ছায়াবর্ণ পর্ব -০৩+৪

#ছায়াবর্ণ
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৩

তিন রুমের একটা ফ্লাট আমাদের। সাথে আছে ড্রয়িং প্লাস ডাইনিং রুম এবং রান্না ঘর। একটা রুমে আমি থাকি, একটা রুমে বাবা মা থাকেন। বাকি একটা রুম অতিথিদের জন্য। তবে আমার রুমকে রুম বললে ভুল হবে, এটাকে জঙ্গল বলা চলে। প্রচন্ড অগোছালো মেয়ে আমি। এই যে এখন যেমন সমস্ত জামা কাপড় বের করে ফেলে রেখেছি। সমস্যা একটাই রানির বাড়িতে যাব। কোন জামাটা পরে যাব বুঝতেই পারছি। জামা কাপড়ের স্তূপের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। বেছে বেছে একটা সাদা রঙের কাতান থ্রি পিস পছন্দ হলো। এটাই পরে যাব। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জামাটা গায়ে ধরে দেখলাম। নাহ! খারাপ লাগবে না। ভালোই। গুন গুন করতে করতে রেডি হতে লাগলাম। এর মধ্যেই মা জননী প্রকট হলেন। আমার রুমের অবস্থা দেখেই তার মাথায় হাত। রাগান্বিত কন্ঠে বললেন–

— রুমের এ কি হাল করে রেখেছিস ছায়া? মনে হচ্ছে রুমের মধ্যে ঘুর্ণিঝড় বয়ে গিয়েছে।

আমি একটা ইনোসেন্ট হাসি দিয়ে বললাম–

— কি করব মা বলো? আমি তো রানিদের বাড়িতে যাব। কোনটা পরে যাব বুঝতে পারছিলাম না। তাই..

মা কাপড় গোছাতে গোছাতে বললেন–

— তাই বলে সব জামা কাপড় বের করতে হলো! তুই সব অগোছালো করে রাখবি আর গুছিয়ে রাখতে হবে আমায়। বিয়ের পর কে গুছিয়ে দেয় দেখব।

মায়ের কথায় তেমন কান দিলাম না। পরিপাটি হয়ে মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বললাম–

— আমাকে কেমন লাগছে মা দেখো তো?

মা তাকিয়ে দেখলেন। আবারও কাপড় গোছানো তে মন দিয়ে বললেন–

— সব সময় যেমন লাগে তেমনই লাগছে। আর হ্যাঁ! যাচ্ছিস ভালো কথা। তাড়াতাড়ি চলে আসবি।

— আচ্ছা। চলে আসব।

আমি বেরিয়ে এলাম। দুপুর হতে এখনও সময় আছে। আজ রানিদের বাড়িতে লাঞ্চ এর ইনভাইট আছে আমার। বেশ ফুরফুরে মেজাজে ফ্লাট থেকে বের হলাম। বিল্ডিং এর সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ভাবলাম, যে রানিদের বাড়িতে তো আর খালি হাতে যাওয়া যায় না। তো আমি কি নিয়ে যাব? আমার ভাবা শেষ হলো না, তার আগে ঝপাৎ করে আমার মাথায় কিছু পড়লো। পুরো শরীর ভিজে যবযবে হয়ে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় ওষ্ঠদ্বয় একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। নিজের দিকে তাকিয়ে আমার গড়াগড়ি খেয়ে কান্না করতে ইচ্ছে হলো। কেউ রঙের পানি ঢেলে দিয়েছে আমার মাথায়। আমার সাদা জামার দফা রফা হয়ে গেল। আমি মুখ ঘুরিয়ে ওপরের দিকে তাকালাম। দেখলাম সেই খিটখিটে লোকটা বালতি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মধ্যে ডোন্ট কেয়ার ভাব। যেন এই কাজটা করার জন্য সে মোটেও অনুতপ্ত নয়। আচ্ছা? এই লোক বারবার বাড়ি ওয়ালা আন্টিদের বাড়ি ঘুরঘুর করে কেন? আমি তো আত্মীয় ভেবেছিলাম, নিশ্চয়ই কেয়ার টেকার হবে। আমি রাগে দুঃখে চেঁচিয়ে উঠলাম–

— এই যে! দেখতে পান না নাকি? জল জ্যান্ত একটা মানুষের ওপর এক বালতি পানি ফেলে দিলেন? পানি হলেও মানা যেত, কিন্তু আপনি রঙ গোলা পানি ফেললেন!

