#অনিন্দিতা
#৮ম_পর্ব
#স্নিগ্ধতা_প্রিয়তা
–“তোমার কি হিংসে হচ্ছে?”
তাজের এমন কথা শুনে চুপ হয়ে যায় অনি। আসলেই কি অন্তরা মেয়েটাকে ওর হিংসে হচ্ছে! কিন্তু তাজের গার্লফ্রেন্ড থাকলেতো ওর জানার কথা। কারণ তাজ কখনো ওর আর পিহুর থেকে কিছু লুকায় না। পুরো ভার্সিটি লাইফে তাজকে কখনো কোনো মেয়েকে নিয়ে কথা বলতে শোনেনি ও৷ তাহলে গার্লফ্রেন্ড কোথা থেকে আসবে! তারপরেও অনির বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছে। কারণ ও এখন তাজের বউ! তাই তাজের লাইফে এখন আর কেউ থাকতে পারে না। ও কিছুটা দ্বিধা নিয়েই বলে,
–“না! মানে! আসলে….হিংসে কেন হবে! আমি জানি তোমার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই! তোমার গার্লফ্রেন্ড থাকতেই পারে না!”
অনিকে এমন আমতা-আমতা করতে দেখে তাজ হেসে ফেলে। তারপর অনির হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বলে,
–“কেন? আমার গার্লফ্রেন্ড কেন থাকতে পারে না? ”
অনি কি বলবে বুঝতে পারে না। তাই একটু চিন্তাভাবনা করে উত্তর দেয়,
–“তোমার মতো ক্যাবলা-কান্ত ছেলের আবার গার্লফ্রেন্ড থাকবে কি করে! তুমিতো আমি আর পিহু ছাড়া অন্যকোন মেয়ের সাথে কথাই বলতে না বেশি!”
অনির সাথে এই নিয়ে কথা বলে তাজ বেশ মজা পাচ্ছিলো। অনিকে রাগানোর জন্য তাজ হেসে বলল,
–“তোমাদের দেখিয়ে সবার সাথে কথা বলতে হবে নাকি? আমার গার্লফ্রেন্ড থাকতেই পারে!”
অনি এবার মনটা ভীষণ খারাপ করে ফেলে। তারপর আচমকা তাজের ফোনটা কেড়ে নিয়ে বলে,
–“না পারেনা! তোমার গার্লফ্রেন্ড থাকতে পারে না! ”
–“কেন? কারণ দেখাও!”
–“বললামতো! তোমার মতো ক্যাবলা-কান্ত…..! ”
–“এটা কোনো কারণ হতেই পারে না! কেননা তুমি ভালো করেই জানো আমার এই পার্সোনালিটির জন্য ক্যাম্পাসে আমি কতটা পরিচিত ছিলাম! রাজনীতিতেও কম ছিলাম না! সে হিসেবে আমার একটা না! অনেকগুলা গার্লফ্রেন্ড থাকতে পারে!”
অনি তখন প্রায় কান্না করে ফেলে। তারপর তাজের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলে,
–“তাহলে যে সবাই বলত, তুমি নাকি শুধু আমাকেই পছন্দ করো! সেটা কি ভুল ছিলো? ইমতিয়াজ এর মতো তুমিও অন্যকাউকে…!”
একথা বলতেই তাজ অনির মুখ চেপে ধরে ওকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে বলে,
–“আরে পাগলী বউ আমার! আমিতো মজা করছিলাম! এতে কান্না করার কি হলো? আমিতো কখনো তোমায় এতটা ইমোশনাল হতে দেখিনি! মজাও বুঝতে পারো না!”
অনিও তাজের বুকে মাথা রেখে শব্দ করেই কান্না করে ফেলে এবার। তারপর বলে,
–“তাহলে এই অন্তরা কে? এতরাতে তোমাকে ফোন কেন করেছে?”
