তার বিকল্পে পর্ব -০২

#তার_বিকল্পে (০২)

‘আমি একটা ছেলে হয়ে আরেকটা ছেলেকে তো বিয়ে করতে পারিনা’
উদয়ের এই কথাটা মেহুলের মগজে গিয়ে এমনভাবে ধাক্কা দিলো যে সে সাথে সাথে দুহাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের চোখ বন্ধ করে ফেললো!
এতো বাজেভাবে তাকে তার কোনো শত্রুও বলেনি। মেহুল কয়েক সেকেন্ড সেভাবে বসে থেকে তড়িঘড়ি করে উঠে এখান থেকে চলে যেতে লাগলো। পেছন থেকে উদয় ডাকলো,
‘ রাগ করলেন নাকি?

মেহুল হাতের মুষ্টি আরো শক্ত করলো। এই মূহুর্তে সে শুধু রাগ না, প্রচন্ডরকম জেদ আর নিজের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে আছে। তারই তো দোষ! কেন বিয়ের জন্য এতো লাফালাফি করছিলো? যেভাবে ছিলো সেভাবে একজীবন একাও তো কাটিয়ে দেওয়া যেতো!
যেতে যেতে সে সামনে কয়েকটা বগি পার হয়ে একটা দরজার সামনে গেলো,গিয়ে সম্পূর্ণ দরজা খুলে বাইরে তাকালো! ট্রেন থেকে রাতের দৃশ্য অদ্ভুত সুন্দর। মাঝেমাঝে গাছপালায় কিছুই দেখা যায়না, আবার মূহুর্তেই সেটা পাল্টে খোলা আকাশের অর্ধচন্দ্রের আলো তারার ঝিকিমিকি চোখ ধাঁধিয়ে দেয়! রাতের ট্রেনের বেশিরভাগ দরজাগুলোই বন্ধ থাকে , সবাই নিজেদের সীটে গা এলিয়ে শুয়ে থাকে, কিংবা ফোন টিপে।
এদিকে খোলা দরজায় মেহুল কোথাও না ধরে দরজার একদম কর্ণারে দাঁড়িয়ে চিন্তা করছে বাড়ি চলে যাবে। এরপর ট্রেনে যেই স্টেশনেই থামুক নেমে ফিরতি ট্রেন খুঁজে নিবে। বাড়ি গিয়ে সবার কাছে হাত জোর করে ক্ষমা চেয়ে প্রতিজ্ঞা করবে তার বিয়ে নিয়ে যেন কেউ কোনোদিন কথা না বলে! তার জীবন অপরিবর্তিতই থাকুক, পরিবর্তনের আশায় জীবনে কাউকে জড়ানো তারই বোকামি ছিলো। এর শাস্তি কাউকে ভালোবাসতে গিয়েও পেয়েছে এখন বিয়ে করতে গিয়েও।

মেহুল উদয়ের কাছ থেকে নিরবে চলে এলেও কিছু প্রশ্ন তার মনে উঠে এসেছে। উদয় তাকে এভাবে ছেলে বললো কেন? অন্তত এই সময়ে এসে তাকে কেউই এভাবে বলতে পারবেনা। তবে কি তাকে আগে থেকে চিনতো? তার চলাফেরা সম্পর্কে উদয় অবগত ছিলো?
মেহুল কপালের চুলগুলোকে মুঠো করে ধরে কিছুটা স্বস্তি পাওয়ার চেষ্টা করলো। হঠাৎ পাশ থেকে কিছু একটা মেহুলের অল্প বেড়িয়ে থাকা কনুইয়ে ঘর্ষণ খেলো। মেহুল সেটার টাল সামলাতে না পেরে ছিঁটকে যাচ্ছিলো, হাতলটা ধরতে পারার আগেই পেছন থেকে কেউ একজন তাকে টেনে ধরে বললো,
‘ ম্যাম আপনি এভাবে সুইসাইড করবেন না, আমার কথা শুনুন।

