#প্রিয়ন্তিকা
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – |২৩|
মাহতিমের ধৈর্য্যের বাঁধ এবার চূ”র্ণবি”চূর্ণ হয়ে পরে। রাগে মাথার ভেতরটায় আগুন দাউদাউ করে জ্ব”লে। এসব পাগলামি কার জন্যে করেছে মাহতিম। প্রিয়ন্তির জন্যই তো! অথচ যার জন্যে মাহতিম বেপরোয়া তাকেই প্রিয়ন্তি বুঝে না। কেন বুঝে না? সে কি একটুও ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নয়? মাহতিম প্রিয়ন্তির হাত নিজের কলার থেকে ছাড়িয়ে নেয়। প্রিয়ন্তি চমকে উঠে। মাহতিম প্রিয়ন্তির দুহাত নিজের হাতে চেপে ধরে পিঠের পেছনে বেধে তীক্ষ্ম কণ্ঠে বলে,
‘ হ্যাঁ, আমি বন্ধুত্ত্বের যোগ্য নই। তোর যোগ্য কে তাহলে? ওই অনুরাগের বাচ্চা অনুরাগ? ও তোর সাথে কথা বললে, ভালো লাগে। আর আমি কথা বললে গায়ে ফো”সকা পরে? কি আছে ওর মাঝে যা আমার মধ্যে নেই? বল! ‘
প্রিয়ন্তি চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে থাকে মাহতিমের দিকে। মাহতিমের হাতের ভাঁজে পি”ষে যাচ্ছে প্রিয়ন্তির হাত। হাতের ব্যথায় মরে যাচ্ছে ও। তবুও সেই ব্যথা তুচ্ছ ঠেকল প্রিয়ন্তির কাছে। মাহতিমের এমন অভদ্রের মত আচরনের সঙ্গে প্রিয়ন্তি একটুও পরিচিত নয়। এ যেন এক নতুন মাহতিম। হঠাৎ মাহতিমের হাতের আঙ্গুল প্রিয়ন্তির কব্জিতে দাবিয়ে মাহতিম চেঁচায়,
‘ কথা বলস না ক্যান? ‘
প্রিয়ন্তি চোখের জল ফেলে। মৃদু স্বরে বলে,
‘ অনুরাগে মধ্যে কি আছে জানতে চাও? অনুরাগ আমার প্রতিটা ভালো মন্দের খেয়াল রাখে। আমার কোন কাজে অসুবিধা হবে, সেটা ওর মাথায় থাকে। আর সবচেয়ে বড় কথা, অনুরাগ আমাকে সম্মান করে! জানো, আজ তোমার কথা ও শুনে একটুও রিয়েক্ট করেনি। বরং রাগের মাথায় তোমাকে কষ্ট না দেই, সেই কথা বলেছে। অথচ তুমি হলে কি করতে। অনুরাগের সঙ্গে আমার নাম মিলে গেলে অনুরাগকে মা”রধর করতে। তারপর এক বুক অপরাধবোধে আমাকে ডুবিয়ে নিশ্চিন্তে মনে আবার আসতে ভালোবাসার কথা বলতে। তোমার কাছে আমি কখনো চাইনি, তুমি আমার জন্যে কাউকে মা”রো, পে”টাও। আমার জন্যে আমারই অফিসের বসকে ব্ল্যাকমেইল করো। বস খারাপ, আমি মানছি সেটা। কিন্তু তাই বললে তুমি আমাকে উপর বিশ্বাস রাখতে পারতেনা। আমি সব সামলে নিতাম, সেই বিশ্বাসটুকু তোমার আমার উপর নেই। এটাই তোমার আর অনুরাগের মধ্যে পার্থক্য। একবার মনে আছে, তুমি আমার জন্যে রাস্তার বখাটেদের সঙ্গে মারামারি করেছ। আমি তাদের প্র”তিশো”ধের কারণে রে”ইপড হতে পারতাম তাদের কাছে। আল্লাহ আমাকে সেদিন বাঁচিয়েছিলেন। নাহলে আজ আমার দেহ কবরে থাকত। ওদেরকে এই সুযোগ কে দিয়েছে? তুমি দিয়েছ! সবসময় মা”রামা”রি করা কোনো কিছুর সমাধান না। তুমি যদি মা”রামা”রি না করে, বারবার সব জায়গায় আমাকে নিজের বেপরোয়া পাগলামি দিয়ে অ”পদস্ত না করে আমার ভালোবাসা চাইতে, আমি হয়ত একসময় না একসময় গলে যেতাম। কিন্তু তোমার এই অসহ্য পাগলামিই আমাকে তোমার দিকে এগিয়ে যেতে বাঁধা দিচ্ছে, মাহতিম। ‘
