#তীব্র_প্রেমের_নেশা (১৫)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
___________________
জ্ঞান ফিরার পর নিজেকে হসপিটালে দেখে বেশ অবাক-ই হলাম। আশে পাশে চোখ বুলাতেই হাতে চলতে থাকা স্যালাইনের দিকে নজর পড়ে। মস্তিষ্ক ফাঁকা। ধীরে ধীরে সবটা মনে পড়তেই আঁতকে উঠলাম। আমি তো পানিতে ছিলাম! দুর্ভাগ্যবশত সাতার না জানায় অনেকটাই পানি পেটে চলে গিয়েছিলো। আতঙ্কে, দমবন্ধ হয়ে কখন জ্ঞান হারিয়েছি মাথায় নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আশেপাশে তাকালাম। এরমধ্যেই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন একজন নার্স। আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে,
‘সেন্স ফিরেছে তবে! এখন কেমন লাগছে শরীর?’
আমি ধীর কন্ঠে বললাম, ‘জ্বি ভালো।’
নার্স এসে স্যালাইন চেক করে মুচকি হেঁসে বললেন, ‘আপনি কিন্তু ভাগ্যবতী বলতে হয় ম্যাম।’
আমি কথাটা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। হঠাৎ আমাকে ভাগ্যবতী বলতে হবে কেনো! উনি ঠোঁট দুটো আরো প্রসারিত করে বললেন, ‘আপনার হাজবেন্ড আপনার অবস্থা দেখে এতক্ষণ পুরো পাগল হয়ে গেছিলো। বাহিরেই বসে আছে এখনো।’
আমি কিছু বললাম না। চুপচাপ থাকলাম। জানি না কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা! আমি বার বার সত্য মিথ্যার মধ্যে ঝুলে থাকি। বুঝি না এরা সবাই আমাকে মনে করেটা কি! ফোঁস করে উঠলাম। নার্স আপুটি আবার বললেন,
‘তবে আপনাকে দেখে কিন্তু আমার সামান্যতম হিংসেও হয়েছে ম্যাম। এতো হ্যান্ডসাম, কেয়ারিং, লাভিং একটা হাজবেন্ড পেয়েছেন। ওয়াও!’
আপনাআপনি ভ্রু কুঁচকে গেলো। মেয়েটার চোখে স্পষ্ট মুগ্ধতা। রাগে গা জ্বলে উঠলো। কত বড় সাহস! আমার বরের দিকে নজর দিচ্ছে তাও আবার আমাকেই এসে বলতেছে! বলি এদের কি লজ্জা শরম কিছু নাই? ফোঁস করে উঠলেও কিছু বললাম না। আপাতত চুপ-ই থাকলাম। আমি তো অসুস্থ তাই না! কিছুক্ষণ পর নার্সটি বের হয়ে যায়। সাথে সাথে কেবিনে আসে তীব্র। চোখ মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই তার এই মুহুর্তে প্রতিক্রিয়া ঠিক কি! তীব্র চুপচাপ টুল টেনে বসে গম্ভীর কন্ঠে বললো,
‘সাতার না পারলে পুকুরে যাওয়ার কোনো দরকার ছিলো তোমার? পেট পুরে পানি খেয়েছো তো?’
উনার কথা শুনে নড়েচড়ে একটু কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করলাম। কোনো জবাব দিলাম না। আসলে উনি কেয়ার করলো নাকি ধমকালো আমি এটাই বুঝলাম না। উনি আমার নীরবতা দেখে কপালে ভাজ ফেললেন। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
‘মুখে কি এখনো পানি আছে যে জবান দিচ্ছো না!’
‘মুখে পানি কেনো থাকবে?’
‘তাহলে প্রশ্নের উত্তর দাও না কেনো? কষ্ট লাগে উত্তর দিতে!’
‘আপনি আমাকে ধমকাচ্ছেন কেনো? আমি না অসুস্থ! কোথায় একটু আদর করে, মিষ্টি করে কথা বলবেন তা না করে ধমকাচ্ছেন! এই আপনার ভালোবাসা? এই ছিলো আপনার মনে?’
আমার কথায় তীব্র রীতিমতো হা। চোখ পিটপিট করে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর আমার দিকে ঝুকে এসে কপাল, গাল চেক করে।আমি ভ্রু কিঞ্চিত কুঁচকে বললাম,
‘কি হয়ছে? এতো কাছে আসতেছেন কেন? এটা হসপিটাল তো। থাক আদর করতে বলছি বলে এখানেই করতে হবে এমন না বিষয়টা। বাড়ি গিয়ে করলেও চলবে।’
তীব্র সাথে সাথে গলা ফাটিয়ে নার্সকে ডাকে। উনার চেঁচানোতে আমি ভয়ে কেঁপে উঠেছি। এতো জোড়ে চেচানোর আওয়াজে কানে হাত দিতে গিয়ে হাাতে টান পড়ে স্যালাইনের সূচ দিয়ে রক্ত উঠে যায়। মৃদু আর্তনাদ করে হাতটা ঠিকমতো রাাখতেই নার্স ছুটে আসে। যেনো সে আমার জামাইয়ের ডাকের অপেক্ষাতেই ছিলো। আমি রাগী রাগী চোখে তাকালাম তার দিকে। নার্স ছুটে এসে বলে,
‘জ্বি! কিছু হয়েছে স্যার?’