মেহুল চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে দেখলো তাকে একটা অপরিচিত ছেলে টেনে ধরে আছে। সে তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে বললো,
‘ না এমন কিছু নয়৷

‘ আমি দেখলাম তো! আর আপনি রাতের বেলা দরজা খোলার সাহস পেলেন কীভাবে? এখানকার কোনো কর্মকর্তা ব্যপারটা দেখেনি? এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে লাফ দিতে হবেনা, জঙ্গলের ভেতরে রামদা দিয়ে কল্লাকাটা লোকেরা যেভাবে বসে থাকে, এক কোপে শরীর থেকে মাথা আলাদা করে দিবে। সেই মাথা তারা বিক্রি করে দিবে। ভাবেন কি ভয়ংকর। আচ্ছা আপনি কি এটা জানেন না?

মেহুল ভয়েভয়ে বললো,
‘ ন’না’নাতো! আচ্ছা দরজা লাগিয়ে দিচ্ছি।

‘ উমমম শুনুন মরে গেলে কেউ মনে রাখেনা, বেঁচে থেকে সবার মনে থাকতে হয়। যান সীটে গিয়ে বসুন।

‘ আমি বিনা সীটের টিকিট নিয়েছি। আমার কোনো সীট নেই।

‘ কিছু মনে না করলে আমার সাথে যেতে পারেন। আমি আর আমার মা একটা আস্ত কেবিন নিয়েছি, আমি আসলে ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য বের হয়েছিলাম। তাহলে আপনি একটু অপেক্ষা করুন আমি ওয়াশরুম থেকে আসছি, তারপর আপনাকে আমাদের কেবিনে নিয়ে যাবো।

মেহুল মাথা নাড়লো। কিন্তু যখনি ছেলেটা ওয়াশরুমে চলে গেলো, মেহুল দ্রুত এই জায়গা থেকে পালাতে লাগলো। না না এভাবে কোনো ছেলের পাল্লায় পড়া যাবেনা৷ এরা ভালো মানুষী দেখিয়ে কখন তার কলিজা ছিদ্র করে দিবে তার ঠিক নেই।
মেহুল এক বগির পর এক বগি পার হতে হতে একবারে শেষ বগিতে গিয়ে থামলো। অনেকেই এখানে দুই সীট নিয়ে আছে। অথচ মেহুল স্টেশন কাউন্টার থেকে একটা টিকিটও ম্যনেজ করতে পারেনি।

মেহুল সর্ব পেছনে গিয়ে ধীরে ব্যাগটা রেখে, মেঝেতেই বসলো । গিয়েই সে তার কনুইয়ে লক্ষ্য করে দেখলো সেখানটা ছুঁলে গেছে। ট্রেনের স্পিডের সাথে কোনো গাছের শক্ত ধাঁরালো পাতার আঁচড়ে এমনটা হয়েছে। লোকটার প্রতি তার একটা কৃতজ্ঞাতাও কাজ করছে। না থাকলে বোধহয় পড়েই যেতো! এদিকে তাকে এভাবে মেঝেতে বসতে দেখে আশেপাশে থাকা কয়েকজন তার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। মেহুল সেসবদিকে কোনো প্রকার ভ্রুক্ষেপ করছেনা।

মেহুল ভাবছে ফোনটা খুলে তার মাকে একটা ফোন দিবে, জানাবে সে সকালে বাড়ি আসছে। এই বিয়ে এমনিতেও হতোনা, কারণ ছেলেই সেটা চাচ্ছেনা। কিন্তু আবার সাহস করতে পারছেনা। একে তো কানের দুলগুলো বিক্রি করে দিয়েছে আবার পালিয়ে এসে সম্মান খুইয়েছে। এদিকে তার ভেতরকার অবস্থাও ক্ষতবিক্ষত! এই সময় তাকে তারা বকাঝকা করলে তার অনেক অভিমান হবে। একসাথে বাড়ি গিয়েই না হয় সবকিছু সহ্য করে নিবে!

