ছন্দহীন পদ্য
.
পর্ব_১৮
.
পদ্য কীভাবে হেঁটে বাড়ির উঠান অবধি এসেছে নিজেই যেন বুঝতে পারছে না। অনিকের করুণ অসহায় মুখটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। কত নিষ্ঠুরভাবে কথাগুলো বলে এসেছে পদ্য। এছাড়া আর কি করার ছিল? মানুষটার তো তাকে ভুলে থাকতে হবে। তাকে ছাড়াই বাঁচতে হবে। তাহলে মিছিমিছি আশা দিয়ে কি লাভ? এর চাইতে অনিক জানুক পদ্য এক হৃদয়হীন নিষ্ঠুর নারী। পদ্যের মন বলতে কিছু নেই। যেরকম অভিনয় করাটা দরকার সেরকমই করেছে পদ্য। নিজের এতটুকু দূর্বলতাও প্রকাশ করতে দেয়নি। ভুলে যাওয়ার জন্য সাহায্য করে এলো সে। এছাড়া আর কি করতে পারবে এই পাগলটার জন্য? কিন্তু এত কষ্ট হচ্ছে কেন? ভীষণ কান্না পাচ্ছে। মানবের মল-মূত্রের চাপ পেলে যেমন সেটাকে এড়িয়ে চলা যায় না, কান্নাও কি তেমন? মাঝে মাঝে কান্নাও কি এতটা জরুরি হয়ে পড়ে? পদ্যের বোধহয় তাই হলো। বারান্দায় পা দিয়েই কান্নায় ভেঙে পড়লো সে। কাঁদতে কাঁদতে দরজা লাগিয়ে নিজেকে টেনে নিয়ে গেল বিছানা অবধি। বালিশে মুখ গুঁজে দিল। আয়োজন করে কাঁদবে সে। এছাড়া আর কি আছে করার? আজ দুপুরে অনিকের ভয়েজ শুনে থমকে গিয়েছিল পৃথিবী। কতদিন পর অনিকটার কণ্ঠ শুনতে পেয়েছে। কত সুন্দর গম্ভীর পুরুষালি গলা। এই অনিককে সে কতটুকুই বা এড়িয়ে চলতে পারবে? কথা চালিয়ে যাওয়ার সাহস হয়নি তাই। পাছে অনিক যদি তার গোপন দূর্বলতা টের পেয়ে যায়? তখন তো তাকে ছাড়া থাকতে আরও কষ্ট হবে ওর। পদ্য কষ্ট দিতে চায় না অনিককে। তবুও রাস্তায় কত কষ্ট দিয়েই না এলো আজ। দুইটার দিকে মিরাজুল ইসলাম তাকে কল দিয়েছিলেন। সে সালাম দিল। উনি জবাব দিয়ে বললেন,
– ‘পদ্য মা, তুমি কি স্কুলে?’
– ‘হ্যাঁ চাচা।’
– ‘একটু বাইরে যাও তো মা, কিছু জরুরি কথা আছে।’
‘আচ্ছা চাচা’ বলে সে বাইরে এলো। তিনি বলতে শুরু করলেন,
– ‘একটা সমস্যা হয়ে গেল পদ্য৷ সকালে নাঈমের বউ কল দিয়ে বলেছিল অনিক একটু পাগলামি শুরু করেছে। ওরা কেউ তো তোমার বিষয় জানে না। আমি জিজ্ঞেস করে যা বুঝলাম অনিক তোমার বিয়ের ব্যাপারে জেনে এমন করছে, শুনছো মা?’
– ‘হ্যাঁ বলুন।’
– ‘তো একটু আগে অনিক কি করছে জানতে কল দিয়েছিলাম নাঈমের বউয়ের কাছে। বেকুবের মেয়ে প্রথমে বলছে ভালো আছে। তারপর আবার কি ভেবে কল দিয়ে বলছে, আব্বা আসলে অনিক ওর প্রেমিকার সাথে দেখা করতে গেছে। কল দিচ্ছি রিসিভ করে না। শরীরে একটু রাগই এলো আমার, কিন্তু কিছু বলি নাই৷ কারণ ও আসলে বোঝেনি গ্রামে আসছে অনিক৷ তাই বের হতে দিয়েছে।’
– ‘গ্রামে আসলে এখন আমি কি করবো চাচা?’
