#ছায়াবর্ণ
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৫
আন্টির পেছনে থাকা লোকটাকে দেখে আমার শরীর কাঁপুনি দিয়ে উঠলো। মৃগী রোগীর মতো হাত পা কাঁপতে লাগলো। আশ্চর্য! আমি কি মৃগী রোগী হয়ে গেলাম নাকি? আন্টির পেছনে থাকা মিস্টার সর্বনাশক অর্থাৎ আন্টির ছেলে আওসাফ বর্ণ। তিনি মাথার টুপি হাতে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। সাদা পাঞ্জাবি তে অন্যরকম সুন্দর লাগছে তাকে। চেহারা থেকে যেন নূর উপচে পড়ছে। এই প্রথম আমার একটা হার্টবিট মিস হয়ে গেল। আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললাম–
— আসসালামু আলাইকুম ভ ভাইয়া!
তিনি গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিলেন–
— ওয়ালাইকুম আসসালাম।
অতঃপর আন্টিকে বললেন–
— কে উনি?
আমি যেন আকাশ থেকে মাটিতে টুপ করে পড়লাম। উনি আমাকে চেনেন না? আচ্ছা? আমার কি চেহারা পাল্টে গিয়েছে? আমাকে কি দেখতে ভয়ঙ্কর লাগছে? উনি আমাকে চিনতে পারছেন না কেন? আন্টি হেসে বললেন–
— ও তিন তলার নতুন ভাড়াটিয়া ভাবির মেয়ে ছায়া। কি লক্ষ্মী একটা মেয়ে! আমার সাথে খুব ভাব হয়েছে।
তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন–
— মা! এসব বাদ দাও। ক্ষুদা লেগেছে আমার। খেতে দাও দ্রুত।
বলেই তিনি লম্বা লম্বা পায়ে এগিয়ে একটা রুমের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। দাঁড়ালেন না এক পলকও। আংকেল বললেন–
— ছায়া মা আজ আমাদের সাথে খেয়ে যাও। তোমার আন্টির মুখে তোমার কথা অনেক শুনেছি। আজ তোমার সাথে আলাপ হয়ে খুব ভালো লাগলো।
আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম–
— না না আংকেল। বাবা এতক্ষণে নিশ্চয় আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি অন্য একদিন খাবো।
আংকেল আর কিছু বললেন না। আন্টি বললেন–
— আবার আসবে কিন্তু ছায়া। তোমার সাথে গল্প করে আমরা খুব ভালো লেগেছে।
আমি হাসি মুখে বললাম–
— অবশ্যই আসবো আন্টি। আমি যাই তাহলে?
আন্টি মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন। আমি বের হয়ে গেলাম। এখনও তার কথা মাথায় ঘুরছে আমার। আমি ভাবতেও পারিনি উনি বাড়িওয়ালার ছেলে হবেন। আর আমি ওনাকে কি কি না ভেবেছি। আবার কত শত গালিও দিয়েছি। উনি যদি এসব জানতে পারতেন তাহলে নির্ঘাত হাতের মুঠোয় চেপে পিষে ফেলতেন। এবার থেকে খুব সাবধানে থাকতে হবে, ছাদেও যাবো না আর ওনার ফুল গাছেও হাত দেবো না। গোমড়া মুখো রাক্ষস কোথাকার! এসব ভাবতে ভাবতে বাসায় ঢুকলাম। মা বাবা ডাইনিং টেবিলে বসে আছেন। মা আমাকে দেখে বললেন–
— একটু তরকারি দিয়ে আসতে বললাম, ঘুমিয়ে পড়েছিলি নাকি? এতক্ষণ লাগে দিয়ে আসতে?
