ছন্দহীন পদ্য
.
পর্ব_২৪
.
আফরা আর হাসপাতালে থাকতে পারেনি। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। পদ্যের থেকে বিদায় নিয়ে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামছে। অনিকের জন্য আর কিছুই কী করার রইল না তার? বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে পদ্য বিয়েতে রাজি হয়ে যাবে? অনিকের জন্য বুকভরা অনুরাগ চেপে রেখে অন্য কাউকে কবুল বলে গ্রহণ করে নিবে! মেয়েটির বুকে কী ভীষণ চাপা এক কষ্ট হবে তখন। এই বিশাল, ব্যস্ত পৃথিবীর তাতে কিছুই যাবে আসবে না৷ যার কষ্ট, একান্ত তারই। অন্যদের জন্য সেটা বড়োই তুচ্ছ। এই কষ্ট নিয়েই হাসিমুখে দৈনন্দিন সকল কাজ-কর্ম চালিয়ে যেতে হবে পদ্যের। রাতে সীমাহীন কাম নিয়ে একজন পুরুষ তাকে স্পর্শ করবে। ঠোঁট এনে যখন রাখতে চাইবে ওর ঠোঁটে। তখন অস্বস্তিতে ইচ্ছা করবে সরিয়ে নিতে। কিন্তু সরাতে পারবে না। সাড়া দিতে হবে। ভালো লাগার অভিনয় করতে হবে। এই অভিনয়ই হয়ে যাবে মেয়েটির জীবনের অংশ। না-কি মন থেকে মেনে নিবে একটা সময়? কেউই জানে না সেটা। মানব-মানবীর রহস্যময় এই মনের মতি-গতি বুঝার সাধ্য হয়তো কারও নেই। আফরা চোখ মুছতে মুছতে বাইরে এসে রিকশায় উঠলো। নীল আকাশ। কোলাহলপূর্ণ রাস্তা। রিকশার টুংটাং শব্দ। আফরা চারদিকে মনযোগ দিতে চাচ্ছে। অনিক-পদ্যের বিষাদময় প্রেমের আখ্যান থেকে নিজেকে বের করার ব্যর্থ চেষ্টা। এই কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে চায় সে। যেখানে তার কিছুই করার নেই। তা নিয়ে শুধু শুধু কষ্ট পেয়ে লাভ কী? সবকিছুতেই কেন তার এত বাড়াবাড়ি? ছোটোবেলা থেকেই এই এক যন্ত্রণা। সবকিছুর জন্য বড়ো কষ্ট লাগে। একবার বাড়িতে কো*রবা*নির জন্য কালো কুচকুচে একটা গরু আনা হলো। তখন যে সে খুব ছোটো তাও না। ঈদের দিন ভোরে গরুটার দিকে তাকিয়ে আফরার বড়ো মায়া হলো। এই গরুটাকে খানিক পর জ*বাই করা হবে? র*ক্তে ভেসে যাবে চারপাশ? খুবই কান্না পায় আফরার।
দৌড়ে রুমে গিয়ে দরজা আঁটকে বালিশে মুখ গুঁজে একা একা অনেকক্ষণ কেঁদেছিল। সেবার কেউ জোরাজোরি করে গোসত খাওয়াতে পারেনি তাকে৷ বেশ কিছুদিন গরুটাকে স্বপ্নে দেখেছে। গরু তার সঙ্গে কথা বলছে। মানুষের মতো কাঁদছে। এমনই হয় আফরার। সবকিছু নিয়ে এমন হয়। বাবাও বোঝাতেন। পৃথিবী হচ্ছে দুঃখ-কষ্টের জায়গা মা। জন্মের পর থেকে তা সহ্য করে উঠতে হয়। এটাই নিয়ম। তুমি ভাবো সবারই পিতা-মাতা একদিন মারা যায়। নিজ হাতে গিয়ে কবরে রেখে এসে তাদেরও বেঁচে থাকতে হয়। ভয়ানক কষ্টের ব্যাপার না? কিন্তু মানুষ এসব সহ্য করার ক্ষমতা ক্রমশই অর্জন করে ফেলে। তোমারও করতে হবে। সবার জন্য, সবকিছুর জন্য এতো কষ্ট পেলে দুনিয়ায় চলা মুশকিল মা। দুনিয়া হচ্ছে কঠিন লোকদের৷ যত কোমল হবে। চারপাশে দেখবে শুধু দুঃখ আর দুঃখ। নিজেকে শক্ত করে তুলতে হয়। আফরা আজও পারেনি নিজেকে শক্ত কঠিন হিসাবে তৈরি করতে। পদ্যের জন্য ভীষণ মায়া হচ্ছে৷ মেয়েটা কত অসহায়। এসব ভাবতে ভাবতে রিকশা বাসার সামনে চলে এসেছে। আফরা রিকশা থেকে নেমে গেইট খুলে দেখে অনিক ওর বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। বাঁ হাতের আঙুলের ফাঁকে একটা জলন্ত সিগারেট। ডান হাতের মুঠোয় চাল। বাইরে পাশের বাসার কয়েকটা কবুতর ওড়াউড়ি করছে।
অনিকের সঙ্গে তাদের অনেক ভাব। আফরার দিকে তাকাল। কিন্তু কিছু বললো না অনিক। আফরা দরজার সামনে খানিক সময় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে কলিংবেল চাপলো। অনিক এসে খুলে দিল দরজা।
– ‘কী হয়েছে ভাবি? কোথায় গিয়েছিলে?’
– ‘কোথাও না।’
– ‘তোমার চেহারার অবস্থা এমন কেন? তোমাকেও কেউ ছেড়ে চলে যাচ্ছে না-কি?’
