বর্ণচোরা পর্ব -০৭ ও শেষ

#বর্ণচোরা
#৭ম_পর্ব_শেষ_পর্ব
#স্নিগ্ধতা_প্রিয়তা

–“নে, তোর বিয়ের সব ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে।এবার খুশি? ”

অরু মায়ের কথা শুনে খুশি হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

–“এই না হলো আমার লক্ষী মা! ”

–“আমার আর তোর বাবার উপর দিয়ে যে কি প্রেসার যাচ্ছে তা আমরা বুঝতে পারছি! দুই ছেলের বিয়ে একসাথে অব্দি ঠিক ছিলো! কিন্তু এখন! তিন ছেলে-মেয়ের বিয়ে একসাথে! কেউ হয়তো কোনদিন এমন ভয়ঙ্কর কাজ করে নি!”

–“মা তোমরা শুধু-শুধু চিন্তা করছো! কোন কাজ কেউ কোনদিন করেনি বলে যে সেটা করা যাবে না তাতো নয়! তুমি করলে দেখবে এরপর আরো অনেকেই এটা করবে! তোমাদেরতো বরং ভালো হচ্ছে! এক্সট্রা করে কাউকে দাওয়াত করতে হচ্ছে না! খরচও করতে হচ্ছে না! এক খরচেই তিন জনের বিয়ে শেষ! তিনটা বিয়ে একসাথে! ওই কমিউনিটি সেন্টারের মালিকেরতো এবার লটারি লেগে গেছে!”

–“তুই যা বুঝলি তাই বললি! ”

–“আর মা শোনো, আমার বিয়ের কথাটা সবার কাছে সিক্রেট রাখবে! কেউ যেন জানতে না পারে! ওইদিন এসে সারপ্রাইজড হয়ে যাবে! আমারতো ভাবতেই ভালো লাগছে! তন্বীর জন্য আমার ফ্রেন্ডরাও থাকবে! সো, ওদেরকেও আর আলাদা করে ইনভাইট করতে হবে না!”

–“আচ্ছা, তুই থাক তোর সারপ্রাইজ নিয়ে! আমি যাই, কত কাজ বাকি! এখনতো আরো বেড়ে গেলো!”

বলেই ওর মা রুম থেকে চলে গেলো। একটু পর আবার রুমে এসে বলল,

–“ওহ! একটা কথা বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম। কাল একবার গিয়ে ছেলেটার সাথে দেখা করে আয়। বাসায়তো ঝামেলা করতে বারণ করলি, কিন্তু তোরা দুজনেতো দেখা করতেই পারিস!”

–“মা! তোমাকে বলেছি না, আমি দেখা-সাক্ষাৎ করতে পারবো না! ছেলে কি আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছে?”

ওর মা একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল,

–“ওই ছেলেও মনে হয় তোর মতো পাগল একটা! তুই দেখা করবি না শুনে ও নিজেও দেখা করতে বারণ করে দিয়েছে!”

–“যাক বাবা! আমার হবু বরটা তাহলে আমাকে এখন থেকেই বুঝতে শুরু করে দিয়েছে!”

–“আমার মেয়েটা যে কবে থেকে বেহায়া হওয়া শুরু করেছে কে জানে!”

বলেই মুখে একরাশ হাসি নিয়ে উনি ফিরে গেলেন।

অবশেষে সেই দিনটা চলেই এলো। আজ অরুদের তিন ভাইবোনের বিয়ে। পুরো কমিউনিটি সেন্টার জুড়ে মানুষে পরিপূর্ণ! সবাই অরুকে বউ সাজে দেখে শকড হয়ে গেছে৷ অনেকে আবার খুশিও হয়েছে। তবে অনেকে মন খারাপ করেছে তাদের জানানো হয়নি বলে। কারণ তারাতো অরুর জন্য আলাদা গিফট আনতে পারতো আগে থেকে জানলে! যাইহোক অরু ওর মিষ্টি হাসি আর কথা দিয়ে সবাইকে খুশি করে ফেলেছে।

নেহাল, শিলা, নিবিড়, তন্বী, অরু সবাই বসে আছে।ওদের সবাইকে অনেক সুন্দর লাগছে। অরুদের আত্মীয়রা সবাই শিলা আর তন্বীর রূপের খুব প্রশংসা করছে। কিন্তু অরুর বরের কোন খবর নেই। সবাই বরের কথা জিজ্ঞেস করলে বরের মা জানালো যে, ওর একটু কাজ থাকায় দেরি হচ্ছে৷ এমন হুটহাট বিয়ে বলে কথা! প্রস্তুতির একটা ব্যাপার আছে না!

অরু তন্বীর সাথে কথা বলছিলো৷ এমন সময় অরুর চাচাতো ভাইবোনেরা বলে উঠল যে, অরুর বর চলে এসেছে। কিন্তু বরকে দেখে অরু এতটাই অবাক হয়ে গেলো যে, মুহূর্তেই ওর হাসিমুখ বিষন্নতায় ছেয়ে গেলো৷ ও বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো তারপর হায়াতের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। সবাইতো হায়াতকে দেখেও ভীষণ খুশি!