তিনি গলা উঁচিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন–

— কেউ সং সেজে কোনোদিকে খেয়াল না করে দাঁড়িয়ে থাকবে, আর আমি পানি ফেললেই দোষ? এতে আমার কোনো দায় নেই। আমি তো রোজ পানি ফেলি তখন তো কেউ থাকে না। তাই আজও দেখে পানি ফেলার প্রয়োজন বোধ করিনি।

কথা গুলো বলে তিনি চলে গেলেন। আমি হা করে তাকিয়ে থাকলাম। যা বাবা! নিজে অন্যায় করে সেই দোষ আমার ওপর চাপিয়ে চলে গেল! এখন আমি আর রানিদের বাড়িতে যেতে পারবো না। সব থেকে বড় কথা! মা আমার সাদা জামার এই হাল দেখলে আমাকে কে”টে কুচি কুচি করে নদীর জলে ভাসিয়ে দেবে। আমি দাঁড়িয়ে সাত পাঁচ ভাবছি, এর মধ্যেই আবার সেই পুরুষালী কন্ঠস্বর কানে ঝংকার তুললো–

— এখনও দাঁড়িয়ে আছ? আচ্ছা বেশ, আমি আরও এক বালতি পানি ফেলবো। যদি তোমার গায়ে পড়ে তাহলে আবার বোলো না যেন যে আমি সাবধান করিনি।

বলে তিনি পুনরায় চলে গেলেন। আমি আবারও হা করে তাকালাম। দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বিল্ডিং এ প্রবেশ করলাম, বলা তো যায় না এবার কি গোলা পানি ফেলে? মনে মনে রানিকে একশো গালি দিয়ে বললাম, “রানিরে তোর বাড়িতে যাওয়ার জন্য আজ আমার এই হাল হলো, তোকে যদি পঁচা পানিতে না চুবিয়েছি তবে আমার নাম ছায়া নয়।” যদিও এখানে রানির কোনো দোষ নেই। তবে ওই হনুমানকে তো আমি কিছু করতে পারবো না, রানির ওপরই আমার রাগ ঝাড়তে হবে।

রাস্তা দিয়ে বাড়িতে ফিরছি আমি আর রানি। রানিদের বাড়িতে যাইনি বলে রানি খুব মন খারাপ করেছে। তাই আর তাকে কিছু বলতে পারিনি। কেন যেতে পারিনি সেটা রানিকে বললাম। রানি প্রথমে হা করে তাকিয়ে থেকে তারপর হেসে ফেলেছিলো। এবং এখনও সে মিটিমিটি হেসেই যাচ্ছে। আমি মেকি রাগ দেখিয়ে বললাম–

— হাসবি না রানি। মা আমার হাড্ডি গুঁড়ো করে ঘরে বসিয়েই রাখতো। তবে ওটা আমার প্রিয় জামা ছিল বলে কান্না কাটি করেছিলাম, এমনকি দুপুরে খাইনি প্রর্যন্ত। তাই আর মা কিছু বলেনি। ওই খিটখিটে লোকটাকে হাতের কাছে পেলে আমি যে কি করতাম রে রানি! দেখে তো মনে হয় জিম করে। আমার গায়ে যদি শক্তি থাকতো না? তাহলে তাকে ল্যাং মেরে উল্টে ফেলতাম। তারপর তার হাত মুড়িয়ে ধরে বলতাম, ” কিরে ব্যাটা? আর পানি ফেলবি আমার ওপর? বল আর ফেলবি?” তখন সে ভয় পেয়ে মাথা দুপাশে নাড়াতো। আহা! আমার মনে শান্তি লাগতো।

— তাই বুঝি? তো আর কি কি করতে ইচ্ছে করে আপনার?

একটানা কথাগুলো বলে দম নিয়েছি কেবল, এরই মধ্যে কানে বাজলো সেই ঝংকার তোলা পুরুষালী কন্ঠস্বর। আমার আর রানির উভয়ের হাঁটা থেমে গেল। আমি বিস্ফোরিত নয়নে রানির দিকে তাকালাম। এর অর্থ, আমি এতক্ষন যাকে নিয়ে এতো কিছু বললাম পেছনে কি সে আছে? রানি আমার চোখের ভাষা বুঝতে পেরে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। চোখ খিচে বন্ধ করে পেছন ঘুরলাম। ধীরে ধীরে চোখ মেলে দু পকেটে হাত গুজে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে আবিষ্কার করলাম। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন একটা ভাইয়া, চোখে চশমা পরা। দেখতে হাবাগোবা লাগে। একটু মেকি হাসার চেষ্টা করলাম। কিন্তু হাসি এলো না। শুকনো ঢোক গিলে বললাম–

— আ আপনি!

