#মেঘের আড়ালে চাঁদ❤
#writer: মহসিনা মুক্তি
#পর্বঃ তেতাল্লিশ
তুলতুল কিছুক্ষণ থম মেরে থেকে উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসলো। কিছুক্ষণ আগে তিয়াস তাকে বুঝিয়ে গেছে। অবশ্য বলেছিল সে যদি বিয়ে করতে না চায় তো ঠিকাছে। কিন্তু রাফসানের কাছে যাওয়ার চিন্তা যেনো না করে। তিয়াসের কাছে, প্রথমত তার বোনের মৃত্যুর কারন রাফসান আর দ্বিতীয়ত, এতকিছুর পরে সে কিভাবে তুলতুলকে নিজের সাথে জড়াতে পারে! তার মতে রাফসান তুলতুলকে ফাঁসিয়েছে। কোন ভালোটালো বাসে না। তুলতুলের মন জয় করার জন্যই তাকে বাঁচিয়েছে আর কিছু নয়! কিন্তু তার মাথায় এটা আসলো না যে, রাফসানের মনে সত্যিই যদি খারাপ উদ্দেশ্য থাকে তাহলে সে কেনো সত্যি বললো, আর কেন নিজের দোষ স্বীকার করলো! সে যদি সত্যিটা তাদেরকে না বলতো তো কোনদিনই জানতে পারতো না। বরং ক্ষতি করার ইচ্ছা থাকলে নিশ্চয়ই এগুলো বলতো না, আর না মাফ চাইতো। কিন্তু এ খেয়াল তিয়াসের মাথায় নেই। সে তার ছোট বোনকে নিয়ে ভয় পাচ্ছে। রাফসানের ফাঁদে যেনো তুলতুল পা না দেয়, কিভাবে তার বোনকে রক্ষা করবে শুধু সেই চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে। একজন ভাই হিসাবে সবকিছু জানার পর এই চিন্তাটা স্বাভাবিক। আর কাউকে বিশ্বাস করে বোনকে তুলে দেবে সেটাও তার কাছে ভয়ের আবার কি না কি হয়ে যায়। কিন্তু তিয়াস ভেবে চিন্তে ছেলের সম্পর্কে সব খোঁজ খবর নিয়ে তারপর ওদিকে এগিয়েছে। যদিও ছেলে তার পূর্ব পরিচিত। তবু্ও কোন রিস্ক নিতে চায় না বোনের ব্যাপারে। তার ধারণা বিয়ে দিয়ে রাখলে রাফসান তার বোনের পিছু ছেড়ে দিবে। আর কোন বিপদ আসবে না। তাছাড়া কখন কি ঘটে যায় বলা যায় না। আগেরবার তুলতুল ছোট ছিল কিন্তু এবার বড় হয়ে গিয়েছে। যার তার চোখে পড়ে যেতে পারে। বিবাহিত হলে ততটা সমস্যা হবে না। এই চিন্তা করেই সে বিয়ে পড়িয়ে রাখতে চাইছে শুধু। পরে তুলতুলের পড়ালেখা শেষ হলে তুলে দেবে। তুলতুলকে এটা বলেছে তুলতুল কিছুক্ষন চুপ করে ছিল পড়ে মত দিয়েছে। এমনিতেও রাফসানকে মন থেকে একমুহূর্তের জন্যও সরাতে পারছে না, কোন দায়বদ্ধতায় আবদ্ধ হলে নিশ্চয়ই সে কিছুটা ভুলতে পারবে। তুলতুল অনেকক্ষণ পরই বের হয়েছে ওয়াশরুম থেকে। চোখ মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে কান্না করেছে। বলে তো দিয়েছে বিয়ে করবে কিন্তু তা কি আদৌও এত সহজ! তুলতুল দেখে দিয়া বিছানায় বসে আছে। রাগী ভাবে তুলতুলের দিকে তাকিয়ে।
-” তোর সমস্যা কি? কেন এমন করছিস তুলতুল?” তুলতুল অবাক হওয়ার ভান করে বললো
-” আমি? আমি আবার কি করলাম?”