আমি চেয়ার টেনে বসে বললাম–
— আমার কি দোষ মা? আন্টি আমাকে বসিয়ে পায়েস দিলেন, না খেয়ে উঠতেই দিলেন না। আর কত গল্পও করলেন।
— আচ্ছা ঠিক আছে, এবার কথা না বলে খেয়ে নে। তোর বাবা বসে ছিল তোর জন্য।
খেয়ে নিলাম চুপ চাপ। ভাবছি যে রানি যদি জানতে পারে যে ওর ক্রাশ আমাদের বাড়িওয়ালার ছেলে, তাহলে ও আমাদের বাড়িতেই সারাজীবনের জন্য থেকে যাবে। এক পাও নড়বে না। রানিকে এই ব্যাপার একদমই জানতে দেওয়া যাবে না।
—
সেদিনের পর থেকে এক প্রকার লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়িয়েছি। চুপি চুপি ফ্লাট থেকে বের হয়েছি আবার চুপি চুপি ফ্লাটে ঢুকেছি। কোনো জায়গায় যদি বর্ণ ভাইকে দেখি, সেখানে আমি ভুলেও যাই না। আমি ওনার সামনে কিছুতেই যেতে চাই না। আর আমি ওনার সর্বনাশক নামটা বাদ দিয়ে দিয়েছি। আমার তো আর ওনার অ্যাটিটিউড দেখিয়ে সর্ব”নাশ করতে পারেননি। ওনার লুক দেখে আমি হুমড়ি খেয়েও পড়িনি। যারা ওনার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে তারাই নাহয় এই নামে ডাকবে। তবে আমি কতক্ষন নিজেকে সামলাতে পারবো বলতে পারছি না। সে জন্যই ওনার সামনে আমি একদমই যাই না। ওনার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। যেহেতু তিন তলায় থাকি সেহেতু নিচে নামতে গেলে আমাকে দুই তলা পার হয়ে যেতে হয়। এখন সময় বিকেল। আমি কোচিং এ যাবো। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে উঁকি ঝুঁকি মারছি। দেখছি যে আশে পাশে বর্ণ ভাই আছে কিনা। না, এদিকটা তো ফাঁকা আছে। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। হঠাৎ টের পেলাম পেছনে কেউ আছে। শুধু আছেই না, খুব কাছে আছে। আমি ধীরে ধীরে পেছন ফিরে বর্ণ ভাইকে দেখে চমকে উঠলাম। পেছাতে নিলেই পা পিছলে গেল। চাপা চিৎকার দিয়ে পড়ে যেতে নিলাম। তৎক্ষণাৎ বর্ণ ভাই আমার ডান হাত চেপে ধরলেন। তীব্র গতিতে ছুটে চলেছে আমার হৃদস্পন্দন। বর্ণ ভাই আমাকে তোলেননি ঝুলন্ত অবস্থায় ধরে রেখেছেন। আমি হেলে রয়েছি পেছন দিকে। উনি হাত ছাড়লেই আমার দফা রফা হয়ে যাবে। আমি আতঙ্কিত কন্ঠে বললাম–
— ছাড়বেন না প্লিজ! আমি পড়ে যাবো। পড়ে গেলে আমার হাড্ডি সব গুঁড়ো হয়ে যাবে। হায় আল্লাহ! আমার হাত পা ভেঙে যাবে। তারপর আমাকে আর কেউ বিয়ে করবে না। আমি সারাজীবন কুমারী থেকে যাবো।
ঝুলন্ত অবস্থায় আহাজারি করছি আমি। বর্ণ ভাই এক হাত পকেটে ঢুকিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। হয়তো অপেক্ষা করছেন আমার বিলাপ বন্ধ হওয়ার। কিন্তু আমি থামার মানুষ নই।
— ও মা গো! আমি যদি এখন পঙ্গু হয়ে যায় তাহলে আমার ভবিষ্যৎ জামাইয়ের কি হবে গো। আমার বিরহে সে তো পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে।
বর্ণ ভাইয়ের বোধহয় সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল। উনি আবার শর্ট টেম্পারড ম্যান। ধমকে উঠে বললেন–
— স্টপ!
ধমকের তীব্রতায় আমি চুপ হয়ে গেলাম। তিনি সূক্ষ্ম শ্বাস ফেলে বললেন–
— এতো কথা বলো কেন? দেবো, হাতটা ছেড়ে দেবো?
আমি আঁতকে উঠে মাথা দুপাশে নাড়ালাম। তিনি আবারও বললেন–
— বেশ, আমি যা যা জিজ্ঞেস করবো ভালো মেয়ের মতো।
এটা কোনো কথা হলো? আমাকে এভাবে ঝুলিয়ে রেখে উনি প্রশ্ন করবেন। ইচ্ছে করছে, ইচ্ছে তো করছে কেঁদে গড়াগড়ি খাই। আমি ছলছল চোখে ঘাড় কাত করে সম্মতি দিলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন–
— আমি রাক্ষস?
আমি চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে রইলাম। তিনি গলা উঁচিয়ে বললেন–
— কি হলো? বলো?
— ন না।
— আমি বাঘ?
— না।
— আমি ভাল্লুক?