অরু হায়াতকে নিয়ে একটু আড়ালে গিয়ে বলল,

–“আপনি এখানে? আপনি আমার মায়ের বন্ধুর ছেলে হন কীভাবে? ”

হায়াত একটু হেসে বলল,

–“কেন হতে পারি না? তোমারতো খুশি হওয়ার কথা আমাকে দেখে! আমার মতো একটা ছেলেকে…”

এটুকু বলতেই অরু ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

–“আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না!”

এমন সময় পিছন থেকে ওর মা এসে অরুর হাত ধরে টেনে ওখান থেকে নিয়ে যেতে লাগলো৷ আর মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে হায়াতকে বলল,

–“ওর কথায় কিছু মনে করো না বাবা! ও কখন কি বলে তার ঠিক নেই!”

–“ইটস ওকে আন্টি! ”

অরুর মা অরুকে ধমক দিয়ে বলল,

–“তুই কি আমাদের মান-সম্মান সব ডুবিয়ে ছাড়বি? মেয়ে মানুষের এত জেদ ভালো না বলে দিলাম! বিয়ের পর এমন কোনো কাজ করলে আমি ভুলে যাবো যে, তুই আমার মেয়ে। তুই বিয়ে করতে চাইলি, বিয়ের ব্যবস্থা করলাম। ছেলের সাথে কথা বলবি না বললি, সেটাও মেনে নিলাম! আর এখন ছেলেকে দেখে বলছিস বিয়ে করবি না! বিয়েটা কি তোর ছেলেখেলা মনে হয়? ”

–“মা আমিও সেটাই বলছি! বিয়েটা ছেলেখেলা নয়! যাকে আমি পছন্দ করি না তাকে কি করে বিয়ে করবো!”

–“পছন্দ করি না মানে? একথা আগে মনে ছিলো না? নাকি আমাদের নাক-কাটার জন্যই তুই এই প্লান করেছিস? অরু! তোর আবার কোনো পছন্দ নেইতো? দেখ, তুই হায়াতকে বিয়ে করবি ব্যাস! এটাই আমার শেষ কথা! ওর চেয়ে ভালো ছেলে তোর মতো জেদী মেয়ের জন্য আর একটাও পাবো না! বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে! অন্তত তোর বাবা আর ভাইদের মুখের দিকে তাকিয়ে কোনো তামাশা করিস না! তোর জন্য সবার আনন্দ মাটি করিস না!”

কথাগুলো বলেই অরুর মা ওকে টেনে নিয়ে গিয়ে হায়াতের পাশে বসিয়ে দিলো। অনিচ্ছাসত্ত্বে অরু অবশেষে হায়াতকে বিয়ে করে নিলো।

বিয়ে শেষে তন্বী আর শিলা চলে গেলো অরুদের বাসায়। আর অরু যাবে হায়াতদের বাসায়। হায়াতকে দেখার পর থেকে অরু যেন বোবা হয়ে গেছে। অরুর মা সবাইকে এটা বলে বোঝালো যে, অরু এই প্রথম পরিবার ছাড়া থাকবে তাই মন খারাপ! আর অরুকে সবার আড়ালে বারবার সতর্ক করে দিলো হায়াতদের বাসায় গিয়ে যেন কোনো ঝামেলা না পাকায়!

অরু নিজের বাসরঘরে বসে আছে আর হায়াতের উপরে রাগে ফুসছে। ও না হয় জানতো না যে হায়াতের সাথে ওর বিয়ে! কিন্তু হায়াততো জানতো! ও অরুর মতামত জানার প্রয়োজন মনে করলো না একবারের জন্যও! খুবতো বড়-বড় কথা বলছিল! ‘সেল্ফলেস মেয়ে’ আবার সেই সেল্ফলেস মেয়েকেই বিয়ে করলো!

–“এখনো আমার উপরে রেগে আছো? সরি তুমি করে বললাম! আসলে এখনতো তুমি আমার…..”

এটুকু বলতেই অরু ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

–“আমাকে বিয়ে করার এত শখ আপনার! আমি আপনাকে আমার স্বামী হিসেবে মানি না! আমি অন্য একজনকে ভালবাসি! সেও আমাকে ভালবাসে! আমাকে চিঠিও দিয়েছে! ”

হায়াত তবুও অবাক না হয়ে বলল,

–“তাহলে সেই চিঠির লেখককেই তুমি ভালবাসো?”

–“হুম! বাসি। তাতে আপনার কি!”

–“আমার বউ অন্যকাউকে ভালবাসবে! এটা আমি বসে-বসে দেখবো! আচ্ছা ওই ছেলের নাম্বার দাও, আমি কথা বলছি!”

