বর্ণচোরা পর্ব -০৫

#বর্ণচোরা
#৫ম_পর্ব
#স্নিগ্ধতা_প্রিয়তা

অরু রূপকের কাছেই চলে এসেছে প্রায়, তখনি একটা মেয়ে দ্রুত ওকে পাশ কাটিয়ে হাসতে-হাসতে রূপকের কাছে গেলো। রূপকও মেয়েটাকে দেখে অনেক খুশি হলো৷ এটা দেখে অরু আর ওদিকে গেলো না৷ ওখানেই দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনার চেষ্টা করলো৷ আর ওদের কথা শুনে বুঝতে পারলো যে, ওই মেয়েটা রূপকের গার্লফ্রেন্ড। রূপক ওই মেয়েটার জন্যই অপেক্ষা করছিলো।

আবার একবার নিরাশ হলো অরু। রূপকের গার্লফ্রেন্ড আছে! তারমানে চিঠিটা রূপক পাঠায়নি। ও আবার সাদা টিশার্ট পড়া ছেলে খুঁজে ব্যর্থ হলো৷ ও নিরাশ মনে ফিরে আসছিলো ঠিক তখনি একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের আড়ালে সাদা টিশার্ট পড়া একটা ছেলেকে দেখতে পেলো৷ ও আবার একবুক আশা নিয়ে ওদিকে এগোতে লাগলো। কিন্তু ওকে এগোতে দেখেই ছেলেটা দ্রুত ওখান থেকে চলে যেতে লাগলো।

অরু বুঝে গেলো যে, ওই ছেলেটাই তারমানে চিঠি লিখেছে৷ ও আরো দ্রুত ছেলেটার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো, কিন্তু ও পৌঁছানোর আগেই ছেলেটা হঠাৎ কোথায় আড়াল হয়ে গেলো৷ ও মুখটাও দেখতে পেলো না!

অবশেষে নিরাশ হয়ে ক্লাসের দিকে পা বাড়ালো। ক্লাসে গিয়ে দেখলো যে স্যার অলরেডি ক্লাস নেওয়া শুরু করে দিয়েছে। ও ফ্যাকাশে মুখে তন্বীর পাশে গিয়ে বসে পড়ল। তন্বী ওর এমন অবস্থা দেখে ভাবলো যে, হয়তো নিবিড় আর ওর কথা শুনেই ও এমন মন খারাপ করে আছে।

ক্লাস শেষ হতেই তন্বী অরুর কাঁধে হাত রেখে ভনিতার সুরে বলতে লাগলো,

–“সরি ননদিনী! ব্যাপারটা তোকে জানানো উচিৎ ছিলো!”

অরুর মাথায় তখন সেই চিঠির কথাই ঘুরছে৷ তাই ও ভাবলো যে, তন্বী হয়তো জানে যে চিঠিটা কে দিয়েছে। তাই আগ্রহ নিয়ে বলল,

–“তুই চিনিস ছেলেটাকে? কে চিঠি দিয়েছে?”

তন্বী ওর কথার কোনো মানে না বুঝতে পেরে বলল,

–“কোন ছেলে? কিসের চিঠি? তুই এসব কি বলছিস অরু? ”

–“ওহ শিট! আমিও পাগলের মতো কি বলতে শুরু করেছি! চিঠির কথা তুই জানবি কি করে!”

তারপর অরু তন্বীকে সবটা খুলে বলতেই তন্বী হেসেই খু*ন হয়ে যাচ্ছিলো। ওকে এভাবে হাসতে দেখে অরুর রাগ হতে লাগলো৷ ও চিন্তায় আছে! আর তন্বী কেমন বেহায়ার মতো হাসছে!

–“আমার এমন অবস্থা দেখে তোর হাসি পাচ্ছে! ভাবিরা ননদকে হেল্প করে! আর তুই হাসছিস! যা! আমিও আর তোকে হেল্প করবো না!”