আচ্ছা মুশকিলে পড়লাম। আমি তো মনে মনে এসব বলেই ওনাকে গালি দিই। এখন আমি বিপদে আছি বলে এসব অস্বীকার করছি। নাহয় জীবনেও অস্বীকার করতাম না। আমি আবারও বললাম–
— না।
— তাহলে আমার সামনে আসো না কেন? আমাকে দেখলেই পালিয়ে যাও কেন? আমার সামনে আসলে আমি কি খেয়ে ফেলবো তোমাকে?
আমি কিছু বললাম না। তিনি এবার ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললেন–
— আর ছেলেদের সাথে এতো কিসের মেশামেশি? ছেলেদের গায়ে হাত দাও কেন? আর তারাও ছুতোয় তোমার গায়ে হাত দেয় সেটা বোঝ না তুমি? কলেজে পড়ো বাচ্চা আছো নাকি এখনও? লাস্ট বার ওয়ার্ন করছি, ছেলেদের থেকে দূরে থাকবে। নাহলে আমি তোমার বাসায় তোমার কীর্তি কলাপ সব জানিয়ে দেবো। নাও চয়েস ইজ ইওরস্।
মায়ের কানে একবার এসব গেলে আমার বাইরে বের হওয়া একদম বন্ধ করে দেবে। আমি কাঁদো কাঁদো হয়ে বললাম–
— আমি আর ছেলেদের সাথে মিশবো না। আপনি প্লিজ কাউকে কিছু বলবেন না।
তিনি হেঁচকা টানে আমাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে এক পা পিছিয়ে গেলেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন–
— যাও।
আমি মাথা নিচু করে সুরসুর করে নেমে গেলাম। রাস্তায় রিকশার আশায় দাঁড়িয়ে রইলাম। দেরি হয়ে গিয়েছে, রিকশা না পেলে আর যাওয়া হবে না। কিছুক্ষণ পর আমার ভাগ্য সহায় হয়ে রিকশার দেখা মিললো। আমি রিকশা থামিয়ে একপাশে উঠে বসলাম। রিকশা এগোনোর আগেই ভয়াবহ ভাবে রিকশা কেঁপে উঠলো। আমি ভীতু মুখে পাশে ফিরে দেখি বর্ণ ভাই নির্লিপ্ত ভাবে বসে আছেন। যেন এখন কিছুই হয়নি। এভাবে লাফ দিয়ে কেউ রিকশায় ওঠে? আমি অবাক হয়ে বললাম–
— আপনি! আপনি আমার সাথে কোথায় যাচ্ছেন।
তিনি রিকশা ওয়ালা কে এগোতে বললেন। অতঃপর সামনের দিকে তাকিয়ে বললেন–
— আমি তোমার সাথে কোথাও যাচ্ছি না। এদিকে আমার কাজ আছে। রিকশা পাচ্ছিলাম না, তাই বাধ্য হয়ে তোমার সাথে রিকশা শেয়ার করতে হচ্ছে।
আমি জড়সড় হয়ে আর একটু চেপে বসতে গেলেই উনি হাত চেপে ধরলেন। তবে আমার দিকে তাকালেন না। কন্ঠে গম্ভীরতা ধরে রেখে বললেন–
— রাস্তায় আছাড় খাওয়ার শখ হয়েছে নাকি? এভাবে চুপচাপ বসে থাকো।
আমি আর নড়লাম না। তবে আমার হাতটাও উনি ছাড়লেন না। কোচিং সেন্টারের সামনে এসে রিকশা থামাতে বললাম। তিনি আমার হাত ছেড়ে দিলেন। আমি নেমে ব্যাগ থেকে অর্ধেক ভাড়া বের করে দিতে গেলেই বর্ণ ভাই বললেন–
— আমি তোমার বাড়িওয়ালার ছেলে। আমার একটা সম্মান আছে তো নাকি? তোমার সাথে এইটুকু এলাম, তোমার উচিত আমাকে ভাড়া দিতে বারণ করে নিজে সম্পূর্ণ ভাড়া দেওয়া। আর তুমি হাফ দিচ্ছ?