তাজ তখন হেসে ফেলে অনির ওই ব্যবহার দেখে। তারপর বলে,
–“আরে ওতো আমাদের অফিসে নতুন জয়েন করেছে। কাজ তেমন ভালো বোঝেনা। ভোলাভালা একটা মেয়ে। কোনো প্রবলেম হলেই আমার থেকে হেল্প নেয়। হয়তো কাজ নিয়ে কোনো প্রবলেম হয়েছে তাই ফোন করেছে। ”
–“তোমাকে কেন সব বুঝিয়ে দিতে হবে? আরকেউ কি নেই অফিসে? আর এতরাতেই বা ফোন কেন দিবে?”
–“আচ্ছা বাবা, আমি তোমার সামনেই ওকে কল করছি। নিজেই শুনে নিও ও কেন কল করেছে।”
এই বলে তাজ বিছানা থেকে উঠে বসে। অনিও ওর পাশে বসে ফোনের কাছে কান পেতে থাকে। যদিও তাজ ফোনটা লাউডস্পিকারে রেখেছিল। কিছুক্ষণ পরেই ওপাশ থেকে একটা মেয়ে কন্ঠ ভেসে আসে,
–“হ্যালো তাজ ভাইয়া? ”
–“হ্যাঁ অন্তরা, বলো।”
–“আপনি এর আগের বার কল রিসিভ করে কেটে দিলেন কেন?”
–“আসলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”
–“আপনি সুস্থ আছেনতো? আজ অফিসে আসলেন না যে? আমিতো ভাবলাম আপনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন কিনা! কল করব কি করব না তা ভাবতে ভাবতেই এতরাত হয়ে গেলো। আপনার জন্য খুব চিন্তা হচ্ছিলো!”
অন্তরার এমন ন্যাকামি কথা শুনে অনির গা জ্বালা করছে। এতরাতে একটা ছেলেকে ফোন দিয়ে ন্যাকামি করা হচ্ছে!
–“হ্যাঁ অন্তরা আমি ভালই আছি! কোনো দরকার আছে কি?”
তাজের কথা শুনে ওপাশ থেকে অন্তরা কিছুটা অভিমানের সুরে বলে,
–“দরকার ছাড়া কি আমি আপনাকে কল করতে পারি না? আপনি এমন কেন? আমি কেমন আছি না আছি তা একবারও জানতে চাইলেন না?”
–“আচ্ছা তুমি কেমন আছো? ”
–“আপনার জন্য খুব চিন্তা হচ্ছিলো। ভালো কি করে থাকি! কাল অফিসে আসছেনতো?”
–“হ্যাঁ। আচ্ছা এখন রাখি। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।”
–“আচ্ছা ভাইয়া। গুড নাইট!”
–“গুড নাইট!”
বলেই ফোনটা রেখে হাফ ছেড়ে বাঁচে তাজ। অনি এদিকে অন্তরার সাথে এমন ন্যাকামোপূর্ণ কথা শুনে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। তাজের কথা বলা শেষ হতেই অনি বলল,
–“এই তোমার হেল্প করা? খুবতো বলছিলে যে, কোনো প্রবলেমে পড়ে হয়তো কল করেছে! এদিকে ফ্লার্টিং এ অনার্স-মাস্টার্স শেষ তোমার ওই কলিগের! ”
তাজ অনির মুখটা নিজের দিকে নিয়ে বলে,
–“আমার বউটা দেখছি জেলাস ফিল করছে! তুমি ফ্লার্টিং নিয়ে কখনো পড়াশোনা করেছো বলেতো মনে হয়না!”
অনি নিজের মুখটা আবার ঘুরয়ে নিয়ে বলে,
–“আমারতো এখন বর আছে! ফ্লার্টিং করবো কার সাথে! তোমার দরকার হলে তুমিও ওই অন্তরার মতো ফ্লার্টিং ক্লাসে ভর্তি হয়ে যাও!”
বলেই শুয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে অনি। তাজ ও ওর পাশে শুয়ে বলতে থাকে,
–“আমিও তাই ভাবছি! অন্তরার থেকেই ফ্লার্টিং করা শিখতে হবে! তাও যদি নিজের এই হিংসুটে বউটাকে একটু পটাতে পারি! এতটা বছর পছন্দ করেও যাকে মনের কথা জানাতে পারলাম না! এখন যদি সেটা করতে পারি!”
