#সুপ্ত_অনুরাগে
#প্রভা_আফরিন
[৬]
বড়ো বোনের আগমনের সুবাদে অপু আজ ভার্সিটি যায়নি। বাড়িতে সকাল থেকেই ভালোমন্দ রান্নার সুগন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তাই শিমুলও স্কুলে যাওয়ার নাম নেয়নি। বেলী সকাল সকাল মুখ ভার করে অপুর ঘরের খুটিনাটি জিনিসপত্র দেখে চলেছে। অপু স্বভাবে কিছুটা শৌখিন। নিজের বা পরিবারের জন্য সব সময় সেরাটাই তার হাতে ওঠে। এতে আনিসুল সাহেবের কোনো বাধা-নিষেধ নেই। উনার একমাত্র চাওয়া ছেলে-মেয়েরা মন দিয়ে পড়বে, আদবের সঙ্গে চলবে। কেউ যেন তাদের বিরুদ্ধে টু শব্দটিও উচ্চারণ করতে না পারে। বেলী, অপু কিংবা শিমুল তিনজনই ছোটোবেলা থেকে বাবাকে খুব বেশি মান্য করে। তাদের জীবনে বাবার কথাই শেষ সিদ্ধান্ত। তাই সন্তানদের নিয়ে আনিসুল সাহেবের গর্বও ছিল আকাশচুম্বী। তাদের ভবিষ্যত নিয়েও সদা চিন্তিত। প্রথম সন্তান হওয়ায় বেলীর উজ্জ্বল ভবিষ্যত নিয়ে অনেক বেশিই আকাঙ্ক্ষা ছিল আনিসুল সাহেবের। মাঝপথে মেয়েটা ভার্সিটিতে উঠে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে কিছুটা নিয়মের বাইরে চলে যায়। এরপর প্রেমের চক্করে পড়ে নাক-কান কাটিয়ে, বাবার উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে ধুলোয় লুটিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালালো। ছেলে-মেয়েদের নিয়ে গর্ব করে আসা আনিসুল সাহেব হুট করে সেই ধাক্কা সামলাতে না পারায় হসপিটালাইজড হয়েছিলেন। বেলীর সঙ্গে কথা বলাও বন্ধ করে দেন।
বেলী পারিবারিক গন্ডিকে পায়ের বেড়ি ভেবে বাইরের দুনিয়াকে একটু বেশিই রঙিন ভেবে ফেলেছিল। উথালপাথাল প্রেমে মজে আজিজের হাত ধরে পালানোর পর বাস্তবতা তার দোরগোড়ায় উপস্থিত হলো। আজিজের ভালোবাসায় কোনো কমতি ছিল না৷ এখনো নেই। তবে সারাজীবন আরাম-আয়েশে বড়ো হয়ে হুট করে একটি স্বল্প আয়ের পরিবারে মানিয়ে নেওয়া বেলীর মতো স্বপ্নে ভেসে বেড়ানো মেয়েরর জন্য কিছুটা কষ্টের বটে। বেলীর ভালোবাসায় বিরক্তি হানা দেয় খুব অনায়াসে। পরিবারের অমতে বিয়ে বিধায় আজিজের পরিবারও কিছুটা বিরূপ ছিল তার প্রতি। এদিকে নিজের ইচ্ছেয় বিয়ে করায় সে কারো কাছেই নিজের সুবিধা অসুবিধা নিয়ে কথা বলতে না পেরে আরো বদমেজাজি হয়ে ওঠে। বাবার বাড়িতে এলে পিঠোপিঠি বোনের শৌখিনতাও তার চোখে বিঁ’ধে।
জানালা গলে সকালের স্নিগ্ধতা খেলে বেড়াচ্ছে সম্পূর্ণ রুমে। অপু পড়ার টেবিলে বসে, চুলে কলম গুজে সকালের পড়াটায় চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলো। বেলীকে খুটুরমুটুর করতে দেখে বলল,
“কিছু খুঁজছো? আমাকে বলো, দিচ্ছি।”
“তোর জিনিস দেখতে অনুমতি লাগবে?” বেলী তেরছা করে জিজ্ঞেস করতেই অপু থতমত খেয়ে গেল। তড়িঘড়ি করে বলল,
“কি যে বলো! আমার তোমার আলাদা নাকি?”