মাহতিম এসব শুনে চট করে প্রিয়ন্তির হাত ছেড়ে দেয়। প্রিয়ন্তি হাতে কব্জি চেপে ধরে। রক্ত পড়ছে হাত থেকে। প্রিয়ন্তি চোখের জল মুছে মৃদু স্বরে হেসে বলে,
” ভালোবাসা মানেই কাউকে জোর করা না, মাহতিম। ভালোবাসা হল নিজের কাজ দ্বারা ওপর মানুষকে বুঝিয়ে দেওয়া, সে তোমায় চোখ বন্ধ করে ভরসা করতে পারে। অথচ তুমি? আমি তোমাকে ভরসা করতে পারি না মাহতিম। তোমার এই ভালোবাসা আজ অব্দি আমাকে অনেক ট”র্চার করেছে, অনেক বিপদের সম্মুখীন করেছে। আর এখন যদি আমি তোমায় বিয়ে করি, তাহলে বলা যায় না তোমাকে এই পাগলামি ভালোবাসার কারণে আমি কতটা মানসিক, শারীরিক যন্ত্রনায় ভুগব। আমি তোমায় ভ”য় পাই, মাহতিম। এই ভয়টা আমার অনুরাগে প্রতি আসেনা। ভালো থেকো। ‘
প্রিয়ন্তি চলে যাচ্ছে। কাদতে কাদতে পথে হাঁটছে ও। বারবার চোখের পানি মুছে হয়তো মনেমনে ধিক্কার জানাচ্ছে মাহতিমকে। প্রিয়ন্তি কিছু হলে কাদতে পারে, কিন্তু মাহতিম কেন কাদতে পারে না! কাদতে ইচ্ছে করলে, চোখ লাল টকটকে হয়ে যায়। নাকের পাটা ফুলে যায়। কিন্তু তবুও কান্না আসে না। মাহতিম আর তাকায় না। গলার টাই ঢিলে করে টাই ছিঁ”ড়ে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দেয়। অফিসে ঢুকে নিজের কেবিন থেকে ব্যাগপত্র নিয়ে বেরিয়ে যায় অফিস থেকে। পথে তাকে আটকায় তার অফিসের কলিগ। অফিস রেখে এখন মাহতিম কোথায় যাচ্ছে জানতে চাইলে, রাগে অন্ধ মাহতিম শুধু এটুকু বলে,
‘ জা”হান্নামে যাচ্ছি। সামনে থেকে সরে দাঁড়াও। ‘
কলিগ আর ঘাটায় না মাহতিমকে। মাহতিম বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে। নিজের ঘরে এসে কাধের ব্যাগ ছুঁড়ে ফেলে সোফার উপর। মাহতিমের ভাই টেবিলে বসে তখন দুপুরের খাবার খাচ্ছে। ভাবি মাহতিমকে এভাবে রে”গে ভেতরে আসতে দেখে দৌঁড়ে যান মাহতিমের দিকে। তবে তার আগেই মাহতিম নিজের ঘরে এসে দরজা আটকে দেয়। ভাবি দরজায় করাঘাত করেন,
‘ মাহতিম, এই মাহতিম। দরজা খুল। কি হয়েছে তোর? এভাবে হুট কর অফিস থেকে চলে এলি কেন? মাহতিম। ‘
মাহতিম জবাব দেয় না। কিছুক্ষণ বারান্দার দোলনায় বসে থাকে। মনেমনে ভাবতে থাকে, প্রিয়ন্তির কথা। এই একটা মেয়ের জন্যে মাহতিম কত কিনা করেছে। নিজেকে বিসর্জন দিয়েছে এই মেয়ের তরে। প্রিয়ন্তি তাকে ভালো না বাসুক, একটু মায়া দয়া তো দেখাতে পারত। বস তার সঙ্গে অভদ্রতা করেছে, এটা প্রিয়ন্তি কেন নিজে থেকে বলেনি। আজ যখন মাহতিম এসব জেনে বসের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়েছে, সেটা প্রিয়ন্তির খারাপ লেগেছে। হ্যাঁ, মানছে সে প্রিয়ন্তির বিশ্বাস ভেঙেছে। বন্ধুত্বের দেওয়া শর্ত ভেঙেছে। কিন্তু এসব কেন করেছে সে সেটা একবার ভাবতে ইচ্ছে করল না প্রিয়ন্তির। এত কঠোর কেন এই মেয়ে? আর কি করলে, এই মেয়ের একটুখানি ভালোবাসা পাওয়া যাবে? কি করলে?