‘আপনি ওকে ভালো করে দেখে ডক্টরকে ডাকুন তো। আমার মনে হয় পানি খেয়ে ওর মাথার তা’র নড়ে গেছে নয়তো ছি’ড়ে গেছে। ওকে কি পাবনা মেন্টালে নিতে হবে?’
উনার কথাতে নার্স কিছু বলার আগেই ফুঁসে উঠলাম আমি। চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম, ‘আপনি আমাকে ইনডিরেক্ট পা’গল বললেন! আপনার এতো বড় সাহস!’
‘আমি তোমাকে ইনডিরেক্ট না ডিরেক্টই পাগল বলছি। কারণ তুমি আসলেই পাগল।’
‘আপনার-ই বউ আমি। এতোই পাগল মনে হলে বিয়ে কেনো করেছেন?’
‘কারণ তখন জানতাম না তোমার মাথায় এতো বড় সমস্যা!’
আমি দ্বিগুণ রাগে ফুঁসে উঠলাম। কিন্তু কিছু বলার আগে নার্স থামিয়ে দেয়। কাচুমাচু করতে করতে বলে, ‘স্যার আপনি একটু বাহিরে যান। ম্যামকে এতো উত্তেজিত করবেন না।’
তীব্র একবার তীক্ষ্ণ চাহনী ছুড়ে চলে গেলেন। নার্স আমাকে শান্ত করলেন। স্যালাইনের আর একটু বাকি। তারপরই আমাকে বাসায় নিয়ে যাবে। মনে মনে পণ করে রেখেছি আজ উনাার পি’ন্ডি চ’টকে তারপর শান্ত হবো। আমাকে পাগল বলা! আমাকে! এই প্রানেশাকে! উনি যদি তাশজিদ শেখ তীব্র হন তাহলে আমি মিসেস তাশজিদ শেখ তীব্র। হুহ!
স্যালাইন শেষ হতেই তীব্র সব বিল পে করে আমাকে নিয়ে হসপিটাল থেকে বের হলেন। বাড়ির কেউ আসেনি নাকি! আমি আশে পাশে নজর বুলিয়ে ঠোঁট গোল করে বললাম,
‘একি! বাড়ির কেউ নেই কেনো? আমি না রোগী! আমাকে না সবাই দেখতে আসবে!’
তীব্র এবার কপালে ভাজ ফেলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। বললেন, ‘এই মেয়ে সত্যি সত্যি কি তোমার মাথা গেছে নাকি? এমন বাচ্চাদের মতো কথা বলছো কেন? কি সমস্যা?’
আমি ভেংচি কেটে বললাাম, ‘আপনার একটা বাচ্চা লাগবে বললেই পারেন আমাকে বাচ্চাদের সাথে তুলনা কেনো দিচ্ছেন!’
তীব্র চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে নিজের কপাল নিজে চাপড়ালেন। হাত ধরে টেনে গাড়িতে বসাতে বসাতে বললেন, ‘তুমি আজ আমাকে পাগল বানিয়ে তবে ক্ষ্যান্ত হবে দেখছি। চুপচাপ গাড়িতে বসো!’
‘কিন্তু বাড়ি থেকে কেউ এলো না?’
‘নাহ আসেনি। কারণ কেউ জানে না তুমি হসপিটালে। ধপাস করে পানিতে পড়ার পর আমিই তোমাকে তুলেছি। পানি খেয়ে পেট ভরিয়ে তো জ্ঞান হারিয়েছো। বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান তারওপর তোমার শরীর একদম ঠান্ডা হয়ে গেছিলো তাই ভয়ে আমিই হসপিটালে নিয়ে এসেছি। আসার সময় শুধু আব্বু, ছোট মামা আর দারওয়ান চাচা দেখেছিলো তাও ওদের মানিয়ে রেখে এসেছি৷ বলেছি আমাদের কেউ খুঁজলে যেনো বলে আমরা একটু বাহিরে আসছি।’
‘তাহলে আমার শাড়ি?’
‘ওটা ছোট মামা দিয়ে গেছে। ভেজা কাপড় তো বদলানো লাগবে তিনি দিয়ে গেছে আর পাল্টিয়েছে ওই নার্সটা।’
আমি মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললাম, ‘এই এই ভালো কথা! আপনি এই নার্সের সামনে ভিজা শার্টে আসছিলেন?’
ততক্ষণে গাড়ি ড্রাইভ করা শুরু করেছে তীব্র। নিজের কাজে মন দিয়েই বললো, ‘হ্যাঁ। কেনো?’