– ‘মা একবার ভাবো। তোমার বিয়ে ঠিক। অসুস্থ বাপ আছেন। বয়স হয়েছে। এখন এসব নিয়ে ঝামেলা হলে কেমন হবে তুমি বলো। আমি বলবো না।’
– ‘চাচা সে বাড়িতে এলে আবার বিদায় করে দিয়েন।’
– ‘এরকম জোর করে কিছু হয় না মা। আরও ঝামেলা হবে। গ্রামে পাগলামি করবে। মানুষ জানাজানি হবে। আমার মনে হয় কি। সে তোমার সাথে কথা বলতে আসবে। তুমি আবার শক্ত হয়ে কথা বললে কিছু করার থাকবে না। ওকে কড়াভাবে কথা বলে বিদায় করে দাও। আমি পারবো, কিন্তু তাতে লাভ হবে না। এক কাজ করবে তুমি। সে বাড়িতে আসলে ধরো তোমাদের ঘরে গেল। তাই না? তখন সে তার কথা বলতে শুরু করলে বলবে ‘এখানে কথা বললে আমার আব্বা আম্মা শুনবে, তোমাদের ছাদে যাও আমি আসছি’। সেখানে গিয়ে তার কথা তো শুনবে৷ শোনার পর বলবে তুমি তাকে পছন্দই করো না। আর সে এভাবে বিরক্ত করলে তোমার ব*দনাম হবে। মানে এমনভাবে কথা বলবে যাতে কোনো প্রশ্রয় না পেয়ে গ্রাম থেকে চলে যায়।’
– ‘আমি চেষ্টা করবো চাচা।’
– ‘শোনো মা, আমি আমার কথা বললাম। এছাড়া আর কোনো বুদ্ধি আমার মাথায় আসছে না। তোমার কোনো কথা থাকলে বলো।’
– ‘না চাচা, আপনার কথাই ঠিক। আমার কাছে এলে আমি সেভাবেই কথা বলবো।’
এরপর তিনি ফোন রেখে দিলেন। স্কুল থেকে ফেরার পথে পদ্য দূর থেকে দেখতে পায় তালগাছের নিচে অনিক দাঁড়িয়ে আছে। পরনে নেভি ব্লু গেঞ্জি। মাথাভর্তি এলোমেলো লম্বা চুল। মুখে দাড়ি-গোঁফ। কি সুন্দর ভঙ্গিতে পকেটে হাত পুরে দাঁড়িয়ে আছে মানুষটা৷ এভাবেই যুগের পর যুগ তাকিয়ে থেকে নয়ন ভরে দেখতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু এমন বিধ্বস্ত, ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেন ওকে? চোখ এত লাল কেন? পদ্যের কষ্ট লাগে। চোখ ফিরিয়ে নেয়। বোরখা-নেকাবে হয়তো অনিক তাকে চিনতে পারবে না। কিন্তু ঠিকই অনিক চিনে ফেলে পিছু থেকে ডাক দেয়। পদ্যের বুকের ভেতর ঝড় বয়ে যায়। উত্তাল সমুদ্রে টালমাটাল নৌকা যেমন মাঝিরা সামলে রাখে, পদ্যও দক্ষ মাঝির মতো নিজেকে সামলে নেয়। বুকে এক পৃথিবী সমান প্রণয় পুষে রেখে মুখে বি*ষাক্ত কথা বলার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়। তারপর? তারপর কি নিষ্ঠুরভাবেই না ছেলেটাকে অপমান করে এসেছে পদ্য। বারবার ওর অসহায় মুখটা চোখে ভেসে উঠে পদ্যকে ক্ষ*ত-বিক্ষ*ত করে দিচ্ছে। বালিশ বুকে জড়িয়ে ধরে পদ্য গগনবিদারী কান্নায় কাঁপিয়ে তুলে ঘর। মনিরা বেগম দরজায় এসে ডাকেন, ‘পদ্য কি হয়েছে মা? দরজা খুল। কাঁদছিস কেন?’
পদ্য জবাব দিতে পারে না৷ দেয়ার ইচ্ছাও নেই। নিজের কান্নাকে প্রশ্রয় দিতে ইচ্ছা করছে ভীষণ। মতিন মাস্টারও এবার দরজায় চাপড় দিতে দিতে বলেন, ‘পদ্য, কি হয়েছে? দরজা খুল। স্কুল থেকে এসেই কাঁদছিস কেন? রাস্তায় কেউ কিছু বলেছে?’
পদ্য নিজেকে খানিকটা সামলে বললো, ‘না আব্বা, আমার পেট ব্যথা করছে। তাই কাঁদছি।’
বাইরে থেকে মতিন মাস্টার পেট ব্য*থার কথা শুনে স্ত্রীকে বললেন, ‘হঠাৎ পেট ব্যথা করছে কেন? আমি গিয়ে তাহলে ডাক্তারকে নিয়ে আসি মনিরা।’
– ‘এতদূর এখন যাবে না-কি?’
– ‘এভাবে কাঁদছে মেয়েটা, না গিয়ে কি করবো? রাস্তায় গিয়ে দেখি না হয়, বাজারে যাওয়ার মতো কাউকে পেলে ডাক্তারকে পাঠাতে বলবো।’
– ‘পদ্যের মোবাইলে ডাক্তারের নাম্বার আছে তো মনে হয়।’
মতিন সাহেব আবার ডাকলেন, ‘মা ডাক্তারকে একটা কল দেই দরজা খুলো।’
পদ্য দরজা খুলে না। বারবার ডেকেও কাজ না হওয়ায় মতিন মাস্টার রাস্তায় বের হয়ে এলেন।
.
নাঈম অফিস থেকে ফিরে এসে দেখে আফরা প্রচণ্ড মন খারাপ করে বিছানায় বসে আছে। কখনও এরকম হয় না। আফরা জব ছাড়ার পর থেকে বাসায় পুরোটা দিন তারজন্য অস্থির হয়ে থাকে। কলিংবেল চাপলেই তাড়াতাড়ি গিয়ে সে নিজে দরজা খুলে দেয়। অথচ আজ ইভা গিয়ে খুলে দিয়েছে। অন্যদিন রুমে আসার পর জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে চোখবুজে থাকবে। সে বিরক্ত হয়ে প্রায়ই বলে, ‘অফিসের কাপড় তো খুলতে দাও আফরা।’
কিন্তু কাজ হয় না। ছাড়বেই না সে। পারলে উলটো ধমক দিয়ে বলবে, ‘স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে না থেকে পিঠের দিকে হাত নিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে পারো না? না-কি অফিসের সুন্দরী মেয়েদের দেখেই মন ভরে গেছে? আমাকে আর জড়িয়ে ধরতে মন চাইছে না, তাই না?’
সেই প্রাণচঞ্চল মেয়েটা আজ এভাবে চুপচাপ বিছানায় বসে থাকলে অবাকই হতে হয়। নাঈম কাপড় না পালটেই আফরার পাশে গিয়ে বসে বললো, ‘আমার মিষ্টি বউটার কি হয়েছে? মুখটা এত মলিন কেন?’