মাহতিম শার্ট খুলতে খুলতে বারান্দা থেকে ঘরে এলো। শার্ট খুলে বিছানার উপর ছুঁ”ড়ে ফেলল। থুতনির নিচ গলার জায়গাটা জ্বল”ছে। মাহতিম আয়নার সামনে গিয়ে গলা দেখল। প্রিয়ন্তির নখের আঁ”চড় লেগে গেছে। মেয়েটা কি নখ কা”টে না ঠিকমত? মাহতিম রাগ সামলাতে না পেরে আয়নায় ঘু”ষি দেয়। সঙ্গেসঙ্গে আয়না ভে”ঙেচুরে মাটিতে পরে যায়। মাহতিম সেই ভাঙ্গা আয়নায় হেঁটে দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে বসে পরে। পা থেকে র”ক্ত ঝরছে তার। সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই তার। এতক্ষণের হম্বিতম্বি পর মাহতিম ক্লান্ত হয়ে যায়। সিলিংয়ের দিকে চেয়ে ভেজা কণ্ঠে আল্লাহর কাছে অভিযোগ করে,
‘ কেউ আমায় একটু ভালোবাসা দাও। আমি ভালবাসা না পাওয়ার অভাবে মা”রা যাচ্ছি। ও আমায় কেন ভালোবাসল না? ‘
____________________________
অনুরাগ ভয় পাচ্ছে। আজকাল প্রিয়ন্তিকে হারিয়ে ফেলার ভয় তাকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়ায়। আর আজ প্রিয়ন্তির মুখে যখন শুনেছে, মাহতিম তার আপন কেউ! অনুরাগের পুরো পৃথিবী থমকে দাড়িয়েছে। অন্ধকার লেগেছে আশপাশ, ভূমণ্ডল। বোধ হয়েছে, প্রিয়ন্তি মেয়েকে জয় করা এত সহজ নয়! প্রিয়ন্তি হচ্ছে গোলাপের ন্যায়। গোলাপ পেতে গেলে তার কাটার ব্যথা তো সহ্য করতেই হবে। অনুরাগ তাই সিদ্ধান্ত নেয়। সে অতি দ্রুত প্রিয়ন্তিদের বাড়িতে বিয়ে প্রস্তাব পাঠাবে। আর কোনো হেয়ালিপনা নয়। প্রিয়ন্তিকে হারিয়ে ফেলার আগেই তাকে নিজের করে নিতে হবে। নাহলে পস্তাতে হবে অনেক!