-” দেখ ফাজলামি করবি না। একজনকে ভালোবেসে আরেকজনকে কেন বিয়ে করছিস?”
-” যাকে ভালোবেসেছি তাকে ভুলে যেতে।”
-” দেখ এতে তোদের তিনজনের জীবন নষ্ট হবে। কেন এমন করছিস? এখন হয়তো জেদের বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলি পরে কিন্তু আফসোস করতে হবে। আমি জানি বিয়ে হোক আর বাচ্চাই হোক তুই রাফসানকে ভুলতে পারবি না। কোনভাবেই না। আর তুই কেনই বা তাকে মেনে নিতে পারছিস না? সে তো খুন করে নি তাহলে? আরেকটা কথাও বলতে পারিস যে তিয়াসা আপু তাকে ভালোবেসেছিল। এটাই কি তোর সমস্যা? এটার জন্য তুই রাফসানকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছিস? তার ভালোবাসাকে উপেক্ষা করছিস? তিয়াসা আপু একবার ভালোবেসেছে বলে কি আর কেউ তাকে ভালোবাসতে পারবে না? আজব! এখানে রাফসানের তো কোন দোষ নেই। আর এমনও না যে তিয়াসা আপু বেঁচে আছে, জেনে যাবে এই ভয়ে তুই রাফসানকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছিস! আর ওদিকে তোর ভাই একটা, কোন সহজ কথা বা সহজ কিছু যেন তার মাথায় ঢোকে না। সবকিছুই জটিল ভাবে। একবার হয়েছে দেখে মনে হয় দুনিয়ায় এককান্ড বারবারই হবে এমন ভাব করে!” দিয়া বলে রাগ নিয়ে বসে থাকলো। তুলতুল একবার দিয়ার চোখের দিকে তাকালো তারপর বললো
-” আমি জানি আমি কি করছি। একসময় হয়তো পস্তাতে হবে আমার এ সিদ্ধান্তের জন্য এও জানি। কিন্তু আমি চাইনা সবকিছু ভুলে গিয়ে রাফসানকে আপন করে নিতে। সবসময় সবকিছু ভোলা যায় না। তিয়াসা আপু ভালোবেসেছে বলে রাফসানকে আর কেউ পছন্দ করতে পারবে না এমন নয়। অবশ্যই পারবে। এখানে রাফসানের দোষ নেই। কিন্তু আমি সেটা পারছি না। তাকে দেখলেই আমার চোখের সামনে আপুর চেহারা ভেসে ওঠে। ভেসে ওঠে ওই আধপোড়া চেহারাটা। লোকটা খুন করেনি কিন্তু তারপরও মনে হয় তার জন্য আমি আপুকে হারিয়ে ফেলেছি। রাগ হয় তখন, খুব রাগ হয়। আবার মাঝে মাঝে মনে হয় এই লোকটিকে ঘিরেই তো আপু সব স্বপ্ন সাজিয়েছিল। কিন্তু না আছে তার স্বপ্ন আর না আছে তার অস্তিত্ব। যখন এসব মনে পড়ে তখন মনে হয় আপুর সাথে অন্যায় করা হবে। রাফসান আশেপাশে থাকলেও আমার শুধু আপুর কথা মনে হয়। আমি স্বাভাবিক থাকতে পারি না। তো এতটা যন্ত্রণা নিয়ে কিভাবে আমি একটা মানুষের সাথে থাকতে পারি? এই অসহ্য যন্ত্রণা গুলো ধীরে ধীরে ভালোবাসাকে গ্রাস করে নিতো৷ সম্পর্ক হয়ে উঠতো তিক্ত। আমার কাছে তিক্ততার থেকে আগে থেকে সরে আসাই উচিত মনে হয়েছে। এখানে দোষ কারো না। আসলে সবই নিয়তি। ভাগ্যে এমনটাই ছিল তাই এটা হওয়ারই ছিল। নাহলে এত মেয়ে থাকতে লোকটা কেন আমাকেই ভালোবাসতে যাবে!” তুলতুল আয়নার সামনে থেকে সরে বেলকনিতে চলে গেলো। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। সে মুছে ফেললো তা। আর দিয়া রেগে বাইরে চলে গেলো।
সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়ে গিয়েছে। পাত্রপক্ষ তুলতুলকে দেখে গিয়েছে। তাকে পছন্দ করেছে। হাতে আংটি পরিয়ে দিয়ে গিয়েছে। আজ সোমবার, বিয়ে পড়ানো হবে শুক্রবার ঠিক করেছে। তুলতুল যখন তাদের সামনে গিয়েছিল তখন বুক ফেটে কান্না আসছিল। কিন্তু সে কান্না করতে পারছিল না। চোখের কোণে পানি জমার আগেই মুছে নিয়েছে। তার মনে হচ্ছিল সবকিছু ছেড়েছুড়ে রাফসানের কাছে ছুটে চলে যাক। অস্থির লাগছিল প্রচুর। সবকিছু ভুলে শুধু এটাই মাথায় ছিল রাফসানকে সে হারিয়েছেন ফেলবে। বাইরে চলে যাওয়ার জন্য পস্তুতিও নিয়েছিল, কিন্তু গেটের সামনে তিয়াসকে পাত্রপক্ষের লোকের সাথে আসা দেখে সে থেমে যায়। মনে হয় সে কি করছিল। নিজেকে খুব কষ্টে সামলে সে রুমে যায়। যাওয়ার সময় একবার তার বাবার সাথে দেখা হয়। তখন সে ভাবছিল যে সে বাবাকে বলে দিক সে বিয়ে করবে না। বিয়ে করলে শুধু রাফসানকে করবে। কিন্তু বলেনি মাথা নিচু করে রুমে চলে এসেছিল। যখন আংটি পড়ায় তার হাতে তখন তার অবস্থা আরো খারাপ ছিল। সেখানেই কান্না করছিল। একজনের কাছে অঙ্গীকার, প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে আরেকজনকে বিয়ে করতে যাচ্ছে ! রুম থেকে বের হওয়ার আগে রাফসানের দেওয়া আংটি টা ডানহাতে পড়ে নিয়েছিল সে। তাকে দেখে চলে যাওয়ার পরে রুমে এসে দরজা লাগিয়ে তাদের দেয়া আংটিটা খুলে ফেলে রুমের একপাশে ছুড়ে মেরেছে। এরপর চিৎকার করে কান্না করেছে। এখন সে চুপচাপ বসে আছে। তুলতুল উঠে বেলকনিতে গেলো। একটু সময়ের জন্য যদি রাফসানকে দেখতে পেত। কিন্তু এখন আর সে তা ভাবতে পারে না। রুমে অসহ্য লাগছে তার তাই বের হয়ে এলো বাইরে। এখন নিশ্চয়ই কেউ বাইরে যেতে বাঁধা দিবে না। সে গেট ঠেলে বাইরে বের হয়। জোরে একটা শ্বাস নিয়ে রাস্তার কোল ঘেঁষে হাটতে থাকে। মনের ভেতর অশান্তি নানারকম চিন্তা ভাবনা ঘুরছে। সত্যিই কি সে অন্য কারো হয়ে যাবে? রাফসানকে আর দেখবে না? অবশ্য সে নিজেই তো বলে দিয়েছে তার সামনে আর আসবে না। কতটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে তাদের মধ্যে। তুলতুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
-” এই দুপুর বেলা রোদের ভেতর এভাবে হাটছেন যে!”