বেলী সে কথায় শ্লেষের হাসি হাসল। ক্লজেটে ঝোলানো একটি অফ হোয়াইট রঙা সেমি লং গাউনে হাত বুলিয়ে বলল,
“আগে হলে তাই ভাবতাম। এই ড্রেসটা কবে কিনলি? কত পড়ল?”
অপুর মনোযোগ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। সে বই উলটে রেখে টেবিল ছাড়ল। দামের প্রসঙ্গে অবশ্য গেল না। পেছন থেকে বেলীকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে বলল,
“বিয়ের পর খুব জেদি হয়েছো আপু। ছোটোবেলা থেকেই যা তোমার তাই আমার ছিল। বিয়ে হয়েছে বলে নিয়ম বদলাতে হবে কেন?”
“তাহলে কী এখন স্বামীটাও তোর সঙ্গে ভাগাভাগি করব?”
অপু বড়ো বড়ো চোখে তাকাল। বেলীর কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে বিরক্তির সঙ্গে বলল,
“পান্তাভাতে ঘি কেন মেশাচ্ছো? আমি তো কথার কথা বলেছি। আমার জিনিসে আগেও তোমার অধিকার ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে।”
“কথার কথা ও বাস্তবতার পার্থক্যটা দেখালাম। সবকিছুতে যা তোর তাই আমার যুক্তিটা খাটে না।”
“এত রু-ডলি কথা বলছো কেন?”
“ছোটোবেলা থেকেই বাবার বাধ্যগত আদরের মেয়ে তুই। বাবার একচোখে যদি আমি আর শিমুল থাকি আরেক চোখে তুই একাই। মুখ ফুটে কিছু বলতেই তা সামনে পেয়ে যাস। আমার পরিস্থিতি বোঝার ক্ষমতা তোর কোনোদিন হবে না।”
বেলী হনহনিয়ে চলে গেল। অপু দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বিড়বিড় করে, “পরিস্থিতিটা তুমি নিজেই সৃষ্টি করেছো আপু। আমি কখনোই এমন পরিস্থিতিতে পড়তে চাই না। বুঝতেও চাই না।”
_____________
সুপ্তের মন দুপুর থেকেই কিছুটা বিক্ষিপ্ত ছিল। তার অপরাজিতা আজ ভার্সিটি যায়নি। এদিকে শিমুলও স্কুলে যায়নি। আর তা যে বড়ো বোনের আগমনে সেটাও সুপ্ত বুঝেছে। সে বিকেলে কিছুটা জলদিই ফরিদ মিয়ার দোকানে গিয়ে উপস্থিত হলো। দুইবার হর্ন বাজিয়ে বাইক থেকে নামল সে। ফরিদ মিয়া আজ আর তাকে দেখে গুল মাখানো দাঁত প্রদর্শন করল না। সুপ্ত বেঞ্চিতে বসে বলল,
“কী ব্যাপার ফরিদ মিয়া? মুখটা এমন কিসমিসের মতো চুপসে আছে কেন?”
ফরিদ অভিমানী গলায় বলল,
“আপনে কামডা ঠিক করেন নাই ভাইজান।”
“আবার আমি কী করলাম?” সুপ্ত ভ্রু কুচকালো।
“আপনের দেওয়া রঙিন পানি আমার জীবনের রঙ কাইড়া নিছে। সরল মনে আপনেরে বিশ্বাস করছিলাম। ওই বিস্বাদের বিস্বাদ রঙিন পানি ক্যান দিলেন আমারে? আদুরী মুহে দিয়াই আমারে গাইল্লাইতে শুরু করছে। আমার লগে বেরেকাপ কইরা দিছে।”
সুপ্ত ঠোঁট কা মড়ে হেসে ফেলল। দুহাত কাঁধ বরাবর তুলে বলল,
“আমার কোনো দায় নেই। তোমাকে আগেই টেস্ট করতে দিয়েছিলাম। এখন বুঝলে তো দেখতে ভালো হলেই স্বাদ ভালো হয় না। এই চা বানানো শিখবে?”