আফরা কোনো জবাব না দিয়ে রুমে চলে গেল। হাত-মুখ ধুয়ে টেবিলে খাবার দিয়ে বেলকনিতে এসে বললো, ‘অনিক খাও এসে।’
– ‘খেতে ইচ্ছা করছে না ভাবি।’
– ‘তুমি কী শুরু করছো বলো তো অনিক? প্রত্যেকবেলা তোমাকে জোরাজোরি করে খাওয়ানোর জন্য আমাকে বেতন দিয়ে রাখোনি। আর অফিসে যাওনি কেন? এভাবে কতদিন চলবে?’
অনিক মুঠোর সকল চাল ছিটিয়ে দিয়ে হাত ঝেড়ে মুচকি হেঁসে বললো, ‘চলো, খেতে চলো।’
খাবার টেবিলে বসে অনিক বললো, ‘আচ্ছা এবার বলো সমস্যা কী? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?’
আফরা মাথা তুলে তাকিয়ে বললো, ‘কেমন?’
– ‘যেমনই দেখাক, স্বাভাবিক না।’
– ‘খেয়ে নাও, তারপর বলছি। বাড়াবাড়ি তো করছিই৷ আর যতটুকু করার বাকি আছে করে ফেলি।’
অনিক আর কোনো কথা বললো না। নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করে উঠে চলে গেল।
আফরা টেবিল গুছিয়ে চা বসালো। অনিকের যখন-তখন চা খাওয়ার অভ্যাস আছে৷ ঘুমানোর আগে, ভাত খাওয়ার পরে। বিয়ের পর এত চা পোকা দেখে মাঝে মাঝে বকাও দিয়েছে আফরা৷ এরপর থেকে অনিক নিজেই জ্বাল দেয়া শুরু করেছিল। সেটাও ছাড়িয়েছে সে। ঘণ্টা খানেক পর চা নিয়ে ওর রুমে গেল সে। অনিকের হাতে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের “দূরবীন” উপন্যাস। পড়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু কোনোভাবেই মনযোগ দিতে পারছে না। আফরা টেবিলে চায়ের কাপ দিয়ে বিছানায় গিয়ে বসে। অনিক বই বন্ধ করে চায়ে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কী বলতে চাইছিলে বলো।’
– ‘কথাগুলো চা খেতে খেতে আয়েশ করে বলার মতো নয়। তবুও বলি।’
– ‘হ্যাঁ বলো, নির্দ্বিধায় বলো।’
আফরা চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, ‘পদ্যের বাবা অসুস্থ। উনি হসপিটাল আছেন।’
– ‘বলো কী? কী অসুখ? কোন হসপিটালে?’
– ‘শান্ত হও। তোমাকে জানানো নিষেধ ছিল। তবুও জানিয়ে দিলাম। কারণ তুমি এমনিতেই জেনে যাবে। আজ রাতে মনিসা আর আন্টি আমাদের বাসায় থাকবেন।’
– ‘তাই না-কি? আর আমাকে জানানো নিষেধ কেন?’
– ‘আগেই বলেছি অস্থির না হতে। ওদেরকে নাঈমই ভর্তি করে দিয়েছে। আমিও গিয়ে দেখে আসলাম।’
– ‘ভালো করেছো, কী অবস্থা এখন?’
– ‘চিকিৎসা চলছে। তুমি শক্ত হও, কিছু কথা বলবো। তোমার অজানা থাকুক আমি চাই না। সব জেনে-বুঝে কষ্ট পাও, তাতেই ভালো।’
– ‘বলো তো, সবকিছু বলো। কি হয়েছে?’
– ‘পদ্যকে তুমি আর পাবে না হয়তো। আমার যতটুকু চেষ্টা করার করেছি। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই।’
অনিক চায়ে চুমুক দিয়ে দীর্ঘ সময় পর বললো, ‘তা তো জানা কথাই। নতুন কী এখানে? পদ্য নিজেই তো ফিরিয়ে দিয়েছে।’
– ‘তুমি এখানেই একটা বিষয় জানো না। আমি সেটা জানিয়ে দিতে চাই। শুনে তুমি হয়তো খুশি হবে৷ কিন্তু কষ্ট বেড়ে আরও কয়েকগুণ হবে হয়তো।’
– ‘এত কাহিনি না করে তুমি বলো তো ভাবি।’
পদ্যও তাকে ভালোবাসে সেটা বলে দিতে ইচ্ছা করছে আফরার। বলতে গিয়েও আঁটকে গেল সে। হঠাৎ মনে হলো জেনে যদি পাগলামি করে? পদ্য এমনিতেই ঝামেলায় আছে। সে চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, ‘তেমন কিছু না, মানে তুমি আর পাবে না পদ্যকে। ওর বিয়ে হয়ে যাবে। এটাই বলতে চাইছিলাম।’
– ‘হায়রে বাবা, এটা তো আমি জানিই। আচ্ছা বাদ দাও। ওরা কোন হসপিটালে আছে?’
– ‘জেনে কী করবে?’
– ‘দেখে আসা দরকার না? পদ্যের সঙ্গে সম্পর্ক ছাড়াও ওরা আমাদের অনেক ঘনিষ্ঠ। নাঈম ভাই শুধু হসপিটালে ভর্তি করে দিলেই হয়ে গেল না-কি। শহরে থাকলে এরকম সবাই করে।
গ্রামের অনেকে আছে রোগীর সঙ্গেই চলে আসে। ছোটাছুটি করে৷ আর আমি এখানে থেকে দেখভাল করবো না? তোমরা বিষয়টা আমার থেকে লুকিয়ে ঠিক করোনি।’
– ‘আমার কিছু করার নেই। তোমাকে যে এখন বলেছি সেটাও অনেক।’
– ‘পদ্যের ব্যাপারটা ভাইয়া যেহেতু জানে, তাহলে আব্বাও নিশ্চয় জানে। আমি কথা বলে নিব। এখন যাই। দেখি ওদের কি অবস্থা। কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি-না। তাছাড়া পদ্য একা একা কী করবে? কোথায় থাকছে, কীভাবে খাচ্ছে কে জানে..।’
আফরা থামিয়ে দিয়ে বললো,
– ‘তোমার অস্থির হওয়া লাগবে না৷ আমরা দেখছি সব।’
– ‘আচ্ছা ঠিকানা বলো আমি গিয়ে দেখি।’
– ‘কিন্তু পদ্যের সাথে কথা বলতে যেও না। ওর বাবা মাইল্ড স্ট্রোক করেছিলেন। বুঝতে পারছো তো? কোনো ঝামেলা করা যাবে না।’
– ‘না না, সেরকম কিছুই হবে না ভাবি। চিন্তা করো না। আমাকে বলো কোন হসপিটাল। রুম নাম্বার কত।’
আফরা তাকে সবকিছু বলতেই। কাপড়-চোপড় পরে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বের হয়ে গেল সে।
.
