ছায়াবর্ণ পর্ব -০১+২

— এই রানি! মোটেও ভালো হবে না কিন্তু। না! না!

ঘটে গেল অঘটন। এই মুহূর্তে কোনো সুঠাম দেহের প্রসস্থ বুকে মাথা ঠেকে আছে আমার। ভয়ে চোখ কুঁচকে বন্ধ করে আছি। শরীর মৃদু মৃদু কাঁপছে। বুকের মধ্যে হাতুড়ি পেটা হচ্ছে। মনে হচ্ছে সিরিয়ালের যখন নায়িকা নায়কের গায়ের ওপর পড়ে তখন যেমন সিন থমকে থাকে, তেমনটাই আমার সাথে হচ্ছে। কিন্তু এখানে সিরিয়াল চলছে না। আর আমি কোনো নায়িকা নই। এটা তো বাস্তব। আর তা আমার জন্য বড়ই লজ্জা জনক। এভাবে অজ্ঞাত কোনো পুরুষের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়াটা কখনো এবং কখনোই স্বাভাবিক ব্যাপার হতে পারে না। কিছুক্ষণ পর পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালাম। লোকটার কটমটে দৃষ্টি লক্ষ্য করতেই আমি ভড়কে গিয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়ালাম এবং জামা কাপড় ঝাড়তে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। তিনিও উঠে দাঁড়ালেন। আমি কাচুমাচু করে বলতে নিলাম–

— স স্যরি! আ আমি..

কথা শেষ করার আগেই রাম ধমক খেয়ে আমার কলিজা ছলাৎ করে লাফিয়ে উঠলো।

— রাস্তা কি নাচানাচি করার জায়গা? দেখে তো কলেজ পড়ুয়া মেয়ে লাগছে অথচ রাস্তায় কীভাবে হাঁটে সেটাও জানো না? স্টুপিড!

অচেনা মানুষের থেকে ধমক খেয়ে আমার চোখ ছলছল করে উঠলো। আমার চৌদ্দ গোষ্ঠীতে আমার মা ছাড়া এমন ধমক কেউ দেয়নি আমায়। সবার খুব আদরের আমি। আর আমি মোটেও রাস্তায় নাচানাচি করি না। বয়স সতেরো পূর্ণ হলো মাস কয়েক আগে, কীভাবে রাস্তা ঘাটে হাঁটতে হয় তা আমি বেশ জানি। রানি ধাক্কা দিয়েছিল বলেই তো ওনার গায়ের ওপর পড়লাম। এতে আমার কি দোষ? কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে নিলেই উনি আবারও ধমকে উঠলেন–

— আর কোনো দিন রাস্তায় এভাবে চলতে দেখলে সোজা কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখবো। আমি বলেই তোমাকে কিছু বললাম না। অন্য কেউ হলে!

ওনার সাথে থাকা একটা ভাইয়া বলে উঠলো–

— আহা! এভাবে বলছিস কেন বাচ্চা মেয়েটাকে? ভুল হয়ে গিয়েছে দেখতে পায়নি হয়তো।

— তুই চুপ কর। এসব বাচ্চাদের তাদের মা বাবা রাস্তায় ছাড়ে কেন আমি বুঝতে পারি না!

উনি এবং ওনার সাথে থাকা ছেলে গুলো চলে গেলেন। খাটাশ লোকটা সহ মোট তিনজন ছিলেন। লোকটা আমাকে বাচ্চাও বলে গেল। আমি একবার নিজের দিকে তাকালাম। কোন দিক দিয়ে আমাকে বাচ্চা লাগে? বুঝতে পারলাম না। আপাতত এসব বিষয় সাইডে রেখে আমি চোখে জল নিয়ে অগ্নি দৃষ্টিতে রানির দিকে তাকালাম। সে আমতা আমতা করে বলল–

— স্যরি দোস্ত! আমি বুঝতে পারিনি এমন একটা ঘটনা ঘটে যাবে। বিশ্বাস কর। আর এতো সুন্দর একটা ছেলের এমন খিটখিটে মেজাজ হবে তা কে জানতো? আমি তো দেখে ক্রাশ খেয়েছিলাম। ইশ্ কি কিউট! তার সাথের ছেলে দুটোও সুন্দর ছিল বল? তাহলে আমি কোনটা কে প্রপোজ করবো দোস্ত? একটু এ্যাডভাইস দে তো।