#প্রিয়ন্তিকা
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – |২৪|
মাহতিমের ঘরে ভা”ঙচুরের শব্দ শুনে রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন হৈমন্তি। মাহতিমের ঘরের দরজার পাশে বড় ছেলের বউ দাড়িয়ে ক্রমাগত কড়া নাড়ছে। হৈমন্তি ছেলের এমন দূরবস্থা দেখে দরজায় শক্ত করে এক আঘাত করলেন। চিৎকার করলেন ওপাশ থেকে,
‘ বাপ, কি হইসে তোর? দরজা খোল। আম্মা ডাকতাসি তো। আব্বা! কেউ কিছু বলসে? বন্ধুদের লগে মাইর করছিস? দরজা খোল, বাপ।’
মায়ের কথা শুনে মাহতিমের অশান্ত মন কেমন যেন ঝিমিয়ে পরল। শান্তিতে চোখ বুজে দরজায় হেলান দিয়ে বসলো। ওপাশ থেকে বড় ভাইয়া এবার ডাকছে। বাবা বাসায় থাকলে বাবাও নিশ্চয়ই ডাকত। মাহতিমের ঘরের দরজা যেন সবাই ভে”ঙে ত”ছনছ করে দেবে এবার। মাহতিম শেষ পর্যন্ত আর বসে থাকতে পারল না। উঠে দরজা খুলে দিল। সঙ্গেসঙ্গে হুড়মুড়িয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকলেন একে একে সবাই। মাহতিমের বড় ভাই তার দিকে আগুন চোখে চেয়ে। পুলিশ অফিসার হওয়ায় বরাবরই তার রাগ চূড়ান্ত। তাই মাহতিমের এমন দুরন্তপনা সে ভালো চোখে মোটেও দেখেনি। মাহতিমের বড় ভাই সীমান্ত বেশ চটে গিয়ে বলল,
‘ অভদ্রতা শিখেছিস? বাইরে থেকে মাথা গরম করে ঘরে এসে কাদের সঙ্গে রাগ দেখাচ্ছিস? এই বেজবান জিনিসগুলোর উপর? ‘
মাহতিম কথা বলে না। চুপ করে বিছানায় বসে থাকে। হৈমন্তি বড় ছেলেকে থামান। চুপ করবি, বলে মাহতিমের পাশে এসে বসেন। মাহতিমের পা তখনো কাটা। রক্ত চুঁইয়ে পরছে পা থেকে। বড় ভাবি দ্রুত স্যাভলন আর তুলো নিয়ে আসেন। মাহতিমের পায়ের কাছে বসে বলেন,
‘ দেখি, পা এগো। কত্তখানি কেটে ফেলেছিস। ইশ! ব্যথা করছে না? ‘
ভাবি নিজের মত বকতে বকতে মাহতিমের পায়ের রক্ত পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। মাহতিমের মা জিজ্ঞেস করলেন,
‘ আব্বা, কি হইসে বল আম্মারে। কে কি কইসে তোরে? ‘
ব্যান্ডেজ করা শেষ হলে ভাবি, নয়না এসে স্বামির পাশে দাঁড়ান। সীমান্ত এখনো ভ্রু কুঁচকে মাহতিমের দিকে চেয়ে। ভাইয়ের মতিগতি ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সে। সীমান্ত একপল ঘরের ভাঙ্গাচুরা আসবাবপত্রের দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলল,
‘ কি হয়েছে তোর, বলবি তো। এমন গর্দভের মত চুপ করে আছিস কেন? ‘
মাহতিম সোজা হয়ে বসল। মাথা নত করে পায়ের ব্যান্ডেজের দিকে নির্লিপ্ত চোখে চেয়ে বলে বসল আচমকা,
‘ আমি একটা মেয়েকে ভালোবাসি এবং তাকে বিয়ে করতে চাই। এবং তা এক সপ্তাহের মধ্যেই। ”
