#একই_সুতোয়_বাঁধা
পর্ব-১
সপ্ত শীখা
পুষ্প দৌড়াচ্ছে রাস্তা ঘাট ভেঙ্গে। তার পিছে পিছে ছুটছে সায়ন। পুষ্পের হিহি হিহি হাসির শব্দে গ্রামের দুপুরকালীন নৈঃশব্দ কে ছারখার করে দিচ্ছে।
সায়ন ঝাঁপিয়ে পড়ে পুষ্পকে ধরতে গেল। পুষ্প এর জন্যেই জায়গামত দাঁড়িয়েছে। ছোট এক লাফে সরে গেল শুধু… আর সায়ন ঝপাং করে পুকুরের পানিতে। কিছুক্ষন ঝাপ্টাঝাপ্টির পর সায়ন কে দেখা গেল বুক পানি তে দাঁড়িয়ে হিহি করে কাঁপছে। শীতের দিনে পুকুরের পানি বরফ ঠান্ডা হয়ে থাকে। তার মাঝেই পড়েছে সায়ন। ঘাটে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে পুষ্প।
— আর আসবা আমার তেতুঁল নিতে ? হিহিহি… পানিত বইসা তেতুঁল খাও অখন।
— পুষ্প তুই আমারে পানিতে ফালাইলি কেন ?
— বেশ করছি ফালাইছি। আর আসবা তেতুঁল নিতে তো আরো ফালামু।
সায়ন শীতে কাপঁতে কাঁপতে পানি থেকে উঠে এল। ঘাটে বসে পুষ্প আরামসে তেতুঁল খাচ্ছে আর পা দুলাচ্ছে। সায়ন এসে ওর গালে জোরে এক চড় কষিয়ে বাড়ির দিকে চলে গেল।
💚💚💚💚💚
— ওকিরে ?? অ পুষ্প তোর গাল লাল হই রইসে কেন?
— পইড়া গিয়া ব্যথা পাইসি আম্মা। অখন ছাড়ো তো ঘুমামু আমি।
— এই বেয়ানবেলা ঘুম কিসের ?
— জানি না কিসের !! আমার পিছ লাইগো না তোমরা। একটু ঘুমামু কইছি এই ক্যান সেই ক্যান… যত্তসব !
পুষ্প নিজের বিছানায় শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুপিঁয়ে কাঁদতে লাগল। দাদি আর ও এই ঘরে থাকে। দাদি নামাজ পড়ে সালাম ফিরিয়ে নাতনি কে কাদঁতে দেখে পাশে এসে বসে মাথায় দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দিলেন।
— অ পুষ্প।
— ………
— অ দাদু উঠ ত!!
— ………
— কি অইছে ? সায়ন মাইর দিসে নাকি ?
— আমি আর কখনো ওর সাথে কথা কমু না। ওরে বইলা দিও দাদি।
— আইচ্ছা আইচ্ছা। আয় তোরে কিচ্ছা শুনাই…
— আমি পিচ্চি নাকি যে কিচ্ছা শুনমু। আচ্ছা কও।
কিচ্ছা কাহিনির দিকে অবশ্য মন নেই পুষ্পের। ওর ১১ বছরের মন আঘাত পেয়েছে সায়নের দেয়া থাপ্পড়ে। একটু পানিতে ফেলেছে বলে এমন করতে হয় ! হলই নাহয় বছর চারেকের বড় তাই বলে যখন খুশি চুল টানবে চড় দেবে ফরমাশ খাটাবে… পুষ্প ওর দাসীবাদিঁ নাকি ! আর যদি কথা বলেছে পুষ্প ওর সাথে ! একেই তো ওর সাথে খুনসুটির জন্য কম কথা শুনেনি পুষ্প মা চাচিদের থেকে। গ্রাম দেশের বাচ্চা মেয়েটাও এখানে ‘সেয়ানা’। সেখানে পুষ্প অবলীলায় পনেরো বছরের একটা ছেলের সাথে সারাদিন ঘুরে বেড়ায় তা নিয়ে কথা তো শুনবেই ! তবু সায়নের জন্যই পুষ্প সব বাধা অগ্রাহ্য করেছে। ও জানে একদিন ও না থাকলে সায়নের কি হবে। সায়ন কই যায় কি করে সব পুষ্পর নখদর্পণে।
💚💚💚💚💚
— তাই বইলা তুই পুষ্পরে থাপ্পর দিবি ? মাইয়াটা রাগ করছে না ? এজন্যই তো কই তিন দিন হয় আমরার চিংড়ি মাছের তিরিং বিরিং দেখিনা ক্যান।
— ভাল করছি থাপ্রাইছি। অ আমারে পানিতে ফেলল ক্যান এই শীতে ?