আমাকে এত কথা শুনিয়ে গেল তাতে তার কিছু না, উনি পড়ে আছেন ক্রাশ নিয়ে। নিজের বান্ধবী ভাবতেই কচু গাছে গলায় দড়ি দেওয়ার তীব্র ইচ্ছে জন্মালো ‌‌। রাগে দুঃখে আমি চেঁচিয়ে উঠলাম–

— রানি কি বা’চ্চি! তোর জন্য আজ আমাকে এত কথা শুনতে হলো। দাঁড়া তুই! আমি জীবনেও এমন ধমক খাইনি। সব তোর দোষ।

ও আশে পাশে না তাকিয়ে দিল ভো দৌড়। আমিও ওর পেছনে ছুটলাম। ও গড়গড় করে বলতে লাগল–

— এবারের মতো মাফ করে দে। তুই না আমার সোনা মোনা কলিজার কনা?

— নি’কু’চি করি তোর সোনা মোনার! পালাচ্ছিস কোথায়? দাঁড়া!

ছুটতে লাগলাম দুজনে। আজ ধরতে পারলে ওর খবর আছে। একটু আগে যে কেউ রাস্তায় ভালো ভাবে না চলার জন্য রাম ধমক দিয়ে গেল, তা ভুলে খেয়ে ফেলে আমি দৌড়াতে লাগলাম।

— মা আমার ক্ষিদে পেয়েছে। কিছু খেতে দাও। মাআআ।

সেই কখন কলেজ থেকে এসে শাওয়ার নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মা খেতে ডাকলেও উঠিনি। আমার খাওয়া পরে আগে ঘুম। এখন বিকেল হয়ে গিয়েছে, মনে হচ্ছে পেটের মধ্যে ইঁদুর দের এক ম্যাচ খেলাও শেষ। খিদের ঠ্যাল‌‌ায় চেঁচাতে চেঁচাতে ড্রয়িং রুমে এসে এক ভদ্রমহিলাকে দেখতে পেলাম। থেমে গেলাম আমি। দেখতে বহুত সুন্দর মহিলা, ফর্সা। নিশ্চয়ই যৌবন কালে খুব সুন্দরী ছিলেন। ছেলেরা নিশ্চয়ই তার পিছু পিছু ঘুরত! তাকে চিনতে পারলাম না। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। মা আমাকে দেখে বললেন–

— এভাবে কেউ চেঁচায়? এই দেখ কে এসেছে।

আমি প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালাম। মা আমার দৃষ্টি বুঝতে পেরে বললেন–

— ইনি হচ্ছেন তোর বাড়িওয়ালা আন্টি। আর ভাবি এই হচ্ছে আমার একমাত্র মেয়ে তাহসীনা ছায়া।

অতঃপর আমার মনে পড়লো যে আমরা নতুন ফ্লাটে উঠেছি। আগের টা বাবার অফিস দূরে হওয়ায় চেঞ্জ করতে হলো। এখান থেকে বাবার অফিসও কাছে আর আমার কলেজও। আমি সৌজন্য মূলক হেসে সালাম দিলাম। উনি সালামের উত্তর নিয়ে বললেন–

— তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন ছায়া? বসো, আমার পাশে এসে বসো।

আমি জোর পূর্বক হেসে ওনার পাশে যেয়ে বসলাম। এদিকে খিদেতে পেটের মধ্যে ইঁদুর লাফালাফি ঝাঁপাঝাঁপি করছে। আন্টি বললেন–

— খুব মিষ্টি মেয়ে তুমি। কোন ক্লাসে পড়?

— জ্বী ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার।

— বাহ! ভালো করে পড়াশোনা করবে কেমন?

আমি দাঁত কেলানি দিলাম। আমি যে পড়াশোনা করি! মায়ের দিকে তাকালাম, এবার আমার ইজ্জত শেষ হবে নিশ্চিত। আমার ভাবনাকে সত্যি করে দিয়ে মা বলা শুরু করল–

— ও আর পড়ালেখা! দুটো দুই মেরুর বাসিন্দা। পড়ালেখার আশে পাশে যেতে চায় না ভাবি। কি যে করবো আমি একে নিয়ে? কোনো কাজ ও পারে না। শুধু পারে খেতে আর টিভি, মোবাইল দেখতে।

আমি চোখ বন্ধ করে শুনে গেলাম। আমার ইজ্জত না ধুয়ে দিলে মায়ের হচ্ছিল না। আন্টি হেসে বললেন–

— আরে ভাবি ছোট মেয়ে এমন একটু আধটু হয়। ঠিক হয়ে যাবে দেখবেন। আমিও তো ছোট বেলায় পড়ালেখা করতে চাইতাম না।

আন্টি আমার সাপোর্ট করেছেন দেখে আমি ছলছল নয়নে হাসি মাখা বদনে একবার তার দিকে তাকিয়ে মাকে মুখ ভেংচি কাটলাম। বোঝালাম যে “দেখো! আমাকেও সাপোর্ট করার মতো কেউ আছে।” ইচ্ছে করছে আন্টিকে জড়িয়ে ধরে দুটো চুমু খেতে। কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে ইচ্ছে টাকে চেপে রাখলাম। মা আমার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে হতাশ শ্বাস ফেললেন।

কলেজ যাবার উদ্দেশ্যে বের হয়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নামছি। হঠাৎ গতকালের সেই খিটখিটে লোকটাকে দেখে আমার পা থেমে গেল। উনি বাড়িওয়ালা আন্টিদের ফ্লাট থেকে বের হচ্ছেন। আন্টি দের কোনো আত্মীয় নাকি? উনি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই আমার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। আমি চোখ ফিরিয়ে চলে যেতে নিয়ে উনি পিছু ডাকলেন–

— এই মেয়ে!

আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। এই মেয়ে বলে ডাকায় রাগ হচ্ছে খুব। তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন–

— এখানে থাকো নাকি? নতুন?

ওনার গম্ভীর কণ্ঠে না চাইতেও আমার গলা শুকিয়ে গেল। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বললাম–

— জি।

উনি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন–

— কত তলায়?

আশ্চর্য! এতো কথা শুনছন কেন উনি? এতো কথা শুনে কি করবে গোমড়া মুখো খিটখিটে লোকটা? বিড়বিড় করে ওনাকে খানিক গা’লি দিয়ে বললাম–

— আশ্চর্য! আমি কত তলায় থাকি আপনাকে বলতে যাবো কেন? এই! আমি চোর টোর নন তো? বাড়িওয়ালা আন্টিদের ফ্লাটে কি করতে গেছিলেন? সত্যি করে বলুন তো?

উনি পারেন তো চোখ দিয়েই আমাকে ভষ্ম করে দেন। আমি শুকনো ঢোক গিললাম। তিনি দিলেন এক ধমক–

— এই মেয়ে! বড়দের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় জানো না? যা জিজ্ঞেস করলাম তার উত্তর দাও। এইটুকু মেয়ে তার আবার এত কথা!

আবারও আমাকে বকলেন! আমি পারি না কেঁদে ভাসিয়ে দেই। মিনমিন করে বললাম–

— তিন তলায় থাকি আমরা। নতুন এসেছি।

তিনি কন্ঠে গম্ভীর্যতা বজায় রেখে বললেন–

— ঠিক আছে যাও। রাস্তায় ভালো ভাবে চলবে। আর আমি যদি দেখি নাচানাচি করতে তাহলে ঠিকানা তো নিয়েই নিলাম, বাসায় যেয়ে বলে আসবো। মনে থাকে যেন।

আমি হা করে তাকিয়ে থাকলাম। উনি আমার তাকানোকে পাত্তা না দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে গট গট করে হেঁটে চলে গেলেন। ব্যাটার তলে তলে এতো! একশো বার নাচবো তাতে তার কি? বাড়িওয়ালা আন্টিকে বলতে বলে এসব খিটখিটে লোকদের যেন বাড়িতে ঢুকতে না দেয়। কি সুন্দর কলেজ যাচ্ছিলাম। আমার মুডটায় খারাপ করে দিল। মুখ কালো করে কলেজের দিকে অগ্রসর হলাম। এখন ফিরে গেলে মা একশো কথা জিজ্ঞেস করে আমার মাথাটাই খেয়ে ফেলবে। আমার হয়েছে যত জ্বালা!
#ছায়াবর্ণ
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ২

আমার সামনে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে রানি। আমি বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে আছি। ইচ্ছে করছে একে পচা পুকুরে চুবিয়ে মা’রি। তাকে আমি সেই গোমড়া মুখো খিটখিটে লোকটার কথা বললাম যে তার সাথে আমার দেখা হয়েছিল আর কি কি কথা হয়েছে তাও বললাম। তখন থেকে তার হাসি থামছেই না। হাসতে হাসতে আবার আমারই গায়ের ওপর গড়িয়ে পড়ছে। রানি হাসতে হাসতে বলল–

— ও ভাই! আমার হাসি থামছে না রে ছায়া। তুই সক্কাল সক্কাল ঝাড়ি খেলি? তাও আবার আমার ক্রাশের কাছে? ও মাই গড!

আমি রেগে বললাম–

— হাসি বন্ধ কর রানির বা’চ্চা। নইলে তোর চুল টেনে আমি ছিঁড়ে দিব বলে রাখলাম।

আমার কথা শুনে রানি ধীরে ধীরে হাসি থামিয়ে দিল। বুঝতে পেরেছে যে হাসি না থামালে আমি ওর চুল ছিড়বই ছিড়ব। রানি ভাবার ভঙ্গি করে বলল–

— আচ্ছা দোস্ত? সে কি তোদের বাড়িওয়ালার কোনো আত্মীয়?

আমি চোখ মুখ কুঁচকে বললাম–

— জানি না আমি। সে কি আমাকে বলেছে?

— যদি আত্মীয় হয় তাহলে তোর বাড়িওয়ালা আন্টির সাথে আমি ভাব জমাব বুঝলি? তারপর তাকে পটিয়ে ক্রাশের ঠিকানা নিব। তারপর তার মাকে পটিয়ে তার বউমা হয়ে যাব। আহা! আমার বুদ্ধিটা কেমন বল?

আমি অগ্নি দৃষ্টি দিয়ে বললাম–

— তুই কি কখনো শোধরাবি না? ছেলেরা লুইচ্চা হয় জানি। মেয়েরাও যে লুইচ্চা হয় তা তোকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না। তোর পায়ের একটু ধুলো দে মেরি মা!

রানি বেশ ভাব নিয়ে বলল–

— থাক থাক! এই রানি হাজারে এক বুঝলি? মেরে যেসা কই নেহি।

আমি হতাশ হলাম। এই মেয়ে জীবনে ভালো হবে না। এই লুইচ্চা কীভাবে আমার বেস্টু হলো আমি এখনো বুঝতে পারিনি। আশাহত হয়ে বললাম–

— তুই ভালো হবি না কখনও। শা’লা লুইচ্চা।

আমার কথা শুনে রানি দাঁত কেলিয়ে হাসে যেন আমি ওকে খুব ভালো কথা বলেছি। আর কিছু খাক বা না খাক ওর প্রতিদিন ক্রাশ খাওয়া লাগবেই লাগবে। এটা এক্কেবারে ফিক্সড্।

কানে ইয়ার ফোন গুজে গান শুনছিলাম। “ডুবে ডুবে ভালোবাসি” আহা! কি সুন্দর গান! ইশ্! কেউ যদি আমাকে এমন ডুবে ডুবে ভালোবাসত! কি ভালোটাই না হতো। হঠাৎ মনে হলো কেউ আমাকে দূর থেকে ডাকছে। কান থেকে ইয়ার ফোন খুলে সামনে তাকিয়ে দেখলাম মা জননী কোমর হাত দিয়ে আমার দিকে রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি শুকনো ঢোক গিললাম। মা কন্ঠে তেজ ঢেলে বললেন–

— তোকে কখন থেকে আমি ডাকছি ছায়া? কানে তো ইয়ার ফোন গুজে বসে আছিস। অকালে কানটা যাক। পরে কানে ব্যথা কানে ব্যথা বলে আমার মাথা খেতে আসিস!

একটু থেমে আবারও বললেন–

— এই লোকটাকে ও বলিহারি! মেয়ে যা বলবে সেই কথাতে উনি নাচবেন। মেয়ে বলল বাবা ফোন কিনে দাও, বাহ! পরদিন-ই তিনি নাচতে নাচতে ফোন কিনে নিয়ে এলেন। এর জন্যই পড়ালেখা সব গোল্লায় যাচ্ছে।

মা একবার শুরু হলে সহজে থামতে চায় না। আমি তার থামার সুযোগে বললাম–

— তুমি আমায় কেন ডাকছিলে মা?

— দেখেছ, আমি আসল কথাটাই ভুলে গেলাম। এই ছায়া! ছাদ থেকে কাপড় গুলো তুলে নিয়ে আয় তো। যা।

— মা আমি পারবো না। তুমি যাও।

— কথায় কথায় শুধু পারবো না আর পারবো না। এই তুই যাবি নাকি আমাকে খুন্তি নিয়ে আসতে হবে?

আমি দমে গেলাম। মা এমনিতেই ক্ষেপে আছে। আরও রেগে গেলে উপায় নেই। হেরে গিয়ে বললাম–

— থাক থাক তোমাকে আর কষ্ট করে আসতে হবে না। আমি যাচ্ছি। ভালো লাগে না ধুর।

রুম থেকে বের হওয়ার সময় ঠাস করে দরজা দিলাম। মাকে বুঝিয়ে দিলাম যে আমি রেগে গিয়েছি। মা পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন কিন্তু আমি পাত্তা না দিয়ে ছাদে চললাম। এই সিঁড়ি বেয়ে ওঠা আমার কষ্টের কাজ গুলোর মধ্যে একটা। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গেলে নিজেকে আশি বছরের বুড়ি মনে হয়। পা চলতেই চায় না। আমি ধীরে ধীরে পা টেনে ছাদে গেলাম। ছাদে এসেই আমার চোখ কপালে। মা যে বাৎসরিক কাচাকাচি করেছে সেটা আমি জানতাম না। হায় আল্লাহ! এতো গুলো কীভাবে নিয়ে যাবো? ইচ্ছে করছে ছাদ থেকে এক লাফ মারি। পরক্ষনেই ভাবলাম, পাঁচ তলা থেকে লাফ দিলে আমার হাড্ডিও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এক রাশ কষ্ট নিয়ে আমি এক এক করে জামা কাপড় তুলতে শুরু করলাম।
কাপড় তোলার এক পর্যায়ে আমার মুখ পর্যন্ত ঢেকে গেল। সামনে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। এক পা দুপা করে এগিয়ে যাচ্ছি। একবার পড়ে গেলে আমি নির্ঘাত পটল ডাঙায় চলে যাব। এগোতে এগোতে হঠাৎ দেওয়ালের সাথে মাথা ঠুকে গেল। উফ্ বলে উঠলাম। মনে হলো কেউ মুখের ওপর থেকে কাপড় সরিয়ে দিচ্ছে। কাপড় সরানো শেষে লোকটাকে দেখে আমার চোখ ছানাবড়া। এ তো দেখি খিটখিটে লোকটা! উনি আমাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে নিলেন। মুখটা বরাবরের মতো গম্ভীর। কন্ঠে বিরক্তি ঢেলে বললেন–

— এভাবে কেউ কাপড় তোলে? চোখ ঢাকা থাকলে পড়ে গিয়ে হাত পা ভাঙত। এসব বাচ্চা কাচ্চা একা একা ছাদে কে পাঠায়?

আমি রেগে গেলাম। উনি আবারও আমাকে বাচ্চা বলছেন। আমি ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললাম–

— দেখুন আমি মোটেও বাচ্চা নই। আমি কলেজে পড়ি। আমাকে বাচ্চা বলবেন না একদম।

উনি কন্ঠে বিরক্ত এনে বললেন–

— বাচ্চারা বলে যে তারা বাচ্চা না। যাও।

আমি বিড়বিড় করে বললাম–

— আমি বাচ্চা? আপনার বউ বাচ্চা হবে খিটখিটে লোক।

উনি ভ্রুটা আরো কুঁচকে বললেন–

— কিছু বললে?

আমি জোর পূর্বক হেসে বললাম–

— না তো কিছু বলিনি। আমি যাই হ্যাঁ?