আচমকা মাহতিমের এহেন কথা যেন বিস্ফোরণ ঘটাল পুরো ঘরে। সীমান্তের কুচকে রাখা ভ্রু সোজা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। হৈমন্তির হাত নেমে এসেছে মাহতিমের কাধের উপর থেকে। নয়না অবশ্য নির্লিপ্ত। কারণ সে জানে মাহতিম একটা মেয়েকে পাগলের মত পছন্দ করে। মাহতিমের মানিব্যাগে সেই মেয়ের ছবি আছে, একবার দেখেছে নয়না। হৈমন্তি হতভম্ব হয়ে বলল,
‘ কারে ভালোবাসছ? মেয়ের নাম কি, কোথায় থাকে, কি করে? ‘
মাহতিম আগের ন্যায় গম্ভীর থেকে উত্তর দেয়,
‘ প্রিয়ন্তি জাহান। বয়স ২৪। মিরপুরে ১০ এ থাকে। আগে একটা অফিসে জব করত। এখন করে না। ‘
কথাগুলো মাহতিম কেমন মুখস্তের ন্যায় বলে দিল। যেন প্রিয়ন্তিকে আগাগোড়া চেনার অধিকার কেবল তারই। হৈমন্তি কিছুক্ষণ বিস্মিত চোখে মাহতিমের দিকে চেয়ে থাকলেন। পরপরই হেসে উঠে বললেন,
‘ তো তুই এই মেয়ের জন্যেই চাকরি নেওয়ার লাইগা এত উতলা হয়ে গেছিলি? মেয়ে দেখতে কি খুব সুন্দরী রে মাহতিম? ‘
মাহতিম মায়ের দিকে চায়। মৃদু হেসে বলে,
‘ তুমি আর ভাবি ছাড়া, আসমান জমিনে থাকা সকল নারী থেকে সে সবচেয়ে বেশি সুন্দরী। ‘
ইশ! হৈমন্তি খুশিতে পাগল হয়ে যাচ্ছেন। সীমান্ত বলল,
‘ এভাবে এক সপ্তাহের মাথায় কিভাবে বিয়ে হবে? মেয়ের পরিবারের সিদ্ধান্ত বলেও তো একটা বিষয় আছে! মেয়ে তোকে ভালবাসে নাকি শুধু তুই একাই? ‘
মাহতিম মনেমনে মিথ্যা বলার জন্যে প্রস্তুতি নিল। মিথ্যা বললে আল্লাহ গোনাহ দিবেন ঠিকই। কিন্তু এই মুহূর্তে মিথ্যা বলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তাই মাহতিম চট করে বলে ফেলল,
‘ হ্যাঁ, বাসে। ‘
সীমান্তকে হালকা হতে দেখা গেল। মৃদু নিঃশ্বাস ছেড়ে সে বলল,
‘ আমরা আগামীকাল যাব মেয়ের বাড়িতে। দেখি, তার পরিবার রাজি হয় কিনা। রাজি না হলে আমরা জোর করতে পারব না ,সেটা জানিস নিশ্চয়ই। ‘
‘ আরে ভাইয়া, রাজি হবে, হবে। আমি ঠিক রাজি করিয়ে নেব। ‘
সীমান্ত ভ্রু কুঁচকাল। বলল,
‘ এটা তোর রাস্তার ছেলেপেলে না! এটা বিয়ে! এত সহজ ভাবিস না সবকিছু। ‘
মাহতিম কথা বাড়াল না। কিন্তু মনেমনে আওড়াল,
‘ এই মাহতিম কঠিন জিনিসকেও পানির মত সহজ করতে জানে। সোনা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আঙ্গুল কিভাবে বাকাতে হয়, এই মাহতিমের তা ভালো করে জানা আছে। ভালো হয়ে যে জিনিস পাইনি, সেটা নাহয় খারাপ হয়েই পাব। ‘