তন্বী অনেক কষ্টে হাসিটা থামিয়ে অরুকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,

–“ওকে বাবা! আর হাসবো না। আমি দেখি জানতে পারি কিনা আমার ননদ জামাইটা কে!”

–“দেখ তনু! এইসব বিষয় নিয়ে একদম মজা করবি না! আমি সিরিয়াস! ”

–“তারমানে তুইও ছেলেটাকে ভালবেসে ফেলেছিস?”

–“তুই কি পাগল নাকি? চিনি না, জানিনা, আর তার প্রেমে পড়ে যাবো! আমিতো শুধু জানতে চাইছি চিঠির লেখকটা কে হতে পারে!”

তারপর অরু আর তন্বী কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করেও বুঝতে পারলো না যে, কে অরুকে চিঠি লিখতে পারে! অরুকে পছন্দ করে এমন ছেলে অনেকেই আছে। তবে সবাই ওর পরিচিত। কিন্তু চিঠিতে লেখা আছে যে, অরুকে সে একবার সামনে থেকে দেখেছে৷ একথা মনে হতেই অরুর মুখে হাসি ফুটে উঠলো৷

–“আমি জানি চিঠিটা কে লিখেছে! পুরোপুরি সিওর না। তবে আমার মন বলছে সেই হবে!”

অরুর এমন কথা শুনে তন্বী বলল,

–“কে? ”

–“হায়াত!”

তখন তন্বীও ওর সাথে একমত হলো। অরু তাড়াতাড়ি করে আদিবকে আনব্লক করে হায়াতের ব্যাপারে জানতে চেয়ে মেসেজ করলো৷ কিন্তু মেসেজের কোন উত্তর না পেয়ে ওর খুব রাগ হতে লাগলো।

দেখতে-দেখতে কোরবানির ইদ চলে এসেছে। তন্বী আর নিবিড়ের কথা অরু ওর মাকে জানিয়ে দিয়েছে। ওর মা-বাবা ছেলের পছন্দকে খুশিমনে মেনে নিয়েছে। আর তন্বীকে যেহেতু ওর না ভালো করেই চেনে তাই অপছন্দ করার কোনো প্রশ্নই আসে না! অরু হায়াত আর চিঠির কথাটা প্রায় ভুলেই গেছে!

অরুরা এবার গ্রামের বাড়িতে ইদ করবে। ওর ছোট চাচা গ্রামেই থাকে৷ ওদের গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক উনি। এর আগেও কয়েকবার গ্রামে ইদ করেছে অরুরা। এইবারও গ্রামেই ইদ করবে। ইদের পরেই যেহেতু নেহাল আর নিবিড়ের বিয়ে তাই ওরা ইদ শেষে ওখান থেকে সবাইকে দাওয়াতও করে আসবে।

আজ অরুর ভার্সিটির শেষ দিন। এরপর ইদের ছুটি হবে৷ অরুর আর এক সেমিস্টার শেষ হলেই অনার্স শেষ হবে।

ক্লাস শেষে অরুরা সব ফ্রেন্ড মিলে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল৷ সবার মতামত শেষে ওরা সিদ্ধান্ত নিলে ওদের ক্যাম্পাস থেকে কিছুটা দূরে যে নদী আছে ওখানেই ওরা ঘুরতে যাবে। অরুর নৌকায় ঘুরতে খুব ভালো লাগে৷ যদিও ও সাঁতার জানে না! তবুও রাজি হয়ে গেলো৷ কারণ ওর আরো অনেক ফ্রেন্ড-ই সাঁতার জানে না!

ঘুরাঘুরি শেষ হতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেলো৷ বাসায় পৌঁছাতে রাত হয়ে যাবে। তাই ছেলেরা সিদ্ধান্ত নিলো মেয়েদের বাসায় পৌঁছে দেবে। রাস্তায় কিছু হলে আবার সমস্যা!