খাওয়ার পর পদ্য সবকিছু ধুয়ে-মুছে রাখছে। মনিরা বেগম স্বামীর পাশে বসে আছেন। মনিসা পদ্যের মোবাইল হাতে নিয়ে গেইম খেলছিল। এমন সময় দরজায় নক পেয়ে সে উঠে গিয়ে খুলে দিল। পদ্য প্লেটগুলো মেঝেতে রেখে কে আসছে দেখার জন্য মাথা তুলে তাকিয়েই অপ্রস্তুত হয়ে গেল৷ অনিক এসেছে। বিধ্বস্ত চেহারা। উষ্কখুষ্ক চুল। চোখের নিচে কালি।
সালাম দিয়ে এসে পাশের বিছানায় বসার আগে বললো, ‘চাচি স্যারের অসুস্থতার কথা আমি ঘণ্টা দুয়েক আগে মাত্র জেনেছি। জানলে আরও আগেই আসতাম। কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?’
মনিরা বেগম শুরুতে খানিক ইতস্তত করলেও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বললেন, ‘না না, নাঈম বাবাজি সবকিছু দেখছে।’
হাতে দুইটা ব্যাগ। একটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘চাচি হঠাৎ মনে হলো রান্নাবান্নার তো এখানে অসুবিধা হবে। তাই একটা ইলেকট্রনিক কেতলি আনলাম৷ এখানে দুধ, ডিম, চা-পাতা, বাদাম এসবও আছে..।’
‘এতকিছু আনতে গেলে কেন বাবা’ বলে মনিরা বেগম ব্যাগ দু’টা নিলেন।
পদ্য পালঙ্কের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। মনিসার সঙ্গে টুকটাক কথা বললো অনিক। আর কী করবে বা বলবে বুঝতে পারছে না। কেমন অস্বস্তি লাগছে। খানিক পর বললো, ‘আন্টি যেকোনো দরকার হলে বলবেন। আর আমি এখানে আসার আগে কথা বলেছিলাম। ওরা বললো অনেকদিন থাকা লাগবে আপনাদের। তবে যাদের শহরে বাসা আছে৷ তারা বাসায় থেকেই ডাক্তারের ডেট মতো আসতে পারে। আমাদের গ্রাম থেকে এসে এগুলো সম্ভব না।’
– ‘হ্যাঁ বাবা, গ্রাম থেকে আসা-যাওয়া তো সমস্যা।’
অনিক ক্ষীণ সময় চুপচাপ থেকে বললো, ‘আচ্ছা এখন যাচ্ছি চাচি৷ পরে আসবো। আর যেকোনো দরকার হলে জানাবেন।’ বলে সে বাইরে গেল৷ মনিরা বেগম দরজা লাগিয়ে বললেন, ‘দেখো কেমন ভালো মানুষের মতো কথা বলে, আর ভেতরে শ*য়তান ভরা। ছেলের মতো দেখতাম এই ছেলেরে। আর আজ ওর কারণেই আমাদের এই অবস্থা…।’
পদ্য এগিয়ে এসে মায়ের হাত ধরে বললো, ‘আম্মা প্লিজ হসপিটালে আর এসব নিয়ে কথা বলো না। আব্বা এগুলো শুনে আরও চিন্তা করবে। আমি তো বললামই, আব্বা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলে। তোমরা যে ছেলেকে বলবে, তাকেই বিয়ে করবো। এগুলো এখন বাদ দাও৷’
মনিরা বেগম এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আবার বিছানায় উঠে স্বামীর পাশে বসলেন।
আফরা দরজা খুলে দেখে অনিক। সে ভেতরে এসে সিটিং রুমের সোফায় বসে বললো, ‘ভাবি, হসপিটাল থেকে ফিরতে ফিরতে ভাবলাম আমি বাড়িতে চলে যাব।’
– ‘তাই না-কি? কেন?’
সে গ্লাসে পানি ঢেলে এক চুমুক খেয়ে বললো, ‘ওদের হসপিটালে থেকে চিকিৎসা করাতে গিয়ে অনেক টাকা খরচ হবে। আমাদের বাসায় নিয়ে আসো৷ এখান থেকে যখন দরকার যাবে। হসপিটালে লিফট আছে, হুইলচেয়ার আছে৷ আনা-নেওয়ার সমস্যা হবে না। টাকা খরচ কম হবে। খাওয়া-দাওয়ার খরচও বাঁচবে। তোমরা মনে করবে বসায় মেহমান এসেছে।’
– ‘তা তো ভালো কথাই বলেছো। তোমার বাপ-ভাই মানবে বলে তো মনে হয় না।’
– ‘আমি আব্বাকে কল দিচ্ছি দাঁড়াও। আব্বা আসলে আমার ব্যাপারটা জানে, তাই না?’
