#কাঞ্চাসোনা_২
#পর্ব_১৪
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
সামিরের যখন দুইবছর তখন তার আব্বা মা/রা যায়।দুই বছরের ছোট ছেলে নিয়ে তার আম্মা উত্তাল সাগরে পড়ে।বাপের বাড়ি গিয়েও ঠাই পায় না।অগ্যতা আবার স্বামীর বাড়িই ফিরে আসে।ভাসুরদের সংসারে কামলা ক্ষেটে মা ছেলে পেটে ভাতে থেকেছে।সামির অবশ্য সুখেই ছিলো সারাদিন ছোটাছুটি করে রাতে মায়ের বুকে ঘুমাতো।এই সুখও তার কপালে বেশীদিন সইলো না প্রচন্ড জ্বরে তার মা তাকে ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমালো।সামির তখন বুঝে না মা কি।মাত্র পাঁচ বছরের বাচ্চা কি ই বা বুঝতে পারে।সামিরের বড়ো চাচা তাকে দায়িত্বে রাখলেন।খাইয়ে পড়িয়ে বড়ো করলেন।এমনে এমনে বড়ো করলেন না তার বিনিময়ে সামির বাড়ির সব কাজ করতো,রান্নার হাড়ি পাতিল,সবার থালা বাসন, ঘর ঝাড়ু,সবার কাপড় ধোয়া বাজার করা থেকে বাড়ির সব কাজকর্ম সামির করতো।এককথায় সবাই সামিরকে মানুষ মনেই করতো না।সামির ছিলো নিশ্চুপ,এই নিশ্চুপতার পিছনেও কারণ ছিলো আর তা হলো এতো কাজের পড়েও তারা সামিরকে পড়াচ্ছে।সামির মেট্রিক পরিক্ষা দেয়ার পরে তার চাচাকে বলে ঢাকায় চলে আসে।এখানে আসতেও নানা ঝামেলা পোহাতে হয়েছে সামির জোড় করে চলে এসেছে।অনেক কষ্ট করে সরকারি কলেজে চান্স পেয়েছে।
কলেজেই ধ্রুবর সাথে পরিচয় তারপর গাঢ় বন্ধুত্ব,যা এখনো অটুট আছে আর থাকবেও।ধ্রুব সামিরকে যতোটা পেরেছে সাপোর্ট দিয়েছে।কিন্তু সামির তার নিজের জীবন নিয়ে হাপিয়ে গেছে,এতো কষ্ট কেনো তার জীবনে?সে এবার
মুক্তি চায়,এই দুর্বিষহ জীবনের অবসান চায় কিন্তু কোথায় কি সেই মুক্তি তো মিলে না হাজার পড়েও একটা চাকরি যোগাড় হচ্ছে না।চাকরিটা হয়ে গেলেই তো অনেক সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।চাকরির কথা মনে হলেই সামিরের চোখে মিতুর আদুরে চেহারাটা ভেসে উঠে।সামির বালিশে চোখ বন্ধ করেই হাসে।হাসির চোটে চোখের কোন বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।তার রুমমেট আব্দুল্লাহ বললো,
“এমন হাসিস কেনো?”
সামির কিছু না বলে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে নেয়।আব্দুল্লাহ বললো,
“কেমনে হাসছে চোখের পানিও চলে আসছে?এতো সুখের খবর যে হাসতে হাসতে চোখে পানি চলে এসেছে।কি খবর বল।”
সামির আব্দুল্লাহর দিকে তাকিয়ে ভাবে,এটা কিসের পানি তোকে বুঝাবো কি করে?এই পানি যে এক ব্যর্থ মানুষের যে কিনা কিছুই পারে না,এক মায়াবী মেয়ের অন্তর জুড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা যার নেই।সেই মেয়ের ডাকে সারা দেওয়ার সাহস নেই।ইচ্ছেমতো তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিজেকে শান্ত করার কোনো রাস্তা নেই।সামিরের ঠোঁট কেঁপে যায়,চোখে আবারো পানি জমতে চায় কিন্তু আব্দুল্লাহ যে এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে।তার সামনে এমন ছেলেমানুষী করা যাবে না।মাথা নেড়ে বললো,
“কিছু না বাদ দে তো।”
আব্দুল্লাহর তাড়া ছিলো তাই সে উঠে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়।সামির মাথার উপরে সিলিঙের দিকে চোখ রাখে।তখনি পিঠের নিচে ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠে।ফোন সহ সামিরের পিঠ কেঁপে ওঠে।সামির চমকায় না সে জানে ফোনটা মিতুর।না দেখেই সে বুঝে,কিভাবে বুঝে সেটা তার জানা নেই।সে চোখজোড়া বন্ধ করে নেয়।পিঠের থেকেও দ্রুত গতিতে তার অন্তর কাঁপছে।ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে নিজের মনোবাসনা পুরণ করতে কিন্তু তার যে হাত বা বাধা।এতিম ছেলেদের কেউ মেয়ে দিতে চায় না আর পাত্র যদি হয় চালচুলোহীন বেকার তাহলে তো দরজা থেকেই তাড়িয়ে দেবে।সামির এসব ভাবতে ভাবতে আবার ফোনটা কেঁপে ওঠে।কেঁপে কেঁপে জানান দেয় হার না মানা এক কিশোরীর মনের সুপ্ত ইচ্ছা।সামির ফোনটা কানে ধরে।মিতু কোনো কথা বলেনা।সামিরও চুপচাপ।মিতু সামিরের থেকে বোধহয় কিছু কথা আশা করেছিলো কিন্তু সামিরের নিশ্চুপতা দেখে তার মনে হচ্ছে সামির কথা বলবে না।মিতুই বললো,
“কি করেন?”