তুলতুল তাকিয়ে দেখলো তখন তাকে যে ছেলে আর তার পরিবার দেখতে এসেছিল সে। এবাড়িতে আসার পর দুইদিন তিয়াসের সাথে দেখেছে তুলতুল। তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতো। তুলতুল এসময়ে এই লোককে দেখে বিরক্ত হলো। কিন্তু কোন কথা বললো না। বিয়ের কথা ঠিক হয়েছে আর এখনি তার পেছনে চলে এসেছে। যদিও তা স্বাভাবিক কিন্তু তুলতুলের কাছে অস্বাভাবিক। লোকটার নামও তুলতুল জানে না। লোকটা তুলতুলের পাশে হাঁটতে হাঁটতে বললো
-” আপনার চোখ দুটো অনেক সুন্দর! ” একথায় তুলতুল লোকটার দিকে রেগে তাকালো। এমনিতেই বিরক্ত লাগছে তারওপর এই লোক তেল মারতে এসেছে। এখন এটাকে তুলতুলের কাছে ছ্যাঁচড়া মনে হচ্ছে।
-” আরে রাগছেন কেন আমি তো সত্যি কথাই বললাম। বিয়ের পরে ঘন্টার পর ঘন্টা বউয়ের চোখ দেখেই কাটিয়ে দিতে পারবো।” কি খারাপের খারাপ! বিয়ে ঠিক হলো মাত্র কিছুক্ষণ আগে। আর এখনি এমন ভাব করছে যেন কতদিনের পরিচয় তাদের এক অপরের সাথে। তুলতুল এবার রেগে কিছু বলবে তার আগেই লোকটার ফোন আসে। তাই তুলতুল কিছু বললো না। সে খেয়াল করলো লোকটার দৃষ্টি তুলতুলের হাতের দিকে। তুলতুল ভ্রু কুঁচকে লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকে কেন তার হাতের দিকে তাকিয়ে আছে তা ভাবার চেষ্টা করলো আর সে বুঝতে পারলো তার হাতে কিছুক্ষণ আগে পরানো আংটিটা নেই। তুলতুল ডোন্ট কেয়ার ভাব নিল। সে হাত না লুকিয়ে ওভাবেই হাঁটতে লাগলো। সে পড়বেও না ওই আংটি, হুহ্! লোকটি ফোনে কথা বলা শেষ করে তুলতুলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো
-” বেশিদূর যাবেন না যেন। আমি আসছি।” বলে লোকটি পেছন ঘুরে চলে গেলো। আর তুলতুলের এই আজাইরা কেয়ার দেখে মনে হলো পেছন থেকে মাথা ফাঁটিয়ে দেয় ইট দিয়ে। কিন্তু কিছু করলো না। লোকটাকে বকতে বকতে সামনে আগাতে লাগলো। তুলতুল এটা খেয়াল করলো যে লোকটা তার হাতের আংটির ব্যাপারে কিছু বললো না। সে আনমনে হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর চলে এসেছে তখন একটা গাড়ি তার পাশে ব্রেক কষে তার হাত ধরে গাড়ির ভেতর উঠিয়ে নিল। তুলতুল হতভম্ব হয়ে আছে। রাফসান তাকে টেনে তার কোলের উপরে বসিয়েছে। তারপর ডোর লক করে তাকে তুলে ঠাস করে পাশের সিটে ফেলে সিটবেল্ট লাগিয়ে দিয়েছে। ঘটনার আকস্মিকতায় তুলতুল হতভম্ব হয়েই তাকিয়ে আছে। আর রাফসান ততক্ষণে গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে। তুলতুলের যখন হুঁশ হয় তখন সে ডোর খোলার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। পরে রাফসানের দিকে রেগে তাকিয়ে বলে
