পবিত্র,অপরূপা!

নিঝুম বিভার কাছে এসে পাঁজকোলে করে নিলো বিভাকে। বিভা নিঝুমের দিকে তাকালো। কিছু বলতে চেয়েও চুপ মেরে গেলো নিঝুমের চাহনীতে। এই চোখ জোরা যে আজ এক অন্য ভালোবাসার জানান দিচ্ছে। চুপি চুপি ইচ্ছেরা উড়াল দিচ্ছে আকাশ ছেঁয়ে। বিভাও নিঝুমের ইচ্ছে গুলো মেনে নিলো চুপি চুপি।

চলবে.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here