জোনাকিরা জ্বলে নিভে পর্ব -০২

#জোনাকিরা_জ্বলে_নিভে #পর্বঃ২
#লেখিকা #রেহানা_পুতুল
কি এক ফ্যাসাদে পড়ে গেলাম। আজকাল কারো উপকার করলেও দেখি উটকো ঝামেলা পোহাতে হয়। মনে মনে বলল শুভ্র।

শুনেন, আমরা কয়েকজন ফ্রেন্ড মিলে এলাকায় একটা সংগঠন গড়ে তুলেছি। যার একাধিক কার্যক্রমের মধ্যে একটা কার্যক্রম হলো বাল্য বিয়ে রোধ করা। আমার কাছে সকালে একটা জরুরী ফোন আসছে এই মেয়েটার বিয়ে বিষয়ে।

আমি সঠিক ইনফরমেশন নিয়েই ছুটে গেলাম সেই গ্রামের বিয়ে বাড়িতে। সেখানে দাঁড়িয়ে বিয়ে বন্ধ করতে পারতামনা আমি। বিয়ে পড়িয়েই ফেলতো জোর করে। আবার পুলিশে জানাতে জানাতেও বিয়ে হয়ে যেতো।
সুতরাং এছাড়া বিকল্প কোন পথ ছিলনা আমার কাছে। আমিতো মেয়েটিকে নিয়ে এসে রাস্তায় ফেলে দিইনি। আমাদের বাড়িতে নিয়ে এসেছি। দেখতে পাচ্ছেন আমার যৌথ পরিবারের লোকজনকে ও। এখন মেয়েটি যদি চায় চলে যেতে পারে। আমার কোন আপত্তি নেই।
আশাকরি এবার ক্লিয়ার হয়েছেন। আমি জোর করে তুলে আনিনি মেয়েটিকে। মেয়েটিকে জোর করে বাল্য বিয়ে দেয়া হচ্ছে।

একদম না স্যার। ওর আঠারো বছর পূর্ণ হয়েছে।

কাজলের পরিবারের একজন লোক রাগত স্বরে গলা উঁচিয়ে বলে উঠলো।

ওরে বাবা আমিতো আর এতকিছু জানিনা। শুনেছি বাল্য বিয়ে। একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে বিয়ে বন্ধ করেছি। এতে আমার কি ভুল বা দোষ? বিরক্তিপূর্ণ কন্ঠে সেই লোকের উদ্দ্যেশ্যে বলল শুভ্র।

পুলিশ বলল সেসব থানায় গিয়ে বলবেন। এখন চলেন। সব স্থানে নেতাগিরি চলেনা।

তড়িতেই শুভ্র’র ছোট বোন উরমি কাজলকে ধরে এনে পুলিশদের সামনে আনলো। বলল, এর পিঠ দেখবেন কি অবস্থা করেছে মেরে? আমার ভাই কি মিথ্যা বলছে? বলেই উরমি কাজলকে ঘুরিয়ে শাড়ির আঁচল টেনে সরিয়ে ফেলল।

পুলিশ তিনজন ও বাকি সবাই বিষ্পোরিত চোখে কাজলের ঘাড়ের পিছনের অংশে হা হয়ে চেয়ে রইলো কিয়ৎক্ষণ।

পুলিশ বলল, না দেখালেও চলতো। আপনার মুখের অভিব্যক্তি দেখেই বিশ্বাস করেছি। তবুও রুলস ফলো করতেই হবে আপনার ভাইয়ের।

তক্ষুনি এক মিনিট, বলে শুভ্র লম্বা লম্বা পা ফেলে বাসার ভিতরে চলে গেল৷ ফিরে এসে পুলিশের হাতে তার সংগঠনের একটি ভিজিটিং কার্ড দিলো। পুলিশ ভালো করে পড়ে দেখল। এবং ভিজিটিং কার্ডটি নিজের পকেটে রাখলো। এরপর একজন পুলিশের মোবাইল বেজে উঠল। সে রিসিভ করেই উঠানের একপাশে সরে গেল। ক্ষণ পরে ফিরে এসেই শুভ্রর মুখ পানে একবার চাইল। এরপর বলল, সর‍্যি মিস্টার। বিরক্ত করলাম। আপনাকে আর পুলিশি ঝামেলায় জড়াতে হবেনা। তবে যত যাই হোক। ও চলে যাক।

কাজলের দিকে চেয়ে দৃষ্টি তাক করে,
এই মেয়ে তোমার অভিভাবকের সাথে চলে যাও। পাগলামি করোনা।

কাজল ভীত সন্ত্রস্ত চোখে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো উঠানে ঘরের সিঁড়ির সামনে।