লজ্জায় পড়ে সম্পূর্ণ ভাড়া দিয়ে ছুটে কোটিং এর মধ্যে ঢুকে গেলাম। রিকশা ওয়ালা মামার সামনে কি লজ্জা টাই না দিলো আমাকে! তবে আসার আগে ওনার মুখের দিকে তাকালে হয়তো মন মাতানো সেই হাসিটা দেখার সৌভাগ্য আমার হতো। যেটা দেখার ভাগ্য সবার হয় না।
#ছায়াবর্ণ
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৬
— এই ছায়া! আমার ক্রাশ তোর সাথে রিকশায় কি করছিল রে? সত্যি করে বল, তুই আবার আমার ক্রাশকে পটিয়ে ফেলিসনি তো?
আমি হতাশ শ্বাস ফেলে রানির দিকে তাকালাম। রানির কাছ থেকে এমনটাই আশা করা যায়। কি দেখে যে একে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড বানিয়ে ছিলাম কে জানে? বর্ণ ভাই রোজ আমার সাথে রিকশা শেয়ার করেন। ওনার কোথায় কি কাজ থাকে সেখানে যান। রানি আজ সেটাই দেখে আমাকে ওই কথাটা বললো। আমি এটা বুঝি না রোজ রোজ আমার সাথে যাওয়ার মানেটা কি? আর রোজ রোজই বা আমার থেকে পুরো ভাড়া কেন নেওয়া হয়? লজ্জায় ওনাকে কিছু বলতেও পারি না। বললেই দেখা গেল সবার সামনে লজ্জা দিয়ে বসলেন। একদিন সাহস করে জিজ্ঞেস করেছিলাম–
— আচ্ছা? আপনি রোজ রোজ আমার সাথে যান কেন? প্রতিদিনই কি আপনার কাজ থাকে?
তিনি হালকা কেশে বলেছিলেন–
— হ্যাঁ, প্রতিদিন আমার কাজ থাকে। তাই আমি যাই।
— তাহলে আমার সাথেই কেন যেতে হয়? আপনি আলাদা রিকশা নিয়ে যেতে পারেন না?
তিনি আমার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। আমি বরাবরের মতই মাথা নিচু করে নিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন–
— রিকশা কি তোমার শশুরের?
কন্ঠে তার রাগ। আমি মাথা দুপাশে নাড়িয়ে মিনমিন করে বলেছিলাম–
— না।
— তাহলে আমি যে রিকশায় যাই না কেন তোমার সমস্যা কোথায়? আমার ইচ্ছে। তুমি তো একা একাই যাও, আমার সাথে রিকশা শেয়ার করলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?
আমি আর কিছু বলিনি। যুক্তিতে তাকে কখনও হারানো সম্ভব নয়।
রানির ঝাঁকুনি তে আমি বাস্তবে ফিরলাম। সে আমার হাত ধরে ঝাঁকিয়ে বলল–
— এই! আমি তোকে কিছু জিজ্ঞেস করছি না? বোবা ভুতে ধরলো নাকি তোকে? চুপ করে আছিস কেন?
আমি ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বললাম–
— ক্রাশ কার?
— অবশ্যই আমার।
— তাহলে তুই গিয়েই জিজ্ঞেস কর না। বক বক করে আমার কানের মাথা খাস না। আমি বাসায় যাচ্ছি।
রানিকে ফেলে রেখে এগোতে লাগলাম। তোর ক্রাশ তুই গিয়ে বোঝ। আমি মরছি আমার জ্বালায় আর উনি আসলেন ওনার ক্রাশ নিয়ে। রানি পেছন থেকে দৌড়ে এসে আমার পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল–
— আরে ছায়া। তুই রাগ করছিস কেন? আমি তো এমনি এমনি বললাম।
আমি ওর কথার কোনো জবাব দিলাম না। রানি মুখ কালো করে হাঁটতে লাগলো। হঠাৎ পেছন থেকে আওয়াজ এলো।
— হেই কিউটি!
আমি ভ্রু কুঁচকে পেছন ফিরে তাকালাম। পর মূহুর্তে ভ্রু যুগল শিথিল হয়ে এলো। প্রফুল্ল কন্ঠে বললাম–
— আরে আফীফ ভাইয়া! কেমন আছেন আপনি? কতদিন পর আপনার সাথে দেখা।
আফীফ ভাই এক গাল হেসে এক পা এগিয়ে এসে উত্তর দিলেন–
— আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
মনে মনে বললাম,” আপনার খাটাশ বন্ধু ভাবো থাকতে দিচ্ছে কই? সব সময় পেছনে লেগেই আছে। কদিন পর তো তাকে কাঁঠালের আঠা নামক এওয়ার্ড দেওয়া হবে।” মুখে বললাম–
— আমিও ভালো আছি ভাইয়া। আপনাকে এতো দিন দেখিনি কেন? কোথায় ছিলেন?
