যেখানে পথচলা শুরু পর্ব -০৫

#যেখানে_পথচলা_শুরু |০৫|
#সাদিয়া_মেহরুজ

প্যারিসে গ্রীষ্ম আসে ভারী নিয়ম করে। এখানে হুট করেই রোদ উঠে যায় না। হুট করেই দেখা মিলেনা সূর্যের। তীব্র শীতের অধ্যায় শেষে উপসংহারে দেখা মেলে মিষ্টি রোদের। আচানক নয়, ধীরে ধীরে। সূর্য পুরোদমে উঠতেই প্যারিসে আরম্ভ হয় রৌদ্দুরের রাজ। তীরুর গ্রীষ্মকাল ভারী পছন্দ! বিশেষ করে তার প্যারিসে গ্রীষ্মকালের আগমনের ব্যাপারটা খুব চমৎকার লাগে। বহুদিন যাবৎ অপেক্ষায় ছিল সে এই গ্রীষ্মের। কিন্তু হায়! আজ সেই কাঙ্ক্ষিত দিন এলেও তীরুর সেদিকে কোনো ধ্যানই নেই! তীরু হাঁটছে, অবিরত কদম ফেলে। গার্ডেনে যেতে একটু সময় লাগে। লম্বা করিডর পেরিয়ে তবেই গার্ডেন। অবশ্য করিডরটাকেও ছোট খাটো গার্ডেন বলা হলে ভুল হবে না। তীরু হাঁটার গতি বাড়াল। কাছাকাছি আসতেই দেখল অদূরে এক সৌম্যপুরুষ বেঞ্চের ওপর একাকী বসে। ছেলেটার উল্টোপিঠ দেখা যাচ্ছে কেবল। লম্বা – চওড়া ছেলেটার গায়ের রঙ দেখে তীরু ধারণা করল, সেই ছেলেটিই অরোন!

-” হ্যালো। ” তীরুর জড়তাপূর্ণ কন্ঠ। তার দৃষ্টি এখন সামনে। তার কন্ঠ শুনতেই ছেলেটা উঠে দাঁড়াল। প্রথমবারের মতো ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। তীরু দেখল তাকে, নাহ্! তার সন্দেহ ভুল নয়। এটাই নিশ্চিত অরোন হবে। পুরো বাঙালি ছেলেদের মতো দেখতে। তীরু স্থির! তার চোখজোড়া অচঞ্চল। কি আশ্চর্য! ছেলেটা তাকাতেই সে এমন ফ্রীজ’ড হয়ে গেল কেন? ছেলেটা কি নিজের চাহনিতে তাকে সম্মোহন করে ফেলল নাকি!

-” তীরু রাইট? ” ভারী পুরুষালি গলা।

তীরু যন্ত্রের মতো মাথা নাড়াল। কিছু বলল না। কন্ঠ দিয়ে বেরুলো না শব্দগুচ্ছ। জট পাকিয়ে যাচ্ছে যে সবকিছু!

-” আসসালামু আলাইকুম। আমি অরোন। ” অরোন ক্ষীণ হেঁসে শুধাল।

তীরু তখনও নড়চড় বিহীন।উঁহু, লোকটার চেহারায় আহামরি কোনো সৌন্দর্য নেই। স্বাভাবিক আর পাঁচ জন বাঙালি ছেলের মতোই সাধারণ দেখতে। কিন্তু চোখ আর হাসিটা সম্পূর্ণ আলাদা! তীরুর গা কেমন শিরশিরিয়ে উঠে। ও নিজেকে সামলে জবাব দেয়,

-” ওয়ালাইকুম আসসালাম। ”

অরোন ধার ধার চোখে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,

-” চিনলেন কি করে? আপনার আম্মু তো আমায় বলেছিল আপনি আমাকে দেখেননি। ”

তীরুর অকপটে প্রতুত্তর করল,

-” বাঙালি ছেলেদের চিনতে অসুবিধা হওয়ার কথা কি? ”

-” তা অবশ্য। ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছেন কি? ”

তীরু চমকাল, ” ব্যাগ গোছাব কেন? ”

-” আন্টি আপনাকে বলেনি আজ আমি আপনাকে আমার সাথে নিয়ে যাব? আমার বাড়ি? উহ্ না আমাদের বাসায়? ”

তীরু ইতস্তত গলায় বলল,

-” একচুয়েলি সামনে আমার এক্সাম। এক্সামের সময়টাতে হোস্টেলে থাকলে ভালো হতো আর কি। সবার সাথে মিলেমিশে গ্রুপ স্ট্যাডি করা যেত। ”

অরোন চুপ রইল কিয়ৎক্ষণ। অতঃপর মন্থর কন্ঠে শুধাল,

-” আমার ফুপি এসেছিলেন লিয়োঁ থেকে আপনার সাথে দেখা করার জন্য। আপনি যদি এই সময় খুব বেশি ব্যাস্ত না হোন তবে কি একটু যেতে পারবেন? বেশি সময়ের জন্য না। জাস্ট একটু দেখা করেই চলে আসলেন নাহয়। ”

