#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্ব_৩১
অরুণীর কপাল বেয়ে ঘামের সরু রেখা গাল ছুঁয়ে গড়িয়ে পড়ছে। হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। ভীত দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকাতে তাকাতে নিজেকে ধাতস্থ করার ব্যর্থ চেষ্টা করছে সে। হঠাৎ পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে চমকে লাফিয়ে উঠলো অরুণী। ভয় ভয় চোখে তাকালো পাশের মানুষটার দিকে। সৌহার্দ্য হঠাৎ করে অরুণীর পাশে বসায় চমকে গিয়েছিল সে। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো অরুণী। সৌহার্দ্য জহুরি দৃষ্টিতে পরখ করলো অরুণীর ভীত ও কম্পিত মুখটাকে। ছোট করে একটা শ্বাস ফেলে বললো,
“এখনো এই ভয়টা কাটেনি তোমার? অভ্যস্ত হতে পারছো না সার্জারীতে? এতো সময় কেন লাগছে তোমার?”
অরুণী টলমলে চোখে তাকালো। বললো,
“সব ভয় কে’টে যেত আমার! আমি সবটা নিজের চোখে দেখতে পারি, কিন্তু নিজের হাতে সার্জারী করার সাহস আমার নেই। তোমার মনে আছে, সৌহার্দ্য? আগে যখন আমি প্র্যাক্টিক্যালি সার্জারী দেখে ভয়ে কুঁকড়ে যেতাম, তখন তোমার বুকে মাথা রেখে শান্তি পেতাম। হয়তো জোর করে তোমায় জড়িয়ে ধরতাম! কিন্তু আমার একমাত্র ওষুধ তো এটাই ছিল!”
সৌহার্দ্য বিরক্ত হলো। চোয়াল শক্ত করে বললো,
“শাট আপ, অরুণী! তুমি সবসময়ই আমার কাছে আসতে চাইতে। আমি দূরে ঠেলে দিতাম। এখন এসব কথা টানছো কেন? তোমাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে এখানে এসে বসেছি। তুমি কি চাও যে, এখন তোমায় আমার লাইফের অপরিচিত মানুষদের তালিকায় ফেলে দেই?”
অরুণী বিমর্ষ ভঙ্গিতে তাকালো সৌহার্দ্যের দিকে। মুখ খুলে আর কিছু বললো না। সৌহার্দ্য অরুণীর দিকে দৃষ্টিপাত না করে বললো,
“সার্জারি জিনিসটাকে নরমালি নেওয়ার চেষ্টা করো। তুমি একজন ডক্টর! এখনও এসবে অভ্যস্ত হতে না পারলে এটা হাস্যকর। তোমার ব্যর্থতা।”
সৌহার্দ্য উঠে দাঁড়াতেই অরুণী বললো,
“নিজের চাঁদকে নিজের করে পেয়েই গেলে! মেয়েটা আসলেই ভাগ্য নিয়ে জন্মেছে। তোমাকে আমার থেকে কেড়েই নিলো অবশেষে।”
সৌহার্দ্য শক্ত কন্ঠে বললো,
“অরুণী, ভুলে যেও না ও তোমার বোন!”
“এমন বোনের চেয়ে শত্রুও অনেক ভালো। ওর ব্যাপারে তো তুমি জানতে না, সৌহার্দ্য! তাহলে তুমি আমার সাথে কেন নাটক করলে? কেন আমাকে ঠকালে? আমি তো তোমাকে সত্যি সত্যিই ভালোবেসেছি। বিশ্বাস করো, সৌহার্দ্য! আমার ভালোবাসায় বিন্দু মাত্র খাদ নেই।”
সৌহার্দ্য তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
“তোমার জীবনে করা পাপের শাস্তি এটা!”
৩৮.
ভেজা ঘাসের ওপর দিয়ে বেশ আনন্দ নিয়ে হাটছে মধু। আজ বেশ সকালে ক্লাস থাকায় তাড়াতাড়ি এসেছে তরী। বাসায় একা একা ভালো লাগবে না বলে মধুও চলে এসেছে ওর সাথে। তরীর ক্লাস এখনো শেষ হয়নি। মধু তাই একা একা-ই হাঁটছে।
“তোমাকে না নিষেধ করেছি একা একা থাকতে! আমার কথা শোনো না কেন, ল্যাভেন্ডার?”