আফরা তবুও কোনো জবাব দিল না। নাঈম এবার ওর পাশে গিয়ে বসে থুতনি ধরে তার দিকে ফিরিয়ে বললো, ‘কি হয়েছে বলো।’
– ‘কী হয়েছে তা দিয়ে তোমার কি! সারাটা দিন আমার কীভাবে গেছে। তা শুধু আমি জানি। তোমাকে তো কল দিয়েও পাইনি।’
– ‘ও হ্যাঁ, তুমি একবার কল দিয়েছিলে। ব্যাক করবো ভেবেও পরে ভুলে গিয়েছিলাম। কি হয়েছে বলো তো।’
– ‘আমি নিজেই তো কিছু বুঝতে পারছি না, তোমাকে আর কী বলবো?’
– ‘কি বুঝতে পারছো না আগে বলো, শুনি।’
– ‘তুমি অফিসে যাওয়ার পর থেকে অনিক কেমন পাগলামি শুরু করেছে। তোমাকে কল দিয়ে পাইনি। বাড়িতে কল দিলাম। আব্বা বললেন ওকে দেখে রাখতে। তারপর জানো কি হয়েছে?’
– ‘কি?’
– ‘ও বাইরে চলে যায়। আমি গিয়ে দেখি ওইযে সেলুনের দোকান আছে না৷ ওখানে ফুটপাতের পাশে বসে বমি করছে।’
– ‘বলো কি? কেন এমন হলো? সে না অফিসের জন্য রেডি হয়েছিল।’
– ‘আরও অনেক কিছু ঘটেছে৷ ও কোন একটা মেয়েকে ভালোবাসে। মেয়েটার বিয়ে ঠিক হয়েছে তাই এমন করছে।’
– ‘তুমি কীভাবে জানলে?’
– ‘আমি বারবার জিজ্ঞেস করার পর ও নিজেই বলেছে। তুমি চিন্তা করো, ও বাথরুমে মাথায় পানি দিচ্ছে। বিছানায় শুয়ে সিগারেট খেয়ে অ্যাশ ফেলছে। সিগারেট চিবিয়ে খেয়ে রাস্তায় গিয়ে বমি করছে৷ ব্যাপারটা কি সিরিয়াস না?’
– ‘হ্যাঁ, অবশ্যই সিরিয়াস, কিন্তু অনিক কোনো মেয়ের জন্য এরকম করবে ভাবা যায় না৷ বিশ্বাস হচ্ছে না৷ সত্যি বলছো এসব? মেয়েটি কে? কোনোদিন তো শুনিনি।’
– ‘কে জানি না। তবে আব্বার কথাবার্তার কিছুই বুঝি না৷ ইভেন আমার অনেক সন্দেহ হচ্ছে। রাগও হচ্ছে।’
– ‘কীসের সন্দেহ?’
– ‘এই যে তুমি শুনলে। তুমি অবাক হচ্ছ না? অস্থির হচ্ছ না? কিন্তু তোমার আব্বা হননি। তাই মনে হয় সবকিছু জানেন উনি।’
– ‘কী জানেন?’
– ‘আরে বাবা ওর প্রেমের কথা আরকি। হয়তো জানেন। আর জেনে থাকলে এত হেলাফেলা করা ঠিক হচ্ছে না৷ মেজাজ খারাপ হচ্ছে আমার। আর মেয়েটাও কোন জমিদারের ঘরের বুঝলাম না। অনিককে সবকিছুতে ব্লক দিয়ে রাখছে। ইভেন আমার মোবাইল দিয়ে কল দিয়েছিল, জানো? কল কেটে দিয়ে এই নাম্বারও ব্লক করে দিয়েছে।’
– ‘বলো কী এসব! আমি তো কিছুই ভাবতে পারছি না। অনিক কোথায়?’
– ‘ওর রুমে।’
– ‘আমি তাহলে যাই।’
– ‘আরে না, আমিও যাচ্ছি না। উলটো বিরক্ত করলে বাসা থেকে বের হয়ে যাবে।’
– ‘তাহলে?’
– ‘তাহলে কি, সেইই বলুক। ওকে আমি বলেছিলাম যে মেয়েকে এত ভালোবাসো। তাকে বুঝিয়ে বলো। বিয়ে হয়ে গেলে তো আর কিছুই করার থাকবে না। সে গিয়েছিল৷ এসেই রুমের দরজা বন্ধ করে পড়ে আছে। আমি গিয়ে ডাকছি না। থাকুক।’
– ‘কি বলো, কথা বলা দরকার।’
– ‘তোমার যেতে হবে না৷ আমি যতদূর বুঝেছি তোমার আব্বা সব জানেন। উনি আমাকে কল দিয়ে বারবার খবর নিচ্ছেন। অনিক বাসায় এসেছে এবং দরজা বন্ধ করে রুমে আছে শুনে তিনি বলেছেন খেয়াল রাখতে শুধু। বাসার বাইরে যেন না যায়।’
– ‘বুঝলাম না, মেয়েটা কে? অনিক যদি এতই ভালোবাসে, তাহলে মেয়েটি তাকে ব্লক দিল কেন? তাকে পছন্দ না করার কি আছে?’
– ‘সেটাই তো বুঝলাম না৷ কোন জমিদারের মেয়ে। খুবই ভয় লাগছো জানো? আমার শরীর এখনও কাঁপছে। অনিকের অবস্থাটা আমি নিজের চোখে দেখেছি। ওই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে কোনো অঘটন ঘটে যাবে। আমি তোমার আব্বাকে বলেছিলাম অনিক ওই মেয়েটির সাথে দেখা করতে গেছে, তিনি রাগ করলেন যেতে দিয়েছি কেন তাই। আমি তারপর বললাম যেতে না দিলে তো সমস্যা আব্বা৷ এর চাইতে অনিক ওই মেয়েকে বুঝিয়ে বিয়ে ভেঙে দিলে ভালো। তখন উনি আমাকে ধমক দিয়ে কল কেটে দিলেন।’
– ‘তুমি এসব বলতে যাও কেন?’
