#অনিন্দিতা
#১০ম_পর্ব
#স্নিগ্ধতা_প্রিয়তা
ভয়,রহস্য,উত্তেজনা আর একরাশ খুশি নিয়েই অনি তাজের ডায়েরিটা খোলে৷ কিন্তু ডায়েরিটা দেখে ও অবাক হয়ে যায়৷ সেখানে কোথাও কিছু লেখা নেই! একদম নতুন একটা ডায়েরি সেটা। তাহলে তাজ যে বলল, ওর সব সিক্রেট এই ডায়েরিতে আছে! তারমানে সবটা ভুল ছিলো? তাজ ওর সাথে মজা করেছে? এসব ভাবতেই তাজের উপর অভিমান আর রাগে ফেটে পড়ে অনি।
‘আমার সাথে ফাইজলামি! এমন ভাব দেখালো প্রথমে যেন এই ডায়েরিতে কি না কি আছে! অথচ এটাতে কিছুই নেই! আমিও বোকার মতো ওর কথাগুলো সত্যভেবে নিলাম! আমিও না!” নিজে নিজেই এসব ভাবতে লাগলো অনি।
তারপর ডায়েরিটা টেবিলের উপর ছুড়ে ফেলে দিয়ে তাজের আর কোনো ডায়েরি আছে কিনা খুঁজতে লাগলো।
অনেক খুঁজাখুঁজির পর বইয়ের তাকে এক কোণায় পুরাতন একটা ডায়েরি পেয়ে গেলো অনি। তারপর অনেকটা কৌতূহল নিয়েই ডায়েরিটা খুলল। এবার আর হতাশ হতে হলো না। ডায়েরিটায় অনেক কিছুই আছে। আর সেগুলো অনেক পুরাতন।
ডায়েরির লেখা আর আঁকিবুঁকি দেখে মনে হচ্ছিলো যে, এটা কোনো বাচ্চার ডায়েরি। কিন্তু এ বাসায় বাচ্চার ডায়েরি আসবে কোথা থেকে! তারপর ভালো করে ঘাটাঘাটি করে অনি বুঝতে পারলো যে, এটা তাজের ডায়েরি। ওর ছোটবেলার৷ পুরো ডায়েরি জুড়ে ওর বাবাকে নিয়ে লেখা।
‘বাবা তুমি এবারো আমাদের সাথে ঈদ করলে না?জানো মা আমাকে নতুন জামা কিনে দেয়নি এবার৷ তুমি আসলে অনেকগুলো নতুন জামা কিনে দিবেতো?’
‘বাবা জানো, আজ না মায়ের একটা ছোট ডল হয়েছে। মা বলেছে ও নাকি আমার ছোট বোন। ডল কখনো বোন হয়? আমি ওর নাম আফিয়া রেখেছি৷ মায়েরও নাকি নামটা পছন্দ হয়েছে৷ এখন থেকে আমি ওই ডলটার সাথেই খেলবো৷ তুমি আসার সময় ডলের জন্যও খেলনা নিয়ে এসো? ও না কান্না করা ডল৷ আর আম্মুও ওর সাথে খেলা করে!’
‘জানো বাবা, ডল না আমার সাইকেল থেকে আজ পড়ে গিয়েছিলো। ওর যাতে ব্যাথা না লাগে তার জন্য ওকে সরাতেই আমি খুব ব্যাথা পেয়েছি। ডলের কিছুই হয়নি! তাও মা আমায় খুব বকেছে। তুমি আসলে মাকেও বকে দিও?’
‘জানো বাবা, ডল আজ আমাকে ভাই বলে ডেকেছে! আমার কি যে ভালো লাগছিলো! আমি মাকে বলেছি ডলকে স্কুলে নিয়ে যেতে। কিন্তু মা রাজি হয়নি! তুমি কবে আসবে বাবা? মা বলেছে আমি বড় হলেই নাকি তুমি চলে আসবে? আমিতো এখন স্কুলে ভর্তি হয়েছি। আরো বড় হতে হবে?’
‘বাবা, আমার এই চিঠিগুলো তোমার কাছে পৌঁছায় না কেন? মাতো বলেছিলো যে, এখানে লিখলেই তুমি দেখতে পাবে। আর আমার চিঠির উত্তরও দিবে! তাহলে তুমি কি অনেক ব্যস্ত আছো? আমার লেখাগুলো তোমার চোখে পড়ে না?’
‘বাবা, আমি না আজ ক্লাসে ফার্স্ট হয়েছি। অঙ্কেতো একশোই পেয়েছি! মা অনেক খুশি হয়েছে। তুমি খুশি হওনি?’