মধু হোঁচট খেল। পড়তে পড়তে কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। প্রহর মিটমিট করে হেসে বললো,
“এখনও হুটহাট পড়ে যাওয়ার রোগটা গেল না? আমার কথা না শুনলে এমন-ই হবে!”
মধু মুখ ভেঙিয়ে বললো,
“তোমার কথা কেন শুনবো আমি? তুমি কি খুব ভালো মানুষ নাকি? খারাপ লোক একটা! আমি তো পড়েই যাচ্ছিলাম! একবার ধরতেও এলো না।”
“তুমি কী চাও? আমি এখন ক্যাম্পাসে সবার সামনে তোমার প্রতি প্রেম দেখাই! ছেলেমেয়েরা দেখে কী বলবে? ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে টিচার ও স্টুডেন্টের মধ্যে প্রকাশ্যে প্রেম’- দারুণ না ব্যাপারটা? তারপর এটা নিয়ে জানাজানি হবে আর সবশেষে তুমি আর আমি ভাইরাল। হাহ্!!”
মধু প্রহরের কথা শুনে শব্দ করে হেসে দিলো। প্রহর ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। মধু খিলখিল করে হাসতে হাসতে বললো,
“আইডিয়াটা খারাপ না। যা-ই বলো! হা হা হা!!”
প্রহর হাতে হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে বললো,
“আচ্ছা? তাহলে এসো! কাছে এসো! জড়িয়ে ধরি তোমায়। সবাই দেখুক আমাদের মাঝের প্রেম।”
“জড়িয়ে ধরায় প্রেম আছে নাকি? মানুষজন তেমন পাত্তা দিবে না। এটা তো নরমাল ব্যাপার! একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরতেই পারে!”
প্রহর অবাক হয়ে বললো,
“তাহলে?”
মধু অদ্ভুত ভঙ্গিতে হেসে বললো,
“কেন? চু*মু খাবা! তুমি জানো না? প্রেম প্রকাশের জন্য এর থেকে ভালো আর কোনো উপায় হয় না! হা হা হা!”
প্রহর চোখ কপালে তুলে তাকালো। মধু এখনো হাসছে প্রহরের দিকে তাকিয়ে। প্রহর চোখ বড়বড় করে বললো,
“আস্তাগফিরুল্লাহ্!! তুমি তো অনেক খারাপ! কী বলছো ভেবে দেখেছো একবার? মধু, আ’ম ওয়ার্নিং ইউ! এরকম মানসিক অত্যাচার করো না আমার ওপর। পরে সামলাতে কষ্ট হবে তোমার।”
প্রহর তড়িৎ গতিতে পা চালিয়ে স্থান ত্যাগ করলো। মধু ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হাসছে। প্রহরের সাথে মজা নিতে আজও অদ্ভুত তৃপ্তি পায় সে। এটার আর কোনো তুলনা-ই হয় না!
তরী ক্লাস থেকে বেরিয়ে হাতে থাকা ঘড়ির দিকে একবার নজর বুলিয়ে নিলো। মধুর ক্লাস শুরু হতে আরো এক ঘন্টার মতো সময় আছে। তরী তাই মধুর কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। ফোন বের করে মধুর নাম্বারে ডায়াল করতে নিতেই ওর কানে ভেসে এলো,
“হাই, অরিত্রী! কেমন আছো?”
হুট করে কারো মুখে নিজের নাম শুনে চমকে উঠলো তরী। সামনে তাকিয়ে দীপ্তের হাসি মুখ দেখে মনে মনে বিরক্ত হলো তরী। কিন্তু সেটা বুঝতে না দিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,
“ভালো। আপনি ভালো আছেন?”
“ছিলাম না। কিন্তু এখন আছি। আর তুমি আমাকে আপনি করে বলছো কেন? তুমি করে বললেই তো পারো!”
তরী মুখে কৃত্রিম হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,
“আমি অপরিচিত মানুষদের তুমি বলে সম্বোধন করি না। দুঃখিত!”