– ‘ও আমি বলতে গেছি, এটা আমার দোষ হয়ে গেছে, তাই না? আমি নিজের চোখে দেখেছি অনিকের অবস্থা। তোমার ভাইকে বাঁচাতে হলে হেলাফেলা করে দেখো না বিষয়টা। ওই মেয়ের বিয়ে হলে ও পা*গল হয়ে যাবে৷ না হয় ম*রবে।’
– ‘কী যে বলো না তুমি। আমি যাই, ওর সঙ্গে কথা বলি।’
– ‘তুমি না, এরচেয়ে আমি যাই, গিয়ে জিজ্ঞেস করি ওই মেয়ের সঙ্গে দেখা হলো কি-না। কি কথা হয়েছে।’
– ‘আচ্ছা যাও তাহলে। আমি কাপড় পালটে নিই।’
আফরা রুম থেকে বের হয়ে এসে অনিকের দরজায় নক করতে গিয়েও করলো না। চা নিয়ে গেলে ভালো হবে। ছেলেটার ওপর দিয়ে অনেক ঝড় যাচ্ছে। কিচেনে গিয়ে চা বসিয়ে দিল। জ্বাল হয়ে যাবার পর চারটা কাপে চা ঢেলে ট্রে’তে করে নিয়ে ইভা এবং নাঈমকে দিয়ে আবার এলো অনিকের দরজার সামনে। কয়েকবার নক করতেই অনিক দরজা খুলে দিল। অন্ধকার রুম। সিগারেটের কটু গন্ধ। আফরা বাতি জ্বালিয়ে টেবিলে ট্রে রেখে একটা কাপ অনিকের হাতে দিয়ে সেও চেয়ারে বসলো।
– ‘ক্ষিধে লেগেছে অনিক? আর কিছু কি দেবো?’
অনিক চা হাতে নিয়ে বিছানায় বসে বললো, ‘না, লাগবে না।’
– ‘অন্ধকারে বসে না থেকে বাতি জ্বালিয়ে রাখবে। অন্ধকারে মন আরও খাবাপ হয়।’
অনিক কোনো জবাব না দিয়ে চায়ে চুমুক দিল। আফরা পুনরায় বললো, ‘তা কিছু বললে না যে, মেয়েটির সাথে দেখা হয়েছে?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘বলেছিলে বুঝিয়ে?’
– ‘না, উলটো কতকিছু নিজে বুঝে এলাম।’
– ‘কি বলো বুঝিনি। মেয়েটা কি বিয়ে ভেঙে দেবে?’
– ‘না।’
আফরা খানিকক্ষণ চেয়ে রইল। তারপর চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, ‘তাহলে আর কি করার বলো তো? মেয়েটাই তো তোমাকে ভালোবাসে না।’
অনিক আর কোনো জবাব দিল না। আফরা আবার বললো, ‘আচ্ছা কে সে? আমি না হয় কথা বলে দেখি।’
– ‘তাতে বিরক্ত করা হবে। কেউ ভালো না বাসলে তার থেকে দূরে থাকতে হয়। যতই বুঝাতে যাবে, তাতে বি*রক্ত হয়, তাদের ব*দনাম লাগে। এবং শেষে তুমি উলটো আরও বেশি তার কাছে বিরক্তিকর মানুষ হয়ে যাবে। এই নাও চায়ের কাপ। যাও এখন।’
আফরাও আর কথা বাড়াতে চাচ্ছে না। সে চায়ের কাপ নিয়ে রান্না ঘরে রেখে আবার নিজের রুমে চলে গেল৷ নাঈম কাপড় পালটে লুঙ্গি পরে বিছানায় বসে আছে। আফরা যেতেই বললো, ‘কি অবস্থা ওর? কিছু বলেছে?’
আফরা বিছানায় বসে বললো, ‘ওই নবাবজাদি না করে দিছে, বুঝলাম না, অনিককে পছন্দ না করার কি আছে? এখনকার মেয়েরা না এত বেশি ফ্যান্টাসিতে ভুগে। মাটিতে পা ফেলে না৷ কোন বড়লোক জামাই পাইছে, ওমনি শেষ। অনিক তো জব করে, লেখালেখি করে। বাপের সম্পত্তিও আছে। ওর কাছে বিয়ে বসলে তো না খেয়ে ম*রবি না। ভালোই থাকবি। ছেলেটা এত ভালোবাসে। কেমনে পারলো ফিরিয়ে দিতে।’
– ‘তুমি এত অস্থির হচ্ছ কেন, শান্ত হও।’
– ‘ও হ্যাঁ, অনিক তো আমার মোবাইল দিয়ে কল দিয়েছিল৷ ওই নাম্বার চেনো কি-না দেখো তো।’
– ‘কোথাকার মেয়ে আমি চিনবো কি করে।’
– ‘আমার ধারণা তোমাদের আত্মীয়-স্বজনদের কেউ হবে, আর না হয় গ্রামের।’
– ‘আচ্ছা নাম্বার দেখি দাও।’
আফরা মোবাইলে নাম্বার বের করে দিল তাকে। নাঈম অনেকক্ষণ দেখে বললো, ‘না তো চিনি না।’
– ‘তোমার ফোনে ডায়াল করে দেখো। সব নাম্বার দেখেই চিনে ফেলা যায় না-কি।’
নাঈম ওর মোবাইলে নাম্বার তুলে দেখে সেভ নেই। খানিক ভেবে বললো, ‘আচ্ছা তোমার নাম্বার তো ব্লক। আমার এটা দিয়ে না হয় কল দিয়ে তুমি কথা বলে দেখো, জিজ্ঞেস করো কে।’
আফরা খানিক ভেবে বললো, ‘কিন্তু অনিক জানলে যদি রাগ করে? একটু আগে বলেছিলাম যোগাযোগ করিয়ে দিতে। না করল।’
– ‘তাহলে বাদ দাও।’
আফরা পায়চারি করে এসে বললো, ‘আচ্ছা কল দিয়ে দেখি কে, বাড়ি কোথায়।’
– ‘তোমারও না, জানে শান্তি নাই।’
– ‘বেশি কথা না বলে দাও তো মোবাইল।’
নাঈম মোবাইল বাড়িয়ে দিল। আফরা বিছানায় বসে কল দিল। নাঈম কান পেতে আছে মোবাইলের কাছে। দু’বার রিং হতেই ওপাশ থেকে রিসিভ করে বসে রইল কেউ। আফরা বুঝতে পারলো মেয়েটি আগে কথা বলবে না। সে নিজেই সালাম দিল। তারপর ওপাশ থেকে জবাব দিয়ে বললো,
– ‘কে বলছেন?’