— হ্যাঁ আমি। তো বলো তোমার আর কি কি করতে ইচ্ছে করে? আমিও একটু শুনি?

আমি না বোঝার ভান করে বললাম–

— কই? আমার তো কোনো ইচ্ছে নেই। এই রানি? তুই বল আমি কি কোনো ইচ্ছের কথা বলেছি?

আমার কথা শুনে রানি ক্যাবলা হেসে মাথা ডানে বায়ে নাড়ালো। আমি ওনার দিকে তাকালাম। আসলে তিনি সুন্দর, বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী পুরুষ। আবার গায়ে সাদা শার্ট জড়িয়ে রেখেছেন, যেটা আমার দূর্বলতা। তীক্ষ্ণ চোখ জোড়ার দিকে তাকালে কোনো মেয়ের সর্বনাশ নিশ্চিত। তিনি শ্যামবর্ণ নন। তার থেকেও এক ধাপ ওপরে। যাকে বলে পারফেক্ট। রানি ওনার ওপর ক্রাশ খেয়ে ভুল কাজ করেনি। খিটখিটে নামটা চেঞ্জ করা উচিত। তাহলে কি বলা যায়? গরু, ছাগল? না না পশু বাদ। মিস্টার সর্বনাশক! হ্যাঁ, এটাই ঠিক আছে। তিনি আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তবে একবার তার চোখের দিকে তাকিয়ে আর তাকানোর সাহস পাইনি। তিনি বললেন–

— আমার পেছনে আমাকে মা’রধর করার ফন্দি! নিজের দিকে তাকিয়ে দেখো। বাচ্চা ইঁদুর লাগে দেখতে। সে আবার আমাকে ল্যাং মারতে চায়!

আমাকে ইঁদুর বলায় আমি নিজের দিকে তাকালাম। আমাকে দেখতে ইঁদুরের মতো লাগে? আমি মুখ গোমড়া করে বললাম–

— আমি মোটেও ইঁদুর নই। আমি ইঁদুরের থেকেও বড়।

রানি আর ওনার পাশে থাকা ভাইয়াটা মুখ চেপে হেসে ফেললো। কিন্তু তিনি হাসলেন না, এমনকি তার সর্বনাশা দৃষ্টিও আমার থেকে সরালেন না। আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। তিনি কন্ঠে তাচ্ছিল্যতা এনে বললেন–

— এই আফীফ! আমি কি ভুল কিছু বলেছি নাকি?

পাশের আফীফ নামক ভাইয়াটি তীব্র প্রতিবাদ করে বললেন–

— মোটেও ওকে দেখতে বাচ্চা ইঁদুরের মতো লাগে না। তুমি ওর কথাকে পাত্তা দিও না তো। তোমার পাশের জনকে শুটকি মাছের মতো দেখতে লাগে।

এই কথা শোনা মাত্রই রানি ফোঁস করে উঠে বলল–

— এই! কি বললেন আপনি?

আফীফ ভাই তাকে পাত্তা দিলেন না। আবারও আমাকে বললেন–

— তোমার নাম কি কিউটি?

আমি গদগদ হয়ে বললাম–

— তাহসীনা ছায়া।

— বাহ! খুব সুন্দর নাম। আর তুমি ওর কথায় কিছু মনে কোরো না কেমন? তুমি খুব ভালো মেয়ে একদম রেড রোজের মতো দেখতে তোমাকে। আর পৃথিবীতে যা শুনকা পটকা আছে সব তোমার পাশের জনকে লাগে।

তিনি কথাগুলো বলে আর অপেক্ষা করলেন না। মিস্টার সর্বনাশক কে নিয়ে চলে গেলেন। আমি তো খুব খুশি। তবে রানি ফোঁস ফোঁস করছে, যেন আফীফ ভাইকে হাতের মুঠোয় পেলে তার গলা টিপে ধরে বলবে, ” কিরে! আমাকে শুকনো বলিস? এই দেখ শুকনো মানুষের হাতের জোর।”#ছায়াবর্ণ
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৪