বরের পাশ থেকে মাঝবয়েসী একজন পুরুষ এগিয়ে এসে বলল,
মা বুঝতে পারলাম তুমি এ বিয়েতে রাজী নয়। এটা যদি আমরা আগে কোনভাবে বুঝতে বা জানতে পারতাম। তাহলে অবশ্যই কাহিনী এ পর্যন্ত গড়াতোনা। তবে পরিবারের মনে আঘাত দেওয়া অনুচিত। তুমি উনাদের সঙ্গে ফিরে যাও আপন বাড়িতে। মা বাবা সন্তান বড় হলেও অপরাধ দেখলে গায়ে হাত তুলতে পারে। নিশ্চয়ই তুমি তেমন কিছু করেছ তাই মেরেছে।

~~ আমি যাবনা ওই বাড়িতে আর। ওখানে আমার আপনজন বলতে একজন ও নেই।

এখানে বড়সড় কোন ঘাপলা রয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বর পক্ষের লোকজন একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল।

যেতেও হবেনা তোর। এই বলে তেড়ে এসে একজন পুরুষ কাজলের চুলের মুঠি চেপে ধরলো উঠানভর্তি মানুষের সামনে। বলতে লাগল ক্ষ্যাপা স্বরে,
আমরা তোর পর? অপয়া অলক্ষী মাইয়া তুই। ইজ্জত সম্মান সব ধূলায় মিশায়ে দিলি। আমাদের বাড়িতে তোর আর কোন ঠাঁই হবেনা। মনে রাখিস। যেখানে আসছিস। ওইখানেই ওদের লাথি উষ্ঠা খাইয়া থাকিস৷
উঃমাগো! বলে কাজল ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠলো।

জেসমিন বেগম রেগে গেলেন। গলা তুলে কিছু বলার আগেই পুলিশ বরপক্ষকে বুঝিয়ে বিদায় করে দিল সেখান থেকে। কাজলের পরিবারের লোকজন ও তাদের আত্মীয় স্বজন চলে গেল বিরস মুখে।

পুলিশ কাজলকে জিজ্ঞেস করলো,
এবার কি করবে তুমি? বিয়ে ও ভেঙ্গে দিলে। তোমার পরিবার ও তোমাকে ত্যাগ করে চলে গেল। অনাহুতের মতো এখানে পড়ে থাকবে?

একদম না। বলল কাজল।
তাহলে কোথায় যাবে? আমাদের বাসায় থাকবে?

পাশ থেকে শুনে শুভ্র কিছু বলার আগেই কাজল প্রতিউত্তর দিল।

আপাতত এখানেই থাকি। আপনারা চলে যান প্লিজ। নিরীহ গলায় বলল কাজল।

পুলিশটা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে সহকর্মীদের নিয়ে চলে গেল। শুভ্র ও বাড়ির বাইরে চলে গেল অস্বস্তিকর হাবভাব নিয়ে।

দিনের আলোকে বিদায় জানিয়ে সন্ধ্যার আলো আঁধার ভর করলো পৃথিবীর বুকে। উঠান ছেড়ে সবাই যার যার মতো করে এদিক সেদিক চলে গেল। কাজল ঘোমটা পরিহিত অবস্থায় উঠানেই দাঁড়িয়ে রইলো। ভাবছে কাজটা কি ঠিক হলো। মারওতো আর হজম করতে পারছিনা।

ছয় বছরের রুশা ছোট ছোট তুলতুলে পা ফেলে কাজলের কাছে এসে দাঁড়াল। কাজলের পাঁচ আঙ্গুলে ঝাঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
তুমি কি আমার শুভ্র ভাইয়ার বউ?

কাজল শুনেও না শোনার ভান করে রইলো।

বউ কথা বলনা কেন?

এই পাকনা বুড়ি ভিতরে যা বলছি। উরমি পুকুর ঘাট থেকে অজু করে এসেই রুশাকে মৃদু ধমক দিয়ে ঘরের ভিতর পাঠিয়ে দিল।

ছোট্ট রুশা ঘাড় ঘুরিয়ে কাজলকে দেখতে দেখতে ভিতরে চলে গেল।

ওমা! তুমি এখনো স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছ কেন? ঘরের ভিতরে যাও। কাজলকে বলল উরমি।

কাজল ক্লান্ত পায়ে ঘরের ভিতরে গেল উরমির পিছন পিছন। বিছানার এক কোনো জড়সড় হয়ে বসে আছে। সবার নামাজ পড়া শেষ হয়ে গেলো। জেসমিন বেগম মেয়ের রুমে এসে বললেন,
উরমি তোর একটা ড্রেস মেয়েটাকে পরতে দিস। মোটা শাড়ি পরে আর কতক্ষণ থাকবে। ওর পিঠে ব্যথার মলম লাগিয়ে দিস। আপাতত মেয়েটা একটু দম ছাড়ুক। পরে সব শোনা যাবে।

