রিকশা পর্ব -০২

#রিকশা
।।২।।
ঠিক কবে থেকে শুভ্রার সাথে খিটিমিটি শুরু হয়েছিল, মনে করতে পারে না পারভেজ। প্রথম ঝামেলাটা মনে হয় বাসা নিয়েই হয়েছিল।
হাতিরপুলে ছোট্ট একটা রুম সাবলেট নিয়েছিল পারভেজ, ছোট হলেও আপত্তি ছিল না শুভ্রার। সেই ছোট্ট ঘরটাকেই সাজিয়ে নিয়েছিল তারা নিজের মতো করে।
শুভ্রার বাসা থেকে সবাই চেয়েছিল ওরা শুভ্রার ফ্ল্যাটে উঠুক, যে ফ্ল্যাট শুভ্রার বাবার দেওয়া শুভ্রার নামে। কিন্তু রাজি হয়নি পারভেজ।
সেই ফ্ল্যাট আগে থেকেই ভাড়া দেওয়া, ভাড়ার টাকা মাসে মাসে জমা হতো শুভ্রার একাউন্টে। সেখান থেকে ইচ্ছে মতো টাকা তুলে আনতে পারত শুভ্রা, খরচ করতে পারত সংসারে কিংবা নিজের শখ মেটাতে, অনলাইন ড্রেস কিনতে, ফুড পাণ্ডা অর্ডার করতে, নতুন মডেলের ফোন ট্যাব কিংবা ল্যাপটপ কিনতে, বাধা দিত না পারভেজ।
সেই ফ্ল্যাটের ভাড়ার টাকা নেওয়া যাবে খরচ করা যাবে কিন্তু সেই ফ্ল্যাটে থাকা যাবে না, এ কথার মাথা মুণ্ডু কিছু বুঝতে পারত না শুভ্রা। এ রকম কিছু কিছু অদ্ভুত গোঁ ছিল পারভেজের।
কিন্তু পারভেজের হিসাব ছিল আলাদা। শুভ্রার নামের ফ্ল্যাটে উঠে যাওয়া মানেই এক প্রকার পরাজয় স্বীকার করে নেওয়া।
এতদিন ধরে ভাড়াটেরা ছিল ওদের ফার্নিচার নিয়ে, এখন ওরা চলে গেলেই ওই তিন হাজার স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে উঠলেই শুভ্রার মনে হবে খাট চাই, ওয়ার্ডরোব চাই, ডাইনিং টেবিল চাই, সোফা সেট চাই, শো কেস চাই, অত্যাধুনিক কিচেন কেবিনেট চাই, গেস্ট রুম সাজানো চাই। এত সব চাইয়ের ভিড়ে হারিয়ে যাবে পারভেজের ভালোবাসা, তখন মাথা নত করতেই হবে, হাত পেতে নিতেই হবে অনেক কিছু।
যতই শুভ্রা বলুক কিচ্ছু লাগবে না তার, কিন্তু মানুষের মন ঘুরে যেতে কতক্ষণ? তার ওপরে রয়েছে শুভ্রার বোনের প্ররোচনা।
শুভ্রার আব্বু কষ্ট করে বড় হয়েছেন, পারভেজের মনস্তত্ত্বটা বোঝেন খানিকটা। কিন্তু শায়লা সেসব মানতে রাজি নয়। আর তার প্রেম মুকুলেই উপড়ে ফেলা হয়েছে, সেই জেদ তো আছেই।
পারভেজের পৈতৃক বাড়ি ময়মনসিংহ, বিয়ের পর মেয়ে সরাসরি মাইক্রোতে করে ময়মনসিংহ চলে গেল। বৌভাত সেখানেই হয়েছিল, কী এক ছুতো দেখিয়ে যায়নি শায়লা।
বৌভাতের দিন কমিউনিটি সেন্টারের ভীষণ গরমে আর গাদাগাদি ভিড়ে আচমকা মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল শুভ্রার আম্মু, ওখান থেকে ধরাধরি করে তাকে নিয়ে শোয়ানো হয়েছিল পাশেই পারভেজদের বাসায়। চেক করে দেখা গেল হাইপো হয়ে গেছে, খোঁজ নিয়ে জানা গেল দুশ্চিন্তায় অনেকক্ষণ না খেয়ে থেকে এই অবস্থা।
তো এর জন্য তো আর পারভেজ দায়ী নয়? কিন্তু শায়লা এই নিয়েও ফোনে কাটা কাটা কথা শোনাতে ছাড়েনি তাকে।