এই বাড়ির ছাদটা আমার খুব ভালো লাগে। আকাশের দিকে মুখ করে তাকিয়ে থাকতে বেশ লাগে। যখন পাখিদের দেখি উড়ে যেতে, তখন মনে হয় যদি আমিও উড়তে পারতাম? তাহলে উড়ে উড়ে কত জায়গায় যে যেতাম। এখানে অনেক ধরনের ফুল গাছ আছে। নিশ্চয়ই বাড়িওয়ালা আন্টি দের। আচ্ছা? এত শখ করে গাছগুলো কে লাগালো? আন্টির কি কোনো মেয়ে আছে? যদি থাকে তাহলে তার সাথে আলাপ করলে মন্দ হয় না, আমারো একজন সাথি হবে। গুন গুন করে গান গাইছি আর ফুল গুলো দেখছি। জোরে গাইলে লোকে বলবে কাক কা কা করছে। সেই ভয়ে আর জোরে গান গাওয়া হয় না। হঠাৎ সুন্দর একটা সাদা গোলাপ দেখে আমার লোভ লাগলো। হাত বাড়িয়ে ধরতে নিলেই পেছন থেকে কর্কশ কন্ঠে কেউ চেঁচিয়ে উঠলো। কানে ঝংকার তোলা সেই পুরুষালী কন্ঠস্বর।

— এই মেয়ে!

আমি হকচকিয়ে পেছন ফিরে তাকালাম। মিস্টার সর্বনাশক দু পকেটে হাত গুজে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি মাথা নিচু করে নিলাম। আমি বুঝতে পারি না, এই বাড়িতে ওনার এতো কি কাজ? যখনই ফ্লাট থেকে বের হই তখনই কোনো না কোনো ভাবে ওনার সাথে দেখা হয়। আশ্চর্য! তিনি ঝাঁঝালো কন্ঠে বললেন–

— ফুল চুরি করা হচ্ছে?

আমি কাচুমাচু হয়ে বললাম–

— আমি তো একটু দেখছিলাম।

— তোমার কি আমাকে অন্ধ মনে হয়? আমি এই মাত্র দেখলাম তুমি ফুল ছিঁড়তে যাচ্ছিলে।

ওনার চেঁচিয়ে বলা কথার সাথে কেঁপে কেঁপে উঠছি আমি। বাচ্চা মেয়ের সাথে এভাবে কেউ কথা বলে? না না আমি তো বাচ্চা না, আমি এখন কলেজে পড়ি। তিনি আবারও বললেন–

— কি হলো? অন্যসময় যে মুখ থেকে ভালোই খই ফোটে। এখন চুপ কেন?

— আমি সত্যিই বলছি, আমি একটু দেখছিলাম শুধু।

তিনি গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছেন। চকলেট কালার টি শার্টের সাথে ব্লাক কালারের ট্রাউজার পরেছেন। ইশ্! চকলেট বয় বুঝি এমনই হয়? আমার ওনাকে এখন খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। ছিঃ ছিঃ এসব কি ভাবনা তোর ছায়া? তোর লজ্জা হওয়া উচিত, ছিঃ। উনি এক পা এগিয়ে এসে বললেন–

— গতকাল তোমার সাথে যে ছেলেটা ছিল ওর সাথে কি সম্পর্ক তোমার?

আমি এবার অবাক না হয়ে পারলাম না। আমার সাথে কোনো ছেলে ছিল কি ছিল না তা জেনে ওনার কি দরকার? আমি বললাম–

— তা জেনে আপনি কি করবেন?

পাল্টা প্রশ্ন করাতে উনি রেগে গেলেন। ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললেন–

— যেটা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দাও। পাল্টা প্রশ্ন আমি পছন্দ করি না।

আমি হা হয়ে তাকালাম। উনি আমার তুলনায় অনেক লম্বা আমি কোথায় পাঁচ ফুট তিন, আর ওনাকে দেখে মনে হয় ছয় ফুট তো হবেনই। সূর্য ডুবতে বসেছে, সেই লালচে আলোয় ওনার মুখ বেশ আকর্ষণীয় লাগছে। আবারও নিজেকে ধিক্কার জানিয়ে মাথা নিচু করে নিলাম। মিনমিন করে বললাম–

— ও আমার ক্লাসমেট। রিফাত।

তিনি গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন–

— ঠিক আছে। ছেলেদের থেকে একটু দূরে থাকবে।

— আশ্চর্য! আমি ছেলেদের থেকে কেন দূরে থাকবো?