সামির কাঠকাঠ গলায় বললো,
“রাতের বেলা মানুষ কি করে?”
এমনতর কথায় মিতু থমথম খেয়ে যায়।
“খাবার খেয়েছেন?”
“না।”
“কেনো?”
“ডায়েট করছি।”
“আপনি তো পার্ফেক্ট আছেন।”
“আর কিছু বলবে?না বললে রাখি।ঘুম পাচ্ছে।”
মিতু ঝটপট বললো,
“বিয়ে করবো।”
“আচ্ছা।”
মিতু খুশীতে ঝুমঝুম করে বললো,
“আপনি রাজি?”
“আমি কেনো রাজী হবো?”
“আপনাকেই তো বিয়ে করবো।”
“মাথা ঠিক আছে?কি বলো এই সব?”
“আপনাকে আর কতোভাবে বুঝাবো?”
সামির ঠোঁট কামড়ে ধরে।মেয়েটা এতো অবুজ কেনো?সামিরের নিঃশ্বাস দ্রুতগতিতে ছুটে।
“ফোন রাখো।”
মিতু আকুল গলায় বললো,
“ভালোবাসি তো।”
সামির ফোনটা কানে চেপে দম আটকে পড়ে থাকে।খুবই আস্তে ফিসফিস করে বললো,
“এতো জ্বালাইয়ো না মিতু আমি সইতে পারিনা।প্লিজ।পাগল হয়ে যাচ্ছি।”
ধ্রুবর হঠাৎ কেমন লাগলো।বুকে কেমন চিনচিন করে অসস্থি লাগলো,শরীর কেমন জ্বালাপোড়ায় ছেয়ে গেলো।ধ্রুব শোয়া থেকে উঠে পড়ে,দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে মনোয়ারার কাছে যায়।
“আম্মা সকাল কই?”
ধ্রুবর কথায় মনোয়ারা ভ্রুকুঁচকে বললো,
“তোর জন্য না চা নিয়ে গেলো।”
“আবার চলে এসেছে তো।”
“এখানে আসেনি।”
ধ্রুব দ্রুত পায়ে ড্রয়িংরুমে আসে।কি মনে করে শাহীনের রুমের দিকে যায়।তখনি কানে আসে সকালের মৃদু গোঙানির শব্দ।ধ্রুবর বুকের খাঁচা কেঁপে উঠে।শাহীন তখন সকালকে দরজার সাথে চেপে ধরে আছে।ধ্রুব আর মনোয়ারার সব কথাই সে আর সকালের কানে এসেছে তাইতো সকালের মুখে হাত দিয়ে চেপে ধরে রেখেছে।ধ্রুব মূহুর্তেই রেগে যায়।গলা কাঁপিয়ে শাহীন বলে ডেকে উঠে।দরজা ধাক্কিয়েও কোনো হেলদুল করতে পারেনা।ধ্রুবর চিৎকারে বাসার সবাই ছুটে আসে।তাকে পাগলের মতো শাহীনের দরজা ধাক্কাতে দেখে কারো বুঝতে কষ্ট হয়না কাহীনি কি।শাহীনের বাবা আনোয়ার মির্জা এগিয়ে এসে বললো,
“সে কি আবারো….!”
ধ্রুবর সারা শরীর রাগে থরথর করে কাঁপছে।আনোয়ার মির্জার দিকে তাকিয়ে বললো,
“সকালকে…!”