বাসে করে ক্যাম্পাসে ফিরে সবাই বাসার দিকে রওয়ানা হলো। অরু ওর এক ফ্রেন্ড তনয়ের সঙ্গে গেলো। তনয়ের বাসা অরুদের বাসার দিকেই পড়ে৷ যদিও নিবিড় ওকে নিতে আসতে চেয়েছিলো ও মানা করে দিয়েছে৷ ও কি এখনো ছোট বাচ্চা নাকি! সব সময় আনা-নেওয়া করতে হবে!

তনয় আর অরু একটা রিকশায় উঠে বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো৷ তনয়ের সাথে অরু বেশি একটা কথা বলে না। তাই ওর সাথে এক রিকশায় যেতে অরু কিছুটা অস্বস্তিবোধ করছিলো৷ তনয় ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলল,

–“আমার সাথে যেতে কি ভয় লাগছে?”

অরু আমতা-আমতা করে বলল,

–“আরে না! তা হবে কেন! ”

–“তাহলে এতো চুপচাপ কেন?”

–“এমনিই!”

–“তুমিতো সব সময় দেখি অনেক কথা বলো। আমার সাথে কথা বলতে কি ভয় লাগছে? নাকি বিরক্ত?”

–“আরে না, তা নয়৷ সারাদিন অনেক ঘুরাঘুরি করা হয়েছেতো তাই ভালো লাগছে না!”

–“তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”

–“হ্যাঁ বলো।”

–“তন্বী কি সত্যিই তোমার ভাইকে পছন্দ করে? না মানে ও সব সময় তোমাকে ননদিনী বলে! আর তুমিও ওকে ভাবি বলে ডাকো! তাই জানতে চাইলাম আর কি! আমার মনে হয় তোমরা মজা করে এটা বলো। তাই না?”

–“তুমি কি তন্বীকে পছন্দ করো?”

অরুর কথায় তনয় কিছুটা লজ্জা পেলো৷ তারপর মুখটা নিচু করে বলল,

–“আসলে আমি সবার সাথে খুব কম কথা বলি৷ ছোটবেলা থেকেই আমি একটু ইন্ট্রোভার্ট! তোমার আর তন্বীর ফ্রেন্ডশিপ দেখে আমারো ইচ্ছে হয় তোমাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে! ভার্সিটি লাইফ শেষ হয়ে গেলো তবুও তোমাদের মতো আমার কোন বেস্টফ্রেন্ড নেই! ”

–“তুমি কি আমাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে চাইছো? ”

–“হয়তো ব্যাপারটা শুধু বন্ধুত্বের নয়! আসলে আমি তন্বীকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করি৷ কিন্তু ভয়ে কখনো বলার সাহস পাইনি! আজ তোমাকে পেয়ে সুযোগটা আর হারালাম না। তন্বী কি সত্যি কাউকে পছন্দ করে? ”

তনয়ের জন্য অরুর খুব খারাপ লাগছিলো৷ ও ক্লাসের টপার স্টুডেন্ট বলে অরুরা কখনো আগ বাড়িয়ে ওর সাথে কথা বলতে যায়নি৷ ও ভাবতো ছেলেটা পড়াশোনা ছাড়া কিছুই বুঝে না! কিন্তু ও যে একটা ছেলে! ওরও যে পছন্দ -অপছন্দ থাকতে পারে এটা ওরা ভুলেই গিয়েছিলো।

–“তারমানে তন্বী কাউকে ভালবাসে? ছেলেটা কে অরু?”