‘জানো বাবা, মা না আজ আমাকে খুব বকেছে৷ আমিতো শুধু তোমাকে একবার দেখতে চেয়েছিলাম। এটা কি ভুল কিছু? তুমিতো কতদিন বাসায় আসো না। ডলকে তোমার দেখতে ইচ্ছে হয়না? মা বলে যে, ডল নাকি দেখতে তোমার মতো হয়েছে। মা আমাকে আরো বলেছে যে, আমি যেন আর তোমার কথা না জিজ্ঞেস করি! তুমি নাকি আর আসবে না! তাই কখনো হয় নাকি! তুমিতো আমাকে বলেছিলে যে, কিছুদিন পর চলে আসবে! তাহলে মা কেন ওসব বলল?’
এরপর আরকিছুই লেখা নেই। পুরো ডায়েরিটা ফাঁকা। প্রতিটা লেখাতেই অনেক বানান ভুল ছিলো,তার উপরে ছোট মানুষের গোটা-গোটা লেখা! অনি নিজের মতো করে বুঝে-বুঝে অনেক কষ্টে লেখাগুলো পড়েছে। তারপরেও কেন জানি লেখাগুলো পড়ে অনির চোখে পানি চলে এসেছে। বাবার প্রতি তাজের ভালবাসা দেখে অনি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না।
একজন বাবা কি করে পারে এত সুন্দর-সুন্দর দুটি বাচ্চাকে রেখে থাকতে? আর তাজের মা এতো ভালো মানুষ! তাকেও কি করে ছেড়ে গেলো? মানুষ এমন কেন? সবাই তাদের সন্তানকে সমানভাবে কেন ভালবাসেনা? কেন কিছু বাবা-মা নিজের ভালো থাকার জন্য সন্তানের জীবনটা নরক বানিয়ে তোলে?
–“ভাবি গোসল করেছো? মা নামাজ পড়ে নিতে বলল। তারপর খেতে চলে আসো। মা নামাজ পড়ছে৷ আমিও পড়ব এখন।”
আফিয়ার কথায় অনি সম্বিত ফিরে পায়৷ তার হাতে তাজের ডায়েরি দেখে আফিয়া ওর দিকে এগিয়ে এসে বলে,
–“এই ডায়েরি তুমি কোথায় পেলে? ভাইয়া এটা কাউকে ধরতে দেয় না। ভাইয়া দেখলে কিন্তু ভীষণ রেগে যাবে। যেখানে ছিলো সেখানেই রেখে দিও! নইলে ভাইয়া বুঝতে পারলে রাগারাগি করতে পারে।”
অনি কিছু বলার আগেই আফিয়া রুম থেকে বের হয়ে গেলো। ও কি দেখবে ভেবেছিলো! আর কি দেখলো! তাজের জন্য একদিকে ওর খুব খারাপ লাগছিলো। অন্যদিকে রাগ হচ্ছিলো এটা ভেবে যে, ওকে নিয়ে তাজ কেন কোনো ডায়েরি লেখে নি? সবাইতো বলতো যে, তাজ নাকি ওকে ভীষণ ভালবাসতো!
যদিও তাজ নিজে ওকে কখনো বলেনি! আর ইমতিয়াজ ওর জীবনে থাকায় ও নিজেও কখনো সেদিকে নজর দেয়নি। তবে আজ কেন ওর মনে হচ্ছে যে, তাজ শুধু ওকেই ভালবাসুক! তাজ ওকে পাগলের মতো ভালবাসুক! ওদের বিয়ের বন্ধন কি সত্যিই ওকে তাজের প্রতি দুর্বল করে দিয়েছে? অনি আর এসব ভাবতে পারে না। ওর মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে৷
গোসল করে, নামাজ পড়ে সবার সাথে খেয়ে নিলো অনি৷ রুমে এসে দেখে যে তাজ কয়েকবার ওকে কল করেছে৷ সকালে ডায়েরি নিয়ে মজা করার জন্য অনি এখানো তাজের প্রতি অভিমান করে আছে। ফোনটা হাতে নিয়ে কল করতে গিয়েও থেমে যায় অনি। কিন্তু তারপর আবার তাজের কল আসলে এবার আর এড়িয়ে যেতে পারে না অনি৷ কল রিসিভ করতেই তাজ ওপাশ থেকে উৎকন্ঠা নিয়ে বলে উঠে,
–“কি ব্যাপার অনি! কল ধরতে এত সময় লাগে? কোথায় ছিলে? তুমি ঠিক আছোতো?”