আনোয়ার মির্জা চেচিয়ে বললো,
“শাহীন সকালের সাথে খারাপ কিছু করার চেষ্টা করবেনা।”
ধ্রুবর শরীরে অসুরের শক্তি ভর করে।পা দিয়ে ধাক্কিয়ে,চেয়ার দিয়ে দরজা ভাঙতে চায়।শাহীন ধ্রুবর এমন কাজে কিছুটা ভরকে যায়,সেই সুযোগে সকাল শাহীনের হাতে কামড়ে ধরে শাহীন ছিটকে কিছুটা দূরে গেলে সকাল দরজার ছিটকিনিটা কিছুটা খুলতে সক্ষম হয়।শাহীন এসে আবারো সকালকে আটকাতে চায়।সে বুঝতে পারে ধ্রুব যেকোনো সময় দরজা ভেঙে ফেলবে তাই কেচি হাতে নেয়,এখনি সব চুল কেটে দেবে।সকাল দরজাটা একটু খুলে দেয়াতে ধ্রুব জোড়ে ধাক্কা দেয়াতে দরজার ছিটকিনির নাট-বল্টু সহ দরজা খুলে যায়।সকাল হাউমাউ করে কেদে উঠে।সকালের লম্বা বেনী শাহীনের হাতে আরেক হাতে কেচি।ধ্রুব এবার আর কাউকে পরোয়া করে না ইচ্ছামতো শাহীনকে মা/রে,এমন মা/র মা/রে যে শাহীনের শরীরে দাগ বসে যায়।কেউ বাধা দেয় না যেনো এমন কাজের এটাই শা/স্তি।ধ্রুব কিছু বলার আগে আনোয়ার মির্জা শাহীনকে থা/প্পড় দিতে দিতে দাত দিয়ে র/ক্ত বের করে ফেলে,তারপর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বাসা থেকে বের করে দেয়।তাছলিমা ফুপিয়ে কাঁদে।আনোয়ার মির্জা হুংকার ছেড়ে বললো,
“এই একদম শব্দ করবিনা।শব্দ করলে এই বদ/মাইশের সাথে তোকেও বের করে দেবো।”
সবাই এমন কাজে হতবাক।কারো মুখে কোনো শব্দ নেই।ধ্রুব সকালকে নিয়ে রুমে চলে যায়।সকাল তখনো তার লম্বা বেনী বুকে জড়িয়ে রেখেছে,আর কাঁদছে।ধ্রুব দরজা আটকে সকালকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে।সকাল ধ্রুবর বুকে মিশে যেতে চায়।ধ্রুব সকালকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে যেনো বুকে ডুকিয়ে নেবে।ফিসফিস করে বললো,
“এতো ভ/য় পেয়েছিলাম জান।মনে হচ্ছিলো কলিজাটা বেরিয়ে আসবে।”
“আমিও খুব ভ/য় পেয়েছিলাম।”
“এই যে বুকে নিয়েছি আর কোনো ভ/য় নেই।দেখি আর কেঁদোনা তো।”
সকাল কান্না থামায় কিন্তু ধ্রুবকে ছাড়ে না।এই বুকে এতো শান্তি কেনো?এই বুকে এসেই অশান্তি কেটে শান্তির দেখা মিলছে।সকাল ধ্রুবর বুকে মাথা রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।ধ্রুব সকালের মনোবাসনা বুঝে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ভাবে,সকালের বিপদ হয়েছিলো বলেই কি তখন তার শরীর এমন জ্বলছিলো?প্রিয় কারো বিপদ হলেই কি এমন লাগে?সবার এমন হয়?ধ্রুবর হলো তো।সকালকে বিছানায় বসিয়ে সে ফ্লোরে বসে সকালের হাত ধরে বললো,
“বড়ো আব্বু শাহীনকে তাড়িয়ে দিয়েছে,আর কেঁদোনা।”
সকাল চুল দেখিয়ে বললো,
“আমার চুল কাটতে চেয়েছিলো।এই চুল তো আপনার খুব পছন্দ।আমার নিজেকে পা/গল পা/গল লাগছিলো।”
খাটে বসা অবস্থায় সকালের চুল ফ্লোর ছুয়ে যায়।ধ্রুব চুল হাতে নিয়ে চুমু খায়।আসলেই তার চুলগুলো খুবই পছন্দ,এতোটা পছন্দ যে রাতে ঘুমালেও কাছে টেনে রাখে।ধ্রুব চুপচাপ সকালের কোলে মাথা রেখে সুয়ে পড়ে।সকাল আর ধ্রুবই জানে আজকে কতোবড় বিপদের হাত থেকে আল্লাহ তাদের রক্ষা করেছে।
চলবে……
সবাই লাইক কমেন্ট করবেন তাহলে আগামীকাল আরেক পর্ব পাবেন।