মোহ মেঘের আলাপন পর্ব -০৪

❝মোহ মেঘের আলাপন ❞
লেখিকা: “নূরজাহান আক্তার আলো”
[০৪]

আদিত্য ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে রুমের যাচ্ছে তাই অবস্থা। সে হতাশার শ্বাস ফেলে রুমের চারদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিলো। না এই মেয়ে কিচ্ছু ঠিকঠাক রাখে নি। তার রাগটা যেনো রুমের
জিনিসপত্রের উপরে উগড়ে দিয়েছে। মেঝেতে জামা-কাপড় ফেলা, বিছানার চাদর ময়লার ঝুড়িতে ঢুকিয়ে রাখা, বালিশ দুটো বেলকণির মেঝেতে, চিরুণীসহ পারফিউমের বোতল খাটের তলায়, সেন্টার টেবিলে একপার্ট স্যান্ডেল রাখা। পানি ভর্তি গ্লাসে কলম ডুবিয়ে রাখা। মোট কথা কোনোকিছুই ঠিক নেই। আদিত্যের রাগ সে এভাবে তুলছে বুঝতেও বাকি নেই।
রুমের অবস্থা দেখে আদিত্য মাথা মুছে রুম গুছিয়ে নিলো।
তার মতে পাগলের সঙ্গে বকার চেয়ে নিজের কাজটা নিজে করা উত্তম। তাছাড়া মেধাকে এখন কিছু বলা মানে বাসাসুদ্ধ সবাইকে জানাবে। ফলস্বরূপ কাজের কাজ কিছুই হবে না। উল্টে তাকেই মায়ের বকবকানি শুনতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতেই আদিত্য রুম গুছিয়ে নিচে গেল। ড্রয়িংরুমে আমান আর মেধা আইসক্রিম খাওয়া নিয়ে বাজি ধরেছে। আদিত্য একবার তাদের তাকিয়ে খেতে বসল। তার বাবাও বসেছেন নিজের বরাদ্দকৃত চেয়ারে। হাতে সংবাদপত্র। সারাদিন খুব ব্যস্ততায় সংবাদপত্রে নজর বুলাতে পারেন না তিনি। তাই এ সময় রাতের খাবার খেয়ে সংবাদপত্র পড়েন। আজ অফিস থেকে ফিরতে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। তাই খাবার বাড়তে বাড়তে সংবাদপত্রে দৃষ্টি বুলিয়ে নিচ্ছিলেন।তখন আদিত্যকে খেয়াল করে বললেন,

-”অফিসের ঝামেলা হয়েছে শুনলাম। কিছু ভাবলে শিহাবের
চৌধুরীর প্রস্তাবের ব্যাপারে?”

-”’উনার প্রস্তাব নিয়ে ভাবার কিছু নেই আমি ডিল ক্যান্সেল করে দিয়েছি।”

-”উনার মেয়ে মিমি সত্যিই রুপে, গুনে, মাশাল্লাহ। সময় তো আছেই আরেকবার নাহয় ভাবো। ”

-“হোক সে রুপে, গুনে, সম্পূর্ণা তবুও এত ভাবার ফুরসত আমার নেই।”

-”রেজাউলের কি অবস্থা? ফোন দিয়েছিল তোমাকে?”

-”মেধা আশেপাশে আছে এই ব্যাপারে কথা না বলি বাবা।সে যদি জানে আঙ্কেল চিকিৎসার জন্য বাইরে গেছে। তখন খুব ঝামেলা করবে তাকে সামলানো মুশকিলও হয়ে যেতে পারে।
আর আমিই ফোন দিয়েছিলাম হুম সব ঠিকঠাক আছে।”

-”কতদিন তার থেকে সত্যিটা লুকিয়ে রাখবে?একদিন না একদিন সে সব জানবেই, তখন?”

-”পরের কথা পরে বাবা।”

এসব নিয়ে কথা বলতে বলতে সীমা বেগম তরকারির নিয়ে আসলেন। বকে মেধা আর আমানকেও খেতে আসতে তাড়া দিলেন। ওরা দু’জনে আইসক্রিমের বাটি ফ্রিজে রেখে খেতে আসল। পাশাপাশি চেয়ারে বসে ফিসফিস করে কীসব বলে যাচ্ছে দু’জন। আদিত্য নিজের খাওয়াতে মগ্ন। তখন মেধা চট করে উঠে দাঁড়িয়ে আদিত্যের প্লেটে খাবার তুলে দিতে দিতে বলল,

-”আদিত্য ভাই আপনার মুখটা এত শুকনো লাগছে কেন?
খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো করছেন না? এটা ঠিক হচ্ছে না। দেখি দেখি আমি খাবার দিচ্ছি সবটা কিন্তু খেতেই হবে বলে দিচ্ছি। আজ কোনো বারণই শুনবো না আমি।”