মেহুল ইউনিভার্সিটিতে কিভাবে ফিরে যাবে এই লজ্জায়ও নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। তার বন্ধুরা তাকে কতো কতো কথা শোনাবে তার কোনো সীমান্তই নেই। তাদের সাথে অনেক বড় বড় কথা বলে এসেছে, ভাব করেছে, চ্যালেঞ্জ করেছে, সবশেষে যদি দেখে সে এভাবেই ফিরে গেছে তাহলে ইজ্জতভ্রষ্ট হওয়া ছাড়া আর কি উপায়! তাছাড়াও তাকে তো এমনিতেও কেউ সম্মান দেয়না। মেহুল ভাবছে সে ঠিকি ফিরে যাবে কিন্তু সবার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে। একদম একা হয়ে যাবে, কোনো টক্সিক মানুষের আশেপাশে নিজেকে রাখবেনা।

তার ভাবনার মধ্যে হঠাৎ ট্রেনের টিটিই ডেকে বললো,
‘ ম্যাডাম আপনি এখান থেকে উঠুন। এখানে আমাদের কাজ আছে।

মেহুল চোখ উপরে তুলে তাকিয়ে দেখলো টিটিইর পেছনে ওই ছেলেটাও দাঁড়িয়ে আছে। যে তাকে বাঁচিয়েছিলো। টিটিই বললো,
‘ আপনি চাইলে উনার মার সাথে গিয়ে বসতে পারেন৷ উনার পুরো কেবিন নেওয়া আছে।

মেহুল ব্যাগটা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
‘ আচ্ছা চলুন।

ছেলেটা আগে আগে যেতে লাগলো। মেহুল পেছনে পেছনে যেতে যেতে ভাবছে, ছেলেটা কে? অন্য কোনো মতলব নেই তো? এই ট্রেনে তো তাকে চেনে শুধু উদয়৷ কোনোভাবে তাকে বিপদে ফেলার চেষ্টা হচ্ছেনা তো?
এসব চিন্তা মাথায় এলেও মেহুল ভয় পেলোনা। মেহুল তো ভয় পাওয়ার মতো মেয়েই না!

ছেলেটা পেছনে তাকিয়ে বললো,
‘ আমার নাম শোভন। তবে যাতায়াতে শোভন চেয়ারে যাওয়ার অভ্যাস নেই কিন্তু,হাহাহাহা! কেবিনই নেওয়া হয়, মাকে ছাড়া কোথাও যাইনা তো। আমার মা বেশি মানুষের মধ্যে দিয়ে চলতে অস্বস্তিবোধ করে। কেবিন বলে মেয়ে মানুষ হিসেবে আপনার ভয়ও লাগতে পারে, আমরা মা ছেলে মিলে আপনাকে স্প্রে মেরে সবকিছু ছিনিয়ে নেই নাকি! কিন্তু বিশ্বাস করতে পারেন, আমি এতটা ভালো না হলেও আমার মা খুব ভালো মানুষ।

মেহুল হাঁটার মধ্যে প্রশ্ন করলো,
‘ আপনার মা কিছু মনে করবেনা?

শোভন পেছনে তাকিয়ে বললো,
‘ আরে আপনাকে না পেয়ে মার কাছে গিয়ে সবটা বলেছিলাম, তারপর মা আমাকে বললো ট্রেন তো একটা সীমাবদ্ধ জায়গা, খুঁজে পেতে সমস্যা হবেনা, খুঁজে যেন নিয়ে যাই! বিপদে পড়া একটা মেয়েকে আমার মা ছেড়ে দিতে রাজী নয়।

মেহুল আর কিছু বললোনা। অবশেষে তারা কেবিনের সামনে এলো, শোভন কেবিনের দরজা খুলতেই মেহুল দেখলো, দরজার সামনে তার মা দাঁড়িয়ে আছে। বয়স না হলেও ৬০ হবে। নামাজের বড় হিজাব পরিধান করা, হাতে একটা তছবী ঘুরছে। সালাম দেওয়ার ততটা অভ্যাস না থাকলেও মেহুল অজান্তে বলে উঠলো,
‘ আসসালামু আলাইকুম।