__________________________
প্রিয়ন্তির বাবা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। হাতে সবজি বাজারে ব্যাগপত্র। সবজি বাজারে আজ কি ভীষন ভিড় ছিল। গরমও সেই সাথে অনেক পরেছে। গরমে গা তার জ্বলছে রীতিমত। হাবিব রুমাল বের করে কপাল, গলার ঘামটুকু মুছে নিলেন। যে পথে যাচ্ছেন হাবিব, রাস্তাটা ভীষন নিরব আজ। একটা জনমানব দেখা যাচ্ছে না। ছোট গলিতে এমনিতে তো অনেক মানুষ থাকে। আজ কেন যে নেই সেটাই বোধগম্য হচ্ছে না হাবিবের। নিজের বাড়ির সামনে আসতেই ভ্রু কুঁচকে গেল তার। সেদিনের বৃষ্টিতে ভেজার সময় সাহায্য করা ছেলেটা দাড়িয়ে আছে বাড়ির সামনে। মাহতিমের দৃষ্টি অনুসরন করে উপরে তাকালেন হাবিব। ঠিক তার মেয়ের ঘরের দিকেই চেয়ে আছে ছেলেটা। হাবিবের মেজাজ চড়ে গেল। সাতপাঁচ চিন্তা করে দ্রুত মিলিয়ে ফেললেন ব্যাপারটা। ছেলেটা ভালো ভেবেছিলেন। অথচ তার মেয়ের সঙ্গেই উনিশ বিশ করছে? তেড়ে সামনে এগুবেন, তার আগেই তার সামনে চলে এল দুজন মুখোশধারি ছেলে। এসেই হাবিবকে টেনে নিয়ে গেল একটা বাড়ির পেছনে। হাবিব তখন ছটফট করছেন। মুখ চেপে ধরে রেখেছে তারা। কথা বলতে পারছেন না হাবিব। বুকের ভেতর অস্থির লাগছে। এই বুঝি আবার হার্ট এ্যাটাক হল। কদিন আগেই একটা ধকল গেল। এখন আবার কিছু হলে ,বাঁচবেন না নিশ্চিত। হাবিবের সঙ্গে স”ন্ত্রাসী লোকদের বেশ ধ”স্তাধস্তি হল। একপর্যায়ে তারা হাবিবের গলায় ছু”রি লাগিয়ে বলল,
‘ মানিব্যাগ আর ফোন বের কর। কোনো কথা বলবি না। ‘
হাবিব ভয়ে সিটিয়ে গেলেন। ব্যাগ থেকে মানিব্যাগ বের করতে লাগলে হঠাৎ পেছন থেকে ইটের বড় টুকরো এসে পরে স”ন্ত্রাসীদের মাথায়। সঙ্গেসঙ্গে স”ন্ত্রাসী দুজন ছু”রি সমেত পেছনে হেলে যায়। মাথায় হাত দিয়ে চেপে আগুন চোখে পেছনে তাকায়। হাবিবও তাকান। মাহতিম হাতে বড় কয়েকটা ইটের টুকরো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে মৃদু হাস! স”ন্ত্রাসী দুজন ছু”রি নিয়ে তেড়ে যায় মাহতিমের দিকে। মাহতিম ইটের টুকরো এবার একে একে ছুঁড়ে ফেলে তাদের মুখের উপর। তারা মুখে চোখে হাত চেপে ছটফট করে উঠে। ছু”রি আবার পকেটে পুড়ে হুন্ডায় চেপে বসে পালাতে চায়। তবে তার আগেই মাহতিম তাদের ধরে ফেলে। আর ধরেই সবার আগে ছু”রি নিজের হাতে নিয়ে নেয়। সন্ত্রাসীদের মুখ থেকে মুখোশ খুলে ছুঁড়ে ফেলে মাটিতে। অবাক হয় মাহতিম। এরা অল্পবয়স্ক ছেলে। এই বয়সেই এমন ভয়াবহ কাজ করার দুঃসাহস এদের কিভাবে হয়? মাহতিম দুটো ছেলের মুখে ভয়াবহ দুইটি ঘু”ষি দিয়ে চেঁচায়,
‘ বাল পাকনা হইসে তোমাদের। হাডুডু খেলার বয়সে এখন ছু”রি চালাস? তোদের তো আজ আমি…’
আরেকটা ঘু”ষি পরে ছেলে দুটো মুখের উপর। সঙ্গেসঙ্গে মুখ বেঁকে যায় তাদের। হাবিব এসে আটকান মাহতিমকে। বলেন,
‘ উঠো। ওদের পুলিশে দাও। এভাবে মারলে পরে তোমার উপরই কেইস হয়ে যাবে। ‘
মাহতিম রাগে তখন অন্ধ। কিন্তু প্রিয়ন্তির বাবার কথা ফেলতে পারে না। উঠে দাঁড়ায়। ছেলেগুলোকে বেঁধে ভাইকে ফোন লাগায়। খানিক পর সীমান্ত তার দলবলসহ আসে সেখানে। সীমান্তকে দেখে অবাক হয়ে যান হাবিব। তার মুখ ফুটে বেড়িয়ে যায়,