একথা বলে মেধা ঝপপট আদিত্যের প্লেটে খাবার তুলে দিতে থাকল। আদিত্য তখনো ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। একসাথে এত খাবার খায় না আদিত্য আর রাতে তো নয়ই। মেধার কাজে বাকিদের চোখ চড়কগাছ। কিন্তু মেধার ঠোঁটের কোণের দুষ্টুমাখা মিষ্টি হাসি। সেটা কারো নজরে না পড়লেও আদিত্য ঠিকই ধরে ফেলেছে। তখন আদিত্য খুব সুন্দর করে বলল,

-”ধন্যবাদ, আমার প্রতি এত খেয়াল রাখার জন্য। তবে আর একটা উপকার করলে খুবই উপকৃত হতাম আমি।”

তখন মেধা আদিত্যের কথা শুনে গদগদ হয়ে বলল,

-”সমস্যা নেই ভাইয়া, কি করতে বলুন আমি করে দিচ্ছি।”

-”খাওয়ার আগে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খাওয়া দরকার আমার। কিন্তু ভুলে গেছি। এখন আবার মনে পড়ছে জরুরি ই-মেইল পাঠানো বাকি। তুমি এক কাজ করো খাবারটা আমার রুমে দিয়ে এসো।”

-”খাবার নষ্ট করার ধান্দা?”

-”তোমার চোখের সামনে সব খাবার ফিনিশ করবো আমি।”

-”আচ্ছা।”

একথা বলে আদিত্য উপরে চলে গেল। বাকিরা এখনো চোখ বড় বড় করেই তাকিয়ে আছে। উনারা ভেবেছিলেন আদিত্য রেগে যাবে নতুবা খাবার ছেড়ে উঠে যাবে। কিন্তু না উনাদের ধারণা মিথ্যা প্রমাণ করে আদিত্য উল্টো কাজটা করল।তবে
মেধার কপালে দুঃখ নাচছে তা নিশ্চিত। চতুর আদিত্য তাকে ফাঁসাতেই বোধহয় রুমে নিয়ে যাচ্ছে। আর বোকা মেধা চিন্তা না করেই চলে যাচ্ছে পিছু পিছু। আদিত্যের বাবা ও মা একে অপরের দিকে তাকাতাকি করে খাওয়াতে মন দিলেন।যেনো
কিছু বোঝেন নি তারা। ততক্ষণে মেধাও খাবার নিয়ে উপরে চলে গেছে। আমানও আর না খেয়ে চলে যেতে যেতে বলল, তার বিশ হাজার টাকা লাগবে। আগামীকাল বন্ধুদের সঙ্গে ট্যূরে যাবে। আদিত্যের বাবা- মা কেউই টু শব্দ করলেন না।
এখন কিছু বললেই আমান চেচামেচি শুরু করবে। আদিত্য বাসায় আছে এই ভুল করা যাবে না। তারপর উনারা নিশ্চুপ থেকেই খেয়ে রুমে চলে গেলেন। ওদিকে আদিত্যের রুমের বিছানায় বসে মেধা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। তার সামনে আদিত্য একটা স্কেল নিয়ে এসে বসেছে। দৌড় দিবে সেই পথও নেই, দরজাও বন্ধ। আদিত্যের কথা এত খাবার
সে একা খাবে না মেধাকেও খেতে হবে৷ অপশনও দিয়েছে, হয় মেধা তাকে খাইয়ে দিবে নয়তো আদিত্যের হাতে তাকে খেতে হবে। আদিত্যের দয়ার শরীর এজন্য তৃতীয় অপশনও রাখল, যদি কোনোটাতেই মেধা রাজি না হয় তবে স্কেল দিয়ে
মার খাবে যতক্ষণ না আদিত্যের মন ভরবে ততক্ষণ। এহেন প্রস্তাবে মেধা হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। মেধা তখন করুণ কন্ঠে বলল,

-”আমার ভীষণ শরীর খারাপ করছে আদিত্য ভাই।”

-”আমারো।”

-”তাহলে কাউকেই খেতে হবে না চলুন নিচে যাই?”

-”তুমি না বললে আমার মুখ শুকিয়ে গেছে এই খাবারগুলো খেতেই হবে। তাছাড়া খাবার নষ্ট করা কী ভালো?”

-”আমি মিথ্যে বলেছি আর কোনোদিনও বলবো না।”

-” উহুম তুমি ঠিকই বলেছো আমি শুকিয়ে গেছি। আসলে অভাবে আছি তাই আর কি।”

-”অভাবে আছেন? তাও আবার আপনি!”

-”মানুষ কী শুধু অর্থের অভাবেই হয়?”