— দেখবে আর কি করে? পড়ালেখা শেষ করেছি তিন বছর হলো। এই তিনটা বছর শুয়ে বসেই আছি। এখন আর কিছু না করলেই নয়। তাই চাকরির জন্য ছোটাছুটি করলাম কদিন।
— চাকরি হয়েছে ভাইয়া?
— হ্যাঁ। তোমাদের দোয়ায় ব্যাংকে চাকরি হয়ে গিয়েছে।
আফীফ ভাই একদম আমার নিজের ভাইয়ের মতো। আমাকে খুব স্নেহ করেন। ওনার চাকরির খবর শুনে খুশিতে এক প্রকার লাফিয়ে উঠে বললাম–
— এটা তো খুব খুশির খবর। মিষ্টি খাওয়াবেন না?
আফীফ ভাই পুনরায় হাসলেন। বললেন–
— অবশ্যই খাওয়াবো। কবে খাবে বলো?
— যেদিন আপনার সময় হবে সেদিন।
পর মূহুর্তে বর্ণ ভাইয়ের কথা মনে পড়লো। উনিও তো পড়ালেখা করে বসে আছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম–
— ইয়ে মানে ভাইয়া, বর্ণ ভাই চাকরি করবেন না?
আফীফ ভাই রসিকতার সাথে বললেন–
— বর্ণ তোমার ভাই নাকি?
আমি ভাবুক হয়ে বললাম–
— আপনাকে তো ভাইয়া বলি। আবার বর্ণ ভাই আপনার বন্ধু। তো তিনি আমার ভাই-ই হবেন, তাই না?
আফীফ ভাই ঠোঁট টিপে হেসে বললেন–
— হ্যাঁ ঠিক বলেছ।
অতঃপর বিড়বিড় করে বললেন–
— তোমার মুখ থেকে ভাই ডাক শুনে ওর কি হাল হবে কে জানে?
আমি শুনতে না পেয়ে বললাম–
— কিছু বললেন ভাইয়া?
— বলছিলাম যে বর্ণ চাকরি বাকরি করতে চাই না। বাপের ঘাড়ের ওপর বসে খেতে চায়। তবে তুমি একবার বলে দেখতে পারো।
আমি চমকে উঠে বললাম–
— আমি বলবো কেন?
— আরে বলেই দেখো একবার। আর আগামীকাল ট্রিট দেবো। তুমি তোমার পাশের হাওয়া হাওয়ায়ী কে নিয়ে কলেজ শেষে কলেজের সামনে দাঁড়িও। আমি গিয়ে নিয়ে আসবো।
আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলাম। এতক্ষণ রানি চুপ করে ছিল। এখন সে মুখ খুললো–
— এই! আপনি কি বললেন?
— আমি আবার কি বললাম?
— আপনি আমাকে হাওয়া হাওয়ায়ী বললেন।
— আসলে তোমাকে দেখলেই মনে হয় তুমি বাতাসে উড়ে যাবে। তাই মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল আর কি।
রানি ফুঁসে উঠে বলল–
— আপনি সেই প্রথম দিন থেকেই আমাকে অপমান করে যাচ্ছেন। আমি মোটেও এতোটা রোগা নই।
আফীফ ভাই ফিক করে হেসে দিলেন। যেন রানি খুব মজার জোকস্ বলেছে। হাসি থামিয়ে বললেন–
— বিয়ের পর খুব ভুগতে হবে। আমার কথা মিলিয়ে নিও, শুধু আফসোস করবে যে আমি আর একটু মোটা কেন হলাম না?