– ‘হ্যাঁ উনি জানেন। তোমার কারণেই পদ্যকে এখানে আনতে চাইছেন না।’
‘পদ্যও ঘ্যাড়ত্যাড়া, আমি থাকলে আসবে না। বাপের কিছু টাকা জমানো আছে মনে হয়। সেগুলো হসপিটালেই দিয়ে যাবে। আর আজ তো দেখলাম। একেবারে চোখ-মুখ শুকিয়ে গেছে। আর কারও কী বাপের অসুখ হয় না? এত মিলিয়ে যাচ্ছে কেন!’
আফরা মুচকি হাসে৷ ছেলেটা জানে না এই শুকিয়ে যাওয়ার পেছনে শুধু বাবার অসুস্থতা নয়। অনিক ততক্ষণে মোবাইল বের করে কল দিয়েছে। ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই সে সালাম দিয়ে বললো,
– ‘আব্বা আমি বাড়িতে আসবো আজ।’
– ‘ও তাই না-কি, তাহলে আসো।’
– ‘আব্বা হসপিটাল গিয়েছিলাম। স্যারের তো অনেকদিন থাকা লাগবে এখানে।’
– ‘হ্যাঁ তা তো লাগবেই।’
– ‘আমাদের বাসা কাছে থাকতে ওরা হসপিটাল থেকে টাকা নষ্ট করবে কেন আব্বা। স্যার তো সারাজীবন তোমার পক্ষেই কাজ করেছেন। স্কুলের মাস্টার হয়ে দেখতাম তোমার পক্ষে ভোট চাইতেন। লোকে নানান কথা বলতো এসব নিয়ে।’
– ‘হ্যাঁ, তা তো ঠিক। এর কারণেই তো নাঈমকে বলেছি সবকিছু দেখতে।’
– ‘ওদেরকে বাসায়ই থাকতে দিন। আমি গ্রামে চলে আসছি৷’
– ‘আচ্ছা দেখছি, নাঈমের সঙ্গে কথা বলবো।’
– ‘আচ্ছা আব্বা, আমি বের হচ্ছি একটু পর।’
– ‘ওকে ঠিক আছে।’
আফরা মুচকি হেঁসে বললো, ‘তোমার শরম-লজ্জা নেই?’
– ‘কীসের শরম?’
– ‘তুমি যে বারবার বলছো আমি গ্রামে চলে আসছি। আবার বলছো ওদের বাসায় থাকতে দিতে তার মানে কী? এর মানে তুমি জানো ওরা তোমার জন্য বাসায় আসতে দেবে না।’
– ‘আচ্ছা এগুলো বাদ দাও, আমি আজই চলে যাই। তুমি একটু পর পদ্যকে কল দিয়ে বলবে আমি চলে গেছি। তাহলে মনিসা আর সে আজ রাতে এখানে এসে থাকলে সমস্যা নেই। যে কয়দিন হসপিটাল ওরা আছে। এভাবে আসা যাওয়া করতে পারবে। আর দু-একদিন পর বাসায় নিয়ে এসো। তোমার একটু কষ্ট হবে আরকি।’
– ‘জি আচ্ছা, তোমার পদ্যের জন্য এটুকু আমি করবো।’
অনিক লজ্জা পেয়ে বললো,
– ‘আমার পদ্যের জন্য না ভাবি। আমার ব্যাপারটা সামনে না আসলে আব্বা নিজেই এসব করতো। আমাদের দুই পরিবারের অনেক ভালো ঘনিষ্ঠতা ছিল।’
– ‘ঠিক আছে আর বুঝাতে হবে না।’
– ‘তুমি কল দিয়ে দাও। চাইলে তো ওরা দিনেও এখানে আসতে পারবে।’
– ‘আচ্ছা দিচ্ছি।’
.
___চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলামছন্দহীন পদ্য
.
পর্ব_২৫
.
নাঈম ভীষণ ক্লান্ত। অফিস শেষে হসপিটালে না গিয়ে সোজা বাসায় চলে এলো সে। আর ভালো লাগছে না তার। দুপুরে একবার আফরা কল দিয়ে প্রায় কান্নাকাটি করেছে। পদ্যও অনিককে ভালোবাসে৷ ওর পরিবারকে জানিয়েছে কথাটা। তাতেই না-কি ওর বাবার আজ এই অবস্থা৷ মেয়েটা কী বিপদে পড়েছে ভাবো? এখন পরিবারের পছন্দের ছেলেকে তার বিয়ে করতে হবে।
সবকিছু ধৈর্য ধরে শুনেছে নাঈম। শুনতে হয় বলে শোনা। সন্ধ্যার আগে বাবা কল দিলেন। অনিক না-কি গ্রামে চলে গেছে৷ এখন পদ্যদের হাসপাতাল থেকে বাসায় নিতে হবে। ভালো এক যন্ত্রণায় পড়া গেছে৷ সে ঝামেলা একদম পছন্দ করে না। অফিস থেকে বাসা, তারপর নাটক-টাটক কিছু একটা দেখে অবসর সময় কাটিয়ে দেয়৷ এটাই তার জীবন। ক্লান্ত অবস্থায় কলিংবেল চাপলো এসে। আফরা দরজা খুলে দিয়ে বললো, ‘এ কী? একা চলে এলে যে, ওদের একেবারে নিয়ে আসলেই পারতে।’
নাঈম ভেতরে এসে বললো, ‘তুমি পারবে না গিয়ে আনতে? না হয় আমি একটু পরে যাব।’
– ‘আচ্ছা আমিই গিয়ে আনবো৷ তোমাকে অনেক ক্লান্ত লাগছে। যাও ফ্রেশ হয়ে এসো, চা দেই?’
– ‘না বাদ দাও, তুমি বরং ওদের আনতে চলে যাও। ওরা এলে একসাথে খাওয়া যাবে।’
– ‘যদি আন্টি থাকেন ওখানে। তাহলে তো পদ্য আসবে। এখন এলে তো তোমার সমস্যা নেই? সমস্যা যে ছিল, সে তো চলে গেছে।
নাঈম শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে হেঁসে ফেললো,
– ‘আচ্ছা আমাকে খোঁচাচ্ছ কেন বলো তো? এখানে আমার আবার সমস্যার কী আছে?’