– ‘আপনি কে বলছেন?’
– ‘আপনি কার কাছে কল দিয়েছেন জানেন না?’
আফরা মোবাইল একটু দূরে সরিয়ে নাঈমকে ফিসফিস করে বললো, ‘মেয়েটার তো অনেক ঝাল আছে মনে হচ্ছে।’
নাঈম চিন্তিত চেহারায় বললো, ‘আচ্ছা আমার কাছে দাও।’
সে ফোন কানে নিয়ে বললো, ‘আমি নাঈম বলছি, আপনি কে?’
– ‘ও হ্যাঁ, নাঈম ভাই৷ আমি পদ্য।’
নাঈম বিস্মিত হয়ে গেল। কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। সে ইতস্তত করে বললো, ‘ও আচ্ছা, পদ্য রং নাম্বারে তোমার কাছে চলে গেছে। কেমন আছো তোমরা?’
– ‘জি, আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি ভাইয়া। তোমরা ভালো তো?’
– ‘হ্যাঁ, আচ্ছা রাখছি এখন পদ্য।’
নাঈম কল কেটে দিয়ে বিছানায় আসন পেতে বসে হাঁটুতে কনুই ঠেকিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে রইল।
__চলবে…ছন্দহীন পদ্য
.
পর্ব_১৯
.
আফরাও ব্যাপারটা বুঝে ফেলেছে। দীর্ঘ সময় রুমে দু’জন চুপচাপ বসা। নাঈমকে খুবই চিন্তিত দেখা যাচ্ছে। আফরা ওর কাঁধে হাত রেখে বললো, ‘থ মেরে বসে আছো যে? কিছু বলো। পদ্য মানে তো ভোরে যার বিয়ের কথা বলেছিলে সে, তাই না?’
নাঈম শূন্যদৃষ্টিতে বিছানার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘হ্যাঁ, আর এই মেয়ে তার কম হলেও ৩-৪ বছরের বড়ো। সব সময় আপু বলেই তো ডাকতো। অথচ তোমার আদরের দেবর আপুর প্রেমে পড়েছে। ভাবো কত বড়ো ব*দমাইশ।’
ওর কাঁধ খানিক শক্ত করে ধরে আফরা বললো, ‘তুমি এত টেনশন করো না তো প্লিজ। শান্ত হও।’
– ‘টেনশন করবো কেন? সে যার-তার সাথে প্রেম করে ম*রলে কার কি আসে যায়?’
– ‘এভাবে বলো কেন? হয়তো প্রেমে পড়ে গেছে। প্রেম কি আর এত ভেবে-চিন্তে হয় না-কি? আমার এক বান্ধবী হিন্দু একটা ছেলের প্রেমে পড়ে গেল। ক্লাসমেট ছিল।’
– ‘কানের কাছে আজাইরা গল্প করো না তো আফরা।’
– ‘এত রাগছো কেন? সে তো তোমাদের কিছু বলেওনি। তার কষ্ট সে তার একা ভোগ করছে। কিন্তু ছেলেটার জন্য মায়া হয়। ইস কি যে করবে এখন। মেয়েটাও তাকে পছন্দ করে না। একতরফা লাভ। সবদিক থেকে ফেঁসে গেল।’
– ‘পদ্য তাকে পছন্দ করারও কথা না। পদ্য অন্যরকম মেয়ে৷ ছোটবেলা থেকে ওকে চিনি। খুবই ভালো, ভদ্র। ছোট ভাইয়ের মতো একটা ছেলের সাথে প্রেম করার মতো নির্লজ্জ না।’
– ‘কিন্তু অনিক কি এগুলো বুঝে না? ও তো অনেক বুদ্ধিমান। এই প্রেমের ভবিষ্যৎ সে কি জানতো না?’
– ‘বেশি বুদ্ধিমান বা*ল পাকনারাই এভাবে কু*ত্তা ম*রা ম*রে।’
– ‘আশ্চর্য! তুমি এত রে*গে যাচ্ছ কেন? তোমাকে এসে কি সে বলছে আমি ম*রে যাচ্ছি, বাঁচাও। আমাকেও কিছু বলেনি।’
– ‘মেয়ে রাজি না তাই বলেনি। রাজি হলে লাফাইতো বিয়ের জন্য।’
– ‘মেয়ে রাজি হলেও তোমরা মানতে না নিশ্চয়?’
– ‘আজাইরা কথা বলো না। আমি নিজেই কল দিয়েছিলাম। আমি ভেবেছি কোনো মেয়েকে হয়তো পছন্দ করে, দেখি কে, আর মেয়ে রাজি হলে বিয়ে করাতে সমস্যা কী? দরকার হয় তোমাকে দিয়ে মেয়েটিকে বুঝাইতাম।’
– ‘তো এখন বুঝানোর চেষ্টা তো করতে পারি আমরা। অনিকের অবস্থাটা মেয়েটিকে বলি না হয়।’
– ‘মাথা কি ঠিক আছে তোমার? গ্রামের মানুষ হাসাহাসি শুরু করবে। সবাই জানে অনিক ছোট। অনিক ওর কাছে পড়তোও ছোটবেলায়। বুঝতে পারছো ব্যাপারটা? যা বুঝো না, সেটা নিয়ে কম কথা বলবে। এজন্য আব্বা ধমক দিয়েছিল আসলে। আব্বা হয়তো জানে ব্যাপারটা।’
আফরা আর কথা বাড়াতে গেল না। নাঈম সচরাচর এরকম কথা বলে না। আজ মনে হয় প্রচণ্ড রে*গে গেছে। আফরা বিছানা থেকে উঠে সিটিং রুমে গিয়ে দীর্ঘ সময় সোফায় চুপচাপ বসে রইল। কি করবে এখন? ভীষণ কষ্ট হচ্ছে অনিকের জন্য। মেয়েটিকে ভোলা ছাড়া আর কোনো পথই তো খোলা নেই ওর। এভাবে একা একা অন্ধকার রুমে বসে থাকলেও তো কখন কি করবে ঠিক নেই৷ আফরা আবার উঠে গিয়ে নাঈমের পাশে বসে বললো, ‘এই, ইভাকে ঘটনাটা না জানানোই ভালো হবে মনে হয় তাই না?’