আম্মু নাকি তাদের জন্যই অসুস্থ হয়ে গেছে। রাগে গা জ্বলে গেলেও চুপ করে ছিল পারভেজ।
শুভ্রাকে কিছু জানায়নি যদিও। বেচারি শুধু শুধু কষ্ট পেত।
বোনের কথার জন্য তো আর সে দায়ী নয়। কিন্তু ঝামেলা এড়াতে চাইলেও এড়ানো সম্ভব হলো না।
অসুস্থ মাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল নতুন বউ, ঠিকমতো কথাই বলতে পারল না আত্মীয় স্বজনদের সাথে। এক কান থেকে দু কান হয়ে খবর ছড়িয়ে গেল পারভেজের নতুন বউটা ভীষণ দেমাগি, অহংকারী।
সেদিনই তাড়াহুড়ো করে ফিরানিতে ঢাকা চলে এলো শুভ্রা, আর পেছনে রয়ে গেল পারভেজের সব আত্মীয় স্বজন পারভেজের আম্মার কান ভাঙানি দিতে। সব কিছু বুঝেও শুভ্রার পক্ষে একটা কথাও বলেনি পারভেজ, জানে তাতেও তীরটা ঘুরে যেত শুভ্রার দিকেই।
নতুন বউ এসেই ছেলেকে বশ করে ফেলেছে!
সেই যে ঝামেলা শুরু হলো, যদিও মিটে গিয়েছিল কিছু দিন পর, রেশ রয়েই গিয়েছিল খানিকটা। তারপর হাতির পুলের এক রুমের বাসা সাবলেট নেওয়ার পর সবার আগে শুভ্রার জন্য ওয়ার্ডরোব কিনেছিল পারভেজ, নাহয় কাপড় চোপড় রাখবে কোথায়?
পরিকল্পনা ছিল একে একে কিনবে সব কিছু, বাবুই পাখির মতো সংসার সাজাবে একটু একটু করে। তাতেও খুশি ছিল শুভ্রা কিন্তু বিপত্তি বাঁধল এক বার শায়লা এসে ঘুরে যাওয়ার পর।
শায়লাকে কেউ দাওয়াত করেনি, সে এসেছিল নিজের কৌতূহলেই। আর বেছে বেছে এসেছিল শনিবার দিনেই।
পারভেজের অফিস ছুটি সপ্তাহে এক দিন, শুধু শুক্রবার। শুভ্রার ছুটি শুক্র শনি দুদিন।
শায়লা ইচ্ছে করেই এসেছিল শনিবার দুপুরে যেন পারভেজ না থাকে বাসায়, আর এসেছিল খুব অল্প সময়ের নোটিশে যেন খুব বেশি আয়োজন করবার সুযোগ না পায় শুভ্রা।
আর সে ঘুরে যাওয়ার পর থেকেই ভার হয়েছিল শুভ্রার মুখ। এই বাসায় লিফট নেই কেন, এসি নেই কেন, ফ্রিজ নেই কেন, কেন তারা খাট কেনেনি এখনো, কেন ফ্লোরিং করে শোয়, কেন ডাইনিং টেবিল কেনেনি, কেন আর এফ এলের প্লাস্টিকের টেবিলে খায় এই সব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়ে গিয়েছিল দুই বোনের মধ্যে, শুভ্রা না বললেও টের পেয়ে গিয়েছিল পারভেজ।
নব দম্পতির মধ্যে বিয়ের পর সেই প্রথম কোনো ভালোবাসাবাসি হয়নি রাতে, ক্লান্তির অজুহাত দিয়ে ঘুমিয়ে যাওয়ার ভান করেছিল পারভেজ। আর ভীষণ তিক্ততায় ছেয়ে গিয়েছিল মনটা।
এমনটাই যে হওয়ার কথা তা তো জানাই ছিল শুভ্রার, সে তো কিছুই গোপন করেনি, তাহলে এখন কেন মুখ ভার, চোখ কেন ছলো ছলো?
আর পর দিন সকালে এত দিন পর প্রথম পারভেজ ভুলে গিয়েছিল শুভ্রাকে বিদায়ী চুমু খেতে। দূরত্বের শুরুটা বুঝি এভাবেই হয়?