‘ তুই? ”
সীমান্তও এতদিন পর পুরোনো স্যারকে দেখে অবাক হয়। সঙ্গেসঙ্গে এসে জড়িয়ে ধরে প্রিয় শিক্ষককে। হাবিব ছলছল চোখে সীমান্তর পিঠে হাত বুলান। আগে যখন তারা সপরিবারে গ্রামে ছিলেন, তখন সেখানে একটা ছোট বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন হাবিব। সীমান্ত ও ইয়ান সেখানেই পড়াশোনা করত। সীমান্ত ছিল শান্তশিষ্ট! কিন্তু ইয়ান দুরন্ত ছিল। ইয়ান সেসময় ছোট ছিল দেখে তাকে বড় হবার পর এই নতুন নামের মাহতিমকে চিনতে পারেন নি হাবিব। কিন্তু সীমান্তের চেহারা তার মনে আছে। কিশোর বয়সের সঙ্গে এখনের চেহারা মিলে যাচ্ছে খাপেখাপ। বহুদিন পর প্রিয় একজন ছাত্রকে দেখে আবেগে জড়িয়ে যাচ্ছেন হাবিব। হাবিবের চোখ ছলছল। সীমান্ত হাবিবের পা ছুঁয়ে সালাম দিয়ে বলল,
‘ কত বছর পর আপনাকে দেখলাম, স্যার! কত শুকিয়ে গেছেন আগের থেকে! অসুস্থ নাকি? ‘
হাবিব চোখের জল মুছে মৃদু হেসে বললেন,
‘ আগের মত গায়ে আর শক্তি নেই। একটার পর একটা রোগ লেগেই আছে সারাক্ষণ। তোর কি খবর? ইয়ান বেশ বড় হয়ে গেছে। আমি তো চিনতেই পারিনি। আমার ছাত্র, আর দেখো কি না আমিই দেখে চিনি নি। এদিকে আয় ইয়ান। ‘
মাহতিম মৃদু হেসে হাবিবের পা ধরে সালাম করে। হাবিব বলেন,
‘ ইয়ানের নামই যে মাহতিম এটা আগে বলিস নি কেন? ‘
মাহতিম সলজ্জ হেসে বলে,
‘ বড় হবার পর এই নামেই সবাই চিনে। তাই আর কাউকে বলা হয়না ইয়ান নামের কথা। ‘
হাবিব মৃদু হাসেন। বলেন,
‘ আমার ঘর সামনেই। আসো দুজন। চা খেয়ে যাবে। আমার মেয়ে খুব ভালো চা বানায়। ‘
মাহতিম শুনে অন্যদিকে ফেরে ঠোঁট টিপে হেসে উঠে। সীমান্ত মাহতিমকে দেখে। তারপর স্যারের দিকে চেয়ে রহস্য করে বলে,
‘ আজ না স্যার। কালকে আসব। তবে একা নয়। একটা অনুরোধ নিয়ে। রাখবেন তো স্যার? ‘
হাবিব উজ্জ্বল হয়ে বলেন,
‘ রাখব, রাখব। তুই যে অন্যায় কিছু চাইতে পারিস না এটা আমার বিশ্বাস আছে। ছোট থেকেই খুব ভালো ছেলে ছিলি। মানুষ হিসেবেও এখনও যে ভালো আছিস, এটা আমি বুঝতে পেরেছি। ‘
সীমান্ত মৃদু হাসে। মাহতিমের ঠোঁটে বাঁকা হাস। ভাই যে অনুরোধ বলতে তার কথাই বুঝিয়েছে এটা সে খুব বুঝতে পারছে। হঠাৎ করে এভাবে সব প্ল্যানমাফিক হয়ে যাবে বুঝিনি মাহতিম। মাঝখানে স”ন্ত্রাসী এসে মাহতিমের কষা প্ল্যানকে আরো শক্তপোক্ত করে ফেলবে, সেটাই সে বুঝতে পারেনি। এবার জমবে খেলা। মাহতিম মাথা তুলে প্রিয়ন্তির ঘরের দিকে দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে বলে,
‘ অপেক্ষা এবার শেষ হবে প্রিয়ন্তিকা। আমার নামের বিয়ের শাড়ি পড়ার সময় এসেছে তোমার। শীগ্রই তুমি আমার হবে! এটা এই মাহতিম ইয়ানের ওয়াদা রইল। ‘
#চলব