– ‘তুমি আর আব্বাই তো চেষ্টা না করে উলটো বিরোধিতা করছো।’
– ‘তুমি আসলে বোকা। অন্য ফ্যামিলি হলে এই ব্যাপারে আরও বেশি ঝামেলা করতো। আমরা তবুও তো কিছুটা উদার।’
– ‘ও আচ্ছা, তোমরা উদার? উদারের কী করেছো শুনি?’
– ‘এই যে তুমি বাড়াবাড়ি করো আমি কী বাঁধা দেই বলো?’
– ‘তারমানে কী বলতে চাইছো? আমি বাঁধা দেয়ার মতো কাজ করছি?’
– ‘সেরকম বলিনি।’
– ‘সেরকমই তো বললে তুমি। আমার কী এখানে। আমি তোমাদের এসবে আর নাই। বাড়াবাড়ি যখন করি। আমি আর এসব নিয়ে কথাই বলবো না। আর তোমার পাড়া-পড়শী হাসপাতাল। এরা আমার কেউ না। আমি এই রাত-বিরেতে এদের আনতেও যাব না।’
– ‘যাহ বাবা, এখন আরেকটা ঝামেলা তৈরি হলো দেখছি। যাও তো প্লিজ, গিয়ে নিয়ে আসো। আর না হয় আমিই যাচ্ছি।’
আফরা গাল ফুলিয়ে সোফায় বসে রইল। লুঙ্গি হাতে নিয়ে এসে নাঈম পাশে বসে বললো, ‘তুমি গেলে লুঙ্গি পরবো৷ না হলে আবার শার্ট পরে বের হতে হবে।’
আফরা কোনো জবাব দিল না। নাঈম পুনরায় বললো, ‘কেন এমন করছো বলো তো? অফিস শেষে বাসায় ফিরে কয়েকদিন থেকে শান্তি পাচ্ছি না’
– ‘কেন আমি অশান্তির কী করি?’
– ‘এই যে অকারণ রাগারাগি করো। সারাক্ষণ অনিকের ব্যাপারটা নিয়ে পড়ে থাকো। এগুলো ভালো লাগে?’
– ‘তুমি আসলে একটা স্বার্থপর।’
– ‘ভালো যন্ত্রণায় পড়লাম। আমার আসলে কী করার আছে তুমি বলো? আব্বা-আম্মা আছেন। তাছাড়া এতদিন জানতাম পদ্য পছন্দ করে না অনিককে। যখন জানলাম করে, তখন ভাবলাম আচ্ছা তাহলে স্যারের সঙ্গে কথা বলা যাবে। আব্বাকেও বলবো। এখন আবার শুনি পদ্য ফ্যামিলিকে বলে দিয়েছিল। তাই ওর বাবা মাইল্ড স্ট্রোক করেছেন। এখন উনার কথা না শুনলে প্রব্লেম হতে পারে। এই অবস্থায় আর কী করার আছে?’
– ‘সাধু সাজবে না। পদ্য ওর পরিবারকে জানানোর পর যদি ওরা রাজি হয়ে যেত। তখন তোমরা ঠিকই রাজি হতে না।’
– ‘কে বলেছে তোমায়? আমি ঠিকই রাজি হতাম। আব্বাকেও রাজি করিয়ে ছাড়তাম।’
– ‘আজাইরা চাপা মা*রবে না। ব্যাটা মানুষদের কাজই হলো বউয়ের কাছে চাপা মা*রা। তোমার পরিবার আমাদেরই তো মানতে চাইছিল না, আর ওদের তো বয়স ফ্যাক্ট আছে।’
– ‘আমাদের তো ম্যাডাম পালিয়ে বিয়ে, তাই রাগারাগি করেছে। তোমার পরিবার মানলে আনুষ্ঠানিক বিয়েতে আপত্তি করতো না। আর আসল কথা হলো পদ্যের ফ্যামিলি মানলে কেউই আঁটকে রাখতে পারতো না। অনিক ঠিকই বিয়ে করে নিত। ওকে চেনো না তুমি।’
– ‘পদ্যের বাবাও এরকম বিয়ে দিতে চাইতো না হয়তো। ওরা চাইবে অনিকের পরিবারও রাজি থাকুক।’
– ‘আচ্ছা এসব বাদ দাও। এরকম তো হয়নি। হলে আমি রাজি থাকতাম। অন্যেরটা জানি না। এবার আমাকে মাফ করা হোক। আমি যু*দ্ধ চাই না, শান্তি চাই।’
– ‘বেশি শান্তিপ্রিয় মানুষই স্বার্থপর হয়।’
– ‘এবার কিন্তু রাগ উঠে যাচ্ছে।’
আফরা হেঁসে ওর গলা টিপে ধরে বললো, ‘রাগ উঠলে কী করবে? মা*রবে? মা*রবে আমাকে?’
– ‘মা*রলে তো আরও অশান্তি শুরু হবে। বাড়ি থেকে চলে যাবে। আর থাকলেও বাসায় গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে। তখন ব*ম মে*রেও মুখ থেকে কথা বের করা যাবে না।’
– ‘ও তার মানে মা*রার ইচ্ছা আছে।’
নাঈম গলা থেকে হাত ছাড়িয়ে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘তুমি খুঁজে খুঁজে ঝগড়ার ইস্যু বের করো না প্লিজ। এমনিতেই ভালো লাগছে না আজ।’
– ‘কেন?’
– ‘কেমন একটা ঝামেলায় আছি না? অফিস, তারপর অনিক, এদিকে ওদের হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে ছোটাছুটি। তাছাড়া অফিসে কিছু ঝামেলাও আছে।’
– ‘অফিসে কীসের ঝামেলা?’