অরু কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলল,

–“আমার ভাইয়ার সাথে ওর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।”

ততক্ষণে ওরা অরুর বাসার সামনে চলে এসেছে। অরু রিকশা থেকে নামার সময় আঁড়চোখে তনয়ের দিকে একবার তাকালো। তন্বীর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে শুনে বেচারা অনেক কষ্ট পেয়েছে৷ ওর চোখেমুখে তা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে৷ ল্যাম্পপোস্টের আলোয় তা আরো করুণ দেখাচ্ছে।

অরু ভাড়া দিতে গেলে তনয় ওকে বাধা দিয়ে বলল,

–“আমি কি তোমাদের ভালো একটা বন্ধু হতে পারি না? অন্তত ভার্সিটি শেষ হওয়ার আগে বন্ধুত্বের স্বাদটা নিতে চাই! প্লিজ! অন্তত এই অনুরোধ টুকু রেখো! অনেকদিনতো আর দেখা হবে না! যোগাযোগ বন্ধ রেখো না! আর আমি যে তন্বীকে পছন্দ করতাম এটা ওকে জানিও না প্লিজ! আমি শুধু তোমাদের ভালো একটা বন্ধু হয়ে থাকতে চাই!”

অরু কি বলবে বুঝতে পারছিলো না৷ রিকশাওয়ালাও হয়তো অরুর উত্তরের অপেক্ষায় ছিলো৷ কারণ তনয় ওই রিকশাতেই বাসায় ফিরবে।

–“আচ্ছা। বাসায় গিয়ে ফোন করো৷ ক্লাস খুললে আবার দেখা হবে। বায়!”

বলেই বাসার দিকে পা বাড়ালো অরু৷ তনয়ও চলে গেলো। অরুর চোখে বারবার শুধু তনয়ের করুণ মুখখানার ছবি ভেসে উঠলো। আদিবের বিয়ের কথা শুনে ওর নিজেরওতো এমনই কষ্ট হচ্ছিলো! এইবার ও আর আদিবের উপরে রাগ করে থাকতে পারলো না! তন্বীর নতো আদিবেরওতো এখানে কোনো দোষ নেই! ওর গার্লফ্রেন্ড থাকলে তাকেইতো বিয়ে করবে!

অরুরা কালকেই গ্রামে চলে যাবে। ইদের আর চারদিন বাকি আছে৷ ইদের পাঁচদিন পরেই নেহাল আর নিবিড়ের বিয়ে৷ ইদ করে পরের দিন ওরা বাসায় চলে আসবে৷ তাই একটু আগেই গ্রামে যাচ্ছে। অরু সকালের নাস্তা করে ফোন নিয়ে বসেছিলো৷ এমন সময় নেহাল ওকে একবক্স চকলেট দিয়ে বলল,

–“আমার পিচ্চিটা কি করে? ”

অরু ফোনটা রেখে হাসিমুখে বলল,

–“ভাইয়া আমি এখনো পিচ্চি আছি! তোমার বউয়ের সামনে একদম আমাকে পিচ্চি বলবে না! তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে! আমিও তাহলে তোমার সব সিক্রেট ভাবিকে বলে দিবো!”

–“তোর ভাবির সাথে তোর আর কথা হয়েছে?”

–“বাব্বাহ! বিয়ে না হতেই বউ বানিয়ে দিলে!”

নেহাল কিছুটা লজ্জা পেয়ে বলল,

–“আমি বউ কই বানালাম৷ তুই-ইতো ভাবি বললি!”

–“তা কি মতলবে আমাকে ঘুষ দেয়া হচ্ছে শুনি?”

–“আমি এমনি মনে হয় তোকে কিছু দেই না! ”

–“তা দাও! তবে আজ মনে হচ্ছে কোনো মতলব আছে! লজ্জা না পেয়ে বলে ফেলো! এই বোনটাতো তোমাদের জন্য জীবনটা দিতেও প্রস্তুত!”

–“জীবন দিতে হবে না! শুধু একটা আইডিয়া দিলেই হবে!”

–“বড় ভাই ছোটবোনের কাছে আইডিয়া চাচ্ছে! হাউ ফানি! আচ্ছা বলো!”

–“আসলে আমরাতো কাল গ্রামে চলে যাবো৷ তাই ভাবছিলাম আজ একটু…..”

–“কি?”

চলবে….?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here