“জিন্দেগীতেও না। আমার গুড়ের চা-ই ভালা।”
সুপ্ত হেসে বলল,
“তারপর বলো, আমার বিড়ি ফাউন্ডেশন-এর সভাপতি আসে দোকানে?”
“তা আর কইতে? এক প্যাকেট একদিনেই শেষ কইরা দিছে।”
সুপ্ত কিঞ্চিত অবাক হলো। তাদের কথার মাঝেই আজিজের দেখা পাওয়া গেল। বোধহয় সিগারেট নিতেই এসেছিল। সুপ্তকে দেখে কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে গেল। সুপ্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তার উপস্থিতি গ্রহণ করল। আজিজ তার পাশে বসে ইতস্তত করে বলল,
“খুব বেশি বিল করে ফেলেছি? সমস্যা নেই আমি পরিশোধ করে দেব।”
সুপ্ত মানা করে বলল,
“না না ভাই। আপনি যত ইচ্ছে নেবেন, টাকার চিন্তা করবেন না। ভাববেন এটা আপনারই দোকান। ফরিদ মিয়া ভাড়ায় চালাচ্ছে।”
সুপ্ত আজিজের দিকে চা ও সিগারেট এগিয়ে দিয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
“কিন্তু ভাই, এত বেশি সিগারেট তো স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আমার ফাউন্ডেশন হওয়া অবধি তো সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হবে। কীসের এত ডিপ্রেশন আপনার?”
আজিজ গরম চায়ে ফু দিয়ে বলল,
“বিয়ে করেননি মনে হচ্ছে। করুন, তাহলেই বুঝবেন, বিয়ের চেয়ে বড়ো ডিপ্রেশন আর কিছুতে নেই।”
সুপ্ত এ বিষয়ে আর ঘাটালো না। ব্যক্তিগত সমস্যা ব্যক্তিগত থাকাই ভালো। সে মনে মনে হাসল। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল উলটোদিকের বিল্ডিংয়ের দিকে। নিঃশব্দে উচ্চারণ করল, “অথচ আমি ডিপ্রেশনে হলেও তাকেই চাই।”
পরপর দুবার পরিচিত হর্নের শব্দ কানে আসতেই অপু বুঝে গেছে কেউ এখন তার জানালার দিকে কড়া নজরে তাকিয়ে আছে। এই সময়টায় না চাইতেও অপুর কিছুটা সংকোচ, অস্বস্তি কাজ করে। বারবার ঘড়ি দেখে। সে অনেকবার চেষ্টা করেছে বিষয়টিকে সামান্যতম পাত্তা না দিতে। কিন্তু মানব মনের স্বভাবই হলো ভুলতে চাওয়া বিষয়টাকে আরো বেশি স্মরণ করিয়ে দেওয়া। বাইশ বসন্তের যৌবনে প্রথমবার এমন অবাধ্য কেউ এসেছে বলেই হয়তো অবচেতনে প্রভাব ফেলছে।
হুট করেই অপুর ফোনের ম্যাসেজ টোনটা বেজে উঠল। স্ক্রিনে আবারো সেই অপ্রত্যাশিত ভাবে প্রত্যাশিত নম্বরটা ভেসে উঠেছে। ফুটে উঠেছে ছোটো এক আবদার।
“ক্ষয়িষ্ণু দিনান্তের প্রান্ত ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা ক্লান্ত পথিকের তৃষ্ণা কি মিটবে না?”
অপু অনেকক্ষণ ম্যাসেজটির দিকে তাকিয়ে রইল। থম মে রে বসে রইল খাটের মাঝে। দিনের আলো যখন সম্পূর্ণ নিঃশেষিত হলো আবারো একটা ম্যাসেজ ইনবক্সে জমা হলো।
“আমি বারোমাস তোমায় ভালোবাসি
তুমি সুযোগ পাইলে বন্ধু বাসিও
আমি বারোমাস তোমার আশায় আছি
তুমি অবসর পাইলে আসিও।”
গানের লাইনটা পড়েই অপু ফিক করে হেসে ফেলল। শিমুলকে অবাক হয়ে তাকাতে দেখে সামলেও নিল দ্রুত। তখনই আবারো বাইকের হর্ন কানে এলো। অপু এবার জানালার কাছে গেল। লোকটা চলে গিয়েছে।
সুপ্ত বাড়িতে ফিরেও গানটা মাথা থেকে তাড়াতে পারল না। সে তাহেরী হুজুরের স্টাইলে গুনগুন করতে করতে সিড়ি বেয়ে উঠে গেল।
“পৌষ মাঘ কাটে না বুঝি এই শীতে
একটু কি পারো নাই কোনো খোঁজ নিতে
বৈশাখী ঝড় মনে শুধু জানিও
তুমি অবসর পাইলে আসিও।”
রফিক সাহেব বসার ঘরে উপস্থিত ছিলেন। ছেলের গানের লিরিক্স শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন। ফারিহাকে ডেকে বললেন,
“ছেলেটা এই বয়সে এসে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ফারিহা। বাড়িতে কী কী করে আমাকে ডিটেইলস বলবে এখন থেকে। নাতি সামলানোর বয়সে কিনা ছেলে সামলাতে হচ্ছে!”
________________
মেয়ে-জামাই আসার পর জাহেদা বেগমের ব্যস্ততা বেড়েছে। তাদের জন্য প্রতিবেলা ভালোমন্দ রান্না করতে করতে কাজুকে মনে পড়ে। বাপ-মা ম রা ছেলেটা কোথায় ঘুরছে, কী খাচ্ছে কে জানে? তাই সকাল সকাল অপুকে বললেন,
“ওই রা ক্ষসকে ফোন কর। বল চো’রের মতো লুকিয়ে না বেড়িয়ে বাড়িতে এসে খেয়ে যেতে।”
অপু ঠোঁট টিপে হাসে। সামনে থেকে দূরছাই করলেও মা যে মামার প্রতি মাত্রাতিরিক্ত দুর্বল তা সে ছোটোবেলা থেকেই অবগত। জাহেদা বেগম মেয়ের হাসির সামনে দাঁড়ালেন না। কাজের বাহানায় ছুটে গেলেন রান্নাঘরে। কাজুকে ফোন করা মাত্রই সে আলাদিনের চেরাগে ঘাপটি মেরে থাকা দৈত্যের মতো সঙ্গে সঙ্গে হাজির হলো বোনের বাড়ি। বাড়ির অবস্থা থমথমে দেখে বলে উঠল,
“কী ব্যাপার? এলাম উৎসবে সামিল হবে। এসে দেখি শ্রাদ্ধশান্তির অনুষ্ঠানের মতো চুপসে আছিস সব।”
শিমুল আস্তে করে বলল,
“বাবার জন্য।”
“কেন? ওই পেটমোটা লোকটা কী হাসির ওপর একশ চুয়াল্লিশ ধারা জারি করেছে নাকি?”
শিমুল বলল,
“তুমি জানো না বাবা বড়ো আপুকে দেখলে কারো সঙ্গে বেশি কথা বলে না। সেজন্য বাবা বাড়ি থাকলে সবাই কম কথা বলে।”
“এত ভয়ের কী আছে হ্যাঁ? ভয়কে জয় করতে না জানলে পুরুষ হতে পারবি ব্যাটা? ভয়কে ভাগাতে শেখ।”
“তুমি বাবাকে ভয় পাও না?”
কাজু উচ্চস্বরে হেসে উঠল,
“আমি! আর ভয়! তাও আবার তোর চান্দিছোলা বাপকে! হা হা! তোর বাপকে আমি একশ একবার…”
কথার মাঝেই দরজার সামনে অনাকাঙ্ক্ষিত একজোড়া পা দেখে কাজু থেমে গেল। চোখ তুলতেই আনিসুল সাহেবের থমথমে মুখটা নজরে এলো। কাজু ঘামতে শুরু করে। ঢোক গিলে, ফোকলা হেসে লাইনটা সম্পূর্ণ করে,
“হে হে একশ একবার সালাম করি। দুলাভাই সালামিটা দিন।”
চলবে…#সুপ্ত_অনুরাগে
#প্রভা_আফরিন
[৭]
আনিসুল সাহেব অফিস থেকে ফিরেছেন সবে। চশমা খুলে পাশের টেবিলে রেখে ক্লান্ত দেহটি চেয়ারে এলিয়ে দিলেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি ভীষণ স্ট্রি’ক্ট একজন মানুষ। ছোটোবেলা থেকে কঠোর পরিশ্রমে নিজেকে এ পর্যায়ে এনেছেন তিনি। আনিসুল সাহেব ছিলেন এক অজপাড়া গাঁয়ে বেড়ে ওঠা শিশু। ছোটো থাকতেই বাবা দ্বিতীয় করেন। সেই দুঃখে মা নানাবাড়ি গিয়ে উঠলেন। কিছুদিন পর মায়েরও নতুন সংসার হয়ে গেল। আর দুই জায়গাতেই তিনি হয়ে উঠলেন চরম অবহেলিত। মায়ে খেদানো বাপে তাড়ানো ছন্নছাড়া জীবনকে একাই টেনে তুলেছেন আনিসুল সাহেব। মাধ্যমিক দিয়ে চলে এলেন ঢাকা শহরে। উচ্চমাধ্যমিক থেকে শুরু করলেন টিউশনি, হোটেলবয়ের কাজ। ভার্সিটি লাইফ থেকেই গোল সেট করেছিলেন নিজেকে সম্মানিত আসনে দেখবেন। নামমাত্র ঘুম ও জাগ্রত স্বপ্ন চোখে তিনি ছুটে চলেছেন ভাগ্য বদলে। জীবনকে করে তুলেছেন দীপ্তিময়। এখন তিনি একজন সম্মানিত সরকারি চাকরিজীবী। যিনি দু’র্নী’তি দেখে চুপ থাকতে বাধ্য হলেও নিজের হাতে তা ঘটাননি। নিজের বিবেকের কাছে সর্বদাই স্বচ্চ একজন ব্যক্তি। যে অবহেলিত শৈশব, কৈশোর নিজে ভোগ করেছেন তা সন্তানদের জীবনে ঘুনাক্ষরেও আসতে দেননি। তবে জীবনযু-দ্ধের ময়দানে ল’ড়তে ল’ড়তে হাত দুখানি লৌহখন্ডে পরিনত হওয়ায় সহসা মায়া বিলি করতে পারেন না। রুক্ষ, শুষ্ক জিভে কোমলতা উঁকি দিতে পারে না। পারেন না একটু আদুরে বাক্যে সন্তানদের উৎফুল্ল করতে। সে জন্যই একটা অদৃশ্য ছায়া সর্বদাই উনার ও ছেলেমেয়েদের মাঝে পড়ে আছে। তবুও সন্তানদের নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন। হুট করেই বেলীর একটি কান্ড উনার বয়ে আনা সুনামকে এমন করে ঝাকি দিলো যে আনিসুল সাহেব সেটা হজম করতে পারলেন না।
আনিসুল সাহেব বাইরের কাপড় ছাড়েননি। আলসেমি আঁকড়ে বসে ছিলেন ইজি চেয়ারে। অপু দরজায় শব্দ তুলে ডাকল,
“আসব বাবা?”
আনিসুল সাহেব মাথা না তুলেই জবাব দিলেন,
“আয়।”
অপু পানির গ্লাস হাতে রুমে প্রবেশ করল। আনিসুল সাহেব এবার চোখ মেললেন। নিঃশব্দে পানি পান করে বললেন,
“তোর মা কোথায়?”
“রান্নাঘরে। রাতের রান্না করছে।”
আনিসুল সাহেব আলস্য ঝেড়ে গম্ভীর গলায় বললেন,
“এখন তো তিনি তিনবেলা মহা ভোজের আয়োজন করবেন৷ শিমুল কী করছে?”
“পড়তে বসিয়েছি।”
“ওর বাংলা বিষয়গুলোতে একটু নজর দিস। তবে তোর পড়ায় ডিস্টার্ব করে নয়। লাগলে টিচার রেখে দেব।”
“আমিই পারব। তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও।”
অপু চলে যাচ্ছিল। আনিসুল সাহেব আবার ডেকে জিজ্ঞেস করলেন,
“ওই মেয়ে কতদিন থাকবে বলেছে?”
অপুর মুখটা ভার হয়ে গেল। নিজের মেয়েকে কিনা ‘ওই মেয়ে’ বলে ডাকে!
“তোমারই মেয়ে বাবা। নিজেও জানতে চাইতে পারো।” সে খানিক সাহস নিয়ে বলল। বাবার থেকে উত্তর না পেয়ে আবার বলল,
“এভাবে মুখ ফিরিয়ে থেকে ইগোর কাছে জিতলেও ক্ষতিটা কিন্তু আমাদেরই হচ্ছে বাবা। সময় দিনগুলোকে প্রতিনিয়ত অতীতে ঠেলে দিচ্ছে। এই সময় আর ফিরে পাব না আমরা।”
আনিসুল সাহেব শুধু শক্ত গলায় বললেন,
“যাও, পড়তে বসো। মনে রেখো জীবনে যত চড়াই-উতরাই আসুক না কেন, সবের মাঝে নিজের পরিচয় বানাতে হবে। পাশে কেউ না থাকলেও যেন নিজেই নিজের অবলম্বন হয়ে উঠতে পারো।”
অপু নিঃশব্দে রুম ত্যাগ করে।
বেলীর এবার বাড়িতে আসার কারণটা প্রকাশ পেল ধীরে ধীরে। আজিজের চাকরিটা চলে গেছে। সীমিত আয়ের পরিবারের ওপর তারা দুজন এমনিতেই বোঝা হয়ে উঠেছিল। এর মাঝে টের পেল তার মাঝে নতুন একটি প্রাণের অস্তিত্ব। এরপর বেলী না পারতে স্বামীকে নিয়ে বাপের বাড়িতে এসে উঠেছে। করেছে ছোটো একটা আবদার। বাবার তো কত চেনাজানা রয়েছে। যদি তার স্বামীর একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারে। বেলীর প্রেগন্যান্সির সংবাদে জাহেদা বেগম খুশি হলেও জামাইয়ের চাকরি নেই শুনে কষ্ট পেলেন। জন্ম হতেই বড়ো মেয়েটার প্রতি জাহেদা বেগমের ভীষণ দুর্বলতা। কোনো আবদার অপূর্ণ রাখেননি। মায়ের আশকারায় বেলী কিছুটা জেদি স্বভাবের হয়ে ওঠে। এমনকি বেলীর পালিয়ে বিয়েটাও তিনিই আগে মেনে নিয়েছিলেন। প্রথম মাতৃত্ব একটু বেশিই উষ্ণ কিনা! অগোচরে মাঝে মাঝে টাকাও পাঠান বেলীর কাছে। অথচ এমন অবস্থায় কিনা তার মেয়েটা অভাবে দিন কা’টাচ্ছে! মেয়ের জন্য মায়ায় মনটা ভরে গেল জাহেদা বেগমের। তিনি ভাবলেন নানা হওয়ার সংবাদে হয়তো আনিসুল সাহেবের মনটা নরম হতে পারে। আজিজ ভালো ছেলে এ নিয়ে তো সন্দেহ নেই। যদি একটা ভালো চাকরি দিতে পারেন মেয়ের জীবনটা একটু গতিময় হবে।
রাতে খাবার টেবিলে একত্রিত হয়েছে সকলে। অপু ও শিমুল মাথা নুইয়ে একাধারে খেয়ে চলেছে। যেন খাবার ছাড়া এ মুহূর্তে তাদের আর কোনো দিকেই মনোযোগ নেই। বেলী ও আজিজকে আগেই খাইয়ে দিয়েছেন জাহেদা বেগম। তিনি দইয়ের বাটিটা এগিয়ে দিতেই আনিসুল সাহেব বললেন,
“আজ এতকিছু কেন?”
জাহেদা বেগম যেন জিজ্ঞাসার অপেক্ষাতেই ছিলেন। খুশি হয়ে বললেন,
“আমাদের বেলীটা মা হবে। আমরা নানা-নানু হতে চলেছি। ভাবতে পারছো?”
আনিসুল সাহেব খাওয়া থামিয়ে কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন। অপু আগে থেকেই অবগত বলে শুধু হাসল৷ বেলী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেখছিল বাবার প্রতিক্রিয়া কী হয়৷ তবে তাকে হতাশ করে আনিসুল সাহেব পুনরায় খেতে খেতে বললেন,
“না ভাবার কারণ নেই। পড়াশোনাটাও শেষ করল না। এবার ভরা সংসার সামলাক।”
বেলী করুণ দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। জাহেদা বেগম স্বামীর উৎসাহ না পেয়ে দমে গেলেন। ক্ষীণ স্বরে বললেন,
“আজিজ ছেলেটা তো ভালো, পরিশ্রমী। অন্তত মেয়ে আমাদের কোনো নে-শাখোর ধরে বিয়ে করেনি। সঠিক দিকনির্দেশনা পেলে আজিজও একটা ভালো পর্যায়ে উঠতে পারবে। এতে তো আমাদের মেয়েটাই সুখে থাকবে বলো?”
আনিসুল সাহেব স্থির কণ্ঠে বললেন,
“ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে কথা বলা আমার একদম পছন্দ না জাহেদা। যা বলার সরাসরি বলবে।”
“না মানে, আজিজের চাকরিটা চলে গেছে। ওকে যদি একটা ভালো চাকরি দিতে…”
“ওহহ আচ্ছা! তোমার মেয়ে বুঝি এই আবদার নিয়েই এসেছে এবার?”
আনিসুল সাহেবের কথায় তাচ্ছিল্য। জাহেদা বেগম ব্যথিত স্বরে বললেন,
“এটা তারও বাড়ি বেলীর বাবা। কোনো কারণ ছাড়াই আসতে পারে। তাছাড়া আমার মেয়ে কী তোমার মেয়ে না? আজিজের ভালো চাকরি হলে বেলীই ভালো থাকবে।”
“ধার করা যোগ্যতায় উন্নতি করায় কোনো গৌরব নেই। চেষ্টা করতে বলো। জীবনের সিদ্ধান্ত যেমন নিজেরা নিতে পেরেছে, বাকিটাও পারবে।”
বেলী ছলছল চোখে মায়ের দিকে তাকায়। তার লাল চোখে যতটা না বেদনার জল তার চেয়েও বেশি ছিল রা’গের আভা।
___________________
সকাল সকাল অপু ভার্সিটির জন্য তৈরি হয়ে নিল। আড়ং থেকে নতুন কেনা লেমন কালার একটি সালোয়ার কামিজের সঙ্গে হালকা একজোড়া কানের টপ পরেছে৷ চুলগুলো হালকা টুইস্টেড হয়ে পিঠের ওপর বিছিয়ে আছে। কি ভেবে যেন রেগুলার পারফিউম মিস্ট টা ছেড়ে আজ হঠাৎ মিস ডিওর-এর পারফিউমটা গায়ে ছোঁয়ালো। বেলী তাকে দেখে ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
“এত সেজেগুজে যাচ্ছিস যে? কোনো প্রোগ্রাম আছে?”
