মোহ মেঘের আলাপন পর্ব -০৫

❝মোহ মেঘের আলাপন ❞
লেখিকা: “নূরজাহান আক্তার আলো”
[০৫]

-”এক্ষুণি রুম থেকে বের হও নয়তো ধাক্কা দিয়ে বের করতে বাধ্য হবো।”

-”অ’ স’ ভ্যে’র মতো ব্যবহার করছেন কেন আদিত্য ভাই? আর আমি তো মরে যাচ্ছি না আপনার রুমে থাকার জন্য।”

একথা শেষ করতে না করতেই আদিত্য মেধার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। রাগে তার মুখটা থমথম করছে। এই মেয়েটা যখন কথা বলে কথার লাগাম টানে না। উচিত ও অনুচিতের ধার ধারে না। এতদিন ছোট ভেবে কিছু না বললেও এখন সহ্য করা যাচ্ছে না। সদ্য কলেজের গন্ডিতে পা দিয়েছে সে।অথচ এমনভাবে কথা বলে যেনো ভালোবাসা নিয়ে পি এইচ ডি কমপ্লিট করে ফেলেছে। গতদিনে ভেবেছিল মেধার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলবে, সময় দিবে। কিন্তু না এই মেয়ে সমস্ত ধারণা বদলে দিয়েছে। সে পুনরায় প্রমাণ করেছে সে সোজা
চলার পথিক নয়। তাকে যত সোজাভাবে বোঝাতে যাবে সে ততই উল্টো বুঝে সমস্যা সৃষ্টি করবে।আদিত্য নিজেও বুঝে
গেছে এভাবে কাজ হবে না। মেধা তখনো গালে হাত দিয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। গালটা জ্বলে যাচ্ছে বোধহয় শরীরের সর্বশক্তি দিয়েই মেরেছে। তাছাড়া এতদিন কারণে অকারণে তর্ক করলে আদিত্য ধমক দিয়েছে অথচ আজ!
তাকে ছলছল নয়নে তাকিয়ে থাকতে দেখে আদিত্যের রাগ বেড়ে গেল। সে আরেকটা মারতে এগিয়ে গেলে, মেধা দু’পা পিছিয়ে গেল। অতঃপর ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে প্রস্থান করল। মেধা যাওয়ার পরপরই আদিত্য প্লেট রেখে বিছানায় শুয়ে পড়ল।তার মেজাজ ভীষণ খারাপ।অন্যরা কাজিনদের
সঙ্গে কত মজা করে, ঘুরতে যায়, কত কী আবদারও করে। অথচ এই মেয়ে….!

এসব ভেবে আদিত্য চোখের উপর একটা হাত রেখে ভাবতে লাগল দুই বছর আগের কথা। যে ঘটনার সূত্রপাত ধরে তার আর মেধার সম্পর্ক তিক্ত হয়েছে।সৌমি নামের একটা মেয়ে তাকে প্রচন্ড ভালোবাসতো। অনেকবার তাকে ভালোবাসার কথা নিজে এসেই বলেছে। কিন্তু যতবার প্রণয়ের দাবি নিয়ে এসেছে আদিত্য ততবারই ফিরিয়ে দিয়েছে। যদিও ফিরিয়ে দেওয়ার মূখ্য কারণও আছে। আর কারণ হচ্ছে সৌমি হিন্দু ধর্মের।
তাছাড়া আদিত্যের চাচা সারাফাত একই ভুল করে নিজের
প্রাণ হারিয়েছে। সারাফাত যাকে ভালোবাসতো তার বাসায় থেকে বলা হয়েছিল, সে নিজে গিয়ে প্রস্তাব দিলে মেয়েটির বাসা থেকে সবাই তাদের মেনে নিবে। সারাফাত সরল মনে সেখানে গিয়েছিলোও। তবে প্রাণ নিয়ে আর ফিরেনি। সেই মেয়েটিকেও দেখা তো দূর তারও আর সন্ধান পাওয়া যায় নি। সেই একই ভুল জেনে শুনে কীভাবে করতো সে। যদিও
সৌমি মুসলিম ধর্ম গ্রহনের প্রস্তাবও দিয়েছিল। এক কথায় সে আদিত্যের জন্য সব করতে রাজি ছিলো। কিন্তু আদিত্যই তাকে মেনে নিতে পারে নি। আর মানলেও তাদের পরিণতি সুখকর হতো না, হয়ও না। শেষবার যখন সৌমি তার সঙ্গে
দেখা করতে এসেছিল সেদিন তার পায়ে ধরে কেঁদেছিলোও।
বার বার বলেছিল তাকে গ্রহন করতে। কিন্তু সে বরাবরই ওর মন সায় না দিলে কিচ্ছু করে না। সেদিনও করে নি। নিরাবতা দেখে সৌমিই উত্তরটা বুঝে নিয়েছিল। তারপর সেখান থেকে ফিরার পথে অসতর্কতায় এক্সিডেন্টে পা হারায় সৌমি। সেই অবস্থায় দিন কাটতে থাকে তার। সৌমির মাসির ছেলে ওকে খুব ভালোবাসতো তবে কখনো সে বলার সাহস করতে পারে নি। আর সৌমির এই অবস্থা তার ভালোবাসা হারিয়েও যায় নি। পরে ছেলেটা নিজেই বাসায় জানায় আর দু পরিবারের সবাই মিলে তাদের বিয়েও ব্যবস্থা করে।আর সৌমির বিয়ের দিন আদিত্য বিনাদাওয়াতে সেখানে গিয়েছিল, দেখা করে, কথাও বলে এসেছিল। সিঁদুর পরানোর আগ মুহূর্তে সেখানে আদিত্যকে দেখে সৌমির ঠোঁটে ফুটেছিল মিষ্টি হাসি। মুখশ্রী জুড়ে ফুটে উঠছিল চাপা খুশি। যখন দেখল তার ধারণা ভুল
তখন সৌমি নিশ্চুপ হয়ে তার দিকে তাকিয়েছিল। আর তার সেই চাহনিতে ছিলো অসংখ্য অভিযোগ, অভিমান। সৌমির এমন চাহনি থেকে আদিত্য মুচকি হেসে বলেছিলো,