নাঈম চিন্তিত হয়ে দুইহাতে নিজের মুখ আঁজলা করে মুছে বললো, ‘ওকে না বলাই ভালো। পদ্যের বিয়ে তো ঠিক হয়েই গেছে। কয়েকদিন পর বিয়ে হয়ে যাবে৷ তখন এমনিতেই দেখবে ইভার দিকে ঝুঁকবে। ব্রেকাপের পর সাথে সাথে আরেকটা মেয়ে পেয়ে গেলে এসব ঢংয়ের প্রেম দেখবে উধাও।
– ‘নাঈম তুমি এভাবে কথা বলে মেজাজ খারাপ করো না তো আমার। তুমিও দেখি অন্যদের মতো। তুমি জানো? যখন দু’জন প্রেম করে, তারা কিন্তু খুবই সিরিয়াস হয়। কি পরিমাণ সিরিয়াস সেটা বুঝতে পারবে ব্রেকাপ হলে কত মানুষ আত্মহ*ত্যা করে, হাত কা*টে এসব খবর রাখলে। কিন্তু তখব কি হয় জানো? একমাত্র প্রেমের বেলায়ই তখন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে, সেটা হলো ওই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে সবাই হাসে। কেউ বলবে ‘ঢং’। কেউ বলবে সামান্য একটা ছেলের জন্য বা সামান্য একটা মেয়ের জন্য এত পাগল হয়ে গেছে। অথচ এই সমাজেরই প্রায় বেশিরভাগ মানুষই একটা বয়সে প্রেম করেছে বা প্রেমে প্রত্যাখ্যান হয়ে কষ্ট পেয়েছে৷ কিন্তু অন্যদেরটা নিয়ে সে ঠিকই হাসাহাসি করবে। এবং আরও আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে অনেক পিতা-মাতা নিজে প্রেম করে পালিয়ে বিয়ে করবে৷ কিন্তু সন্তানের বেলায় খুবই কড়া।’
নাঈম খানিক রূঢ় গলায় বললো, ‘এত লেকচার কেন দিচ্ছ? আমি তো ভালো কথাই বললাম। পদ্যকে তো পাওয়া পসিবল না তার। তাই ইভা ওর সঙ্গে এখন মিশলে ভালো হবে।’
– ‘তা ঠিক। সেটা আমি নিজেই তোমাকে বলতে এসেছি। কিন্তু কথা হলো অন্যের প্রেমকে ঢংয়ের প্রেম বলা ঠিক না। তুমি মনে হয় ভুলে গেছো আমরাও প্রেম করে বিয়ে করেছি। আর অনিক আমাদের সহযোগিতা করেছিল। অনিকের কারণেই আমাকে তোমার মা-বাবা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে।’
– ‘আরে ধু*র, তুমি কোথা থেকে একেকটা কথা খুঁজে খুঁজে বের করতে শুরু করছো? একে তো মেয়েটা বয়সে বড়ো, তার উপর একতরফা ভালোবাসা। কীসের সাথে কি টানছো?
আফরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিছানা থেকে উঠে গেল। নাঈমকে এত রেগে যেতে আজ প্রথম দেখেছে সে। ইভার দরজায় এসে দু’বার নক করতেই কারও সঙ্গে মোবাইলে কথা বলতে বলতে এসে দরজা খুলে দিল সে। আফরা গিয়ে বিছানায় বসলো। ইভা কথা বলা শেষ করে বললো, ‘কোনো সমস্যা আপু? আজ বাসা কেমন অন্যরকম লাগছে যে?’
– ‘তেমন কিছু না। ওদের পারিবারিক কিছু সমস্যা হচ্ছে। অনিক যে বিয়ে-শাদি করে না এগুলো নিয়েই আরকি।’
– ‘হ্যাঁ অনিক ভাইকেও দেখলাম কেমন যেন।’
– ‘সবার বকা খাচ্ছে তো তাই। ওর চাচা-চাচিও ইংল্যান্ড থেকে কল দিয়ে বুঝিয়েছেন। তবুও সে বিয়ে করবে না৷ এগুলোর জন্য নাঈমের আব্বাও বকা দিছেন।’
– ‘ও আচ্ছা।’
– ‘তুই আবার ওকে গিয়ে বলিস না মন খারাপ কেন? এসব জানার চেষ্টা করার দরকার নেই।’
– ‘কি যে বলো আপু। আমি বসে আছি তোমার দেবরের মন খারাপের কারণ জিজ্ঞেস করতে। আমি তো এখন উনার ধারেকাছেও যাই না।’
– ‘যাবি না কেন, তোমরা তো প্রায় সমবয়সি। তাছাড়া তালতো ভাই-বোনের তো এমনিতেই ভালো সম্পর্ক থাকে।’
– ‘কি বললে? তোমার দেবরের সমবয়সী আমি?’