— তুই ওর পিছে তেতুঁলের লাগি দৌড়াইলি ক্যান? তোর বাড়িত তেতুঁল নাই ?
— আম্মা তুমিও পুষ্পের পক্ষ নিয়াই কথা কও। আমার আছেটা কে ?
সায়নের বাবা সাদেকুর রহমান জমির কাগজ দেখছিলেন। সাথে কান খাড়া ছিল মা ছেলের ছেলেমানুষি ঝগড়ায়। দুইদিন পরপরই এইই হয়। পুষ্প আর সায়ন মারামারি করে আসবে তারপর কদিনের মন কষাকষি। শেষে সায়নই পুষ্পের জানালার পাশে তেতুঁল নিয়ে দাঁড়ায়। অদ্ভুত এদের সম্পর্ক। সাদেকুর রহমান হাসলেন। ভিতরের ঘর থেকে তীব্র কাশির শব্দ আসছে। সাদেকুর রহমানের স্ত্রী লাইলি বেগম ভিতরে গেলেন। সাদেকুর রহমানের বৃদ্ধা মা… সায়নের দাদি বিছানায় শায়িত। বলা ভাল মৃত্যুশয্যায়। ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত বৃদ্ধা কিন্তু দাপট এখনো অপরিসীম। সাদেকুর রহমান পর্যন্ত মায়ের ভয়ে কাপেঁন।
— এই শুনেন
— কি ?
— আম্মায় আপনেরে ডাকে।
— কাশি বাড়ছে নি ?
— হু। মুখ চউখ লাল হয়া গেছে। শ্বাসটান ও উঠতাছে।
— কয় কি !
সাদেকুর রহমান দ্রুত মায়ের ঘরে গেলেন। প্রায় অন্ধকার ঘরটা জুড়ে একটা অদ্ভুত ভ্যাপসা গন্ধ বিরাজ করছে। মৃত্যুর গন্ধ মনে হচ্ছে সাদেকুর রহমানের। মায়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে মায়ের হাত টা ধরলেন।
বয়স ৬০ মত হবে বৃদ্ধার। কিন্তু এখনি গায়ের চামড়া ঝুলে নব্বই বছরের দেখায় তাকে। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে সেই যে শয্যা নিয়েছেন আর উঠতে পারেননি। সায়ন তার নয়নের মণি।
— আম্মা কষ্ট হইতেছে ?
— সাদেক… আমি বুঝতে পারতাছি আমার সময় শ্যাষ। কাইল রাতে আমার আম্মা আব্বা আর তর বড়খালা আইছিল।
— উনারা তো মারা গেছেন !
— হ… আমারে নিবার আইছিল।
সাদেকুর রহমানের শরীর কেঁপে উঠল। মৃত আত্মীয়রা নিতে আসে এমন একটা কথা চালু আছে লোকের মাঝে। মৃত্যুর আগে মৃত স্বজন রা ঘরে ভিড় জমায়।
— ও সাদেক
— বলেন আম্মা।
— আমার শ্যাষ ইচ্ছাটা…( কাশি )
— আম্মা পানি নেন। হু। বলেন।।
— শ্যাষ ইচ্ছাটা কই তোরে। বউরে ডাক।
— এই লাইলি। লাইলিইই ভিত্রে আসো তো !