অরু একটু ভয় পেয়ে বলল,

–“তার নাম্বার আমি আপনাকে কেন দেব? আমিই তাকে সবটা বলে দিব! যে আমাদের বিয়েটা নামেমাত্র! আমরা কেউ কাউকে ভালবাসি না। সে ঠিক বুঝবে!”

অরুর হাতে ওর ফোন ছিলো হায়াত ওর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে একটা নাম্বারে কল করতেই হায়াতের ফোনটা বেজে উঠলো। তারপর হায়াত বলল,

–“তোমার চিঠির লেখকের ফোন বাজছে! ধরবো?”

অরু অবাক হয়ে বলল,

–“তারমানে আপনিই চিঠিটা লিখেছিলেন? তাহলে সেদিন অস্বীকার করলেন কেন?”

হায়াত হেসে বলল,

–“শুধু চিঠির লেখক না ম্যাডাম! আমি আপনার পড়া গল্পেরও লেখক!”

অরু এবার যেন আকাশ থেকে পড়লো। চোখ বড়-বড় করে বলল,

–“আর ইউ কিডিং মি! আপনি গল্প লেখক মানে? আদিব? আদিব রায়হান?”

হায়াত এবার অরুর হাত ধরে ওকে শান্ত করে বলল,

–“আসলে আমি তোমাকে মিথ্যা বলতে চাইনি! তোমার মা জানতে পেরেছিলো যে, তুমি আদিবের সাথে কথা বলো! সামান্য একটা গল্পের লেখক আদিব! তাই তোমার মায়ের ব্যাপারটা ভালো লাগে নি। উনি আমার আইডিতে মেসেজ করে নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছিলেন যে, আমি যেন আর তোমার সাথে কথা না বলি। তাই আমি তোমার সাথে কথা বন্ধ করে দেই। আর গল্প লেখাও বাদ দিয়ে দেই। তারপর একদিন আমার মা তোমার কথা জানালো যে, আমার বিয়ে ঠিক করেছে। আমি রাজি ছিলাম না। কিন্তু তোমার ছবি দেখেই আমার খুশি ধরে রাখতে পারিনি! সেদিন ছুটে গিয়েছিলাম তোমার ভার্সিটি! আর আমি চাচ্ছিলাম যে, তুমি আদিব নামটা ভুলে যাও! কারণ ওই নামে আসলে কেউ নেই! ওটা আমারি ফেইক আইডি!”

অরু খুশি হবে নাকি হায়াতের উপরে রাগ করবে বুঝে উঠতে পারছিলো না।

–“কিন্তু সে কথা আপনি আমাকে আগে জানাননি কেন? আমি কত কষ্ট পেয়েছি জানেন! ”

–“ইদের দিন তোমার আদিবের প্রতি ভালবাসা দেখে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, তোমার ভাইদের বিয়ের দিন আমি তোমাকে সব সত্যিটা জানিয়ে দেবো! কিন্তু তার আগেই এতকিছু হয়ে গেলো!”

অরু এবার কান্না করতে-করতে বলল,

–“আপনি জানন, আপনি আমাকে কতটা কষ্ট দিয়েছেন! আমি এবার তা সুদেআসলে পূরণ করবো! ”

হায়াত অরুকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে বলল,

–“যাকে এত ভালবাসো তাকে কষ্ট দিতে পারবেতো?”

অরু না সূচক মাথা নাড়িয়ে বলল,

–“না! পারবো না! আপনাকে কষ্ট দিলে তার চেয়ে হাজারগুণ বেশি কষ্ট যে আমি নিজে পাবো! আমি আপনার মতো নিষ্ঠুর না! তারমানে আপনি মানে আদিব আমাকে ভালবাসতো?”

–“পাগলী! ভাল না বাসলে কি তোমার সব কথা শুনতাম! তোমার কি মনে হয়? আমি সব মেয়ের সাথেই ওভাবে কথা বলি? একদম না! তুমিতো আমার কাছে স্পেশাল ছিলে! তোমার মায়ের কথায় আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম! কিন্তু আজ তোমাকে পেয়ে আমার সব কষ্ট গুলো হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে! আমি আর কখনো তোমাকে হারাতে চাই না আদিবা!”

হায়াতের মুখে আদিবা নাম শুনে অরু ভীষণ খুশি হয়৷ তারপর বলে,

–“হুম! আমি আদিবের আদিবা! হায়াতের নয়! আর আপনি আমার কাছে সারাজীবন আদিব হয়েই থাকবেন!”

–“তোমার জন্য আমার রিয়েল আইডিন্টিটিই হারিয়ে ফেলবো দেখছি!”

–“কোন সমস্যা?”

–“নাহ! তুমি আমার পাশে থাকলে কোনো সমস্যাই আমাকে ছুতে পারবে না!”

অবশেষে অরু ফিরে পেলো তার আদিবকে! যে তার প্রথম ও শেষ ভালবাসা!

সমাপ্ত…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here