– ‘তা নয় তো কিরে বোকা? ধর তোর বিয়ে হবে, তখন কি তোর থেকে বয়সে কিছু বড়ো ছেলের সঙ্গে হবে না? এরকমই তো হয়। মেয়েরা কয়েক বছরের ছোট হলেও সমবয়সী ধরা যায়।’
– ‘হ্যাঁ, তা অবশ্য ঠিক।’
– ‘চল তো, ওর আজ এমনিতেই মন খারাপ। গিয়ে গল্প-টল্প করি। সবার বকা খেয়েছে ছেলেটা।’
– ‘আহারে দেবরের জন্য কি প্রেম।’
আফরা ফ্যাকাসে মুখে কৃত্রিম হাসি এনে সঙ্গ দিল ওকে। দু’জন গিয়ে নক দিল অনিকের দরজায়। অনিক এসে দরজা খুলে দিল। এখন রুমে বাতি জ্বলছে। সে নিজেই বললো, ‘আসো।’
আফরার কেমন যেন ওর স্বাভাবিক আচরণকে আরও বেশি অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। চোখ দু’টা সিঁদুরের মতো লাল হয়ে আছে। দু’জন গিয়ে বিছানায় বসলো। অনিক দেয়ালে বালিশ ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে বসে বললো, ‘কবিতা পড়ছিলাম। শুনবে তোমরা? পা তুলে আরাম করে বিছানায় বসো। কবিতা পড়ে শুনাই তোমাদের।’
আফরা আসন পেতে বসলো উঠে। ইভা পাশে বসে বললো, ‘কার কবিতা?’
– ‘হেলাল হাফিজের, বইয়ের নাম ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ অদ্ভুত না নামটা?’
– ‘হ্যাঁ অদ্ভুত, জলে তো আগুন নিভে।’
‘কিন্তু উনি আরেকটা জল কোত্থেকে আবিষ্কার করছেন এটায় আগুন জ্বলে’ বলে অনিক অস্বাভাবিকভাবে হেঁসে উঠে আবার থেমে বললো ‘আচ্ছা পড়ি তাহলে।’
আফরা বললো, ‘হ্যাঁ পড়ো।’
অনিক একটা কবিতা বের করে পড়তে শুরু করলো,
“কষ্ট নেবে কষ্ট
হরেক রকম কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট!
লাল কষ্ট নীল কষ্ট কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট
পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট,
আলোর মাঝে কালোর কষ্ট
‘মালটি-কালার’ কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট।
এখানে এসে থামলো অনিক। তারপর পাশ থেকে সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে বললো, ‘বেয়াদবি মাফ করবে কিন্তু ভাবি।’
ইভা ফিক করে হেঁসে বললো, ‘অদ্ভুল লাগছে আজ আপনাকে।’
অনিক সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে বললো,
– ‘তালতো বোন, কবিতাটা সুন্দর না?’
– ‘কিছুই তো বুঝিনি কবিতার।’
– ‘তাই না-কি? আচ্ছা আবার পড়ি তুমি বলবে কি বুঝোনি।’
– ‘আচ্ছা।’
“কষ্ট নেবে কষ্ট
হরেক রকম কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট!
লাল কষ্ট নীল কষ্ট কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট
পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট…’
ইভা থামিয়ে দিয়ে বললো, ‘পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট এটা আবার কি?’
অনিক সিগারেটে টান দিয়ে হেঁসে উঠলো।সেই হাসি দেখলে কান্না বলেই ভ্রম হবে। কান্নার মতো দেখাল হাসিটা। তারপর হাসি বন্ধ করে একেবারে শান্ত গলায় বললো, ‘মাঠের সবুজ ঘাসের উপর ইট রেখে দেখেছো কখনও?’
– ‘না তো।’
– ‘ইট বা পাথর কিছুদিন সবুজ ঘাসের উপর রাখলে সেই ঘাস সাদা হয়ে যায়।’
– ‘মরে সাদা হয়?’
– ‘না, জীবন্ত ঘাস সাদা হয়ে যায়। খুবই কোমল, নরম পিচ্ছিল লাগে তখন।’
– ‘ও আচ্ছা।’
‘এবার বুঝেছো পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট কি জিনিস?’
– ‘কিছুটা।’
আবার সিগারেটে টান দিয়ে চোখবুজে হাসলো অনিক। ইভা আফরার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উলটে ইশারা করছে৷ তার কাছে আজ অনিককে বিকৃত লাগছে। আফরা চুপ থাকতে ইশারা করলো ইভাকে।
অনিক খানিক পর বললো, ‘কবিতা টবিতা এত বুঝা লাগে না ইভা। কিছু বিষয় না বুঝলেও আমাদের ঠিকই মজা লাগে। রবীন্দ্রনাথ এ বিষয়ে কি বলেছেন জানো?’
– ‘কি?’
– ‘কেউ যখন কবিতা পড়ে বলে বুঝলাম না। তখন ভীষণ মুশকিলে পড়তে হয়। কেউ যদি ফুলের ঘ্রাণ শুঁকে বলে এটা কি বুঝলাম না। তখন বলতে হয় এখানে বুঝার কিছুই নাই, এটা কেবল গন্ধ।’
– ‘ও আচ্ছা।’
– ‘তাহলে আবার কবিতাটা শুরু করি।’
ইভা বাঁধা দিয়ে বললো,
– ‘না, দুঃখের কবিতা ভালো লাগছে না।’
অনিক সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে বললো, ‘আচ্ছা ভাবি, একটা ব্যাপার ভেবে দেখেছো মানুষ কত অদ্ভুত?’
আফরা নিঃশব্দে তার কথাবার্তা শুনছিল।প্রশ্ন শুনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘না, ভাবিনি।’
– ‘তুমি দেখবে কেউ প্রেমে ব্যর্থ হলে বিরহের গান শুনে। এবং কেউ কষ্টের গান শুনলে আমরা বলিও ছ্যাঁকা খেয়েছিস না-কি? বলি না?’