আচ্ছা আম্মু দিচ্ছি। ও আমার সাথেই ঘুমাতে পারবে রাতে। যদিও আমাদের আলাদা রুম ও খালি পড়ে আছে।

অজানা অচেনা গ্রাম। মেয়েটা রাতে পরে ভয় পাবে৷ তোর সাথেই ঘুমাক।

ওক্কে আম্মু।

কাজল ওয়াশ রুমে গিয়ে শাড়ি গহনা সব চেঞ্জ করলো। সারা মুখে বার কয়েক পানির ঝাপটা মারল। নিস্তেজ চোখে আয়নায় দৃষ্টি ফেলল। উচ্চতায় প্রায় উরমির সমান বলে পোশাক পরা নিয়ে আর বিপাকে পড়তে হলনা তার।

রাতে সবার সাথে পেটপুরে ভাত খেলো সে। গ্রোগাসে তার খাওয়া দেখে ডাইনিং টেবিলে বসা কেউই কিছু মনে করলোনা। একে অপরকে চোখের পাতার ইশারায় বুঝিয়ে দিল যে, কবেলার অভুক্ত না জানি মেয়েটি।
খাওয়া শেষে নিরবে নিঃশব্দে কাজল উঠে চলে গেল তার জন্য বরাদ্দকৃত রুমে। কারো সাথে কোন কথাই বললনা।

শুভ্রর চাচী রুবানা ভ্রুকুটি করে বলল,
শুভ্র তুই যে মহান সাজলি এমন একটা যুবতি মেয়েকে তুলে এনে। এখন কি হবে এর? কি গতি করবি?

আহ চাচী চব্বিশটা ঘন্টাও এখনো হয়নি। তুমি এমন ক্যাঁচ ক্যাঁচ করছ কেন? আমাদের বাসায় কত দূরাত্মীয় অনাত্মীয় এসেও সপ্তাহ ধরে থাকে৷ এতে কি আমাদের কোন কিছু ফুরিয়ে যায়? বল? তুমিতো নিজের আপনজনকে কিছু দেওয়ার সময় বল, দানে আনে দানে বাড়ে। দানে কখনো কমেনা। তাহলে এখন এমন করছ কেন?

ভাবি শুনলেন আপনার ছেলের খোঁড়া যুক্তি। আত্মীয় স্বজন আর উড়ে এসে জুড়ে বসা মেয়েটির বিষয় এক হলো?

চাচী আমার উদ্দেশ্য ছিল আপাতত তার বিয়ে বন্ধ করা। পরে পরিবার বিষয়টাকে সহজভাবে দেখবে আর তাকে নিয়ে যাবে। এখনতো দেখলাম প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এরা মনে হয় এর আসল মা বাবা নয়। সব জানতে হবে। ঘটনা এমন জটিল হবে এটা আগে জানলে অন্য প্রক্রিয়া অবলম্বন করতাম নিঃসন্দেহে।

জেসমিন বেগম হালকা মেজাজ ঝাড়লেন ছেলের উপরে। হইছে থাম। সমাজসেবী জনদরদী এসে গেছে। উঠে যা তোর রুমে। মায়ের আদেশ পেয়ে শুভ্র বাধ্য ছেলের মতো ডাইনিং টেবিল ছেড়ে উঠে গেল।

সারাদিনের কর্মমুখর ব্যস্ততা শেষে রাতে সবাই নিদ্রাদেবীর কোলে এলিয়ে পড়ল যার যার স্থানে। কাজলেরও দুচোখ ভেঙে নিদ্রা চলে এলো। কিছুই ভাববার অবকাশটুকুও পেলনা।

পরেরদিন সকালে হলদে রোদের তেজ না উঠতেই শুভ্রদের বাড়ি গিয়ে হাজির হলো দুজন মানুষ। একজন নারী ও একজন পুরুষ। উঠান ঝাড়ু দেওয়া থামিয়ে দিয়ে জরিনা এগিয়ে এলো,
কে আপনেরা?

তুমি চিনবেনা। কাল বউর সাজে যে মেয়েটিকে এ বাসায় আনা আনা হয়েছে। তাকে একটু ডেকে দাওতো। জরুরি দরকার আছে।

খাড়ান। দিতাছি ডাইকা।

জরিনা এক দৌড়ে ঘরের ভিতর চলে গেল। উরমির রুমে গিয়ে কাজলকে জানাল বিষয়টা। কাজল কোন বিশেষ হেলদোল দেখালনা। কারণ সে জানতো এমন কিছু হবেই। বের হয়ে আসল কাজল।

তারা দুজন একইস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। নারীটির সারামুখে তীব্র আকাঙ্খার গাঢ় প্রলেপ।

উরমিও কৌতুহলভরা দৃষ্টি নিয়ে উঠানে গিয়ে কাজলের পাশে দাঁড়ালো। কাজল অবাক হয়ে ফুফু আপনি?

চলবেঃ ২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here