তবে বরফ গলতে খুব বেশি সময়ও লাগেনি প্রথম বার। অফিস থেকে ফেরার পথে শুভ্রার প্রিয় হালিম নিয়ে ফিরে এসেছিল পারভেজ।
হালিম দেখেই মুখে হাসি ফুটেছিল শুভ্রার। নিজেই হাত থেকে হালিমের হাঁড়িটা নিয়ে রান্নাঘরে চলে গিয়েছিল শসা লেবু কেটে আনতে।
আহ কি সব দিন গিয়েছে! দেখে দেখে যেন আশ মিটত না শুভ্রাকে।
হাতির পুলের পাঁচ তলায় সেই এক রুমের ফ্ল্যাটের ছোট্ট জানালায় উঁকি দিয়ে কোনো দিন চাঁদ লজ্জা পেয়ে যেত ওদেরকে দেখে আবার কোনো কোনো বর্ষার দিন খোলা জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাট এসে ঘুম ভাঙিয়ে দিলে জানালা বন্ধ করার বদলে বাইরে হাত বাড়িয়ে দিত শুভ্রা।
আদুরে গলায় বলত, “চলো ছাদে যাই!”
“মাথা খারাপ? এই বৃষ্টিতে ছাদে?” এক কথায় শুভ্রার আবদার নাকচ করে দিয়ে ওকে এক ঝটকায় বুকের ভেতরে টেনে নিত পারভেজ। ক্ষণে ক্ষণে মুহুর্মুহু বিজলির সার্চ লাইট জ্বালিয়ে ওদের প্রেম বিনিময়ের প্রমত্ত মুহূর্তগুলো ঝলকে দেখে নিত দুরন্ত আকাশ।
বিজলি চমকালে লজ্জায় দু হাতে মুখ ঢাকত শুভ্রা আর বাইরে অঝোর বর্ষণকে পারভেজের মনে হতো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আবহ সঙ্গীত। শুভ্রা বলত, “ক্যাম্পাসে থাকতে কত রিকশা করে ঘোরা হতো, এখন আর হয়ই না! চলো না এক দিন যাই?”
“আচ্ছা যাব!” শুভ্রার চুলের ঢলে মুখ ডুবিয়ে দিতে দিতে বলত পারভেজ।
কিন্তু হয়নি। গত দেড়টা বছরের মধ্যে কি একটা দিনও সময় করতে পারেনি পারভেজ?
আসলেই তো কেন পারেনি? কী নিয়ে ব্যস্ত ছিল সে?
এখন মনে পড়লে নিজের দিকেই রাগ হয়। শুক্রবার দিনগুলোতে সকালে যেন বিছানা থেকেই উঠতে মন চাইত না।
সাড়ে এগারোটায় বুয়া আসত, তার আগে পর্যন্ত বিছানাতেই গড়াগড়ি করত আর মন চাইলে শুভ্রাকে টেনে নিত বুকের ভেতর। শুভ্রা যেন ছিল একটা জীবন্ত খেলনা, যাকে নেড়ে চেড়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যতভাবে দেখা যায় ততই আনন্দ।
অথচ শুভ্রার মন খারাপ তার চোখে পড়ত না। পারভেজের শুক্রবার বিকেলগুলো বরাদ্দ ছিল টিউশ্যনির জন্য।
ফার্মগেটে একটা কোচিং এ ক্লাস নিত পারভেজ। টাকার ভীষণ প্রয়োজন ছিল।
দিনের পর দিন জমে ওঠা শুভ্রার বিষণ্ণতা ওর চোখে পড়ত না, অভিযোগ করতে আসলে কানে তুলত না। কেবলই বিয়ের আগের দিনগুলোর সাথে তুলনা করত বিয়ের পরের দিনের।
কিছুই কেন কানে যায়নি পারভেজের?
গত রাতে আর থাকতে না পেরে শুভ্রাকে মেসেজ পাঠিয়েছে সে, অনেক দিন পর।
“ফিরে এসো, প্লিজ! রিকশায় ঘোরা বাকি আছে যে আমাদের!”
(প্রিয় পাঠক, গল্পটি পড়তে ভালো লাগলে প্রি অর্ডার করতে পারেন আমার নতুন বই “নাটাই ঘুড়ি”। প্রি অর্ডার লিংক কমেন্ট সেকশনে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here