আফরার আগে ইভাই বললো, ‘হ্যাঁ বলি।’
– ‘মানুষের এই ব্যাপারটা অদ্ভুত না? ধরো সে প্রেমে ব্যর্থ হলো। তার অনেক কষ্ট। তখন তার কি করার কথা ছিল? যেভাবে মন ভালো হয় তা করার কথা৷ কিন্তু সে তখন কেন উলটো বিরহের গান আরও বেশি শুনে? এর কারণ কি? দুঃখী মানুষরা আরও বেশি দুঃখ পেতে চায় কেন?’
ইভা মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘কি জানি, আপনাকেই তো আজ কেমন যেন লাগছে।’
অনিক আবার হেঁসে উঠলো। আফরা বিরক্ত হয়ে ইভাকে চিমটি দিয়ে বললো, ‘আচ্ছা তুই যা তো। ওর সঙ্গে একটু কথা আছে।’
– ‘আমি চলে যাব?’
– ‘হ্যাঁ।’
ইভা উঠে চলে গেল। অনিক ঠোঁটে সিগারেট নিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। আফরা খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে অবাক গলায় বললো, ‘পদ্যকে তুমি এতো ভালোবাসো অনিক? এতো বেশি? কীভাবে!’
প্রশ্ন শুনে অনিক তাকিয়ে দেখলো আফরার দু’টা চোখ জলে টলমল করছে।
.
পদ্য বিছানায় শুয়ে আছে। বিকেলে ডাক্তার এসেছিল। পেট ব্যথার কথা বলে ভালোই যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছে তার। ডাক্তার এসে কত কি জিজ্ঞেস করলো। সে যখন ইচ্ছা “হ্যাঁ, না” বলেছে। ডাক্তার একপর্যায়ে বললো, ব্যথা তো মনে হয় অ্যাপেন্ডিক্সের। হসপিটাল নিয়ে যান। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখুন কীসের ব্যথা। মনিরা বেগম অস্থির হয়ে গেলেন। মতিন মাস্টার চিন্তিত। পদ্য একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বললো, ‘ডাক্তার ভাই, আমার স্কুল থেকে এসে একটু ব্যথা করেছিল৷ আজই প্রথম। এখন ব্যথা আর নেই। আপনি প্লিজ গ্যাসের ওষুধ দিয়ে বাড়ি থেকে বিদায় হোন।’
এভাবেই একমত ডাক্তারকে বিদায় করেছে৷ সন্ধ্যায় একবার মোবাইলে অনিকের ছবি দেখে আবার কান্না এসে গেল। এত কান্না তার কোনোদিন আসেনি। এত ঘন ঘন কান্নার অভ্যাস হুট করে কীভাবে হলো কে জানে। সেটা দেখে মনিরা বেগম স্বামীকে বললেন, ‘এই, মেয়েটা একবার কাঁদে, আরেকবার স্বাভাবিক৷ উপরি কিছু কি-না বুঝতাছি না। মসজিদের হুজুরকে খবর দাও, দোয়া-দরুদ পড়ে ফুঁ দিয়ে গেলে ভালো হয়।’
মতিন মাস্টার সত্যি সত্যি গিয়ে মসজিদের হুজুর আনলেন। হুজুর পানি পড়া দিলেন। এবং বলে গেলেন স্কুলের পেছনে একটা পুরাতন দোষী গাছ আছে৷ সেখান থেকে কিছু লাগলে লাগতেও পারে। পানি পড়া দিয়েছি। আশাকরি আল্লাহ শেফা দান করবেন।
একটু আগে হুজুর চা-পান খেয়ে বিদায় হয়েছেন। পদ্যের রাগে-দুঃখে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু ঠিক করেছে আর কাঁদবে না৷ কান্না পেলে শব্দ হতে দেবে না। দরকার হয় বিছানা চাদর মুখে ঠেসে ঢুকিয়ে রাখবে। তারপরও কাউকে শুনতে দেবে না। এরা তাকে এখন শুধু হসপিটাল নিয়ে যাওয়া বাকি আছে। সারাটা দিন থেকে বড়ো অসহায় লাগছে। বারবার ভেতর গুলিয়ে কান্না পায়। যা ভাবে তাতেই কান্না আসে। সে এখন বিছানায়ই শুয়ে আছে। পালঙ্কের একপাশে মা-বাবা বসে আছেন। পড়ার টেবিলে মনিসা। কিন্তু সে কিছুই পড়ছে না। গল্প শুনছে। মতিন মাস্টার বললেন, ‘মনিরা তাহলে এটাই বলি ঘটককে?’
– ‘হ্যাঁ তাই বলো, বিয়েতে যেহেতু কোনো খরচ করছি না। তাহলে এই কাজ আগে করা দরকার। নতুন জামাই-বউ এই ঘরে থাকবে না-কি? বিয়ে পিছিয়ে দিলে। উঠানের দক্ষিণে মাটি দিয়ে টিনের ঘর তুলতে কয়দিন আর লাগবে? বিয়ের পর পদ্য জামাইকে নিয়ে সেখানে থাকলো।’
‘হ্যাঁ, ভালো কথাই বলেছো’ তারপর মতিন মাস্টার পদ্যের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মা মোবাইলটা দে তো, ঘটকের সাথে একটু কথা বলি।’
পদ্য মোবাইল বাড়িয়ে দিল।
– ‘আহা নাম্বার বের করে দে মা।’
পদ্য ঘটকের নাম্বার বের করে দিয়ে রাগে-দুঃখে এখান থেকে উঠে অন্য রুমে চলে গেল। মতিন মাস্টার অবাক হয়ে বললেন, ‘কিরে মা? তোর আবার কি হলো?’
মনিরা বেগম স্বামীকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললেন, ‘বিয়ের কথাবার্তা শুনে লজ্জা পাইতেছে হয়তো। তুমিও সবকিছু ওর সামনে বলা শুরু করো।’
__চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম
লেখা: জবরুল ইসলাম