– ‘বাদ দাও, এখন যাও ওদের নিয়ে আসো।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে’ বলে আফরা রেডি হয়ে একজনের খাবার নিয়ে বের হয়ে গেল৷ ওদের রুমের দরজা ভেজানোই ছিল। সে নক দিয়ে ভেতরে গেল। মনিরা বেগম বললেন, ‘হায় আল্লাহ, বউমা কষ্ট করে রাতে আসতে গেলে কেন?’
– ‘নাঈম সবে অফিস থেকে এসেছে তো। অনিকও গ্রামে৷ তাই নিজেই চলে এলাম।’
– ‘অনিক বাবা গ্রামে চইলা গেছে না-কি?’
– ‘হ্যাঁ আন্টি, আর এখানে খাবার আছে। আগের টিফিন দিয়ে দেন। আর আঙ্কেলের সাথে কে থাকবেন। একজন থেকে আমার সাথে দু’জন চলে আসুন।’
মনিরা বেগম স্বামীকে রেখে যেতে চাইলেন না। অনিক নেই যেহেতু তিনি পদ্যকে বললেন, ‘তোমরা দুইবোন চইলা যাও।’
পদ্য আমতা-আমতা করে বললো, ‘আম্মা তুমি চলে যাও। এখানে একা একা তোমার অসুবিধা হবে।’
– ‘না, এখানে আর কীসের অসুবিধা৷ কোনো অসুবিধা হইলে ডিউটি ডাক্তার তো আছেই।’
আফরা বললো, ‘হ্যাঁ, এখানে কোনো অসুবিধা হবে না। তোমরা চলে আসো। ভোরে এসে না হয় আন্টিকে পাঠিয়ে দিবে বাসায়৷ হাসপাতালে সারাক্ষণ ভালো লাগবে না।’
– ‘না না বউমা। পদ্যের বাপকে এখানে রাইখা আমি কোথাও যাব না।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে। ওরা দু’জন চলে গেলে তো ঘুমানোর সীটও খালি পাবেন। চলো পদ্য।’
পদ্য চুল খোপা বেঁধে নিল। অতিরিক্ত কোনো কাপড় আনতেও মাথায় আসেনি। পরনের সেলোয়ার-কামিজ নিয়েই বেরিয়ে পড়েছে। মনিসা আর পদ্য রেডি হয়ে ভোরের টিফিনও হাতে নিল। আফরা বের হতে গিয়েও পুনরায় ফিরে এসে বললো, ‘আর হ্যাঁ, অনিক বললো আপনারা বাসায় থেকেও চিকিৎসা নিতে পারবেন। আরও দু-একদিন পর নাঈম কথা বলে বাসায় নিয়ে যাবে আপনাদের।’
মনিরা বেগম মাথা নাড়লেন। তারা বের হয়ে এলো রাস্তায়৷ একটা রিকশায় তিনজন অসুবিধা হওয়ায় সিএনজি নিয়ে আসতে হলো। নাঈম শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছে৷ পদ্য ঢুকতে গিয়েও সরে গেল৷ কেমন অস্বস্তি লাগছে। নাঈম ভাই নিশ্চয় সবকিছু জেনে গেছে। সে সিটিং রুমের সোফায় গিয়ে বসলো। নাঈম ডেকে নিল মনিসাকে৷ দু’জন বসে এটা-ওটা নিয়ে কথা বলছে। আফরা ফিরে এসে পদ্যের পাশে বসে বললো, ‘কী হলো?’
– ‘নাঈম ভাই সবকিছু জানেন তাই না?’
– ‘তা তো ওর বাবাও জানেন।’
– ‘সেটা না, আমিও পছন্দ করি সেটাও নিশ্চয় বলে দিয়েছেন।’
আফরা মুচকি হেঁসে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘হ্যাঁ, তবে আসল মানুষটাকে বলিনি।’
– ‘ও হুট করে গ্রামে চলে গেল কেন?’
– ‘দুপুরে এসে ওর বাবাকে কল দিয়ে বললো তোমাদের বাসায় আনাতে। সে গ্রামে চলে যাবে।’
– ‘এগুলো কেন করছে ভাবি? অকারণ আমার কষ্টের বোঝা বাড়ানো৷ ওর জন্য তো কিছুই করার নেই আমার।’
– ‘অনিক যাওয়ার পর ওর রুম পরিষ্কার করিনি। ওর উশৃংখল রুমটা দেখবে আসো।’
– ‘রুম আবার উশৃংখল হয় না-কি?’
আফরা মুচকি হেঁসে বললো, ‘আসো না, দেখো এসে।’
পদ্য পিছু পিছু গেল। দরজা খুলেই আফরা নাক-মুখ কুঁচকে বললো, ‘সারাদিন দরজা জানালা বন্ধ করে থাকে। বন্ধ ঘরের ভ্যাপসা গন্ধ হয়ে গেছে রুমে।’
পদ্যকে নাক-মুখ কুঁচকাতে দেখা গেল না। সে ধীরে ধীরে রুমে প্রবেশ করলো। নাঈম তখন ডাক দিল, ‘আফরা এদিকে আসো একটু, কই তুমি?’