অনি কোনো কথা বলে না। তাজ আবার বলে,
–“আমার বউকে কীভাবে পটানো যায় বলোতো? কাল থেকেই মিশনে নেমে পড়বো! তবে আমার বউটা পটবে কিনা সন্দেহ! যেই পরিমাণ হিংসুটে!”
তাজের এসব কথা শুনে অনি মনে-মনে ভীষণ খুশি হয়। তারপর আর থাকতে না পেরে আস্তে করে বলে উঠে,
–“এই মিসেস তাজওয়ারকে পটানো এত সহজ না মিস্টার!”
বলেই আবার চুপ করে যায়। কথাটা শুনে তাজও হেসে ফেলে। তারপর কখন দুজন ঘুমিয়ে পড়ে বুঝতেই পারে না!
সকালে তাজের মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙে অনির। অনেক বেলা হয়ে গেছে ভেবে লাফ দিয়ে উঠে পড়ে অনি৷ তারপর চোখ কচলাতে-কচলাতে দরজা খুললে তাজের মা যখন অজু করার কথা বলে তখন ওর ঘুমটা পুরোপুরি ভেঙে যায়। আসলে ফজরের নামাজ পড়ার জন্য তাজের মা অনিকে ডাকছিলো। অনি উঠেছে দেখে উনি ভীষণ খুশি হন। তারপর হাসিমুখে অনিকে বললেন,
–“দেখোতো মা তাজকে তুলতে পারো কিনা! আমিতো ওকে হাজার ডেকেও তুলতে পারিনা ভোরে।….সারাদিন-ই নামাজ পড়াতে পারিনা! আবার ভোরে!”
শেষের কথাগুলো বিড়বিড় করে বলল তাজের মা। তারপর ওখান থেকে চলে গেলেন।
অনি তাজকে কয়েকবার ডেকে অজু করতে গেলো। অজু করে এসে তাজকে আবার ডাকতে লাগলো। তাজ “উঠছি” বলে আবার পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। অনি ওকে তুলতে ব্যর্থ হয়ে নিজের নামাজটা পড়ে নিলো।
নামাজ শেষে রুমের বাইরে এসে দেখলো যে তাজের মা উনার রুমে কোরান পড়ছে৷ অনি নিরবে গিয়ে উনার পাশে বসে কোরান তেলওয়াত শুনতে লাগলো। ওর মায়ের কোরান তেলওয়াত ও এভাবে মাঝেমধ্যে শুনতো। তাজের মায়ের পড়া শুনে ওর নিজের মায়ের কথা খুব মনে পড়তে লাগলো। যেমন নিরবভাবে ও রুমে গিয়েছিলো, তেমন নিরবভাবেই রুম থেকে বের হয়ে আসছিলো। তখনি তাজের মা কোরান পড়া শেষ করে অনিকে ডাক দিয়ে বলল,
–“কিছু বলবে মা?”
অনি চমকে পিছনে তাকিয়ে না সূচক মাথা নাড়িয়ে ওখানেই মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে পড়লো। তাজের মা কোরানটা রেখে অনির পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
–“ঘুম পাচ্ছে? তাজকে কি উঠাতে পেরেছো?”
–“না মা। ঘুম পাচ্ছে না। আর আপনার ছেলেকে অনেকবার ডেকেও তুলতে পারলাম না।”
–“আচ্ছা মা, তুমি যে উঠেছো এতেই আমি ভীষণ খুশি। তুমি পড়লে আস্তে-আস্তে ওকেও পড়াতে পারবে, ইনশাআল্লাহ! ”
নিজের শাশুড়ীর মুখে প্রশংসা শুনে অনি খুশি হয়ে গেলো৷ তারপর উনাকে বলল,
–“আপনি কি এখন আবার ঘুমাবেন মা?”
উনি হেসে বললেন,
–“নারে মা! আমি সকালে আর ঘুমাই না। এটা খুব বাজে অভ্যেস! কেন? তোমার কি ঘুম পাচ্ছে? তাহলে যাও আরেকটু ঘুমিয়ে নাও। তোমারতো অভ্যেস নেই। আস্তে-আস্তে অভ্যেস করলে হয়ে যাবে। ইনশাআল্লাহ! ”
–“না মা! আমারো আর ঘুম পাচ্ছে না। আমিও মাঝেমধ্যে সকালে উঠে অহি আর বাবার জন্য নাস্তা বানাতাম। অভ্যেস আছে একটু-আধটু! ”
–“তুমি রান্না-বান্না পারো?তোমার স্টাইল দেখে আমিতো ভাবতাম তুমি সাজগোজ ছাড়া আরকিছুই পারো না!”
অনি কিছুটা লজ্জা পেয়ে বলল,
–“না, মা মারা যাওয়ার পর বড় মেয়ে হিসেবে আমাকেই সংসার সামলাতে হতো! এখনতো অহিকেই আস্তে-আস্তে সব শিখতে হবে! মেয়েটা কি যে করছে!”
–“আচ্ছা আজ তাহলে আমরা দুই শাশুড়ী-বউমা নাস্তা বানাবো চলো। আফিয়ারাও এসেছে। মেয়ে জামাইকে একটু আদর-যত্নতো করতেই হয়!”
অনি খুশি হয়ে বলল,
–“আচ্ছা, চলুন।”
তারপর দুইজন রান্নাঘরে চলে যায়।
এদিকে তাজ ঘুম থেকে উঠে দেখে যে অনি পাশে নেই। ঘড়িতে দেখলো যে, সাতটা পঁচিশ বাজে। এত সকালে মেয়েটা কোথায় যেতে পারে! এসব ভেবে চিন্তায় পড়ে গেলো তাজ। অনির কথা জিজ্ঞেস করতে ওর মায়ের কাছে রান্নাঘরে যেতেই অনিকে দেখে অবাক হয়ে গেলো তাজ। পাকা রাধুনির মতো রান্না করছে অনি। আর পাশেই ওর মা দাঁড়িয়ে দেখছে।
–“দেখেছিস বউমা আমাকে চুলার পাশে যেতেই দিচ্ছে না। আজ নাকি সব নাস্তা ও নিজেই বানাবে! ”
মায়ের কথায় অনির দিক থেকে চোখ সরিয়ে নেয় তাজ। তারপর বলে,
–“তাই নাকি! ভালই হয়েছে, তুমি এইবার রেস্ট নিতে পারবে!”
কথাটা শুনে অনি বলে,
–“ঠিক বলেছো! আমি থাকতে মা এখন কেন কষ্ট করবে! আমিই রান্না-বান্না করবো এখন থেকে। মা শুধু আমাকে গাইড করে যাবে। তাই না মা?”
–“হুম”
তাজ আরেকটু সময় অনির রান্না করা দেখে ফ্রেস হতে চলে যায়।
এদিকে অনির নাস্তা বানানো শেষ হলে আফিয়ার স্বামীকে আগে খেতে দেওয়া হয়। কারণ উনার সকালে একটা কাজ আছে। এছাড়া উনি মহিলাদের সামনে যান না। আফিয়ার মায়ের সামনে গেলেও অনির সামনে তিনি যেতে পারবেন না। তাই শুধু উনাকেই আগে খেতে দিলো আফিয়া।
–“আজকের রান্নাটা মনে হয় মা করেনি। তাইনা আফিয়া?”
আড়াল থেকে অনি আফিয়ার স্বামীর এমন কথা শুনে ভয় পেয়ে যায়। তারমানে রান্নায় কোনো গন্ডগোল হয়নিতো? কিন্তু আমিতো টেস্ট করে দেখেছি, ভালই হয়েছে! শুধু-শুধু পন্ডিতি করে রান্না করতে গেলাম! এসব ভেবে নিজেকেই নিজে গালি দিতে লাগলো অনি।
চলবে…?