অপু আমতা আমতা করে বলল,
“সাজলাম কই? রেগুলার ভার্সিটি লুকেই যাচ্ছি।”
বেলীর বাঁকানো ভ্রু সে উত্তরে সোজা হলো না। অপু দ্রুত পায়ে বোনের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল।
ভার্সিটি গিয়ে যথারীতি পথের সম্মুখেই সেই ব্যক্তিটির দেখা পেল। এ যেন নিত্যদিনকার বিষয়। এক্সট্রা কোনো অবাকতা নেই। অপু আসবে, সুপ্ত তার আশেপাশেই উপস্থিত থাকবে এই যেন রোজকার রুটিন। অপু বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে চলে যেতে নিচ্ছিলো। সুপ্ত দ্রুত এগিয়ে তার পায়ে পা মেলাতে শুরু করল। বুকের বা পাশে হাত রেখে স্বস্তির শ্বাস নিয়ে বলল,
“ফাইনালি আমার আকাশে মেঘ সরে চাঁদ উঁকি দিয়েছে!”
অপু থেমে গেল। বুকে দুহাত গুজে, ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,
“আচ্ছা আপনার কি কোনো কাজ নেই?”
সুপ্ত ঠোঁট টিপে হেসে বলল,
“নিজের সম্পদ পাহারা দিচ্ছি। এরচেয়ে বড়ো কাজ আর আছে নাকি?”
অপু ত্যক্তবিরক্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। দাঁতে দাঁত চেপে চোয়াল শক্ত করে।
“এমন করে বলছেন যেন আমাকে লিখে নিয়েছেন?”
“উঁহু, একটু ভুল হলো। লিখে নেওয়া তো চুক্তি মাত্র। সম্পত্তি চুক্তির বিষয় আর সম্পদ অর্জনের। আমি অর্জন করতে জানি।”
“ওভার কনফিডেন্স!”
“উহুম, আমি নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে জ্ঞান রাখি। যেটা তুমি রাখো না।”
সুপ্তের মিষ্টি কথায় বারবার পরাস্ত হয়ে অপুর মুখটা লাল হয়ে উঠছিল। সুপ্ত তা বুঝতে পেরে মিটিমিটি হাসল। ইচ্ছে করল আদুরে গালটা টেনে দিতে। বুকের মাঝে লুকিয়ে নিতে। মেয়েটা কবে যে একটু সদয় হবে? সে আবার বলল,
“ঝিনুক বুকের মাঝে মুক্তা জমায়। আমিও মনের মাঝে ভালোবাসা জমাই। তার মুক্তা যদি মূল্যবান হয়, আমার ভালোবাসা অমূল্য। এতটুকু হিসেবও বোঝো না। অংকে কাঁচা ছিলে তাই না?”
অপুর নাকের পাটা ফুলে ওঠে। দু-হাত মুঠো করে ঝারা দিয়ে উচ্চারণ করে,
“অসহ্য!”
সুপ্ত কানের কাছে ঝুকে এসে ফিসফিস করে উচ্চারণ করে,
“সহ্য করতে শিখে নাও প্রিয়।”
এক মুহূর্ত থেমে লম্বা শ্বাস নিয়ে আবার বলল,
“বাই দ্যা ওয়ে, স্মেলস্ রিয়েলি নাইস! আই লাইক ইট!”
চলবে…