-” সমস্যা কি আপনার? কেন আমাকে উঠিয়ে নিয়ে এসেছেন? আপনি না বললেন আমার সামনে আসবেন না? আর জোর করবেন না? তাহলে কেন আমাকে উঠিয়ে নিয়ে এসেছেন?” রাফসান কিছু বললো না সে একমনে গাড়ি চালাচ্ছে। যেন তেমন কিছুই হয়নি, শুধু তুলতুলের কথায় গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে তুলতুল ভয়ে চিৎকার করে রাফসানকে গাড়ি থামাতে বলে কিন্তু থামায় না। সে কিল, ঘুষি দিয়েও রাফসানকে বিচলিত হতে বা কোন রিয়াকশন করতে দেখে নি। যেন একটা রোবট। আর তুলতুল রাফসানকে উল্টো পাল্টা বলছে। কেন তাকে এনেছে? সে না বড় মুখ করে বললো তার সামনে আর যাবে না! তাহলে? আর সে রাফসানকে ভালোবাসে না, এটা অন্যায়, আমি পারবো না। আপনি গাড়ি থামান, আমার ভয় করছে, ভাইয়া জানতে পারলে ভালো হবে না, আপনার ভেতর কি অপরাধ বোধ হচ্ছে না, আমার খারাপ লাগছে নামিয়ে দিন, কেন নিয়ে এসেছেন? আরো কতশত কথা, জ্ঞান রাফসানকে দিচ্ছে কিন্তু রাফসানের কোন রিয়াকশন নেই। নেই বলতে একদমই নে! সে ধীর, স্থির ভাবে শুধু হাত দুটো নাড়িয়ে দ্রুত স্পিডে গাড়ী চালাচ্ছে। নির্দিষ্ট স্থানে গাড়ি থামিয়ে তুলতুলের দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর তুলতুলের হাত আর মুখ শক্ত করে বেঁধে দিয়। তুলতুল ছটফট করছে কিন্তু কোন কাজ হচ্ছে না। বাঁধা শেষ হলে সে তুলতুলের দিকে রাগী চোখে তাকায়। রাফসানকে এভাবে তাকাতে দেখে তুলতুল চুপসে যায়, এমনিতেও তার হাত পা বেঁধে দিয়েছে। আবার কি না কি করে। রাফসানের চোখ গুলো লাল হয়ে আছে, কালকেও লাল ছিল কিন্তু তুলতুলের কাছে তা ভয়ংকর লাগছিল না কিন্তু আজকে লাগছে। রাফসান তুলতুলের মুখ বাঁধা অবস্থায় ফোনে ছবি তুললো। এরপর তুলতুলের মাথার পেছনে হাত দিয়ে চুল মুঠ করে ধরে তার কাছে নিয়ে এসে বলে
-” তোকে বলেছিলাম না আমি যে যাই হয়ে যাক তোকে অন্য কারো হতে দেব না? তুই ভাবিস কি করে অন্য কারো হওয়ার কথা? এত সাহস তোর? আর আমি তোর সামনে আসবো না বলেছিলাম কিন্তু এটা বলিনি যে তুই অন্য কাউকে বিয়ে করবি আর আমি চুপ করে থাকবো। তুই আমার না হলেও আমি সেটা মেনে নিতাম তোর সামনে সত্যি কোনদিন আসতাম না কিন্তু তুই অন্য কারো হওয়ার চেষ্টা করেছিস। তোকে কোনদিন আমি অন্য কারো হতে দেবো না বুঝেছিস? আর না দেখতে পারবো। অবশ্য আজকের পর থেকে তা কোনদিন হবে না। অন্যায়, টন্যায়, অপরাধ বোধের গুল্লি মারি। রাফসান এগুলোর ধার ধারে না। কিন্তু তোর প্রতি ভালোবাসা জন্মে এ কয়দিন আমি একদম ডুবে গেছি এসবে। তাই বলে অপরাধবোধের জ্বালায় আমি তোকে হারাবো? ইম্পসিবল! ওগুলো ওগুলার জায়গায় তুই তোর জায়গায়। এই তুই কোন সাহসে ওই ছেলের সাথে হেঁটেছিস? আমি একদিন মানা করিনি? কথা কানে যায় না? চড়ায়ে দাঁত ফেলে দেব একদম। ফাজিল কোথাকার!” রাফসান তুলতুলকে ধাক্কা দিয়ে সিটে ফেলে ফোন হাতে নেয়। আর তুলতুল কান্না করছে। কিন্তু কেন কান্না করছে সে নিজেও জানে না? রাফসানকে দেখে খুশি হয়ে নাকি অন্যায় হবে তাই ভেবে? সে কিছুই ফিল করতে পারছে না৷ কিন্তু চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। কান্না করতে ইচ্ছে করছে খুব তার।