আফরা পদ্যকে রেখে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে চলে গেল। পদ্য বাতি জ্বালিয়ে চারদিকে মন্ত্র-মুগ্ধের মতো তাকাচ্ছে৷ সে একা অনিকের রুমে এটা ভাবতেই গা কেমন কাঁটা দিয়ে উঠলো। মেঝেতে সিগারেটের টুকরোগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। টেবিলের চেয়ারে উলটো হয়ে ঝুলে আছে একটা প্যান্ট। এলোমেলো বিছানা, কোলবালিশ মাঝখানে পড়ে আছে। মাথার বালিশের পাশে খোলা বই। এই এলোমেলো রুমটাকেও পদ্যের কেমন ভীষণ আপন লাগছে। সবকিছু ইচ্ছা করছে গায়ে মাখিয়ে নিতে। পদ্য ধীরে ধীরে গিয়ে বিছানায় বসে। কোলবালিশটা হাতে নিয়ে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে চোখবুজে থাকে খানিকক্ষণ। পুরো শরীরে কেমন অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। ইস এই বালিশটাকেই তো অনিক জড়িয়ে ধরে ঘুমায়। পদ্য মাথা বিছানায় গা হেলিয়ে দিল। কোলবালিশটা শক্ত করে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে খানিকক্ষণ চোখবন্ধ করে শুয়ে রইল। তারপর বিছানা থেকে গেল আলনার দিকে৷ নেভি ব্লু একটা গেঞ্জি উলটো হয়ে ঝুলে আছে। হাতে নিয়ে মুখে চেপে ধরলো সে। এই গন্ধগুলো এত আপন লাগছে কেন? অনিক বুঝি এই কারণেই ছোটবেলায় তার কাপড় পেলেই নাকে চেপে ধরতো? পদ্যের আবার বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা হয়। মানুষটাকে আর আপন করে পাবে না সে। এরকম একটা একলা রুমে, একান্তভাবে ওর সঙ্গে থাকা যাবে না। ওর স্পর্শ পেয়ে এই জন্মটাকে স্বার্থক করা যাবে না। পদ্যের চোখদুটো ছলছল করে উঠলো। তখনই আবার ভেজানো দরজা আর্তনাদ করে খুলে গেল। সে অন্যদিকে ফিরে চোখ মুছে নিল। আফরা কাছে এসে কাঁধ ধরে টেনে ওর দিকে ফিরিয়ে বললো, ‘তুমি একা একা কাঁদো অনেক তাই না?’
পদ্য ফ্যাকাশে মুখে হেঁসে বললো, ‘কেন?’
– ‘আমারই কান্না পায় তোমাদের কষ্ট দেখে। একটা ডায়েরি ওইদিন পড়েছিলাম অনিকের। তোমাকে কত ভালোবাসে ছেলেটা।’
– ‘কোথায় ডায়েরি?’
আফরা টেবিল, বিছানার নিচ সহ সবকিছু দেখে বললো, ‘মনে হয় তালা মে*রে রেখেছে ওয়ার্ডরোবে। চাবি কোথায় জানি না।’
– ‘ও আচ্ছা, ডায়েরিটা কী নীল?’
– ‘হ্যাঁ, তুমি জানলে কীভাবে?’
– ‘অনেক পুরাতন ডায়েরি এটা। এটা পড়েই জেনেছিলাম সবকিছু।’
– ‘ও বুঝেছি, আচ্ছা যাও, তুমি সিটিং রুমে গিয়ে বসো। আমি ওর রুম গুছিয়ে রেখে আসছি।’
পদ্য চারদিকে তাকিয়ে মনে হলো এই অগোছালো রুমে এখনও অনিক মিশে আছে। এলোমেলো কাপড়গুলো অনিকের নিজ হাতে রাখা৷ মেঝেতে সিগারেটের টুকরো অনিকই খেয়ে ফেলেছে। একবার সবকিছু গুছানো হয়ে গেলে এই রুমে এসে আর অনিককে পাবে না সে। আফরার হাত ধরে বললো, ‘ভাবি থাকুক যেরকম আছে। সে আসার আগেরদিন পরিষ্কার করে নিবেন না হয়।’
– ‘কেন?’
– ‘এমনিই।’
– ‘আহা অগোছালো রুমের প্রতি মায়া পড়ে গেছে বুঝি?’
পদ্য লজ্জা পেয়ে মাথা নীচু করে ফেললো। আফরা ওর থুতনি ধরে মুখ তুলে ধরে বললো, ‘তুমি চাইলে এই রুমে থাকতেও পারো। তারপর অনিক এসে যখন জানবে তুমি থেকেছিলে। সেও বলবে ভাবি এই রুম যেরকম আছে সেরকম থাকুক। কোনোদিন ঝাড়ু-টারু দিয়ো না। আজীবন এরকম থাকবে।’
পদ্য ফিক করে হেঁসে ফেললো। আফরা তারপর সিরিয়াস চেহারায় বললো, ‘সত্যিই থাকতে পারো এখানে। সমস্যা নেই। আমি মনিসার কাছে থাকবো।’
‘কি যে বলো ভাবি, চলো তো যাই।’
দু’জন দরজা লাগিয়ে বাইরে এলো। মনিসাকে নাঈম গ্রামের নানান বিষয় জিজ্ঞেস করছে৷ দু’জন মেতে উঠেছে গল্পে। আফরা গিয়ে ডেকে নিল মনিসাকে। দু’জনকে খুলে দিল ইভার রুম। তারপর বললো, ‘তোমরা চাইলে আমার কাপড় পরতে পারবে, দেই এনে?’
মনিসা বিছানায় বসে বললো, ‘আপনার কামিজ আমার পরনে তো বোরখা হয়ে যাবে।’
আফরা হেঁসে বললো, ‘তাও ঠিক। তবে পদ্যের লাগবে।’
পদ্য আমতা-আমতা করে বললো, ‘আজ থাক ভাবি। কাল দিলে হবে।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে, তোমরা হাত-মুখ ধুয়ে নাও। আমি ভাত দিচ্ছি।’
রাতের খাওয়ার শেষে ওরা দু’জন রুমে চলে গেছে। আফরা রান্নাঘরের কাজ শেষ করে রুমে গিয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে অনিক বেশ কয়েকটা কল দিয়েছে। মোবাইল হাতে নিয়ে সিটিং রুমে এসে কল ব্যাক করলো সে। একবার রিং হতেই অনিক ওপাশ থেকে রিসিভ করলো।
– ‘হ্যালো ভাবি।’
– ‘হ্যাঁ অনিক, কী খবর? বাড়িতে গিয়ে আর কল দাওনি যে।’
– ‘হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিয়েছিলাম।’
– ‘ডাটা অফ ছিল, খেয়াল করিনি।’
– ‘ওরা এসেছে?’