— কি আম্মা ?
— বউ তোমারে খুব কষ্ট দিছি কিছু মনে রাইক্ষ না গো। আমার শেষ ইচ্ছাটা পূরণ কইরা দেও তোমরা যেন শান্তিতে মরতে পারি। বাপ তুই আমার কসম খা।
— আচ্ছা আম্মা। কসম আপনের।
— রহিমের মাইয়াটা যে… পুষ্প। হ্যার সাথে আমাগর স্যনের বিবাহের ব্যবস্তা কর।
— কি কন আম্মা ? পুষ্পরে এখন বিবাহ দিব না ! মাত্র ১১ বছর বয়স ওর !
— আমি এরচে কম বয়েসে বিয়া কইরা তোর আব্বার ঘর করিনাই ? আর আমি কইছিনি বিয়া কইরা ঘর করতে। বিয়া দিয়া থুইবি।
— আম্মা…
— আইজ বিকালের মাইঝে ব্যবস্থা করবি। আমি যেন দেইক্ষা যাইতে পারি। কসম কাটছস তুই।
— জি আম্মা।
বাইরে এসে ছাতাটা নিয়ে সাদেকুর রহমান বেরিয়ে পড়লেন। রোদ পড়ছে মাথার উপর।
💙💙💙💙💙
গোলাম রহিম সাদেকুর রহমানের কথা শুনে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন।
— সাদেক ভাই ইতা কি কন ? আমার মাইয়াটা এক্কেরে বাচ্চা। খেলাধুলা করে তাই বইলা বিবাহ ?
— আইচ্ছা রহিম ভাই আমার পোলা কি পাত্র হিসাবে খারাপ ? না আমরার জাত বংশ ভালা না ?
— আমি তো তা কইনাই সাদেক ভাই। আপনে আর কয়ডা বছর পর আইতেন… আমি আপনেরে মাথায় তুইল্লা নিতাম। কিন্তু এখন…
— তাইলে কয় বছর পরেই সব হইব। অখন খালি বিয়া পড়ায়া রাখমু। এমন ভাবে সব করামু যেন মাইয়া আর পোলা বুঝে না যে বিবাহ হইছে। পরে বালেগ হইলে মেয়ে ধুমধাম কইরা তুইল্লা নিমু। এম্নেও ইসলাম মতে এগর বিবাহের বয়স হইছে।
— সাদেক ভাই মেয়ের মা রাজি হইব না।
— রাজি করান। রহিম ভাই… আমার পোলার প্রস্তাব আইলে যে কেউ নাইচা উঠব। সেখানে আপনেরা এমন করেন। আমি ত বলতাছি কাকপক্ষীও টের পাইব না বিবাহ হইছে এগর। এমনকি এরা নিজেরাও বুঝব না কিছু।
— আমি ভিতরে যাইয়া একটু কথা বইলা আসি ভাই। আপনে চা মুখে দেন।
আধা ঘন্টা হয় সাদেকুর রহমান বিরস মুখে বসে আছেন। চা জুড়িয়ে ঠান্ডা হয়ে সর পড়েছে। সেই সরের উপর আবার কোত্থেকে এক মাছি এসে ডুব দিয়েছে।
— ভাই দেরি করাইলাম।
— কি কইলেন ভাবিসাব ?
— উনি রাজি ভাই। হেয় সায়নরে বড়ই ভালা পায়। আমার আম্মারে রাজি করতে দেরি লাগছে। শেষে খালাম্মা আর আম্মা যে সখি আছিল হেইকথা বইলা রাজি করাইলাম।
— আলহামদুলিল্লাহ ভাই। মিষ্টিমুখ করেন।