যেতে গিয়েও থেমে গেলাম। পিছু ঘুরে বললাম–

— আচ্ছা আপনি বাড়িওয়ালা আন্টির কি হন? কোনো দূরসম্পর্কের আত্মীয়? আত্মীয়রা এতো ঘন ঘন আসা ভালো দেখায় না বুঝলেন? তাই একটু কম কম আসবেন। আমি তো আমার নানু বাড়িতেও আপনার মত এত বেশি যাওয়া আসা করি না।

উনি চোখ রাঙিয়ে তাকালেন। মুখ খুলতে নিবেন তার আগেই আমি কেটে পড়লাম। ওনার রাম ধমক খাওয়ার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই। ভালো কথা সবারই গায়ে লাগে। হুহ!

রাতে বাবা আসলেন। ফ্রেশ হয়ে খেতে বসেই হাক ছাড়লেন–

— ছায়া! এসো খেয়ে নাও।

এটা বাবার রোজকার নিয়ম। অন্য সময় না হলেও রাতে আমরা একসাথে খাই। বাবার আসতে যত দেরি হোক না কেন আমারা একসাথেই খাব। আমি বাবার ডাকে সুড়সুড় করে বেরিয়ে এলাম। মা বাবাকে খাবার বেড়ে দিচ্ছেন। আমি আহ্লাদে আটখানা হয়ে বাবার গলা ধরে ঝুলে পড়লাম। বাবা হাসলেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আদুরে গলায় বললেন–

— পড়ালেখা কেমন চলছে আম্মা?

বাবা আমাকে ভালোবেসে আম্মা বলে ডাকেন। শুনেছি দাদি আমার মতো দেখতে ছিলেন। আমার চাচ্চু আর ফুপি রাও আমাকে মা বলে ডাকে। আমি মুখ খোলার আগেই মা ফোড়ন কেটে বললেন–

— আর পড়ালেখা! কি একটা কিনে দিয়েছেন না? ফোন। এই ফোনেই ওর পড়ালেখা খাওয়া দাওয়া সব শেষ করে দিচ্ছে।

আমি মুখ গোমড়া করে ফেললাম। বাবা মাকে বললেন–

— ওভাবে বোলো না। আমার মেয়ে কত ভদ্র একটা মেয়ে। দেখলে না? এসএসসি তে কেমন ভালো ফলাফল করেছে? এইচএসসি তেও ভালো করবে। তাই না আম্মা?

আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম–

— হ্যাঁ বাবা।

— এখন খেয়ে নাও।

আমি বাবার পাশের চেয়ারে বসে পড়লাম। এই তিন জন নিয়েই আমাদের ছোট্ট হাসি খুশি পরিবার। বাবা একটা এনজিও তে চাকরি করেন এবং মা গৃহিণী। খেতে খেতে বাবা বললেন–

— কলেজ ভালো লাগছে তো? স্যার ম্যাডামরা কেমন?

— খুব ভালো বাবা। আমার টুকিটাকি বন্ধু হয়েছে। আর রানি তো আছেই।

বাবা আর কিছু বললেন না। খেয়ে উঠে গেলেন। আমি ধীরে ধীরে খাচ্ছি। মা এক ধমক দিয়ে বললেন–

— ছায়া! কত বছর লাগবে খেতে?

— খাচ্ছি তো মা।

— আচ্ছা বেশ! খেয়ে দেয়ে সব গুছিয়ে রাখবি। আমি গেলাম।

মা চলে গেলেন। আমি হা করে তাকিয়ে থাকলাম। সব সময়ই আমার সাথে এমনটা হয়। খেতে দেরি হবে আর মা চলে যাবে। পরে সব আমাকে গুছিয়ে রাখতে হবে। আমি যে কেন একটু দ্রুত খেতে পারি না? বিয়ের পর জামাইকে বলব আমাকে গালে তুলে খাইয়ে দিতে। বিয়ের আগে শর্ত দিয়ে রাখব যে আমাকে তিন বেলা গালে তুলে খাইয়ে দিতে হবে। তবেই আমি বিয়ে করব।
আহা! আমার কি বুদ্ধি! মাঝে মধ্যে নিজেকে নোবেল পুরস্কার দিতে ইচ্ছে করে।

চলবে..
{

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here