একথা বলে আদিত্য মেধার মুখে খাবার তুলে দিলো। মেধা
আদিত্যের হাতে স্কেল দেখে ভদ্রভাবে মুখে খাবার নিয়ে বসে রইল। বাম হাতে স্কেল নাড়াচ্ছে আর হাসছে আদিত্য। তবে ওর হাসি ঠোঁটের কোণেই লুকায়িত। সে বুঝে গেছে মুক্ত শব্দ সবার জন্য প্রযোজ্য নয়। তার জলজ্যান্ত প্রমাণ মেধা। একে যত ছাড় দিয়ে রাখবে মেধা তত উড়তে থাকবে।এতে লাভের
লাভ কিছুই না। তখন মেধা খাবারটুকু গিলে আগ্রহভরা স্বরে
বলল,

-”আপনি সত্যি অভাবে আছেন আদিত্য ভাই?”

-”হুম, বিশ্বাস হচ্ছে না?”

-”আপনি শান্তভাবে কথা বলতে পারেন তাও আমার সঙ্গে
এটাই তো বিশ্বাস হচ্ছে না আমার।”

মেধার কথা শুনে আদিত্য মুচকি হাসল। এতে মেধা বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল। স্বপ্ন ভেবে হাতে চিমটি কেটে দেখল সব সত্যি। তবে আদিত্য কিসের অভাবে আছে জানতে তার মন ব্যাকুল হয়ে উঠল। অপ্রিয় মানুষটা অভাব সম্পর্কে জানতে চায় সে। অর্থের অভাব ছাড়া আর কিসের অভাবে ভুগছে আদিত্য? মূখ্য কথা আদিত্যের মতো ছেলের কাছে অভাবও আসে? এসব ভেবে ব্যতিব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করে ফেললো,

-”বললেন না তো কিসের অভাব আপনার?”

-“বললে কি হবে শুনি?”

-‘জানি না, ‘আমি শুনতে চাই আদিত্য ভাই।”

-”যদি না বলি?”

-”কেন বলবেন না শুনি?”

-”বললে সমাধান খুঁজে দিবে? ”

-”হুম, এবার বলুন আপনার কিসের অভাব?”

-”আমার বউয়ের অভাব। বউয়ের প্রয়োজন বোধ করলেই একটা ছেলে শুকিয়ে যায়। এখন যেমন আমি শুকিয়ে আমচুর হয়ে যাচ্ছি। ”

আদিত্য মজা করে বললেও মেধা সেটা মজা হিসেবে ধরলো না। বরং সে কঠিনভাবে জবাব দিলো,

-”আপনার এই রুপ আমি মানতে পারছি না আদিত্য ভাই।
আপনি কিছুতেই আদিত্য ভাই হতেই পারেন না। আমি যেই আদিত্যকে চিনি তার মুখে এমন ধরণের কথা মানায় না। সে
ভালোবাসতে জানে না আর না পারে কারো ভালোবাসাকে সন্মান করতে। আর ভালোবাসা ছাড়া একটা মেয়ে বউ হতে চায় না, কখনো না, কোনোদিনও না। আপনি শুকিয়ে শুঁটকি মাছ হয়ে গেলেও আপনার এই অভাবটা পূরণ করা হবে না। আপনি আগে ভালোবাসতে শিখুন, ভালোবাসার মর্ম বুঝুন, তারপর নাহয় বউয়ের প্রত্যাশা করবেন। সত্যি বলতে মনেও হয় আপনার দ্বারা এসব কখনো সম্ভব হবে। তারচেয়ে যেমন আছেন তেমনই থাকেন ভালোবাসতে গিয়ে ভালোবাসাকে আর অসন্মান করিয়েন না।”

-”ভালোবাসা শিখাবে আমায়? দায়িত্বটা নাহয় তুমিই নাও।”

-”প্রশ্নই আসে না।”

-”কেন?”

-”আমার ভালোবাসা অপাত্রে দান করার ইচ্ছে আমার নেই।”

একথা বলে উঠতে গেলে আদিত্য তার হাত ধরে ফেললো।
স্বজোরে একটানে তার দিকে ঘুরিয়ে চোখ চোখ রেখে অদ্ভুত স্বরে বলল,

-”আজ এই মুহূর্ত থেকেই শুধুমাত্র তোমার কাছে আমি এক অন্য আদিত্য। যে আদিত্যের আগমনের তোমার জন্য…..! তবে হ্যাঁ কথা দিচ্ছি, যতক্ষণ না নিজে এসে স্বীকার করবে তুমি ভুল, আমার প্রতি করা তোমার ধারণাও ভুল। ততক্ষণ অবধি না আমি তোমাকে চিনবো, জানবো, স্মরণে রাখা তো দূর। মেয়ে তুমি অনেক বলে ফেলেছো। এখন এই রুম থেকে বের হও নয়তো ধাক্কা দিয়ে বের করতে বাধ্য হবো।”

To be continue…….!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here