আমার দিকে তাকিয়ে বললেন–
— তাহলে ছায়া ওই কথাই থাকলো। দাঁড়াবে কিন্তু।
আফীফ ভাই চলে গেলেন। রানি চাপা ক্রোধে দাঁতে দাঁত চেপে বলল–
— তুই দেখে নিস ছায়া ওই ব্যাটার বউ আমার মতোই রোগা হবে। আর দিন রাত ওনার চুল ছিড়ে টাকলা বানিয়ে ফেলবে।
আমি হাসলাম। কল্পনা করলাম রানির সাথে আফীফ ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে আর সে বসে বসে তার মাথার চুল ছিঁড়ছে! নিজের কল্পনার কথা ভেবেই জোরে হেসে ফেললাম। আর রানি গোল গোল চোখে তাকিয়ে রইল।
—
সময়টা সন্ধ্যার পর। এমনিতেও আমি পড়ি না, আজ আর পড়তে ইচ্ছেও করছে না। আম্মুর সাথে গল্প করে মজা নেই। সে আমার কোনো কথাই ভালো করে শোনেন না। ভাবলাম বাড়ি ওয়ালা আন্টি দের বাসায় একবার গেলে কেমন হয়? এখন নিশ্চয়ই কেউ বাড়িতে নেই। এমনকি বর্ণ ভাইও না। আমি মায়ের রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে উঁকি দিলাম। মা বাবার জামা কাপড় গুছিয়ে রাখছেন। আমি ডাকলাম–
— মা?
মা কাজ করতে করতেই জবাব দিলেন–
— বল।
— আমি একটু বাড়ি ওয়ালা আন্টির কাছে যাই?
— তোর পড়ালেখা নেই ছায়া? এখন শুধু শুধু আন্টিকে জ্বালাতে যাবি কেন?
আমি মুখ গোমড়া করে বললাম–
— আমি মোটেও জ্বালাতে যাই না মা। আন্টি আরও আমাকে যেতে বলেছেন। আমি একটু যাই মা? যাবো আর চলে আসবো।
— আচ্ছা যা। তাড়াতাড়ি চলে আসিস।
আমি আর দাঁড়ালাম না। মাথায় ওড়না টেনে দিয়ে বের হয়ে গেলাম। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল বাজালাম। আন্টি দরজা খুলে দিলেন। আমাকে দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন–
— আরে ছায়া! এসো এসো।
আমি ভেতরে প্রবেশ করলাম। আন্টি দরজা লক করে দিয়ে ড্রয়িং রুমে বসলেন। আমিও বসলাম। আন্টি বলা শুরু করলেন–
— কেমন আছো বলো?
আমি হেসে বললাম–
— একদম ফার্স্ট ক্লাস। আপনি কেমন আছেন?
— আমিও ভালো আছি। তুমি এসেছো এখন আরও ভালো লাগছে। বাপ ছেলে থাকে নিজেদের মতো। আমি একদম একা হয়ে থাকি।
আন্টি আমাকে পেলে যে কি খুশি হন তা ওনার মুখ দেখলেই বোঝা যায়। আন্টি আমার সাথে বিভিন্ন গল্প শুরু করলেন। যেমন: ওনার আর আংকেলের বিয়ের গল্প। আংকেলের বাড়ি থেকে ওনাকে দেখতে গিয়েছিল। তারপর আংকেল এক দেখাতেই কাত হয়ে গিয়েছেন। আন্টি ছাড়া তিনি আর কাউকে বিয়ে করতে চাননি। আন্টি যে এতো সুন্দরী ছিলেন যে আংকেল পুরো ফিদা হয়ে গেছিলেন। আমি বললাম–
— আপনি এখনও অনেক সুন্দর আন্টি। যদি বলেন আপনার জন্য আবার ছেলে দেখি?
আন্টি হেসে আমার কান আলতো ভাবে টেনে ধরে বললেন–
— তুমি দেখি ভারি দুষ্টু ছায়া!
— একটু আধটু দুষ্টুমি না করলে কি আর মজা হয় বলুন তো?
— হ্যাঁ ঠিক বলেছো। তোমার মতো থাকতে কত দুষ্টুমি করেছি। এমনকি বিয়ের পরও করেছি। তোমার আংকেল কে নাকানিচুবানি খাওয়াতে আমার বেশ লাগতো।
আন্টি আর আমি খুব হাসলাম। আন্টি হাসি থামিয়ে বললেন–
— ছায়া তুমি বসো, আমি তোমার জন্য চা করে নিয়ে আসি।
আমি বারণ করা সত্ত্বেও আন্টি শুনলেন না। রান্নাঘরে চলে গেলেন। আমি বসে রইলাম। হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে গেল। চারদিকে অন্ধকার ছেয়ে গেল। আন্টি রান্না ঘর থেকে চেঁচিয়ে বললেন–
— ভয় পেও না ছায়া। আমি আসছি।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। অন্ধকারে আমি ভয় পাই না। তবুও একটু হাতিয়ে দেখি কাছে কিছু পাওয়া যায় কিনা। নাহয় আন্টির কাছে এগিয়ে যাই ধীরে ধীরে।
চলবে..