শোভনের মা সালামের জবাব দিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললো,
‘ কি সুন্দর মেয়েটা মাশাল্লাহ! এই তুমি কেন আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলে বলোতো? বসো এখানে।

মেহুল আস্তে করে বসতে বসতে গলায় পেঁচিয়ে রাখা ওড়নাটা টেনে খানিকটা মাথায় দিলো। এদিকে শোভন মেহুলকে দিয়েই সেখান থেকে বের হয়ে গেলো। শোভনের মা মেহুলের গালে স্পর্শ করে বললো,
‘ জানো আমার ভীষণ শখ ছিলো আমার একটা মেয়ে হবে। কিন্তু আল্লাহ আমাকে কোনো মেয়ে দেয়নি। শোভনের বড় আমার দুইটা ছেলে ছিলো, একটা ছেলে তিন বছর অবস্থায় কিডনি বিকল হয়ে মারা গেছে, আর একজনের যখন ১৩ বছর বয়স, তখন আমার বয়স ৩০ পেরিয়ে,আমি আল্লাহর কাছে মেয়ের উদ্দেশ্যে শেষ একটা সন্তান চাইলাম। আমার প্রেগ্ন্যাসির যখন ৪ মাস চলে, তখন আমার স্বামী সন্তান দুইজন একটা বিয়ে অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে রোড এক্সিডেন্টে আমাকে একেবারে একেবারে নিঃস্ব করে করে দিয়ে চলে যায়। আমার সারা দুনিয়া তখন ঘোর অন্ধকারে তলিয়ে গিয়েছিলো। চোখেমুখে কোনো দিশা খুঁজে পেতাম না। বেঁচে থাকার ইচ্ছে হারিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু নিজের সাথে আরেকটা প্রাণ বিসর্জন দিতে চাইনি বলে জীবনের সাথে যুদ্ধ করেছি।
আল্লাহর ইচ্ছে বদলেছি, মেয়ের বদলে আবার ছেলে চেয়েছি। আমার মেয়ে হলে সেতো পরের ঘরে চলে যাবে তখন আমি আবার একা হয়ে যাবো। আর ছেলে হলে সে আমার ঘরে ঠিকি আরেকটা মেয়ে নিয়ে আসবে। আল্লাহ আমার কথা শুনেছিলো হয়তো, তাইতো আমার শোভন আমার পৃথিবী আলো করে এসেছে। এখন আমার মরতে ইচ্ছে করেনা জানো? নিজ চোখে সন্তানের সফলতা দেখছি, অনেকদূর দেখার ইচ্ছে। দেখো মা আমি যদি স্বামী সন্তান হারিয়ে সেই অবস্থা থেকে বেঁচে থাকতে পারি, তাহলে তোমার কিসের দুঃখ! দেখো একটা সময় তোমার মনে হবে দুনিয়ার সবকিছু উপভোগ করতে জীবনটা অতি সামান্য!

মেহুল বুঝতে পারলোনা তার আসলে কি বলা উচিত। সে তো আসলে সুইসাইড করতে যায়নি, শুধু একটা এক্সিডেন্ট ছিলো। কিছু না পেয়ে আস্তে করে বললো,
‘ আলহামদুলিল্লাহ! আমি বেঁচে থাকবো।

তখনি দরজা খুলে শোভন কিছু খাবারের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললো,
‘ মা খেতে খেতে কথা বলো, কিন্তু বলতে বলতে ছেলের সমন্ধ পাকা করে ফেলোনা। আমি কিন্তু এখন বিয়ে করবোনা।

শোভনের মা বলে উঠলো,
‘ সেটা আমার ইচ্ছা, তুই কথা বলার কেরে?

শোভন সাথে সাথে আবার দরজা বন্ধ করে চলে গেলো।

মেহুল দুদিকেই বোকার মতো তাকিয়ে আছে।

লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here