আর রাফসান মুচকি হেসে স্টিয়ারিয়ের ওপর পা তুলে চিল মুডে ফোন কানে নেয়
-” হ্যালোওওও! মাই কিউট মিউট শালা বাবু। কেমন আছেন জিজ্ঞেস করছি না। বুঝতে পারছি আপনি এখন কেমন থাকবেন। নিশ্চয়ই তুলতুলকে উঠিয়ে আনার খবর পেয়েছেন। তাইনা! তো কি বলেছিলাম সেদিন যে তুলতুলকে আমার করতে বেশিকিছু করতে হবে না। আর না আমি তাকে অন্য কারো হতে দেবো। পারলে আলাদা করে দেখাবেন! তো আলাদা করার জন্যই বোনকে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিচ্ছিলেন? যে রাফসান তার পিছু ছেড়ে দিবে? এলাস! এমন কিছুই হলো না। একদম ভালো করেন নি এমনটা করে। আরে এত হাইপার হচ্ছেন কেন? এটা কিন্তু স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। চিন্তা করবেন না। আমি আপনার বোনকে ফিরিয়ে দেবো, কিন্তু অবশ্যই আমার করে। ওহ হ্যা, আপনার ফোনে একটা ছবি পাঠাচ্ছি দেখে নেবেন। ঠিকাছে? রাখছি। জাস্ট চিল!” বলে রাফসান ফোন রেখে দিল। তারপর তুলতুলের দিকে রাগ নিয়ে তাকিয়ে আরো একটু এগিয়ে গিয়ে বলে
-” বলেছিলাম বিশ্বাস করতে, একটু ভরসা করতে, একটু ভালোবাসতে কিন্তু তুই তার কিছুই করিস নি। যাকগে সেটা নিয়ে আমি আফসোস করছি না কিন্তু তুই অন্য কারো হওয়ার চিন্তা করেছিস, আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করতে যাচ্ছিলি এর শাস্তি তোকে পেতে হবে।” বলে গাড়ি থেকে নেমে তুলতুলকে টেনে নামায়। তুলতুল আশেপাশে তাকিয়ে কিছু চিনতে পারে না। রাফসান তার হাত আর মুখের বাঁধন খুলে দেয়। আর তুলতুল সাথে সাথে কথা শুরু করে দেয়
-” আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছেন? ছাড়ুন আমাকে, কোথাও যাবো না আমি আপনার সাথে!” তুলতুলের কথায় রাফসান শয়তানি হাসি দিয়ে বলে
-” বেবি কি বলো এসব! আমি কি তোমাকে তাই ছেড়ে দিতে পারি? কখনো না! তোমাকে বিয়ে করতে নিয়ে এসেছি মাই লাভ!” আর তা শুনে তুলতুল চোখ বড় বড় করে আশেপাশে তাকিয়ে সামনে তাকায় দেখে দোতালায় কাজী অফিস, আর নিচে পার্লার। সে ঢোক গিলে রাফসানের দিকে তাকায় আর রাফসান ভ্রু কুঁচকে তার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়। আর তুলতুল চিৎকার শুরু করে
-” আমি আপনাকে বিয়ে করবো না। শুনেছেন আপনি? আপনাকে আমি ভালোবাসি না। এটা অন্যায়! আর এভাবে বিয়ে হয় নাকি? পরিবার ছাড়া বিয়ে হয় না। ওটাকে বিয়ে বলে না চুক্তি বলে। আমি কোন চুক্তি করবো না।
-” ওই চুপ! একদম বেশি বুঝে উনি। বিয়ে মানে চুক্তি না তো কি তোর মাথা? বিয়ে মানে একে অপরের পাশে থাকার চুক্তি, মানিয়ে নেওয়ার চুক্তি, বিশ্বাস করার চুক্তি, সারাজীবন একসাথে থাকার চুক্তি, বিপদে আপদে সুখে দুঃখে পাশে থাকার চুক্তি! চুক্তি মানে কি জানিস! প্রতিজ্ঞা, অঙ্গীকার বুঝেছিস? আর বিয়ে মানে এগুলো সব মেনে নিয়ে চুক্তি করা। তো কোন দিক দিয়ে তোর মনে হয় বিয়ে চুক্তি না? জ্ঞান কম দিবি। নাহলে কানের নিচে দেব!” বলে