আমি ফুঁসে উঠলাম। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, ‘এজন্যই তো বলি মেয়েটা এতো প্রশংসা কেন করলো! নিজের এই হ*ট লুক না দেখাইলে চলছিলো না আপনার? বলি মাস্ক কিনার পয়সা নাই আপনার কাছে? এতো কি’প্টা কেন আপনি? এখন থেকে ঢিলাঢালা কাপড় আর সব সময় মাস্ক পড়ে ঘুরবেন।’
সাথে সাথেই গাড়ি থামিয়ে দিলেন তীব্র। ড্যাবড্যাব করে মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি ধমকে বললাম, ‘সমস্যা কি? গাড়ি থামিয়েছেন কেনো?’
তীব্র গোল গোল চোখ নিয়ে বলে, ‘তোমার ব্যাপার স্যাপার আমার ভালো লাগছে না প্রাণ। কি হয়ছে বলো তো! কি সব তো বলতেছোই সাথে আমাকে ধমকাচ্ছোও! তোমার নিশ্চয় মাথার তা’র দুয়েকটা ছি’ড়ে গেছে৷ আ’ম ড্যাম সিউর।’
আমি কিছু বলতে নিয়েও বললাম না। গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে ফিরে বসলাম। তীব্র গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললেন, ‘আমাকে যা বলতেছো বলো সমস্যা নাই কিন্তু বাড়ি গিয়ে উল্টা পাল্টা কিছু বলো না বা করোও না।’
আমি চট করে তার দিকে ফিরলাম। চকচকে চোখ নিয়ে বললাম, ‘ভালো কথা। ভাবছি বাড়ি গিয়ে শ্বাশুড়ি মা আর ননদিনীকে দারুন রকমের সারপ্রাইজড করবো।’
তীব্র একবার আমার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর আমি নিজের মতো বসে রাস্তা দেখতে দেখতে বাড়ি পৌছলাম। আমাদের দেখে দ্রুত ছুটে আসলেন ছোট মামা আর আঙ্কেল। চিন্তিত সুরে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘তুমি পুকুরে পড়লে কিভাবে মা? এখন শরীর ঠিক আছে তো?’
আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললাম। তীব্র আমাকে সাথে নিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই তিহা, মিলি কাছে এগিয়ে আসে। লিভিং রুমের সোফায় তানহা আর শোভা বসে ছিলো। তীব্র আমাকে নিয়ে সরাসরি রুমে যেতে চাইলেও আমি ব্যাগড়া দিলাম। কেনো যাবো রুমে! তিহা কাছে এগিয়ে এসে বলে,
‘ব্যাপার কি ভাইয়া ভাবী? তোমরা এতক্ষণ কোথায় ছিলে? আর ভাবি সেই যে বের হলে আর এতক্ষণ পর আসলে!’
আমি দাঁত বের করে বললাম, ‘আগে তো কখনো এখানে আসা হয়নি আর বিয়ের ঝামেলার জন্য বের হওয়াও হয়নি। কাল তোমার ভাইয়ের সাথে রাগ করেছিলাম। তাই আজ আমার রাগ ভাঙাতে ঘুরতে নিয়ে গেছিলো।’
মুখটা একটু লাজুক লাজুক করে আড়চোখে তানহার দিকে তাকাতেই দেখি খুব রেগে গেছে। ফর্সা চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। এবার তীব্রর দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি হা করে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। তিহা আর মিলি মিটমিট করে হেঁসে বললো,
‘বাহ বাহ। ভাইয়া! শুধু কি ভাবীকে নিয়ে ঘুরলেই হবে? আমাদেরও কিন্তু ঘুরতে নিয়ে যেতে হবে।’
‘আচ্ছা নিয়ে যাবো। প্রানেশা রুমে চলো!’
আমি ঠোঁট উল্টে মাথার আঁচল টেনে নিয়ে তীব্রর সাথে রুমের দিকে হাঁটা লাগালাম। পেছন থেকে শব্দ পেলাম কিছু ভাঙার। সাথে সাথেই চেপে ধরলাম তীব্রর হাত। তীব্র আর পিছু না ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে হাঁটতে থাকলেন। আমি ঠোঁট চেপে হাসলাম। আমার মন এর থেকেও জোড়ে ভেঙেছে আর তানহার তো কেবল কফির কাপটাই ভেঙেছে। ঠোঁট বাকালাম। রুমে আসতেই তীব্র বললো,
‘মিথ্যা বললে কেনো নিচে?’
‘আমার শখ হয়েছে বলেছি। আরো বলবো! আপনার কি?’
তীব্র আমার মাথায় ছোট্ট করে একটা গাট্টা মে’রে বললো, ‘রেস্ট নাও যাও!’
আমি চুপচাপ বিছানায় হেলান দিয়ে বসলাম। তীব্র বের হয়ে যেতে নিলে পিছন থেকে হুট করেই প্রশ্ন করলাম, ‘আপনি কি আমাকে ভালোবাসেন তীব্র?’
তীব্র থমকে দাঁড়ালেন। কয়েক পল সেভাবেই দাঁড়িয়ে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রইলেন। আমি সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। তীব্র কোনো জবাব না দিয়েই চলে গেলেন। আমি তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। ঠোটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো। উনি বাসে না আমাকে ভালো। বাসে না। সকল অভিনয়ের সমাপ্তি ঘটিয়ে মুখে হাত চেপে ডুকরে উঠলাম।
চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)