তিনি চোখ রাঙিয়ে তাকালেন। ভয়ে আমার কলিজা ছলাৎ করে উঠলো। ঘন ঘন মাথা নাড়িয়ে বললাম–

— ছেলেদের আশে পাশেও যাবো না।

— গুড! যাও এবার নিচে যাও।

আমি এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে নিচে চলে আসলাম। কার মুখ দেখে আজ উঠেছিলাম কে জানে? পরে মনে পড়লো আমি তো নিজেরই মুখ দেখেছিলাম। হায় কপাল!

আজ শুক্রবার। শুক্রবার মানেই একটা মজার দিন। সকালে মায়ের ডাকা ডাকি তে অতিষ্ঠ হয়ে ন’টার সময় উঠেছি। আজ সকালের খাবার ছিল খিচুড়ি আর ডিম ভাজা। আহা! আমার পছন্দের একটা খাবার। প্রতি শুক্রবারে মায়ে এটা রান্না করতেই হবে, কারণ এটা বাবার পছন্দের। খাওয়া দাওয়া শেষে বাবা আবার শুয়ে পড়লেন। আজ দিনটা তিনি বিশ্রাম নিয়ে কাটাবেন। এনজিওর চাকরি তো, তিনি অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়েন। আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরে খানিক আবদার করলাম। আমার এই চাই, আমার ওই চাই। বাবাও তা হাসি মুখে মেনে নিলেন। আমি বাবাকে আর জ্বালাতন করলাম না। মা কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন। আজ ভালো মন্দ রান্না হবে। আমি রান্না ঘরে উঁকি মেরে দেখছি যে মা কি করছেন। মা আমাকে উঁকি দিতে দেখে বললেন–

— কি রে ছায়া! কি দরকার তোর?

— না মানে আমি কি তোমাকে কোনো সাহায্য করতে পারি মা?

মা সবজি কাটতে কাটতে বললেন–

— তুই আমাকে সাহায্য করতে এসে আমার কাজ আরও বিগড়ে দিস। আর আমাকে দ্বিগুণ খাটতে হয়। মনে আছে? একবার যে ডিম ভাজতে যেয়ে কড়াইতে পানির মধ্যে তেল ঢেলে দিয়েছিলি? তার পর ওর মধ্যেই আবার ডিম দিয়েছিলি। তেল পানি একসাথে ছ্যাত করে উঠে হাতে লেগে সে কি অবস্থা! তোর বাবা তোর জন্য আমাকে বকেছিল।

আমি মুখ গোমড়া করে বললাম–

— মা! সেটা তো ক্লাস ফাইভের কথা। তখন ছোট ছিলাম, এখন তো বড় হয়ে গিয়েছি। এখন আমি ডিম ভাজতেও পারি।

— হ্যাঁ খুব পারো। বিয়ের পর শশুরবাড়ি তে রান্না করে খাওয়াস। এখন আমাকে জ্বালাস না। যা তো, রান্না ঘর থেকে বের হ।

ধুর! মা শুধু এমন করে। আমি তো কত কিছু রান্না করতে পারি! ডিম ভাজতে পারি, ডাল রান্না করতে পারি। আরও অনেক কিছু পারি, কিন্তু মনে পড়ছে না। আমি চুপচাপ ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখতে লাগলাম।
বাবা রেডি হয়ে একটার সময় নামাজ পড়তে চলে গেলেন। আমিও গোসলটা সেরে নিলাম। নামাজ টাই বা বাদ রাখি কেন? নামাজও পড়ে নিলাম। ড্রয়িং রুমের সোফায় আবারও ধপ করে বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর মা ডাকলেন–

— এই ছায়া! শুনে যা তো।

আমি এগিয়ে গেলাম। মা ডাইনিং টেবিল সাজাচ্ছেন। বাবা আসলেই খাওয়া শুরু হবে। মা আমার দিকে একটা বাটি এগিয়ে দিয়ে বললেন–

— এটা বাড়িওয়ালা আন্টি দের বাসায় দিয়ে আয়। ভাবি যখনই ভালো কিছু রান্না করে আমাদের দিয়ে যান, আমরা না দিয়ে হয়?

আমি নাকোচ করে বললাম–

— মা আমার যেতে ইচ্ছে করছে না।

মা কোমরে হাত গুজে বললেন–

— সেদিন যে দুধ পিঠে দিয়ে গেল, সেটা তো বেশ মজা করে খেলি। আর এখন ওনাদের একটু দিয়ে আসতে বলছি তাই পারবি না? দিবি আর চলে আসবি। যা।

আমি মুখ কালো করে মাথা ওড়না তুলে দিয়ে বাটি নিয়ে বের হয়ে গেলাম। বাড়িওয়ালা আন্টি দের বাসায় আমার আগে কখনও যাওয়া হয়নি, এই প্রথম যাচ্ছি। দুই তলার পুরোটা নিয়ে আন্টিরা থাকেন। এতো গুলো রুম কি করেন তারাই জানেন। আমি দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। হাত বাড়িয়ে কলিং বেল বাজালাম। কিছুক্ষণ পর আন্টি এসে দরজা খুলে দিলেন। আমাকে দেখে এক গাল হেসে বললেন–

— আরে ছায়া! এসো ভেতরে এসো। তুমি তো একদমই আসো না।

আমি মৃদু হেসে ভেতরে প্রবেশ করে বাটি টা এগিয়ে দিয়ে বললাম–

— মা এটা দিয়েছে।

আন্টি ওটা হাতে নিয়ে বললেন–

— এসবের কি দরকার ছিল বলো তো? তুমি বসো আমি আসছি।

আমি ভদ্র মেয়ের মতো সোফাতে বসলাম। আন্টি দের বাসাটা বেশ সাজানো গোছানো। দেওয়ালে চকচকে সাদা রঙ করা, তাছাড়া সব দামি আসবাব পত্রে ভরা। ডাইনিং টেবিল টা কাঁচের। সোফার সামনে দেওয়ালে মনিটর লাগানো। চার থেকে পাঁচ টা রুম আছে। দুটো রুম খোলা আর বাকিগুলো বন্ধ। তার মানে ওগুলোতে কেউ থাকে না। কিছুক্ষণ পর আন্টি আসলেন। একটা ছোট ট্রেতে করে পায়েস আর পানির গ্লাস টি টেবিলের ওপর রাখলেন। পায়েস আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন–

— আজ পায়েস রান্না করেছি। খেয়ে দেখো তো কেমন হয়েছে?

আমি নাকোচ করা সত্ত্বেও আন্টি জোর করে খেতে বললেন। আমি মুখে দিয়ে দেখলাম বেশ হয়েছে খেতে। আমি বললাম–

— অনেক ভালো হয়েছে আন্টি। এটা আমাকে শিখিয়ে দেবেন?

আন্টি খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন–

— অবশ্যই শেখাবো।‌ কেন শেখাবো না? একদিন সময় করে এসো, আমি তোমাকে শিখিয়ে দেবো।

আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। বললাম–

— আচ্ছা আন্টি? আপনার কয় ছেলে মেয়ে?

— আমার একটাই ছেলে। বাবা ছেলে মিলে নামাজ পড়তে গিয়েছে।

আন্টির ছেলে কেমন হবে? আমার বয়সী বা আমার থেকে একটু বড় হতে পারে। আন্টির সাথে টুক টাক গল্প করতে করতে দুইটা বেজে গেল। আমরা একদিনেই বন্ধুর মতো হয়ে উঠলাম। আন্টি অনেক মিশুক প্রকৃতির মানুষ। আংকেল বা ছেলে সব সময় বাসায় থাকে না, তিনি একা থাকেন। এবার থেকে আমি সময় পেলেই আন্টির সাথে গল্প করতে আসবো বলে ঠিক করলাম। আন্টিও নিশ্চয়ই খুব খুশি হবেন। আর আন্টির কাছ থেকে টুক টাক রান্নাও শেখা যাবে। হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠলো। আন্টি উঠে গেলেন। একটু পর আন্টির সাথে একটা লোক আসলেন। আন্টি বললেন–

— এই হচ্ছে ছায়া! যার কথা তোমাকে বলেছিলাম না? দুই তলায় থাকে। আর ছায়া, এই হচ্ছে তোমার আংকেল।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে ভদ্রতার সাথে সালাম দিলাম। তিনি সালামের উত্তর নিলেন। আন্টির পেছনে থাকা আরেকজন লোককে দেখিয়ে আন্টি বললেন–

— এই হচ্ছে আমার ছেলে আওসাফ বর্ণ।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here