রাফসান টানতে টানতে তাকে কাজী অফিসের ভেতর নিয়ে গেলো। তুলতুল উপায় না পেয়ে কান্না করছে কিন্তু রাফসানের মন এতে গলছে না। তুলতুল ভেতরে গিয়ে দেখে কাজী আর একটা লোক ওদিক ফিরে বসে আসে। রাফসান তুলতুলকে লোকটার পাশের একটা চেয়ারে বসিয়ে সেও চেয়ার টেনে তুলতুলের পাশে বসে তুলতুলের হাত ধরে থাকে শক্ত করে। আর তুলতুল খালি বলছে সে বিয়ে করবে না। কিন্তু না পাশে থাকা লোক কিছু বলছে, না কাজী কিছু বলছে, আর না রাফসান কিছু বলছে তারা স্বাভাবিক ভাবে বসে আছে। একটুপরে কাজী একটা ফাইল এগিয়ে দেয় রাফসানের কাছে আর বলে স্বাক্ষর করতে। রাফসান একবার চোখ বুলিয়ে সাইন করে দেয়। তারপর তুলতুলকে বলে সাইন করতে।
-” আমি বিয়ে করবো না আপনাকে শুনেছেন? আর না সাইন করবো।”
-” মা সাইনটা করে ফেলো!” তুলতুল এবার পাশে থাকা লোকের দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকায়। পাশে তার বাবা বসে আছে। সামনের দিকে ঘুরে ছিল দেখে সে চেহারা দেখে নি আর খেয়ালও করে নি। তুলতুল কান্নাজড়িত কন্ঠে বলে
-” বাবা!”
-” মা, আমাদের এই জীবনটা অনেক ছোট। জীবনে মান, অভিমান, দুঃখ, কষ্ট থাকবেই। কিন্তু তা নিয়ে তো সারাজীবন কাটিয়ে দেয়া যায় না। একটা সময় মান অভিমান ভুলে জীবনে এগিয়ে যাওয়া উচিত। অনেক তো হলো মান অভিমান! অনেক পাওয়া হয়েছে দুঃখ কষ্ট। আর কতো বয়ে বেড়াবে এগুলো? এবার কি সব দূরে সরিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা উচিত নয়? চারবছর তো কেটে গেলো এসব নিয়ে। এই ছোট জীবন থেকে চারচারটা বছর চলে গেছে। আর কেন এগুলো নিয়ে পড়ে থেকে কষ্ট পেতে চাইছো? তুমি রাফসানকে ভালোবাসো, রাফসানও বাসে। এখানে ভুলের তো কিছু নেই। নাকি একসময় তিয়াসা ভালোবাসতো দেখে তুমি মেনে নিতে পারছো না? এটা কিন্তু ঠিক না। আমারও প্রথমে রাগ হয়েছিল, রাফসানকে দোষী মনে হয়েছিল। কিন্তু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখলাম সে দোষী নয় বরং ভুক্তভোগী। সে নিজেও জানতো না যে ওরকম পরিস্থিতিতে তাদের পড়তে হবে। তাছাড়া রাফসানের ওপরও অ্যাটাক হয়েছিল শুধু তার ভাগ্য ভালো দেখে বেঁচে গিয়েছে। নয়তো সেদিন তিয়াসার সাথে তারও কিন্তু মৃত্যু হতে পারতো। তাহলে কেন তুমি তাকে মানতে পারছো না মা? ভালোবাসো তাকে অথচ তাকে মানতে পারছো না এতে দুজনেই কষ্ট পাচ্ছো। আর আমি তোমার এই মলিন মুখটা দেখতে পারছিলাম না। কষ্ট হচ্ছিল আমার। আজ সকালে যখন তোমাকে বিধস্ত অবস্থায় দেখছিলাম তখন নিজেকে ব্যর্থ বাবা মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল হয়তো আমি তোমার খুশি ছিনিয়ে নিচ্ছি। তাই রাফসানকে বিশ্বাস করে তোমার জীবনে তাকে ফিরিয়ে দিতে চাইছি। আর তিয়াসার সাথে অন্যায় হবে ভেবে তুমি বিয়ে করতে চাইছো না। কিন্তু সত্যি বলো তো এতে কি অন্যায় হবে? তিয়াসা রাফসানকে ভালোবাসতো তাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল কিন্তু তিয়াসা এখন আমাদের মাঝে নেই তাহলে তুমি রাফসানকে ভালোবাসলে তাকে বিয়ে করলে কি এমন অন্যায় হবে? আর তাছাড়া ওটা তিয়াসার ভাগ্যে ছিল। বাস্তবকে মেনে নিতে শেখো। অবশ্য এমন ভাবে লুকিয়ে বিয়ে দিতে চাইছিলাম না তোমাকে কিন্তু তিয়াস জানলে তা হতে দিত না। ওরও অবশ্য দোষ নেই। তোমাদের দুইবোনকে প্রচন্ড ভালোবাসে সে তাইতো কোন কিছু না ভেবেই এমন করছে। সেটাই স্বাভাবিক হয়তো। যদি ঠান্ডা মাথায় একবার ভাবতো তো এমন করতো না। কিন্তু সে কারো কথাও শুনছে না এমনকি আমারো না। তাই বাধ্য হয়েই তোমাকে এখন রাফসানের সাথে বিয়ে দিয়ে দেওয়াই উচিত মনে করছি আমি। সাইটা করো বাবা!” বলে তফিজ আহমেদ
তুলতুল চোখে পানি নিয়ে তার বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। তফিজ আহমেদ তুলতুলের মাথায় হাত বুলায়। কোনকিছু বোঝানোর হলে তার বাবা তাকে তুমি করে বলে। তুলতুল তার বাবার কথা শুনে আর কিছু ভাবলো না। কান্না করতে করতেই সাইন করে দিল। কবুল বলার আগেও তার বাবা তাকে আশ্বাস দিয়েছে। ব্যাস, রাফসান কবুল বলার পর তুলতুলও বলেছে। বিয়ে সম্পূর্ণ হয়েছে তাদের। তুলতুল তার বাবার চোখেও পানি দেখে। আবিরও এসেছে সেও সাক্ষী হিসেবে সাইন করেছে। রাফসান আর তফিজ আহমেদ তুলতুলকে সেখানে বসিয়ে বাইরে যায় কথা বলতে। আবির রয়েছে তুলতুলের পাশে। কিছুক্ষণ পরে রাফসান ভেতরে আসে তারপর বলে
-” বউ চলো।” কিন্তু তুলতুল কিছুই বললো না সে চুপচাপ বসে রইল। রাফসান তুলতুলকে টেনে দাঁড় করিয়ে তার হাত ধরে বাইরে বের হলো। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় রাফসান তুলতুলকে থামালো। সে তুলতুলের কাছে গিয়ে তার চোখের পানি মুছে দিয়ে চুলে হাত বুলালো। দুজনের কয়েকটা ছবি উঠালো একসাথে। তারপর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তুলতুলের মাথার ওপর নিজের থুঁতনি রেখে দাড়িয়ে রইল। কিন্তু আর কিছু বললো না। কিছুক্ষণ পরে তুলতুলের হাত ধরে নিচে নেমে দাঁড়ালো। তুলতুল বুঝতে পারছে না সে এখন কোথায় যাবে। তখনই রাফসান ঝুঁকে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো
-” বিয়ে হয়েছে এখন বর ছাড়া থাক! এটাই তোর শাস্তি। সবাই বিয়ে করে শশুড় বাড়ি যায় কিন্তু তুই বিয়ে করে বাপের বাড়ি যাবি!” বলে রাফসান আর কোন দিক না তাকিয়ে হনহন করে গাড়িতে উঠে চলে গেলো। আর তুলতুল আহাম্মকের মতো দাঁড়িয়ে রইল। রাফসান যেভাবে বললো মনে হচ্ছে সে রাফসানের সাথে থাকার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছে। তুলতুলের ধ্যান ভাঙে তার বাবার ডাকে। তাকে তার বাবা তাকে গাড়িতে উঠতে বলছে। তুলতুল ওভাবেই গুটিগুটি পায়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো।
চলবে…..
[ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। এ পর্বে আপনাদের মন্তব্য আশা করছি।]