-”যা হয় ভালো জন্যই হয়। জীবনকে আর একবার সুযোগ দাও। স্বাগতকে ভালো রেখো আর নিজেও ভালো থেকো।”

-”আসলেই যা হয় তা ভালোর জন্যই হয় আদিত্য? পঙ্গু হয়ে আমার ভালোটা ঠিক কোথায় হলো বলো তো আমায়? মন প্রাণ দিয়ে ভালোবেসে হারানোর ব্যথায় প্রতিনিয়ত ছটফট করছি এতেও ভালো আছে? তোমাকে দেখে আমার হৃদয়ের ক্ষতটা দ্বিগুন হয়ে গেছে। আমার বেঁচে থাকাটাও ব্যর্থ মনে হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার বুঝছো তুমি? এখানে ভালো খুঁজে পাচ্ছো আদিত্য।অন্যের বোঝা হয়ে হুইলচেয়ারে বাকি জীবনটা পার করতে হবে তবুও বলবে যা হচ্ছে ভালো হচ্ছে। সেই ভালোটা আমি কেন দেখছি না, কেনই বা সেই ভালোতে
আমি সন্তুষ্টু হতে পারছি না?”

-” এর জবাব আমি নই ‘সময়’ দিবে।”

-”তুমি সত্যিই খুব পাষাণ আদিত্য। তোমার মন বলে কিছু নেই।’

-”মন আছে তবে নিজের আয়ত্তে নেই।”

-”মানে, ভালোবাসো কাউকে?”

-”হুম প্রচন্ড। তবে সে বুঝে না আমাকে, চায়ও না।”

-”যে তোমাকে চিরসখা করা সুযোগ পেয়েও অবহেলা করছে তার মতো বোকা বোধহয় এর পৃথিবীতে নেই। ”

-”অথচ সেই বোকা পাখিটাকেই আমি ভীষণ ভালোবাসি।”

-”যাকে ভালোবাসি তার মুখে অন্যকে ভালোবাসার কথা শোনাও যে এত কষ্ট আজ বুঝলাম।”

-”এখানে এসেছি এইটুকুই জানাতে যে তোমাকে কষ্ট দিয়েছে সে নিজেও ভালো নেই।তোমার মতোই পুড়ছে প্রণয় অনলে।
তার হৃদয়খানাও কারো না কারো জন্য ক্ষত-বিক্ষত। তার ভেতরাও র/ক্তা/ক্ত কারো কথার তীরে। এসব ভেবেই নাহয় স্বান্ত্বণা দিও নিজেকে।”

একথা বলে আদিত্য চলে এসেছিল। আর সৌমি লাজলজ্জা ভুলে হাউমাউ করে চিৎকার ওর নাম ধরে কেঁদেছিল। আর ওকে এভাবে কাঁদতে দেখে স্বাগত মনে মনে বলেছিলো,

-” এটাই হোক তোমার শেষ কান্না। আমি একবার নয় আরো বহুবার কাঁদাবো তোমায় তবে সেটা হবে অনাবিল সুখে।”