তীরু দ্রুত বলল, ” হ্যা এই টাইমটাতে মোটামুটি ফ্রী থাকি। চলুন যাওয়া যাক? ”

বলতেই তীরু থেমে গেল। পুনরায় আমতা আমতা করে শুধাল,

-” আচ্ছা না, একটু থাকুন হ্যা? আমি বরং ফ্রেশ হয়ে আসছি। মাদার বাহিরের মানুষদের কিছুতেই এলাউ করেন না ভেতরে যেতে। নাহলে আপনাকে অবশ্যই ভেতরে আসতে বললাম। ”

অরোন ছোট্ট করে জবাব দিল, ” ব্যাপার না আপনি যান। আমি ওয়েট করছি। ”

তীরু! ভীষণ শক্ত মনের, আবেগহীন হৃদয়ের অধিকারী মেয়ের নাম তীরু। যার মনে নেই কোনো আবেগের রাজত্ব, নেই কোনো অনুভূতি। ভালোবাসা যে কি জিনিস সে তা বোঝেই না! তবে তবে, নিয়ম কি বদলাতে চলেছে? সবসময় সবার চোখে চোখ রেখে টাস টাস করে কথা বলা তীরুর অরোনের চোখে তাকাতে এতো কেন জড়তা, অস্বস্তি? অরোন কথা বললেই কেন তার কন্ঠ শুনে পুরো গা কেঁপে উঠে? কি আশ্চর্যজনক ব্যাপার!
অরোন। ভারী মেপে মেপে কথা বলা মানুষ। মুখশ্রী জুড়ে তার নমনীয়তা, আলাদা এক শীতলতার রাজ রয়েছে। মুখোশ্রীতে নমনীয়তা থাকলেও কন্ঠস্বরটা কেমন ভারী ভারী। কানে লাগে! বুক দুরুদুরু করে কাপেঁ। আর, তীরুর ভীষণ পছন্দের চোখের দৃষ্টি? উহ্ হ্যা, আলাদা কিছু তো আছেই ছেলেটার চোখে। একদম আলাদা! অরোনের চোখটা যেন বিরাট এক সমুদ্র। সমুদ্রের মাঝে বিস্তার করা কালশিটে মনি। যেন দীঘির জলে ভেসে বেড়াচ্ছে এক শুভ্র শাপলা।

তীরু চটজলদি ফ্রেশ হয়ে তৈরি হয়ে নিল। নরমাল গেটআপ। নেভি ব্লু রঙয়ের জিন্সের সাথে সাদা রং এর কূর্তি। লম্বা চুলগুলো উঁচু করে ঝুটি করে ও ফোন হাতে তুলে ছুটল। ইতিমধ্যে দশ মিনিট লেট! লোকটা কি ভাবে কে জানে?
অরোন হাঁটছিল। পদচারণ কালীন তীরুকে দৌড়ে আসতে দেখে ভ্রু কুচকালঁ! এগিয়ে গিয়ে বলল,

-” আস্তে থামুন। ছুটছেন কেন? ”

তীরু তপ্তশ্বাস ফেলল, ” অনেক বেশি অপেক্ষা করিয়েছি আপনাকে, তাই না? ”

-” নাহ কে বলেছে? মাত্র পাঁচ – দশ মিনিট হয়েছে। আমি তো ধরে রেখেছিলাম আপনার কমপক্ষে বিশ কি পঁচিশ মিনিট লেট হবে। ”

-” এতোটা এক্সট্রা টাইম ধরে রাখার কারণ? ”

অরোন মৃদু হাসল, ” মেয়েদের নাকি তৈরি হতে লেট হয় একটু। তাই! আপা আসার সময় বলে দিল। ”

তীরু এ ব্যাপারে আর কথা বাড়াল না। অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল।

-” আপনার যে তিনবোন আছে তারা আপনার সাথে প্যারিসেই থাকেন? ”

অরোন ভরাট কন্ঠে জবাব দিল,

-” নাহ। ওরা বাংলাদেশেই থাকে। যার কথা বলেছি তিনি আমার ফুপাতো বোন হোন। ”

-” ওহ আচ্ছা। ”

কথা বলার কোনো টপিক না পেয়ে তীরু চুপ হয়ে গেল। অরোনও আর কথা বলল না। বলা বাহুল্য ইচ্ছে করেই যেন চুপ। তীরু কিছু বললে স্বল্প করে উত্তর দিয়ে নির্বাক রূপে ফিরে যাচ্ছে। তীরুর কেন যেন খারাপ লাগল খানিক, অরোন কি তাকে এড়িয়ে যেতে চাইছে?
মেট্রোতে উঠে দু’জন দু’প্রান্তে বসল। এক সাথে সিট না পাওয়ার দরুন একত্রে বসার সুযোগটা হলো না। তীরু দূর হাতে মাঝে মাঝেই অরোনের পানে দৃষ্টি ফেলছে। কেন যেন অরোনের প্রতি তাকাতে তার ভালো লাগছে। অথচ নি ষ্ঠু র ছেলেটাকে দেখো! একটি বারও তার দিকে তাকাল না? তীরুর তাতে অবশ্য বিশেষ কোনো হেলদোল নেই।

পৌঁছাতে লাগল বিশ মিনিট। দরজা দিয়ে প্রবেশ করতেই তীরুর মাথায় বৃষ্টির মতো ঝড়ঝড়িয়ে পড়ল গোলাপের পাপড়ি। তীরু চমকাল! তাকাল অরোনের পানে। অরোন কন্ঠের খাদ নামিয়ে বলল,

-” কিছু মনে করবেন না। আমার ভাই বোনদের পাগলামি ছিল এটা। ”

তীরু তৎক্ষনাৎ ব্যাতিব্যাস্ত হয়, ” আরে নাহ্ আশ্চর্য তো, কিছু মনে করতে যাবো কেন? আমি বরং দারুণ খুশি হয়েছি। ”

তীরুর কথা শেষ হতে না হতেই স্বমঃস্বরে চেঁচাল একঝাকঁ মানুষ।

-” ওয়েলকাম টু হোম ভাবী…”

সবাই ছুটে এলো। লহমায় ভাব জমিয়ে ফেলল তারা তীরুর সাথে। নিজেদের আদুরে কথা, স্নেহাশিষ আচরণে তীরুকে মুগ্ধ করে ফেলল! ক্ষীণ সময় বাদে সকলকে ঠেলে সম্মুখে এলেন মাঝবয়সী নারী যাকে ধরে ধরে আনছে অরোন। তিনি এসেই তীরুর গাল চেপে ধরে বললেন,

-” কি মিষ্টি বউরে মাশাআল্লাহ। আমার অরোনটা সাক্ষাৎ হিরে পাইছে। ”

তীরু বুঝল, ইনি অরোনের ফুপি। ও চটজলদি উঠে দাঁড়িয়ে নম্র গলায় সালাম দিল। অরোনের ফুপি সাহেদা সবাইকে রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে বললেন তীরুর সাথে একা কথা বলবে বলে! সকলে যেতেই সাহেদা তীরুর সাথে আলাপে মশগুল হলেন। কথার ফাঁকে হাতে ঔষধ নিয়ে উপস্থিত হলো অরোন। চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করল,

-” তুমি সকালের ঔষধ খাওনি কেন ফুপি? ”

সাহেদা হাসলেন। ” মনে থাকেনা তো বাবা। দে দেখি এখন খাই। ”

-” এমন অনিয়ম করলে কিভাবে হয় ফুপি? রো গ সাড়বে এমন অনিয়ম করলে? ”

সাহেদাকে ঔষধ খাইয়ে অরোন চলে গেল। যাওয়ার পূর্বে স্থিরচিত্তে বসে থাকা তীরুকে একঝলক দেখে তবেই বেরুলো রুম থেকে।

-” আমাদের পরিবারে ছেলে খুব কম হয়। খালি মেয়েই বেশি। দশ বছর অরোন একমাত্র ছেলে হয়। সবাই আদর করে লাটে উঠায় রাখতাম। কিন্তু ওর সুখ মনে হয় ওর ১৮ বছর পর্যন্তই কপালে লিখা ছিল। ভাবী যে ওদের চার ভাই বোনরে ফালায় রেখে চলে গেল তারপর থেকে অরোনের জীবনে ঝড় আসা শুরু করল। ছেলেটার স্বপ্ন ছিল ইন্জিনিয়ার হওয়া। সাইন্স নিয়ে এইচএসসিতে কতো ভালো যে রেজাল্ট করল কিন্তু সবকিছু তখন শেষ! একের পর এক বড় বড় দু র্ঘ ট না আসতে থাকল ওর জীবনে। সবকিছু সামলায় ও নিজের পরিবারের দেখভাল করত শান্ত থেকে, আমাদের সাথে হাসি মুখে কথা বলত কিন্তু ছেলেটার মনে যে কি আছে তা বুঝি। লাস্টেরবার যা হইলো তারপরও অরোনের এতোটা স্বাভাবিক আচরণ মেনে নেয়া যাচ্ছে না বউ। তুমি ওরে একটু দেখে রেখো। ”

তীরু মনোযোগ দিয়ে শুনছিল সাহেদার সব কথা। শেষের কথায় কৌতূহলী হলো ও। নিজেকে দমাতে না পেরে জিজ্ঞেস করল,

-” শেষেরবার কি হয়েছিল ফুপি? ”

-” ঐটা তোমারে অরোনই বলবেনে বউমা। ”

চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here