তাজের এমন কথা শুনে অনি আরো রেগে যায়। ও কিছুটা রাগান্বিত স্বরেই বলে,
–“তোমার এত সিক্রেট একসাথে জানার পরেও আমি ঠিক থাকি কি করে বলো! ”
–“সরি! আমিতো তখন মজা করেছিলাম! রাগ করেছো?”
–“নাহ! আমি কি তোমার উপরে রাগ করতে পারি? সেই অধিকার কি আমার আছে নাকি?”
–“সরি বললামতো! আরে পাগলী আমার ডায়েরি পড়ে তোমাকে সিক্রেট জানতে হবে না! কি কি জানতে চাও আমাকে বলো, আমি নিজে আজ তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দেবো! তবুও রাগ করো না। প্লিজ! ”
–“সত্যি বলবে?”
–“আরে আমার লাইফে এমন কোনো সিক্রেট নেই! আমার লাইফের সবকিছুইতো তোমার জানা! আর কি জানবে বলো?”
–“আছে। অনেককিছু আছে যা আমার অজানা। আর আমি সেগুলো জানতে চাই।”
–“আচ্ছা ঠিক আছে। তোমার জন্য কিছু আনতে হবে?”
–“আরে না! কালকেইতো এত্ত শপিং করলাম! আবার কি আনতে হবে!”
–“তারপরেও কিছু যদি বাদ থাকে!”
–“কিছুই বাদ নেই। তুমি কখন আসবে?”
–“কেন আমাকে দেখার তর সইছে না মনে হচ্ছে!”
–“না মানে! কেন জানি তোমার সম্পর্কে অনেককিছু জানতে মন চাচ্ছে! ”
–“আর আমাকে দেখতে মন চাচ্ছে না?”
–“ধুর! আচ্ছা ফোন রাখো। আফিয়ারা মনে হয় চলে যাবে এখন।”
–“আচ্ছা। নিজের খেয়াল রেখো।”
–“তুমি এমনভাবে বলছো, যেন কতকাল ধরে তুমি আমার থেকে দূরে আছো! আরো অনেককাল থাকবে!”
–“এই দূরত্বের মানে তুমি কি বুঝবে!”
বলেই কল কেটে দেয় তাজ। আসলে অন্তরাই ওকে বলেছিলো একটু পরপর অনিকে কল করে খোঁজ নিতে৷ এতে নাকি মেয়েরা অনেক ইমপ্রেস হয়৷ আর এটাও বলেছে যেন, প্রতিদিন বাসায় ফেরার পথে অনির জন্য ছোটখাটো কোনো গিফট নিয়ে যায়৷ যেগুলো অনি বেশি পছন্দ করে। এছাড়া মাঝেমধ্যেই অনিকে নিয়ে বাইরে কোথাও ঘুরতে যেতে বলেছে। অন্তরার টিপসগুলো তাজের বেশ ভালো লেগেছে।
বিকেলের দিকেই আফিয়ারা চলে গেছে। এরমধ্যে তাজ আরো কয়েকবার ফোন করে অনির খোঁজ নিয়েছে। এতে অনির কেন জানি খুব ভালো লাগছে।
সন্ধ্যার নাস্তা করে অনি ফোন নিয়ে বসে ছিলো। ওর কেন জানি মনে হচ্ছিলো যে, তাজ আবার কল করবে। এসব ভাবতে-ভাবতে সত্যিই তাজ আবার কল করলো। তাজের সাথে কথা বলতে ওর এত ভালো কেন লাগছিলো ও যেন বুঝে উঠতে পারছিলো না। তাজ কল কেটে দিলেও ও কানের কাছে ফোনটা কিছুক্ষণ ধরে রাখে। এত ব্যস্ততার মাঝেও তাজ ওর খোঁজ নিচ্ছে! ব্যাপারটা ভেবে ওর খুব ভালো লাগছে।
তাজের মা ভীষণ খুশি যে, আজ অনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েছে। এইরকম প্রতিদিন পড়লেইতো আস্তে-আস্তে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। আর একবার নামাজে অভ্যস্ত হয়ে পড়লে বাকি কাজগুলোও সহজেই করতে পারবে। উনি অনিকে নিয়ে যে ভয়টা পাচ্ছিলেন তা কেটে গেছে। মনে হচ্ছে অনি সহজেই ইসলামের পথে এগিয়ে আসতে পারবে।
তাজ আসার আগেই উনি রাতের খাবার খেয়ে নিলেন। অনিকে বললেও ও খেল না৷ বলল খিদে নেই।উনি বুঝলেন যে অনি তাজের জন্যই খচ্ছে না! ব্যাপারটা উনার কাছে খুব ভালো লাগলো। উনি নিজেও এটাই চাচ্ছিলেন যে, তাজ আর অনির মধ্যেকার সম্পর্কটা যেন তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যায়। উনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, বন্ধুত্ব থেকে হঠাৎ বিয়ে! মেনে নিতে একটু সময়তো লাগবেই!