– ‘ওরা বলতে হবে না। যার কথা জানতে চাচ্ছ সে এসেছে। তুমি যেরকম রুম ফেলে গিয়েছিলে। সেই অবস্থায় তোমার রুমে নিয়ে নাজেহাল অবস্থাটাও পদ্যকে দেখিয়ে দিয়েছি।
– ‘এটা কী করলে ভাবি। তুমি শ*ত্রু না বন্ধু?’
– ‘শ*ত্রু হতে যাব কেন?’
– ‘এমনিতেই তো পছন্দ করে না। অপছন্দের পরিমাণটা আরেকটু বাড়িয়ে না দিলেও পারতে।’
– ‘অপছন্দ করে কীভাবে বুঝলে?’
– ‘পছন্দ করলে এরকম হতো?’
– ‘কাউকে পছন্দ না করার মানে কী অপছন্দ করা?’
– ‘না, কাউকে পছন্দ না করার মানেই অপছন্দ করা নয়। তবে শেষের দিন ওর কথাবার্তা থেকে তাইই মনে হয়েছিল।’
আফরা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো। অনিক পুনরায় বললো,
– ‘ওর সঙ্গে আর কে এসেছে?’
– ‘মনিসা।’
– ‘ও আচ্ছা।’
– ‘তুমি কোথায় এখন?’
– ‘ছাদে, তোমাকে মিস করছিলাম তাই কল দিলাম।’
– ‘ও আচ্ছা তাই? ছাদে গিয়ে আমাকে মিস করছিলে বুঝি? ছাদ থেকে সোজা কার বাড়িটা দেখা যায়? আমার না-কি পদ্যের?’
অনিক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
– ‘আহা তুমি এই ব্যাপারগুলো ভালো বুঝতে পারো। সত্যিই গ্রামে এসে নস্টালজিক হয়ে যাচ্ছি। কত স্মৃতি চারদিকে। পদ্যের হয়তো এসব মনে নাই।’
আফরা আবার চুপ হয়ে যায়। অনিক পদ্যের ব্যাপারে কিছুই জানে না। তারও কিছু করারও নেই। খানিক পর বললো,
– ‘ওকে দেখবে অনিক?’
– ‘দেখাও।’
– ‘কিন্তু দেখাবো কীভাবে? ওরা দরজা ভেজিয়ে বাতি অফ করে শুয়ে আছে। গেলে তো জেগে যাবে।’
অনিক খানিক ভেবে বললো, ‘রুম তো অন্ধকার তাই না?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘তুমি ভিডিয়ো অন করে ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে যাও। যেহেতু রুম অন্ধকার। ওরা জেগে গেলেও ভাববে মোবাইলের বাতি জ্বালিয়েছো।’
– ‘ওরা বলবে রুমের বাতি জ্বালাও।’
– ‘তুমি তখন জ্বালাবে। এর ভেতরে তো ভিডিয়ো হয়ে গেল।’
– ‘তবুও দেখতেই হবে?’
– ‘আমি বলছি না-কি? তুমি নিজেই বললে দেখবো কি-না৷ আমি জাস্ট বুদ্ধি দিলাম।’
– ‘কিন্তু এটা কী ঠিক হবে? লুকিয়ে ভিডিয়ো করে দেওয়া।’
‘আমি বলছি না-কি দিতে। তোমার ইচ্ছা হলে দাও না দিলে নাই’ বলেই অনিক কল কেটে দিল। চাঁদনি রাত। ছাদের রেলিঙে কনুই ঠেকিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে নিল। এখান থেকে পদ্যের বাড়ি, উঠান, পুকুর, রাস্তা সবকিছু দেখা যাচ্ছে। এই ছাদে মাদুরে বিছিয়ে তারা গল্প রেকর্ড করতো। পদ্যের কালো চুলগুলো কখনও খোলা আবার কখনও খোঁপা বাঁধা। খোলা থাকলেই সে খুশি হত ভীষণ। পড়ার সময় সে বুঁদ হয়ে তাকিয়ে থাকতো ওর দিকে। খোলা চুলে কী যে মায়াবী লাগতো। ওর কথা-বার্তা, চাল-চলন সবকিছু কেমন যেন শৈল্পিক, কাব্যিক ছিল। কথা বললে তার ইচ্ছা করতো হাত বাড়িয়ে ঠোঁট ছুঁয়ে দেখতে। ওর চোখের দিকে চোখ পড়লে হিপনোটাইজ হয়ে যেত। হাতটা বিদ্রোহ করতো ওর মুখটা ধরার জন্য। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ টিউন বাজতেই অনিক সিন করলো। ভাবি ভিডিয়ো পাঠিয়েছে। সিগারেট দূরে ছুড়ে ফেললো সে। রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ক্লিক করলো ভিডিয়োতে। দেখলো আফরা দরজা খুলতে “খ্যাক” করে শব্দ করলো। এরপর অন্ধকার রুম আলোকিত করে বাতি বিছানার দিকে গেল৷
পদ্য তাড়াতাড়ি উঠে বসে আকাশি কালার ওড়না ঠিক করে বললো, ‘কে?’
– ‘তোমরা ঘুমিয়ে গেছো না-কি? আমি আরও আসলাম গল্প করতে।’
– ‘না ঘুমাইনি। বাতি জ্বালাও ভাবি।’
ভিডিয়ো এটুকুই। কিন্তু অনিক বারবার একই ভিডিয়ো খুব মনযোগ দিয়ে দেখতে শুরু করলো।
_চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম