#বর্ণচোরা
#২য়_পর্ব
#স্নিগ্ধতা_প্রিয়তা
–“আপনি আমাকে চিনেন?”
অরুর মুখে এমন কথা শুনে ছেলেটি হেসে ফেলল। তারপর অরুকে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করে বলল,
–“না চিনলে কি কথা বলা যায় না?”
–“না। যায় না। আমি অপরিচিত কারো সাথে কথা বলি না। ”
ততক্ষণে একটা রিকশাওয়ালা ওদের সামনে এসে হাজির হলো৷ তারপর অরুকে লক্ষ্য করে বলল,
–“কই যাবেন আপা?”
অরু কিছু বলতে যাবে তার আগেই ছেলেটা রিকশাওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–“আপনি কি এই ম্যাডামকে চিনেন?”
রিকশাওয়ালা হেসে বলল,
–“কি যে কন না ভাইজান! আমি এই আপাকে ক্যামনে চিনবো! আপাইতো আমারে ডাকলো যাওয়ার জন্য।”
ছেলেটি তখন একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল,
–“আসলে আপনার এই আপা না অপরিচিত কারো সাথে কথা বলেন না! আর তার সাথে কোথাও যাওয়াতো দূরে থাক। আপনি বরং চলে যান।”
–“কি আজব মানুষরে বাবা! রিকশায় উঠতেও আবার মানুষ চেনা লাগে নাকি! এই প্রথম শুনলাম! মাইয়াডা পাগলাগারদ থাইকা পালাইয়া আইছে মনে হয়! ”
কথাগুলো বিড়বিড় করতে-করতে রিকশাওয়ালা ওখান থেকে চলেই যাচ্ছিলো তখন অরু বলল,
–“আরে মামা আপনি চলে যাচ্ছেন কেন! আমি কোথায় যাব তা না শুনেই চলে যাচ্ছেন। আপনাকে আমি ডেকেছি! ওই লোকটার কথায় আপনি কান দিবেন নাতো!”
একথা বলতেই রিকশাওয়ালা থেমে গেলো৷ অরু তখন ওই ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–“আর এই যে মিস্টার কাচ্চি! আমাকে না চিনলে ভাগেন এখান থেকে৷ অপরিচিত কারো সাথে আমি কথা বলিনা৷ ”
বলেই রিকশায় উঠতেই যাবে তখন ছেলেটা ওর আগেই রিকশায় উঠে বসে পড়ল৷ তারপর বলল,
–“কথা না বললে পরিচিত হবেন কি করে? ‘আদিব রায়হান’ আইডিটা খুব ভালো করেই চিনেন মনে হয়?আর না চিনলে বলুন আমি এক্ষুণি নেমে যাচ্ছি!”
বলেই ছেলেটা নামতে যাচ্ছিলো তখনি অরু একলাফে রিকশায় উঠে বলল,
–“আরে না! আপনাকে নামতে হবে না। আমি উঠছি। আপনি আদিবকে চিনেন? জানেন আজ একমাসের মতো হয়ে গেলো উনার কোন খোঁজ নেই৷ উনার আইডিটাও আর খুঁজে পাচ্ছিনা। কোনো নতুন গল্পও পাচ্ছিনা! পেইজে মেসেজ করে রেখেছি সেখানেও কোনো রিপ্লাই নেই! আমিতো উনার সম্পর্কে কিছুই জানিনা! কখনো একটা ছবি পর্যন্ত দেয়নি আমাকে! ”
একদমে এতগুলো কথা বলে থেমে যায় অরু৷ আসলে ‘আদিব রায়হান’ একজন ফেসবুকের লেখক। উনার কোনো বই বের না হলেও ফেসবুকেই অনেক গল্প আর ফ্যান-ফলোয়ার আছে। অরু গল্প পড়তে খুব ভালবাসে, বিশেষ করে আদিবের গল্পগুলো৷ আর সেইখান থেকেই আদিবের সাথে ওর পরিচয়। আজ দেড় বছরের মতো ছেলেটার সাথে ওর মেসেজে কথা হয়। অরু ওর সম্পর্কে সব কথাই ছেলেটাকে জানিয়েছে। এমনকি ওর ছবি পর্যন্ত দিয়েছে। কিন্তু আদিব ওর সম্পর্কে তেমন কিছুই বলে নি। ছবি দেওয়াতো দূরে থাক।
–“আপা কই যাবেন কইলেন নাতো?”
রিকশাওয়ালার কথায় ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে আসে অরু। ছেলেটি ওর কথার এখনো কোনো জবাব দেয়নি। অরু রিকশাওয়ালাকে ওর ঠিকানা বলতেই যাবে তখন ছেলেটিই ওর বাসার ঠিকানা বলল।
–“এই যে মিস্টার কাচ্চি! আপনার পরিচয়টা দিলেন নাতো! আপনি কি সত্যিই আদিবকে চিনেন? আমিও পাগলের মতো আপনার সাথে রিকশায় উঠে পড়লাম! আর আপনি আমার বাসার ঠিকানাও জানেন?”
অরুর কথা শুনে ছেলেটি বলল,
–“আমাকে কাচ্চি না বলে আমার নাম ধরে ডাকলে খুশি হবো আদিবা!আর শুধু আপনার বাসা কেন! আপনার অনেক কিছুই আমার জানা!”
ছেলেটির মুখে আদিবা নাম শুনে অরু আরো চমকে যায়। এই নামটতো ও একমাত্র আদিবকে বলেছিলো! আদিবের নামের সাথে মিলিয়ে আদিবা। তাহলে কি এই ছেলেটাই আদিব! একথা ভাবতেই এতক্ষণে ছেলেটার দিকে তাকায় অরু। কি মায়াবী চেহারা! শ্যাম বরণ চেহারা! ফর্সা বললেও ভুল হবে না! সব থেকে বড় কথা অরু আদিবের খুব বড় একটা ভক্ত! এটা আদিব হলেতো অরু হাজারবার এর প্রেমে পড়ে যাবে!
–“আমি আরিফ হায়াত। আদিবের বেস্ট ফ্রেন্ড। আপনি আমাকে হায়াত বলতে পারেন। আসলে আদিবের মুখেই আমি আপনার কথা অনেকবার শুনেছি। আপনার ছবিও দেখেছি। এখানে একটা দরকারে এসেছিলাম। আপনাকে দেখেই আদিবের দেখানো ছবির কথা মনে পড়লো, তাই ভাবলাম একটু পরিচিত হই।”
হায়াতের কথা শুনে অরুর আশা যেন হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। কিছুটা হতাশ হয়ে বলল,
–“আপনি তাহলে আদিব না? আমিতো ভেবেছিলাম…”
এটুকু বলেই থেমে যায় অরু। তারপর বলে,
–“আদিবের কি হয়েছে জানেন? আজ মাস খানেক কোনো যোগাযোগ নেই। খুব অসুস্থ নাকি? ”
–“আসলে ও ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত আছে একটু। তাই আর অনলাইনে থাকে না বেশি। আর ওই আইডিটাতো ওর গল্প লেখার জন্যই তাই ওই আইডিতে আর আসে না। আপনার সাথেও যোগাযোগ করতে পারে না।….আচ্ছা আপনাদের রিলেশনটা কি?”
অরু কিছুটা ইতস্তত হয়ে বলে,
–“আমিতো উনার অনেক বড় একজন ভক্ত! উনার কাছে আমি কি তাতো বলতে পারবো না! উনারতো কতই ফ্যান-ফলোয়ার রয়েছে! তার মাঝে আমার কথা কি আর মনে আছে! আর উনারতো ক্যারিয়ারের কথা ভাবতেই হবে!… আচ্ছা উনার আসল নাম কি? ”
হায়াত একটা হাসি দিয়ে বলে,
–“নাম ওইটাই! আর ও আপনার কথা আমার কাছে যখন বলে তখন অবশ্যই আপনি বিশেষ কেউ হবেন! কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”
–“বলেন।”
–“আপনি কি আদিবকে পছন্দ করেন? মানে আমি জানি প্রশ্নটা অযৌক্তিক! কাউকে না দেখে, কারো সম্পর্কে না জেনে কেউ কাউকে পছন্দ করতে পারে না! তারপরেও ওর প্রতি আপনার আগ্রহ দেখে জানতে ইচ্ছে করছে। ”
অরু এইবার কিছুটা লজ্জা পেয়ে যায়। সত্যি বলতে যেদিন থেকে ও জানতে পেরেছে যে, আদিব ওর সিনিয়র, মানে এস এস সি তিন ব্যাচ আগের, আর অবিবাহিত! সেদিন থেকেই অরু আদিবকে পছন্দ করতে শুরু করেছে। কেন জানি ওর সাথে কথা বলতে অরুর খুব ভালো লাগে৷ সারাদিন কি হয় না হয় সব ও আদিবের সাথে শেয়ার করে।
–“আপনি বলতে না চাইলে থাক! আমি জোর করবো না! আসলে আমার মনে হয় আদিব আপনাকে পছন্দ করে!”
–“সত্যি?”
খুশিমনে কথাটা বলে উঠে অরু। তারপর কিছুটা অভিমান নিয়ে বলে,
–“আমারতো তা মনে হয়না! আমাকে পছন্দ করলে কি আর এতদিন কথা না বলে থাকতে পারতো! যত ব্যস্ততাই থাকুক না কেন একবার হলেও আমাকে ব্যাপারটা জানাতো!”
–“তারমানে আপনি ওকে পছন্দ করেন?”
–“আপনাকে কেন বলব! যাকে পছন্দ করি তাকেই শুধু বলব!”
কথাটা বলেই জিভ কামড়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে অরু। বলবে না বলেওতো ও কথাটা হায়াতকে বলে ফেলেছে! হায়াত তখন মুচকি একটা হাসি দিয়ে বলল,
–“আচ্ছা তাকেই বলবেন। আমি ওকে বলবনে আপনার সাথে যোগাযোগ করার কথা। এবার আপনি নামতে পারেন৷ আপনার বাসার সামনে চলে এসেছি।”
অরু রিকশা থেকে নামতে-নামতে হায়াতকে বলতে লাগলো,
–“আদিবকে প্লিজ এই কথাটা বলবেন না যে, আমি উনাকে পছন্দ করি! তাহলে হয়তো উনি আমার সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিবে!”
–“আচ্ছা!”
বলে সেই রিকশাতেই হায়াত চলে গেলো। অরুকে ভাড়াটাও দিতে দিলো না। আর অরু সেদিকেই তাকিয়ে রইলো যতক্ষণ হায়াতকে দেখা যায়। আর আদিবের কথা ভাবতে-ভাবতে বাসায় প্রবেশ করলো।
বাসায় ঢুকতেই ওর মনে হলো যে, ওরতো আদিবের ফোন নাম্বারটা রাখা উচিত ছিলো৷ আর নইলে ওর আসল আইডি! ওর ছবিটাওতো দেখতে পারলো না! অন্তত হায়াতের নাম্বার বা আইডি জানা উচিৎ ছিলো! এতবড় বোকামি কি করে করলো অরু! এতভালো একটা সুযোগ হাত ছাড়া করে ফেললো!
ও তাড়াতাড়ি গেট থেকে বের হয়ে হায়াতের রিকশাটা খুঁজতে লাগলো৷ কিন্তু আশেপাশে কোথাও সেই রিকশাটা নেই৷ এতক্ষণে হয়ত অনেক দূরে চলে গেছে৷ নিজেই নিজেকে গালি দিতে-দিতে বাসায় গেলো। তারপর কলিংবেল দিয়ে হায়াত আর আদিবের কথাই ভাবতে লাগলো।
–“কিরে বাসায় ঢুকবি? নাকি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবি?”
মায়ের কথা শুনে কিছু না বলে রুমে ঢুকে পড়ে অরু। মেয়ের এমন ব্যবহার দেখে ওর মা ওর পিছু-পিছু রুমে প্রবেশ করে। অরু ব্যাগটা নামিয়ে পিছন ঘুরতেই ওর মাকে দেখে চমকে উঠে।
–“মা তুমি? এভাবে ভূতের মতো আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
ওর মা অরুর কপালে আর গলায় হাত দিয়ে চেক করে বলল,
–“জ্বরওতো হয়নি! তুই ঠিক আছিসতো? এমন অদ্ভুত আচরণ করছিস কেন?”
অরু মায়ের উপর কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল,
–“অদ্ভুত আচরণ আমি করছি! নাকি তুমি করছো! ”
–“ছেলেটা কে?”
মায়ের এমন কথা শুনে অরু আরো অবাক হয়ে যায়৷ এমনিতেই আদিবের কথা ভেবে ও হয়রান হয়ে আছে! তার উপর ওর মা আবার কোন ছেলের কথা বলছে! ভাবতেই হায়াতের কথা মনে পড়ে যায়। কিন্তু ওর কথা ওর মা কীভাবে জানবে! ও সিওর হওয়ার জন্য ওর মাকে জিজ্ঞেস করলো,
–“কোন ছেলে মা? কিসের ছেলে? কার ছেলে?”
–“নাটক করতে হবে না। আমি দেখেছি। তোকে রিকশা করে যে বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেলো আমি সেই ছেলের কথা বলছি! কে ছেলেটা?”
অরু কি বলবে বুঝতে পারে না। ও অপ্রস্তুত হয়ে বলে উঠে….
চলবে….?