অনি তাজের জন্য অপেক্ষা করছিলো৷ একটু কিছুর শব্দ হলেই মনে হচ্ছিলো যে, এই বুঝি তাজ এসেছে আর কলিংবেল বাজাচ্ছে! অবশেষে অনির অপেক্ষার অবসান ঘটলো৷ তাজ চলে এসেছে। অনি দরজা খুলে দিতেই তাজ বলল,
–“তুমি কি দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলে নাকি? বেল দিতে না দিতেই দরজা খুলে দিলে যে?”
অনি তাজের হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে রুমের দিকে চলে গেলো। তাজের কথায় ও কিছুটা লজ্জা পেয়েছে। তারপর আমতা-আমতা করে বলতে লাগলো,
–“আমার বয়েই গেছে দরজার সামনে ওয়েট করতে! আমিতো পানি খেতে এসেছিলাম!”
–“পানিতো দেখছি রুমেই আছে। তুমি আবার বাইরে কেন গিয়েছিলে?”
অনি তাজের ব্যাগটা রেখে একগ্লাস পানি ভর্তি করে গ্লাসটা তাজের দিকে এগিয়ে দিলো। আসলে এটা তাজের মা ওকে বলেছে যে, তাজ বাইরে থেকে আসলে যেন ওর ব্যাগটা হাত থেকে নিয়ে নেয় এবং ওকে একগ্লাস পানি এগিয়ে দেয়। তাই ও কাজটা করলো৷ যদিও ওর ভালই লাগছে এসব করতে।তারপর ও তাজের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বলল,
–“আমিতো এখান থেকেই গিয়ে দরজা খুলে দিয়েছি! এখানেইতো পানি খাচ্ছিলাম!”
তাজ পানি খেয়ে গ্লাসটা রেখে বলল,
–“হাতটা দেখি!”
অনি অবাক হয়ে বলল,
–“হাত কেন? তুমি কি এখন থেকে মানুষের হাত দেখা শুরু করেছো নাকি?”
তাজ ব্যাগ থেকে এক ডজন কালো কাঁচের চুড়ি বের করে অনির হাতে পড়িয়ে দিতে-দিতে বলল,
–“আমিতো বউয়ের হাত চেয়েছি! মানুষের হাত হবে কেন! বউতো অন্যসবার থেকে আলাদা। তাইনা?…. তোমারতো কাঁচের চুড়ি পছন্দ! আর কালো রংটাও পছন্দ! রাস্তায় চুড়িগুলো দেখে তোমার কথা মনে পড়লো! তাই নিয়ে আসলাম। পছন্দ হয়নি?”
অনির কাঁচের চুড়ি পছন্দ। কালো রংটাও পছন্দ। তবে কালো চুড়িগুলো ওর কাছে তেমন ভালো লাগছিলো না। কিন্তু তাজ গিফট করেছে ভাবতেই সেগুলোই ওর চোখে আকর্ষণীয় হয়ে উঠলো। ও খুশি হয়ে বলল,
–“অনেক সুন্দর হয়েছে। থ্যাংকস! ”
–“থ্যাংকস লাগবে না। অন্যকিছু দিলে নিতাম!”
–“কি নিবে? বলো। আমি দিচ্ছি।”
–“এখন না৷ যখন লাগবে চেয়ে নেবো!”
বলেই বাথরুমের দিকে চলে গেলো তাজ।
আজ সকালে অনেকবার ডাকার পরেও অনির ঘুম ভাঙলো না। তাজের মা অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে নিজেই নামাজ পড়ে নাস্তা বানাতে গেলো।
অনি ঘুম ভেঙে দেখে যে সাতটার বেশি বাজে। ও লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়ে। আজ নামাজও পড়তে পারেনি! আর নাস্তাও মনে হয় ওর শাশুড়ী বানাচ্ছে। ভয়ে অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায় অনির। ওর শাশুড়ী যদি নামাজ না পড়ার জন্য বকা দেয়?
তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে রান্না-ঘরের দিকে ছুটে যায় অনি। গিয়ে দেখে যে, ওর শাশুড়ী নাস্তা বানাচ্ছে। ভয়ে-ভয়ে রান্নাঘরে প্রবেশ করে অনি।
চলবে…?