দীপ্ত অবাক হয়ে বললো,
“অপরিচিত? অরিত্রী, আমি এখনো তোমার অপরিচিত? আমাদের মধ্যে তো পরিচয় হলো-ই! যদিও তেমন ভাবে আমরা একে অপরকে চিনি না।”
তরী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
“শুনুন! আপনি বার বার আমার সাথে এভাবে অপ্রয়োজনে কথা বলার চেষ্টা করবেন না। আমার থেকে দূরে থাকবেন!”
“কেন? তুমি আমাকে ইগনোর করতে চাইছো কেন, অরিত্রী? আমার দেওয়া চিঠিটা দেখেছিলে? ঐটা নিয়ে ভেবো না। আমি তো জাস্ট….. ”
দীপ্ত আর কিছু বলতে পারলো না। কথা শেষ হওয়ার আগেই ওর গালে সশব্দে চড় একটা চড় পড়লো। দীপ্ত হতভম্ব হয়ে তরীর দিকে তাকিয়ে দেখলো, তরী অবাক হয়ে মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মানে তরী চড়টা দেয়নি। তরীর পাশে মধু দাঁড়িয়ে দীপ্তের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মধুকে দেখে দীপ্ত ভয়ে ঢোক গিললো। মধু দীপ্তের চোয়াল একহাতে চেপে ধরে বললো,
“তোর সাহস হয় কী করে ওকে ডিস্টার্ব করার? কী ভেবেছিলি? আমার থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে ওর মন জয়ের চেষ্টা চালাবি? গেটআপ পাল্টেছি, বস! ক্যারেক্টার না। হাত-পা আগের মতোই চলে এখনও!”
মধু দীপ্তকে ছেড়ে দিলো। দীপ্ত তড়িঘড়ি করে চলে যেতে নিলে মধু বললো,
“শোন! তরীর পেছনে ঘুরঘুর করে লাভ নেই। ও বিবাহিত, আমার ভাবী। তার মানে এই না যে, তুই অন্য মেয়েদের পেছনে ঘুরঘুর করবি। আরেক বার এরকম কিছু করতে দেখলে হাত-পা ভেঙে গলায় ঝুলিয়ে দেবো।”
দীপ্ত হাতাশার নিঃশ্বাস ফেলে চলে গেল। তরী মধুর দিকে তাকিয়ে বললো,
“এতো হাত চলে কেন তোর? আমি বুঝিয়ে কথা বলতাম ওর সাথে! ”
“হ্যাঁ দেখলাম তো! কত বুঝাচ্ছিলে তুমি! তোর কথা কানে নিতো এই ছেলে? এই ছেলে তোকে লাভ-লেটার দিয়েছে, সেটা আমি ভালো করেই জানি। এতো দূর ভেবে ফেলেছে, আর তুই বলছিস তুই বুঝালে ও বুঝতো? আজব পাবলিক মাইরি!”
মধু তরীর ওপর বিরক্ত হয়ে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলো। তরীও কোনো উপায় না পেয়ে মধু পিছে পিছে হাটা দিলো।
সারাদিন ক্যাম্পাসেই কাটলো তরীআর মধুর। সন্ধ্যার দিকে প্রহর জোর করে ওদের ডিনার করাতে দিয়ে গেল। সব কিছু স্বাভাবিক লাগলেও প্রহরের জহুরি নজর তরীর চোখ এড়ায়নি। প্রহর বারবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তরীকে পর্যবেক্ষণ করছে। হয়তো কিছু বোঝার চেষ্টা করছে, কিন্তু বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। তরী আনমনে হাসলো, মনে মনে রহস্যের হাসি দিয়ে ভাবলো,
“অরিত্রী সেহরীশ কখনো কাঁচা কাজ করে না, প্রহর সাহেব। সাক্ষ্য-প্রমাণহীন কাজ করতেই অভ্যস্ত সে। শুধু শুধু তার পেছনে লেগে সময় নষ্ট করছেন। তবুও মনের শান্তি-ই বড় শান্তি। সেজন্য যা খুশি করতে পারেন। তবে অরিত্রী আপনার ধরা-ছোয়ার বাইরে। সে তো র*ক্ত ঝরাবে-ই! র*ক্তের প্লাবন বইয়ে দেবে। আটকাতে পারবেন না আপনারা! কেউ আটকাতে পারবেন না।”
-চলবে……
[