তারপর প্রায় একবছর পর সৌমির সঙ্গে দেখা হয়েছিল ওর।
লাল পেড়ে শাড়ি, সিঁথিভর্তি সিঁদুর আর শাখা পলা পরিহিত সৌমিকে অন্যরকম লাগছিলো দেখতে। তাকে দেখেই সৌমি মুখভর্তি হাসি নিয়ে কুশল বিনিময় করেছিলো। একরাশ সুখ তার দুয়ারে হানা দেওয়ার গল্পও শুনিয়েছিল। স্বাগতের সঙ্গে সে ভালো আছে, সুখেও আছে। তাকে ভালো থাকতে দেখে
ওর ভালো লাগছিল।আর এই ঘটনার শুরু মেধা জানলেও
শেষটা জানে না। তাই ভাবে আদিত্য কারো ভালোবাসাকে সন্মান করতে জানে না। আর যে ভালোবাসাকে সন্মান করে না সে ভালোবাসা পাওয়ারও যোগ্য না।এসব ভাবতে ভাবতে
আদিত্যের চোখজোড়া ঘুমে বুজে এসেছে। সে একরাশ মন নিয়েই তলিয়ে গেছে ঘুমরাজ্যে। পরেরদিন সকালে মেধা খুব সকালে ঘুম থেকে উঠল। রাতের কথা স্মরণ হতেই পুনরায় মন খারাপ হয়ে গেল ওর। প্রচন্ড কান্না করার ফলে চোখের পাতা ভারি হয়ে আছে। সে উঠে এক পা এক পা করে বাইরে এলো। তখন তার দৃষ্টি গেল বাগানে ফুটে থাকা গোলাপের দিকে। কী সুন্দর লাগছে ফুলগুলো! সে মন খারাপের হেতু ভুলে এগিয়ে গেল ফুলগুলো ছুঁয়ে দেখতে। আলতো স্পর্শে ছুঁয়ে দেখলও। তারপর কী মনে করে প্রতিটা গাছের গোড়ায়
পানি দিতে লাগল। তার জানামতে এই গাছগুলো আমানের আনা আর লাগিয়েছেও বোধহয় সেই’ই।ওই নিষ্ঠুর মানবের পক্ষে ফুল গাছ লাগানো সম্ভব না। ফুল হচ্ছে পবিত্র জিনিস যত্নে আগলে রেখে ভালোবাসার জিনিস। আর যার হৃদয়ে ভালোবাসার ছিঁটেফোঁটাও নেই সে আর কীভাবে কী…….! এসব ভাবতে ভাবতে মেধা সব গাছেপানি দিয়ে ভেতরে চলে গেল। আদিত্যের মা উঠে রান্নাঘরে রান্না করছে। মেধা সময় নিয়ে বাবার সঙ্গে কথা বলে কল কাটতেই ফোনটা হঠাৎ হাত থেকে পড়ে গেল। সে ফোন তুলে ঘুরতেই স্বজোরে এক ধাক্কা খেলো আদিত্যের সঙ্গে। আদিত্য তখন মাকে চেঁচিয়ে বলল,

-”আম্মু এই আপদ আর কতদিন এখানে থাকবে? আঙ্কেল সঙ্গে নিয়ে গেলেও পারতেন। শুধু শুধু আমাদের প্যারা দিতে অকারণে এখানে রেখে গেছে।”

ছেলের এ কথা শুনে আদিত্যের মা অবাক হয়ে মেধার দিকে
তাকালেন। মেধা নত মস্তকে মেঝের দিকেই তাকিয়ে আছে।
অপমানে তার গাল বেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে অজস্র নোনাজল। তখন উনি আদিত্যকে কিছু বলার আগেই আদিত্য বলল,

-” থাকছে ভালো কথা। ফ্রিতে থাকা খাওয়ার বদলে তোমার কাজে হাত লাগালেও তো পারে।”

-”আদিত্য মেয়েটাকে এভাবে বকছিস কেন? ওর বাবা এসব শুনলে কী ভাববে?”

-”যা ইচ্ছে হয় ভাবুক তাতে আমার কিছু যায় আসে না। তুমি বলে দাও এখানে থাকতে হলে কাজ করে খেতে হবে। নতুবা
ফিরে যাক তার বাসায়।”

আদিত্যের কথাশুনে মেধা সত্যি সত্যিই তার ব্যাগপ্যাক নিয়ে বেরিয়ে এলো। আদিত্য দেখেও না দেখার ভান করে ফোন
স্কল করছে। তাছাড়া আজ শুক্রবার, কোথাও যাওয়ার প্ল্যান তার নেই। মেধাকে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পুনরায় আদিত্যই বলল,

-”লজ্জা থাকলে এই বাসা আর মুখো আর হবে না। তোমাকে দেখলে আমার ঘৃণা লাগছে, যাও বের হও।”

(বি:দ্র: কেমন হচ্ছে গল্পটা কমেন্টে নিজের মতামত জানান)

To be continue……….!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here